ডাক্তার সাহেব পর্ব ৩৮

#ডাক্তার সাহেব
#শারমিন আঁচল নিপা
#পর্ব-৩৮

কথাটা মনে হতেই জ্ঞান হারালাম।

বাইরে হাক ডাক শুনা যাচ্ছে কিছুর। শোঁ শোঁ শব্দ করছে। চারপাশে নীরবতার বালাই নাই কোনো। চোখ মেলতে কষ্ট হচ্ছে বেশ। কপালে কারও হাতের উপস্থিতি টের পাচ্ছি। শরীরটায় বল পাচ্ছি আবার পাচ্ছি না। সময়টা বহমান স্রূতের সমান্তরালে চলছে। কী হচ্ছে কী হবে কে জানে। চোখ মেলব কী না বেশ দুটানায় আছি। কপালটা যেন নিজ থেকেই ভাঁজ হয়ে যাচ্ছে। টানতে থাকলাম চোখগুলো। মোলায়েম কন্ঠ কানে আসলো। কন্ঠটা আর কারও না কন্ঠটা আমার প্রিয়তম নীলের। আস্তে গলায় বলল

– সিঁথি কষ্ট করে চোখ খুলতে হবে না। চিন্তা করো না, তুমি এখন ঠিক আছো।

নীলের কথা শুনার পর চিন্তা আমার জন্য হচ্ছে না চিন্তা হচ্ছে আমার বাচ্চার অবস্থা জানার জন্য। জিহ্বাটা কোনোরকম নাড়িয়ে বললাম

– আমাদের বাবু কেমন আছে?

হাতের কোমল স্পর্শ কপালে অনুভব করলাম। শীতলতম শুদ্ধতম স্পর্শ। বেশ সুরেলা সুরেই জবাব আসলো

– আমাদের বাচ্চা ভালো আছে। তবে এত প্রেসার নেওয়া তোমার ঠিক হয়নি। যেকোনো সময় বিপদ হতে পারত। মা সময়মতো কল না দিলে আমাদের বাচ্চাটাকে হারাতে হত। তুমি একটু বিশ্রাম করো। এখন পুরোপুরি বেড রেস্ট নিতে হবে। আমাদের বাবুর জন্য হলেও তোমাকে স্থির হতে হবে।

চোখ বন্ধ করেই বললাম

– আমি এখন আছি কোথায়?

– বাসায় আছো পাগলি বুড়ি। তোমার কিছু হবে না। আমি আছি তো। আল্লাহ তোমায় ঠিকেই সকল বিপদ থেকে রক্ষা করবেন। আমাদের বাচ্চারও কিছু হবে না।

– মা কোথায়?

– রান্না করছে।

– বাকিরা এসেছে?

– আসতেছে রাস্তায়। তোমার মা, বাবাও এসেছে তারা পাশের রুমে বিশ্রাম করছেন। তুমি কী তাদের সাথে এখন কথা বলবে? আমি কী ডেকে দিব?

– মন চাচ্ছে না। আমার হাতটা শক্ত করে ধরবে? তোমাকে চোখ খুলে দেখতে ইচ্ছা করছে কিন্তু চোখ খুলতে কষ্ট হচ্ছে।

কপালে ঠোঁটের আলতো স্পর্শ মিলল।

– আমি তোমার পাশেই আছি। আমাকে দেখতে হবে না শুধু উপস্থিতি অনুভব করো। একটু ঘুমানোর চেষ্টা করো। নিজের উপর কোনো প্রেসার ক্রিয়েট করো না বাবুর ক্ষতি হবে। বাবুর জন্য হলেও এখন অনেক কাজ সাবধানে করতে হবে। তোমার বয়স অল্প তাই চিন্তাও বেশি। পাগলি বুড়ি আমার নিজের যত্ন নিতে শিখো।

আমি আর কোনো কথা বললাম না নীলের হাতটা শক্ত করে ধরে চোখ বন্ধ করে রইলাম। ঘুমটা চোখে ঝেঁকে বসলো। এক পর্যায়ে ঘুমিয়েও গেলাম।

ঘুম ভেঙেছে কখন খেয়াল নেই। উঠার পর লক্ষ্য করলাম নীলের বুকের সাথে লেপ্টে আছি। তার বুকে হালকা কামড় দিতেই সে চোখ খুলে বলল

– ঘুম ক্লিয়ার? ভালো লাগছে এখন?

– হুম ভালো লাগছে। তবে ক্ষুধা পেয়েছে ভীষণ। আমি আইসক্রিম খাব।

– এখন আইসক্রিম খাওয়া যাবে না ঠান্ডা লেগে যাবে। এজমার সমস্যা আছে তোমার। ভাত আনি ভাত খাও। আমি খাইয়ে দিচ্ছি।

আমি নীলকে বারংবার আমার দাঁড়ালো দাঁত দিয়ে কামড় কষে বললাম

– আইসক্রিমেই খাব।

– এ বায়না রাখা যাবে না। অন্য বায়না করো।

– না আমি আইসক্রিমেই খাব। বাবু খেতে চেয়েছে। আমার আইসক্রিম লাগবে। তুমি বাবুকেও খেতে দিবে না। কেমন বাবা তুমি? বাবুর মাকেও তুমি ভালোবাসো না বাবুকেও না।

– ওকে দিব তবে শর্ত আছে।

– কী শর্ত?

– আগে ভাত তারপর আইসক্রিম।

– শর্ত মন্জুর করলাম। আচ্ছা আমাদের ছেলে হলে কী নাম রাখব আর মেয়ে হলে কী?

– তুমি কী কোনো নাম ঠিক করেছো?

– আমি শুধু ছেলের নাম ঠিক করেছি।

– ছেলের নাম কী ঠিক করেছো?

– আব্দুল্লাহ।

– বাহ! বেশ সুন্দর নাম। আমি মেয়ের নাম ঠিক করি তাহলে।

– ওকে করো। ভেবে এখনি বলো।

নীল থুতুনীর নীচে হাতটা দিয়ে কিছুক্ষণ ভেবে বলল

– রুবাইয়া।

– এ নাম কেন রেখেছো?

– এমনিতে মনে আসলো তাই। আমার বড় বোনের মেয়ের নাম ছিল রুবাইয়া। বছর তিন হতেই মারা যায়। তাই কেন জানি না এ নামের প্রতি ভীষণ মায়া কাজ করছে। মনে হচ্ছে তোমার কোলে রুবাইয়ায় আসবে।

– আচ্ছা ঠিক আছে।

– যাইহোক তোমার বাবা, মাকে ডাকি। উনারা তোমাকে দেখার জন্য উতলা হয়ে আছে। আমি রুমে তাই আসতেও পারছে না।

– হুম আসতে বলো। থাক আমিই উঠে যাচ্ছি।

নীল শক্ত করে ধরে বলল

– একদম লাফালাফি করবে না। পুরোপুরি বেড রস্ট। বাথরুম ছাড়া বেড থেকে উঠা যাবে না। বেশি তরতর করলে বাবুর ক্ষতি হবে সাথে তোমারও। আমি কাউকেই হারাতে চাই না। এ সময়টা এমনিই অনেক রিস্ক। প্লিজ সিঁথি এমন কিছু করো না যেটার মাসুল সারাজীবন দিতে হয়। তোমার সব পাগলামি আমি সহ্য করি। তোমার বয়স কম পাগলামি করো আমি তাতে সায় ও দিই। তোমাকে আমি ভীষণ ভালোবাসি তবে এবার অন্তত একটু পাগলামি কমাতে হবে। প্লিজ আমার কথা শুনবে বলো।

গালটা ফুলিয়ে মুখটা বাকিয়ে বললাম

– আমি কী তোমার কথা শুনি না? এভাবে বলছো কেন?

– তুমি যে গাঢ় ত্যাড়া তাই।

চুল গুলো টেনে ধরে বললাম

– ভালো হয়েছে আমি গাঢ় ত্যাড়া। আরও ত্যাড়ামি করব।

– আরে বাবা চুল ছাড়ো। টাক হলে আমার বাচ্চাকে সবাই ক্ষেপাবে তার দজ্জাল মা তার বাবাকে চুল টেনে ছিঁড়ে টাক করে দিয়েছে।

– আমি দজ্জাল?

রেগে আগুন হয়ে গেলাম। নীল তার ঠোঁট জোরা দিয়ে আমার ঠোঁট চেপে ধরে ধরল। আমি চোখটা বন্ধ করে ফেললাম। পরক্ষণেই নীল ঠোঁটটা ছেড়ে গালে কয়েক ঝঁটা চুমু দিতে দিতে বলল

– তুমি আমার লক্ষী বউ। আমার গ্রাস কার্প মাছ।

আমি চোখ গুলো কপালে তুলে বললাম

– গ্রাসকার্প মাছ মানে?

– মানে আমার প্রিয় মাছ গ্রাসকার্প আর তুমিও আমার প্রিয়।

– তাই বলে গ্রাস কার্প। একটু জাতের মাছ বললেও মেনে নিতাম। ইলিশ মাছ হলেও ঠিক ছিল তাই বলে গ্রাস কার্প।

– ওলে আমার গ্রাস কার্পটা রাগ করে না। বাবুর ক্ষতি হবে। আমি তোমায় ভীষণ ভালোবাসি।

বলেই জড়িয়ে ধরল। পরম শান্তি এ বুকে মাথা রেখে। প্রিয় জনের বুকটা শুধু শান্তি দেয় না শীতল অনুভূতি দেয়। যে অনুভূতিতে নিজেকে খুব সহজে বিলীন করে দেওয়া যায়।

দরজায় খটখট আওয়াজ করছে কেউ। বাইরে থেকে শ্বাশুড়ি মা ডেকে বললেন

– অনি সিঁথির কী ঘুম ভেঙেছে? ওর আব্বু এখনও খায়নি ওর জন্য। ওকে একটু তুলে নিয়ে আসো।

নীল হন্ত দন্ত হয়ে উঠে বলল

– মা ওকে এখন হাঁটানো ঠিক হবে না। খাবার এখানে নিয়ে আসতে হবে। উনাদের তুমি খেতে দিয়ে দাও। আর তুমিও খেয়ে নাও। আমি আসতেছি এখনি।

বেলা বাজে চারটে। নীল শুয়া থেকে উঠল। আমি শুয়েই আছি। নীলকে ডেকে বললাম বাথরুমে যাব। নীল আমাকে ধরে বাথরুমে নিয়ে গেল। এ পরম মমতা কাটিয়ে উঠা বড় দায়। শুনেছি বেশি ভালোবাসা নাকি সহে না। আমার কপালে এত ভালোবাসা সইবে তো? প্রশ্নটা মনে আসতেই কেমন জানি কেঁপে উঠলাম। বাথরুম থেকে বের হয়েই নীলকে জড়িয়ে ধরে বললাম। কান্না গলায় বললাম

– আমি কখনও তোমাকে হারাতে চাই না। আমাকে ছেড়ে চলে যাবে না তো?

– সৃষ্টিকর্তা ছাড়া তোমার কাছ থেকে কেউ কেড়ে নিতে পারবে না।

//

আস্তে করে সবার সামনে গেলাম। সবাই একসাথে বসে খেলাম। মা আমার রুমে এসে অনেকগুলো কথা বললেন। নীলের প্রতি থাকা সকল অভিযোগ মায়ের মলিন হয়ে গেছে নীলের ভালোবাসা দেখে। বাবা তো নীলকে আগে থেকেই ভালোবাসত আর এখন আরও বেশি বাসে। তারা আমাকে দোয়া করে বাসায় চলে গেলেন। নীল হাসপাতালে গেল পুনরায়। শ্বাশুড়ি মা মাথায় তেল দিয়ে বিশ্রাম করতে বলে নিজের রুমে গেলেন।

সন্ধ্যা সাতটা বাজে মিহু, তামান্না, আর বাবা এয়ারপোর্টে থেকে চলে আসলো। মিহুর মন ভীষণ খারাপ। সুনীলের কাছে যেতে মিহুর মিনিমাম দেড় বছর অপেক্ষা করতে হবে। এ দেড় বছর দুজনের থাকতে হবে এপার আর ওপারে। মিহুর চোখ লাল হয়ে আছে। আমার কাছে আসতেই হুঁ হুঁ করে কেঁদে দিয়ে বলল

– ওরে ছাড়া থাকব কীভাবে? ঘরে গেলেই ওর গন্ধ পাই খুব কষ্ট হচ্ছে সিঁথি।

মিহুর কষ্টটা আমার উপলব্ধি হচ্ছে বেশ ভালোই। জানি না যাদের স্বামী মারা যায় তাদের সহ্য ক্ষমতা আল্লাহ কী করে দেন। আমি তো নীলকে ছাড়া এক দন্ডও চিন্তা করতে পারি না। মিহুর হাতটা চেপে ধরে বললাম

– একটু কষ্ট কর। ভাইয়া তো আছেই। ঠিকেই আবার এক হবি। এক বছর পর তো ভাইয়া এসে সব প্রসেসিং করে নিয়ে যাবে। তুই এভাবে কাঁদলে আমার খারাপ লাগে। কাঁদিস না।

মা রুমে প্রবেশ করল। মায়ের মনটাও ভীষণ খারাপ। মিহুর পাশে বসেই মিহুর মাথায় হাত দিয়ে বলতে লাগল

– মারে ধৈর্য ধরো। সবুর করলে সব সুন্দর হয়।

মিহুর বাঁধ ভাঙা চোখের জল যেন থামছে না। মিহু কাঁদতে কাঁদতেই নিজের রুমে গেল। মাও নিজের চোখের জল মুছতে মুছতে রুম থেকে বের হলেন। এদিকে নীলকে কল দিয়ে আইসক্রিমের কথা বলতে বেমালুম ভুলে গেলাম। এতক্ষণ ইচ্ছা করলেও এখন আর আইসক্রিম খেতে মোটেও ইচ্ছা করছে না। তামান্না এসে আমার সাথে কিছুক্ষণ গল্প করে গেল। বড় আপারা রোজ কল দিয়ে খবর নিচ্ছে। এত ভালোবাসা এত ভালো সময় কখনও আশাও করিনি।

রাত বাজে ৯ টা। নীল বাসায় ফিরেছে। নীল কাছে আসতেই কেন জানি না অদ্ভুত লাগছে তাকে। নীল বাথরুমে যেতেই কেন জানি না তার মোবাইলটা হাতে নিলাম। সাথে সাথে রিদির মেসেজ পেলাম। রিদিকে মেসেজ দিতে দেখে ভীষণ অবাক হলাম। যে মেয়ে কী না আমার বিয়ের পরও একটা বারও খোঁজ নেয় নি সে হঠাৎ নীলকে কেন মেসেজ দিল! আগ্রহ কৌতুহল দুটোই প্রকাশ পেল। আমি মেসেজটা অপেন করলাম। অপেন করার সাথে সাথে মনে হলো আমার মাথায় বাজ পড়ল।

চলবে?

কপি করা নিষেধ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here