ডাক্তার সাহেব পর্ব ৩৭

#ডাক্তার সাহেব
#শারমিন আঁচল নিপা
#পর্ব-৩৭

মেয়েটা কিছুক্ষণ দম নিল। দমের গতি যখন মৃদু হলো মেয়েটা তখন তার পরিচয় দিল। মেয়েটার নাম সাইমুমা। মেয়েটা অনার্স কমপ্লিট করেছে সবেমাত্র। বেশ কিছুদিন আগে মেয়েটার সাথে অনীলের পরিচয় হয় ফোনে। মেয়েটা জানায় সে যার সাথে কথা বলে সে একজন ডাক্তার। কিন্তু বিপত্তি ঘটে অন্য জায়গায়। কারণ মেয়েটা এটাও বলল যে, সে যার সাথে কথা বলেছে সে বিদেশ স্যাটেল। এখন মেয়েটা কাকে ইঙ্গিত করেছে আর কে কথা বলেছে এতে যথেষ্ট কিন্তু রয়েছে। তবে অনীলের উপর থাকা বিশ্বাস যেন আমার উঠতে লাগল। উপস্থিত সবার মুখ চুপসে আছে। কিছু করার মতো বোধ তারা পাচ্ছে না। মা পাশ থেকে গড় গড় করে বলে উঠলেন

– আগেই আমি বলেছিলাম। এখন মিলিয়ে নে সিঁথি।

মায়ের কথাটা শুনে কলিজাটা যেন দ্বিখন্ডিত হয়ে গেল। কষ্টটা আরও বাড়তে লাগল। চোখ দিয়ে গড়গড়িয়ে পানি পড়ছে। অনীল আমার হাত চেপে ধরে বুঝাতে চাচ্ছে সে মেয়েটাকে চিনে না। অপরদিকে সুনীলও মিহুকে একই সান্ত্বনা দিচ্ছে। এ সান্ত্বনা যেন আরও বেশি বিরক্তির মাত্রা বাড়িয়ে দিয়েছে।

এর মধ্যেই পরিবেশ যখন তুঙ্গে মেয়েটা জোরে হেসে বলল

– আরে অনীল, সুনীল, আমি তুরসী। তোদের ছোট বেলার ফ্রেন্ড। সেই যে ক্লাস ফাইভে পড়ার পর বিদেশ গিয়েছিলাম তোদের সাথে তো তখন থেকে যোগাযোগ নেই। যখন যোগাযোগ করতে আসলাম তখন বিয়ের কাহিনি শুনতে পেলাম। ব্যাস আমিও একটা প্রাংক করে নিলাম।

মুহুর্তের মধ্যেই পরিস্থিতি পাল্টে গেল৷ তুরসী কান ধরে উপস্থিত সবার কাছে ক্ষমা চেয়ে নিল৷ বিষয়টা নিয়ে কেউ আর বাড়াবাড়ি করল না। আমার কলিজায় যেন পানি চলে আসলো। ভালোবাসার মানুষের প্রতি থাকা সকল অবিশ্বাস যেন নিমিষেই চলে গেল। ভেতরটা প্রশান্ত হয়ে গেল। মিহুও যেন হাফ ছেড়ে বাঁচল। সে সাথে সুনীল, অনীল ও প্রাণ ফিরে পেল।

সবকিছু শিথীল হওয়ার পর বিয়েটাও সম্পন্ন হলো। মিহুর বিয়েটাও বেশ সাদাসিধে ভাবে হলো। যদিও কথা হয়েছে দু বছর পর দুজনের বিয়ের প্রোগ্রামেই জমজমাট করে করা হবে। তবে আপাতত দুজনকেই তুলে নিয়ে যাবে ওদের বাসায়।

মিহু আর আমি দুজনেই এখন শ্বশুড় বাড়িতে। সংসার জীবনটা বেশ ভালোই কাটছে দুজনের। শ্বশুড় শ্বাশুড়ি দুজনেই মাশআল্লাহ অনেক ভালো। ননদীনির কথা আর নাই বলি । মনেই হয় না তামান্না আমার ননদীনি মনে হয় সে আমার বান্ধবী। অপরদিকে মিহুও সব সময় কাছে থাকে। সময়টা বেশ রঙিন সূতায় বহমান হচ্ছে।

সময় কেমন জানি দ্রূত চলে যায়। সুখের সময় গুলো একটু দ্রূতই বহমান। মানুষ চাইলেও যেন সেগুলো ধরে রাখতে পারে না তবে ছোট্ট একটা ফ্রেমে আবদ্ধ করে রাখতে পারে সে স্মৃতিগুলো।

রঙ বদল হতে থাকে সময়ের। আস্তে আস্তে বিবাহিত জীবনের ২ মাস করলাম। নীলের সাথে আমার সম্পর্ক বেশ ভালোই চলছে।

আজকাল মাথা বেশ ঘুরপাক খায়। বমি বমি লাগে ভীষণ। নীল সবে হাসপাতাল থেকে বাসায় এসেছে, কেন জানি না নীলের উপরেই মাথা ঘুরে পড়ে গেলাম। নীল আমাকে ধরে শুইয়ে দিল৷ আমার হাতের পালস সব কিছু মেপে নিল। বেশ চিন্তিত দেখাচ্ছে তাকে। আমি কিছুটা মলিন মুখেই জিজ্ঞেস করলাম

– আমার কী বড় কোনো রোগ হয়েছে?

নীল কপালের ঘামটা মুছতে মুছতে বলল

– বিষয়টা আমার গাফলতির জন্যই হয়েছে৷ আমার উচিত হয়নি এমন গাফলতি করা। এ অল্প বয়সে তোমাকে এমন কষ্ট দেওয়া উচিত হয়নি। আমি বুঝতেছি না কী করব।

আমি কিছুটা অবাক হয়ে বললাম

– এমন করে বলছো কেন? কী হয়েছে খুলে বলো। আমার কী কোনো বড় ধরণের রোগ হয়েছে? আমি কী আর বাঁচব না।

নীল আমার হাতটা চেপে ধরল। আমাকে কাছে এনে তার বুকের সাথে মিশিয়ে নিল। তারপর ভীত গলায় বলল

– তুমি প্র্যাগনেন্ট যতদূর বুঝতে পারলাম। সবে বয়স ষোলো। এখন তোমার বাচ্চা নেওয়ার মতো সঠিক সময় হয়নি। এ বাচ্চা রাখব কী না আমি চিন্তিত।

মা হওয়ার ব্যাপারটা প্রতিটি মেয়ের কাছেই সুখকর। তবে আমারও হালকা ভয় লাগছে কথাটা শুনে। বয়স অল্প তার উপর নিজের যত্নই আমি নিতে পারি না। তবে বাচ্চা নষ্ট করার মনমানসিকতা আমার মোটেও নেই। আমি নীলকে শক্ত করে ধরে বললাম

– জীবনে তো অনেক স্ট্রাগল করেই বাঁচতে হয়। তুমি আমার পাশে থেকো। আমার কিছু হবে না। তবে একটা প্রাণকে নষ্ট করে দেওয়া ঠিক হবে না।

নীল আরও শক্ত করে জড়িয়ে ধরল। আমাকে তার বুকের সাথে মিশিয়ে বলল

– বিষয়টা তোমার স্বাস্থ্যের সাথে সংযুক্ত তাই এত ভয় পাচ্ছি। তার উপর তোমার পড়াশোনা আছে। সব সামলানো কী এত সহজ হবে?

– দুজন মিলেই সব ঠিক করে নিব। এত চিন্তা করতে হবে না৷

বাসার সবাই বিষয়টা জানলো। মিহু তো কাছে এসে রিতীমতো ক্ষেপিয়ে বলতে লাগল

– তুই আর নীল তো ছক্কা মেরে দিলি।

– একদম হাবিজাবি বলবি না। তোরা মনে হয় কিছু করিস না। সারা রাত মনে হয় গল্প করে কাটাস।

– তো কী। আমরা তো গল্প করেই কাটাই।

– মিহু এমনিই লজ্জা লাগছে আর লজ্জা দিবি না। বাবা মা কী ভাববে আমি নীলের সাথে এসব করেছি।

মিহু বেশ জোরে সোরেই হেসে বলল

– তো স্বামী স্ত্রী কী ঘরে বসে ঘুমাবে। পাগল কোথাকার। এখনও তোর বুদ্ধি সুদ্ধি হলো না। আমি আর সুনীল তো তোর পাগলামি নিয়ে কত কথা বলে হাসি। সুনীল তো বলেই নীল এত শান্ত মেজাজের হয়েও তোর মতো বাঁদরকে পছন্দ করেছে কীভাবে বুঝতে পারে না।

আমি কপালটা ভাঁজ করে চেঁচিয়ে বললাম তোর রুমে তুই যা তো। এমনিই রাগ উঠতেছে। মিহু আর কথা বাড়াল না মুচকি হেসে বলল

– কী কী খেতে মন চায় বল রান্না করি। শ্বাশুড়ি মা বার্তাটা শোনার পর আমাকে বলেছে তোর যা মন চায় তাই যেন খেতে দিই। আর ভাইয়া কোথায়?

– ইমারজেন্সিতে রোগী এসেছে দেখতে গিয়েছে।

– তোর কী খেতে মন চাচ্ছে বল।

– কিছু না।

– তা বললে কী হয় মা। এ সময় বেশি বেশি খেতে হবে নাহয় শরীর ভালো থাকবে না আমার নাতি নাতনি কষ্ট পাবে।

শ্বাশুড়ি মা হঠাৎ রুমে প্রবেশ করে এসব বলতে লাগলেন। লজ্জায় মাথাটা নুইয়ে ফেললাম আমি। তিনি প্রবেশের পর পরই তামান্না প্রবেশ করলো রুমে। লজ্জায় যেন মাথাটা আরও নুইয়ে গেল। মা আমার পাশে বসে আমার মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বললেন

– যা মন চায় খেতে, আমাকে বলবে নাহয় মিহু আর তামান্নাকে বলবে। এখন তোমাকে সাবধানে থাকতে হবে। আর তোমার মায়ের সাথে কথা হয়েছে উনি তোমাকে ঐখানে যেতে বলেছে তবে আমি রাজি হয়নি। আমার কাছে মনে হয়েছে ঐখানে একা থাকার চেয়ে এখানে সবার সাথে থাকলে তোমার মন ভালো থাকবে বেশি।

রাত বাজে সাতটা নীল হাসপাতাল থেকে এসেছে। তার চিন্তিত মলিন মুখটা দেখে বললাম

– এত চিন্তায় বা কেন করছো? আমি মা হতে চলেছি এটা এত চিন্তার বিষয় না।

নীল কপালে চুমু কেটে বলল

– তুমিই যে বাচ্চা তাই চিন্তা বেশি হয়।

নীলের বুকে মাথাটা এলিয়ে দিলাম। পরম শান্তি লাগছে। এ শান্তিতে বিলীন হয়ে যেতে পারলে হয়তো আরও বেশি ভালো লাগত।

আল্ট্রা করানোর পর পুরোপুরি নিশ্চিত হলাম আমি দেড় মাসের অন্তঃসত্ত্বা। মা আমাকে কল দিয়ে অনেকবার বলল বাসায় যেতে তবে আমার শ্বশুড় বাড়িতেই বেশ ভালো লাগছে থাকতে। মিহু আছে, তামান্না আছে, নীলের মা তো আমার মায়ের মতোই ভালোবাসে। সব মিলিয়ে এখানে থাকার সিদ্ধান্তটা আমার মা আর বাবাকে জানিয়ে দিলাম। তারা আর আপত্তি করল না। তবে যখন মন চায় চলে আসে দেখতে।

সামনে পরীক্ষা শরীরটাও ভালো যায় না তেমন। নীল যতটুকু পারে সাহায্য করে। চার মাস চলতেছে। শরীরের দুর্বলতা কাটিয়ে উঠতে বেশ কষ্ট হয়। পরীক্ষা গুলো বেশ কষ্ট করেই দিয়েছি। আজ শেষ পরীক্ষা ছিল। পরীক্ষা হল থেকে আসার পর পরই যেন মাথাটা অনেক ঘুরছিল। শরীরের ব্যথাটা বাড়তে লাগল। পেটে হালকা ব্যথাও হচ্ছে। মনে হচ্ছে প্রাণ বের হয়ে যাবে। মিহু পরীক্ষা দিয়ে সরাসরি গিয়েছে এয়ারপোর্টে সুনীলকে বিদায় দিতে, বাবা আর তামান্নাও সাথে গিয়েছে। মা গিয়েছে ছাদে কাপড় নাড়তে। নীল হাসপাতালে। শরীটা কেমন অসাড় হয়ে যাচ্ছে। বারবার মনে হচ্ছিল আমি আর আমার বাচ্চা টা মরে যাব। এমন সময়েই মাথাটা ঘুরে জোরে আছড়ে পড়লাম। তলপেটের ব্যথায় কাঁতড়ে উঠলাম। অবচেতন মনে বলে উঠলাম আমার বাচ্চাটা আমাকে ছেড়ে চলে যাবে না তো? কথাটা মনে হতেই জ্ঞান হারালাম।

চলবে?

কপি করা নিষেধ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here