ডাকপাড়ি পর্ব -৭+৮

#ডাকপাড়ি
#পর্ব_৭
#আফনান লারা
________
অর্কর রুমটা একটা ছোট সাইজের লাইব্রেরি।যে যাবে তার একটি বই নিয়ে পড়তে ইচ্ছে হবে,সে নিজেও বই পড়ে,অন্যকেও পড়তে বাধ্য করায়।তার বইয়ের কালেকশন দেখলে সবারই পড়তে ইচ্ছে হয়।
ফারাজ দরজার কড়া নেড়ে ভেতরে পা রাখলো।অর্ক ফারাজের বড় ভাই ফাহাদের ছেলে।
ফারাজ মুচকি হেসে ওর পাশে চেয়ার রেনে বসে।অর্ক তখন চশমা ঠিক করে একটা খাতা এগিয়ে ধরে বললো,’১৪দিন,৫ঘন্টা ১০ মিনিট ধরে এই অংকটা করার চেষ্টা করেছি উত্তর ১০হয়।সেটাই সঠিক উত্তর তবে আমার মেলানো সঠিক না।অংকটা এত সহজে মিলার অংক না।এটার সংজ্ঞা অনেক বড় হবার কথা।তুমি সেই বড় বিশ্লেষণ টা দেখিয়ে দাও’

ফারাজ কলম ঘুরিয়ে হাত চালিয়ে দু মিনিটেই খাতা ভর্তি করে ফেললো।শেষে উত্তর ১০ লিখে একটা টিক দিয়ে বললো,’বুঝেছো নাকি মুখে বলে বুঝিয়ে দিতাম?’

অর্ক মাথা খাটিয়ে খাতা দেখে নিজে নিজে বোঝার চেষ্টা করছে।ফারাজ উঠে গেলো নিজের ঘরে।
ফোন বন্ধ রেখেছিল এতদিন,মনে করে পকেট থেকে ফোন বের করে অন করলো সবার আগে।এরপর গায়ের পাঞ্জাবিটা খুলে দম ফেলো বিছানায় বসলো।গোসল করে এসে রাত দশটা অবধি একটা ঘুম দেবে তারপর খাবার খেয়ে বই পড়বে।অর্কর রুমে নতুন একটা বই দেখেছে।’Stranger in a strange land’
নাম শুনেই বোঝা গেলো বইটি দারুণ,পড়তেই হবে।
আড়মোড়া ভেঙ্গে ফারাজ গোসলে গেছে।গোসল সেরে অর্কর রুম থেকে বইটা এনে বালিশের তলায় রেখে শুয়ে পড়ে।মিসেস সোনালী চায়ের কাপ নিয়ে এসেছেন রুমে।ফারাজ চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে।
উনি ভেবেছিলেন না খেয়ে দেয়ে ফারাজ শুকিয়ে যাবে।কিন্তু সে শুকায়নি,বরং হালকা স্বাস্থ্য হয়েছে।মুচকি হেসে চায়ের কাপটা টেবিলে রেখে বললেন,”তা এতদিন মেসের খাবার খেয়ে এত মোটা হয়েছিস নাকি অন্য কারণ?’

‘কারণ অন্য।বললে তোমার মুচকি হাসি মাখা মুখটা ফ্যাকাসে হয়ে যাবে।ধুসুর বর্ণ ধারণ করবে’

মা ব্রু কুঁচকে ওর পাশে বসে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললেন,’হবেনা।বল প্রেমে-টেমে পড়লি?মেয়েটা দেখতে কেমন রে?লম্বা তো??তোর কাঁধ অবধি নাকি একেবারে মাথা বরাবর?’

‘উমমম,আমার গলায় তার মাথার চুল লাগে।সম্ভবত পাঁচ ফুট ছয় হবে’

‘কিসে পড়ে?’

‘গ্র্যাজুয়েট’

‘ওমা তাই??তাহলে ডাক না বাসায়।বিয়ে করিয়ে দেই’

ফারাজ মাথায় হাত রেখে বাঁকা হয়ে শুয়ে মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে হেসে বললো,’আমার মোটা হবার কারণ সে না’

মা এবার মুখটা ফুলিয়ে বললেন,’তবে কে?’

‘তোমার মেয়ে,সারথি’

মা চট করে উঠে দাঁড়িয়ে পড়লেন।ছুটে গিয়ে দরজাটা ভেতর থেকে লাগিয়ে আবার এসে বসলেন ফারাজের পাশে।ওর হাত চেপে ধরে বললেন,’কেমন আছে?’

‘ভালো না।মুখটা সারাদিন কালো করে রাখে’

‘কেন?সজীব এসেছে?’

‘সে আসলে তো ওর মুখ কালো থাকতো না।সে আসেনা বলেই এই অবস্থা।এইবার বুঝো, সারথি কেন তোমার সাথে বিয়ের পর থেকে ২বছর ধরে কথা বলেনা’

মা দীর্ঘনিশ্বাস ফেললেন।চুপচাপ উঠে দরজা খুলে চলে ও গেলেন।ফারাজ চা খেলোনা।কারণ সে এখন ঘুমাবে।চা খেলে ঘুমটা আর আসবেনা।তাই মতিনকে ডাক দিলো।
———–
‘ভাইয়া কেমন আছেন?

‘ভালো।নাও কাপটা নিয়ে যাও’

‘ভাইয়া এই চা টাংকির পানি দিয়ে বানানো হয়নি তো,সাপ্লাই পানি থেকে বানানো’

‘তাও খাব না,ইচ্ছে নেই।তুমি খাও নাহয় অন্য কাউকে দিয়ে দাও’

মতিন কাপটা নিয়ে চুমুক দিয়ে মনের আনন্দে চলে গেলো।ফারাজ বালিশ জড়িয়ে চোখ বন্ধ করে রাখে আবার।
——–
পূর্ণতা তার খাটের তলায় টর্চলাইট নিয়ে ঢুকে কাগজপত্র খুঁজছে।এখানে লোহার একটা বাক্স ছিল,জংয়ে ধরা।একদিন রাগের বশে বাক্সটাকে ঢুকানোর সময় ছুঁড়ে মেরেছিল যার কারণে তার ঢাকনা খুলে ভেতরের কাগজপত্র বেরিয়ে সব এলোমেলো হয়ে গেছে।এমন করে চলে গেছে ৬টা মাস।এখন কাগজপত্র সব গুছিয়ে বাক্সে রাখতে এসেছে সে।জমির কিছু কাগজ লাগবে,চারিত্রিক সনদটা পাচ্ছেনা কিছুতেই।কাগজ সব এক এক করে গুছিয়ে রাখার পরেও সনদটা সে পেলোনা।মন খারাপের ঝুড়ি নিয়ে খাট থেকে না বের হতেই মাথা তুললো।আর অমনি দুম করে বাড়ি খেয়ে আবার বসে পড়েছে।

‘কিরে আবার বাড়ি খেলি?’

‘প্রেমা চুপ করবি?বাড়ি খেয়ে কথা বলতে ইচ্ছে করেনা।চোখে সব গোল দেখছি।উহহঃ এত জ্বালা জীবনে!’

পূর্ণতা মাথা ঘঁষতে ঘঁষতে বের হলো খাটের তলা থেকে।সনদ পত্রটা কোথায় রেখেছিল মনে পড়ছেনা কিছুতেই।ওটার খুব দরকার।এখন আবার মেয়র থেকে সনদ আনতে শত প্যাঁচ করতে হবে।আগের সনদটা যে করেই হোক লাগবেই’
————
‘মা কি খাবেন বলেন,আমি বুয়াকে দিয়ে সব রান্না করেছি,বিশেষত আমার হাতে ফালুদাও বানিয়েছি আপনার জন্য।কখন খাবেন?’

মিসেস রিমা সারথির হাত ধরে বসলেন সোফায়।ওর মাথায় হাত রেখে মুচকি হেসে বলেন,’সজীবকে ভিডিও কল দাও?’

সারথি মন খারাপ করে চুপ করে আছে।মিসেস রিমা ওর থুঁতনি টেনে বলেন,’এই রুপ না দেখালে স্বামী গলবে কি করে?মাঝে মাঝে ভিডিও কল দিবে।ওকেও দিতে বলবে।এভাবে নিরামিষ হয়ে থাকলে চলে?’

‘আগে তো অনেক চাইতাম মা।উনিই তো আগ্রহ দেখান না।জোর করে কি বা করা যায়?’

উর্মি তখন বিসকিটের বোয়াম নিয়ে সারথির পাশে বসে বললো,’ভাবী আমি তোমায় শিখিয়ে দিব ভাইয়ার মন কি করে জয় করতে হয়।রাতে আমরা এক সাথে গল্প করবো সেটা নিয়ে।সময় বের করে নিও’

সারথি লজ্জা পেয়ে গেছে।মিসেস রিমার ফোনে সজীবের কল আসায় তিনি কানে ধরে উঠে চলে গেছেন ওখান থেকে।সজীব সকালে সারথিকে যা যা বলেছে মাকেও তাই বলতে ফোন করেছে।মা তখন ওকে ঝাপটে ধরে বললেন,’উর্মির পরের মাসের সতেরো তারিখে বিয়ে।তোকে আসতেই হবে।আমি কিছু শুনতে চাইনা।বউয়ের জন্য না আসিস,নিজের একমাত্র বোনের বিয়ের জন্য তো আসতে পারিস।’

‘মা সময় বের করতে পারছিনা’

মিসেস রিমা একবার পেছনে চেয়ে সারথি কোথায় আছে তা নিশ্চিত হয়ে গলার আওয়াজ কমিয়ে বললেন,’সত্যি করে বল,ওখানে কাউকে বিয়ে করিস নি তো?’

সজীব খিলখিল করে হেসে বললো,’দেশে সুন্দর একটা বউ থাকতে আমি কেন বিদেশে বিয়ে করবো?’

‘তবে দেশে আসিস না কেন?নাকি সুন্দর বউ আছে মনে করেই শান্তি পাস?’

‘ধৈর্য্যর ফল মিষ্টি হয় মা’
————
ফারাজ রোকেয়া হলের কাছে এসে দাঁড়িয়ে আছে।অনেকক্ষণ ধরে দেখলো এখানে সব মেয়েদের মেলা।
মেয়ে দেখতে তার ভালই লাগে,তবে একবার করে দেখে।এর বেশি দেখেনা।ঐ একবার দেখাতেই মনে ছবি সেভ হয়ে যায়।
দশ মিনিট পর কাগজটা মুড়িয়ে ধরে ফোন বের করে দাদাজানকে কল করলো সে।দাদা রিসিভ করে বললেন,’রোকেয়া হলের দায়িত্বে যিনি আছেন তার কাছে গিয়ে বলবে “পূর্ণা নামের কাউকে চেনে কিনা,রসায়ন বিভাগের।তারপর ওকে নিয়ে আসবে বাড়িতে””

ফারাজ ফোন পকেটে ঢুকিয়ে ওখানে গিয়ে পৌঁছালো।একজন লোক চেয়ারে বসে বসে ফাইল ঘাঁটছেন।দেখে বয়স্ক মনে হলেও ওনার বয়স ৩০বছর,কি একটা রোগে তাকে বয়সের তুলনায় অধিক বয়স্ক মনে হয়।ওনাকে সে একবার চায়ের দোকানে দেখেছিল।আলাপ হয়েছিল ফারাজের আঁকা একটা ছবি নিয়ে।ছবিটি ছিল রঙধনুর আট রঙ নিয়ে।তিনি বললেন রঙধনুর সাত রঙ হয়।ফারাজ তার বিরোধিতা করে বলে না আট রঙ।শেষের রঙটা মানুষের মনের রঙ।ঐ সাত রঙ মিশে যে রঙ হয় সেটাই সাত তম রঙ।
লোকটা ফারাজকে দেখেই চিনে ফেললো।হাসি দিয়ে ওকে বসতে বললেন।ফারাজ বসলোনা।শুধু দাদার বলা কথাটা পুনরাবৃত্তি করলো।

‘পূর্ণা?রসায়ন বিভাগের?
চিনি তো।সেকেন্ড ফ্লোরে ওর রুম।আচ্ছা বোসো আমি ডেকে দিচ্ছি’

ফারাজ বাধ্য হয়ে বসে থাকলো।অনেকক্ষণ বসতে হচ্ছে।সময় নষ্ট করা ফারাজের পছন্দ না,তাই ব্যাগ থেকে খাতাটা বের করে ছবি আঁকায় মন দিয়েছে।

পূর্নতার কাছে একটা গার্ড এসে বলে গেলো ওকে ম্যানেজার ডাকছেন।
——–
‘স্যার আসবো?’

‘আরে পূর্ণা এসো এসো।’

পূর্ণতা কাছে এসে বলে,’স্যার আমার নাম তো পূর্ণতা,পূর্ণা আমার ডাক নাম।আপনি জানলেন কি করে?’

‘রসায়ন বিভাগে “প” দিয়ে নামের একমাত্র তুমি আছো।আন্দাজ করে নিলাম।।উনার সাথে পরিচিত হও।জনাব ফারাজ মিনহাজ,তোমায় নিতে এসেছে’

পূর্ণতা পাশে তাকিয়ে ফারাজকে দেখে চমকে উঠে।ফারাজ এখনও আঁকছে।পূর্ণতার চোখ লাল হয়ে আসলো।রাগে কটমট করতে করতে বললো,’উনি আমায় কেন নিতে আসছে?’

‘সেটা তো জানিনা,ওনার সাথেই কথা বলে দেখো,ফারাজ,দেখেন পূর্ণা এসেছে’

ফারাজ মাথা তুলে তাকিয়ে পূর্ণতা কে দেখে সে নিজেও চমকে গেছে।উঠে দাঁড়িয়ে কিছু না বলেই ফোন বের করে দাদাকে কল করতে করতে রুম থেকে বের হয়ে গেলো।দাদা ফোন ধরতেই ফারাজ বললো,’দাদা,এই মেয়েটাকে কি সত্যি আমাদের বাসায় আনতে হবে?’

‘হ্যাঁ।কেন তোমার সমস্যা আছে?’

‘ও ভাল না।এর আগেও পরিচয় হয়েছিল,জেলে ও গেছে’

‘ও খারাপ হলেও তার ঠাঁই আমি আমার বাড়িতে করবো।আলাদা রিকশা ধরিয়ে নিয়ে আসো,এক কাজ করো ওকে ফোনটা দাও, আমি কথা বলি’

ফারাজ বিরক্ত হয়ে পূর্ণতার কাছে এসে ফোনটা দিয়ে বললো কথা বলতে।

‘হ্যালো’

‘হ্যালো কে,পূর্ণা?অরিন্দমের মেয়ে?’

‘হ্যাঁ,আপনি জানলেন কি করে?’

‘আমি তোমার সম্পর্কে দাদা হই,যাকে তোমরা বলো ঠাকুরদা।’

‘বাবার সাথে আপনার কথা হয়েছে?’

‘হ্যাঁ,সে আমায় বললো তোমায় আমাদের বাড়িতে নিয়ে আসতে।তাই আমার নাতি ফারাজকে পাঠালাম।ব্যাগপত্র গুছিয়ে ওর সঙ্গে চলে আসো।বাড়িতে আসলে কথা হবে’

পূর্ণতা ফোনটা ফারাজের হাতে দিয়ে গাল ফুলিয়ে রেখেছে।ফারাজ ও মুখটা গম্ভীর করে নিজের ব্যাগে আঁকা ছবিটা পুরছে চুপচাপ।পূর্ণতা ম্যানেজারকে বলে নিজের ব্যাগ আনতে গেলো কিসব ভাবতে ভাবতে।
চলবে♥#ডাকপাড়ি
#পর্ব_৮
#আফনান লারা
________
ফারাজ পকেট হাতিয়ে দেখে পকেট ফাঁকা।অনেক খোঁজাখুঁজির পর ছেঁড়া বিশ টাকার নোট একটা বের হলো তাও তেরো ভাঁজ করা।কাল সিয়াম,অনন্ত,পিয়ালিদের জন্য চকলেট কেনায় টাকা সব শেষ।

“দাদাজানের ভাষ্যমতে দুটো রিকশার প্রয়োজন,এদিকে টাকার অভাবে আমায় মনে হয় একটা রিকশার আওতাধীন হতে হবে।অন্যদিকে যে মেয়েটা রিকশায় উঠতে চলেছে সে মোটামুটি আমার চোখের শত্রু।তার পাশে বসে বাসায় পৌঁছানো আমার বিবেকে বাঁধবে।দম বন্ধ থাকবে, এদিকে এতদূর এই কাঠ ফাটা রোদে হেঁটে যাওয়া সম্ভব নাহ।কি করা যায়!”

পূর্ণতা দুটো ব্যাগ ভর্তি করে এসে হাজির হয়েছে ফারাজের সামনে।ওকে আকাশের দিকে তাকিয়ে মনে মনে অংক কষাকষি করতে দেখে পূর্ণতা বললো রিকশা নেয়ার জন্য।

ফারাজ আকাশ দেখা বাদ দিয়ে পূর্ণতার দিকে ফিরে বললো,’আপনার কাছে বিশ টাকা আছে?’

‘না নেই।আমি আপনার চেয়েও ফকির’

‘আমি ফকির?’

‘ফকির নাহলে কেউ একটা মেয়েকে নিয়ে যেতে এসে তার থেকে রিকশা ভাঁড়া চায়না’

ফারাজ গাল ফুলিয়ে একটা রিকশা দাঁড় করালো।পূর্ণতার দুটো ব্যাগ উঠিয়ে দেয়ার পর তাদের দুজনের একজনের জায়গা হলোনা।কোনো উপায়ন্তর না পেয়ে ফারাজ রিকশাওয়ালাকে বিশ টাকার নোট ধরিয়ে বললো হাবিজাবি মেনশনের দিকে যেতে।
রিকশা চলে যাবার পর পূর্ণতা সোজা হাঁটা ধরেছে।ফারাজ তখন ওকে থামিয়ে বলে,’আমি বলিনি আমরা হেঁটে যাবো।রিকশা নিয়ে বাড়িতে পৌঁছেও ভাঁড়া দেয়া যায়।চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকুন,এত উত্তেজিত হতে হবেনা’

পূর্ণতা মুখ গোমড়া করে একটা জাম গাছের তলায় গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকলো।ফারাজ রিকশা নিয়ে ওর দিকে তাকিয়ে আগে নিজে উঠে বসেছে।পূর্ণতাও এসে বসলো।

রিকশা চলছে তার গতিতে,রাস্তার অবস্থা ভাল না বলে ঝাঁকুনি কম খেতে হচ্ছেনা।দুজন যেখানে আড়াই ইঞ্চির ফাঁক রেখেছিল, ঝাঁকুনি খেয়ে সেই আড়াই ইঞ্চি বরাট হয়ে গায়ে গা লেগে গেছে।পূর্ণতা আর ফারাজ দুজনেই রিকশার সাথে লেগে বসার চেষ্টা চালাচ্ছে কিন্তু রাস্তার অবস্থার সাথে পেরে উঠছেনা।একেবারে তাদের লেগে বসে থাকতে হচ্ছে রীতিমত।
শেষে ফারাজ তার কাঁধের ব্যাগটা মাঝখানে রেখে দম ফেললো।
পূর্ণতাও স্বস্তি খুঁজে পায়।

বাড়িতে পৌঁছোতে বেশি সময় লাগেনি,অল্প সময়েই তারা এসে পড়ে “হাবিজাবি মেনশনে”

পূর্ণতা নেমপ্লেটটার দিকে চেয়ে চেয়ে হাসছে,কি অদ্ভুত নাম!এত বড় একটা বাড়ির কিনা এমন একটা নাম দিলো।কিন্তু কেন!

ফারাজ কলিংবেলে চাপ দিয়ে দাঁড়িয়ে আছো।এক রিকশাওয়ালা চলে গেছে আর একজনের ভাঁড়া দেয়া বাকি।
কলিংবেল বাজার কয়েক সেকেন্ড পার না হতেই মতিন দরজা খোলে।এটা তার অনেক পুরোনো অভ্যাস।বাড়ির গেট পার হবার সময় সে টের পেয়ে যায় বাড়িতে কেউ ঢুকেছে।তাই আগে থেকে দরজার পাশে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে।দরজা খুলে পূর্ণতাকে দেখে এক গাল হাসি দিয়ে বললো,’ আসেন,আসেন ভেতরে আসেন’

ফারাজ পূর্ণতার আগেই ভেতরে গিয়ে মায়ের কাছ থেকে বিশ টাকা নিয়ে এসে রিকশাওয়ালা কে বিদায় করতে গেলো।পূর্ণতা ভেতরে পা রেখে পুরো বাড়িটাতে চোখ বুলাচ্ছে।মতিন দৌড়ে গেছে বেলায়েত হোসেনকে ডাক দিতে।

পিয়ালি আর সিয়াম সোফায় বসে কার্টুন দেখছিল।নতুন অতিথি এসেছে শুনে তরা কার্টুন দেখা বাদ দিয়ে পূর্ণতার সামনে এসে ওকে ড্যাব ড্যাব করে দেখছে।পূর্নতা ওদের গাল টিপে দিয়ে বললো,’তোমাদের নাম কি বাবুরা?’

সিয়াম সবার আগে প্রশ্ন করলো ‘তুমি কি ভাত খাও?’

পূর্ণতা অবাক হয়ে বললো,’কেন খাব না?’

‘তাহলে কি দিয়ে খাও?আমাদের মতন মাংস দিয়ে ভাত খাও তোমরা?’

পূর্ণতা আশ্চর্য হয়ে তাকিয়ে আছে সিয়ামের দিকে।পিয়ালি সিয়ামকে থামিয়ে বললো,’তুমি হাতে লাল সুতা পরোনি??আচ্ছা তোমরা কি এ সময়ে কোনো পূজা করো?সেই পূজার নাম কি?জানো,আমাদের বাগানে তুলসি গাছ আছে।তোমার পূজা করার ইচ্ছা হলে বলবা।’

ফারাজ ব্যাগ এনে রেখে নিজের রুমে চলে গেছে।সোনালী হাতের কাজ ফেলে একবার পূর্ণতাকে দেখতে আসতে পারছেনা।এদিক সেদিক হলেই তরকারি পুড়ে যাবে।
পূর্ণতা রোবটের মতন এক জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে শুধু।তখন ওখানে এসে হাজির হলেন মিসেস সায়না।ফারাজের কাকি।
উনি পূর্ণতাকে ভালো করে দেখে বললেন,’তোমার এখানে থাকতে অসুবিধা হবেনা তো?তুমি কি কি খাও বলবা।আমরা মতিনকে দিয়ে আলাদা রান্না করে দিবো তোমাকে’

তখনই দাদা আসলেন।পূর্ণতা ওনাকে দেখে সালাম দিলো।

ওর সালাম শুনে সবাই অবাক চোখে ওর দিকে চেয়ে আছে।মতিন ছুটে এসে বললো,’একি আপা!!হিন্দু হয়ে সালাম দিলেন!!আপনার তো নমস্কার বলার কথা’

দাদা নিজেও অবাক হয়ে পূর্ণতার দিকে তাকিয়ে আছেন।পূর্ণতা কাছে এসে বললো,’আমার নাম পূর্ণতা রহমান।হ্যাঁ এটা ঠিক যে বাবা হিন্দু ধর্মের,কিন্তু আমার মা হলেন একজন মুসলিম।বাবা চেয়েছিলেন আমাকে হিন্দু ধর্মে দীক্ষিত করতে, আমাকে অনেক কিছু শিখিয়েছেন ও।কিন্তু মা সবসময় চেয়ে এসেছেন আমাকে ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত করবেন।আসলে তারা বাসায় আলাদা ধর্ম পালন করে দুজনে।
আর আমি কেবল ইসলাম ধর্ম পালন করি’

বেলায়েত হোসেন ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে সোফায় বসতে বললেন।তারপর চারপাশে চোখ বুলিয়ে ফারাজকে অনুপস্থিত পেয়ে মতিনকে বললেন ওকে ডেকে নিয়ে আসতে।

‘তোমার বাবা মা এখন কোথায়?’

‘তারা ভারতে থাকেন।’

‘তাহলে তুমি একা মেয়ে বাংলাদেশে কি করছো?’

‘আমিও চলে যেতাম দাদু,কিন্তু আমাদের দেশের বাড়ির জমি বিক্রি নিয়ে সমস্যা আরও অনেক বছর আগ থেকেই।মায়ের চিকিৎসার জন্য বাবার যেতেই হতো।তাই জমির দিকটা আমাকে সামলাতে রেখে গেছে এখানে।কাজ শেষ হলে আমিও চলে যাবো’

‘তোমার মায়ের কি হয়েছে?’

‘জানি না,রোগটার কথা বাবা নিজেও আমায় জানায় নি।আচ্ছা বাবা কি আপনাকে ফোন করেছিল?বাবা ভারতে গিয়ে নতুন একটা সিম কিনে আমাকে চিঠিতে নাম্বারটা পাঠিয়েছিল কিন্তু দূর্ভাগ্যবশত আমি সেই চিঠি পাইনি।আর বাবা অন্য কারোর ফোন দিয়ে আমায় ফোন কেন করেননি তাও আমি জানিনা।
এখন বাবাকে অনেকবার করে চিঠি পাঠিয়েছি।বাবা উত্তর দেননা।আপনি চিঠি পেয়েছেন তাতে আমি নিশ্চিন্ত হলাম একটু’

‘আচ্ছা তুমি এখানে কি কোনো চাকরি করতে?মানে তোমার ভরণপোষণ ‘

‘আমি একটা কিন্ডার গার্ডেনের টিচার।বাচ্চাদের পড়াই।তা থেকে ইনকাম আসে।ওটাতে কোনো রকমে চলে যায়।বেশি তো থাকতে হবেনা।জমির ভেজাল শেষ হলেই আমি প্রবাসে পাড়ি জমাবো’

‘আচ্ছা তোমায় নাকি জেলে যেতে হয়েছিল?’

পূর্ণতা মনে মনে ফারাজকে মোটা আকারের একটা বিশ্রি গালি দিয়ে মুচকি হেসে বললো,’ঐ আসলে আমি একটা বাচ্চামু করেছিলাম।আজকালকার কিছু পুলিশদের তো বাচ্চামি দেখলেও অপরাধ মনে হয়। ধরে জেলে পুরে দেয়।আমার সেরকম হয়েছে আর কি।বড় কোনো অপরাধ না।বলতে গেলে বিনাদোষে জেলে ঢুকেছিলাম, দুই ঘন্টার জন্য কেবল’

বেলায়েত হোসেন গালে হাত দিয়ে কিসব ভাবলেন তারপর মতিনকে বললেন পূর্ণতাকে এক কাপ চা দিতে।ফারাজ এসে গেছে তখন।কাছে এসে মাথা নিচু করে দুহাত পেছনে নিয়ে বলে,’দাদা আমায় ডেকেছিলেন?’

‘এই মেয়েটাকে কিভাবে চেনো?’

‘পার্কে দেখা হয়েছিল,ঠিকানা জানতে এসেছিল’

‘এতে করে তোমার কাছে সে খারাপ হয়ে গেলো?’

‘জেলে গেছে,তাই খারাপ’

পূর্ণতা ভেংচি কেটে চুপ করে ওর মুখের দিকে তাকিয়ে আছে।বেলায়েত হোসেন চোখ রাঙিয়ে বললেন,’অরিন্দম একটা ভাল ছেলে,ওর মেয়েও ওর মতই ভাল হবে।আমি চাইনা তুমি মনে ওর জন্য ঘৃনা পুষে রাখো,কারণ আজ থেকে সে আমাদের সাথেই এক বাড়িতে থাকবে।এটা আমার শেষ কথা,এবার যেতে পারো ‘

ফারাজ গাল ফুলিয়ে চলে গেলো।পূর্ণতা ব্যাগ নিয়ে মিসেস সায়নার পিছু পিছু চলেছে।অতিথিদের রুমটা ওর জন্য পরিষ্কার করা হয়েছিল।পূর্ণতার পিছু পিছু পিয়ালি আর সিয়াম ও চলছে।মিসেস সায়না দরজা খুলে রুমটা দেখিয়ে দিয়ে বললেন,’এই রুমটাতে অনেক বাতাস আসে দক্ষিণ থেকে।আমার খুব শখ ছিল রুমটা নিজের করারম
কিন্তু বাবা দিলেননা।তিনি আমাদের এর চেয়ে ভাল একটা রুম দিয়েছেন কিন্তু আমার এই রুমটাতেই মন আটকে আছে।এটাতে যে বাতাস।দাঁড়াও একটু বাতাস খেয়ে নিই’

কথাটা বলে তিনি জানালার গ্রিল ধরে মাথা ঠেকিয়ে চুপ করে রইলেন।পূর্ণতা ব্যাগগুলো রুমে ঢুকিয়ে বিছানায় বসেছে।খাট গুলো মান্ধাতার আমলের।তবে নতুন রঙ করা বলে মনে হয় যেনো এই যুগেরই।দেয়ালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের একটা ছবি টাঙানো।পূর্ণতার মুখে হাসি ফুটলো তা দেখে।এমন একটা ছবি তার বাবার রুমেও ছিল।সে ছবিটাকে ভালভাবে দেখছে সেসময়ে বেলায়েত হোসেন এসে বললেন,’তুমি জানলে অবাক হবে,তোমার বাবাও কিন্তু এই রুমেই থাকতেন’

পূর্ণতা আরও খুশি হয়ে গেলো।তখনই মতিন ওর হাতে চায়ের কাপ ধরিয়ে চলে গেছে।রুম এখন ফাঁকা।বেলায়েত হোসেনের সাথে সাথে বাকি সবাইও চলে গেছে পূর্ণতাকে একা ফেলে।পূর্ণতা চায়ের কাপ হাতে রুম থোকে বের হয়ে বাইরেটা দেখার জন্য পা বাড়ালো।কিছুদূর গেলেই একটা খালি রুম দেখতে পাওয়া যায়।ওটাতে ধুলোয় জমা সব ফার্নিচার। সেটাকে বাদ দিয়ে আরেকটা রুম দেখতে এসেই সে দেখে ছোট একটা ছেলে বসে বসে গড়গড় করে পড়ছে।চোখে চশমা,টেবিলে গাদা গাদা বই আর এক গ্লাস দুধ।পূর্ণতা মনযোগ সহকারে ছেলেটির পড়া দেখছিল,হঠাৎ করে ছেলেটা দুধের গ্লাস নিয়ে জানালা দিয়ে সব দুধ ফেলে খালি গ্লাসটা রেখে আবার পড়তে বসে গেছে।পূর্ণতা তখন দরজায় দুইটা টোকা দিয়ে বললো,’আসতে পারি?’

অর্ক মাথা তুলে পূর্ণতাকে দেখে বললো,’ইয়েস’

পূর্ণতা ভেতরে এসেই তার কৌতূহলের নিঃশেষ ঘটালো।প্রশ্ন করে বসলো, কেন এতগুলো দুধ অর্ক ফেলে দিয়েছে।

অর্ক পূর্ণতার হাতের চায়ের কাপটা ভালভাবে দেখে নিয়ে বললো,’ধরুন, আপনি জানলেন আপনার হাতের কাপটার চা যে পানি দিয়ে বানানো হয়েছে তাতে ইউরিন মিক্স করা।তখন আপনি সেই চা খাবেন?’
চলবে♥

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here