#জোয়ার_ভাটা
#পর্ব-২২
#সুরাইয়া_সাত্তার_ঊর্মি
” পৃথিবীতে একই রকম মানুষ দেখতে সাত জন হয়। তুই এত কেন ভাবছিস?”
শীপ্রা জুসের গ্লাসে একটু চুমুক দিয়ে তাকালো মার্জানের অশান্ত মুখের দিকে। মার্জান বলল,
” আমি জানি না, কিন্তু ওঁকে দেখার পর বড্ড উথাল পাথাল হচ্ছে মনে।”
শীপ্রা ওঁর হাতের উপর হাত রাখলো,
” তুই বেশি ভাবছিস?”
মার্জান দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো,
” তোর কথা সত্যি হোক শীপ্রা। বাই দ্যা ওয়ে তোকে ছেড়ে দিলো তায়ান শাহ্?”
শীপ্রা ম্লান হাসলো,
” ওঁ আমাকে মরার আগ পর্যন্ত মনে হয় না ছাড়বে, তবে হ্যাঁ কয়েদিনের শান্তি অবশ্যই পেয়েছি। ”
ফিচেল হেসে আবার বলে উঠলো,
” বাদ দে আমার কথা, তোর কথা বল। তোদের শো তো সুপার ডুপার হিট হচ্ছে। শুনেছি নমনেটেড হয়েছিস তুই? ”
মার্জান এতক্ষণে হাসলো একটু,
” সায়ান স্যার তো তাই বললেন!”
ওঁদের কথার মাঝেই ওয়েটার এসে পাশে দাঁড়ালো। মার্জান বিল পে করে উঠবে ঠিক তখনি পাশের একজনকে এসে ওয়েটারকে ধাক্কা মেরে দেয়। মার্জানের শরীরে বেচে থাকা জুসটুকু টুপ করে পড়ে যায়ম ওয়েটার আতঙ্ক মাখা কন্ঠে বলে উঠে,
” ম্যাম আম সরি।”
মার্জান “ইটস ওকে বলে ওয়াশরুমের দিকে ছোটে। শীপ্রা সেখানেই বসে রয়। মার্জান ওয়াশরুমে গিয়ে নিজের ড্রেস পরিস্কার করতে লাগলো। ঠিক তখনি উপস্থিত হলো রিয়ানা। মার্জানের বুঝতে বাকি নেই কিছুক্ষণ আগের ঘটনা টা ওঁর ফাঁদ। মার্জান রূঢ় কন্ঠে বলে উঠলো,
” কি চাই?”
রিয়ানা স্বভাব মতো ওঁর পেটে হাত বুলিয়ে বলে উঠলো,
” তোমাকে ইনভাইট করতে এলাম। কাল আমার বেবি সাওয়ার সময় মতো চলে এসো।”
মার্জান বাঁকা হেসে বলে উঠলো,
” আসবো তো অবশ্যই। ”
রিয়ানা থতমত খেয়ে গেলো ওঁর হাসি দেখে। বলল,
” এভাবে হাসছো কেন?”
মার্জান রিয়ানার কাছে আসতেই রিয়ানা পিছনে চলে যেতে নিলো ওঁর উঁচু হিলের জন্য পরে যেতে নিলো। মার্জান টেনে ধরে ফেললো। রহস্যময় কন্ঠে বলে উঠলো,
” আরে, আরে সামলাও নিজেকে? এখনি এই অবস্থা? কাল কি করবে?”
রিয়ানা ভ্রু কুচকে তাকালো,
” কি বলতে চাইছো?”
” এটাই যাষ্ট। নিজেকে সামলে চলতে শিখো, সামনে কি হবে বলা যায় না।”
বলেই বেড়িয়ে যেতে নেয় ওঁ। তখনি কারো সাথে ধাক্কা লেগে যায় ওঁর। এবং ওঁর পার্স ছিটকে পড়ে কিছু দূর, এবং একটি বেসরেটও বেড়িয়ে এলো। মার্জান মাথা তুলে দেখলো রিয়ানার চামচি চৈতি। ওঁ চৈতির দিকে তাকাতেই দেখলো চৈতি ওই বেসলেটের দিকে তাকিয়ে। মার্জান দেড়ি করলো না সঙ্গে সঙ্গে তুলে নিয়ে চলে গেলো। ওঁর যাওয়ার পথে তাকিয়ে রইলো শুধু।
————————-
শীত নেমে এসেছে। চারপাশের বইছে শীতল বাতাস। পরিস্কার আকাশ মেঘাছন্ন। মার্জান করিডরে দাঁড়িয়ে হাসপাতালের। ঠিক তখনি রাফি এসে বলল,
“মার্জান আমি খুব জলদি আবার ব্যাক করছি। আমার মতে মৃণালকে দেশের বাহিরে নিয়ে যাওয়া উচিত। ওখানে আমার এক বন্ধু আছে স্টিফেন ওঁর সাথে ম্যাচ করে গেছে ওর ব্রোন ম্যারো। এখন তোমার সম্মতি বাকি।”
মার্জান দোনোমোনোয় পড়ে গেছে। কি করা যায় ভাবছে। তা দেখে আবার রাফি বলে উঠলো,
” এক সপ্তাহ সময় আছে তোমার হাতে মার্জান!”
“ঠিক আছে।”
মার্জান ছোট করে শ্বাস ফেললো। এর মাঝেই ওঁর সব কাজ শেষ হয়ে যাবে। ওঁ তো মুলত এসেই ছিলো প্রতিশোধ নিতে, আর মৃণালের ডোনার খুঁজতে। আর কোনো কাজ নেই বাকি ওঁর জীবনে। সে না হয় আবারো নতুন জীবন শুরু করবে। নতুন ভাবে! তাই ভেবেই মৃণালের কেবিনের দিকে চলে গেলো। মার্জান মৃণালের পাশে এসে বসলো। ছেলেটা শুঁকিয়ে গেছে। ফ্যাঁকাসে লাগছে মুখ। মার্জানের ভিতর টা ফুপিয়ে উঠলো। ছেলের হাত ধরে নিরবে কেঁপে উঠলো। মৃণালের ঘুম ভেঙে গেলো। মায়ের মাথায় হাত বুলিয়ে বলে উঠলো,
” জান তুমি কেন কাঁদছো? আঙ্কেল সামার কি তোমায় বুলি করেছেন? কষ্ট দিয়েছেন তোমাকে?”
মার্জান ছেলের গায়ে হাত বুলিয়ে বলল,
” নাহ্ বাচ্চা। ”
“তাহলে কেন কাঁদছো?”
“তোমার খুব কষ্ট হয় তাই না?”
“নো জান, তুমি কাঁদলে আমার কষ্ট হয়।”
মার্জান চোখের পানি মুছে ফেললো,
” নাউ আর কাঁদবো না।”
বলেই হাসলো। মৃণাল তখনি এক অভাবনীয় প্রম্ন করে বসলো,
” মম আমার পাপাকে?”
মার্জান মৃণালের অবলীলায় বলা কথায় থমকে গেলো। জিজ্ঞেস করলো কাঁপা কাঁপা কন্ঠে,
” হঠাৎ এমন কেন বলছো মৃণাল?”
মৃণাল চুপ করে রইলো মন খারাপ করে। হয়তো ওঁর মাকে আবার কষ্ট দিয়ে ফেলেছে ভেবেই চুপ করে গেলো ওঁই?
———–
আজ কাল গ্রীষ্মের সাথে নির্ঝোরকে দেখা যাচ্ছে খুব। গুঞ্জন হচ্ছে গ্রীষ্মের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের কথা। আজও দেখা যাচ্ছে পাঁচ তারকা হোটেলের একটি রেস্টুরেন্টে ডিনার করছে ওঁরা । এই খবরটি মার্জান অনেক আগেই পেয়েছে কিন্তু আজ স্বচোক্ষে দেখতেছে। মার্জান কিছুক্ষণ আগেই পৌঁছেছে এইখানে রিয়ানার বেবি সাওয়ারে। নির্ঝোর আর গ্রীষ্মকে দেখে থম মেরে গেলো ওঁ। পাত্তা না দিয়ে নিজের গন্তব্য এগিয়ে চলে গেল। জমকালো সন্ধ্যা। চারপাশের আলোয় আলোকিত রিয়ানার বেবি সাওয়ারের অনুষ্ঠান। রিয়ানা বউয়ের মতো সেজে আছে। পাশেই বসে আছে সুরভি। মার্জানকে দেখেই কালো হয়ে গেলো ওঁর মুখ। কিন্তু রিয়ানা হাসলো। উপহাসের হাসি।বেবি স্টেপে এগিয়ে এলো মার্জানের কাছে। সকলকে আকর্ষণ করে বলে উঠলো,
” দেখো আমার বড় বোন এসেছে। ”
নিস্তব্ধতা ছড়িয়ে পড়লো চার পাশে কিছুক্ষণের জন্য, তারপর পরই কে এক জন বলে উঠলো,
” এতো মার্জান। ওঁর নাকি ছেলে আছে একটা?”
অন্য একজন বলে উঠলো,
” আমি তো এটাও শুনেছি, ও খুন করেছে ওঁর মাকে?”
” আমিও শুনিছি। এও কানে এসেছিলো ওঁর নাকি বাচ্চা আছে। অথচ ও অবিবাহিত। ”
এঁকে এঁকে নানাম কন্ঠ ভেসে আসতে লাগলো। মার্জান পাত্তা দিলো না। রিয়ানার কাছে গিয়ে বলে উঠলো,
” আমি তোমার জন্য, পৃথিবীর সব থেকে বড় গিফট এনেছি।”
রিয়ানা কিছুটা অবাক হলো বটে,
” আচ্ছা তা কি?”
মার্জান, ‘এক মিনিট ‘বলে পার্স থেকে একটি পেইন ড্রাইভ বের করে নিলো। এবং সামনে প্রজেক্টরের কাছে চলে গেলো। পেইন ড্রাইভ লাগিয়ে অপেন করতেই উপস্থিত সবাই থমকে গেলো। ঠিক তখনি উপস্থিত হলো ভাদ্র, ফুলের তোড়া হাতে। আপত্তিকর কিছু শব্দ রিয়ানার চোখের সামনে অন্য কারো সাথে রাত কাঁটাতে দেখেই রিয়ানা মাটিতে বসে পড়লো। অপলক দৃষ্টি স্কীনের উপর। ভাদ্রের হাত থেকে ফুলের তোড়া পড়তেই ওখানে তাকালো সবাই। রিয়ানা রাগে ক্ষোভে উঠে গেলো ভাদ্রের দিকে। পর পর থাপ্পড় পড়লো ওঁর গালে। রিয়ানা বলতে লাগলো,
” তুমি আমাকে ঠকালে, আমি তোমাকে কত ভালোবাসলাম আর তুমি। কেন করলে, বলো।”
ভাদ্র এত মানুষের সামনে এভাবে হেনস্তা হতে হচ্ছে দেখে ধাক্কা দিয়ে সরালো রিয়ানাকে। রিয়ানা কাঁচের টেবিল নিয়ে পেটের উপর পড়লো। সঙ্গে সঙ্গে বাল্ড বেড়িয়ে গেলো। রিয়ানা নিজের পেটে হাত দিতেই চমকে উঠলো। কয়েকটি কাঁচের টুকরো গিথে গেছে ওঁর পেটে। তা দেখেই ঘাবরে গেলো ভাদ্র। দৌঁড়ে কাছে আসতেই রক্তে রাঙ্গা লাল হাতটা উপরে তুলে থামতে বলল। সুরভি দিকে তাকিয়ে বলে উঠলো,
” মা আমার বাচ্চাকে বাঁচাও। আমি মরে গেলেও আমার বাচ্চাকে বাঁচাও।”
সুরভি সহ কয়েকজন কাছে এসে তুলে বেড়িয়ে গেলো ওঁকে। পিছন স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে রইলো ভাদ্র। এই হল ঘরের মানুষ জন কমতে লাগলো ধীরে ধীরে। রয়ে গেলো ওঁরা মার্জান আর ভাদ্র। মার্জানের মন অবশ্যই খারাপ হয়েছে। যতই হোক রিয়ানা তার বোন। কিন্তু ওঁর সাথে যা হয়েছে তার জন্য কাুকে কি মাফ করা যায়? মার্জান উচ্চস্বরে হাসলো। হল ঘরটিতে প্রসারিত হতে লাগলো আওয়াজ।
” কথায় আছে মি: ভাদ্র পাপ বাপকেও ছাড়ে না। কি হবে এবার তোমার? এই বাচ্চা পৃথিবীর মুখ না দেখছে তুমি সারা জিবন বাচ্চার জন্য কাতরাবে তাই না? তাই তো ভাবছো? ঠিক বলছি?”
ভাদ্র ভ্রমে ছিলো। ঘটে যাওয়া ঘটনাতে নিজেকে দোষ দিতে লাগলো ওঁ। কিন্তু মার্জানের কথাতে হুমড়ি খেয়ে গেলো যেন।
” তুমি কি সব বকছো?”
” আমি সত্যি বলছি। ইনফেক্ট প্রুভ আছে আমার কাছে। রিয়ানাকে তুমি মোটেও ভালোবাসো না। অন্য সব মেয়েদের মতো কবে ছুঁড়ে দিতে তাকে। কিন্তু দেখো কি খেল কয়েক মাস আগের একটি এক্সিডেন্টে বাবা হবার শক্তি হারিয়ে ফেলো তুমি? কি? সত্যি বললাম তো?”
ভাদ্র বড় বড় চোখ করে তাকালো। শুকনো ঢুক গিলে বলে উঠলো,
” বাজে বকছো তুমি!”
এবং ওই স্থান ত্যাগ করলো সঙ্গে সঙ্গে। মার্জান নিজেও বেড়িয়ে যেতে লাগলো। কষ্ট লাগছে রিয়ানার জন্য, যাই হোক ওঁ একজন মা, আরেকজন মায়ের কষ্ট বুঝে। কিন্তু ওঁর জিবন নষ্ট করে আর কত সুখী করতে চায়? কিন্তু মার্জান চায় নি,বাচ্চার কিছু হোক। এমন কিছু হয়ে যাবে চিন্তা করে নি মোটেও। কিন্তু যা হবার তাই হয়। কে আটকাতে পারবে এসব? কেউ না। একদম না। মার্জানের ভাবনায় ফাটল পড়লো। নির্ঝোর আর গ্রীষ্মকে একই সাথে একটি রুমে যেতে দেখে থমকে গেলো ওঁ। চোখ জোড়ায় টলমল জল। মার্জান না চাইতেও গ্রীষ্মের উপর দূর্বল হয়েই পড়েছে। কিন্তু নির্ঝর ওঁর বন্ধু হয়ে এসব কিভাবে করতে যাচ্ছে?
মার্জান চোখের জল মুছলো। শীপ্রাকে কল করলো। শীপ্রাকে ওঁর বাসায় আসতে বলে বেড়িয়ে গেলো।
____________
হসপিটালের করিডোর সুরভি চিন্তিত মুুখে বসে আছে। রিয়ানার অপারেশন চলছে। পাশে দাঁড়িয়ে থাকা ভাদ্র আর ওঁর বাবা-মাকে কটাক্ষ করে বলছে,
” আমার এক মাত্র মেয়ে, ওঁর কিছু হলে কাউকে ছাড়বো না কাউকে না।”
নিরবভাবে শুনছে ভাদ্র। ডাক্তার এগিয়ে আসতেই তাদের দিকে সুরভি জিজ্ঞেস করলো,
” ডাক্তার এখন কেমন আছে ওঁরা?”
“সরি আমরা বাচ্চাটাকে বাঁচতে পারিনি।”
ভাদ্র ধপ করে বসে পড়লো। সুরভি ক্রোদন কন্ঠে বলে উঠলো,
“রিয়ানা…!”
” ওঁ কমোয় চলে গেছে।”
সুরভি হাউ মাউ করে কেঁদে উঠলো। করিডোরের নিস্তব্ধতার বুক চিঁড়ে কান্নার শব্দ ভেসে ভেসে যাচ্ছে যত দূর পর্যন্ত যাওয়া যায়…..
শীতের রাতে হেঁটে যাচ্ছে রাস্তার ধার ঘেঁষে। থেকে থেকে একটা দুটো গাড়ি ছুটে যাচ্ছে। মার্জান এবার দু’টি লাইন আওয়রালো,
” আলো যে আজ গান করে মোর প্রাণে গো।
কে এল মোর অঙ্গনে, কে জানে গো।
হৃদয় আমার উদাস ক’রে
কেড়ে নিল আকাশ মোরে,
বাতাস আমায় আনন্দবাণ হানে গো।
দিগন্তের ওই নীল নয়নের ছায়াতে
কুসুম যেন বিকাশে মোর কায়াতে।
মোর হৃদয়ের সুগন্ধ যে
বাহির হল কাহার খোঁজে,
সকল জীবন চাহে কাহার পানে গো।”
মার্জান আপন মনে হাটছে। অথচ একটি অবয়ব ওঁর পিছন পিছন চলছে। মার্জান একবারের জন্যও বুঝলো না। ব্যক্তিটি কে?
——————
চলবে,
পরের পর্ব পরশু রাতে ১২ টার আগে দিবো।