#ডাকপাড়ি
#পর্ব_৪৫
#আফনান_লারা
________
মায়ের কথা শুনে সারথির চোখ দিয়ে তখনই এক ফোটা পানি গড়িয়ে নিচে পড়ে গেলো।আনাফ সেটা দেখে নিয়েছে, কারণ তার চোখ সারথির উপরই ছিল।
মা আবার বললেন,’আমার ছেলেকে আমি সব এফোর্ট দিয়ে বড় করেছি।তাকে শিক্ষিত বানিয়েছি,আমার ছেলে সব দিক দিয়ে পারফেক্ট।তার জন্য কেন আমি সেক্রিফাইস করে একটা অন্ধ মেয়েকে ঘরের বউ করে আনবো?আমি কি আশা করতে পারিনা একটা সুন্দর,পারফেক্ট পুত্রবধূ?? বুড়ো বয়সে বউমার সেবা খাওয়া কি আশা করতে পারিনা আমি?বুয়া কি সব পারে?
এই মেয়েটাকে বিয়ে করে আনলে আমার তো উল্টে ওর সেবা করতে হবে মনে হচ্ছে’
‘দেখো মা,সেবার বিষয়টা যে বলছো এটা একেবারেই অযৌক্তিক। আমার যে টাকা আছে সেটা দিয়ে আমি এখন যেমন দুইটা বুয়া রাখছি, দরকার পড়লে বিয়ের পর আরও দুজন বুয়া বাড়িয়ে দেবো।তোমার সেবার কোনো ত্রুটি থাকবেনা।আর যে নরমাল সেবা তুমি আশা করো সারথি সেটা অবশ্যই করতে পারবে,আমি বিশ্বাস করি।সে চোখে দেখেনা তো কি হয়েছে??সজীবের বাসায় কি ছিল না সে??সজীবের মায়ের সেবা করে নাই?”
‘আমার বেলায় কেন এমন হবে আনাফ??’
‘মা এসব কি বলতেছো?আমরা ছেলেরা এই কথা বলা উচিত যে আমরা কেন বিবাহিত মেয়ে বিয়ে করবো।সেখানে তুমি শাশুড়ি হয়ে বলতেছো তোমার অবিবাহিত মেয়ে লাগবে!!যেখানে আমার কোনো সমস্যা নাই সেখানে তোমার সমস্যা লাগলো?’
‘শুন আনাফ!আমি নাহয় বুকে পাথর বিধে রাজি হয়ে গেলাম।কিন্তু তোর বাবা?তোর বাবাকে কি করে রাজি করাবি?দশদিন পরে কানাডা থেকে আসবেন উনি, এসে যদি এগুলা শুনে তখন কি করবি?
আমি বাবা মিথ্যা কিছু বলতে পারবোনা।সারথির অতীত যা যা আছে সব বলে দিব।কারণ উনি আমার স্বামী।তার থেকে এত বড় কথা লুকানো আমার পক্ষে সম্ভব নাহ।’
সারথি চোখ মুছে নেয়ার সুযোগ খুঁজছে।আনাফ চুপ করে বসে আছে এবার।আসলেই মা রাজি হলেও বাবাকে রাজি করানো অসম্ভব।
মা উঠে চলে গেছেন হঠাৎ করে।
আনাফ ওমনি সারথির দিকে ফিরে ওর চোখ জোড়া মুছিয়ে দিলো।এরপর বললো,’তোমার চোখের অশ্রু কমাতেই আমি তোমায় বিয়ে করতে চাচ্ছি,সেই তুমি বিয়ে হবার আগে থেকেই অশ্রু ঝরালে??এমনটা তো চাইনি আমি।তবে কেন এমন হয়?’
‘ আমায় বিয়ে করে আপনি নিজের পরিবারে কেন অশান্তি করছেন?
আপনার বাবা মায়ের চেয়ে আমি বেশি হয়ে গেলাম?আন্টি তো ঠিকই বলেছে।আপনি আরও ভাল ডিজার্ভ করেন’
‘শোনো!!টিপিক্যাল হবু বউয়ের মতন কথা বলবানা।অন্তত তোমার থেকে এই কথা আমি আশা করিনা।
আর কে বলেছে বাবা মায়ের অমতে বিয়ে করবো?বিয়ে করলে তাদের হাসিমাখা মুখ ধরে রেখে করবো,সেটার জন্য আমাকে যা করতে হবে আমি তাই করবো।তোমায় কিছু করতে হবেনা।শুধু দেখে যাও আমি কি কি করি’
——–
আনাফের আম্মু হাতে চায়ের কাপ আর চিনি,লবণ,বেকিং সোডা নিয়ে সারথির সামনে ট্রেটা রাখলেন তারপর বললেন,’সারথি তোমার সামনে তিনটে বোয়ামে তিনটে উপকরণ আছে।কি কি সেগুলা বলছিনা।পাশে চায়ের কাপ আছে, চিনি ঢেলে নাড়ো।আমি দেখবো’
সারথি হাত বাড়িয়ে বোয়াম ১মটা ধরে ছিপি খুলে ভেতরের চামচ দিয়ে একটু খানি বের করে আঙ্গুল দিয়ে ছুঁতেই তার কাছে দানাগুলো চিকন মনে হলো।তারপর সে ঐ বোয়াম রেখে পরের বোয়াম ধরলো।এটাতে দানাই নেই।দানাগুলো মিহি করে পিষানো।এটাও সে রেখে শেষেরটা হাতে নিলো।এটার দানাগুলো চিনির মতন বড় বড়।এটা থেকে এক চামচ চিনি নিয়ে সে চায়ের কাপ হাতিয়ে তাতে ঢেলে নাড়ছে এখন ।
আনাফ মুচকি হেসে বললো,’হলো তো বিশ্বাস??আমি জানতাম সারথি ঠিক পারবে।’
আনাফের মা গাল ফুলিয়ে রাখলেন,ভালমন্দ কিছুই বললেননা।আনাফের ইচ্ছা করছিল সারথিকে জড়িয়ে ধরতে।
মায়ের কারণে পারছিলনা।মা না থাকলে নির্ঘাত ঝাপটে ধরতো।তার এই ইচ্ছা কেমন করে যেন পূরণ হয়ে গেলো।মা চায়ের কাপটা নিয়ে তার রুমের দিকে চলে গেলেন তখন।ওমনি আনাফ খুশি হয়ে সারথিকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বললো,’ভালোবাসিরে তোরে!!’
‘ইইইইইইইইই!!ছাড়ুন!এটা কিরকম অসভ্যতামি!!তুমি থেকে এবার তুইতোকারি শুরু করে দিলেন’
‘মানুষ খুশিতে পাগল হয়ে যায়।আমি তার প্রমাণ ‘
————
মানিক সাহেবের সামনে বরাবর টুলে বসে আছে ফারাজ।তার পেছনে দাঁড়ানো ফাহাদ।সবেমাত্র এসেছে বাড়িতে।আসতেই বাবার ডাক পড়ে গেলো।মিসেস সোনালী ফাহাদের জন্য বিরিয়ানি রাঁধবেন তাই মশলাপাতির লিস্ট নিয়ে আনলেন মানিক সাহেবের হাতে দেবেন বলে।এখন ওনাকেও মানিক সাহেব দাঁড় করিয়ে রেখেছেন।
ফাহাদ বাবার ভয়ে দীর্ঘ দশ মিনিট ধরে দাঁড়িয়ে থাকলেও ফারাজ গেছে বিরক্ত হয়ে।ব্রু কুঁচকে বললো,’বাবা কিছু বলবেন??আমার একটা কাজ আছে’
‘বসে থাকতে কি পা চুলকায় তোমার?দাঁড় করিয়ে রাখবো নাকি?’
ফারাজ এবার মাথা নিচু করে বসে থাকলো।মানিক সাহেব ওকে দাঁড়াতে বলে ঐ টুলে ফাহাদকে বসতে বললেন।তাই দুজনে অদলাবদলি করে নিলো।অবশেষে মানিক সাহেব এবার মুখ খুলে গম্ভীর গলায় কথা শুরু করেন।
‘ফাহাদ জীবনের বড় ভুল করেছিল প্রেম করে বিয়ে করে।তার সেই ভুলের মাশুল আমরা আজ অবধি দিয়ে যাচ্ছি ।জীবনে বড় ছেলের বউয়ের হাতের এক কাপ চা খাইতে পারি নাই।আমার পোড়া কপাল!
আর সেই ভুল আমার ছোট ছেলে করতে চলেছে।কদিনের আসা একটা মেয়ের প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছে সে। কেমন সুন্দর একটা মেয়ের পরিবার থেকে প্রস্তাব আসলো আর উনি বলেন উনি ওকে বিয়ে করবেননা কারণ নাকি কেবল ব্যবহার।
আরে ব্যবহার ধুই কি পানি খাইবা তুমি?’
‘বাবা আমি পূর্ণতাকেও বিয়ে করবোনা।’
‘কাকে করবা দেখবো তো শেষ অবধি’
মিসেস সোনালী কাগজটা এগিয়ে ধরে বললেন,’ফারাজ পূর্ণতাকে বিয়ে করলে কি সমস্যা তোমার?ফাহাদের বউয়ের হাতের চা খাওনি তো কি হয়েছে,পূর্ণতার হাতের চা কয়বার খাইছো হিসেব আছে তোমার?’
‘বাড়িতে থাকলে চা তো বানাবেই।ফাহাদের বউ তো বাড়িতেই থাকেনা।কার সাথে কাকে মেলাচ্ছো?চা বানিয়ে খাওয়ালেও পূর্ণতাকে আমি ফারাজের পাশে মানতে পারবোনা’
‘কারণ তোমার কাছে ওর বাবাকে ভাল্লাগেনা।তাই তো?’
মানিক সাহেব বড় বড় চোখে তাকালেন সোনালীর দিকে।আর কিছুই বললেননা।ফাহাদ তখন হালকা কেশে ধীরে বলে উঠলো,’বাবা ওকে তো বলেছি বাবুকে নিয়ে বেড়াতে আসতে।ও আসলে একটু অসুস্থ ‘
‘তোর বউ বারো মাসই অসুস্থ থাকে, এ আর নতুন কি!’
——–
পূর্ণতা তার ব্যাগ গুছিয়ে নিয়ে বাবার পা ধরে বসে আছে এই বলে যে সে আর এই বাড়িতে থাকবেনা।থাকলেই তাকে ধরে হয় শাহেদ নাহয় ফারাজের সাথে বিয়ে দিয়ে দেয়া হবে যেটা সে কিছুতেই করবেনা।
‘দেখ মা আমার মতে ফারাজ,শাহেদ দুজনেই ভাল ছেলে।তোর ওদের দুজনের মধ্যে একজনকে বেছে নেয়া উচিত।
এটা তোর বিয়ে করার মোক্ষম সময়।রাজি হয়ে যা মা’
‘বাবা তুমি বোঝো!!এদের দুজনের একজনকেও আমার পছন্দ নয়।আমার জন্য কি ছেলের অভাব??তাহলে এদের দুজনের মাঝে একজনকেই কেন বেছে নিতে হবে?’
‘তোর যাকে খুশি বিয়ে করিস।কিন্তু আমি বেলায়েত বাবুর আদেশ ছাড়া এই বাড়ি ছাড়তে পারবোনা।তুই তাকে না মানলেও আমি মানি।সেই ছোটকাল থেকে আমার বাবার মতন হয়ে তিনি আমায় মানুষ করে ছিলেন।আমায় যদি তিনি বলেন ফারাজের সাথেই তোর বিয়ে দিবেন তবে আমি তাতেই রাজি হয়ে যাবো’
পূর্ণতা বুঝে গেছে সে যত চিল্লাফাল্লা করুক,বাবার মত বদলাতে পারবেনা।তাই সে ঠিক করেছে রাতের আঁধারে বাড়ি ছেড়ে পালাবে।তার হাতে এ ছাড়া আর কোনো উপায় খালি নেই।
ওদিকে বাবা ইচ্ছামত ঝেড়েছেন ফারাজকে।সাথে ফাহাদকে ডিটার্জেন্ট দিয়ে ধুয়ে রোদেও শুকাতে দিছেন।এবার ইস্ত্রি করা বাকি শুধু।ফাহাদ জানত আজ সে বাড়িতে আসা মানে বাবার বকুনি খেতে খেতে পেট ভরিয়ে ঘুমাতে যাওয়া।মা কত স্বাদ করে বিরিয়ানি রান্না করছে।বাবার বকুনি খেয়ে সেই বিরিয়ানি আর গলা নিয়ে নাববে না।
ফারাজ ঝাড়ি খেয়ে তার রুমে এসে দরজা বন্ধ করে বসে আছে।বাবার কথা গায়ে লাগার মতন।
কষ্ট দিয়ে কথা বলে ঠিক তবে সব সত্যিই বলে,ফাহাদ ভাইয়াকে যা যা বলেছে সব সঠিক।ভাইয়া বাড়িতে থাকেনা এটা একটা অপরাধ।বকা খাওয়া স্বাভাবিক। কিন্তু ফারাজ নিজে কেন বকা খেলো!
তার কি দোষ!!পূর্ণতাকে বিয়ে না করলে দাদাজান মাথা খাবে,আর বিয়ে করলে বাবা মাথা খাবে।কি একটা ফ্যাসাদে পড়ে আছে ফারাজ!!এর চেয়ে বরং বাড়ি ছেড়ে পালানোই শ্রেয়!
———-
সারথিকে নিয়ে আনাফ চেয়েছিল অধরার কাছে ফিরে যেতে।কিন্তু মা দিলোনা কারণ মা খুব ভাল করে জানেন এই রাতে ওদের দুজনকে একা দেওয়ার মানে কি দাঁড়ায়।তিনি সারথিকে একটা রুম দেখিয়ে দিলেন ঘুমানোর জন্য।এরপর নিজে ঘুমাতে চলে গেলেন।আনাফ সারথিকে দেখতে চেয়েছিল একবার কিন্তু মায়ের ভয়ে পারছিল না।
অনেকক্ষণ অপেক্ষা করে ফ্রেশ হয়ে সোজা মায়ের রুমের বাইরে গেলো দেখতে মা ঘুমিয়েছে কিনা।
দরজা একটু ফাঁক করে সে উঁকি দিয়ে দেখে মা ঘুমে।নাক ডাকছেন।দাঁত কেলিয়ে পা টিপে টিপে আনাফ এবার সারথির রুমের দিকে গেলো।এসে দেখলো সারথি বিছানার মাঝখানে বসে আছে,ঘুমায়না।
‘আসি?’
‘নাহ’
‘মা ঘুমে।জানতে পারবেনা কিছু’
‘আসতে হবেনা।আপনি নিজের রুমে গিয়ে ঘুমান’
আনাফ তাও ত্যাড়ামি করে রুমে ঢুকে গেলো।সারথির পাশে বিছানায় উঠে বসে বলািশ বুকে ধরে বললো,’দেখলে মা রাজি হয়ে গেছে’
‘আপনার বাবা তো রাজি হোননি’
‘আরে সেটাও হয়ে যাবে।কিছু খাবে তুমি?কি খাবে বলো, আমাদের ফ্রিজে সবসময় খাবার-দাবার থাকে। তুমি যেটা বলবে সেটাই খাওয়াবো’
——-
বোরকা পরে নিকাব টেনে হাতে ব্যাগ ঝুলিয়ে বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে পড়েছে পূর্ণতা।উদ্দেশ্য যেখানে পারবে সেখানে যাবে।
কিছুদূর এসে একটা বাসেও উঠে পড়েছে সে।মনে মনে শান্তি লাগলো, সব কিছু থেকে সে নিজেকে ছাড়াতে পেরেছে।
বাসের সিটে বসে জানালা পুরো মেলে দিয়ে চোখ বন্ধ করে রাখলো সে।কিছুক্ষণ পর মনে হলো তার পাশে কেউ একজন এসে বসেছে।
তাও সে চোখ খোলেনি।আরামসে চিল করছে।
‘প্লিজ জানালা বন্ধ করবেন?আমার হাঁপানির সমস্যা আছে’
এই কথা শুনে চমকে পূর্ণতা চোখ খুলে তাকালো পাশে।তার পাশেই ফারাজ বসে আছে। ফারাজের হাতেও ব্যাগ।সম্ভবত সেও পালিয়েছে।
পূর্ণতা নিজের কপালে নিজে একটা বাড়ি দিয়ে নিকাবটা খুললো।এবার ওকে দেখে ফারাজ নিজেই চমকে গেছে।
‘আপনি!!!’
‘আমি পালিয়েছি বলে আমায় কপি করলেন?’
‘যে সমস্যায় পড়েছি পালাবো না তো কি করবো?’
‘আর বাস পাইলেন না?’
‘জানালা বন্ধ করো।আমার অস্বস্তি লাগছে।’
——-
মতিন ফারাজ আর পূর্ণাকে একসাথে ব্যাগ হাতে বেরিয়ে যেতে দেখেছে।এখন সে হল রুমের মাঝে দাঁড়িয়ে চামচ দিয়ে কড়াই পিটতে পিটতে বললো,’সবাই এসে দেখে যাও।ফারাজ ভাই আর পূর্ণতা আপা পালাই গেছে।তাদের বিয়ো করালেনা বলে তারা পালালো, সবাই দেখে যাও’
মতিনের চিৎকার চেঁচামেচি শুনে সবাই যে যার রুম থেকে বের হয়ে আসে।মতিনের কাছে জানতে চায় সে কেন এত চিৎকার করছে।
এরপর মতিন যা বললো তা শুনে মানিক সাহেবের মাথা ঘুরে পড়ার মতন অবস্থা হলো।কিন্তু এই ক্ষেত্রে দাদাজান,আজিজ খান আর অরিন্দম বড়ই খুশি হয়।তাদের খুশি তারা প্রকাশ করলোনা তবে মনে মনে খুশিতে গদগদ হয়ে আছে।
চলবে♥#ডাকপাড়ি
#পর্ব_৪৬
#আফনান_লারা
________
দাদাজান মানিক সাহেবকে এই নিয়ে ৩নাম্বার পানির গ্লাস এগিয়ে দিলেন।মানিক সাহেবের অবস্থা দেখার মতন।তিনি ছেলে পালানোর শোকে কাতর। ঘন্টা দুয়েক আগে এই ছেলেকে কতইনা লেকচার দিয়েছিলেন তিনি,আর সেই ছেলে কিনা একেবারে পালিয়েই গেলো?এতদিন তো বাড়িতেই ছিল আর আজ বকা খেয়ে একেবারে পগারপার??
এটা তিনি মানতে পারছেন না।তার ধারণা দুজনে একসাথে পালানো মানে একেবারে ফিরলে বিয়ে করেই ফিরবে। এটা ভেবেই তার চোখ মুখের সামনে সব অন্ধকার নেমে আসছে।
মিসেস সোনালী পাশে দাঁড়িয়ে থেকে পরপর বাতাস করছেন ওনাকে।তিনিও মনে মনে খানিকটা হলেও খুশি।
পূর্ণতাকে তার ভালই লাগে।কিন্তু তারা না পালিয়ে বড়দের কথা মতন বিয়ে করে নিলেই পারতো,কষ্ট করে পালাতে গেলো কেন?
দাদাজান সবার সামনে এবার কথা পেশ করলেন।তিনি বললেন,’অনেক হয়েছে।আমরা ওদের ছোট ভেবে ছাড় দিতে দিতে ব্যাপারটা এতদূর গড়ালো।যদি শুরুতেই তাদের আচরণ বুঝে বিয়েটা পরিয়ে দিতাম আজ কি তারা পালাতো?আশেপাশের মানুষ জানলে কি হবে ভাবতে পারছো কেউ?মান সম্মান সব ডুবালো ওরা দুজন।আমরা কি তাদের বিয়ের খেলাপে ছিলাম?আমরা তো বরাবরই চেয়েছি তাদের বিয়েটা হোক।তারাই তো চেয়ে চেয়ো বিষয়টা খালি ঘুরিয়েই গেছে।তবে আজ কেন পালাতে হলো তাদের?দুজনের দুই জায়গায় বিয়ে ঠিক হওয়ায় তারা বুঝতে পেরে গেছে এখন আর লুকোচুরি করে লাভ নেই।আসলেই তারা একে অপরের সাথে জীবন কাটাতে চায়,অন্য কারোর সাথে সেটা করা তাদের কাম্য না।এবার সব খোলসা হয়ে গেলো।তোমরা আমার কথা মিলিয়ে নিও।এরপর ওরা আসলে যদি বিয়ে না করেও থাকে,ওদের ধরে বিয়ে করিয়ে দিব আমি।এটাই আমার শেষ কথা।সবাই সব সময়কার জন্য প্রস্তুত থাকো’
এই বলে দাদাজান উঠে নিজের ঘরে চলে গেছেন।সঙ্গে সঙ্গে আজিজ খান ও হাই তুলতে তুলতে চলে গেছে।
মানিক সাহেব হাতে থাকা পানির গ্লাসের সবটা পানি নিজের মাথায় ঢেলে নিজেও চলে গেছেন।
———–
পূর্ণতা ফারাজের কোলে মাথা দিয়ে ঘুমাচ্ছে।এই অসাধ্য সাধন জীবনেও হতোনা।ঘুমের নেশায় পড়ে শুরুতে ফারাজের ঘাড়ে মাথা চাপিয়েছিল সে।এরপর বাস ঢোলার সাথে সাথে সোজা ফারাজের কোলে তার মাথা চলে আসে।ফারাজ গালে হাত দিয়ে সামনের দিকে চেয়ে চলন্ত পথ দেখছে।যাকে বিয়ে করার ভয়ে তার বাড়ি ছাড়া হলো সেই মেয়েটাই এখন তর কোলে মাথা দিয়ে দিব্যি আয়েশে ঘুমিয়ে চলেছে।
কেন বারবার নিয়তি মিলিয়ে দিচ্ছে তাদের?তবে কি নিয়তিও চায় বিয়েটা হোক?
পূর্ণতার ঘুমের ডিস্টার্ব হলো এভাবে শুয়ে থেকে তাই চট করে উঠে পড়লো সে।চোখ ডলে ডানে বামে চেয়ে দেখে জানতে চাইলো তার এখন কোথায়।
‘কোথায় বলতে নির্দিষ্ট কোনো জায়গা নেই, আমরা কেবল যাচ্ছি।বাস শেষ যেখানে একেবারে থামবে,সেখানে নেমে যাব আমরা।এরপর আপনি আপনার পথে আর আমি আমার পথে’
‘আমি রোকেয়া হলে যাব,আর আপনি?’
‘আমি একটা মেসে থাকতাম ওটা রোকেয়া হলের কাছাকাছি। ওখানে চলে যাবো’
‘আচ্ছা একটা কথা ভেবেছেন?বাড়ির সকলে জানে রোকেয়া হল আর আপনার মেসে আমাদের দুজনকে পাবে। যদি তারা খুঁজতে খুঁজতে চলে আসে?তখন কি করবেন?
‘সেটাও ভাববার বিষয়।তবে আর যাবেন কই?এই আনাফের বাসায় যাবেন?’
‘ওটা তো অনেকদূর।যেতে যেতে ভোর হয়ে যাবে।এভাবে কাউকে না বলে যাওয়াটা কি ঠিক?’
‘সেটাও কথা।তবে যাবটা কোথায়??এখন বাড়ি ফিরলে নির্ঘাত সবাই মিলে ধরে বিয়ের স্টেজে উঠিয়ে দিবে।বাড়িতে যাওয়া মানেই বিয়ে।কি করা যায়?’
‘আচ্ছা আগে যেখানে ঠিক করেছি ওখানেই যাই।ওনারা ধরতে আসলে আমরা পালিয়ে যাবো।’
‘আমরা কি আগে থেকে জানবো ওনাদের আসার কথা?’
‘কি বিপদ!এবার কি হবে তাহলে?’
ফারাজ অনেক ভাবছে,সাথে পূর্ণতাও ভাবছে। রাত ১টা বাজে।কি থেকে কি করবে দুজনেরই অজানা।কি করলে দুজনেই বেঁচে যাবে কিন্তু ধরা খাবেনা!!
বাস ছেড়ে ফারাজ আনাফের নাম্বারে একটা কল করে।আনাফ সেসময় ঘুমাচ্ছিল।তার ফোন ভাইব্রেট হয়ে যাচ্ছে।সে টের পায়নি কলের।
ফারাজ অনেকবার কল করেও ওকে পায়নি।তাই ঠিক করেছে আন্দাজেই যাবে সাইনবোর্ডের দিকে।
দুজনে এবার সাইনবোর্ডের একটা বাস ধরে।আনাফকে না জানিয়েই ওদিকে যাচ্ছে দুজন।সারথি আপু সব ম্যানেজ করে নিবে।এটা কোনো ব্যাপার না।
———–
সকালে আনাফ নাস্তা সেরে মাকে বলে হাসপাতালে চলে গেছে।আর সারথিকে বললো সজীবদের বাসা থেকে ঘুরে আসতে।
মা ওদের দুজনকে বিদায় দিয়ে নিশ্চিন্তে দরজা বন্ধ করলেন।সারথি মনে মনে ভাবছিল অমাফ হঠাৎ বদলে গেলো কেন।সে কি ভেবে ওকে আবার সজীবদের বাসায় যেতে বললো?এই কথা বলার মানুষ তো আনাফ না!
এত কিছু ভাবতে ভাবতে সারথি হাতিয়ে হাতিয়ে সজীবের বাসার কলিংবেলে টিপ দিতেই যাচ্ছিল ওমনি ওর হাত আটকে ধরে আনাফ।
হাঁপিয়ে বললো,’আরে তোমায় সজীবের বাসায় যেতে বলেছি তার মানে কি সত্যি সত্যি যাবে?মাকে শুনাতে বলেছি যাও।তুমি জানোনা আমি কি চাই?’
‘আপনি তো বললেন সজীবদের বাসায় যেতে,আর এই বলে আপনিও হাসপাতালে চলে গেলেন’
‘সব নাটক ছিল।তোমার কি মনে হয়,মাকে যদি বলতাম আমি সারথিকে নিয়ে অধরার কাছে যাচ্ছি,মা মেনে যেতো?’
‘তাও ঠিক।আচ্ছা চলুন যাই’
আনাফ হাসিমুখে সারথির হাতটা ধরে হাঁটা ধরে, ওমনি পেছন থেকে উর্মির ডাক শুনতে পেলো দুজনে। উর্মি মর্নিং ওয়াকের জন্য বেরিয়েছিল।ওখান থেকে এসে ছাদে ছিল এতক্ষণ।
সেখান থেকে নিচে নামতে গিয়ে আনাফ আর সারথিকে একসাথে দেখেই সে থামতে বলে।
‘ভাবী তুমি এখানে,এত সকালে?বাসায় না ঢুকে চলে যাচ্ছো কেন?’
সারথি চুপ করে উর্মির কথা শুনে গেলো,কিছুই মুখ ফুটে বললোনা।
আনাফ সারথির হাতটা আরও শক্ত করে ধরে রাখলো।উর্মি ওদের হাত ধরাধরি দেখে ব্রু কুঁচকে বলে,’তাহলে কি সজীব ভাইয়ার সন্দেহই ঠিক?ভাবী তুমি আনাফ ভাইয়াকে পছন্দ করো?’
সারথি মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে,আনাফ নিজে থেকেই বলে উঠলো’তোমার ভাবী পছন্দ করলেও কি না করলেও কি?আমি ওরে পছন্দ করি।কদিন পর আমাদের বিয়ে।আর তুমি হয়ত জানোনা তোমার গুনধর ভাই সারথিকে ডিভোর্স দিয়েছে একটা সাদা চামড়ার, সাদা চুলের মেয়ের জন্য।সাদা ধুই পানি খাবে তোমার ভাই!!যেমন চোর পালাইলে বুদ্ধি বাড়ে তেমনই তোমার ভাই ঠিক কোন জিনিস হারাইছে,এবং সেই জিনিস আমার ঘরে আসি আলোকিত হইলে বুঝতে পারবে।এখন বুঝবেনা।এখন সে সাদা চামড়ার কম্বল বানিয়ে ঘুমাচ্ছে।আমি সারথিকে বিয়ে করে নিই তারপর দেখিও তোমার ভাইয়ের ঘুম কেমনে গায়েব হয়।কি হারাইছে খুব জলদি বুঝতে পারবে,কাঁদবে,জ্বলবে,পুড়বে।জ্ঞান হারাবে তাও সারথিকে পাবেনা।তার কাছে সব চাইতে কষ্টের কি লাগবে জানো?দুই তিন বছরের বিবাহিত জীবনে সে এত সুন্দর একটা মানুষকে ছুঁয়ে দেখেনি।আনাফ ছুঁলে এবার তার চামড়া পুড়বে,এটা মনে করেই আমার পৈশাচিক আনন্দ লাগছে মনে’
উর্মি হতবাক হয়ে আনাফের কথা শুনছে।এত কিছু হয়ে গেলো আর সে কিছুই জানেনা!!
সারথির হাত টানতে টানতে উর্মির সামনে থেকে আনাফ নিয়ে চলে গেছে।
উর্মির হুশ ফেরায় সে ছুটে বাসার ভেতর গেলো মাকে সবটা জানানোর জন্য।
মা তখন টেবিলে খাবার সাজাচ্ছিলেন।ছুটতে ছুটতে এসে মায়ের সামনে দাঁড়িয়ে সে এখন আর কথা বলতে পারছেনা।কথা গলা অবধি এসে আটকে গেছে।
‘কিরে কিছু বলবি?এত ছুটলি কেন?’
‘মা জানো সজীব ভাইয়া কি করছে?’
‘কি করছে আবার?’
‘সারথি ভাবীকে নাকি ডিভোর্স দিয়ে দিছে।আর আমরা দুজন এ ব্যাপারে কিছুই জানিনা’
মা চোখ বড় করে বললেন,’কে বলেছে তোকে এসব?যতসব বাজে কথা’
‘আরেহ মা সত্যি।আনাফ ভাইয়া বললো আমায়’
‘আনাফ কে আবার?’
‘আমাদের বাড়ির মালিকের ছেলে আনাফ।চিনো না?’
‘তো সে এসব জানলো কি করে?’
‘আনাফ ভাইয়াই তো সারথি ভাবীকে এখন বিয়ে করতে চায়’
‘এই তোর মাথা ঠিক আছে??কি বলছিস এসব?সকাল সকাল কি গ্যাস্ট্রিকের সমস্যা হলো তোর?নে ধর ঔষুধ খা’
উর্মি চেয়ার টেনে বসে প্যান্টের পকেট হাতিয়ে ফোন বের করে এরপর সজীবকে কল করলো।
মা তখন বললেন,’এখন সজীবদের ওখানে রাত।তুই ওকে ডিস্টার্ব কেন করছিস?’
সজীব ঘুম ঘুম চোখে উর্মির কলটা দেখছে।সকালে উর্মি কখনওই কল করেনা।ওর বিয়ের কথা শুরু হবার পর থেকে তো তিন চারদিন পরে একটা কল দেয় তাও বিকালে।আজ হঠাৎ সকালে করলো দেখে লাফ দিয়ে উঠে বসে পড়েছে সজীব।রিসিভ করে সবার আগে জানতে চাইলো সারথি ঠিক আছে কিনা।
‘ভাইয়া তুমি সারথি ভাবীর খবর নিচ্ছো?তাহলে কি তোমার আর ভাবীর ডিভোর্সের কথাটা মিথ্যা?’
সজীব বুঝে গেছে সারথি কথা প্রকাশ করে ফেলেছে। ওকে চুপ থাকতে দেখে উর্মি আবার জানতে চাইলো কথাটা।
‘হুম সত্যি।আমাদের ডিভোর্স হয়ে গেছে’
‘তাহলে আবার ওর কথা জানতে চাইলে কেন?আর আমাদের কাউকে জানালে না কেন?’
‘জানতি আস্তে আস্তে।’
‘এটা কি ছোটখাটো ব্যাপার?ধরো মায়ের সাথে কথা বলো।আমি কিছু জানিনা’
‘কিরে সজীব?উর্মি এসব কি বলছে?’
‘মা আসলে আমি!’
‘এটা যদি সত্যি হয়ে থাকে তবে আমি তোর সাথে এখন কথা বলতে চাচ্ছিনা।’
এই কথা বলে মা লাইন কেটে দিলো।সজীব জানতো মা জানলে এমনটাই হবে। মা এটা কিছুতেই মেনে নিবেননা।
উর্মি মায়ের মুখের দিকে চেয়ে থেকে বললো,’কেন এমন হলো মা?ভাইয়া আর ভাবী কি সুখী ছিল না?’
‘তোর ভাই শুরু থেকেই বিদেশী একটা মেয়ের জন্য পাগল ছিল।আমি ভেবেছিলাম বিয়ের পর ঠিক হয়ে যাবে কিন্তু এখন মনে হয় আমি ভুল ছিলাম।তোর ভাই আজও সেই মেয়ের জন্যই দিবানা হয়ে আছে। আর তাই সারথিকে ডিভোর্স দিলো তাও আমাদের কাউকে না জানিয়ে।তার মানে দোষটা সজীবেরই!!’
———-
অধরা ভোরের দিকে দরজা খুললো প্রাইভেট পড়তে যাবে বলে।দরজা খুলতেই দেখলো দূর থেকে ফারাজ আর পূর্ণতা আসছে এদিকে।ওদের দেখে সে চিনেছে।ফারাজ কাছে এসে বললো,’ভাল আছো অধরা?আনাফ আর সারথি কোথায়?’
‘তারা তো কাল কোথায় যেন গেছিলো,আর ফেরেনি’
‘এখন বাসায় কেউ নাই?’
‘বুয়া আছে,নাস্তা বানাচ্ছে।আপনারা এত সকালে?কিছু হয়েছে নাকি?’
‘নাহ হয়নি।আসলে আনাফের সাথে কথা ছিল।’
‘আপনারা ভেতরে গিয়ে রেস্ট নিন।আমি প্রাইভেট পড়তে যাই।ভাইয়া হয়ত আজকে চলে আসবে আবার।যতদূর জানি তারা মনে হয় নানুর বাড়ি গেছে’
এই বলে অধরা চলে গেলো।পূর্ণতা সারারাত বাসে থেকে ভালমতন ঘুমাতে পারেনি।কোনোরকমে ভেতরে এসে সামনে যে রুম পেয়েছে ওটাতেই ঢুকে ধপাস করে শুয়ে পড়ে।
ফারাজ সোফাতে বসে ঝিমোচ্ছিল।সে নিজেও ঘুমায়নি সারা রাত।এত দূরের জার্নি ছিল কাল রাতের!!
——–
বুয়া ফারাজ আর পূূর্ণতাকে দেখে বারতি রুটি বানাতে বসে গেছে তারপর কি ভেবে মাথা বের করে উঁকি দিয়ে বললো,’ভাই আপনারা কি হোন আনাফ ভাইয়ের?’
‘আমার বোন সারথি আনাফের খুব ভাল বান্ধবী’,
‘বান্ধবী?শুনেছি ভাইয়ে আপাকে বিয়ে করবে’
‘কে বলেছে?’
‘ভাই নিজেই তো বলেছে।আপনি জানেন না?’
‘না তো!’
‘আচ্ছা ভেতরের রুমে যে মেয়ে ঘুমায়,ও আপনার কি হয়?’
‘কিছু হয়না’
কথাটা শুনে বুয়া চুপচাপ আবার নিজের কাজে মন দিলো
“””””যখন একটা ছেলে একটা মেয়েকে নিয়ে ঘোরে আর কেউ ওর ব্যাপারে জিজ্ঞেস করলে বলে কিছু হয়না তার মানে দাঁড়ায় ঐ মেয়েটা তার সবকিছু।শুধু নাম দেয়া হয়নি বলে আলগা আলগা ভাব’
———–
আনাফ গাড়ীতে উঠার পর থেকে কিছু বলছেনা।সারথি অনেকক্ষণ চুপ থাকার পর নিজেই বললো,’আচ্ছা আপনি উর্মিকে এত কথা বলতে গেলেন কেন?’
‘যেটা সত্যি সেটা বলেছি।আর আমি ওকে এসব বলেছি যাতে করে কথাগুলো কপিপেস্ট হয়ে সজীবের কানে যায়।সজীবকে জ্বলাতে হবে ভুষি ঢেলে ‘
‘আমি ওনাকে জেলাস ফিল করাতে চাইনা।উনি ভাল থাকুক এটাই চাই’
‘শোনো,সজীব তোমাকে চিট করছে।এখন তুমি ওরে বেশি বেশি বদদোয়া দিবা।যাতে করে সে নদীর দুই কূল হারায়।সিনেমার নায়িকাদের মতন সজীবের ভাল কেন চাইতেছো??ও তোমার কি লাগে?’
‘কিছুই হয়না আমার’
‘তাহলে বদদোয়া দিবা।বলবা যেন ওর সাদা চামড়ার জিএফ আরেক ছেলের সাথে পরকিয়া করে ওর সামনে ধরা খায়।তাহলে সে বুঝবে সারথিকে কিভাবে সে ধোকা দিছিলো’
চলবে♥#ডাকপাড়ি
#পর্ব_৪৭
#আফনান_লারা
________
সারথিকে নিয়ে আনাফ তার বাসায় ফিরে দেখে সোফায় ফারাজ ঘুমাচ্ছে।ভেতরের রুমে পূর্ণতা ঘুমাচ্ছে।এগুলো সে হা করে দেখছিল,সারথি তখন বললো,’কি হয়েছে?নড়ছেন না কেন?ভূত দেখলেন নাকি?’
‘তোমার ভাই আর ভাইয়ের হবু বউ দুুজন দুই জায়গায় ঘুমাচ্ছে।সেটা দেখে অবাক হলাম আর কি ‘
‘মানেহ?ওরা এখানে আসলো কই থেকে?আপনি কি সত্যি বলছেন?’
‘হুম।ফারাজ সোফায়,পূর্ণতা তোমার রুমে,, ঘুমে দুজনেই’
সারথি তাই আনাফকে বললো ফারাজকে ডেকে তুলতে।কিন্তু আনাফ মানা করে তার এই কথায়।কারণ সকালে যারা এমন করে ঘুমায় তারা নিশ্চয় রাতে ঘুুমায়নি।তাই ওদের ঘুমাতে দেয়া উচিত বলে আনাফ সারথিকে ফ্রেশ হতে চলে যেতে বলে সেও গেলো নিজের রুমের দিকে।সারথি ও আর নিজ থেকে ফারাজকে ডাকেনি।
———–
বুয়া নাস্তা টেবিলে সাজিয়ে ঘুমন্ত ফারাজকে দেখে ভাবছিল ডাক দিবে নাকি দিবেনা,সেসময় আনাফ গায়ে তোয়ালে ঝুলিয়ে চেয়ার টান দিয়ে বসতে আসতে বললো,’সারথিকে ডেকে আনো।’
‘ওনাদের ডাকবোনা?’
‘ওদের খাবারটা ঢেকে রেখে দাও।দুজনে ঘুমাচ্ছে,ঘুমাক’
বুয়া মাথা নাড়িয়ে সারথিকে ডাকতে গেলো, সারথি বারান্দায় ছিল।বুয়া গিয়ে ওকে নিয়ে এসেছে।
এখন আনাফ আর সারথি দুজনে কোনো আওয়াজ না করে নাস্তা করে চলেছে।
একটা সময় সারথি বলে উঠলো,’এবার ডাক দেই?’
‘ভাই তোমার নাকি আমার??একটুুও মায়া দরদ নাই?দেখোনা কি সুইট করে ঘুমাচ্ছে সে?’
‘সেটাই তো সমস্যা,এই সাত সকালে এখানে ওরা দুজন কেনো আসলো আর এখনই বা কেন এমন বেঘোর ঘুমোচ্ছে?’
‘কারণ অবশ্যই আছে।তারা উঠুক না, তারপর নাহয় জানা যাবে’
‘আমার গলা দিয়ে খাবার নামছেনা।জানা জরুরি’
আনাফ আরও কিছু বলতে চাইলো কিন্তু তার আগেই ওর ফোনে একটা কল আসে।আননউন বিদেশী নাম্বার।খাবার ছেড়ে ফোন কানে ধরে সে রুমে চলে আসলো।
ওপাশ থেকে শোনা গেলো,’হাই’
আনাফ ও বললো “হাই।”
‘আর ইউ আনাফ?’
‘ইয়েস।হু আর ইউ?’
‘আমি সজীব।’
সজীব নাম শুনে আনাফ বুঝে গেছে পানি ঘোলা হয়ে গেছে। তাই সে চুপ করে থাকলো।সজীব আবার বললো,’বিচ্ছেদের পরে মেয়েদের ভাল সিমপাথি দেখিয়ে,পটিয়ে যে সব ছেলেরা মন জুগায়তে পারে ঐ ছেলেগুলোকে সহজেই মেয়েরা আপন করে ফেলে।তাই না আনাফ?তুমি হয়ত বয়সে আমার বয়সী হবে।তাই তুমি বলছি। সেদিন ও তুমি বলছিলাম।তোমার কি মনে আছে??আমাদের কিন্তু দেখা হয়েছে আগে।’
‘হুম মনে আছে’
‘আমি এতক্ষণ যা যা বললাম শুনেছো নাকি আবার রিপিট করবো?’
‘ফালতু কথা শুনতে সমস্যা হয়না তেমন।আমার কানের পর্দা শক্ত’
‘ফালতু কথা?আমি ফালতু কথা বলেছি?’
‘পঁচা পানিতে ডিপকল বসালে কল দিয়ে পঁচা পানিই বের হয়।তেমনই যে মানুষটা নিজেই ফালতু তার কথাও তো ফালতুই হবে তাই না?’
‘তুমি শুরুতেই বেয়াদবি করছো আনাফ!’
‘তুমি আমার মুরব্বি না যে তোমার সাথে বেয়াদবি করা যাবেনা।সত্যি কথা বলা যদি বেয়াদবি হয় তবে হ্যাঁ,আমি বেয়াদবি করতেছি।এখন কি কারণে কল করেছো?গা জ্বলা শুরু করেছে নাকি?’
‘শাট আপ!তোমার মতন ডাক্তার আর দেখি নাই।মানে মেয়ের কি অভাব পড়েছে??শেষে বিবাহিত?? ‘
‘অবিবাহিত একটা মেয়ের চেয়ে যদি বিবাহিত একটা মেয়ের চরিত্র আমার চোখে অসাধারণ হয় তবে বিবাহিতই শ্রেয়! ‘
‘লজ্জা করেনা তোমার আনাফ?’
‘সেম প্রশ্ন আমিও করতে পারি সজীব।তোমার লজ্জা করেনা?ডিভোর্স তো দিয়ে দিছো।তোমার বউ আর তোমার নাই।তোমার আবার জিএফ ও আছে।এখন আবার তোমার এক্স ওয়াইফকে লাগবে?
কতগুলা লাগবে তোমার সজীব??এত কেন জ্বলছে?একটা মেয়েকে বছরের পর বছর ফালাই রাখছিলা অবহেলা করে।এখন তারে ছেড়ে দিয়ে তার দাম বুঝে নাচানাচি আসতেছে তোমার?নাচো।আমাকে ডিস্টার্ব করবানাা।যমুনা ফিউচার পার্কে যাব বিয়ের মার্কেট করতে,রাখছি’
————
সারথি চায়ের কাপ নিয়ে বসে আছে ফারাজ থেকে একটু দূরে।চা খেতে খেতে জোরে জোরে চায়ের কাপ রাখছিল সে টেবিলের উপর।আওয়াজটা ইচ্ছে করেই করছে কারণ সে চায় ফারাজ ঘুম থেকে উঠুক।জরুরি কথা বলা মানুষটা যদি ইচ্ছে করে দেরি করে,,, কথা বলায় দেরি করে তখন ঐ মানুষটাকে কোনো কিছুর বিনিময়ে পিটাতে ইচ্ছে করে।নিজের ভাই বলে এখন আওয়াজের মাধ্যমে তার স্বাদের ঘুম ভাঙ্গানোর আইডিয়া ছাড়া সারথির কাছে আর কোনো উপায় নাই।
সে সফল হয়েছে।তার খটখট আওয়াজে ফারাজ জেগে গেলো।হাই তুলতে তুলতে উঠে বসে দেখে সামনে সারথি বসে বসে চা পান করছে।
ফারাজ এবার পা নামিয়ে বসে।চোখ বুলিয়ে পূর্ণতাকে একবার খুঁজে নেয়।তার হদিস কোথাও নেই,তার মানে সে এখনও ঘুমে।যাই হোক আপাতত সারথির মুড দেখে বোঝা গেলো সে তাদের হুটহাট এখানে চলে আসা নিয়ে বিভ্রান্তিতে আছে।
‘কেমন আছো সারথি?’
‘ভালো।’
এই বলে সারথি চায়ের কাপটা একেবারে রেখে দেয় টেবিলের উপর।মানে সে শুনার জন্য প্রস্তুত ওদের এখানে আসার কারণ।
ফারাজ বলতে চাইছেনা।মাথা ঝিম ধরে আছে।চা খেয়ে শরীর তাজা করলে হয়ত কথা বের হতো কিন্তু সারথিকে এমন অধৈর্য্য হতে দেখে সে নিজের ঘুমকে বিদায় দিয়ে বলাই ধরছিল তাদের এখানে আসার কারণ ওমনি ভেতর থেকে আনাফ এসে বললো,’একি ফারাজ উঠে পড়লে?তোমার বোন ডাকছে নাকি তোমায়?জানো আমি হাজারবার মানা করেছি।
ভাইয়ের প্রতি বোন যে এত হিংসুক হয় তা তোমাদের দেখে সিওর হলাম।আমাকে নিয়ে অধরা কিন্তু এমন করেনা,তোমার বোন কেন যে এমব করছে!’
সারথি তখন রেগে গিয়ে বললো,’তেমন কাজ করলে তো হবেই।ফারাজকে জিজ্ঞেস করেন সে পূর্ণতাকে নিয়ে হুট করে এখানে কি জন্য আসলো আর এসেই ঘুমিয়ে পড়লো কেন?তারা কি রাতে বাড়ির বাইরে ছিল?’
ফারাজ নিজের মাথা চুলকাচ্ছে।লজ্জায় কি বলবে ভেবে পাচ্ছেনা।আনাফ কিছুটা হলেও আন্দাজ করে নিলো তাই সে ফারাজের পাশে বসে বললো,’যা হয়েছে পরে শোনা যাবে।যাও ফ্রেশ হয়ে আসো,নাস্তা করো।’
‘না।আগে ওকে বলতে হবে।আপনি বারবার কথাটাকে কেন ঘুরাচ্ছেন?’
ফারাজ এবার ধীর স্বরে বললো,’আমি আর পূর্ণতা বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে এসেছি।আসলে আমরা একসাথে না।আলাদা আলাদাই পালিয়েছিলাম তাও কিভাবে যেন এক বাসে উঠে পড়েছি।এরপর কোথায় যাব ভেবে না পেয়ে এখানে আসলাম’
এটা শুনে সারথি আশ্চর্য হয়ে গেছে।আনাফ মিটমিট করে হাসছে শুধু।
—–
‘তোরা পালাতে গেলি কেন?’
‘বাড়ির সবাই আমাদের দুজনের বিয়ের পেছনে লেগেছিল।পালাতেই হতো’
‘তো এখন যে একসাথে পালালি।জীবনে দাদাজানের সামনে গিয়ে দাঁড়াতে পারবি তোরা দুজন?’
‘জানি পারবোনা তাই তো এখানে এলাম’
সারথি মাথায় হাত দিয়ে বসে আছে।আনাফ আগাগোড়া বুঝলোনা
দুজনে বিয়ের ভয়ে পালিয়েছে এটা ঠিক তবে একসাথে কেন পালিয়েছে?
‘আচ্ছা তোমরা কি একজন আরেকজনকে বিয়ে করার ভয়ে পালিয়েছো?’
‘হুম’
‘তবে একসাথে কেন পালালে গাধা রে!!!”
‘এটা পূর্ণতার ভুল।সে আমার বাসে উঠেছে’
ভেতরের রুম থেকে পূর্ণতা হনহনিয়ে কাছে এসে বললো,’আমার দোষ দিচ্ছেন?বাসে আগে আমি উঠেছিলাম।এরপর আপনি উঠেছিলেন’
‘আচ্ছা তোমরা দুজন থামো।ভুল হয়েছে বুঝেছি।আপাতত দুজনেই সেফ আছো।কিন্তু তোমরা কি এটা ভেবেছো বাড়ি ফিরলে তোমাদের নির্ঘাত বিয়ে পরিয়ে দিবে?’
‘জানি আনাফ ভাইয়া।এবার বুদ্ধি দেন কি করবো?’
আনাফ মুচকি একটা হাসি দিয়ে বলে ফেললো তাদের দুজনের বিয়ে করা উচিত।কারণ দুজনে বিয়ের ভয়ে পালিয়েও তারা দুজন এখনও একসাথে,তার মানে দাঁড়ায় বিধাতাও চায় তাদের বিয়েটা হোক।আর দেরি না করে বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে যাওয়া উচিত তাদের।
ফারাজ আর পূর্ণা এই কথা শুনে দুজনেই রেগে গেলো।যেখানেই যাচ্ছে তারা সেখানের মানুষই উপদেশ দেয় বিয়ের।
মানে তাদের দুজন রেখে কি দুনিয়াতে আর কোনো ছেলেমেয়ে নাই?
ফারাজের জন্য কি মেয়ে নাই?
পূর্নার জন্য কি ছেলে নাই?
এই কথার উত্তরে সারথি বললো,’কোটি কোটি আছে।কিন্তু বিয়ে তো একজনের সাথেই হয়।কোটিজনের সাথে হয়না’
———-
জনাব বেলায়েত হোসেন মার্কেটে এসেছেন একটা পাঞ্জাবি কিনবেন বলে।সাথে এসেছে আজিজ, অরিন্দম আর জোরপূর্বক আনা হয়েছে মানিক সাহেবকেও।
বেলায়েত আর আজিজ খান মিলে যেই পাঞ্জাবি সুন্দর বলছেন সেই পাঞ্জাবিটাকে খারাপ বলে সম্বোধন করছেন মানিক সাহেব।
শেষে বিরক্ত হয়ে আর তাকে জিজ্ঞেস করাই বন্ধ করে দিছেন ওনারা।
মানিক সাহেব রাগে ফুলতে ফুলতে দোকানের একটা চেয়ার দখল করে বসে রইলেন।অরিন্দম দুটো কাপ চা নিয়ে ওনার কাছে এসে বললো,’খাবেন দাদা?’
‘আপনি খান’
‘আমি তো এই এক কাপ খাবো,বাকি কাপটা নাহয় আপনি খান’
রাগ থাকার সত্ত্বেও মানিক সাহেব চায়ের কাপটা হাতে নিয়েছেন।চুমুক দিতেই তার রাগ একটু হলেও কমে গলো।
চা ছিল দারুণ।অরিন্দমের উপর সন্তুষ্ট হলেন তিনি এরপর কথায় কথায় বলে উঠলেন,’আমার ছেলে কোটিতে একটা জানো?’
‘জানি,আপনার পরিবারকে আমি চিনবোনা?সেই পরিবারের ছেলে যে কি পরিমাণ ভাল হবে তা নিয়ে আমার কোনো সন্দেহ নেই’
‘আমি মানতে পারিনা তোমার মেয়ে আমার ছেলের বউ হবে। আমার চাহিদা আরও বেশি ছিল!’
‘দাদা একটা কথা বলি?আপনার ফারাজ যেমন কোটিতে একটা মনে করেন আমার মেয়েটিও তেমন।
ওর মাঝে কোনো খারাপ নেই।আমি ওকে সব শিক্ষা দিয়ে বড় করেছি।গুরুজনদের সম্মান করা,ছোটদের স্নেহ করা।কোনো কিছু বাদ রাখিনি। আশা করতে পারি সে আপনার মাথা কখনও নত হতে দিবেনা’
‘আমি আশা করেছিলাম বড়লোক ঘরের মেয়ে হবে,ফকফকা ফর্সা হবে।আমার ছেলে তো ফর্সা।ওর সাথে তো ফর্সাকেই মানাবে’
অরিন্দম দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বলে,’দাদা আপনার ছেলে কিন্তু বড়লোক,সাদা দেখে প্রেমে পড়েনি।সে আমার মেয়ের মন দেখেছে’
‘আমার ছেলে যে তোমার মেয়েকে ভালবাসে সেটার কি গ্যারান্টি? সে তো শুরু থেকেই বলছে পূর্ণাকে সে বিয়ে করতে চায়না’
‘তাহলে সে অন্য কাউকে কেন বিয়ে করছেনা?নিজেকে মিথ্যা বাহানা দিয়েন না আর।আপনার ছেলে একজনেই মুগ্ধ হয়ে আছে’
———
পূর্ণতা মুখে রুটি পুরতেই দেখে বুয়া বড় বড় চোখ বের করে ওকে দেখে যাচ্ছে।খাওয়া বাদ দিয়ে সে জানতে চাইলো উনি কিছু বলবেন কিনা।এটা শুনেই তিনি বললেন,’হ্যাঁ বলবো তো।আচ্ছা আপনারা কি জামাই বউ?’
‘না’
‘তবে কি জামাই বউ হইবেন?’
‘সেটাও না’
‘তাহলে এই বাড়িতে দুবার আসলেন।দুইবারই একসাথে।আপনারা কি হোন তাহলে?’
‘আমরা কিছু হইনা’
‘তাহলে একসাথে কি করেন?’
পূর্ণতা মাথায় হাত দিয়ে বুয়ার দিকে চেয়ে আছে।ফারাজ গাপুসগুপুস করে নাস্তা করেই চলেছে।বুয়া যে পূর্ণাকে পেঁচিয়ে ধরেছে সে দিকে সে খেয়ালই করে নাই।
শেষে বুয়ার কথার সাথে পেরে না উঠে পূর্ণতা টেবিলের নিচে পা দিয়ে ফারাজকে একটা খোঁচা দিলো।ফারাজ ওমনি তাকালো বুয়ার দিকে।কারণ বুয়াই সামনে ছিল।
বুয়া দাঁত কেলিয়ে বলে,’ভাই আমার দিকে তাকাইলেন ক্যান?খোঁচাটা আপামণি দিছে’
পূর্ণতার মাথাটা একেবারে হেট হয়ে গেছে।ফারাজ সরাসরি পূর্ণতার মুখের দিকে তাকিয়ে ছিল,বুয়া এবার হাসতে হাসতে চলে গেলেন ওখান থেকে।
‘খোঁচা দিলেন কেন?’
‘আপনি দেখছেন না বুয়া কত প্রশ্ন করছে?’
‘বলে দিন আমরা কেউ কারোর কিছু হইনা’
‘ওটাই তো সমস্যা। কেউ কারোর কিছু হইনা তাও দিনশেষে ঘুরেফিরে আমরা একসাথেই থাকি ‘
চলবে♥