#ডাকপাড়ি
#পর্ব_৬০
#আফনান_লারা
________
‘শুনতে পান?’
‘হ্যাঁ।আমার শালাবাবু আর তার বউ ঝগড়া করছে ‘
‘আচ্ছা ওরা এত রাতে কেন ঝগড়া করছে?মানে এই সময় কেন?আপনি কিছু জানেন?তখন তো শুনলাম ওদের সাথে কথা বলছিলেন’
‘ঝগড়া না,বলা চলে খুনসুটি। আমার কাছে ফারাজ ভাই আর পূর্ণতার কেমিস্ট্রি অসাধারণ লাগে।বিয়ে করে কি দারুণ ভাবে ইঞ্জয় করছে তারা মোমেন্ট টা।’
‘তাহলে কি আমাদেরও ঝগড়া করা উচিত এখন?’
আনাফ সারথির হাতটাকে দোলাতে দোলাতে বললো,’নাহ।একেকজনের ভালবাসা প্রকাশ করার ভঙ্গি একেকরকম। আমাদের টা ভিন্ন।আমরা মিষ্টি কথার মাধ্যমে ভালবাসাটাকে প্রকাশ করছি,এবং করবো।
সারথি চুপ হয়ে যায়।জানালা দিয়ে আসা বাতাস এখন কমে গেছে,বলতে গেলে আর আসছেইনা।আনাফ ও আর কথা বলেনি।সারথির হাতটাকে আয়ত্তে পেয়েছে তার আর কি চাই।ঘুম পাড়াতে এই একটা শীতল হাতের পরশই যথেষ্ট।
দুজনেই নিরব থেকে ঘুমিয়ে যায় একসময়।
ভোর হলো অর্কর ডাকাডাকিতে।চোখের চশমাটা ইদানিং বেশ ঢিলা হয়ে গেছে।শুধু নাকের উপর চলে আসে।ঠেলে দিয়ে চশমাটাকে চোখ বরাবর করে দরজার কড়াটা কয়েকবার করে নাড়লো সে।তার ঘাড়ে দায়িত্ব চেপেছে ফুফু আর ফুফাকে ডেকে তোলার।
কড়া নাড়া তিনবারের সময় গিয়ে দরজা খুলেছে আনাফ।চোখ ডলতে ডলতে অর্ককে দেখে সে জানতে চাইলো কি হয়েছে।
অর্ক মাথা তুলে আনাফের মুখোর দিকে চেয়ে থেকে হাত উল্টে ঘড়ি দেখিয়ে বলে,’৯টা পনেরো বাজে।সকলে নাস্তা করতে বসেছে।বলেছে পনেরো মিনিটের ভেতরে ওখানে পৌঁছাতে’
‘আচ্ছা কিন্তু তোমার ফুপি তো…..’
‘ফুপিকে আসতে কেউ বলেনি।আপনাকেই ডেকেছে,আপনি আসুন ‘
এই বলে অর্ক চলে গেছে।আনাফ পেছনে তাকিয়ে দেখলো সারথি কাঁথা মুড়ি দিয়ে এখনও ঘুমায়।ওকে আর ডেকে তুললোনা সে।নিজেই ফ্রেশ হয়ে নিচের তলায় গেলো।
সকলে ওরই অপেক্ষায় ছিল।দাদাজান পাউরুটি রঙ চাতে চুবিয়ে খাচ্ছিলেন।আনাফকে দেখে বললেন,’নাতিন জামাই,বলো দেখি রঙ চা দিয়া পাউরুটি আমাদের চিকিংসা শাস্ত্র কতটা যুক্তি দেয় ভালর প্রতি?’
‘রঙ চা শরীরের জন্য ভাল,পাউরুটি ও ভাল।কিন্তু অধিক মাত্রায় পাউরুটি আপনার শরীরের জন্য ক্ষতিকারক। তাই খাওয়া চললেও সেটা সীমার মধ্যে হতে হবে’
‘বুঝলাম,আমার নাতিন কই?’
‘সে তো পায়ের ব্যাথার জন্য হাঁটতে পারবেনা আগামী ৭দিনেও।ধরে নিয়ে আসবো নাকি?’
‘না থাক,ওখানেই নাস্তা চলে যাবে।তুমি খাও।হাসপাতাল যাবেনা?’
‘ছুটি নিয়েছি কদিনের জন্য।’
———–
ফারাজ বাগানে বই পড়ছে।পূর্ণতার হাতে নাস্তার ট্রে ধরিয়ে দিয়েছেন সায়না কাকি।ফারাজ টেবিলে এসে নাস্তা করতে পারতো কিন্তু তিনি দিলেন না।তিনি চান ওরা দুজনে বাগানেই নাস্তা করবে,এই বুদ্ধি অবশ্য দাদাজানের।তিনি উসকানি দিয়েছে ওদের যত একান্তে রাখা যায় ততই ওদের জমবে ভাল একান্নবর্তী ওরিবারে নতুন বউ জামাইকে নিজেরা মিলেই আলাদা করে দিতে হয় কিছু সময়ের জন্য।নাহলে মেলামেশাটা ঠিক জমেনা।
পূর্ণতা মনে মনে ফারাজকে বকতে বকতে বাগানের দিকে যাচ্ছে,এর পেছনে কারণ হলো কাল রাতে পূর্ণতার অনেক কথা বলার ইচ্ছা ছিল,কিন্তু মাঝ পথে ফারাজের নাক দিয়ে বের হওয়া স্বল্প স্বরের ডাক তার সব আশায় পানি ঢেলে দিয়েছিল।ফারাজ সহজেই ঘুমিয়ে গেছে যেখানে ওর কাড়ি কাড়ি কথা জমে ছিল বলার জন্য।এমন বর কার পছন্দ?
কারোরই না।পূর্ণতার মেজাজ সে কারণেই গরম হয়ে আছে।তাও নিজেকে দমিয়ে বাগান অবধি পৌঁছালো সে।এসে দেখে ফারাজ চেয়ারে পায়ের উপর পা তুলে ডান হাতে বই রেখে পড়ছে।পূর্ণতা টেবিলে নাস্তা ঠাস করে রাখতেই নজরটা সে বই থেকে সরিয়ে পূর্ণতার দিকে তুললো।পূর্ণতা কিছু না বলেই গাল ফুলিয়ে রেখে খেতে বসে গেছে।
‘কি হলো?সকাল সকাল আগুনের লাভা ঝরছে কেন?’
‘কাল রাতে আমার কথা না শুনে ঘুমিয়ে গেছিলেন কেন?’
‘ওহ সেটা!ঘুম আসলে তো ঘুমাবোই।রাত আসেই তো ঘুমানোর জন্য’
‘নাহ,আমার কথা শুনার জন্য।সারাদিন কি হয় না হয় এইসব একজন স্ত্রী তার স্বামীকেই তো বলবে তাই না?আর কাকে বলবে?সেখানে আমার কথা না শুনে আপনি কি করলেন!নাক ডাকা শুরু করলেন!’
———-
লোকমান মিয়া মুড়ির বস্তা নিয়ে হাবিজাবি মেনশনের সামনে দিয়ে যাচ্ছিল,বাগানে ফারাজ আর পূর্ণাকে নাস্তা করতে দেখে দাঁড়িয়ে পড়ে অনেকক্ষণ দেখে বললেন,’পালিয়ে বিয়ে করলে এমনই হয়,বাগানেই নাস্তা করবার সুযোগ মেলে।ঘরে আর জায়গা পাইতোনা!হুহ!ঠিক হইছে”
মতিন সেসময় ফুলগাছে পানি দিচ্ছিল।লোকমান মিয়ার এরুপ মন্তব্য সে শুনে ফেলে বলে’আরে গাধা!সবাই মিলেই এদেরকে বাগানে নাস্তা করতে পাঠিয়েছে।এরা নিজ থেকে আসেনি”
‘ওহ তাই?আর তোমাদের সারথি আপা আর তার জামাইর কি খবর?শুনলাম রাতে নাকি রয়ে গেছে।ঘরজামাই রাখবে নাকি?’
‘সবসময় উল্টাপাল্টা ভাবেন কেন আপনি?আপনি তো মজা ভেজালের লোক!সারথি আপা সিঁড়ি থেকে পড়ে পায়ের হাল খারাপ করে ফেলছে বলে রাতে যেতে পারেনি।এখন যাবে’
‘এখন বুঝি দৌড়াইতে পারে?’
‘উফঃ!!আপনি এমন কেন??দৌড়াতে যাবে কি জন্য?হয়ত আনাফ ভাইয়ে কোলে করে নিয়ে যাবে। সব কিছুর একটা সমাধান থাকে’
‘তো কাল রাতে কোলে করে নিয়ে যেতে পারে নাই?কাল এই বাড়িতে থাকলো কেন?’
‘এই বাড়িতে বাসর ভাল হবে বলে।হইছে?আর কিছু জানতে চান?
কি আজব লোক রে বাবা!সব কিছু নিয়ে তার সমস্যা, সব কিছুতে তার দোষ খুঁজতে হবে।আপনার দোকান চলে কিভাবে বলুন তো?সারাদিন টইটই করে যে ঘুরে বেড়ান,দেশ বিদেশের খবর রাখেন।দোকানটা চলে কিভাবে?’
লোকমান মিয়া বস্তা নিচে রেখে বাউন্ডারিতে হাত রেখে বলে,’তবে শুনো,সকলে আমার দোকানে এসে চায়ের অর্ডার দিলে আমি শুরু করি সকল বাড়ির খবরাখবর। তখন চায়ের পর চা শেষ হয়,বিসকুট শেষ হয়।তাদের জানার শেষ হয়না আমারও বলার শেষ হয়না।এবার বলো লাভ টা কিসে হয়?’
মতিন নিজের কপালে নিজে একটা বাড়ি দিয়ে দিলো লোকমানের কথা শুনে।
“হুশের পাগল হলে এমন হয় আর কি।”
‘এটার ঠিক মানে বুঝলাম না।হুশের পাগল মানে কি?’
‘মানে আপনি যে পাগল এটা আপনি জানেন এবং বোঝেন কিন্তু তাও আপনি একটা পাগল’
——-
সারথির ঘুম ভেঙ্গেছে দশটার দিকে।সে জানেই না এখন কয়টা বাজে।উঠে বালিশের পাশে হাতিয়ে বুঝে নিলো রুমে কেউ নেই।তবে গেলো কই?কয়টা বাজে এখন?এসবই ভাবছিল সেসময় পূর্ণতার গলার আওয়াজ শুনে নড়চড়ে বসলো সে।
‘কি গো নতুন বউ।সকাল হয়েছে?’
‘কয়টা বাজে পূর্না?’
‘সেকি জানোনা?বেলা বারোটা বাজে গো’
সারথি নাথায় হাত দিয়ে বলে,’কি বলছো!এত ঘুমালাম?’
‘হুম।তোমার বর তো তোমায় ফেলে চলে গেছে।বলেছে বউ আমার এত ঘুমালে তো চলবেনা,ওর ওঠা অবধি অপেক্ষা করলে হাসপাতালও যাবে সাথে মানইজ্জত ও’
সারথি মন খারাপ করে বললো,’চলে গেলেন?রাগ করেছে কেমন?’
‘হুম।অনেক রাগ করেছে’
তখনই পেছন থেকে ফারাজ এসে পূর্ণতার কান টেনে ধরে বললো,,’সারথি ওর কথা বিশ্বাস করবানা।হুদাই তোমায় ভয় দেখাতে এসেছে।এসব কিছুই হয়নি।আনাফ ভাই বাগানে বছে।ভেবোনা’
সারথি দম ফেললো স্বস্তির।পূর্ণতা রেগে কটমট করে বললো’একটু মজাও করতে দেবেন না?আপনার কি দরকার ছিল এখন আসার?আজিব লোক!আমি যেখাণেই যাই না কেন উনাকেও সেখানে আসতে হবে।’
‘ভেজাল করে যে বেড়াচ্ছেন তাতে কার কি লাভ হচ্ছে?’
‘কারোর লাভ নাহলেও আমার পৈশাচিক আনন্দ হচ্ছে’
‘এমন করে ভেজাল হতে দিব না আমি।চলেন এখন আমার সাথে’
‘রুমে আনাফ ভাই থাকলেও আসতে দেন না।না থাকলেও আসতে দেন না।আপনার কি ভয় হয় আমি সারথি আপুর থেকে আমার কোনো গোপন তথ্য জেনে যাব কিনা সেটা নিয়ে?’
‘মোটেও না’
———
আনাফ বাগান থেকে সোজা সারথির কাছেই আসছিল,তখন তার ফোনে একটা কল আসে, ইমারজেন্সিতে তাকে
হাসপাতাল যেতে হবে একজন গুরুতর রোগী এসেছে তাই।আনাফ দ্রুত সারথির কাছে এসে নিজের মানিব্যাগটা বালিশের তলা থেকে বের করে পকেটে পুরে বললো,’সারথি আমায় হাসপাতাল যেতে হবে রোগী এসেছে।অবস্থা খারাপ রোগীর।নাহলে আরেকজনকে হ্যান্ড ওভার করে দেয়া যেতো।আমাকেই প্রয়োজন। তুমি রাগ করোনা,আমি রাত এগারোটায় এসে তোমায় নিয়ে যাব বাসায়,তৈরি থেকো’
কথাগুলো দ্রুত বলে আনাফ চলে গেছে।সারথি আগেরমতন বিছানাতে বসা ছিল।বিয়ের পরের দিনটা এমন যবে তা ভাবেনি সারথি।তাও মেনে নিয়েছে হাসিখুশি।কারণ সে তো আগে থেকেই জানে আনাফ এমন হুটহাট হাসপাতালের দিকে দৌড় দেবে।
আনাফ যেতে যেতে এটাই ভেবে নিয়েছে সারথি আর যাই হোক অন্তত পরিস্থিতি বুঝবে।তাকে আর আলাদা সময় নিয়ে বোঝানোর দরকার নাই।
সারথি নিজে নিজে বিছানা থেকে উঠতে পারলেও ওয়াশরুম অবধি যাওয়ার সাহস তুলতে পারেনি।আনাফ ও নেই যে ধপ করে পড়লে এসে তুলবে।আশেপাশেও কেউ নেই।সবাই মনে হয় নিচ তলায়।
দেয়াল ধরে এক পা অনেক কষ্টে ফেলেছে সে।মনে হলো পরেরটাও পারবে।
ঠিক তাই হলো।সাহস করে পরের কদন ফেলতে পেরেছে সে।তার খুশি আর ধরে কই। তার মানে পা সেরে আসছে।
——–
আনাফের আজ এগারোটার জায়গায় ১টা বেজে গেলো।রোগীর অপারেশন করার পর তার অবস্থার অবনতি ঘটায় তাকে নিয়ে আনাফের আরও তোড়ঘোর করতে হয়েছিল,যার কারণে হয়ে গেছে অনেক রাত।সারথি অনেক অপেক্ষায় ছিল আনাফের।ভয়ে ফোন করেনি ডিস্টার্ব হবে বলে।সজীবের অফিস টাইমে কল করলে ও রাগ দেখাতো।আনাফকেও সেরকম ভেবে সারথি একটিবার ও কল করেনি।শুধু প্রহর গুনছিল ওর আসার।
আনাফ যে এত দেরি করবে তা ভাবেনি সারথি,ভাবনার বাহিরে হলো সব ।কিছুক্ষণ আগেও জেগে ছিল সে।কিন্ত ঘুমের নেশার সাথে শেষ অবধি আর পারোনি।ঘুমিয়েই পড়েছে।আনাফকে মতিন দরজায় খুলে দিয়েছিল,দিয়েই বলেছে খো
খেতে বসতে।আনাফ খাওয়া দাওয়া বাদ দিয়ে আগে ছুটেছে সারথির রুমের দিকে।
ধীরে দরজা খুলে সে সারথিকে ঘুমন্ত দেখে তার বুকটা যেন জ্বলে উঠলো।সারথি কি এটাই আশা করেছিল তার থেকে!নিশ্চয় অপেক্ষাতে ছিল কখন সে আসবে এই ভেবে,আনাফের ভীষণ খারাপ লাগলো।
সারথিকে জাগানো উচিত না,এদিকে ওর অভিমান টাকে দূর না করলে আনাফের নিজেরই ঘুম হবেনা।
অনেক ভেবেচিন্তে সে গিয়ে আগে ফেশ হয়ে আসলো।সারথি অন্যপাশ হয়ে ঘুমায় এখন।
আনাফ ওর পাশে বসে কয়েক মিনিট ধরে ভেবেছে ওকে জাগাবে নাকি জাগাবেনা।পরে ঠিক করলো জাগাবেনা।সকালেই রাগ ভাঙ্গানো যাবে।
জানালার কাছে এসে পর্দাটাকে সরিয়ে পকেটে হাত ঢুকিয়ে আনাফ দীর্ঘশ্বাস নেয়।সারথিকে খুব বেশি সময় দেয়ার ইচ্ছা ছিল তার, অন্তত বিয়ের পরের সময়টা থেকে।
আজকেই এরকম ব্যস্ততা শোভা পায়নি।
‘আমিও ইচ্ছে করে করিনি আর রোগী তো আর ইচ্ছা করে আসেনি।তাও খারাপ লাগছে আজকের দিনটায় কেন সব হতে গেলো”
জানালায় এক হাত রেখে রাতের কালো আকাশ দেখছিল আনাফ,তখনই তার বাম হাত স্পর্শ করে দাঁড়ায় সারথি।আনাফ শুরুতে মনের ভুল মনে করে থাকলেও সারথির স্পর্শ তার মনের ভুলটাকে সত্যিতে পরিণত করে দেয়।আনাফ অবাক হয়ে জানতে চায় সে কি করে এখানে আসলো আর সে জানেই বা কি করে যে ও এখানে দাঁড়িয়ে আছে।
উত্তরে সারথি কিছুই বলেনা।আনাফের হাতটা ধরে রেখে সে জানালার বাতাস খাচ্ছে।আনাফ আলতো করে ওকে গায়ের সাথে লাগিয়ে ধরে বলে,’আমার একটা প্রশ্নের জবাব দেবে?’
‘হুম’
‘আমি তোমায় যতটুকু চিনেছি সেই প্রেক্ষিতেই বলছি। তুমি আমার উপর রাগ করেছো তাই না?’
‘হ্যাঁ।তবে সামান্য’
‘সেটার কারণ আমার আজকের দিনটা তোমার পাশে না থাকা?’
‘নাহ,দেরি করে আসা।কথা ছিল এগারোটায় আসবেন’
‘বুঝতে পারিনি এত দেরি হয়ে যাবে।আমি নিজেই কষ্ট পাচ্ছি।রাগ করোনা সারথি,আমি নিরুপায়”
‘রাগ সামান্য ছিল।কবেই চলে গেছে।আপনি তো ভাল কাজে দেরি করেছেন।রাগ করবো কেন!’
আনাফও সারথির ঘাড়ে হাত রেখে বললো,’আমি চাইবোনা তোমায় সেসব পরিস্থিতির সম্মুখীন করতে যেগুলো সজীব করেছিল।আমি ওর চেয়ে বেস্ট হয়ে দেখাতে চাই”
———
দেয়ালে কান লাগিয়ে পূর্ণা শুনার চেষ্টা চালাচ্ছে আনাফ সারথি কি কথা বলে।ফারাজ নিজের একটা ছবি আঁকায় এতক্ষণ ব্যস্ত ছিল।আঁকা শেষে রঙতুলি সাইডে রেখেমাথা তুলে তাকাতেই সে দেখে পূর্ণতার কান্ড।
একটা মানুষকে বিয়ে না করলে জানা যাবেনা সে মানুষটা দিনে রাতে কেমন!
এটাই কি সেই পূর্ণতা?বেনি দুলিয়ে ভদ্র মেয়ের মতন ঘুরে বেড়াতো।এই সেই পূর্ণতা?যে এখন দেয়ালে কান লাগিয়ে ননদ আর ননদের জামাইর কথা শুনতে প্রাণপণ চেষ্টা চালাচ্ছে?’
পূর্ণতা কোনো কথা না শুনতে পেয়ে বিরক্ত হয়ে পেছনে তাকাতেই দেখে ফারাজ হাতে স্কেল নিয়প ওর দিকে চেয়ে আছে গাল ফুলিয়ে।
‘হেহে!!মশা মশা।দেয়ালে মশা বসে ছিল।আপনি জানেন দেয়ালের মশারা একটু ভিন্ন।বলতে গেলো মদখোর মশা।
মদখোর মশা মানে হলো ওরা মানুষের চামড়া রেখে দেয়ালে বসে থাকে।তারা ভাবে পুরা দেয়ালটাই একটা চামড়া।তাই ওরা হলো মদখোর মশা।🙄🐸’
চলবে♥#ডাকপাড়ি
#পর্ব_৬১
#আফনান_লারা
________
আনাফের গায়ের আতরের গন্ধটা আজ অনেক বেশি করে ভাসছে বাতাসে।সারথি পারছেনা দূরে দাঁড়িয়ে থাকতে।এদিকে আনাফ ওকে না বলে কিছু করবেওনা সেটা ও খুব ভাল করেই জানে আর তাই নিজ থেকেই আনাফের খুব কাছে এসে দাঁড়িয়ে আছে।কেন,কি কারণে তারা দাঁড়িয়ে আছে তা দুজনেই জানেনা তবে মূহুর্তটা খুব সুন্দর যাচ্ছে।
আনাফ সারথির ঘাড়ে হাত রেখে ওকে ধরে বলে,’চলো ফাঁকা রাস্তা থেকে ঘুরে আসি’
‘এই রুমই ভাল’
আনাফ অবাক হয়ে সারথির দিকে চেয়ে রইলো।তারপর আবারও জানালার দিকে ফিরে বলে,’কেন?মন খারাপ?’
‘মন ভাল হবার জন্য এই রুমটাই যথেষ্ট ‘
‘এভাবেই সারারাত দাঁড়িয়ে থাকবো নাকি?’
‘তো চলুন বিছানাতে বসি,আমি তো দাঁড়িয়ে থাকতেও বলিনি ‘
আনাফ সারথিকে টেনে বিছানার কাছে নিয়ে বসে।দুজনে সেখানে বসে এবার পা দুলাচ্ছে।রুমের ড্রিম লাইটের আলোটুকু আলাদা পরিবেশে নিয়ে গেছে ওদের।সারথির অবাধ্য খোলা চুলগুলো ওর পা দোলার সাথে পাল্লা নিয়ে দুলছে বারবার।আনাফ সেটাই দেখছিল এতক্ষণ। সেসময় সারথি বলে ওঠে,’কি দেখছেন?’
‘আমি যে তাকিয়ে আছি বুঝলে কেমনে?’
‘আমার সামনে থাকলে যে আমাকেই দেখেন সেটা জানি।তাই আর জানতে হয়না’
আনাফ জিভে কামড় দিয়ে মুখটা ঘুরিয়ে বলে,’আর কি করি বলো!কত সাধনার বউ,কত সাধনা করে তাকে পেলাম।দেখবো না তো কি করবো?’
সারথির মুখে হাসি ফুটে গেলো, তারপর আবারও পা দুলাতে দুলাতে বললো,’আপনি অনেক ফ্লার্ট করতে জানেন’
‘বিশ্বাস করো!জানতাম না।তোমায় দেখে মুখ দিয়ে গড়গড় করে বের হয়ে আসছে এইসব।আমি এমন ছিলাম না।আমার মুখ দিয়ে কোনো মেয়ে ভালবাসার কথা বের করতে পারতোনা।সেই আমি তোমায় দেখে কবি,উপন্যাসিক হয়ে গেছি ‘
সারথি এবার খিলখিল করে হেসে ওঠে।ওর হাসির আওয়াজ শোনা গেলো পূর্ণতা আর ফারাজের রুমে।
পূর্ণতা সেসময় ফারাজের কানের কাছে ঘ্যানঘ্যান করছিল।সারথির হাসির আওয়াজ পেয়ে ফারাজকে রেখে দিলো এক দৌড়।সোজা দরজার দিকে।ফারাজাও বেশ বুঝতে পারে যে পূর্ণতা ওদিকেই যাওয়ার জন্য দৌড় দিয়েছে।তাই সে শোয়া থেকে উঠে এসে পূর্ণার হাত ধরে আটকালো।
‘না আপনি যাবেন না’
‘আরেহ আপু হাসতেছে।মনে হয় মজার কোনো কথা বলছে।আমি গিয়ে একটু শুনে আসি’
‘নতুুন জামাই বউ হাসবেনা তো কি কাঁদবে?আজব কথাবার্তা! আপনার কি লজ্জা নাই?ওদের দরজা বন্ধ এখন জানেন না?’
‘দরজা খুলতে বলবো’
‘কানের নিচে একটা উত্তমধ্যম চড় দিয়ে আপনার এই ছেলেমানুষি তুলে দিব।চুপচাপ গিয়ে শুয়ে পড়ুন।আসছে আমার বোন আর বোনের জামাইকে ডিস্টার্ব করার জন্য।আরেহ আমাকে ডিস্টার্ব করেন না,কোনো সমস্যা নাই।আমার বোনকে কেন ডিস্টার্ব করবেন?চুপচাপ গিয়ে ঘুমাবেন এখন’
পূর্ণতা কোমড়ে হাত রেখে ফারাজের দিকে বিরক্ত চোখে চেয়ে বলে,’আমি সাধে করছি এইসব?আপনি আমায় সময় দেন না,আমার সাথে কথা বলেন না।নতুন বউ জামাই অনুভূতি হয় না বলেই তো আমার অন্য দিকে ঝোঁক।আপনি যদি ঠিকঠাক ব্যবহার করতেন তবে তো আমার আরেকজনের টা দেখতে যেতে হতোনা’
ফারাজ মুখ ফুলিয়ে বিছানায় এসে বসে বলে,’মানে কি সোজা করে বলে দেন।এত প্যাঁচ বুঝিনা’
পূর্ণতা চট করে ফারাজের পাশে বিছানায় উঠে বসে বললো,’শুনুন।আপনি আমায় নিজের ইচ্ছেতে বিয়ে করেছিলেন তাই না?’
‘হুম।তো?’
‘তো আমার সাথে এক রুমে ঘুমাতে আপনাকে সবাই মিলে জোর করাতে হয় কেন?’
ফারাজ চুপ করে আছে এবার।পূর্ণতার কথার জবাব কি দিবে তা সে জানেনা কিন্তু জবাব তো দিতেই হবে,এদিকে জবাবটা তার জানা নাই।বানিয়ে বললেও বিপদ।পূর্ণতার সামনে কথা বানানো অসম্ভব।
‘কি হলো বলুন ‘
‘আপনি কি চাইছেন বলেন?আমি বাদ রাখবোনা’
পূর্ণতা ওমনি ফারাজের গায়ের সাথে লেগে বসে বললো,’আপাতত চাই আমাকে বউ হিসেবে আদর যত্ন করেন।তাতেই হবে’
‘আমি কি অনাদর করতেছি?’
‘ওটাই তো সমস্যা। আপনি কিছুই করতেছেন না।বিষয়টা এমন হয়েছে যে, খাচ্ছি দাচ্ছি আর ঘুমাচ্ছি।আমাদের যে বিয়ে হয়েছে,আমরা য়ে নতুন বউ জামাই সেটা দেখে বোঝা যায়না।কিন্তু জানেন?সারথি আপু আর আনাফ ভাইকে দেখে বোঝা যায় তারা নতুন বউ জামাই’
‘তো কি করতে হবে নতুন বউ জামাই অনুভূতি আনতে হলে?’
‘রাতে বসে গল্প করতে হবে,হাসাহাসি করতে হবে’
‘হাসির কথা না হলে হাসবো কি করে?আমার তো কোনো কিছুতেই হাসি পায়না’
পূর্ণতা ওমনি দাঁত কেলিয়ে ফারাজকে কাতুকুতু দেয়া শুরু করে দেয়।ফারাজ এইটার জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিল না।হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খাচ্ছে সে এখন ।তাদের দুজনের রুমের দরজা খোলা ছিল।অর্ক হাতে বই নিয়ো পানি খেতে এসছিল এদিকেই।ফারাজকে চেঁচামেচি করতে শুনে সে এদিকে এসে দরজায় হাত রাখলো ধাক্কা দিতে ওইসময় ফারাজ দরজা খুলে বের হয়ে আসলো।অর্ক ওকে কিছু বলতে যাবে তার আগেই পূর্ণতা ও বের হয়ে গেলো।আবারও ওকে কাতুকুতু দেবে এমন সময় অর্ককে দেখে নিজেকে সংযত রাখলো সে।অর্ক চশমা ঠিক করে বলে,’চাচ্চু তুমি কি চাচিমণিকে ভয় পাও?’
‘না তো’
ফারাজ পাঞ্জাবি টেনে ফু দিলো।পাঁচ মিনিটের কাতুকুতু দিয়ে পূর্ণতা ফারাজের হাল খারাপ করে ফেলেছে।অর্ক পূর্ণতার দিকে চেয়ে বলে,’তুমি কি চাচ্চুকে ভয় দেখাচ্ছিলে?’
‘তোমার চাচ্চু কাতকুতুতে ভয় পায়।সেটা দিয়েছি বলে পালাচ্ছিল,সত্যি কথা বলতে লজ্জা পায়’
ফারাজ কপালে হাত দিয়ে বললো,’ওরে না বলার পেছনে কারণ ছিল আমার।এখন ও পুরো বাড়িসুদ্ধ সবাইকে জানাবে’
এই কথা শেষ করেই ফারাজ দেখে অর্ক উধাও।সত্যি সে সবাইকে বলতে গেছে পূর্ণতা ফারাজকে কাতুকুতু দেয়।
——–
‘ আচ্ছা বাইরের রুম থেকে হট্টগোল কিসের শোনা যায়?আপনি শুনছেন?’
‘হুম।দাঁড়াও দেখে আসি’
আনাফ উঠে এসে দরজা খুলতেই অর্ক ওর সামনে এসে দাঁড়ায়।সে এদিক দিয়েই যাচ্ছিল।
‘কি ব্যাপার অর্কবাবু?কিছু হয়েছে নাকি?’
‘পূর্ণতা চাচিমণি ফারাজ চাচ্চুকে কাতুকুতু দিয়ে ভয় দেখাচ্ছে।’
সারথি এ কথা শুনে মুখে হাত দিয়ে ফেললো।আনাফ পেছনে তাকিয়ে ওর দিকে চেয়ে বললো,’তোমাদের গোটা বাড়িটাই একটা বিনোদনকেন্দ্র।এই খবর এবার আর কাকে জানাবে এই পিচ্চি??”
‘দাদাজানকে জানাবে এবার।পূর্ণতা আর ফারাজ ও কম না।এই কথা বাইরে পাচার হলো কি করে?’
———-
ফারাজ পর্দার আড়ালে দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে আর অর্ক সারা বাড়ি করে এসেছে পূর্ণতা ফারাজকে কাতুকুতু দিচ্ছে।
পূর্নতা শুরুতে এটাকে তেমন একটা গুরত্ব না দিলেও এখন যে পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে তাতে লজ্জার তার চামড়া খসে পড়ে যাচ্ছে।ফারাজ যে পর্দার আড়ালে দাঁড়িয়ে ছিল সেটার পেছনে এসে এবার পূর্ণতাও দাঁড়িয়ে আছে।
‘শান্তি হইছে আপনার?বউ জামাই ফিলিংস আসছে?’
পূর্ণা দেয়ালে পিঠ লাগিয়ে ফারাজের দিকে কপাল কুঁচকে চেয়ে বললো,’নিজেদের মাঝে জামাই বউ ফিলিংস আনতে চাইছিলাম।ঢাকঢোল পিটিয়ে এমনটা চাইনি আসলে’
‘এখন কেমন লাগছে আপনার?পুরা জামাই বউয়ের সম্পর্কের গুষ্টি উদ্ধার করে দিয়েছে অর্ক।গিয়ে বলেন আর কিছু লাগলে’
‘এভাবে বকতেছেন কেন?আমার কি মনে ছিল নাকি এত কিছু?আর বউ জামাইকে কাতুকুতু দিতেই পারে।এটা স্বাভাবিক।মানুষ জানলে কি হইছে!’
‘ স্বাভাবিক হলে পর্দার আড়ালে আমার সাথে এসে লুকিয়েছেন কেন বলুন?’
‘হেহে!!জামাই লুকিয়ে থাকবে আর বউ বাইরে বাইরে ঘুরবে।বিষয়টা কেমন দেখায় না?’
————
আনাফ ফারাজ আর পূর্ণতাকে পর্দার আড়ালে গিয়ে ফিসফিস করতে দেখে চলে এসেছে ওখান থেকে।রুমে এসে দরজা লাগিয়ে সারথির পাশে বসতেই সারথি জানতে চাইলো বাইরে কি হচ্ছে।
‘তোমার ভাই আর ভাইয়ের বউ দুইজনেই বয়সের তুলনায় একেবারে অপরিপক্ব।অর্ক খবর পাচার করছে দেখে দুজনেই পর্দার আড়ালে গিয়ে লুকিয়ে আছে।ভাবতে পারো!’
সারথি মাথায় হাত দিয়ে বললো,’ওদের জন্য রুম খালি পড়ে আছে।পর্দার আড়ালে লুকানোর কি দরকার।হায়রে!বিয়ে করে দুজনের মাথাটা পুরো গেছে’
সারথি আর হাসি আটকাতে পারছেনা।হেসেই চলেছে সে।আনাফ বিছানায় পা তুলে গুটিশুটি দিয়ে শুয়ে পড়লো হঠাৎ।মাথাটা রাখলো সারথির কোলে।এতদিনের এই ইচ্ছাটা পূরন করার একটা নির্দিষ্ট সময় খুঁজছিল।সেই সময়টা এসে গেছে বলে পূরণ করে নিলো।
সারথি আনাফের কপালে হাত রাখে।মানুষটাকে এভাবে এর আগে ছুঁয়ে দেখা হয়নি।আনাফের কপালে হাত দিয়েই শিউরে ওঠে সে।
ইশ যদি চোখে দেখা যেতো!মানুষটা কিরকম যদি জানা যেতো!!তার ঠোঁটজোড়া দেখা যেতো!’
আনাফ সারথির বিষণ্ণবদন দেখে জানতে চায় এর কি কারণ।
‘আমি কেন আপনাকে দেখার সৌভাগ্য পেলাম না?’
‘মানুষটাকেই পেয়ে গেছো।চোখে দেখার সৌভাগ্য চাও?পুরো সৌভাগ্য টাই তো তোমার সারথি।যাকে দেখায় পাওনি,তাকে ছোঁয়ায় পাবে।কতটা সৌভাগ্যবতী তুমি ভাবতে পারো?’
চলবে♥#ডাকপাড়ি
#পর্ব_৬২
#আফনান_লারা
________
সারথির বিয়ের খবর সজীবের বাবাকে আশাহত করে দিয়েছে।তিনি সারথির উপর নয় বরং সজীবের উপর ক্ষেপে আছেন প্রচণ্ডরকম ভাবে।তার মতে সজীবের বেহুদা কার্যকলাপের জন্যই আজকের এই দিনটা এসেছে।সারথির কোনো দোষ তিনি দেখেননা।একটা মানুষকে অবহেলা করলে সে তো অন্যদিকে যাবেই।আর সজীব থাকতে তো সারথি এসব কিছু করে নাই।সজীবের আচরণে আর ডিভোর্সের পরেই আনাফের সাথে সম্পর্ক গড়েছিল।সজীব ও সারথির দোষ দেয়নি।সে দোষ দিয়েছে নিজের কপালের।
যাই হোক দুই দিন দুই রাত বাবার রাগারাগি তো অতীষ্ঠ হয়ে সে সিদ্ধান্ত নেয় মালয়েশিয়া ফেরত চলে যাবে।কারণ দেশে থেকে তার আর কোনো কাজ নেই,যেটা ঠিক করতে এসেছে সেটা বেঠিক হয়ে বসে আছে।এখন আর চিৎকার দিয়েও বিষয়টা আগেরমতন সাজানো যাবেনা।
সজীবের এই সিদ্ধান্ত টাকে বাবা খুব সিরিয়াসলি নিয়েছেন।তবে!তিনি ভেবেছেন সজীব মালয়েশিয়া যাওয়া মানে ওকে সহজে আবার বাংলাদেশে আনা অসম্ভব। আর সজীবের কাছে মালয়েশিয়া মানেই হলো লেভেন নামের সেই মেয়েটা।অনেক হারাম সম্পর্ক গড়েছে তারা,এবার নাহয় সব ভুলে মানসম্মান বাঁচাতে ঐ মেয়েটার সাথেই সজীবের বিয়েটা দিয়ে দেয়া উচিত।
অনেক ভেবেচিন্তে তিনি এই সিদ্ধান্তটা নিয়েছেন।সজীব মালয়েশিয়া চলে যাবার আগেরদিন রাতে তিনি ওকে ডেকে পাঠালেন নিজের রুমে।
—-
‘বাবা আসবো?’
‘এসো’
বাবা তখন ফোন দেখছিলেন।সজীবকে দেখে ফোন রেখে ওর দিকে মুখ তুলে তাকালেন।
‘বলতে পারো লেভেন মেয়েটার বয়স কত?’
‘২৬’
‘এত বয়স??কবে থেকে প্রেম করো তোমরা?’
‘কয়েক বছর!
‘যাই হোক,যে দোষী তাকে তার দোষ মনে করিয়ে দিয়ে সময় নষ্ট করতে চাইনা আমি।শুনো,ঐ মেয়েটাকে বলো তার পরিবার নিয়ে আমাদের বাসায় আসতে।তোমাদের বিয়ের ব্যাপারে কথা বলবো’
এ কথা শুনে সজীব যেন আকাশ থেকে ধপাস করে নিচে পড়লো।বাবার দিকে হা করে তাকিয়েই থাকলো শুধু।বাবা ওকে অবাক হতে দেখে আবার বললেন,’এত হা করে তাকিয়ে থাকতে হবেনা।সারথির সাথে যদি লেভেনকে কমপেয়ার করা হয় আমি সারথিকেই বেছে নিব।কিন্তু আফসোস!সারথি আর আমাদের রইলোনা।তোমায় আর ঐ মেয়েটাকে এখন আবার আগেরমতন তো খোলামেলা চলতে ফিরতে দিতে পারিনা।সব কিছুর একটা নাম থাকে তাই আমি চাইছি তোমাদের বিয়েটা দিতে।যেটা বলছি করো।আমার হাতে সময় কম।লন্ডনে ফেরত যেতে হবে।’
———
আনাফ সারথিকে নিয়ে তাদের বাসায় এসেছে।বাবা বাসায় ছিল না তখন। মা আর ফুফুরা মিলে সারথিকে ওয়েলকাম জানায় সুন্দরভাবেই।আনাফ সারথির সাথে সাথেই থাকছিল কিন্তু ওর ফুফাতো বেনেরা দুষ্টামি করে ওকে খোঁচা দিয়ে কত কথা শুনালো যার কারণে লজ্জার চোটে এখন সে সারথির ধারের কাছে গিয়েও বসতে পারছেনা।ওদের কথার ভয়ে সে যাচ্ছেনা মূলত।
সারথির আশেপাশে ওর ফুফাতো বোনেরা সব ঘুরঘুর করছে।
আনাফ দেখলো সময় পেরিয়ে যাচ্ছে তাও কেউ সারথিকে ওর রুমে আসতে দিচ্ছেনা।যেভাবে সবাই গল্প জুড়েছে, এই গল্প রাত বারোটা পেরিয়ে যাবে তাও শেষ হবেনা।ফুফুদের গল্পের আসর অনেক ভারী।আনাফ খুব ভাল করে জানে।ছোটকালে মা যখন ওকে আর অধরাকে নিয়ে ফুফুদের বাসায় বেড়াতে যেতো, গল্প করতে করতে রাত দুটোর দিকে সকলে ঘুমাতো।এত এত গল্প করতো সবাই।এখনও তাই।আনাফের পেটে কামড় দিলো এই ভয়েই।সারথিকে যে করেই হোক ছলছাতুরি করে তার রুমে আনতে পারলেই হলো,এরপর আর বোনেরা যাই করুক আনাফকে সারথির পাশ থেকে সরাতে পারবেনা।
বুদ্ধি করে আনাফ নিজের রুমের মাঝে গিয়ে দাঁড়ায়।ফোন বের করে কথা বলার এক্টিং করে চেঁচিয়ে বললো,’হ্যালো,হ্যাঁ স্যার।জি স্যার,আমার ওয়াইফ বাসাতেই আছে।দাঁড়ান দিচ্ছি’
এই বলে আনাফ দরজার কাছে এসে বলে,’সারথি একটু এদিকে এসো,আমার হাসপাতালের সিনিয়র একজন সার্জন কল করেছেন।আমার ফ্রেন্ড হয়।কথা বলতে চায় তোমার সাথে,সে এখন কানাডা তাই আসতে পারেনি বাসায়’
সারথি মাথা নাড়িয়ে নিজে নিজে এদিকে চলে আসলো দেয়াল ধরে ধরে।আনাফের ফুফাতো বোনেরা বুঝতেই পারেনি আনাফ নাটক করছে।
আনাফ সারথির হাত ধরে তার রুমে নিয়ে এসে দরজাটা ঠেলে দিয়ে সারথির কানের কাছে ফিসফিস করে বললো,’শুনো।আমি মিথ্যে বলেছি।কেউ কল করেনি। তোমাকে এই রুমে আনার নিঞ্জা টেকনিক ফলো করলাম।চুপ করো বসো এখন ‘
সারথি মুচকি হেসে বিছানায় বসে।আনাফ দম ফেলে দরজাটা আটকাতে যাওয়া ধরতেই দেখে তার ফুফাতো বোনেরা এসে হাজির।
‘কই দেখি কিসের কথা হয়’
আনাফ ভয়ে চোখ বড় করে চেয়ে আছে সবার মুখের দিকে তাকিয়ে।তখনই সারথি আনাফকে বাঁচাতে বলে উঠলো,’কথা বলা শেষ’
‘ওমা এত জলদি?’
‘হুম।শুধু জানতে চেয়েছিল ভাল আছি কিনা’
এবার সবাই বিছানায় উঠে বসে গল্প শুরু করে দিছে।আনাফ নিজের কপাল চাপড়াতে চাপড়াতে সারথির পাশের খালি জায়গায় বসেছে।
বেশ কিছুক্ষণ পর হঠাৎ ফুফু এসে সবাইকে চলে যেতে বললেন রুম থেকে।সারথিকে রেস্ট নিতে বলে আনাফের সব ফুফাতো বোনদের নিয়ে তিনি চলে গেলেন ওখান থেকে।আনাফ তো খুশিতে মনে মনে ঠিক করে নিলো ফুফুকে আড়ংয়ের গিফট কার্ড কিনে দিবে।কত বড় উপকার করলো ফুফু।খুশিতে নাচতে নাচতে গিয়ে দরজাটা লক করে সে এক ছুটে সারথির পাশে এসে বসে আবার।
সারথি বললো,’আপনি এমন পাগলামো কেন করছেন শুনি?আমাকে আর দেখেননি?’
‘হাসপাতালের ছুটি আর কয়েকদিন আছে।তাই এই সময়গুলো উপভোগ করে নিচ্ছি।আর কিন্তু সহজে সময় পাবোনা’
———–
‘বুঝলেন ভাই।হাবিজাবি মেনশনের নামটা একেবারে সার্থক।এই মেনশনের মানুষগুলা সব আউলাঝাউলা,তাদের কাজকর্ম ও সব আউলাঝাউলা।
আজকের কথাই বলি শোনেন, জীবনে দেখছেন ছেলে বিয়ে করাই আনলে মেয়ে পক্ষের বাড়ি থেকে গাজী টাংকি দিতে?এই বাড়িতে সেই কাজটাই হইছে।ওদের ঐ যে ছেলে ফারাজ আছেনা?ওরে বিয়ে করাইছে কয়েক দিন আগে।ওমা!আমি ভাবতেছিলাম মেয়ের বাড়ি থেকে বুঝি কিছুই দেয়নাই!
আজ দেখলাম মেয়ের বাপে একটা গাজী টাংকি লইয়া আনছে।ভাবতে পারেন!কতটা আজগুবি কাজ!!
যৌতুক হিসেবে কেউ গাজী টাংকি দেয়?’
লোকমান মিয়ার কথা শুনে অপরিচিত লোকটি চায়ে চুমুক দিয়ে আগ্রহ সহকারে বলে,’হয়ত তাদের টাংকির প্রয়োজন।বিয়েতে তো ছেলেরা তাদের প্রয়োজনের কথা জানালে মেয়েরা সেটা দেয়’
‘টাংকি কেন প্রয়োজন!ওহ হো মনে পড়ছে।টাংকিতে তো হিসু করে রাখে বাড়ির বিচ্ছু গুলা।তবে নতুন টাংকি কি জন্য?এটাতে কি হিসু করবেনা?’
‘হিসু করে মানে?এটা কেমন কথা?টাংকিতে প্রস্রাব করবে কেন?’
‘আপনি জানেন না?’
‘না’
‘তাহলে ধরেন আরেক কাপ চা।শোনেন কাহিনী,এদের বাড়ির টাংকিতে সারাদিন ইউরিন মিক্স করা পানি থাকে।এরা সেটা দিয়ে শরবত বানাই খায়’
‘কি বলছেন সত্যি?’
‘আরেহ হ্যাঁ।শুধু খায়না।ধোয়,গোসল করে সব সব।খবিশ দেখতে হলে এই বাড়িতে গিয়ে দেখেন’
‘এটা আদৌ সম্ভব?
‘আপনার বিশ্বাস হচ্ছেনা তো?আপনি এক কাজ করেন,ওদের বাসায় যান।আপনাকে শরবত খাইতে দিবে।তারপর সেই শরবত যদি নোনতা লাগছে তো বুঝে নিবেন ওটা টাংকির পানি’
‘ছিঃ!কি বলছেন।এত খবিশ এরা?’
‘হুমম।মস্ত বড় খবিশ।যাই হোক,কি বলা ধরছিলাম যেন?’
‘বিয়েতে কেউ টাংকি দেয়?এটা বলছিলেন’
‘ওহ হ্যাঁ,
ভাবেন!টাংকি মানুষ বিয়ের উপহার হিসেবে দেয়!এটা কেবল এই বাড়ির মানুষের চিন্তাধারার সাথেই মেলে।অন্য মানুষ এগুলা চাইবেনা অন্তত’
———
পূর্নতা টাংকিতে তালা দিয়ে চাবি নিজের আঁচলে বেঁধে বললো,’এইবার কি করে এই টাংকির পানি নোংরা করে বাবুরা সেটাই আমি দেখবো।এখন থেকে আমি যেভাবে চালাবো সেভাবে চলবে বাড়ির প্রতিটা বাচ্চাকাচ্চা!
ফারাজ ছাদের এক কোণায় বসে ছবি আঁকছিল।অর্ক ওর পাশে বসে বইয়ের পাতা উল্টাচ্ছিল।পূর্ণতা কোমড়ে হাত দিয়ে টাংকির পাশে দাঁড়িয়ে বুক ফুলিয়ে বিড়বিড় করছে।সেটা দেখে অর্ক ফারাজকে বলে,’চাচিমণি মনে মনে গৌরবিত হচ্ছে কেন?’
‘টাংকিতে তালা দিয়ে নিজেকে মহারাণী ভিক্টোরীয়ার নাতনি ভাবতেছে’
‘উনিও হয়ত এই অসাধ্য সাধন করতে পারে নাই।টাংকিতে তালা দেয়া মহৎ কাজ।যদিও আগে জানতাম না তবে চাচিমণিকে এভাবে গৌরবিত হতে দেখে মনে হলো।আমিও টাংকিতে তালা দিব ভাবছি’
——
ফারাজের রুমে ডাবল বেড আনা হয়েছে।
অনেক সুন্দর একটা ডিজাইনে করা ডাবল বেডটা পেয়ে পূর্ণতা মাঝখানে শুয়ে শুয়ে ছাদ দেখছে।ফারাজকে জায়গা দিচ্ছেনা।ভাবতেই মনটা ভাল হয়ে যাচ্ছে পূর্ণতার যে আজ থেকে এই সুন্দর খাটটা তার।ফারাজের অবশ্য এদিকে ভ্রুক্ষেপ নেই নতুন খাটে বসার কিন্তু খাট আসার ঘন্টা কেটে যাবার পরেও পূর্ণতা ওকে বসতে দেয়নি।সে পুরো খাটে গড়াগড়ি করছে।
‘এক কাজ করেন।খাটের কাঠ ভেঙ্গে চিবিয়ে খাওয়া শুরু করে দেন’
‘আপনার হিংসা হচ্ছে?এতদিন তো শুকনা-চিকনা খাটে শুতেন,
এখন আমি আসায় দাদাজান এই নান্দনিক খাটটা এনে দিয়েছে বলে আপনার হিংসা হচ্ছে?’
‘মোটেও না।আপনি পুরো খাট জুড়ে শুয়ে থাকেন,আমার কিছু না।’
‘তবে এত কথা কেন বলছেন? যান না নিজের কাজ করেন ‘
ফারাজ মনে মনে পূর্ণতা বকা দিয়ে হাতের কাজটা শেষ করে গোসলে গেলো।সব সময়কার মতন তোয়ালে নিতে ভুলে গেছে।আগে ফাঁকা রুমে বেরিয়ে এসে বিছানা থেকে তোয়ালেটা নিতো,কিন্তু এখন কিভাবে নিবে?’
‘পূর্ণা?’
‘কে?কে ডাকে আমায়?’
‘ঢং করতে হবেনা।বিছানার কোণায় আমার তোয়ালে আছে।এনে দিন’
‘বুঝে গেছি আমি।তোয়ালে দিতে আসলে আপনি আমায় হ্যাঁচকা টান দিয়ে ভেতরে নিয়ে যাবেন তারপর রোমান্স হবে।ইশ! আমার লজ্জা করে।আমি পারবোনা তোয়ালে দিতে।যাঃ দুষ্টু!’
‘পূর্ণতা ফাজলামি বন্ধ করে আমার তোয়ালেটা দিন।শীতে কাঁপতেছি।গা মুছতে হবে আমার’
‘আগে প্রমিস করেন আমাকে টান দিবেন না’
‘আমার ঠেকা পড়ছে আপনাকে টান দেয়ার।সোজাসুজি আমার তোয়ালে দেন বলছি!’
পূর্ণতা তোয়ালেটা নিয়ে ওয়াশরুমের কাছে এসে সামনে ধরলো।ফারাজ তোয়ালেটা ধরে টান দেয়া ধরতেই পূর্নতা বললো,’আপনার কি মনে হয়না আমাকে টান দেয়া উচিত? ‘
‘এখনই বললেন যে টান যেন না দিই।প্রমিস ও করালেন, এখন আবার এসব কি?তোয়ালেটা ছাড়ুন। আমায় দিয়েও আবার দিচ্ছেন না?কি হয়েছেটা কি আপনার!!”
———
আনাফ দরজায় কান লাগিয়ে শুনছে বাইরের রুমে ফুফুরা সবাই হাসাহাসি করছে ওকে নিয়ে।বউ পেয়ে নাকি পাগল হয়ে গেছে সে।এ কথা শুনে আনাফের লজ্জায় ইচ্ছে করছিল বাড়ি ছেড়ে দূরে কোথাও পালিয়ে যেতে।কথাটা সারথিও শুনেছে।
‘আপনার কি দরকার ছিল দরজা লক করার?’
‘বোনেরা কেউ যাতে আসতে না পার তাই তো দরজা লক করলাম।আমি কি জানি দরজা লক করলে ওরা এসব বলবে।আর ফুফুই তো ওদের নিয়ে গেলো আমাদের একা সময় দেয়ার জন্য।তবে এখন এসব কেন বলছে?’
—–
‘আনাফ যে অন্য সবার চাইতে আলাদা সেটা আমরা আগেও জানতাম কিন্তু ও যে সারথির মতন একটা মেয়েকে বিয়ে করে দেখিয়ে দিবে তা আসলেই ভাবনার বাহিরে ছিল আসমা!’
‘ঠিক বলছেন আপা।আমি নিজেও অবাক হয়েছি যখন শুনলাম ও সারথিকে ভালবাসে,বিয়ে করতে চায়।আনাফের পছন্দ কিরকম সেটা জানতাম কিন্তু ওর এমন অদ্ভুত পছন্দ যে বাস্তবে পূরণ হয়ে যাবে তা আসলেই ভাবিনি।আমার এখনি সব স্বপ্নের মতন মনে হয়।আনাফ সব কেমন করে যেন সত্যি করে নিলো।ওর বাবাকেও রাজি করিয়ে নিয়েছে রাগ দেখিয়ে’
‘আসলে ভাগ্য ছিল বলেই হয়েছে নাহলে ভাইজানের যে চয়েস।সারথিকে জীবনেও তিনি আনাফের পাশে মেনে নেয়ার মতন মানুষ না।তাও কিরকম করে যেন বিয়েসাদি সব হয়ে গেছে। ভাইজান কোথায় এখন?’
‘অফিসের কাজে ঢাকার বাহিরে গেছে’
‘নাকি রাগ করে?’
‘নাহ রাগ নয়।বরং অপেক্ষায় ছিল কখন সারথি আনাফ আসবে বাসায়।আমাকে বলেছে সব তৈরি রাখতে’
——
সারথি নিজে নিজে উঠে রুমের এক কোণায় একটা জায়গা আবিষ্কার করলো যেখানে নিচে কিছু কুশন পাতানো আর কয়েকটা ফুলের গাছ তাও তাজা,জীবন্ত।
আনাফ সেসময় দরজায় কান রেখে সব শুনার চেষ্টায় ছিল।সারথি সেখানে বসে হাত বাড়িয়ে ফুলগাছগুলো ছুয়ে ছুঁয়ে দেখছে।এর আগে আনাফের রুমে তার আসা হয়নি।অধরা যে বাসায় আছে ওটাতে আনাফের রুমে যাওয়া হয়েছে কিন্তু এই বাসার রুমে এ প্রথমবার।কুশন একটা কোলে নিয়ে যে সামনে মুখ ঘুরিয়ে আন্দাজেই বলে ওঠে,’আনাফ পাশে বসবেন একটু?আমায় বলুন তো এই জায়গায় আলো কিরকম আসে?এখন থেকে আপনার চোখ দিয়ে দেখতে চাই।আগের মানুষটা আমায় কেবল কালো রঙটাই চিনিয়েছে।আমি জানি আপনি আমায় রঙধনুর রঙ চেনাবেন’
চলবে♥