তিলেত্তমা পর্ব ৪

তিলোত্তমা
পর্বঃ ৪

বেশ অনেকটা সময় কেটে গেলো একভাবেই। সাগুফতাটা তো দিব্যি ফোনে মজে আছে! ধুরো, বইটই কিছু নিয়ে আসা দরকার ছিলো সাথে করে, সেই কখন থেকে হ্যাবলার মত বসে আছি! আদৌ কি সে ছেলে আসবে? নাকি না?- ভাবতে ভাবতেই ‘হোহো’ হাসির শব্দে চমক ভাঙে আমার।

‘জয় মা কালীইইইইই!’- কতগুলো ছেলের কণ্ঠ সমস্বরে বেজে ওঠে, কোরাসের মত! চমকে গিয়ে উঠে দাঁড়াই, ঘাড় ঘোরাতেই চোখে পরে সেদিনের দেখা সেই ছেলেগুলোকেই, বাইসাইকেলে করে রাস্তা আটকে দাঁড়িয়ে ছিলো যারা! তিনজনের দলটা আমাদের সামনে দিয়ে হেঁটে চলে গেলো। কিন্তু কই, শোভন তো নেই ওদের সাথে! আর কী বলছিলো ওরা… হিন্দু ধর্মের নাকি ওরা সবাই?

ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে সাগুফতার দিকে তাকাতেই দেখি মিটিমিটি হাসছে ও।

–‘কী হলো রে এটা সিফু?’- প্রশ্ন করলাম।

–‘কিইজানি! এরা এখানে কী করে? কই, তোর নায়ক কই?’

অদ্ভুত তো!

স্কুলের মাঠে দু’একজন বাচ্চা ছেলেমেয়ে খেলছিলো। শোভনের ঐ বন্ধুরা কিছুদূর যাবার পরই বাচ্চাগুলির একজনকে ডেকে নিয়ে কিছু একটা বলে… আমরা তখনো দাঁড়িয়ে দেখছি ওদেরকে। আগামাথা কিছুই তো বোঝা যাচ্ছেনা ছাই!

একটু বাদেই বাচ্চাটা দৌড়ে আমাদের দিকে আসে, তারপর ডানহাতে ধরা সাদা কাগজটা আমার দিকে বাড়িয়ে দেয়-

-‘ন্যান! এইডা আফনের!’

–‘আর এই দুইডা আফনের! তাত্তাড়ি ফুন নাম্বারডা লেইখা ফিরুত দ্যান, খেলতাসি আমরা।’ – সাগুফতার দিকে একটা গোলাপী রঙের কাগজ আর বলপেন এগিয়ে দেয় বাচ্চাটা।

নিজের হাতের কাগজটা পড়ব কি, আমি বোকার মত সাগুফতার দিকে চেয়ে রইলাম! হচ্ছে কী এসব?

বাচ্চাটার হাত থেকে কাগজটা নিয়ে দ্রুতহাতে খসখস করে কিছু একটা লিখে আবার ফেরত দেয় সাগুফতা। জিনিসদুটো নিয়েই একদৌড়ে চলে যায় ছেলেটা।

মাথাটা পুরো এলোমেলো লাগছে আমার! যন্ত্রের মত হাতে ধরা কাগজটায় চোখ বুলাই-

-‘Sorry, আমাকে মুক্তি দিলে ভালো হয়।
……….- শোভন’

ব্যস! কেবল এতটুকুই লিখা। এপিঠ-ওপিঠ উলটে দেখলাম, আর কিচ্ছু নেই!

মানে কী! কে কাকে আটকালো আর কে ই বা কার থেকে কীসের মুক্তি চাচ্ছে? আমি তো যেচে পড়ে শোভনের সাথে কথা বলিনি একবারও! ও-ই তো সেদিন…

আলগোছে চিরকুটটা ধরা ছিলো আমার হাতে, ছোঁ মেরে কেড়ে নিয়ে সেটা পড়ে নেয় সাগুফতা। তারপর ‘ফুঃ’ করে একটা নিঃশ্বাস ছেড়ে বলে-

-‘হায়রে গল্পনেশী! ছাইপাশ নোভেল গিলে গিলে মাথাটা যে পোকার বাসা বানিয়েছিস এবার বুঝলি তো? কে কবে এলো কি এলোনা, দুটো কথা বললো কি বললো না- ওমনি প্রেমে হাবুডুবু খেতে খেতে খাতাপত্তর জুড়ে তার নাম লেখে ভরানো! এত সস্তায় প্রেম হয়না, বুঝলিই? আশা করি কোনটা মোহ কোনটা প্রেম আর কোনটা ভালোবাসা- আমাকে এসব শেখাতে আসবি না আর!’

সাগুফতার টেনে টেনে বলা কথার সুরে ভাবনায় ছেদ পরে আমার। কী বলছে ও এসব আবোলতাবোল?

-‘কী বলছিস সিফু, আমি এখনো কিছুই বুঝিনি বিশ্বাস কর…’

-‘সে তুই বুঝবিওনা জানি! থাকিস তো সারাদিন কুনোব্যাঙ-এর মত এক কোণায় বসে, দু’খানা বই হাতে নিয়ে! কুয়োর ব্যাঙ সমুদ্রে পরলে যা হয় আরকি!’- ঠোঁট বাঁকায় ও।

-‘তুই কি কিছু জানিস, সিফু? কে এই শোভন, কোত্থেকে এসে এভাবে উদয় হলো আর কেনইবা এখন…’

-‘সে তোর শোভনকে যেয়ে জিজ্ঞেস করগে যা!’

সাগুফতা ঘাড় দোলায়, তারপর বাড়ির দিকে হাঁটতে আরম্ভ করে। ওর পেছন পেছন যেতেও ভুলে যাই আমি, ঠায় দাঁড়িয়ে থাকি স্কুল মাঠটায়। আমি কি এখনোও অপেক্ষা করছি কারো আশায়? যে আসবে বলে কথা দিয়েছিলো গতকাল, যার জন্য এত আয়োজন…

যে বন্দি না হতেই মুক্তির আবেদন নিয়ে এসেছে- তার আশায়?

কতক্ষণ পার হয়েছে জানিনা, সন্ধ্যে হবে হবে অবস্থা। মাঠের কোণার দিকে একটা কাঁঠাল গাছের গুঁড়ির ওপর বসে আছি এখনও। প্রচণ্ড তৃষ্ণা পেয়েছে, অথচ বাড়ি ফেরারও কোনো তাগিদ পাচ্ছি না। চলে যাবো এভাবে? ঘন্টা তিনেক আগেও কত কী ভাবছিলাম! দুরুদুরু বুকটাকে শাড়ির আঁচলে আগলে, একবুক প্রত্যাশা নিয়ে যে সাদা কাগজে নতুন কোনো গল্প লিখবো ভেবে এলাম, একটা কালির আঁচড়ও পরবেনা তাতে?

হায় খোদা! যদি শূন্যই করে দেবে তবে পূর্ণ করেছিলে কেনো? বেশ তো ছিলাম আমি একলা একলা! নিজের জগতে, নিজের মতো করে…

-‘এক্সকিউজমি আপু!’- কেউ একজন পাশে এসে দাঁড়ায়। ধ্বক করে ওঠে হৃদপিণ্ডটা, সে নয় তো?

নাহ! সে নয়! অন্য কেউ… তবে মুখটা চেনা, কোথাও দেখেছি একে!

-‘আমার নাম নিবিড়, আমি শোভনের বন্ধু। সেরকম বন্ধু নই, কেবল পাড়া-প্রতিবেশী ধরণের বন্ধুত্ব আরকি। শোভন আপনার সাথে যেটা করেছে একদমই ঠিক হয়নি সেটা… আমি বারবার না করেছিলাম ওকে কিন্তু..’

শোভন যে ঠিক কী করেছে আমার সাথে সেটাই আমি এখনো জানিনা! সে তো আর আমার সামনেই এলোনা। আমি তো দিব্যি আমার মত ছিলাম, শোভন কেনইবা যেচে আমার জীবনে আসতে চাইলো, কখনইবা আমি ওকে বন্দি করলাম যে এখন আবার মুক্তি চাচ্ছে, আর এমনটাই যখন করবে তখন কেনো অযথা আমায় টেনে এখানে নিয়ে এলো! এইতো গতকালও ফোনে কীসব বলছিলো, আর আজ কী হলো? সে যদি চলেই যাবে তবে এলোই বা কেনো, আর এলোই যদি তবে দু’দিন বাদেই চলে যেতে চায় কেনো? ঐ এক বাক্যের একটা চিরকুট, যে বাক্যটার কীনা কোনো আগামাথাই নেই- তাই দিয়ে কি এত প্রশ্নের উত্তর দেয়া যায়? যদি শোভন নিজে এসে আমায় স্পষ্টাস্পষ্টি প্রত্যাখ্যান করে যেতো, তো আমি গটগট করে হেঁটে এতক্ষণে বাড়ি ফিরে যেতাম ঠিকঠিক! কেননা, আমি তো আর সেধে সেধে ওর কাছে যাইনি, আর তাই আমাকে প্রত্যাখ্যানের অধিকার ও ওর নেই। ও কিছু বলবে বলেছিলো, তাই শুনতেই তো আমি এসেছি! কাউকে ডেকে এনে এবারে ‘আমি তোমার থেকে মুক্তি চাই’- এই কথা বলার কোনো মানে হয়?

কিন্তু তা তো সে করেনি! এই একবাক্যের একটা চিরকুট, একটা পৃষ্ঠার চারভাগের একভাগ- এই দিয়ে কী বুঝবো আমি?

সেদিনের বহুবছর পর অনেকবার ভেবে দেখেছি, বোধহয় সেজন্যেই অতক্ষণ ওখানে একা একা বসে ছিলাম আমি- একটা স্পষ্ট উত্তরের আশায়! ভাল-মন্দ, সুখ-দুঃখ সে যাই-ই হোক, অন্তত একটা উত্তরের আশায়…

-‘আপু, শোভন আসলে আপনার ঐ বোনকে পছন্দ করতো, নদীর পাড়ে একদিন ওকে দেখেই শোভন আমাদেরকে সেকথা জানায়। কিন্তু আপনার বোন শোভনকে বলে আপাতত কোনোরকম সম্পর্কে জড়াতে চায়না সে, তবে একটা শর্তে কেবল বন্ধুত্ব করতে রাজি আছে শোভনের সাথে। যদি শোভন আপনাকে পটাতে পারে তবে…’

ও! তবে এই কথা! সাগুফতাকে ছোটোবেলা থেকেই জানি আমি, নিজের মতের বিরুদ্ধে একটা শব্দও সহ্য হয়না ওর। সেদিন যে বলেছিলাম সুজনের সাথে ওর প্রেমটা হয়তো প্রেম নয়- তার জন্যে এতবড় শাস্তি আমার?

-‘আপু, আমি অনেকবার নিষেধ করেছিলাম শোভনকে, এমনকি সেদিন তেরাস্তার মোড়ে ওরা যখন আপনাদের পথ আটকে দাঁড়ালো আমাকে তখনো মিথ্যে বলেছিলো ওরা… আমি জানতাম যে আপনার বোনের সাথে কথা বলার জন্যেই ওরা সেদিন গিয়েছিলো! যেহেতু শোভন ওকে পছন্দ করে বলেছে, তাই আমিও ছিলাম সেদিন সেখানে… ‘

ব্যস! সমস্ত উত্তর পেয়ে গেছি এবারে! ঠিক যা ভেবেছিলাম তাই-ই! সাগুফতাকেই চেয়ছিলো শোভন, আমাকে নয়।

নাহ! দুনিয়া এখনো ওল্টায়নি! সাগুফতাকে ফেলে রাত্রিকে কেউ কোনোদিন পছন্দ করেনি- সবকিছু যেমন ছিলো তেমনই আছে।

কী ভীষণ বোকা আমি! এতশত বই পড়া জ্ঞান(!) আমার, তবু এটুকু মনে এলোনা- গল্পের নায়িকারা কখনোও কালো হয়না, অসুন্দরী হয়না।

সাগুফতাদের দুনিয়াতে রাত্রিরা কোনোদিনই গল্পের কেন্দ্রে থাকেনা! কোনোদিন না!

-‘অনেক ধন্যবাদ! আপনাকে আজীবন মনে থাকবে…’- এইতো কী স্বাভাবিকভাবে ছেলেটার সাথে কথা বলছি আমি! কোনো আক্ষেপ নেই, রাগ-দুঃখ কিংবা ক্ষোভ- কিচ্ছু নেই! আচ্ছা, মনের খুব গোপনে কি কেউ জানতো যে এমনটাই হবার ছিলো?

জানতো ই তো! আমার সেই বন্ধু- মিছিমিছি! কতবার বারণ করেছিলো সে আমায়! শুনিনি সেসব, অসম্ভবের পথে পা বাড়িয়ে দিয়েছি বদলে। হলো তো তার শাস্তি এবার!

সন্ধ্যা ফুরিয়ে এসেছে প্রায়, রাত নামছে চারদিকে। অন্ধকার এখনো পুরোপুরি জাঁকিয়ে বসেনি। এই সন্ধ্যার হালকা আঁধারের ভেতরেও দিনের যতটুকু আলো অবশিষ্ট আছে- সেও আমার চেয়ে ফর্সা! আর, এই কালো- কুচ্ছিত মেয়েই কীনা ভেবে বসে আছে কোনো একজনের তাকে দেখে ভালো লেগে গেছে! আকাশ কুসুম বুঝি একেই বলে!

শাড়িটা এলোমেলো হয়ে গেছে, অভ্যেস নেই যে একদমই শাড়ি পরবার! রাজবাড়ির দাসী কিনা রাজপুত্রের আশায় শাড়ি জড়িয়ে, সেজেগুজে বিবাহমণ্ডপে হাজির হয়েছে! ছিঃ ছিঃ, কী দুর্বিষহ লজ্জা, কী ভয়ংকর অপমান! শরীরের কোষগুলোতে ‘মেলানিন’ বেশি- এই অপরাধের অপরাধী করে আর কাওকে পাঠিয়ো না খোদা এখানে, দেখলে তো প্রতি পদে পদে কেমন লাঞ্চনা সইতে হয়? আর যদি তবুও পাঠাও, তবে অন্তত দু’হাতে দুখানা খড়্গ দিয়ে পাঠিও- যেন ‘জয় মা কালী’ হর্ষধ্বনি শোনার সাথে সাথে দু’চারটা অসুর ও বধ করতে পারি।

অন্ধকারের বুক চিড়ে আরো অন্ধকার একটা অবয়ব ধীরপায়ে হেঁটে স্কুলমাঠ ছাড়ে। তারপর জনারণ্য পৃথিবীর বুকে নিঃসঙ্গ অবয়বটাকে দেখা যায়- স্কুলমাঠ, পোস্ট অফিস, বাঁশঝাড় আর সবশেষে উত্তরের দীঘি পেরিয়ে যেতে…তার চোখ বেয়ে কি অশ্রুধারা নেমেছে? কে জানে! লাঞ্ছনা আর অপমানের বোঝা মাথায় করে হেঁটে যাওয়া মেয়েটা বোধহয় মনেমনে আওড়ায়- ‘ হে ধরণী দ্বিধা হও!’- তাই-ই বা কে শোনে! ধরণী সেই কবে কোন সত্যযুগে অপমানিত, লাঞ্চিত সীতার লজ্জায় দ্বিধা হয়েছিলো… কলিযুগে তা আর হবার নয় বুঝি!

এর অনে..ক-অনেকদিন পর যেয়ে ঐ সরল, বোকাহাবা, অভিমানী মেয়েটার কথা ভেবে আমার বড় কষ্ট হবে। অনেক বছর পর, লোকারণ্য কোনো লাইব্রেরির কোণায় বসে আমি ভাববো- ‘আহ! যদি পারতাম ঐ সতের বছরের মেয়েটার কানেকানে ফিসফিস করে বলে আসতাম- ”অভিমান করোনা মেয়ে! বিশ্বাস করো, শোভনের মত কোনো অপদার্থের জন্য তুমি জন্মাওনি! বিশ্বাস করো!”

কিন্তু সেটা হয়না! বাইশ বছরের রাত্রি পৌঁছতে পারেনা সেই সতের বছরের রাত্রির কাছে।

সতের বছরের মেয়েটা তাই পুরো বিশ্বসংসারের ওপর অভিমান করে বসে। পণ করে বসে- এই এক জীবনে আর কাউকে বিশ্বাস করে ঠকবে না সে!

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here