#ডাকপাড়ি
#পর্ব_৯
#আফনান_লারা
________
বাচ্চা মানুষ মজা করবেই,এটাই স্বাভাবিক। কিছু কিছু বাচ্চা আবার বাজে মজা করে।অর্ককে সেরকমই লাগলো পূূর্ণতার।সেজন্যে মিছে হাসি দিয়ে সে কাপটা নিয়ে চলে আসছিল ওখান থেকে।অর্ক তখন গলার আওয়াজ বাড়িয়ে বলে,’আমি যা বললাম তা কিন্তু সত্যি’
পূর্ণতা এবার থেমে গেলো।আবার আগের জায়গায় ফিরে জানতে চাইলো অর্কর বলা কথাটার ব্যাখা।অর্ক পূর্ণতার চায়ের কাপটা নিয়ে টেবিলে রেখে বললো,’আমাদের বাড়ির টাংকিতে অনন্ত আর সিয়াম দুষ্টুমি করে প্রস্রাব করে,প্রায় প্রতিদিন। সেই পানি দিয়েই আপনার জন্য চা আর আমার জন্য দুধ বানিয়ে আনা।তাই আমি দুধ ফেলে দিয়েছি।যা বললাম সব সত্যি।এই বাড়ির কোনো কিছু বিশ্বাস না হলে ফারাজ কাকাকে জিজ্ঞেস করতে পারেন’
পূর্ণতা কাপটা তুলে জানালা দিয়ে সব চা ঢেলে খালি কাপ নিয়ে হেঁটে চলে গেছে।অর্ক পুনরায় নিজের পড়ায় মন বসিয়েছে।
ফারাজ তার ঘরে বসে সেই বইটা পড়ছিল যেটা অর্কর রুম থেকে সে এনেছে।বইটা শুরুতে বেশ একটা ভালো না লাগলেও কয়েক পৃষ্ঠা যেতে যেতে তার আকর্ষণ বাড়তে লাগলো।ফারাজ এবার পুরোপুরি বইটিতে ডুব দিয়েছে।পূর্ণতা কাপ রান্নাঘরে রেখে এসে নিজের রুমে বসে বসে পা দুলায়।গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে আছে।একটু পানি খেতে পারলে ভাল হতো।
“এই বাড়িতে কেউ কি পানি খায়না?খেলেও কি ঐ টাংকির পানি খায়?ছিঃ! এ কোন খাচ্চোর বাড়িতে এসে পড়লাম।আমার হলই তো ভাল ছিল’
টেবিলের উপরে রাখা গ্লাসটার সব পানি ফেলে পূর্ণতা রুম থেকে বেরিয়ে ফারাজের রুমের দিকে চললো।ফারাজের রুম খোঁজা মুশকিল মনে হয়।এখানে সব রুমের মাঝে একটা করে খালি রুম।এত এত রুম তৈরি করার কি দরকার ছিল?বিরক্ত লাগছে।একটা বাদে একটা রুমে মানুষ।গোলচক্কর দিয়ে অবশেষে সে ফারাজের রুমের সন্ধান পেয়েছে।রুমের কাছে এসে উঁকি দিলো আগে।ফারাজ বিছানায় শুয়ে শুয়ে বই পড়ছে। পূর্ণতা দরজার কড়া নেড়ে বললো,’আসি?’
‘নাহ’
‘একটা অতি জরুরি বিষয় জানার আছে’
‘অর্কর কাছে যান’
‘নাহ,ওই তো আপনার কাছে পাঠিয়েছে।সুতরাং সাহায্য টা আপনি করতে পারবেন’
‘নাহ।পারবোনা,আমি এখন ব্যস্ত। যেতে পারেন’
পূর্ণতা তাও ত্যাড়ামি করে ঢুকে পড়ে।ফারাজের রুমে তেমন আহামরি কিছুই নেই।একটা টেবিল,একটা আলমারি আর খাট।পূর্ণতা চেয়ার টেনে বসে ফারাজের দিকে চেয়ে আছে।ফারাজ বইটা রেখে বিরক্তি দেখিয়ে ওর দিকে তাকালো।
‘আপনাদের বাড়িতে টাংকির পানি ছাড়া আর কোথায় পানি পাওয়া যাবে?’
‘ সাপ্লাই পানি,সকাল সাতটায় আর বিকাল পাঁচটায় আসে,দুই ঘন্টার জন্য।আর কিছু?’
‘আপনিও কি সাপ্লাই পানি আসলে খান?’
‘আমি এই বাড়িতে বেশি থাকিনা,আর থাকলেও আমি পানি খাইনা।কম খাই।’
পূর্ণতা উঠে চলে গেলো চুপচাপ।ও যেতেই ফারাজ উঠে এসে ঠাস করে দরজা ভেতর থেকে লাগিয়ে আবারও বই পড়তে বসে গেছে।পূর্ণতার ভীষণ একা লাগছে নিজেকে।হলে তো প্রেমা,তিশা থাকতো।খুব মজা হতো এখন এই বাড়িতে এসে সবাইকে কেমন যেন লাগছে।খাপছাড়া সব!’
——–
উর্মি সারথিকে শত শত বুদ্ধি দিল সজীবকে হাতের মুঠোয় করার জন্য।অথচ এসব কিছু সারথির কাছে বেকার মনে হলো।এগুলো দিয়ে জীবনেও সজীবের মন গলানো যাবেনা।বরং সজীব রেগে যাবে, আর নয়ত ঠাট্টা করবে।
একটা প্রশ্ন সারথির মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিল অনেক মাস ধরে।আজ উর্মিকে একা পেয়ে সে প্রশ্নটা করেই বসে।
‘আচ্ছা উর্মি বলতে পারো তোমার ভাইয়া আমাকে পছন্দ করে কিনা?’
‘অবশ্যই।বিয়ের সময় তো ভাইয়াই সবার আগে তোমায় পছন্দ করেছিল’
সারথি হঠাৎ উর্মির হাতটা চেপে ধরে বললো,’তবে উনি আমাকে ছুঁয়ে দেখেননি কেন?’
উর্মির মুখটা ফ্যাকাসে হয়ে গেছে তখনই।সারথির চোখ দিয়ে পানি বেরিয়ে টপটপ করে পড়ছে সব হাতের উপর।উর্মি ওকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বললো,’ভাবী এসব মাথায় এনো না।ভাইয়া হয়ত কোনো কারণে আপসেট।তা নাহলে এমন করার কোনো কারণ দেখছিনা।ভাইয়া তো নিজেই তোমায় পছন্দ করেছিল,এমনটা নয় যে আমরা জোর করেছি।ভাইয়া সব সময় ইউনিক পছন্দ করে।তোমার মাঝে সেই অসাধারণত্ব দেখেই ভাইয়া রাজি হয়েছিল।তাহলে ছুঁয়ে কেন দেখেনি,এটা নিয়ে তুমি সরাসরি ভাইয়ার সাথে কথা বলে দেখতে পারো।হয়ত তোমায় বলবে সমস্যার কথা’
——–
সারথি ফোন নিয়ে টকিং এসিস্টেন্ট এর মাধ্যমে সজীবকে কল করেছে।সজীবের এখন অফিস নেই।
কলটা সে বাসার সবার সাহসেই করলো।সজীব সে সময়ে শাওয়ার নিচ্ছিলো।একজন কাজের লোক এসে বলে গেলো তার কল এসেছে।তই সে শাওয়ার অফ করে তোয়ালে পেঁচিয়ে এসে দেখে সারথির কল।বিরক্ত হলো তাও রিসিভ করে সে।
সারথি সালাম দিয়ে চুপ করে আছে।সজীব সালামটা নিয়ে বললো,’শাওয়ার নিচ্ছিলাম।কি এমন জরুরি কাজ হলো যে এই সময়ে ফোন করেছো?’
উর্মির ইশারায় সারথি দাপট দেখানোর অভিনয় করলো,যদিও এটা তাকে দিয়ে হয়না।বুক ফুলিয়ে সে বললো,’আমি আপনার স্ত্রী।আমি কল দিবো না তো কে দিবে?’
সজীব অবাক হলো।অবাক হয়ে এখন কি বলবে ভেবে পাচ্ছেনা।সারথি আবার বলে,’কি হলো?কথা বলবেননা?’
‘হুম শুনছি।বলুন’
‘আমাদের বিয়ের কতদিন হয়েছে জানেন?’
‘নাহ’
‘দুই বছর তেইশ দিন’
‘তো?’
‘আপনি আমাকে ছুঁয়েও দেখেননি।আমি জানতে চাই কি কারণে?’
সজীব চেয়ার টেনে বসলো।দম ফেলে এবার বললো,’কারণ আমার ইচ্ছে হয়নি।ইচ্ছে হলে ছুঁবো, এটাতে এত সিরিয়াস হবার কি আছে?’
‘ইচ্ছে হলে ছুঁবো মানে?এটা কেমন কথা?আমি আপনার বিয়ে করা বউ হই।মানুুষ বিয়ে কেন করে?’
সজীব হাতের পশমে হাত বুলিয়ে বললো,’ডাবল হবার জন্য।আমি এখন ব্যস্ত। এসব কথা পরেও বলা যাবে।বাই’
সজীব লাইনটা কেটে দিয়েছে।সারথি বারান্দায় দাঁড়িয়ে সব বলছিল।রেগে সে ফোনটাই এক আছাড় দিয়ে ভেঙ্গে ফেলে।আনাফ সেময়ে তার মায়ের বারান্দায় বসে বসে গেমস খেলছিল।বিকট আওয়াজ শুনে হুমড়ি খেয়ে উঠে দাঁড়িয়ে দেখলো সারথি রেগেমেগে বারান্দার গ্রিল ধরে কাঁপছে শুধু।যেন এখনই ঝাঁপ দিবে।
‘দিয়েন না।কাল আম্মু খেজুরের আচার বানাবে,বলেছিল আপনাকেও একটু দিবে।মরার আগে খেয়ে নিয়েন’
আনাফের কথা শুনে সারথি পাশে ফিরে দাঁড়ালো
আনাফ ওর দিকেই তাকিয়ে আছে।সারথি অনেকক্ষণ ওভাবে দাঁড়িয়ে থেকে বললো,’একটা প্রশ্ন করবো?’
‘অবশ্যই’
‘একসাথে থাকার জন্য চোখ থাকা কি খুব জরুরি?’
কথাটা শুনে আনাফ চোখ বড় করে চেয়ে রইলো।এ কেমন প্রশ্ন সারথি ওকে করেছে।এরপর ঢোক গিলে বললো,’আমি তো বিয়ে করিনি,তাই জানিনা বিয়ের পরে মানুষের পরিস্থিতি কেমন হয়’
‘আপনার আন্দাজ থেকেই বলুন’
‘চোখ কোনো ফ্যাক্ট না,আমার মতে’
সারথি মুখটা কালো করে ওখান থেকে চলে গেলো।
আনাফ বুঝে গেছে কি সমস্যা চলছে এখানে।তারবও মন খারাপ হলো।এমন একটা মেয়েকে মানুষ কি করে এড়িয়ে চলতে পারে।এটা ঠিক না।মেয়েটা সারাদিন মন খারাপ করে থাকে বুঝি এই কারণেই।
আনাফের ডাক পড়লো।ওর মা তৈরি হয়ে নিছেন,ওকেও সাথে আসতে বলছেন।আনাফ ভাল করে জানে মা কোথায় যেতে চাইছে।মেয়ে দেখতে যাচ্ছে তারা।আনাফকে তিনি জিজ্ঞেস ও করছেন না সে রাজি নাকি রাজি না।আনাফ ও তার মতন ফোন টিপতে টিপতে বাসা থেকে বের হয়েছে।
———-
পূর্ণতা পানি খাওয়ার জন্য পাশের বাড়িটাতে গেছে।পাশের বাড়িটা আরও অদ্ভুত।তার নাম “এলোমেলো ”
আচ্ছা এই এরিয়ার সবগুলো বাড়ির নামই কি এমন উল্টোপাল্টা?? কি আজব নাম রাখে এগুলো।কত সুন্দর নাম আছে দুনিয়ায়,ওগুলা না রেখে এসব কি রাখে?
কলিংবেল চাপ দেয়ার এক মিনিট পর একটি মেয়ে এসে দরজা খুললো।মেয়েটির নাম বানু।মতিনের প্রেমিকা।
বানু পূর্ণতাকে দেখে বললো,’কে আপনে?’
‘আমি পূর্ণতা।পাশের বাসায় থাকি’
বানু কোমড়ে হাত রেখে মুচকি হেসে বললো,’মতিন ভাইদের বাড়ি?হাবিজাবি?’
‘হ্যাঁ হাবিজাবি’
‘তয় কি জন্যে আসলেন?মতিন ভাই আসেনি?’
পূর্ণতা একটা খালি বোতল ধরিয়ে বললো,’আমাকে এক বোতল পানি দিবে?’
মেয়েটা গলা চুলকে বোতলটা নিয়ে বললো,’বিকালে আইসেন।আমাগো তো টাংকির ঢাকনা নাই।তার উপর কবুতর পালে এরা।কবুতর পায়খানা করে কি হাল যে বানাই রাখো।আবার পরিষ্কার করতে হবে,বিকালে আসিয়েন আপা’
পূূর্ণতা চোখ কপালে তুলে বোতলটা নিয়ে এক দৌড় দিলো।এবার রাস্তার মাঝখানে দাঁড়িয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে ভাবছে কোথায় গেলে শান্তি পাবে।এই বাড়িতে মনে হয়না বেশিদিন টেকা যাবে।পানির অপর নাম জীবন।পানি ছাড়া এতকাল থাকা অসম্ভব। ওমা কিসব বলে এরা।আমি পানি খাবো!কেউ পানি খাওয়াও আমাকে!!!’
ফারাজ দোকান থেকে এক বোতল পানি কিনে যাচ্ছিল বাড়ির দিকে।পূর্ণতাকে রাস্তার মাঝখানে দাঁড়িয়ে বিড়বিড় করতে দেখে সে না দেখার ভান করে চলে যাচ্ছে।পূ্র্ণতা ওর হাতে পানি দেখে ছুটে এসে বললো আমায় একটু খেতে দিন।আমি পানি খাবো’
ফারাজ ওর দিকে বোতলটা ধরলো।পূর্ণতা অর্ধেক পানি শেষ করে ফেলেছে।
ফারাজ মুখ গোমড়া করে বোতলটা নিয়ে চলে গেলো।
পূর্ণতা যেন আকাশের চাঁদ পেয়েছো হাতে।কলিজা ঠাণ্ডা হয়ে গেছে তার।
এখন থেকে পানি আসলে বোতল ভর্তি করে রাখতে হবে।নাহলে পানির অভাবে অকালে মরতে হবে।
——
আনাফের সামনে এনে বসানো হয়েছে কাঙ্ক্ষিত সেই মেয়েটিকে যাকে ওর মা পছন্দ করেছেন।
আনাফকে বললেন কিছু জানার হলে জেনে নিতে।আনাফ মেয়েটাকে ভাল ভাবে দেখে নিয়ে বললো,’আপনি শাড়ীর ভেতরে জিন্স পরেছেন তাই না?’
মেয়েটা অবাক চোখে ওর দিকে চেয়ে থেকে লজ্জা পেয়ে মাথা নিচু করে বললো ‘হ্যাঁ।’
আনাফ সোফার হাতলে হাত রেখে এবার বললো,’আপনি কাল বিকালে টিএসসিতে ছিলেন তাই না?
মেয়ে এবার থতমত খেয়ে গেলো।আনাফ আবার বললো,’আপনার হাতে একটা ছেলে বেলি ফুলের মালা পরাচ্ছিল আর আপনি ভিডিও করছিলেন তাই না?গানটা ছিল’তুম সে মোহাব্বাত হে’ ”
চলবে♥#ডাকপাড়ি
#পর্ব_১০
#আফনান_লারা
________
আনাফের কথাগুলো সব সঠিক। মেয়েটা আশ্চর্য হয়ে কেবল ভাবছে কি করে এত কিছু সে জানলো।তাও এমন নিঁখুত ভাবে!
মেয়েটাকে চুপ করে থাকতে দেখে আনাফের মা যিনি আগে থেকেই চটে ছিলেন তিনি এবার মুখ খুললেন।জোরালো কন্ঠে বললেন,’এসব কি তবে সত্যি?আনাফ তুই জানতি এই মেয়েটার সম্পর্কের কথা?’
আনাফ মুচকি হাসছে শুধু।মিসেস প্রভা উঠে দাঁড়িয়ে পড়লেন।মেয়েটার মায়ের দিকে অগ্নি দৃষ্টি নিক্ষেপ করে চলেও গেলেন ওখান থেকে।আনাফ ও চললো মায়ের পিছু পিছু।
মেয়েটার কোনো সম্পর্ক না থাকলেও আনাফ এই বিয়েটা করতোনা।তার এখন বিয়ে করার ইচ্ছে নেই একেবারে।
———
সজীব ডিনার সামনে রেখে বসে আছে।সারথির কথাগুলো কানে বাজছে অনবরত। বিয়ের দু বছরে সে এই কথা বলেনি,হঠাৎ আজ বলে ফেললো।অর্থাৎ ওকে সামনের দিকে এড়িয়ে চললে আরও প্রশ্ন করবে।কপাল এক হাত দিয়ে টিপতে টিপতে অন্যহাতে সজীব খাবারের প্লেটের উপর চামচ নাড়ছিল।
তার পাশেই চেয়ার টেনে বসলো একটি মেয়ে।গায়ে লাল রঙের গাউন,চুল ছেড়ে দেয়া,ঠোঁটে কড়া রঙের লিপস্টিক।মেয়েটা সজীবের ঘাড়ে হাত রেখে বললো,’কি এমন হয়েছে যে আমার সজীবের মন খারাপ?আবার মাথা ধরাও?’
সজীব মাথা তুললোনা,যেমন করে চোখ বন্ধ করে ছিল তেমন করেই আছে।মেয়েটা ওর ঘাড়ে চাপ দিয়ে একটু কাছে এসে বসলো।কাজের লোকেরা সেই জায়গা ছেড়ে চলে গেছে তখন।সজীব ঘাড় থেকে মেয়েটার হাত সরিয়ে বললো,’লেভেন লিভ মি এলন’
‘আমি অনেক কষ্ট বাবার চোখ এড়িয়ে তোমার সাথে দেখা করতে এসেছি।আজ রাতটা আমাদের একসাথে কাটানোর কথা সজীব।বিয়েও করছোনা,লিভ ইনেও থাকতো চাইছোনা।ডোন্ট টেল মি, তুমি ঐ অন্ধ মেয়েটার জন্য দূর্বল হচ্ছো’
সজীব মাথা তুলে রাগী চোখে তাকিয়ে থাকলো লেভেনের দিকে।তারপর ঠাস করে টেবিলে হাত রেখে বললো,’আমি তোমার আর তোমার বাবার হাতের পুতুল না।আমার ব্যাক্তিগত একটা জীবন আছে।তুমি এখন যেতে পারো,আমাকে একা থাকতে দাও’
‘আমি পরেরমাসে বাংলাদেশ যাচ্ছি।
উর্মির বিয়েতে যাবোই।তুমি গেলে যাবে,না গেলেও আমি যাবো।বাধা দিতে পারবেনা’
কথাটা বলে লেভেন চলে গেছে।সজীব সামনের প্লেট আর গ্লাস ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে নিজের রুমে চলে আসলো।বিশাল থাই গ্লাসের দেয়ালের ওপারে একটা সাগর।সাগরের পাশেই সজীবের বাংলো।
এই গ্লাসের সামনে দাঁড়িয়ে শত ঢেউয়ের সাগরটা দেখা যায়।এখন রাত বলে অন্ধকার কিন্তু সাগরের স্রোতের উথাল পাতালের আওয়াজটা কানে এসে লাগছে সজীবের।গ্লাস হটিয়ে বের হয়ে গেলো সে।
হাঁটতে হাঁটতে সমুদ্রের খুব কাছে এসে বালিতে বসে গেলো।লেভেনের সাথে সজীবের প্রেমের সম্পর্ক তিন বছরের।
মা বাবাকে অনেক হাতজোড় করেও সে তাদের বিয়েতে রাজি করাতে পারেনি।কারণ লেভেন খ্রিস্টান। বিদেশে পড়ালেখা করতে এসে সজীবের সাথে লেভেনের প্রেম হয়েছিল।
এরপর বাবা মায়ের জোরজবরদস্তিতে সারথিকে দেখতে গিয়ে যখন সে জানতে পারে ও অন্ধ তখন সে রাজি হয়ে যায়।সে চেয়েছিল যাকেই বিয়ে করবে তার যেন কোনো না কোনো দূর্বলতা থাকে।সেই দূর্বলতাকে অস্ত্র বানিয়ে সে জীবন কাটাবে। যেমনটা এখন করে আসছে।
লেভেন আর ওর ইচ্ছে ছিল বিদেশে এসে বিয়েটা সেরে নিবে,তাছাড়া লেভেন বিদেশেই থাকে।বাংলাদেশে ও মাঝে মাঝে আসা-যাওয়া করে।ওখানে ওর দেশের বাড়ি।
কিন্তু আজকাল সজীবের মনে হয় সারথিকে সে ধোকা দিয়ে ঠিক করছেনা মোটেও।তার ইচ্ছে করে ওকে সব সত্যিটা জানিয়ে দিতে।কিন্তু সাহস কুলিয়ে পারছেনা।
এদিকে লেভেনের বাবা শর্ত দিয়ে বসে আছেন,যতদিন না সজীব একশো কোটি টাকার মালিক হচ্ছে ততদিন লেভেনের সাথে তিনি ওর বিয়ে দিবেননা।
লেভেনের বাবা এখনও জানেন ও না যে সজীব বিবাহিত
জানলে জীবনেও বিয়েটা হতে দিবেননা।সজীব ব্যাংক ব্যালেন্স বৃদ্ধি করার জন্য দুইটা বছর ধরে খাটছে।কিছুতেই একশোর কাছাকাছি পৌঁছোতে পারছে না।ব্যবসায় যেমন লাভ আছে তেমন লস ও আছে।সজীব নতুন বলে অনেকবার লস খেয়েছে।যদিও এখন আর লস খায়না।কিন্তু আগে যা হয়েছিল তার ঘাটতি পোষণ করতেই মাসের পর মাস কেটে যাচ্ছে।লেভেন অপেক্ষায় আছে কবে সজীবের সাথে ওর বিয়ে হবে।লেভেন মডার্ণ একটা মেয়ে।তার চিন্তাধারা বেশ অন্যরকম।যেখানে মেয়েরা বিয়ের আগে একসাথে থাকার বিরোধিতা করে সেখানে হেভেন পারেনা চব্বিশ ঘন্টা সজীবের বেডরুমে শুয়ে থাকে।সজীবকে কাছে পেতে যা করা লাগে সে করেছে।একদিন তো জামা ই খুলে ফেলেছিল ওর সামনে।কিন্তু সজীব তার চেয়েও অন্যরকম একটা মানুষ।সে এসবের ধারের কাছেও ঘেঁষেনা।সারাদিন একটা চিন্তা নিয়ে বসে থাকে।সারথিকে সে ফোন দেয়না এটা ঠিক কিন্তু সে সবসময় ওর কথাই ভাবে।একদিন তো হেভেনের ছোঁয়া পেয়ে মুখ ফুটে সারথির নাম নিয়েছিল।
সে নিজেও জানেনা কিসের উপর দিয়ে তার জীবন চলছে।
—–
সারথি রাতে কিছু খায়নি।উর্মি আর সজীবের মায়ের জন্য কোথাও শান্তিতে একটু নিরবে বসে থাকতে পারছেনা। ওরা সারথির মন ভাল করার জন্য একবার একটা করে।কিন্তু মন ভাল যে একমাত্র সজীবকে দিয়ে হবে সেটা ওনাদের কে বুঝাবে।
বারান্দায় বসে আকাশের দিকে বিপুল অভিমানের চোখে চেয়ে ছিল সারথি,যদিও এই আকাশ তার কাছে অন্ধকার।
তাদের যেদিন বিয়ে হয় সেদিন ছিল ভরা পূর্নিমার রাত।কথাটা সজীব বলেছিল।
বাসর ঘরের দরজা লক করে কথাটা বলে সে সোজা বারান্দায় চলে গিয়েছিল।ঠিক এই জায়গায়।সারথি অনেকক্ষণ বিছানায় বউ সেজে বসেছিল সজীবের অপেক্ষাতে। ও আসছেনা দেখে নিজে নিজে বিছানা ছেড়ে দেয়ালে হাত রেখে সজীবের নাম ধরে ডাক দিয়ে এগোলো।সজীব তখন পেছনে ফিরে বললো,’আমি তোমার পেছনের দিকটায়।সামনে না’
সারথি ঘুরে দাঁড়িয়ে ওর কাছে আসলো।সজীব এক দৃষ্টিতে সারথির দিকে তাকিয়ে ছিল।লাল শাড়ী আর সোনার গহনায় তাকে নতুন বউ লাগছিল ঠিক কিন্তু লিপস্টিক লেপটে যাওয়ায় কেমন যেন লাগছিল।সজীব ওর লেপটানো লিপস্টিক হাত দিয়ে মুছতে যেতেই সারথি পিছিয়ে বললো,’কি করছেন!’
‘আমি খারাপ কিছু করতে চাইনি।তোমার লিপস্টিক লেপটে আছে।সেটা মুছে দিতেই!!!’
সারথি নিজের ঠোঁটে হাত দিয়ে বললো,’একটা মশা বসেছিল।তার কামড়ে চুুলকানিতে অতীষ্ঠ হয়ে ঘষাঘষি করছিলাম তাই হয়ত!
আচ্ছা আপনি এখানে কি করছেন?’
‘চাঁদ দেখি।বললাম না ভরা পূর্ণিমার চাঁদ’
‘চাঁদ অনেক সুন্দর হয় তাইনা?ফারাজ বলেছিল।ওর মতে আকাশে তারাদের রুপ হার মানাবে চাঁদের কাছে।’
কথাটা হাসিমুখে বললেও শেষের দিকে সারথির মুখটা ফ্যাকাসে হয়ে গিয়েছিল।এত সুন্দর জিনিস, তার দেখা হলোনা।
সজীব মাথা বাঁকিয়ে রুমের ভেতর ঘড়িটার দিকে তাকালো।রাত ১টা বাজে।অমনি সে তাড়াহুড়ো করে বললো,’ঘুমোতে হবে।আমি এত রাত জাগিনা’
কথা শেষ করেই সারথিকে সে কোলে তুলে নেয়।সোজা ওকে বিছানায় নামিয়ে, নিজে বিছানার একপাশে শুয়ে পড়ে।
সারথি অবাক হয়ে বসে আছে।কি থেকে কি হয়ে গেলো।বাসর রাত কি শুধুই কোলে তোলা নিয়ে সীমাবদ্ধ!
সজীব ঘুমিয়ে পড়েছে।সারথি বেশি খারাপ লাগেনি,বরং আলাদা ভাল লাগা কাজ করছে মনের ভেতর।কি সুন্দর তাকে কোলে তুলে নিয়ে আসলো।লজ্জায় লাল হয়ে বিছানার চাদরটা খাঁমছে ধরলো সে।নিজের চোখে যদি দেখতে পারতো সজীব ওকে কোলে তুলায় কেমন লাগছিল।
সেই রাতটা সারথির সারাক্ষণ মনে পড়ে।সজীবকে শুরুতে ওর অদ্ভুত লাগতো।ভাবতো হয়ত ধীরে ধীরে কাছে আসতে চায়।কিন্তু আসলে সে কাছেই আসতে চায়না।
সেই রাতের কোলে তোলাটাই শেষ ছোঁয়া ছিল তাদের। এরপর আর দুজন দুজনের কাছে কখনও আসেনি।মাঝে মধ্যে সারথি চোট পেলে হাত ধরে ওকে রুমে নিয়ে আসতো সজীব।এর বাইরে কিছুইনা।
————–
ফারাজ গামছা পরে ছাদে নিজের জামাকাপড় শুকাতে দিচ্ছে।পূূর্ণতা ঐ সময়ে ছাদে বসে একটা আচারের বোয়াম খুলে আচার খাচ্ছিল প্রচণ্ড খিধে পেয়েছে বলে,রান্নাঘরে গিয়ে দেখে এসেছে রান্না এখনও হয়নি।
তাই আচার খাচ্ছে।ফারাজকে নিজের সব জামাকাপড় ধুয়ে শুকাতে দিতে দেখে পূর্ণতা এগিয়ে এসে বললো,’এত পানি পেলেন কই?নাকি ঐ ইউরিনের পানি দিয়ে ধুয়েছেন।ওয়াক থু!থু!
ফারাজ বালতি নিয়ে চলে গেছে চুপচাপ।পূর্ণতা ঝোলানো পাঞ্জাবি টেনে শুঁকে দেখলো ডিটারজেন্টের গন্ধ।তাই আবারও ফারাজের পিছু নিয়ে বললো,’পানি কই পেলেন?এখন তো সাপ্লাই পানি আসে নাই তাই না?’
ফারাজ থেমে পেছনে ফিরে বললো,’পুকুর থেকে ধুয়ে এসেছি,পাশেই পুকুর আছে।গিয়ে আপনিও চুবে বসে থাকুন’
‘আমি তো সাঁতার জানিনা’
‘তাহলে এই টাংকির পানি দিয়ে করেন।আমাকে বিরক্ত করবেননা প্লিজ’
ফারাজ দ্রুত হেঁটে চলে গেলো।পূর্ণতা বাড়ি থেকে বেরিয়ে পুকুরটা দেখতে এসেছে।বেশ ভালোই।প্রয়োজনীয় কাজ করা যাবে পুকুরের পানি দিয়ে।
খুশি হয়ে হাতটা ধুয়ে নিলো সে পুকুর থেকে।
এরপর আবার হাবিজাবিতে ফেরত আসলো।ফারাজ তার রুমের দরজা লাগিয়ে রেখেছে পূর্ণতার ভয়ে।মেয়েটা এত জ্বালাতন করে!
———
বানু এক বোতল পানি নিয়ে হাবিজাবি মেনশনে এসে হাজির।দরজা খুলেছে মতিন।বানুকে দেখে তার চোখে মুখে ভালোবাসার ছড়াছড়ি হয়ে গেছে।
‘মতিন কেমন আছো?’
‘এই তো তোমার আদরে ভালই আছি বেশ।তুমি কেমন আছো? ‘
‘আমিও তোমার ভালোবাসাই ভালো আছি।এই নাও বোতল।তোমাদের বাড়িতে নতুন যে আপা আইছে তারে দিও’
‘তুমি ক্যান কষ্ট করলা বানু?আমাকে ডাক দিলেই হতো,জানালা দিয়ে’
‘তোমায় কষ্ট দিতে চাই নাই।তাছাড়া অনেকদিন তোমায় দেখা হয়না।চা খাইবা?’
মতিন নাক মুখ খিঁচালো।বানু মুচকি হেসে বললো,’দোকানের চা।আমাদের বাড়ির ও না,তোমাদের বাড়ির ও না।চলো যাই’
মতিন ও ধেই ধেই করে চললো।দুজনে চা খাবে,হাঁটা হাঁটি করবে।হালকা পাতলা প্রেম হবে তারপর যে যার বাড়িতে ফিরে আসবে।
পূর্ণতা মতিনের থেকে পানির বোতলটা নিয়ে ওদের দুজনকে প্রেম করতে দেখে মিটমিট করে হাসছিল ওমনি কারোর হাঁচির আওয়াজ পেয়ে উপরে চেয়ে দেখলো ফারাজ বারান্দা থেকে সরে চলে যাচ্ছে।এতক্ষণ এগুলো দেখছিল সে।ভুলবশত হাঁচি এসে যাওয়ায় থতমত খেয়ে পালিয়েছে।
চলবে♥