ডাকপাড়ি পর্ব -৪৮+৪৯+৫০

#ডাকপাড়ি
#পর্ব_৪৮
#আফনান_লারা
________
সোফায় অধরা মাঝে বসে আর দুপাশে ফারাজ পূর্ণতা সহ বসে টিভিতে একটা সিনেমা দেখছে।সিনেমার নাম”বিয়ের ফুল”

অধরা মনযোগ দিয়ে দেখছিল বটে কিন্তু ফারাজ পূর্ণতা একটুও মনযোগ দিতে পারছিল না।দুজনের মাথায় বিয়ের বোঝা চেপে বসে আছে এমন ভাবে যেন বিয়ে শব্দটা দুজনেরই এখন ঘাড় মটকে দেবে।ছবিটা তাদের কাছে বিষের মতন মনে হচ্ছিল কেবল।
অধরা যে মিষ্টিভাবে সব দেখছিল তারা দুজন তার ঠিক উল্টো চাহনিতে দেখছিল।তাদের মন চাইছে টিভির ভেতরে গিয়ে সিনেমার সকলের গলা টিপে ধরতে।সব খানে শুধু বিয়ে আর বিয়ে।
বিয়ে ছাড়া কি দুনিয়ায় আর কিছু নাই?
দুজনেই বিরক্ত এবং দুজনেই একসাথে একে অপরের দিকে একই সময় তাকায়।দুজনে চোখের ইশারাতে একজন আরেকজনের সাথে সিওর হয়ে নিলো যে সিনেমাটি তাদের দুজনের কাছেই অসহ্যকর লাগছে।তাই একসাথেই তারা উঠে চলে যাওয়া ধরলো ওমনি বুয়া হাতে পপকর্ণ এনে টেবিলে রেখে নিচে একটা মোড়া পেতে টিভির সামনে বসে বললো,’আপনারা উঠে চলে যান ক্যান?ছবি দেখবেন না?’

ফারাজ আর পূর্ণতা একসাথে বললো,’বিয়ে নিয়ে বানানো সিনেমা তারা দেখবেনা’

বুয়া জানতে চাইলো কেন দেখবেনা।

এবার দুজনে একসাথে বলে,’কারণ সেটা বিয়ে নিয়ে বানানো ‘

অধরা মুচকি মুচকি হাসতে হাসতে পপকর্ণের বাটিটা কোলে তুলে বললো,’বাদ দাও,ওনাদের যেতে দাও বুয়া।ভাইয়া বলছে ওনারা বিয়ে করবেন না,বিয়ে নিয়ে কিছু দেখবেন না,শুনবেননা কিন্তু একসাথে প্রস্থান করবে ঠিকই’

এটা বলে বুয়া আর অধরা হাসিতে লুটিয়ে পড়ে।পূর্ণতা, ফারাজের কাছে বিষয়টা দৃষ্টিকটু লাগলো। যার কারণে তারা দুজন বাসার বাইরে চলে গেছে।
এখন আনাফের বাসার বাইরের ছোট্ট বাগানে দুজনে চুপটি করে বসে থাকলো।
ফারাজ আকাশ দেখছে আর পূর্ণতা ঘাস ধরে ধরে দেখছে।ঘাসগুলো মনে হয় কদিন আগেই কাটা হয়েছে।সবগুলোর মাথা নাই।হাত বুলিয়ে পূর্ণতা বললো,’ভাবছি বাবাকে ছাড়াই ভারতে চলে যাবো’

‘কেনো?’

‘বাবা আমার সঙ্গে যেতে রাজি নয়।আর আমি এখানে থাকলে সবাই মিলে আপনার সঙ্গে বিয়ে পরিয়েই দেবে একদিন না একদিন’

‘তো যান।’

‘সেটাই তো সমস্যা! আমার তো পাসপোর্ট নাই!ওটা করতে অনেক সময় লেগে যাবে।ততদিন কি বিয়ের বাইরে থাকতে পারবো?’

‘আমার নাহয় বোন এখানে তাই আমিও এখানে এসে হাজির হয়েছি।আপনি গিয়ে রোকেয়া হলে থাকুন না।আপনাকে একা পেয়ে তো কেউ কিছু করবেনা’

‘আমার যদি গলা টিপে ধরে জানতে চায় আপনি কোথায় আমি তো বলতে বাধ্য হবো। আমি আবার হুমকি-ধামকি ভয় পাই।’

‘এতকিছু ভাবলে তো হবেনা।আমাদের একসাথে থাকা ঠিক না
তাও কেন আমরা একসাথে থাকছি?এখন সবাই মিলে যে হাসাহাসি করছে আমাদের নিয়ে।এটা কি মানা যাচ্ছে?’

‘আমার উপর সব কাজের ভার না দিয়ে নিজেও তো কিছু করতে পারেন।নিজে অন্য একজনকে বিয়ে করে নিলেই পারেন।অন্তত আমাকে বিয়ে করতে হবেনা আপনাকে’

‘তা সঠিক কিন্তু আমি আপাতত কাউকেই বিয়ে করতে চাইছিনা’

‘আপনি নিজেও কিছু করবেন না।আবার আমাকেই সব করতে বলবেনা।এভাবে চললে তো নির্ঘাত কপালে বিয়ে’
———
সারথি আনাফের রুমের বাইরে এসে দরজায় হাত দিয়ে কয়েকবার নক করে জানতে চাইলো সে ভেতরে আসতে পারবে কিনা।
আনাফ সেসময় ভিডিও কলে তার এক রুগীর সাথে কথা বলছিল তাই সে ওকে পাঁচ মিনিট দাঁড়াতে বলে।সারথি তাই দাঁড়িয়ে ছিল পাঁচ মিনিট।
ঠিক পাঁচ মিনিট হতেই আনাফের কথা বলা শেষ হয় এবং সে ল্যাপটপ অফ করে সারথিকে ভেতরে ডাকে।সারথি দেয়াল ধরে ধরে ভেতরে এসে বললো,’আপনার সাথে আমার কিছু কথা আছে’

‘বলে ফেলো’

সারথি বিছানা হাতিয়ে এক কোণায় বসে।তারপর বলে,’ফারাজ আমার অনেক আদরের।জমজ বলেই হয়ত টানটা একটু বেশি ওর প্রতি।ছোট থেকেই আমাকে কেউ না বুঝলেও ফারাজ ঠিকই বুঝতো।এতদিনে বুঝেছি হয়ত পূর্ণতা ওর জন্য একজন ভাল সঙ্গী। কিন্তু আমার বোকা ভাই সেটা বোঝেনি।পূর্ণতা নিজেও বোঝেনি।
আমি চাই ওদের বিয়েটা দিয়ে দিতে।ফারাজ একটা মেয়েকে ভালবাসতো,তার বিয়ে হয়ে গেছে।ভাইটা আমার বাইরে দিয়ে যেমন হাসিখুশি ভেতরে ততটাই ভেঙ্গে আছে।আমি চাই ওর মনটা আবার গড়ুক।পূর্ণতা পারবে ওর মনটা জোড়া লাগিয়ে দিতে।আপনি আমায় সাহায্য করবেন?’

‘পরিবারের অমতে বিয়ে হওয়া ঠিক বলে আমি মনে করিনা’

‘পরিবারের সকলে রাজি শুধু গাধা আর গাধী দুজন রাজি না।আমি চাই আপনি ওদের আমার বাড়িতে নিয়ে যান।ব্যস এইটুকুতে সব কাজ হয়ে যাবে।বাড়ির সকলে মিলেই ওদের বিয়েটা পরিয়ে দিবে।কিন্তু তার জন্য ওদের হাবিজাবি অবধি নিতে হবে।ওরা সজ্ঞানে যাবেনা কোনোদিন’

আনাফ অনেক ভাবলো এরপর আবার বললো,’ওরা দুজনেই ম্যাচিউর।জোরজবরদস্তি করা কি ঠিক হবে?হতে পারে আসলেই তারা একজন আরেকজনের সাথে জীবন কাটাতে প্রস্তুত না’

‘একটা মেয়ে কনে সাজে বসেও ভাবে সে বিয়ে করতে প্রস্তুত না। কিন্তু বিয়ের পরেরদিন থেকে ঠিকই সে সংসার করে।
আমরা আসলে কখনওই প্রস্তুত থাকিনা।যখন প্রস্তুত থাকি তখনই বুঝতে পারিনা তার কথা।ওদের হয়েছে তেমনই একটা অবস্থা।’
——–
ঘাসের উপরে বসে থাকা ফারাজ পূর্ণতাকে দেখে আনাফ সারথিকে বললো,’কি কিউট লাগছে ওদের দুজনকে।কি সুন্দর জোড়া!অথচ তারা নাকি বিয়ে করতে চায়না।তুমি সিওর তো?আমি কিন্তু যাচ্ছি ভেজাল লাগাইতে’

‘আমি সিওর।আপনি গিয়ে আগুনে ঘি ঢেলে দেন’

আনাফ শার্টের হাতা ফোল্ড করতে করতে বাসার বাইরে চলে আসলো।ফারাজ আর পূর্ণতার কাছে এসে বললো,’কি খবর আপনাদের?ঘাসে বসে ভাইবোন জাতীয় বিতর্ক করছেন নাকি প্রেম সম্বন্ধীয় কিছু? ‘

ফারাজ বললো,’আমরা ওসবে নাই ভাই।আপনি হঠাৎ এখানে??’

‘চকলেট খাইবা তোমরা?’

কথাটা বলে আনাফ পকেট থেকে একটা বক্স বের করে দুজনের দিকে বাড়িয়ে ধরলো।পূর্ণতা বক্সটা নিয়ে উল্টে পাল্টে বললো,’চকলেটের নাম কি?এমন কেন দেখতে?এটা কিসের চকলেট?’

‘দারুণ একটা চকলেট।এটা খেলে দুনিয়ার সব মানুষকে সুইট লাগবে’

‘নেশা জাতীয়?’

‘আরেহহহহ না!কে বলে তোমায় এত সত্যি কথা বলতে! এটা নেশা জাতীয় কেন হবে?এটা খেলে সব কিছু মিষ্টি লাগবে।এটা অনেক মিষ্টি তো তাই।খাও খাও’

আনাফের কথার আগাগোড়া কিছুই বোঝেনি ফারাজ আর পূর্ণতা।তাও চকলেট নিয়ে মুখে পুরে দিয়েছে।আনাফ বিশ্বজয়ের হাসি হেসে গ্যারেজ থেকে গাড়ী আনতে গেলো।ওদের হাবিজাবি বাড়িতে দিয়ে আসার সময় হয়ে গেছে।গাড়ীতে ফারাজ পূর্ণতার সাথে সাথে সারথিকেও এনে বসালো সে।সারথি তখন বললো,’যে ঔষুধটা চকলেট বলে খাওয়ালেন ওটা আসলে কি?’

‘এটা মার্কেটে নতুন এসেছে।স্পেশালি বাচ্চাদের সুঁই ফোটাতে প্যানিক হতে যাতে নাহয় তার জন্য এই চকলেটটা খাইয়ে দীর্ঘ দশ/বিশ মিনিটের জন্য মাথাটা হ্যাং করে রাখার কাজে দেয় এটা।শুধু বাচ্চা না।বয়স্ক যারা সুঁই ভয় পান।একেবারেই প্যানিক হয়ে যান তাদের জন্য এই চকলেট দারুণ কাজ দেয়।অল্প সময়ের জন্য।তার মানে হলো আমায় এখন বিশ মিনিটের মধ্যে হাবিজাবিতে পৌঁছাতে হবে।পাঞ্জাবিটা পরার সুযোগ পেলাম না।আজকেই আমার শালার বিয়ে আর আমি একটু সাজতে পারলাম না’

‘মজা না করে গাড়ী জলদি চালান।যদি বাড়ি পৌঁছাবার আগে ওদের হুশ এসে যায় তাহলে সব পানিতে’

ফারাজ আর পূর্ণতা গাল ফুলিয়ে গাড়ীর পেছনের সিটে বসে একজনের কাঁধে একজন মাথা রেখে বিড়বিড় করছে।মাথার জ্ঞান বুদ্ধি সব যেন স্থগিত হয়ে আছে।তারা কি করছে,কোথায় যাচ্ছে তার কিছুই তারা জানেনা,বুঝতেছেও না।
গাড়ী চলছে……..
ফারাজ পূর্ণার হাতটা মুঠো করে ধরে বললো,’পূর্ণ আমি যে চকলেট খেলাম সেটা তো তুমিও খেলে তাইনা?’

‘আপনি আমায় তুমি বলছেন?’

‘আগে আপনি বলতাম?’

‘হ্যাঁ তো।’

‘যাই হোক শুনো পূর্ণ।তুমি না অনেক সুন্দরী! ‘

‘আমি একটা সত্যি কথা বলি?’

‘বলো’

‘ভুলে একবার আপনাদের বাসার টাংকির পানি খাই ফেলছি।’

এটা শুনে ফারাজ খিলখিল করে হেসে দিলো।সারথি ওর হাসি শুনে বললো,’চকলেটটা কি নেশাজাতীয়?বলদের মতন হাসতেছে কেন?’

‘ছোটরা ঘুমিয়ে পড়ে আর বড়রা বুঝে যায় তারা ঘোরে আছে।ঘোরে থাকলে সত্যি কথা তো বের হবেই’

সারথি কপালে হাত দিয়ে বললো,’এটা শরীরের ক্ষতি করে?’

‘না।অবশ করে,ক্ষতি না।যেহেতু বাচ্চাদের জন্য স্পেশালি বানানো সেহেতু ক্ষতির প্রশ্ন আসেনা।তবে ফারাজ আর পূর্ণতাকে এত ভাল করে ধরেছে কেন বুঝলাম না।আমিও তো আজ একটা খেলাম,আমার তো কিছু হলোনা’

সারথি জিভে কামড় দিয়ে বললো,’চকলেটের বক্সটা পূর্ণতার হাত থেকে নিয়েছিলেন আবার?’

‘আরে হ্যাঁ।আমি তো ভুলেই গেছিলাম ওটা নিতে।হায়হায় মনে হয় পুরো চকলেটের বক্স খালি করে ফেলেছে দুজনে।কত বড় ভুল হয়ে গেলো’
———-
সজীবের মেজাজ বিগড়ে আছে।কোথাকার কোন ছেলে এসে সারথিকে হাত করে নিলো।তাও এমন ব্যবহারের একটা ছেলে!
‘মানে ও নিজেকে কি ভাবে?আমার চাইতে বেশি ইনকাম করে সে?নাকি আমার চেয়ে সুন্দর!’

লেভেন চুপিচুপি এসেছিল সজীবের অফিসে।এসেই পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে বললো,’কি মিস্টার?কি ভাবছেন?’

‘জানো? সারথি অন্য একজনকে পেয়ে গেছে’

‘তাহলে তো ভালই।তোমার তো খুশি হবার কথা।সে নিজের জীবন টাকে গুছিয়ে নিচ্ছে।’

সজীব মুখ গোমড়া করে বলপয়েন্ট ঘুরাচ্ছে টেবিলের ওপর।জ্বলছে,খুব জ্বলছে।এরকম এ্যাটিটিউডের দোকানের সাথে কিনা সারথি জোড়া লাগালো?
মনে তো হয় সারথির সাথে আর জীবনে কথাও বলতে দিবেনা।’

লেভেন সজীবের যত কাছে আসার চেষ্টা করছে কিন্তু সজীব কিছুতেই সেদিকে মন দিতে পারছেনা।সে কেবল সারথির কথা ভাবছে।
——–
কলিংবেলের আওয়াজ শুনে মতিন গামছা গলায় ঝুলিয়ে গেলো খুলতে।খুলতেই দেখে ফারাজ আর পূর্ণতা দাঁড়িয়ে আছে।দুজনের মুখেই হাসি।
মতিন ওদের দেখে ইয়া বড় হা করে বললো,’খালু,নানা, দাদা সবাই দেখে যান।ফারাজ ভাই আর পূর্ণতা আপা চলে আইছে।সবাই দেখে যান’

এই বলে মতিন ছুট লাগালো।তার চিৎকার চেঁচামেচি শুনে সবাই এক এক করে এসে হাজির হচ্ছে ওখানে।দূরে আনাফ আর সারথি দাঁড়িয়ে ছিল।তারা কাছে আসেনি।আগে দেখে বুঝে নিচ্ছে কি হবে সামনে।

দাদাজান ফারাজ আর পূর্ণতার মুখের দিকে তাকিয়ে আছেন।ওরা যে সজ্ঞানে এই বাড়িতে পা রাখার মানুষ না তা তিনি অবশ্যই জানতেন।কিন্তু সমস্যা হলো তবে তারা এখানে এলো কি করে।তার চেয়ে বড় সমস্যা হলো দুজনেই দাঁত কেলাচ্ছে কেন?মদ-টদ খেলো নাকি!
না সেটা খেলে তো গব্ধ আসতো।’

মতিনকে পাঠিয়ে দুই জগ পানি আনালেন তিনি।এরপর দুই জগের পানিই ওদের দুজনের মুখের উপর ছুঁড়ে মারলেন।দুজনেই পানিতে ভিজে একাকার হয়ে নিচে বসে পড়েছে।আনাফ দূর থেকে সব দেখছে।কারণ ঘটনাটা বাগানে হচ্ছে।সে সারথিকে এটা বলায় সারথি বললো,’এবার তো ওদের হুশ ফিরবে’

‘আরে এটা কি মদ নাকি যে পানিতে হুশ ফেরানো যাবে।এটা অবশ জাতীয়।ওদের হুশ আছে কিন্তু প্রয়োগ করার ক্ষমতা নাই।এই তো বিকালের দিকে এসে যাবে হুশ’

দাদাজান ওদের দুজনকে দেখলেন এখনও দাঁত কেলাচ্ছে ওরা।

‘মনে হয় ওদের হুশ নাই।বিয়ে এখন পরানো উচিত ছিল কিন্তু বিনাহুশে তো বিয়ে করানো ঠিক না।তোমরা এক কাজ করো সব তৈরি তে লেগে যাও।ওদের হুশ ফিরলে আমরা বিয়ে পরিয়ে নিব।প্রস্তুতি নাও সবাই’

এই বলে দাদাজান ভেতরে চলে গেছেন।মতিন ও তার পিছু পিছু চললো।আনাফ এবার সারথিকে বাড়িতে ঢুকতে বলে।সারথি আজ আনাফকেও সাথে নিয়েছে।সবার সাথে এবার পরিচয় করাবে ওর’
চলবে♥
(এই কদিন নানুর বাড়িতে ছিলাম।আমার নানু অনেক অসুস্থ ছিল, তাই তাকে দেখতে গেছিলাম।নানুর বাড়িতে কোনো নেট নাই। অনেক চেষ্টা করেও পোস্ট করা গেলোনা গল্প)#ডাকপাড়ি
#পর্ব_৪৯
#আফনান_লারা
________
সারথি বাড়ির ভেতরে আসতেই বাড়ির বিয়ে বিয়ে আমেজটা যেন আরও দিগুণ বেড়ে গেলো।
সাথে আনাফকে দেখে হইহই রইরই ও বেড়ে গেছে।
সারথি সবাইকে একসাথে বলে দেয় আনাফ তার খুব ভাল বন্ধু।
এই শুনে সবাই যতটা আদর যত্ন করছিল মুখে হাসি নিয়ে ঠিক ঐসময়ে সারথি বলে উঠে তার আর সজীবের ডিভোর্স হয়ে গেছে।
মূহুর্তেই পরিবারের প্রতিটি মানুষের মুখ ফ্যাকাসে হয়ে যায়।সবাই সারথির দিকে তাকিয়ে আছে ডিভোর্সের কারণ জানার জন্য।সারথি কিছুই বলছেনা।
আনাফ তখন হাতের শরবতের গ্লাসটা রেখে দিয়ে বলে,’আমি বলছি কি কারণ।সজীব মালয়েশিয়াতে একটা মেয়েকে পছন্দ করে,ওকে বিয়েও করবে।আর তাই সে সারথিকে ডিভোর্স দিয়েছে। ‘

আনাফের কথা শুনে কেউ কেউ কষ্ট পেলো আর কেউ কেউ রাগান্বিত হলো।মানিক সাহেব তো চট করে ফোন কানে ধরলেন।কল করেছেন সজীবের বাবার নাম্বারে।আজ এর একটা বিহিত হবেই।দাদাজানের খারাপ লাগলো সারথির জন্য।তিনি ওর মাথায় হাত দিয়ে বললেন,’কাঁদিস না।সবাই শুরুতে ভালোটা পায়না’

আনাফ তখন মুচকি হেসে বললো,’আহা পুরো কথা তো শুনেন।সেই ভালো সে পেয়ে গেছে।এই যে আমি বসে আছি,আপনাদের হবু নাতিন জামাই।পেশায় ডাক্তার।যার যার যা সমস্যা আমায় বলবেন,চিকিৎসা করে দিব ফ্রিতে’

দাদাজান আনাফের মুখের দিকে চেয়ে আছেন,আসলেই কি সত্যি বলছে।নাকি মশকরা করছে।মিসেস সোনালী এগিয়ে এসে সারথির কাছে ফিসফিস করে জানতে চাইলেন এটা সত্যি কিনা।সারথি কিছুই বললোনা।
আনাফ আবার বললো,’ওকে কি জিজ্ঞেস করছেন।লজ্জায় সে কি নিজের মুখে বিয়ের কথা বলবে?আচ্ছা আপাতত এই যুগলের বিয়েটা হয়ে যাক তারপর নাহয় আমার আর সারথিরটা হবে।আমি কিন্তু যা বলছি সব সিরিয়াসলি বলছি’

দাদাজান আনাফের পাশে বসে ওর দিকে এক দৃষ্টিতে চেয়ে থেকে বললেন,’সারথির সাথে তোমার পরিচয় হলো কি করে?’

‘সে অনেক কাহিনী।আগে বলুন তো আপনি আপনার নাতিন আমার সাথে বিয়ে দিবেন?আপনার নাতিন আমাকে হ্যাঁ ও বলেনা,না ও বলেনা।এখন আপনাদের মত না জানা অবধি আমার শান্তি হচ্ছেনা।’

‘তুমি রাজি হলে কি হবে?তোমার বাবা মা কি রাজি হবেন?’

‘বিয়ে তো আমি করতেছি,তারা শুধু অনুষ্ঠান করবে।তারাও রাজি,ওটা নিয়ে ভাবিয়েন না।
আমি আপনাদের মতামত জানতে চাই’

দাদাজান আনাফকে হঠাৎ জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে ফেললেন।কেঁদে কেঁদে বললেন,’মানুষ ভাল হলে কেন এত কষ্ট পায়?আমার সারথি ছোট থেকে কষ্ট পেয়ে যাচ্ছে।তার জীবনে আমি একটিবার ও সুখ দেখিনি।এখন আবার তার সাথেই এমন কেন হতে হলো?জানো সজীবও ওকে পছন্দ করেই বিয়ে করেছিল।’

‘আমি তো ওরে পছন্দ করার কথা বলিনি।
আমি ওরে ভালোবেসে ফেলেছি।’

সারথি দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে আনাফ দাদাজানের কথা শুনছিল সেসময় মিসেস সায়না ওকে চিমটি একটা দিয়ে বললেন,’কিরে সারথি!!এই ছেলে দেখি সজীবের চেয়েও সুন্দর।তোকে যদি দেখাতে পারতাম!!!
এত সুন্দর একটা ছেলে তোর বর হতে যাচ্ছে জানিস??’

‘সব সুন্দর ভাল হয়না’

‘এই বেলায় সুন্দরটা ভাল হলো।নাহলে কোন ছেলে এতসব জেনেও বিয়ে করতে এক পায়ে খাড়া হয়??তাও ডাক্তার!!আমার না বিশ্বাস হচ্ছেনা।আসলেই ডাক্তার তো?অবশ্য ডাক্তার গুলার চেহারা দেখেই বুঝা যায়।একে দেখে ডাক্তারই মনে হয়।কিভাবে পরিচয় হলো?’

‘সাতাশ জুলাই ছাদ থেকে পড়ে যাওয়া থেকে বাঁচিয়েছিলো,এরপর থেকে চিনি।’

‘বাহ!!নায়কের মতন এন্ট্রি!তারপর প্রেম হলো কি করে?’

‘প্রেম?আমাদের প্রেম হয়নি!’

‘তবে ছেলে যে বললো তোকে ভালোবাসে?’

‘সব ভালোবাসাতে কি প্রেম থাকা লাগে চাচিআম্মু?’

‘তাও ঠিক!সরাসরি ভালবাসি বলেছে?’

‘এই মানুষটা ভালবাসি না বলেও তার সব কাজে কেমন করে যেন দিনের পর দিন বুঝিয়ে দিয়েছে।আমি যে ধোকা খেলাম,আমি যে মরতে চাইলাম কেমন করে যেন আগলে নিয়েছে সবটা।আমি এই ধাপে এসে বুঝতে পারলাম উনি ধীরে ধীরে আমার একজন উত্তম জীবনসঙ্গী হয়ে যাচ্ছেন’
———-
ঘন্টাখানেক পর ফারাজ আর পূর্ণতার হুশ ফিরেছে।দুজনেই চেয়ে দেখে একজন আরেকজনের সাথে মাথা ঠেকিয়ে বসে আছে।তাই হুশ ফেরায় দুইদিকে দুজনে সরে গেলো।উঠে দাঁড়িয়ে বোঝার চেষ্টা করলো তারা কোথায়।পরে বুঝতে পারলো তারা হাবিজাবিতে।
এটা দেখে দুজনেই দিলো এক দৌড়,কিন্তু গেট অবধি গিয়ে আর যেতে পারেনি,মতিন গেটে তালা ঝুলিয়ে রেখেছে।

‘আমরা এখানে এলাম কি করে?’

‘পূর্ণতা আপনার মনে আছে আনাফ ভাই আমাদের একটা চকলেট খাইয়েছিল?’

‘হুম মনে আছে’

‘তার পর থেকে তো আর কিছু মনে নাই আমার।আপনার কিছু মনে আছে?’

‘আপনি আমার হাত ধরেছিলেন’

‘এটা মিথ্যা কথা’

‘আর বলেছিলেন আমি সুন্দরী,আমার এই টুকুই মনে আছে,মেয়েরা সব ভুলে গেলেও প্রশংসা ভুলেনা’

‘আমি বলবো আপনাকে সুন্দরী?মিথ্যে বলার জায়গা পান না?হয়ত অসুন্দরী বলেছিলাম’

‘না।আমার মনে আছে আপনি আমায় সুন্দরী বলেছিলেন’

আজিজ খান ওদের মাঝখানে এসে তখন বললেন,’হুম।ঐ সুন্দরীর সাথেই আজ তোমার বিয়ে হবে ফারাজ ‘

ফারাজ ঢোক গিলে চুপ করে আছে।পূর্ণতা বললো,’আমি পালাই’

এটা বলে সে দেয়াল টপকে ওপারে যাবার বৃথা চেষ্টা করে।শাড়ী পরে থাকায় সে দেয়ালে উঠতেই পারেনি।তখন ফারাজ এসে বললো,’আপনি থাকেন,আমি বরং পালাই’

এটা বলে ফারাজ নিজে দেয়াল টপকানোর চেষ্টা চালালো ওমনি আজিজ খান আর মতিন মিলে ওকে জড়িয়ে ধরে নিচে নামিয়ে চ্যাংদোলা করে বাড়ির ভেতরে নিয়ে গেছে।পূর্ণতা নখ কামড়াতে কামড়াতে কোনদিক দিয়ে পালাবে সেটা ভাবছিল তখনই দাদাজান এসে দাঁড়ালেন ওর সামনে।
ওনাকে গম্ভীর চাহনিতে তাকিয়ে থাকতে দেখে সে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইলো।

‘আজ কোথায় পালাবা তোমরা?তুরুইল্লার বাসায় গিয়েও যদি পালাও তোমাদের বিয়ে আজই হবে’

এই বলে দাদাজান চলে গেলেন।পূর্ণতা তালা ভাঙ্গার চেষ্টা করছে এবার।
—–
‘আমি এসব কি শুনছি বেয়াই??সজীব বাবা নাকি সারথিকে ডিভোর্স দিয়েছে?’

সজীবের বাবা জনাব আমিন অফিসের কিছু ফাইল দেখছিলেন,মানিক সাহেবের মুখে এই কথা শুনে চট করে ফাইলটা বন্ধ করে ফেললেন।মানিক সাহেব যে ঠাট্টা করার মানুষ না এটা তিনি জানেন,তার মানে এটা সত্যি!

‘কি হলো কিছু বলছেন না কেন বেয়াই?’

‘আমি আপনার থেকে মাত্র শুনলাম।আচ্ছা আমি সজীবের সাথে কথা বলছি।আপনি শান্ত থাকুন’

‘শান্ত থেকে আর কি হবে?ডিভোর্স হয়ে গেছে।বাচ্চারা আমাদের না জানিয়ে এত বড় সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললো আর আমরা সব হয়ে যাবার পর জানছি!’

আমিন সাহেব কলটা কেটে সজীবের নাম্বারে কল দিলেন এবার।
সজীব সেসময় সমুদ্রের কিণারায় বসে ছিল গাল ফুলিয়ে।সারথির সাথে আনাফের সম্পর্কটা সে কিছুতেই মেনে নিতে পারছিল না।একটা কাজের লোক এসে ওর ফোন দিয়ে গেলো তখন।গাল ফুলিয়ে রেখে নাম না দেখেই সে ফোন কানে ধরে।
ওপাশ থেকে ধমকের সুরে শোনা গেলো,’এসব কি শুনছি সজীব?’

বাবার কন্ঠ শুনে সজীব নড়েচড়ে বসে।বাবা আবারও জানতে চাইলেন সবাই যেটা বলছে সেটা সত্যি কিনা।তার মানে বাবা ডিভোর্সের খবর জেনে গেছে। এই ভয়টাই পেয়েছিল সজীব।
সজীবকে চুপ হয়ে থাকতে দেখে আমিন সাহেব সিওর হয়ে গেলেন ডিভোর্সের ব্যাপারটা তাহলে সত্যি।

‘আমি জানতে চাই কোন সাহসে তুমি এত বড় সিদ্ধান্ত নিলে?
সারথিকে চেনা আছে আমার।ওর মতন বোকাসোকা,দৃষ্টিপ্রতিবন্ধি মেয়ের পক্ষে তোমায় ডিভোর্স দেয়া অসম্ভব। তার মানে ডিভোর্স দিলে তুমিই দিছো।
তোমার এত দুঃসাহস আসে কই থেকে সজীব?টেল মি!’

‘বাবা আসলে আমি!’

‘এখন বলোনা তুমি কিয়ামের মেয়ে লেভেনের প্রতি আসক্ত আজ অবধি!এই কথা আমি শুনতে চাইনা!যদি এটাই শেষ কথা হয়ে থাকে তবে জেনে রাখো!দুদিনের মধ্যে তুমি বাংলাদেশ ফিরবে,সারথিকে আবার বিয়ে করবে।তোমাদের ডিভোর্স আমি মানিনা আর কেউ মানবেওনা।মানতে দিব না আমি।সারথিকে আমি আর তোমার মা মিলে পছন্দ করে এনেছিলাম।তোমার কোনো রাইট নাই আমাদের না জানিয়ে তাকে ডিভোর্স দেয়ার।এত বড় বেয়াদবি করেছো এটার শাস্তি তুমি অবশ্যই পাবে।
যদি আমার কথা না শুনো তবে মনে করবে তোমার বাবা মা মারা গেছে।তুমি বেছে নাও।লেভেন নাকি তোমার গোটা পরিবার’

এই কথা বলে আমিন সাহেব কল কেটে দিছেন।সজীব রাগ করে ফোন ছুঁড়ে মারে বালিতে।বাবা কঠোর হবে,রাগ করবে এটা সজীব জানতো কিন্তু এমন একটা ডিসিশান সামনে এনে দেবে এটা সজীব জানতোনা।এখন তো দোটানায় ঝুলছে!
লেভেনকে ছাড়া অসম্ভব। আর তাকে না ছাড়লে পুরো পরিবার সজীবকে ছেড়ে দিবে।কি অদ্ভুত এক ঝামেলা!!
‘তারা কি জানে সারথি আমার অনুপস্থিতিতে আনাফকে আপন করে ফেলেছে।সে কি আবার আমায় বিয়ে করবে!বাবার জানা উচিত সারথি আর আমার পথ দুদিকে চলে গেছে।চাইলেই এক হওয়া আর সম্ভব না।’
———-
ফারাজকে মতিন ধরে রেখেছে।আজিজ দাদু পাঞ্জাবি প্যাকেট থেকে বের করছেন ওকে পরানোর জন্য।ওদিকে ভেতরের রুমে পূর্ণতা গাল ফুলিয়ে বিছানার মাঝখানে বসে আছে আর মিসেস সায়না ওর চুল বেঁধে দিচ্ছেন। হাবিজাবিতে বিয়ের আমেজ লেগেছে।

মানিক সাহেব কল দিয়ে দিয়ে ঝগড়া করছেবন সজীবের বাবা মায়ের সাথে।
তিনি ফারাজ পূর্ণতার বিয়ের খবর জানেন না এখনও।
আনাফ সারথিকে নিয়ে ওদের ছাদে এসেছে।সারথি ছাদের রেলিংয়ে হাত রেখে বলে,’জানেন আমাকে কখনও বাড়ির ছাদে আসতে দিতো না কেউ’

‘কেন?’

‘আমি পড়ে যাব বলে’

‘তোমাদের তো ছাদের রেলিং আছে।ভয়ের কি আছে?’

‘আমারও এক কথা।তাও কেন যে কেউ দিতোনা!’

আনাফ সারথির দিকে চেয়ে থেকে আললো,’তুমি কি খুশি?’

‘কি কারণে?’

‘এই যে কদিন পর আমাদেরও বিয়ে হবে’

‘সব সুখে হাসতে হয়না’

‘তবে কিসে হাসতে হয়?’

‘হাসতেই হয়না।হাসলে নিজের উপর নিজের নজর লাগে।হাসির কারণটা খুব জলদি নিরুদ্দেশ হয়ে যায়।তাই এখন আর আমি হাসিনা’

‘তার মানে তুমি চাও আমি সারাজীবন থাকি?’

চলবে♥#ডাকপাড়ি
#পর্ব_৫০
#আফনান_লারা
________
বিকালের মিষ্টি আবহাওয়াকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে বিয়ের আমেজ।সোফায় একপাশে ছাই রঙের মখমলের পাঞ্জাবি পরা বসে আছে ফারাজ।মাথায় সাধারণ একটা সাদা টুপি।গালটা কুমড়োর মতন ফুলিয়ে রেখেছে সে।

তার ঠিক পাশের সোফায় লাল রঙের সুতির শাড়ী আর মাথায় নেটের ঘোমটা টান দিয়ে বসানো হয়েছে পূর্ণতাকে।দুজনেরই মুখের অবস্থা ছোটখাটো একটা কুমড়োর বাগান হয়ে আছে।
একজন আরেকজনের দিকে আড় চোখে দেখছে।পুরো হল ভর্তি মানুষ।সেই দোকানদারটাকেও ডাকা হয়েছে।
সবার হাসি খুশিতে গমগম করছে গোটা হাবিজাবি বাড়ি।শুধু হাসি নেই বর বউয়ের।ফারাজ তার বাবার দিকে চেয়ে বলে বিয়েটা সে করতে চায়না।কিন্তু ওর কথা শুনে কোনো রিয়েকশান জানাতে পারেনি মানিক সাহেব।তার হাত পা যেন বাঁধা।
তিনি নিজেও দেখেছেন ফারাজ পূর্ণতাকে সবসময় না না বলে দিনশেষে ওকে নিয়েই ভেগেছে তাই এখন আর তিনি কিছু বলতে চান না,করতেও চান না।
পূর্ণতাও তার বাবাকে বললো সে বিয়েটা করতে চায়না।কিন্তু তিনিও কোনো উত্তর দিলেন না।
হুজুরের কথায় যখন কবুল বলার সময় এলো তখন ফারাজের মুখ দিয়ে আর কথা বের হয়না।দাদাজান ওর পাশে বসে ওর দুহাত চাপ দিয়ে ধরে বললেন,’বলো কবুল।আর ছাড়া পাবেনা চান্দু’

ফারাজ তাও কিছু বলছেনা।পূর্ণতা ফিসফিস করে বলছে,’কবুল বলিয়েন না।প্লিজ কবুল বলিয়েন না।আজ যেন আপনার মুখ দিয়ে কবুল না বের হয়’

পাশে বসে থাকা মিসেস সায়না মুচকি হেসে বললেন ‘ওকে মানা করে তুমি নিজেই তো তিনবার বলে দিয়েছো’

পূর্ণতা অমনি নিজের কপালে নিজে একটা বাড়ি মেরে দিলো।ফারাজ বলছেনা কিছু তখন হুজুর ওকে আবারও বলতে বললেন।এরপরেও ফারাজ কিছু বলেনি।
দাদাজান তখন ফোন বের করে ফারাজের দিকে চেয়ে বললেন,’তবে তাই হোক।আজ পূর্ণতার সাথে শাহেদের বিয়ে হোক।যাও পাঞ্জাবিটা খুলে ভাঁজ করে নিয়ে এসো।আমি শাহেদকে ফোন করছি,সে শীঘ্রই চলে আসবে’

ফারাজ হা করে দাদার মুখের দিকে চেয়ে রইলো।মানিক সাহেব এই কথা শুনে চট করে রাজি হয়ে গেলেন।দাদাজানের হাত থেকে ফোন নিয়ে তিনি কল করা ধরলেন শাহেদকে।শাহেদ ফোন রিসিভ করার পর তিনি ওকে জলদি আসতে বললেন বাড়িতে।ফারাজের চোখের সামনে সব হয়ে যাচ্ছে।সে কিছুই করছেনা।পরে দাদাজান ওকে ঝাঁকিয়ে বললেন জলদি করে পাঞ্জাবিটা খুলে নিয়ে আসতে।
ফারাজ উঠে দাঁড়ায়,মূর্তির মতন হেঁটে হেঁটে সে উপরের দিকে চললো।
অরিন্দম দাদাজানের কাছে এসে ফিসফিস করে বলে যদি সত্যি সে পাঞ্জাবি খুলে নিয়ে আসে তখন! দাদাজান মিষ্টি করে একটা হাসি দিয়ে বললেন এমনটা হবেনা।সে নিজে বিয়ে না করলেও পূর্ণতাকে অন্য কারোর হতে দেবেনা।
ফারাজ তার রুমে এসে বসেই ছিল।প্রায় এক ঘন্টা পর কানের কাছে হইচইর ঢল শুনে কান খাড়া করে সে দরজা খুলে বাইরে বেরোয়।
নিচে শাহেদকে দেখলো পূর্ণতার পাশে বসানো হচ্ছে।
আজিজ খান উপরে চেয়ে ফারাজকে দেখে বললেন,’নাতি তুমি তো আসবানা,পাঞ্জাবিও আনবানা আমরা জানতাম, তাই শাহেদকে শার্ট পরিয়েই পূর্ণতার সাথে বিয়েটা দিচ্ছি।এসো এসো, দেখতে এসো’

ফারাজের যেন পায়ের তলার মাটি নড়ে গেছে।চোখ বড় করে সে বিয়েটা হতে দেখছে।মাথা কাজ করছেনা।পাঁচ মিনিট দেখে সে সবাইকে থামতে বলে।
দ্রুত হেঁটে নিচে নেমে সবার সামনে এসে বললো,’নাহ।শাহেদ পূর্ণতাকে বিয়ে করবেনা’

সবাই ওর মুখের দিকে চেয়ে আছেন।দাদাজান বললেন,’তোমার এত রঙঢং দেখার সময় আমাদের নেই।যাকে বিয়ে করবা তাকে নিয়ে তুমি সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগো সারাক্ষণ সুতরাং তাকে বিয়ে করার কোনো দরকার নাই তোমার।এই শাহেদ কবুল বলো’

ফারাজ তখন শাহেদকে সরিয়ে নিজে পূর্ণতার পাশে বসে বললো,’না।আমি ওকে বিয়ে করবো,শাহেদ করবেনা’

পূর্ণতা হা করে ফারাজের দিকে তাকালো।সবার মুখে হাসি ফুটে উঠেছে।শাহেদকে এখানে আনা হয়েছিল আগুনে ঘি ঢালার জন্য।কাজটা হয়ে গেছে বলে এবার সে দর্শকের মতন একপাশে দাঁড়িয়ে গেলো।দাদাজান আরও একবার জানতে চাইলেন আসলেই সে বিয়ে করতে চায় কিনা।ফারাজ জোর গলায় বললো সে চায় বিয়ে করতে।
পূর্ণতা শুধু দেখে যাচ্ছে।ফারাজের কবুল বলার পর যখন তার বেলা আসলো তখন সে আর কিছু বলতে পারছেনা।সে রীতিমত আশ্চর্য হয়ে গেছে!

এবার মিসেস সোনালী পূর্ণতাকে খোঁচা দিলেন হুজুর কি বলছে সেটা শুনতে।
পূর্ণতা রোবটের মতন তাই তাই বলে গেলো যেটা হুজুর বলতে বললেন।সে অবাকের শেষ সীমানায় চলে গেছিলো।ফারাজ এত জলদি রাজি হবে সেটা ও কল্পনাও করতে পারেনি।বিয়েটা যে হয়ে গেছে সেটার ও হুশ নেই তার।

ফারাজের কৃতকলাপে সে চমকে বসেই আছে, কোনো কিছু বলার বা করার জোর পাচ্ছেনা।
————–
খাটে উঠে আনাফ মুখে ফুল একটা ধরে আরেকটা ফুল খাটের স্ট্যান্ডে লাগাচ্ছে।নিচে সারথি দাঁড়িয়ে আছে হাতে ফুলের ব্যাগ নিয়ে।আনাফ ফুলটা টেপ দিয়ে লাগিয়ে বললো,’তোমার ভাইয়ের খাটটা ছোট মনে হয়।ওদের দুজনের হবে তো?একজন আরেকজনকে তো পছন্দই করেনা।পরে দেখা গেলো একজন নিচে শোবে’

‘ফারাজ নিচে শুতে পারেনা, ওর ঠাণ্ডা লেগে যায়,সব চেয়ে বড় কথা প্যানিক হয়ে যায় ফ্লোরে শুলে।পূর্ণতাকেও নিচে শুতে দিবেনা যতদূর জানি।খাতাখাতি করে দুজনে বিছানাতেই শোবে।বাবাকে বলে বড় একটা খাটের ব্যবস্থা করে দেবো’

‘বাসরঘর শেষবার সাজিয়েছিলাম আমার একটা বন্ধুর বিয়েতে।এরপর নিজের শালার বাসর ঘর সাজাবো কখনও কল্পনা করিনি।
দেখতে যে সুন্দর হবে এমনটাও না।আমি তেমন করে সাজাতে পারিনা’

‘যে ফুল আনিয়েছে মতিন,হাতে নিয়ে বুঝলাম। ওগুলা দিয়ে আমার মনে হয় সুন্দরই হবে সব’

আনাফ সারথির থেকে একটা গোলাপ নিয়ে ওর মুখের দিকে তাকিয়ে সেই গোপন হাসি হাসলো।সারথি বুঝলো না।গোলাপটা সে আলাদা করে রেখে অন্য গোলাপ নিয়ে কাজ করছে এখন।সারথি ফুলের ঘ্রাণ নিয়ে বলে,’আমি ফুল অনেক পছন্দ করি।গিফট হিসেবে ফুলই বেস্ট বলে মনে হয় আমার’

‘আমায় বলার কারণ আমি যেন এরপর থেকে ফুল দিই?’

‘মোটেও না’

‘মোটেও তাই মনে হলো।তবে তুমি না বললেও কিন্তু আমি সব গিফটের সাথে একটা করে ফুল দিতাম কারণ ফুল আমার নিজেরও অনেক পছন্দ’

‘তাই বলে আপনার নিজের বাড়ির বাগানে ফুল নেই?’

‘তুমি জানলে কি করে?’

‘বাগানে দাঁড়ালেই বোঝা যায় সেটা বাগান নাকি অন্য কিছু’

‘আসলে সময় পাইনা বাগান করার।তবে অনেক শখ আমার।বুড়ো বয়সে বাগান করবো।এখন তো সময় পাইনা’

‘কই?সারাক্ষণ দেখি আমাকে নিয়ে ছুটছেন।রোগী দেখেন কখন?’

‘রাত বিরাতে!ও হ্যাঁ একটা কথা তো বলতে ভুলেই গেছি।শোনো আমি কিন্তু একটা জরুরি বিষয়ে আলাপ করবো তোমার সাথে’

‘কি সেটা?’

আনাফ চট করে বিছানায় বসে সারথির হাত ধরে ওকে কাছে টেনে আনলো এরপর বললো,’ধরো তোমার মুখের পাশের চুলগুলো কানের পেছনে গুজে ঠোঁট দিয়ে ছুঁতে যাচ্ছিলাম তোমার ঐ মুখ ওমনি আমার কল আসে,রোগীর সিরিয়াস অবস্থা তখন কিন্তু না ছুঁয়েই আমায় বেরিয়ে যেতে হবে।তুমি রাগ করতে পারবেনা’

সারথি বিরক্ত হয়ে বলে,’এটা কেমন কথা?আমার কাছে রোগীর চাইতে রোমান্স বেশি হয়ে যাবে?’

‘পুরো কথা তো শুনবে।আমার ভুল সময়ে কল আসে সবসময়।যেমন ধরো রাত বারোটার পরে,দুপুর দুইটার পরে।মানে যখন তোমায় কাছে আনতে যাব তখনই আমার হাসপাতালে মূমুর্ষ রোগী এসে পৌঁছে,এবার ভাবো!!’
——–
পূর্ণতার কান জ্বালাফালা করে তুলেছে দোকানদারের বউ সেলিনা।
তিনি একাই একশো।পূর্ণতাকে জ্ঞান দিয়েই যাচ্ছেন।পূর্ণতা গাল ফুলিয়ে বসে আছে এক কোণায়।

‘শোনো মাইয়া,আমাগো পোলা খুব সাদাসিধা। ওরে নিয়ে ভাববার কিছু নাই। ও হয়ত জানেওনা পিরিত কি জিনিস।তুমি ওরে শিখাইবা।তোমারে দেইখা আমার কেমন জানি বাতি বাতি লাগে’

‘বাতি বাতি মানে কি?’

‘মানে পাকনা আর কি।তুমি এর আগে কয়ডা প্রেম করছিলা?’

‘করি নাই’

‘মিছা কথা কম কও মাইয়া।তোমারে দেখে মনে হয় বহুত কয়ডা প্রেম করছো।তোমার মুখে লেখা আছে”আমি বিশটা প্রেম করছি”

‘আসলেই?আর কি লেখা আছে?’

‘আর লেখা আছে “আমি জামাই পালতে পারমু'”

মিসেস সায়না এসব শুনে হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খাচ্ছেন।পূর্ণতা তব্দা খেয়ে বসে আছে।ফারাজ তাকে বিয়ে করেছে নিজের সম্মতিতে এটা সে ভাবছে।অন্য কিছু ভাবতেও পারছেনা।
————-
রাত নয়টার পরে আবারও সেই জোরজবরদস্তি করে ফারাজ পূর্ণতাকে এক ঘরে করে দেয়া হলো।
আগে ফারাজই ঢুকে ছিল,পূর্ণতা শেষে।
আনাফ আর সারথি মিলে ওদের রুমে ঢুকিয়ে দরজা আটকে দিছে।পূর্ণতা এতক্ষণ নিজেকে শক্ত করে রেখেছিল সবার সামনে,এবার সে পেয়েছে ফারাজকে একা।ঘোমটা ফেলে ফারাজের দিকে আঙ্গুল তুলে এগিয়ে এসে সে বলে,’আপনার থেকে এটা আশা করিনি আমি।আপনি বিয়েটা না করলে আজ আমায় বিয়ে করতে হতোনা’

‘রিয়েলি?আমি আপনাকে বিয়ে না করলে শাহেদের সাথে আপনার বিয়ে হয়ে যেতো’

‘হতোনা।সবাই আপনার মতামত জানার জন্য নাটক করছিল আমি সিওর’

‘নাহ।এটা সত্যিনা।যদি আমি কোনোকিছু না বলতাম তবে শাহেদের সাথে সত্যি সত্যি আপনার বিয়েটা হয়ে যেতো’

‘তবে হতো।অন্তত আপনার সাথে তো হতোনা।আপনি কেন আগ বাড়িয়ে আমায় বিয়ে করলেন?আপনি না আমায় পছন্দ করেন না?তাহলে এটা কি করলেন!’

ফারাজ এবার চুপ।কোনো কিছু না বলে বিছানায় বসে গেছে সে।পূর্ণতা আবারও ধমকে বললো,’বাসর ঘর যে সাজিয়েছে,খাটের ছিরি দেখেছে কেউ?এই খাটে দুজন অপরিচিত মানুষ কেমনে ঘুমাবে?আপনাকে চিনতে আমার আরও কয়েক মাস পাড়ি দিতে হবে সেখানে বাসর রাত থেকেই গায়ের সাথে গা লাগিয়ে শুতে হবে?আমি পারবোনা’

‘আমি অর্কর রুমে গিয়ে ঘুমাবো।আপনি ঘুমান এখানে’

এই কথা বলে ফারাজ তার বালিশ নিয়ে দরজায় হাত লাগাতেই বুঝতে পারলো আনাফ বাইরে দিয়ে দরজা লক করে দিয়েছে।

‘কেউ আছো?দরজা খুলো’

কেউ কোনো সাড়া দেয়নি।পূর্ণতা বিছানায় উঠে বসে বললো,’আমি নিচে শুতে পারবোনা,আপনার সাথে লেগেও শুতে পারবোনা’

‘এক কাজ করেন, আপনি শুইয়েনই না আজকে।জেগে থাকেন,আমায় ঘুমাতে দেন।আমার কাল একটা মেলায় যেতে হবে।আমার আঁকা ছবি সেখানে সেল হবে।’

‘তো?বিয়ে করার সময় মনে ছিল না?কবুল বললেই সব শেষ?কবুল দিয়ে সব শুরু।আমার যে দায়িত্ব আছে সেটা আজ থেকে আপনার।আমি রাতে ঘুমাবো কি করে এটার ভাবনাটাও আপনার।’

‘আপনি তো এত ক্যাচ ক্যাচ করতেন না আগে।বিয়ে হতেই মেয়েরা এমন বদলে যায়?’

‘আমার না বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে যে আপনি আমায় নিজে জেনে বুঝে বিয়েটা করেছেন।আচ্ছা একটা কথা বলুন,আমার বিয়ে হয়ে গেলে আপনার কি যায় আসতো?আপনি কেন নিজে শাহেদকে সরিয়ে বিয়েটা করে নিলেন?’

‘জানিনা’

ফারাজ বালিশটা আগের জায়গায় রেখো লাইট অফ করে এক কোণায় শুয়ে পড়ে।পূর্ণতা প্রায় দেয়ালের সাথে লেগে গেছে।ফারাজকে একটা ধাক্কা দিয়ে সে বললো,’আমি এই চিপায় ঘুমাবো কি করে?বউ জামাইকে কেউ সিঙ্গেল খাট দেয়?আপনার পরিবার জোর করে বিয়ে দিতে পারছে, জোর করে বড় খাট দিতে পারে নাই?’

‘আপনি এই ঘ্যান ঘ্যান কাল সকালে করবেন?আমায় প্লিজ একটু ঘুমাতে দিন’

‘না দিব না।আমার ঘুমের কি হবে?কাল সকালে উঠে যে নতুন বউ সেজে কত ন্যাকামি করতে হবে ওগুলার জন্য যে এনার্জি লাগবে সেগুলো আসবে কই থেকে যদি আমি রাতে ঘুমাইতে না পারি?!!’

আনাফ তখন বাইরে থেকে বললো,’ডিয়ার নতুন বউ জামাই,দয়া করে আপনারা ঝগড়াঝাঁটি বন্ধ করে হালকা প্রেম ভালবাসা জমিয়ে ঘুমিয়ে পড়ুন।নতুন বর বউ গায়ের সাথে লেগে ঘুমালে ভালবাসা চিরকাল থাকে,আমি শুনছিলাম
এক মহাজ্ঞানী বলেছিল’

সারথি জানতে চাইলে কোন মহাজ্ঞানী।
আনাফ তখন নিজের শার্টটা টেনেটুনে ঠিক করে বললো,’ফারাজ ভাই নতুন বউকে এত রাগাইওনা।দরকার হলে ওরে কোলে নিয়ে ঘুম পাড়াও।তোমাদের চেঁচামেচিতে আমরা ডিনারটাও করতে পারছিনা’

পূর্ণতা লজ্জা পেলো,সে তো আস্তে আস্তেই কথা বলছিল তবে সবাই চেঁচামেচি শুনলো কি করে?

চলবে♥

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here