#ঝিলের_ওপারে_পদ্মফুল
তন্বী ইসলাম -২১
“পদ্মফুল’
শ্রাবণের মিষ্টিমধুর কন্ঠস্বরে হালকা নড়ে উঠলো পদ্ম। মুখ খুললো কিছু বলার জন্য, কিন্তু পরক্ষণেই ভুলে গেলো সে কি বলবে। আবারো মুখ ভার করে বসে রইলো মাচার উপর। ওপাশ থেকে শ্রাবণ সামান্য ধমকের গলায় বললো
“আমার কথা শুনতে পাচ্ছিস না পদ্মফুল? উত্তর দিচ্ছিস না কেন?
পদ্ম’র এবার কান্না পেলো। একে’তো কাল বিয়ের দিন সে থাকবেনা, তার উপর এখন আবার বকছে। এবার অভিমানে গাল ফুলালো পদ্ম। বললো
“নাহ! কমুনা আমি কথা।
পদ্ম’র কথা শুনে কিঞ্চিৎ হাসলো শ্রাবণ। বললো
“কেন কথা বলবে না আমার পদ্মফুল?
“পদ্মফুলের মন খারাপ তাই।
“সেটার কারণ জানতে পারি আমি?
“তুমি জানো না শ্রাবণ ভাই?
“কি জানিনা! বিস্ময়ে বললো শ্রাবণ।
পদ্ম এবার নড়েচড়ে উঠলো। মাচা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে অবাক হয়ে বললো
“কাল যে আপার বিয়ে তা তুমি জানো না?
“কাল! ওর বিয়ে না পরশু হওয়ার কথা?
পদ্ম এবার নরম গলায় বললো
“একদিন আগায়া আনছে বিয়া।
“আমাকে তো কেউ কিছু বললো না। একা একা বিড়বিড় করে বললো শ্রাবণ। কথাটা কানে গেলো পদ্ম’র। আবারও রাগ হলো তার।
রাগে ফুসে উঠে বললো
“তুমি জানবা কেমনে, কেউ কল দিলে তুমি কি ধরো নাকি? ওইসময় কতগুলা কল দিছি। তুমি রিসিভ করো নাই কেন? উলটা আরো ফোন কেটে দিছো।
পদ্ম’র কন্ঠে স্পষ্ট অভিমান। শ্রাবণ তার পদ্মফুলের অভিমান বুঝতে পেরে ক্ষীন হেসে নরম গলায় বললো
“আমার রুমের সুইচবোর্ডটা হঠাৎ কাজ করছে না রে পদ্ম। ফোনে চার্জ ছিলো না তাই পাশের ফ্রেন্ডের রুমে মোবাইল চার্জে লাগিয়ে ছিলাম। তুই তখনই বোধহয় কল করেছিলি। আমিও দরকারে একটু বাইরে গেছিলাম, তাই ওরা ফোন কেটে দিছিলো। আমি স্যরি রে পদ্মফুল।
পদ্ম’র রাগ এবার কিঞ্চিৎ কমলো। ভারী গলায় বললো
“এখন কি হইবো শ্রাবণ ভাই? তোমারে ছাড়া আপার বিয়াটা আমার কাছে একদমই ভালো লাগবো না। কাঁদোকাঁদো মুখ করে বললো পদ্ম।
“মন খারাপ করিস না রে পদ্মফুল। কিন্তু বিয়ের ডেইট চেঞ্জ করলো কেন?
পদ্ম মলিন গলায় কারণটা শ্রাবণকে বললো। সবটা শুনে শ্রাবণ বললো
“এখন আর কি করার। আমিতো আর এক্সাম ছেড়ে আসতে পারবো না। তাই অপেক্ষা করতে হবে। আমার ফিরে আসার অপেক্ষা।
“হুম। মলিন মুখে বললো পদ্ম।
“শাপলাকে উঠিয়ে নেওয়ার আগেই আমি চলে আসবো পদ্মফুল। আমার জন্য অপেক্ষা করবি না? শ্রাবণের কন্ঠে উদগ্রীব। পদ্ম হেসে বললো
“করবো তো শ্রাবণ ভাই।
শ্রাবণ হেসে বললো
“তা কাল শাপলার সাথে কে যাবে ও বাড়ি?
“আমি। হেসে বললো পদ্ম।।
“একদমই না। সাথে সাথেই নিষেধ করে বসলো শ্রাবণ। পদ্ম’র মুখটা চুপসে গেলো। বললো
“কেন?
“তুই বড় হয়েছিস না? এতো বড় মেয়ের ওখানে যাবার কোনো দরকার নেই।
“তাই বলে আমার দুলাভাই এর বাড়ি আমি যামু না শ্রাবণ ভাই?
“যাবি তো। আমার সাথে যাবি। আগে আমি আসি, তারপর।
“তোমার সাথে কি আম্মা আমারে দিবো যাওয়ার লাইগা? চিন্তিত গলায় বললো পদ্ম।
“সে আমি দেখে নিবো।
“আচ্ছা।
“এবার আমি রাখি রে পদ্মফুল। পড়া বাকি আছে অনেক।
পদ্ম মলিন গলায় বললো
“রাখবা? আইচ্ছা তাইলে রাখো।
পদ্ম ফোন রাখতেই যাচ্ছিলো, এরমধ্যে আবারও শ্রাবণের কন্ঠস্বর শোনা গেলো। সাথে সাথেই ফোনটা আবারও কানে ঠেকালো সে। বললো
“কিছু বলবা শ্রাবণ ভাই?
“তুই কি এখনো ঝিলের কাছে আছিস?
“হুম।
“এক্ষুনি বাড়ি যা। আর কোনো দিনই যাতে না শুনি তুই রাতে ঝিলের পাড় গিয়েছিস। আর একটা কথা..
“কও শুনি। ভাবলেশহীন ভাবে বললো পদ্ম।
“আশিকের কাছ থেকে নিজেকে যথেষ্ট দূরে রাখবি। সবসময়ই মাথায় রাখবি একটা কথাই, তুই শুধুই তোর শ্রাবণ ভাইয়ের।
কথাটায় বেশ লজ্জা পেয়ে গেলো পদ্ম। কিছু বলার মতো সাহস আর হলো না তার। শ্রাবণ আবারও বললো
“আমি সব সহ্য করতে পারবো, কিন্তু আমার পদ্মফুলকে অন্য কারো সাথে ভাবতেও পারবো না।
“শ্রাবণ ভাই!
আবেশে ডাকলো পদ্মফুল। শ্রাবণ মৃদুহেসে বললো
“কি?
“ভালোবাসি তোমারে।
শ্রাবণ হেসে বললো
“ইশশ, এখন যদি তুই আমার সামনে থাকতি রে পদ্ম।
পদ্ম’র মুখটা চুপসে গেলো হঠাৎ। বললো
“থাকলে কি করতা?
“আমার পদ্মফুলকে আমার বুকের সাথে শক্ত করে মিশিয়ে নিতাম।
লজ্জায় লাল হয়ে গেলো পদ্ম। ফোনটা কান থেকে সরিয়ে নিলো ঝট করে। আর কিছু শুনতে পারবে না সে, আর কিছু বলতেও পারবে না। ওপাশ থেকে আর্তনাদের মতো শ্রাবণ ভাইয়ের ডাক খুবই ক্ষুদ্রভাবে কানে ভেসে আসছে। আসলে আসুক, এখন সে কোনোভাবেই তার শ্রাবণ ভাইয়ের সাথে কথা বলবে না।
বিয়েতে যারা যারা আসার কথা ছিলো তারা সবাই প্রায় এসেই গেছে। গুটিকয়েক বাকি আছে তারা কাল সকালে আসবে। মহিলারা লেগে গেছে কাটাকুটির কাজে। কেউ পেয়াজ কাটছে তো কেউ রসুন। কেউ আদা জিরা বাটার কাজে ব্যস্ত৷ মেয়ে কাল পরের ঘরে চলে যাবে সেই শোকে কাজ করতে গিয়েও করতে পারছে না আলেয়া। ক্ষনে ক্ষনে নিরবে কেঁদে উঠছেন তিনি। আসমা আর জুবেদা তাকে সামলাচ্ছে তখন। তারাও নানারকম কাজে ব্যস্ত।
প্রচুর ঘুম পাচ্ছে পদ্ম’র। ঘুব পাবেই বা না কেন, রাত যে প্রায় এক’টা ছুইছুই। কিন্তু শাপলার জন্য ঘুমোতেও পারছে না। খচরখচর করে একটু বাদে বাদে কি যেনো করে যাচ্ছে আপন মনে। সে যা করছে করুক, তাতে তার কোনো সমস্যা ছিলো না। কিন্তু খচখচানির শব্দে চোখে ঘুম এসেও আসছে না।
অবশেষে উঠে বসলো পদ্ম। কারেন্ট থাকলেও তাদের রুমের লাইটটা অফ করা। মুলত ঘুমানোর জন্যই অফ করেছিলো শাপলা। লাইট অফ থাকলেও পুরো ঘর অন্ধকার হয় নি তখনও। উঠোনের লাইট জ্বালানো, আর মাঝঘরের লাইটও জ্বলছে৷ যে কারণে ওপাশেও লাইটের অস্পষ্ট আলোতে সবকিছু ঝাপসা ঝাপসা দেখা যাচ্ছে। এতো দিন ওদের রুমটা পর্দা দিয়ে আলাদা করা ছিলো, পর্দা থাকলে আরো ক্লিয়ার ভাবে সব দেখা যেতো। কিন্তু মেয়ের বিয়ে তাই রঙ্গিন টিন আনিয়েছেন আলেয়া। সে টিন দিয়ে মাঝখানে পার্টিশন বসিয়েছেন। মেয়ের জামাইকে তো আর পর্দার পার্টিশন দেওয়া রুমে বসানো যাবে না। আবছা আলোতে পদ্ম খেয়াল করলো শাপলা কি যেনো করছে। কিন্তু কি করছে সেটাই বুঝা যাচ্ছে না। এক প্রকার বিরক্ত হয়ে শাপলাকে উদ্দেশ্য করে পদ্ম বলে উঠলো
“এতো রাইতে তুই ওইখানে কি করিস রে আপা?
পদ্ম’র কথায় কিঞ্চিৎ চমকে উঠলো শাপলা। এরপর মৃদু হেসে বললো
“তুই ঘুমাস নাই এখনো পদ্ম?
“ঘুমামু কেমনে? তুই যেমনে খচখচানি করতেছিস, ঘুমানোর উপায় আছে কি?
শাপলা এবার তরিঘরি করে এগিয়ে এলো পদ্ম’র কাছে। বললো
“এই নে, আমিও শুয়ে পরছি। এবার ঘুমিয়ে যা।
“কিন্তু তুই করতেছিলি কি এতো রাইতে? তোর না কাইল বিয়া? হয়তো তুই ঘুমাবি, নয়তো বইসা বইসা শুইয়া শুইয়া কানবি। তা না কইরা অন্ধকারে কিসব করতাছিস।
বোনের কথায় হেসে উঠলো শাপলা। বললো
“কান্না করার জন্য তো কাল সারাদিনই পইরা রইছে পদ্ম।
“কিন্তু তুই করতাছিলি কি?
শাপলা এবার মলিন গলায় বললো
“ও তুই বুঝবি না রে পদ্মফুল। নে এবার ঘুমা।
বালিশে মাথা রেখে কপালের উপর হাত দিয়ে শুয়ে পরলো শাপলা। পদ্মকেও তাড়া দিলো শোয়ার জন্য। যেহেতু চোখভরা ঘুম ছিলো, তাই আর কোনো কথা না বাড়িয়ে নিজেও শুয়ে পরলো বোনের পাশে। কয়েক সেকেন্ড বাদেই শব্দ করে হেসে উঠলো পদ্ম। ওর হাসি শুনে ভ্রু বাকালো শাপলা। বললো
“পাগলের মতো হাসিস কেন?
“কাইল থেইকা এই বিছানাতে আমি একা থাকমু আপা!
“এই জন্য হাসছিস?
“না। একলা থাকতে তো আমার ভাল্লাগবো না, ভয় লাগবো।
“ভয় লাগলে মানুষ হাসে নাকি পাগল।
“এর লাইগা আমি হাসি নাই তো আপা।
“তা কিসের লাইগা হাসছোস? মাথাটা উচু করে একহাত মাথার উপর নিয়ে রেখে বোনের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলো শাপলা। পদ্ম দুষ্টু হেসে বললো
“কমু?
“হু।
“বিয়ার পরে যখন তুই তোর জামাইরে নিয়া আমাগো বাড়ি আসবি তখন তো এই বিছানাতেই থাকবি। যদিও তখন তোর সাথে আমি থাকমু না, তোর জামাই থাকবো।
“তাতে কি হইছে?
“আমি তো তখন আম্মার সাথে থাকমু। আইচ্ছা আপা, তোর শরম করবো না পুরুষ মানুষের সাথে থাকতে? ঘুম থেইকে উইঠা আমার আর আম্মার সামনে আসবি কেমনে তুই ? আমার তো ভাব্লেও শরম লাগে। বলে আবারও দুষ্টু হাসলো পদ্ম।
বোনের কথায় চোখ কপালে উঠার উপক্রম হলো শাপলার। বললো
“ওরে দুষ্টু রে। এইবার ঘুমাবি নাকি আম্মারে ডাকমু?
পদ্ম চোখ বন্ধ করে বললো
“ডাক আম্মারে। আম্মা আইসা দেখুক তার গুণধর মাইয়া বিয়ার টেনশিনে ঘুমাইতে পারে নাই এখনো।
শাপলা লম্বা একটা নিশ্বাস ছেড়ে বললো
“আহ পদ্ম, তুই যার কপালে জুটবি তার কপালে যে কি আছে আমি শুধু সেইটাই ভাবি।
“এমনিতেই তুই আমার আর শ্রাবণ ভাইয়ের মাঝখানে যেমনে ঝরের মতোন ঢুইকা পরিস, সেইটাই অনেক বেশি। আর আমাগো নিয়া চিন্তা করিস না বোইন, পরে যদি এর চাইতেও ভয়ংকর ভাবে ঢুকে যাস তখন আমাগো কি হইবো! কথাটা বলে দুষ্টুমির ছলে কাঁদতে লাগলো পদ্ম। শাপলা হাসতে হাসতে বললো
“আর কান্দিস না পদ্ম। কালই তো আমি এ বাড়ি ছেড়ে চলে যাবো, এরপর তোরা নিশ্চিন্তে প্রেম করিস। আমি আর কাবাব মে হাড্ডি হমু না।
বোনের কথায় পদ্ম’ও হাসলো। এরপর দুজনেই নিশ্চুপ। কিছুক্ষণ বাদেই ঘুম এসে ঠিকরে ভর করলো পদ্ম’র চোখে। ঘুমের জগতে পাড়ি দিলো সে গভীরভাবে। কিন্তু ঘুম এলো না শাপলার চোখে। চেষ্টা করেও ঘুমাতে পারছে না সে। বার বার শুধু মনের মধ্যে ঘোরপাক খাচ্ছে একটা কথায়, ‘আজকের রাতটাই এ বাড়িতে তার শেষ রাত। আজকের পর এ বাড়িটা হয়ে যাবে পরের বাড়ি, নিমিষেই হয়ে যাবে সে এ বাড়ির মেহমান।’
খুব ভোরে মোরগের ডাকে ঘুম ভাংলো পদ্ম’র। হাই তুলতে তুলতে উঠে দেখে বাইরে এখনো আবছা অন্ধকার। তবে লাইট জ্বলছে তখনও। অনেক মানুষের শোরগোল কানে আসছে। তার মানে এখনো সবাই সজাগ, সারারাত জেগে কাজ করেছে তারা। এখনো করছে। পাশে তাকাতেই চোখ গেলো শাপলার দিকে। মাথার উপর বালিশ রেখে উপুড় হয়ে শুয়ে ঘুমোচ্ছে সে। শরীরের এক অংশ একদিকে, আরেক অংশ আরেকদিকে। বাকা হয়ে ঘুমিয়ে আছে সে। বোনের এমন ধরণের ঘুমানো দেখে হাসি পেলো পদ্ম’র। কিন্তু সে হাসলো না।।খুব ধীরে ধীরে সতর্কতার সাথে বিছানা ছাড়লো সে যেনো শাপলার ঘুম ভেঙ্গে না যায়। আজ সারাটা দিন বেচারির উপর দিয়ে বেশ ধকল যাবে।
হাসিমুখে ঘর থেকে বেরোনোর জন্য পা বাড়ালো পদ্ম। কিন্তু হঠাৎ চোখ গেলো ঘরের এক কোনে ভাঙ্গা চেয়ারের উপর। অবাক হলো সে প্রচন্ড রকমের। বিস্ময়ে এগিয়ে যাওয়ার জন্য পা বাড়ালো সেদিকে।
চলবে…..