তিলেত্তমা পর্ব ২

গল্পঃ তিলোত্তমা
পর্ব: ২

সেই ক্লাস ফাইভের রাত্রি, সাড়ে তিনফুটের জেদী মেয়েটা আচমকা একদিন টের পেলো পৃথিবীর বুকে যে গল্পটা হাতে নিয়ে সে এসছে, সেটা তার বড় একলার, বড় নিজস্ব। আর কেউ এই গল্পের ভাগীদার হতে চায়নি কোনোদিনই, কেবল প্রকৃতির নিয়মে বাধ্য হয়ে জড়িয়ে গেছে! সেই রাতে আমি অনেক্ষণ কেঁদেছিলাম, অনেক্ষণ। ছোট্ট বুকটার ভেতর কী প্রচন্ড রকমের কষ্ট হচ্ছিলো সেদিন আমার! এখনো চোখ বুজে সেদিনের কথা ভাবলে টের পাই বুকের ভেতরটা দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছে। এগারো বছরের সেই রাত্রি বুকের ভেতর একটা কুঠুরী বানাতে শুরু করলো সেদিন থেকে। খুব গোপন, অন্ধকার একটা কুঠুরী- তার বাইরের রঙটার থেকেও গভীর কালো! চারপাশ থেকে আসা সমস্ত আঘাত, হাস্যছলে বলা সমস্ত অপমানগুলো এক একটা দুঃখবই বানিয়ে করে সেখানে জমাতে থাকলো সে। বয়েস বাড়ে, সাথে জমতে থাকা দুঃখবইও! মনেমনে নিজের একজন খুব কাছের বন্ধু বানিয়ে নিলাম তারপর, নাম দিলাম- ‘মিছিমিছি’! মন খারাপ হলেই সেই মিছিমিছি নামের মেয়েটার সাথে মনেমনে কথা বলতাম আমি, দু’জনে মিলে গান গাইতাম, আমি প্রশ্ন করতাম সে উত্তর দিতো আবার পালটা প্রশ্নও করতো আমায়! আর তারও অনেক পরে এই ডায়েরিটাকেও আমাদের দু’জনের বন্ধু বানিয়ে নিলাম- এখন তিনজনে মিলে ভালই আছি!

বোধহয় আমার মত একলা গল্প নিয়ে আসা মানুষগুলির জন্যেই সৃষ্টিকর্তা এই ‘মন’ বলে জিনিসটা বানিয়ে দিয়েছেন! নয়তো এই এত এত মানুষভরা পৃথিবীতে এরা একলা একলা বাঁচতো কী করে?

আমাদের স্কুলে একজন নতুন অঙ্কের স্যার এসেছেন, খুব সুন্দর করে ধীরে ধীরে বুঝিয়ে পড়ান। সপ্তাহখানেক তাঁর ক্লাস করেই টের পেলাম ধীরে ধীরে গণিত বিষয়টা ভালো লাগছে আমার। কী মনে করে কে জানে, মা’কে যেয়ে বললাম আগের অঙ্ক স্যারের বদলে ওনার কাছেই কোচিং করতে চাই আমি। মায়ের অবাধ্য মেয়ে আমি, আরো আগে থেকেই নিজের ইচ্ছেমত টিচার অদলবদল করি- মাও তাই বিনা বাক্য ব্যায়ে রাজি হয়ে গেলেন। অন্তরীক্ষে কেউ একজন বোধহয় একটা প্রশ্রয়ের মুচকি হাসি হাসলেন। বহুবছর পর জেনেছি- জীবনের সবচেয়ে সঠিক আর সবচেয়ে সুন্দর সিদ্ধান্তটা আমি সেদিন নিয়েছিলাম।

আর সবচেয়ে বিচ্ছিরি আর ভুল সিদ্ধান্তটা? পেছন ফিরে তাকালে যে দিনটার কথা ভেবে আমার সবচেয়ে বেশি আফসোস হয়, ঐ বোকা রাত্রি নামের একরত্তি মেয়েটার জন্য বড় করুণায় বুকের ভেতরে হাহাকার করে ওঠে- সেই দিনটা?

সবে এস.এস.সি পরীক্ষা শেষ হয়েছে আমাদের। আমার দুই মামা, ছোটোখালা আর নানা-নানী সকলে মিলে রাজবাড়ীর একটা গ্রামে থাকেন, বড় বন্ধ পেয়ে আমি আর সাগুফতা দু’জনেই নানুবাড়ি বেড়াতে চলে এসেছি। নানুদের বিশাল বাড়িটা একেবারে পুরনো আমলের জমিদারবাড়ির মতন দেখতে- চারদিকে বড় বড় ঘর তোলা, মাঝে ছড়ানো উঠান, বাড়ির প্রবেশদ্বারে জোড়ায় জোড়ায় সারি সারি নারকেল গাছ, উঠানে ঢুকতেই নানীর হাতে গড়া টুকরো বাগান আর উত্তরে, বাড়ির একেবারে পেছনে একটা দীঘি।

আমার নিজের কোনো মোবাইল বা কম্পিউটার নেই। নেশা বলতে এক গল্পের বই আর দুই গান শোনা! সাগুফতাকে অবশ্য বড়খালা একটা ফিচার ফোন কিনে দিয়েছিলেন গতবছর, বৃত্তি পেয়েছিলো বলে উপহার হিসেবে চেয়ে নিয়েছিলো ও-ই। স্কুলের লাইব্রেরি থেকে বেশ ক’টা বই বাগিয়ে নিয়ে নানুবাড়ি যেয়ে অবাক হয়ে আবিষ্কার করলাম সেই ফোনে-ফোনে কীভাবে কীভাবে একটা ছেলের সাথে নাকি প্রেম হয়ে গেছে সাগুফতার! স্কুলের অনেক মেয়েরাই আরো আগে থেকেই এ ধরণের সম্পর্কে জড়িয়ে গিয়েছিলো সে আমি জানতাম। কিন্তু তাই বলে সাগুফতা! বড়খালার বাধ্য মেয়ে, মায়ের চাঁদপানা মুখের মেয়ে, বড়মামার আদরের মেয়ে- সাগুফতা!

-‘সুজন আমাদের সাথে একই কোচিং এ পড়ে, সেখান থেকেই পরিচয় হয়েছে আমাদের।’- সাগুফতা চোখ মটকে বলে।

-‘তারপর?’- আমি বোকার মত জিজ্ঞেস করি।

-‘তার আবার পর কী? তুই তো জানিসই ছেলেরা ক্যামন ঘোরে আমার পিছপিছ! সেরকমই… সুজনটা হ্যাংলার মত পেছন পরে রইল, শেষমেশ আমিও গলে গ্যালাম!’- সাগুফতা হাত নাড়ায়, যেন মাছি তাড়াচ্ছে। আমি গোগ্রাসে গিলতে থাকি ওর কথা।

-‘এই-ই! ওরকম তো কতজনেই তোর পেছন পেছন ঘোরে! এর বেলায়ে হঠাৎ গলে গেলি যে?’

-‘তুই তো দেখসনি সুজনকে! সেইই হ্যাণ্ডসাম! আর, ঝিনাইদায় ওদের বিশা-ল বাংলোর মত বাড়ি…’

আমি প্রচন্ড অবাক হয়ে সাগুফতার দিকে চেয়ে রই। এভাবে বুঝি ভালবাসা হয়? এই বয়সে হাজারখানেক বই পড়া শেষ আমার, মাথার ভেতর চকিতে খেলে যায় সবগুলো প্রেমকাহিনী। নাহ! এরকমভাবে যে সম্পর্কের শুরু সেটা কখনোই সত্যিকারের সম্পর্ক হতে পারেনা! সেই কথাটাই সাগুফতাকে বলি-

-‘টাকা পয়সা আর হ্যাণ্ডসামনেস দেখে কি ভালোবাসা হয়?

-‘তো? কী দেখে হয় তাহলে?’- সাগুফতা ঘাড় নাচায়।

-‘আমি কত বইতে পড়েছি, এভাবে মোহ তৈরি হয়। কিন্তু… কিন্তু তা দিয়ে পুরো একটা জীবন কাটানো যায়না…’

সাগুফতা আগুন চোখে আমার দিকে তাকায়।

-‘তুই এসবের কী জানিস? কেউ কোনোদিন করেছে তোকে প্রোপোজ? তুই জানিস, সুজন যেদিন আমাকে প্রোপোজ করেছিলো সবচেয়ে দামী চাইনিজ রেস্টুরেন্টটার টপ ফ্লোর পুরোটা সারাদিনের জন্য book করে নিয়েছিলো! শোন, অন্তত তোর কাছ থেকে প্রেম-ভালোবাসার জ্ঞান নিতে হবেনা আমাকে!’

সত্যিই, বড় বেশি বলে ফেলেছি। তাইতো! এসবের আমি কী জানি? আমাদের স্কুলের প্রায় সবারই দু’একবার উড়োচিঠি পাওয়ার অভিজ্ঞতা হয়ে গেছে এরমধ্যেই! আয়েশা, সুমি, রুমানা- এদের একনজর দেখার জন্য তো স্কুলের গেটের সামনে ছেলেদের লাইন পড়ে যেতো! পরে প্রিন্সিপাল ম্যাডামের হস্তক্ষেপে সেসব এখন কমেছে। আর আমি? গত দুই বছর ধরে তো একলা একলাই যাতায়াত করছি। না কেউ কোনোদিন ভুলেও একটা চিঠি দিলো, আর না কেউ কোনোদিন একবারের বেশি দু’বার ফিরে তাকালো!

আমি তাই চুপ হয়ে যাই, ঘাড় গুঁজে দেই বইএর ভেতর। বোধহয় দু ফোঁটা নোনাজল বেয়ে পরে বইএর পাতায়, কে জানে তার খবর? সাগুফতা তখন SMS bundle কিনে নিয়ে সুজনের সাথে টেক্সটিং এ ব্যস্ত…

এর আগে ডিসেম্বরে স্কুল ছুটি হলেই আমরা দৌড়ে নানুবাড়ি চলে আসতাম। খুব মজা হতো সেসময়, এখানে আমাদের সমবয়সী মেয়েদের সাথে কতরকম খেলা যে খেলতাম! ছি-বুড়ি, কানামাছি, বউছি, বরফ-পানি, কুমির ডাঙা, ডাক ডাক বেলী… কত্তকিছু! একবার তো ব্যাট আর বল যোগাড় করে ক্রিকেট ও খেলেছিলাম।

কিন্তু এবার সব কেমন ওলট-পালট হচ্ছে! গ্রাম এলাকা বলে আমাদের সমবয়সী অনেক মেয়েদেরই এরমধ্যেই বিয়ে-থা হয়ে গেছে, আর যারাওবা বাকি আছে এরা এখন আর এসব খেলে-টেলে না! কেমন বড় মানুষের মত মুখ করে ঘুরে ঘুরে বেড়ায়, গ্রামের মেয়েরা বোধহয় দ্রুত বড় হয়ে যায়! ওদিকে সাগুফতাটাও ফোনে মজে আছে, এবার বেশিরভাগ সময়টাই দীঘির পাড়ে বসে বই পড়ে পড়েই কাটাচ্ছি তাই। বাড়িতে মামারা থাকেন বলে সাগুফতা প্রায়ই আমাকে নিয়ে ঘুরতে যাবে বলে নদীর পাড়ের দিকে চলে যায়, তারপর আমাকে পাহারায় বসিয়ে দিয়ে সুজনের সাথে ফোনালাপে ব্যস্ত হয়ে পড়ে! প্রায়ই এমন হতো, আমি নদীর এক ধারে বসে ঘাড় গুঁজে বই পড়ে চলেছি- কখনো জাফর ইকবাল, কখনো হুমায়ূন আহমেদ অথবা কখনো নিতান্তই কোনো ছোটদের ভূতের গল্পের বই- যেটা কিনা ছোটখালা আমাকে পাশের বাড়ি থেকে ধার করে এনে দিয়েছেন! সত্যি বলতে ঐ সময়টায় আর কোনো কিছু খেয়াল থাকতো না আমার। একমনে ডুবে যেতাম বইয়ের ভেতর, কীসের পাহারা দেয়া কীসের কী! সাগুফতা হাঁটতে হাঁটতে কথা বলতো ফোনে, কখনো কখনো বেশ দূরেই চলে যেতো। ওদের কথা বলা শেষ হলে পরে আবার আমায় নিয়ে বাড়ি ফিরে যেতো। এভাবেই চলছিল দিনগুলি। এই বড় অনিয়মের নিয়ম করা দিনগুলিতে হঠাৎ একদিন… এক রবিবার একটা অদ্ভুত ঘটনা ঘটলো!

প্রতিদিনকার মতই সাগুফতা ব্যস্ত ছিলো ফোনে আর ঘাড় গুঁজে বই পড়ছিলাম আমি নদীর ধারে বসে বসে, হঠাৎ-ই কোত্থেকে কেউ একজন এসে ধপাস করে বসে পরলো আমার পাশে।

-‘ওমা! কথা শেষ আজকে এত তাড়াতাড়ি? বাড়ি যাবি নাকি…’

ভেবেছিলাম সাগুফতা এসেছে বোধহয়। কথা বলতে বলতেই বইটা বন্ধ করে ঘাড় ঘুরাই। প্রচণ্ড বিস্ময়ে বিমূঢ় হয়ে দেখি সাগুফতা নয়, সম্পূর্ণ অচেনা একজন এসে বসে আছে আমার পাশে।

একটা ছেলে! আমাদেরই বয়সী!

তড়িঘড়ি করে উঠে দাঁড়াই আমি, সাথে সাথে সে-ও উঠে দাঁড়ায়! মিষ্টি একটা হাসি ঝুলিয়ে বলে-

-‘হাই! আমি শোভন! ঢাকায় থাকি, এখানে দাদুর বাসায় বেড়াতে এসেছি।’

আমি থ’ হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলাম কেবল। এপাশ থেকে কোনো উত্তর না পেয়ে খানিক বাদে আবার ছেলেটা বলে উঠে-

‘আচ্ছা তোমাকে মানে আপনাকে বলতে হবেনা কিছু! আমি জানি আপনার নাম রাত্রি!’

কী ভয়ঙ্কর! কে এই ছেলে? কোত্থেকে এভাবে উদয় হলো! নিজেকে একেবারে বোবা লাগছে।

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here