ডিভোর্স অতঃপর পর্ব ৬

#ডিভোর্স_অাত_ :_পর
.পর্ব ৬
.
শিমুল ছোট্ট একটা মেসেজ পাঠিয়েছে,
“আমি আমার মেয়ের সাথে দেখা করতে চাই,
যদি তোমার কোন আপত্বি না থাকে। ”
মেসেজটা পড়ার পর আর ঘুমোতে পারেনি রিয়া।
কি করবে এখন রিয়া ?
সে কি মেইলের জবাব দেবে ?
না দেয়ারও তো কোন কারণ নেই।
কি লিখবে শিমুলকে ?

গত সাত বছরে কত কষ্ট করেছে ওরা,
কত ঝড় বয়ে গেছে ওদের জীবনের উপর দিয়ে।
সেকথা শিমুল জানেনা।
যখন শিমুলের সাথে বিচ্ছেদ হয়েছিল, তখন বয়স কম ছিল। কিন্তু ইগো বেশী ছিল।
রিয়ার এখন মনে হয়,হয়তো আরো সহনশীল হলে জীবনটা এমন হতোনা।
অন্তত রায়নার জীবনটা বাবাহীন হয়ে যেত না।
রিয়া এখন বিশ্বাস করে আজ রায়নার এমন অবস্হার জন্য সে এবংশিমুল দু’জনই দায়ী।
সে সময় ওরা রায়নার কথা একটুও ভাবেনি।
ভেবেছিল শুধু নিজেদের কথা।
নিজেদের চাওয়া,মান-অপমান,জেদের কথাই শুধু ভেবেছিল।
কিন্তু সন্তান আল্লাহ্ র এমন এক অমূল্য উপহার বাবা-মায়ের জন্য, যে তার আগমনে বাবা-মায়ের জীবনই বদলে যায়।
রায়নার আগমনে রিয়ার জীবন বদলে গেছে একটু একটু করে।
রিয়া তার সব সুখ, সব শান্তি, সব পাওয়া দেখতে চায় রায়নার মাঝে। রায়নার ভাল থাকাটা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এখন রিয়ার কাছে।

শিমুল যখন সাত বছর আগে রিয়াকে অস্বীকার করেছিল,তখন প্রকৃত পক্ষে রায়না হারিয়েছিল তার বাবাকে। এবং সেটা রায়না তার ছোট্ট মাথার বুদ্ধি দিয়ে বুঝতে পেরেছিল।
রিয়ার সাথে রায়না যখন থেকে তার নানুর বাসা ছেড়ে ক্যান্টনমেন্টে চলে এসেছিল, তখন থেকেই ওর পরিবর্তন একটু একটু করে লক্ষ করেছিল রিয়া।
মেয়েটা চুপচাপ হয়ে গিয়েছিল।
রিয়া এক সময় খেয়াল করলো মেয়েটা বায়না করেনা খুব একটা।
আর সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় ছিল যে,সে তার বাবার বিষয়ে কথা বলা বন্ধ করে দিয়েছিল।
দিনে দিনে মেয়েটির মুখে তার বাবার চেহারা আরো স্পষ্ট হতে লাগলো। যেন শিমুলের মুখটা বসানো।
স্বভাব,খাওয়া-দাওয়া,পছন্দ-অপছন্দ এমন কি ঘুমের ভঙ্গিটা পর্যন্ত হুবহু শিমুলের মত।
ছোট মাছ শিমুল খুব প্রিয়, মেয়েটাও ছোট মাছ খুব ভালবাসে।
শিমুল সহজে সবার সাথে মিশতে পারতো না। একটু সময় লাগতো ঘনিষ্ট হতে। রায়নারও একই স্বভাব। মেয়েটা শিমুলের মত অসম্ভব মেধাবী হয়েছে। প্লে-গ্রুপ থেকে এখন এখন পর্যন্ত প্রতিটা ক্লাসে খুব ভাল মার্কস নিয়ে প্রথম হয়ে আসছে।

একদিন রায়না মাকে জিজ্ঞাসা করেছিল,মা মিস বলছিল আমি খুব ব্রিলিয়ান্ট। মা আমি এত ব্রিলিয়ান্ট কেন ?
রিয়া হেসে ফেলে বলেছিল, তোমার বাবা, দাদা,চাচ্চু ফুপি সবাই খুব ব্রিলিয়ান্ট। তোমার ফ্যামিলির সবাই খুব ব্রিলিয়ান্ট। তাই তুমি এত ব্রিলিয়ান্ট।
তোমার দাদীও খুব বুদ্ধিমতী ছিলেন।
মা, তারা কি আমার ব্লাড ?, জানতে চেয়েছিল রায়না।
রিয়া মাথা ঝাঁকিয়ে সম্মতি জানিয়েছিল।
রায়নার মুখটা সেদিন খুব উজ্জ্বল হয়ে উঠেছিল।
রক্তের সম্পর্ক বিষয়টা তখন সে মাত্র শিখেছে।
তাই রক্তের সম্পর্কের মানুষদের সম্পর্কে তার আগ্রহ
বেড়েছে খুব।

একবার রিয়া খুব অসুস্হ হয়ে পড়েছিল। প্রচন্ড জ্বর নিয়েই বেশ ক’দিন রিয়াকে স্কুল থেকে আনা নেয়া করতে হয়েছিল। সেসময় ওরা ক্যান্টের বাইরে ভাড়া বাসায় থাকতো। রিয়ার ভয়াবহ কষ্ট দেখে রায়না কেঁদে ফেলে বলেছিল, মা আজ যদি বাবা আমাদের সাথে থাকতো, তাহলে তোমাকে জ্বর নিয়ে আমাকে স্কুলে নিয়ে যেতে হতনা। বাবা আমাকে স্কুলে নিয়ে যেত।
তোমার কষ্ট হতনা।
রিয়ার বুকের ভেতরটা শূন্য হয়ে গিয়েছিল।
রিয়া বুঝতে পারত রায়নার কষ্ট হয় তার বাবার জন্য। সে সরাসরি বলে না।

রিয়ার সবচেয়ে কষ্ট হত যখন রায়নাকে নিয়ে শপিং এ যেতো এবং রায়না এটা, ওটা চাইত। কিন্তু দাম বেশী হওয়ায় রিয়া দিতে পারতো না বলে, না করে দিত।
তখন রায়না বলতো,মা এটা আমার আসলে লাগবে না। রিয়া খুব ভাল করেই বুঝতো রায়না মাকে কষ্ট দিতে চায়না বলে এমন বলছে।
হতাশায় রিয়ার বুক ভার হয়ে থাকতো তখন।
কিইবা করবে রিয়া ?
এখন তো রায়না প্রয়োজনীয় জিনিসের কথায় মুখ ফুটে বলতে চায়না।
রায়নার সব সখ পূরণ সে করতে পারে না। তাকে হিসাব করে চলতে হয়। রায়নার ভবিষ্যৎ এর কথা ভাবতে হয়।

গত দু’/তিন বছর থেকে রায়না তার বাবার ব্যাপারে খুব আগ্রহ প্রকাশ করছে।
রিয়া কখনোই রায়নার কাছে তার বাবাকে খারাপ করে তোলেনি। রিয়ার মতে,সমস্যা তার সাথে। এখানে বাবা-সন্তানের মধ্য জটিলতা বাড়ানোর কোন কারণ নেই। রিয়াও করেনি সেটা।
এতদিন পর শিমুল মেয়েকে দেখতে চাইছে !
রিয়া কি বাঁধা হয়ে দাড়াবে বাবা-মেয়ের মধ্যে ?
রায়নাও তো অপেক্ষা করে তার বাবার জন্য !
রায়নার মনের গোপন ইচ্ছে, তার বাবা স্কুল ছুটির পর তাকে গাড়ী নিয়ে আনতে যাবে।
ওর সব বন্ধুরই বাবা আছে।
প্রায়ই তারা গাড়ী নিয়ে আসে স্কুল গেটে।
ওর বন্ধুরা খুশীতে ঝলমল করতে করতে তাদের বাবার সাথে গাড়ীতে করে বাড়ী ফিরে যায়।
গাড়ীর ভিতর থেকে হাসি মুখে হাত নেড়ে রায়নাকে বিদায় জানায়।
রায়না বিষর্ন্ন চোখে তাকিয়ে থাকে।
মনে মনে ভাবে তার বাবাও যদি একদিন এমন করে চলে আসতো !
তাহলে বন্ধুদের দেখিয়ে দিতে পারতো।
একদিন রাতে রিয়ার বুকে মুখ গুঁজে এসব কথা বলেছিল রায়না।
রিয়া নিঃশব্দে কেঁদেছিল সেরাতে।
রায়নাকে বুঝতে দেয়নি।

রিয়া নিজেও বদলেছে অনেক।
কম বয়সের সেই রাগ,জেদ, অদূরদর্শী ভাবনা এখন আর নেই রিয়ার মধ্যে।
জীবনের টানাপোড়েন তাকে শিখিয়েছে অনেক কিছু। ধর্য্য আর মানিয়ে চলার মত কঠিন দু’টো অভ্যাস গড়ে তুলেছে।
এই কলেজের চাকুরী তাকে সব পরিস্হিতিতে শান্ত এবং ধর্য্য ধরা শিখিয়েছে।
এখানে যেটা যেভাবে বলা হবে সেটা সেভাবেই করতে হবে। বাড়তি কথার সুযোগ নেই।
সিনিয়রদের মুখের উপর তো কোন কথা বলায় যায়না। চাকুরীতে ভাল করার একটা তাগিদ ছিল রিয়ার। সে খুব আন্তরিকতা এবং দায়িত্বের সাথে কাজ করে বলে তার যথেষ্ট সুনাম আছে।
আগে যখন বাবা-মায়ের সাথে থাকতো তখন রায়নাকে নিয়ে এত ভাবতে হয়নি।
বাবা-মা ই রায়নার সব কিছু দেখতো।
কিন্তু এখন চাকুরী, ঘর এবং রায়নার সব কিছু
তো তাকেই সামলাতে হয়।
মাঝে মাঝে ক্লান্ত লাগে রিয়ার।
তবুও, রিয়ার জীবনের একমাত্র লক্ষ রায়নাকে ভাল রাখা। ওকে সঠিক ভাবে মানুষ করা।

রিয়া শিমুলের মেইলের উত্তর লিখলো, “মেয়ের সাথে দেখা হতে পারে। আমার কোন আপত্বি নেই।”

নিজেকে নির্ভার মনে হলো।
পরদিন রাতে রায়নাকে বললো,তোমার বাবা তোমার সাথে দেখা করতে আসবেন।
রায়না হতভম্ব হয়ে গেল মায়ের কথা শুনে !
সত্যিই তার বাবা আসবে ?
তাকে দেখতে তার বাবা আসবে ???
(চলবে..)

Copy post

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here