#ঝড়ের রাতে
বিয়ের দু’সপ্তাহ গত হলেও রিপনের সাথে এখনো সহজ হতে পারেনি শবনম। দেখতে এসে হঠাৎ বিয়ে বলে আগে থেকে জানাশোনার কোন ব্যাপার নেই। অর্নাস প্রথম বর্ষে পড়ালেখা করা শবনমের কাছে বাইরের রঙিন দুনিয়া কেবলই উন্মোচিত হচ্ছিল। সেই মুহুর্তে বিয়ে করার মোটেও কোন ইচ্ছে ছিল না তার। কোথায় বন্ধুদের সাথে ঘুরবে বেড়াবে, একসাথে হুল্লোড় করবে তা না। বিয়ে দিয়ে তাকে ঘর বন্দী করার প্ল্যান করা হয়েছে। গত সপ্তাহে তার সব বন্ধুরা মিলে সেন্টমার্টিন থেকে ঘুরে এলো। আর সে কিনা একা একা ঘরে বসে টিভি দেখছে! বিরক্ত হয়ে টিভি বন্ধ করে শবনম। মেজাজ খারাপ হচ্ছে তার।
বাবার সাথে যুদ্ধ করে ও বিয়ে আটকাতে পারেনি শবনম। এতো ভালো পাত্র নাকি সবসময় পাওয়া যাবে না। মুখ বাঁকাল সে। হুহহ, কি এমন ভালো পাত্র? কুয়েট পাশ ইন্জিনিয়ার এখন স্কলারশিপ নিয়ে আমেরিকা পড়তে যাবে। সে নিজে কি কম নাকি? চাইলে সেও ডাক্তার ইন্জিনিয়ার হতে পারতো। নেহাৎ ব্যবসা করবে বলে কমার্সে পড়েছে। এখন যে বিশ্ববিদ্যালয়ে বিবিএ পড়ছে সেটাও টপ র্যাংকড। দুই বছর পরে নিজ চেষ্টায় আমেরিকা যেতে পারবে সে। বাবা এসব কিছুই বুঝলোনা। নিজের মতামত চাপিয়ে দিল তার উপর।
ফেসবুক খুলতেই বন্ধুদের সেন্টমার্টিন ট্রিপের ছবি নিউজফিড জুড়ে। রাগে ক্ষোভে ফোন বন্ধ করে দিলো শবনম। দু’সপ্তাহ গত হলেও এখনও পর্যন্ত কোথাও যাওয়া হয়নি ওর। রিপন এখন ভীষণ ব্যস্ত তার আমেরিকা যাওয়ার কাগজ তৈরিতে। মুলত বিয়েটা এতো তাড়াহুড়ো করার কারনও এটা। হাতে আর দু’সপ্তাহ আছে। এরপর এক বছরের জন্য গায়েব হয়ে যাবে ব্যাটা। গেলেই ভালো হবে। অন্তত এক বছরের জন্য এই গৃহবন্দী অবস্থা থেকে মুক্তি মিলবে তার।
আনমনা হয়ে মোবাইলে বিয়ের ছবিগুলো বের করে। একদম ঘরোয়া আয়োজনের বিয়ে বলে ঘরেই সেজেছিল শবনম। তার ছোটখালা সাজিয়ে দিয়েছিল তাকে। অনিচ্ছায় মুখ গম্ভীর করে বসে আছে সে। তারই পাশে হাসি মুখের রিপনকে বসে থাকতে দেখলো। পাঁচ আট লম্বা রিপনের মাঝারি মানের মুখটিতে সেই হাসি বেশ মানিয়ে গেছে। ওরই দিকে মুগ্ধ দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে আছে মানুষটা। রিপনকে দেখে মেজাজ আরেকবার নতুন করে খারাপ হলো তার। এই লোকটার কারনেই তার এই অবস্থা। সেদিন যদি লোকটার ওকে পচ্ছন্দ না হতো তাহলে আজ সেও সেন্টমার্টিন ট্রিপের ছবি আপলোড করতে পারতো। বদলোক একটা। ফোনটা বিছানার আরেকপ্রান্তে ছুড়ে দিলো সে।
“শবনম, আমরা বেরুচ্ছি। মা আর টুনিকে খালার বাসায় নামিয়ে দিয়ে আমি একটু মতিঝিল যাবো ব্যাংকের কাজে। তুমি বাসায় একা থাকতে পারবে তো নাকি বাসায় যাবে?”
রিপনকে ঘরে ঢুকতে দেখে বিছানায় উঠে বসলো শবনম। বাবার উপর অভিমান করেছে শবনম কাজেই বাসায় সে যাবে না। বিয়ের পর থেকে যায়নি। সে মাথা নাড়লো- “না। আমি বাসাতেই থাকবো।”
“ভেবে বলো। মা আর টুনির ফিরতে দেরি হবে। আমারও হয়তো ফিরতে রাত হতে পারে।”
শবনম গোঁয়ারের মতন মাথা নাড়লো- “বললাম তো থাকতে পারবো।”
রিপন কাঁধ ঝাঁকাল- “এ্যাজ ইয়োর উইশ। আমি গেলাম তবে।”
কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে রুম থেকে বেরুলো রিপন। শবনম আবার বিছানায় গা এলিয়ে দিলো। দরজা লাগানোর তাড়া নেই ওর। মনিখালা আছে সে লাগিয়ে দেবে। শাশুড়ী মা কিছু মনে করলে করতে পারে। তবে মনেহয় না করবে। তার শাশুড়ীমা বেশ কিউট আছে। রাগারাগি করার মতো মানুষ না সে। এই ক’দিনে এতটুকু বুঝেছে শবনম।
আলস্য চেপে ধরেছে তার শরীরে। আসলে শবনমের স্বভাব এমনই। মন খারাপ থাকলে ওর শুধু ঘুম পায়।
এখন বেলা বারোটা, এখনও নাস্তা করেনি সে। ফোন হাতে নিয়ে আবার রেখে দিলো। কি হবে দেখে? শুধু শুধু মন খারাপ হবে। শবনম চোখ বুঁজে পড়ে রইলো।
★★★
ঘুম যখন ভাঙলো তখন জমাট অন্ধকার চারিদিকে। শবনম পাশ ফিরতে গিয়ে টের পেলো কেউ তাকে জাপ্টে ধরে শুয়ে আছে। হঠাৎ করেই প্রচন্ড ভয় ঘিরে ধরলো তাকে। বাসায় তো কেউ ছিলো না তাহলে কে তাকে জড়িয়ে ধরে আছে? অশরীরী ভয় জেঁকে ধরা মাত্রই চোখ বুজে তাত স্বরে চেচিয়ে উঠলো শবনম-
“উউউ, ভুত ভুত ভুত।”
তখনই রুমের বাতি জ্বলে উঠলো- “আস্তে মেয়ে, এখানে ভুত পেলে কোথায়? আমি তোমার স্বামী রিপন।”
শবনমের মুখ চেপে ধরে রিপন। শবনম ঝাটকা মেরে রিপনের হাত সরায়-“আপনি! কখন এলেন? আর এসে এভাবে ঘর অন্ধকার করে শুয়ে আছেন কেন?”
রিপন বিছানায় পা ছড়িয়ে বসলো- “তো কি করবো? বাতি জ্বালিয়ে তোমার ঘুম ভাঙাই আর তুমি চেচিয়ে বাড়ি মাথায় তোলো?”
শবনম মিইয়ে গেল- “আমি কখন আপনার সাথে চেঁচালাম?”
চোখের কোনে হাসি নিয়ে রিপন পাল্টা জবাব দেয়- “চেঁচাওনি কারন আমি সে সুযোগ তোমাকে দেইনি। তোমার বাবা বলেছেন আচমকা ঘুম ভাঙলে তোমার মেজাজ খারাপ হয়।”
শবনম অবাক হলো। এই লোক এটাও জানে? বুকের কোন এক কোনে ভালোলাগার হালকা বাতাস ছুঁয়ে গেল। কিন্তু সেটা প্রকাশ না করে মুখ গম্ভীর করে রইলো। রিপন এবার মুচকি হাসে- “একটু হাসলে তোমার ট্যাক্স দিতে হবে না।”
“মানে?”
বিরক্তি প্রকাশ করে শবনম। রিপন আচমকা ওর কাছে চলে এলো। ছেড়ে রাখা চুলগুলো ফু দিয়ে উড়িয়ে দিলো- “সবসময় মুখটা এমন তেতো বানিয়ে রাখ কেন? একটু মিষ্টি করে কথা বলতে পারনা?”
“না পারিনা। আপনাকে আমার ভালো লাগে না।”
শবনম বিছানা ছেড়ে উঠতেই রিপন ওর হাত ধরে টানলো। তার মুখটা এখনো হাসিহাসি।
“আমার প্রতি এতো বিরক্তি কেন? কি করেছি আমি?”
“বিয়ে করেছেন।”
শবনমের উত্তরে কিছুক্ষণ ওর মুখপানে তাকিয়ে রইলো সে। তারপর ঘর কাঁপিয়ে হাসতে শুরু করলো। শবনমের বিরক্তি সীমা ছাড়াল। এই লোকের এমন উদ্ভট হাসির কারণ সে খুঁজে পেল না। সবসময় দেখছে ও যাই করছে তাতেই লোকটা মজা পাচ্ছে। এমনকি এই যে এতোদিন ধরে শবনম ওর সাথে দূরত্ব বজায় রাখছে তাতেও সে বিরক্ত হয়নি।
সে থমথমে মুখ নিয়ে রিপনকে দেখছে।
“বিয়ে করে দোষ করেছি? কেন? তুমি কি জীবনে বিয়ে না করার পন করেছিলে?”
“করতাম তবে পরে। বন্ধুদের সাথে ঘুরে বেড়িয়ে, নিজের স্বাধীন জীবন উপভোগ করে বিয়ে করতাম। এখন কি হলো? সবাই বেড়াতে যায় আর আমি আপনার বাড়িতে পড়ে পড়ে ঘুমাচ্ছি। এসবই হয়েছে আপনার কারনে। আপনি সেদিন আমাকে পচ্ছন্দ না করলে আজও আমি সিঙ্গেল থাকতাম।”
এবার একটু গম্ভীর হলো রিপন। বিষাদের ছায়া পড়লো মুখের রেখায়।
“এইজন্যই আমার থেকে দূরে থাকা হয়? কেন? বিয়ের পর ঘোরাঘুরি করা যায় না? আমার সাথে ঘুরবে।”
শবনম মাথা নাড়ে- “স্বামীর সাথে ঘোরা আর বন্ধুদের সাথে ঘোরার পার্থক্য আছে। দু’টো দুরকম ব্যাপার। আপনি বুঝবেন না।”
রিপন হতাশ হয়ে শবনমকে দেখলো। মেয়েটার ভাবনা চিন্তা যথেষ্ট ইম্যাচিউর। সে শবনমকে শান্ত করতে বললো- “আচ্ছা, ঠিক আছে। আমি তো আর দু’সপ্তাহ আছি। আমি চলে গেলে না হয় তুমি ঘুরে বেড়িয় বন্ধুদের সাথে।”
শবনম তাচ্ছিল্যের হাসি দিলো- “আপনার মনেহয় আমার বা আপনার বাবা মা দেবেন অনুমতি?”
“দেবে। আমি বলে যাব তাদের।”
“আপনার করুনার দরকার নেই আমার।”
রিপন আর কথা বাড়ায় না। সে গম্ভীর হয়ে পাশ ফিরে শুয়ে পড়লো। মেয়েটা তাকে বোঝার কোন চেষ্টাই করছে না। কোথায় ভেবেছিল বউকে নিয়ে দেশ বিদেশ চড়ে বেড়াবে। গত পনেরো দিন গাধার মতো দৌড়ে আমেরিকা যাওয়ার প্রসেসিং করলো। ভেবেছিল আজ থেকে বাকি পনেরটা দিন শবনমকে সময় দেবে। মেয়েটা বিশেষ কথাটথা বলে না ওর সাথে। সময় দিয়ে যদি ওর সাথে সম্পর্কটা সহজ করা যায়। কিন্তু এতো দেখি একেবারেই বাচ্চামো স্বভাবের মেয়ে।
★★★
“বউ, তুমি খাইয়া নিলা? রিপন বাবাজী তো এখনও খায় নাই। আপা আর টুনিমা আসবে না শুইনা কইলো তোমার লগে খাইবো।”
শবনম থতমত খেল। রিপন না খেয়ে ওর জন্য অপেক্ষা করছে এটা তো সে জানেনা।
“আমি তো জানি না খালা। আচ্ছা ওনাকে ডেকে নিয়ে আসি।”
রিপনকে একবার ডাকতেই সে উঠে বসলো। শবনম জানতে চাইলো- “আপনি দুপুরে খাননি?”
রিপন মাথা নাড়লে শবনম বলে- “ওহহহ, আমি তো খেয়ে নিয়েছি।”
“বেশ করেছ।”
রিপন উল্টো ঘুরে শুয়ে পড়লো।
“আপনি খাবেন না? শুয়ে যাচ্ছেন কেন?”
“খাবো না। ইচ্ছে করছে না।”
রিপন ওভাবেই শুয়ে থাকে। শবনম তবুও দাঁড়িয়ে রইলো। মনেহচ্ছে ওর খেয়ে নেওয়ার কথা শুনে রাগ করেছে মানুষটা।
“শুনুন, চলুন খাবেন।”
“খাবো না বললাম তো।”
“আরে খাবেন না কেন? আমি তো জানতাম না যে আপনি আমার জন্য না খেয়ে বসে আছেন?”
রিপন উঠে বসলো। শবনমের চোখে চোখ রেখে জানতে চাইলো- “তুমি কি চাও আমি ভাত খাই?”
শবনম দ্বিধা নিয়ে মাথা দোলায়।
“তাহলে নিজ হাতে ভাত মেখে খাইয়ে দাও আমায়।”
শবনম চমকে তাকায়। এরকম একটা প্রস্তাব আসবে ঘুনাক্ষরেও টের পায়নি। গত পনেরো দিনে ওকে বিশেষ বিরক্ত করেনি লোকটা। অথচ আজ কেমন যেন করছে। আকাশকুসুম ভাবতে ভাবতে প্লেটে ভাত তরকারি নিয়ে ফেরত এলো শবনম। রিপনের সামনে বসলো- “এই যে আপনার ভাত।”
“হ্যা তো? আমি নিজ হাতে খাবো না বলেছি তো। মাংস দিয়ে নলা করে মুখে দাও।”
মোবাইলে চোখ রেখে উত্তর দিলো রিপন। শবনম মনে মনে হাজারটা গালি দিলো রিপনকে। গরুর মাংসের সাথে ভাত মেখে ওর মুখের সামনে ধরলো- “নিন। হা করুন।”
মোবাইলে চোখ রেখেই হা করলো সে। শবনমের হাতের আঙুলসহ ভাত চেটেপুটে নিলো। প্রথমবারের মতো রিপনের উষ্ণ আর্দ্র ঠোঁটের স্পর্শে আমুলে কেঁপে উঠলো শবনম। নিজের অজান্তেই গালদুটোতে জমা হলো শরীরের সমস্ত রক্ত। দ্বিতীয় লোকমা তুলে দিতে গিয়ে দেখলো তার আগুলগুলো কাঁপছে থরথর। অসস্তি নিয়ে রিপনের দিকে তাকাতেই টের পেলো বদ লোকটা মিটিমিটিয়ে হেসে তাকেই দেখে যাচ্ছে।