তিলেত্তমা পর্ব ৩

তিলোত্তমা
পর্বঃ ৩

-‘রাত্রি! চুপচাপ দৌড় দে! খবরদার, এর সাথে কথা বাড়াস না’- আমি টের পাই বুকের ভেতরের গহীন কুঠুরিতে বসে বসে আমার সেই বন্ধু ‘মিছিমিছি’ আমাকে বলছে।

কিন্তু পা দুটো যেনো আটকে গেছে মাটির সাথে, ঠায় দাঁড়িয়ে আছি কেবল মূর্তির মত!

-‘যাকগে! তুমি বোধহয় ভয় পাচ্ছো। আমি বাঘ-ভাল্লুক নই, রাত্রি! কাল এখানে থেকো- কথা আছে!’- এই বাক্যটুকু বলেই শোভন নামের অদ্ভুত ছেলেটা পেছন ফিরে চলে গেলো! কতক্ষণ একভাবে ঠায় দাঁড়িয়ে ছিলাম জানিনা, ঘোর ভাঙে সাগুফতার ডাকে।

-‘কী রে! বন্ধ বই হাতে নিয়ে এমন পুতুল সেজে দাঁড়িয়ে আছিস ক্যানো?’

-‘হু! ও তুই! না কিছুনা, চল যাই!’

তারপরের পুরো দিনটা যে কীভাবে গেলো আমি জানিনা! ঘোরগ্রস্তের মত কেবল হেঁটে-চলে বেরিয়েছি বোধহয়। মনের ভেতর থেকে ‘মিছিমিছি’ বারবার বলছিলো- ‘যাসনে রাত্রি! যাসনে!’ অথচ ঠিকই পরদিন বিকেল হতে না হতেই বুকের ভেতরে একশো প্রজাপতি ডানা মেলে ওড়াওড়ি শুরু করে দিলো! অজান্তেই টুকটাক সাজগোজ ও করে ফেললাম। ছিছি! সেকথা ভাবলে এখনো লজ্জায় গা রি রি করে ওঠে! মায়ের আগ্রহে বহু প্রসাধনী মাখামাখির পর মুখটাকে কিছুদিন শান্তি দিয়েছিলাম নানুবাড়ি এসে, সেই আমিই সাগুফতার থেকে চেয়ে নিয়ে মুখে ফাউণ্ডেশন মাখলাম, পাউডার লাগালাম, ঠোঁটে লিপস্টিক, কানে চকমকে পাথর বসানো দুল- রীতিমত সঙ সাজা বলে যাকে! কী অদ্ভুত! এতটা কমবয়েস ও তো ছিলোনা আমার! কতশত বই পড়া আমি, কতজনের কতরকম প্রেমের অভিজ্ঞতার ঘটনা শুনে কান পাকানো আমি কী না এই একজনের, একদিনের, দুটো বাক্য শুনেই কেবল এভাবে গলে পানি হয়ে গেলাম?

কী অদ্ভুত! কী অদ্ভুত!

বই একটা নিয়ে গেছিলাম হাতে করে, সে কেবল শো-পিস! মুখের সামনে কেবল ধরে বসে ছিলাম, সাদা কাগজের কালো অক্ষরগুলি আদৌ মস্তিষ্কে ঢোকেনি একটাও। বুকের ভেতর ধ্বকধ্বক বাদ্য বাজছিলো অনবরত… কে এই ছেলে? আমায় চেনে কীভাবে?

-‘রাত্রি!’- অচেনা কণ্ঠে দুই অক্ষরের চেনা শব্দটা শুনে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাই।

এসেছে!

-‘জি! আপনি… মানে আপনি আমার নাম জানলেন কী করে?’- পুরো একটা দিন ধরে সাহস সঞ্চয় করে, মনে মনে একশোবার এই সময়টার মহড়া দিয়ে, রীতিমত ‘স্ক্রিপ্ট তৈরী করে নিয়ে এসেও শেষে কিনা তোতলাচ্ছি!

-‘যা জানা দরকার তা মানুষ যে করেই হোক জেনে নেয়, রাত্রি! ঐযে বলেনা- পথ পথিকের সৃষ্টি করেনা বরং পথিকই পথের সৃষ্টি করে নেয়?’

ও বাবা! এ দেখি বাংলা ব্যাকরণ বই থেকে quote করছে! এমন ভারী ভারী কথার কী জবাব আমি দেবো?

-‘যাকগে, তুমি বোধহয় ফ্রি হতে পারছো না, ভেবেছিলাম এমনই হবে! নাও এটা ধরো- সুবিধামত যোগাযোগ করো!’- ছোট্ট আধাপাতার একটা চিরকুট বাড়িয়ে ধরলো সে। প্রচণ্ড ভয়ে আমার নিজেকে বিবশ লাগছিলো, আচ্ছা মামা বা মামার কোনো বন্ধু যদি এখন আমাদের দেখে ফেলে তখন? দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে চোখের পলক ফেলছিলাম কেবল, হাত বাড়িয়ে চিরকুটটা নেবার মত শক্তি কিংবা বুদ্ধি কিছুই খুঁজে পাচ্ছিলাম না। অবশেষে…

অবশেষে বাম হাতখানা বাড়িয়ে আমার ডানহাতে ধরে চিরকুটটা মুঠোয় পুরে দিয়ে খানিক হাসে শোভন, কী মিষ্টি ওর হাসিটা! তারপর ‘আসছি! অপেক্ষায় থাকবো বলে দিলাম!’- বলেই চলে যায়।

মুঠোর ভেতর জ্বলন্ত অঙ্গার নিয়ে ঠায় দাঁড়িয়ে রই শতবর্ষী বটগাছটার মত!

সকাল থেকেই আকাশ মেঘলা ছিলো, দু’য়েক মুহূর্ত বাদেই টিপটিপ বৃষ্টি শুরু হয়ে গেলো।

যেন বহুকাল পরে সাগুফতা ফিরে এলো। হাতের চিরকুটটা দেখে একেবারে হইহুল্লোড় শুরু করে দিলো সে! একটা ফোন নাম্বার শুধু লিখা ওতে, আর কিছুনা। সাগুফতা পারলে তক্ষুণি ফোন দেয় ঐ নাম্বারে, আমি অনেক কষ্টে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে ওকে থামালাম। দু’জনে বাড়ির পথে যাচ্ছি। আমার হাতে তখনো গল্পের বইটা ধরা, বইয়ের ভেতরে চিরকুটটা স্থির হয়ে বসে আছে। জ্যান্ত বিড়ালছানার মত লাফাচ্ছে কেবল আমার বুকের ভেতরটা!

-‘কে রে এই ছেলে? আমায় দেখাস তো এরপরেরবার এলে! ক্যামন রে দেখতে? হাইট কতো? নাম কী?…’

নদীর পাড় ধরে হাঁটছিলাম আমরা, সাগুফতা একাধারে একের পর এক প্রশ্ন করে যাচ্ছিলো। একটু এগোতেই একটা তেরাস্তার মোড়, মোড় থেকে সোজা হেঁটে খানিকদূর গেলেই নানুদের বাড়িটা। চাইলে ডানদিকের রাস্তাটা ধরেও যাওয়া যায়, একটু ঘুরপথে। মোড়ে যেতে না যেতেই সাঁই করে একটা বাইসাইকেল একেবারে আমার পাশ কাটিয়ে সজোরে সামনে যেয়ে থামলো। চমকে সেদিকে তাকালাম- শোভন! কোথা থেকে ডানদিকের রাস্তাটা দিয়ে এসে পাশ কাটিয়ে একেবারে আমাদের সামনাসামনি এসে থেমেছে! সাগুফতা আর আমার- দু’জনেরই গতিরোধ হলো, চমকে দাঁড়িয়ে পড়লাম আমরা।

এরই মধ্যে ঐ একই পথ ধরে আরো তিন-চারজন একই বয়সী ছেলে বাইসাইকেল করে এসে মোড়টায় জমায়েত হয়েছে, ডানদিকে যাবার রাস্তাটা ব্লক করে দিয়ে। বৃষ্টির বেগ এরমধ্যেই খানিকটা বেড়ে গেছে, নানুবাড়ির এত কাছে এসে এইভাবে এই অবস্থায় যদি কেউ আমাদের দেখে ফেলে? ভয়ে অন্তরাত্মা শুকিয়ে যাচ্ছে আমার, এখান থেকে যত দ্রুত সম্ভব পালাতে পারলে বাঁচি! কিন্তু বাড়ি যাবার দু’দিকের রাস্তাই আটকে রেখেছে ছেলেদের দলটা। ভোম্বলের মত কেবল শোভনের দিকে তাকিয়ে ছিলাম। মেরুন রঙের একটা ফুলহাতা শার্ট পরনে, হাতা দুটো নিপাট ভাঁজ করে কনুইয়ের কাছটাতে গুঁজে রাখা। সেই অদ্ভুত হাসিটা ঠোঁটে ঝোলানো তার! বাইসাইকেলের কিকস্ট্যাণ্ডটা বৃষ্টিভেজা মাটিতে গেঁথে এলোমেলো চুলগুলি বামহাতে পেছনে সরিয়ে একেবারে চোখের ভেতর দিয়ে অন্তরের গভীরে দৃষ্টি নিক্ষেপ করল!

-‘উফফ! মা..রডালা!’- সাগুফতা আমার দিকে ঝুঁকে বিড়বিড় করে বললো।

আমার পাথর হয়ে যাওয়া চোখজোড়া কেবল দেখতে পেলো পায়ে পায়ে এদিকেই আসছে শোভন। চোখ থেকে খবর গেলো মস্তিষ্কে, আর সেখান থেকে সমস্ত অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে, সমস্ত শিরা-উপশিরায়!

ভীতুর ডিম পা জোড়া দিগ্বিদিকজ্ঞানশূন্য হয়ে বামদিকের রাস্তায় দৌড় লাগালো!

একটু বাদে টের পেলাম উপায়ন্তর না পেয়ে সাগুফতাও আমার পেছন পেছন দৌড় লাগিয়েছে!

-‘কী ভীতুর ডিম রে তুই রাত্রি? ছেলেগুলি সব হাঁ হয়ে তাকিয়ে ছিলো! এভাবে দৌড় দিলি ক্যানোও?’- হাঁটতে হাঁটতে জিজ্ঞেস করে সাগুফতা। বামদিকের রাস্তা ধরর হেঁটে প্রাইমারি স্কুলের মাঠের কাছাকাছি এসে পড়েছি প্রায়, খানিকক্ষণ এখানে অপেক্ষা করে আবার তেরাস্তার মোড় হয়েই বাড়ি ফিরতে হবে!

-‘কেউ দেখে ফেললে? তখন?’

-‘আরে! ও তো শোভন! ছোটমামার বন্ধু রাজীবমামার ভাইয়ের ছেলে! ওর সাথে কথা বলতে দেখলেই বা কী হতো?’

-‘তুই চিনিস ওকে!’

-‘হ্যাঁ! রাজীবমামাকে তো তুইও চিনিস, তারই তো ভাস্তে! যাকগে, যাহোক।শেষমেশ তোর ও কপাল খুললো, বল? আচ্ছা, এবার এই নে ধর, ফোন কর!’- হাতের মোবাইল ফোনটা আমার দিকে বাড়িয়ে দেয় ও।

-‘ধুর! আমি অতসবে নেই! কোথাকার কে না কে…’

মুখে বললেও মন জানে- এর সব মিথ্যে! আগাগোড়া সব জানার জন্য বুকের ভেতরটা ফেটে যাচ্ছে আমার। কে এই শোভন? আমার নাম জানলো কী করে? আর কেনইবা আমার সাথে কথা বলতে চায়? আচ্ছা, আমায় যখন দেখেছে তখন নিশ্চয়ই সাগুফতাকেও চোখে পড়েছে ওর! ওকে ফেলে আমাকে পছন্দ করেছে কেউ-এমনটাও কি সম্ভব? আচ্ছা, এমন তো নয়- যে সাগুফতার কাছে যাবার জন্যে আমাকে সহজ সিঁড়ি ভেবে নিয়ে কথা বলতে চাইছে শোভন বলে ছেলেটা? চকিতে এমন একটা সম্ভাবনার কথা মাথায় খেলে যায় আমার, সত্যিই তো! হলে এটাই হবে!

-‘সিফু, আমার মনেহয় ঐ ছেলের তোকে ভালো লেগেছে। তোর কাছে যাবার সাহস না পেয়ে আমায় এসে ধরেছে…’

সাগুফতা সরু চোখে তাকায়।

-‘তোর মাথায় এতসব বুদ্ধি-কুবুদ্ধি ঘোরে রে রাত্রি! ছাইপাশ নোভেল-উপন্যাস পড়ে পড়ে এসব হয়েছে বুঝলি!’- নাক টেনে টেনে বলে সাগুফতা।

সাগুফতার হাজার জোরাজোরি সত্ত্বেও সেদিন আর কিছুতেই ঐ চিরকুটের নাম্বার ফোন দিতে সাহস হয়নি আমার। মনের ভেতর থেকে ‘মিছিমিছি’ বারবার বারণ করছে যে!

পরদিন একটু বেলা হতেই আবার ধরে বসে সাগুফতা। এদিকে এতগুলো ঘন্টা আমার সাথে মারামারি করে ‘মিছিমিছি’ও ক্লান্ত হয়ে হাল ছেড়ে দিয়েছে- ‘মরগে যা! পরে আমার কাছে কাঁদতে আসিসনে যেনো!’- বলে!

-‘এই রাখলাম ফোন! বিশ মিনিট সময়, আমি গোসল সেরে আসার মধ্যে যদি call করিস তো করবি নয়তো সুযোগ শেষ! এরপর সারাদিনের জন্য আমার দখলে চলে যাবে ফোন- বলে দিলাম!’- দু আঙুলে আমার নাকে চেপে ধরে মাথাটাকে ডানে-বামে ঘুরিয়ে চলে যায় সাগুফতা।

ফোনটা যেন দুর্বোধ্য যান্ত্রিক কোনো ভাষায় ডাকছে আমাকে! জানিনা কী ভেবে সবে হাতে তুলে নিয়েছি, সাথে সাথে ভেতর থেকে ‘মিছিমিছি’ আবার বলে উঠলো-

‘ছি রাত্রি! কী ছেঁচড়া রে তুই!’

-‘চুপ মিছিমিছি! একদম চুপ! তুই কী জানিস এসবের?’

তবু মিছিমিছি চুপ করেনা, গজগজ করতে থাকে।

আর আমি?

আমি ঘোরগ্রস্তের মত বাটন চাপি- ০১৬৩….

-‘হ্যালো!’- অপর প্রান্তের কণ্ঠটা বুকের ভেতর মাদল বাজিয়ে দেয় যেন!

-‘জি! হ্যালো?’

-‘রাত্রি!’- যেন বিস্ময়ের একটা অস্ফুট শব্দ কানে এলো আমার।

-‘ফোন করলে তবে অবশেষে! কেমন আছ?’

-‘জি, ভালো! আপনি কেন অযথা এমন করছেন বলুন তো!’

-‘অযথা!!’- প্রায় চিৎকার করে ওঠে শোভন।

‘তোমার কাছে অযথা মনে হতে পারে রাত্রি,কিন্তু আমার কাছে তো নয়!

এপ্রান্তে আমি নিশ্চুপ! ফোন ধরা ডান হাতটা কাঁপছে অনবরত, তাল মিলিয়ে মাথাটাও কেমন দুলছে। আচ্ছা, অজ্ঞান-টজ্ঞান হয়ে যাবনা তো আবার?

-‘কথা বলবেনা তো? আচ্ছা বেশ, দরকারটা যখন আমার তখন আমিই নাহয় বলছি! রাত্রি! গত পাঁচটা দিন ধরে কেবল তোমাকে একনজর দেখবার জন্য নদীর পাড়ে ঘুরেছি! শেষে সেদিন সাহস করে কাছে গেলাম… আমার তোমাকে ভালোলাগে রাত্রি! প্রথম যেদিন বিকেলের আলোয় তোমাকে দেখলাম- থমকে দাঁড়িয়ে গেছিলাম জানো? কী ভয়াবহ রকমের শান্ত, সুন্দর একটা মেয়ে!…’

-‘বানিয়ে ছানিয়ে ক্যানো এসব বলছেন? সুন্দর শব্দটা আমার সাথে যায়না সে আমিও জানি। শুধু শুধু…’

আমার কথা শেষ না হতেই ওপাশ থেকে মৃদু একটা গুঞ্জন কানে আসে আমার। ভালমত কিছু বোঝার আগেই ফোনটা কেটে যায়। খানিক বাদে আবার রিং হয়, শোভন কল ব্যাক করেছে!

-‘হ্যালো!’

-‘তোমার কথাগুলো একেবারেই অবান্তর রাত্রি! ফোনে আর কত কী বলবো, কাল বরং প্রাইমারি স্কুলের মাঠটায় চলে এসো বিকেলের দিকে? ওদিকটা নির্জন আছে একটু, কারো দেখে ফেলার ভয় থাকবেনা!’

ফোন রেখে দিলো শোভন।

না, জ্ঞান হারাইনি এখনোও! নিজের হাতে চিমটি কেটে দেখলাম- কল্পনা কিংবা স্বপ্ন নয়, বাস্তবেই ঘটছে এসব!

মানুষ কত অদ্ভুত, না? এই আমি সুজনের কথা শুনে সেদিন সাগুফতাকে বোঝাতে যেয়ে কত বড়বড় শেখা বুলি কপচিয়ে গেলাম, অথচ সেই আমিই এখন একজনের সাথে সবে দু’দিনের পরিচয়ে মনে মনে তাকে নিয়ে খেলাঘর পেতে বসেছি!

কোথাও সাদা কাগজ দেখেছি? তো সেই চিরকুটটার কথা মনে পরছে!
বাইসাইকেলের বেল-এর ক্রিংক্রিং আওয়াজ কানে এসেছে? তো এক ঝলকে সেদিনের কথা মাথার ভেতর উঁকি দিচ্ছে! ইশ! কী হতো আরেকটুখন ঐ তেরাস্তার মোড়ে দাঁড়ালে?

ফোন নাম্বারটা ঠোঁটস্থ, মুখস্থ, কণ্ঠস্থ করে ফেলেছি একেবারে! দিনের মধ্যে একশো একবার করে কেবল ওটাই আওড়ে যাচ্ছি!

আচ্ছা, একেই কি সবাই প্রেম বলে?

-‘বাপরে বাপ রাত্রি! তলে তলে এত্ত?’- সাগুফতার কথার সুরে চমকে তাকাই। কী হলো আবার?

ঠোঁট টিপে হাসছে সাগুফতা। ওর চোখের ইশারামত সামনে তাকাতেই একরাশ লজ্জা ঘিরে ধরে বুকের ভেতরটায় আমার…যদি ফর্সা হতাম তো এতক্ষণে বোধহয় গাল-টাল সব লাল হয়ে যেতো। ঐ গল্প-উপন্যাসের সুন্দরী নায়িকাগুলোর মত!

ছোটমামার টেবিলে বসে, ওর ই একটা খাতার মলাটে কলম চালিয়ে কেবল একজনের একটা নাম ই লিখে গেছি এই এতক্ষণ ধরে! বসে বসে তো আকাশ পাতাল ভাবছিলাম আর এদিকে অজান্তেই খাতার মলাট ভরিয়ে ফেলেছি ‘শোভন’, ‘শোভন’ লিখে!

কী লজ্জা! কী লজ্জা!

-‘তাড়াতাড়ি খাতাটা লুকিয়ে ফ্যাল! মামা দেখলে না! খবর হয়ে যাবে কিন্তু, হুউ!’

কী বিপদ! দ্রুত খাতাটা খুলে দেখলাম ভেতরে ছোটমামার গুরুত্বপূর্ণ কিছু আছে কিনা। নাহ! ভাগ্য ভালো বলতে হবে! কেবল দুই-একটা বাজারের লিস্ট ছাড়া আর তেমন কিছু নেই। তড়িঘড়ি খাতাটা নিয়ে ব্যাগে বন্দি করে ফেললাম।

হয়ে গেছে যা হবার! আটকে গেছি জালে!

-‘তো নায়িকা আপা? দিবস রজনী আপনি যে কার আশায় আশায় থাকেন- সে জানে এসব?’- সাগুফতা চোখ মটকায়।

-‘ধুর! সিফু! যা ভাগ!’- ওর হাত থেকে গামছাটা কেড়ে নিয়ে দৌড়ে গোসলঘরের দিকে যাই আমি। মাথার ভেতর ততক্ষণে বেজে চলেছে-

‘দিবস রজনী আমি যেন কার আশায় আশায় থাকি।
তাই চমকিত মন, চকিত শ্রবণ, তৃষিত আকুল আঁখি॥’

পুতুলনাচের পুতুলের মত ঠিকঠিক পরদিন বিকেল হতেই প্রাইমারি স্কুলের মাঠে হাজির হয়ে গেলাম! সাগুফতাও ছিলো সাথে। বাসা থেকে সব পুরান-ধুরান জামাকাপড় নিয়ে এসেছিলাম নানুবাড়িতে, গ্রামে এলে তো এমনিতেই কাপড়চোপড় ময়লা হয় বেশি। তাই ভাল জামাগুলো ইচ্ছে করেই আনিনি। সাগুফতাই বুদ্ধি দেয় ছোটোখালামনির শাড়ি পরে আসার! প্রথমে তো একদমই রাজি ছিলাম না আমি, তারপর সাগুফতা বললো এমনিতেও ও আজকে শাড়িই পরবে, সুজন নাকি ওর কাছে ছবি চেয়েছে শাড়ি পরা অবস্থায়! ছোটমামার একটা ডিজিটাল ক্যামেরা আছে, দু’জনে মিলে ওতে শাড়ি পরা ছবিও তোলা হয়ে যাবে এই ফাঁকে!

বেশ, শেষে পরলাম শাড়িই দু’জনে মিলে! সাগুফতাকে একেবারে পরীর মত লাগছিলো! মিথ্যা বলবনা, ওর পাশে নিজেকে দেখে একটু… না না, একটু না, বেশ অনেকখানিই মন খারাপ লাগছিলো আমার। কী বেমানান লাগছে ওর পাশে আমায়! একই পোশাক, একইরকম ভাবে পরেছে দুজন মানুষ, অথচ দেখো- একজনকে লাগছে আকাশের পরীর মত আর আরেকজনকে লাগছে বাঁশঝাড়ের পেত্নীর মত!
ধুর!

টপাটপ দু’চারটা ছবি তুলেই তড়িঘড়ি বেরিয়ে স্কুলমাঠে এসেছি দু’জনে মিলে। সাগুফতা সুজনকে MMS করে ছবি পাঠাচ্ছে, আমি ওর পাশেই গালে হাত দিয়ে বসে আছি।

সে আসেনি এখনোও…

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here