#তি_আমো(রিপোস্ট)
পর্ব ৭
লিখা- Sidratul Muntaz
সামনেই ইনকোর্স এক্সাম। খুব মনোযোগ দিয়ে পড়াশুনা করছি। মা আমার মাথায় তেল লাগিয়ে দিতে দিতে বলল,” আচ্ছা তারু, তোর স্যারকে একদিন বাড়িতে দাওয়াত করলে কেমন হয়?”
আমি পড়ার তালে ছিলাম। তাই প্রথমেই মায়ের কথাটা বুঝতে পারলাম না। জিজ্ঞেস করলাম,” কোন স্যার?”
মা হাসি-খুশি গলায় বলল,” তোর কোচিং-এর স্যার। সেদিন যে তোকে বাড়ি পৌঁছে দিল!”
আমি বিস্মিত হয়ে বললাম,” হঠাৎ তাকে কেন দাওয়াত করতে চাইছো?”
” আমি না, তারিফ বলছিল।”
আমি শঙ্কিত হলাম। ভাইয়া আর মায়ের মনে কি চলছে বুঝতে পারছি না। আর ঈশানকে বাড়িতে দাওয়াত করার প্রশ্নই আসে না। আমি কঠিন গলায় বললাম,” এসবের কোনো দরকার নেই।”
” দরকার নেই কেন?”
” আমার কোচিং-এ তো পনেরো জন স্যার। সবাইকেই কি বাসায় দাওয়াত করে খাওয়াবে? আজব!”
” সবাইকে খাওয়াতে যাব কেন? আমি শুধু ঈশানের কথা বলছি।”
” তোমার নামও মনে আছে?”
” তো মনে থাকবে না? একই এলাকায় থাকি আমরা। সেদিন তো দেখাও হলো। গলির মোড়ের দোকানটায়। আমার হাতে বাজারের ব্যাগ দেখে বলল, আন্টি দেন। আমি ধরি। আপনার কষ্ট হচ্ছে। সে ব্যাগগুলো বাড়ি পর্যন্ত পৌঁছে দিল। আমি বললাম, বসো। সে বসল না। তুই বাড়িতে নেই শুনেই চলে গেল।”
ভালোই মাকে কবজা করেছে ঈশান। আমার রাগ লাগল। ইদানীং সে আমাদের বাড়ির আশেপাশে খুব ঘুরছে। ভাইয়ার চোখে পড়লে সর্বনাশ হবে। লোকটা কি চায়? আমি বিরক্ত গলায় বললাম,” বাজারের ব্যাগ ক্যারি করেছে বলে কি এখন তাকে বাড়িতে এনে খাওয়াতে হবে? এসবের কোনো দরকার নেই মা।”
আমার কথা শুনে মা রেগে বলল,” তোর এতো সমস্যা কিসের? তুই তো সম্মানও দিতে জানিস না মানুষকে। সেদিন ঈশানের সাথে তোর কথা বলার ধরণ তো দেখলাম। এমন ভাবে কথা বলছিস যেন স্যার না, সে কোনো বখাটে! কি ভাববে সে? ভাববে আমরা তোকে আদব-কায়দা শেখাইনি।”
আমি নিজেকে ধাতস্থ করে বললাম,” ঠিকাছে। তোমার যা ইচ্ছা তাই করো মা। আমি আর কিছু বলব না।”
” তোকে কিছু বলতেও হবে না। তুই শুধু স্যারের বাসার ঠিকানা দে।”
আমি চুপ করে পড়ার ভাণ ধরলাম। হুট করে বাসার ঠিকানা কিভাবে দিব? সে তো এখানে থাকেই না। মা উত্তর না পেয়ে আবার বলল,” কিরে? ঠিকানা জানিস তো? না জানলেও সমস্যা নেই। আমি খুঁজে বের করব। এই গলির পরের গলি না?”
আমি বিব্রত হলাম,” তোমার খুঁজে বের করতে হবে না। তুমি যে দাওয়াত করেছ এটা আমি কোচিং-এ দেখা হলে স্যারকে বলে দিব।”
” ঠিকাছে। বলিস কিন্তু। সামনের শুক্রবার দুপুরে যেন আমাদের বাড়িতে চলে আসে।”
” আচ্ছা বলব। কিন্তু স্যার না-ও আসতে পারে।”
মা চলে যাচ্ছিল। আমার কথা শুনে থামল।
” না-ও আসতে পারে মানে? আসবে না কেন?”
আমি কি বলব বুঝতে পারছি না। ঈশানকে তো আমি জীবনেও দাওয়াত করতে যাব না। চট করে মিথ্যা বলা খুব কঠিন। আর একবার মিথ্যা বলে ফেললে সেটা অভ্যাসে পরিণত হয়। আমি এখন মিনিটে মিনিটে মিথ্যা বলছি।
” কারণ শুক্রবারে স্যার বাড়িতে যায়।”
” বাড়িতে যায় মানে?”
” মানে স্যার তো এখানে ব্যাচেলর থাকেন। আর স্যারের মা-বাবা থাকেন মফস্বলে। তাদের সাথেই দেখা করতে যায় আরকি!”
” ও আচ্ছা। তোর স্যার ব্যাচেলর থাকে মানে কি একা থাকে? আহারে! তাহলে রান্না-বান্না কে করে?”
” আমি কিভাবে জানব? একদিন স্যারের বাড়িতে গিয়ে দেখে আসি রান্না-বান্না কে করে.. তারপর তোমাকে জানাই?”
” একা বাড়িতে তুই যাবি কেন? খবরদার!”
আমি হাসলাম,” সত্যি সত্যিই তো আর যাব না। মজা করে বললাম।”
মায়ের কপালে সুক্ষ্ম চিন্তার ভাজ পড়ল। ঈশানের বাড়িতে রান্না-বান্না কে করে তাই নিয়ে মা গভীর দুশ্চিন্তায় ডুবে গেল। একটু পর মা বলল,” আচ্ছা তারু, আমাদের ছাদের ওই চিলেকোঠার ঘরটা তো খালি পড়ে আছে। তোর স্যারকে ওখানে থাকতে দিলে কেমন হয়? তুই জিজ্ঞেস করিস তো ভাড়া নিবে নাকি?”
আমি রেগেমেগে বললাম,” কি উল্টা-পাল্টা কথা বলছ? উনি নিজের বাসা ছেড়ে আমাদের চিলেকোঠার মতো ভাঙা ঘরে থাকতে যাবে কেন?”
মা কোমল স্বরে বলল,” ভাঙা ঘরে কেন থাকবে? তারিফ তো ঘরটা মেরামতের কথা ভাবছেই। আর দেয়ালগুলো রঙ করা হলে আরও নতুন হয়ে যাবে ঘর। তখন তো ভাড়া দেওয়াই যায়। তাছাড়া তোর স্যারের কাছে ভাড়া দিলে লাভ আছে। তোর পড়াশুনাতেও সুবিধা হয়ে গেল। আর তারও খাওয়া-দাওয়ায় সমস্যা হবে না। আমাদের সাথে খাবে।”
বাহ, আমার জননীর মাথার বুদ্ধি দেখে ইচ্ছে করল মোটা বইটা দিয়ে কিছুক্ষণ নিজের মাথায় মারি। কোন দুঃখে যে বলতে গিয়েছিলাম ঈশান ব্যাচেলর!এখন মায়ের মাথায় নতুন ভূত চড়েছে। ওই রাজপুত্র নাকি তার রাজমহল ছেড়ে আমাদের ছোট্ট কুটিরে ভাড়া থাকতে আসবে! জোকস অফ দ্যা ইয়ার।আমার ভেবেই হাসি পেল। মা বলল,” কিরে?বুদ্ধিটা কেমন?”
আমি হেসে বললাম,” খুব দারুণ বুদ্ধি মা। তোমার বুদ্ধি বুদ্ধি খেলা শেষ হলে এবার আমাকে একটু পড়তে দাও?”
এমন সময় পানের বাটা নিয়ে ঘরে ঢুকল বুড়ি। দেখে মনে হচ্ছে আমাদের কথা এতোক্ষণ সব আড়ি পেতে শুনছিল। বুড়ির এই স্বভাবটা অত্যন্ত বাজে। কান পেতে সব কথা শুনবে। বুড়ি আমার বিছানায় আয়েশ করে বসতে বসতে বলল, ” ঘর ভাড়া দেওনের দরকার কি? মাষ্টরের লগে আমগো তারুরে বিয়া দিয়া দিলেই তো হয়। তাইলে মাষ্টরের বেতনও দেওন লাগব না। ফিরি পড়াইবো। মাষ্টরও হইল, ভাড়াইট্টাও হইল, আবার ঘরজামাইও হইল। ঘরের মাইয়া, ঘরেই থাকল।”
বুড়ির কথা শুনে আমার কান ঝাঁ ঝাঁ করতে লাগল। কুচুটে বুড়ির মাথায় সব কুচক্রী মার্কা বুদ্ধি। মাকে দেখলাম হাসছে। আমি অবাক হয়ে বললাম,” ছিঃ এসব তোমরা কি বলছ? উনি আমার স্যার হয়। আমার গুরুজন। উনাকে আমি কিভাবে বিয়ে করব?”
” স্যারের লগে বিয়া নিষিদ্ধ নাকি? ওইদিন খবরে দেখলাম গাইবান্দার এক ছেড়ি মাষ্টরের লগে ভাগছে। বিয়াও হইছে। ”
” সেই মেয়ে ভেগেছে বলে কি আমাকেও ভাগতে হবে? আমি কি বাজে মেয়ে?”
” তোরে তো ভাগতে কেউ কয় নাই। তুই খালি বিয়া করবি।”
আমি বুড়ির ভাষাতে বললাম,” না। আমি বিয়া করতাম না!”
” দেখা যাইব। শুনো আয়েশা, মাষ্টররে ঘরে ডাকো। তার যদি তোমার মাইয়ারে পছন্দ হয় তাইলে আলাপ সালাপ কইরা কথা আগাও। না পারলে আমারে কইও। আমি ব্যবস্তা করুম। পোলাডা ভালা আছে। এক্কেরে চান্দের টুকরা।”
” এতোই যদি চান্দের টুকরা হয় তাহলে তুমিই বিয়ে করে ফেলো।”
” হেই বয়স কি আর আছে?”
” বয়স থাকলে বুঝি বিয়ে করতে?”
” ভাইবা দেখতাম।”
আমি মনে মনে বললাম,” ছিঃ, ছি, নির্লজ্জ বুড়ি!”
আমাদের কথোপকথন শুনে মা খুব জোরে হাসতে লাগলেন।আমি ক্ষেপে ঘর থেকে বের হয়ে গেলাম।
ভাইয়া কিছুদিনের জন্য ঢাকার বাইরে আছে। ঘনিষ্ট এক বন্ধুর মা মারা গেছে। চারদিন শেষ না করে আসতে পারছে না। আমি বেজায় খুশি। ভাইয়া বাড়িতে না থাকলেই নিজেকে মুক্ত পাখি মনে হয়। আগামীকাল নিহার জন্মদিন। আমি ঠিক করেছি আজরাত বারোটায় গিয়ে নিহাকে সারপ্রাইজ দিব। আমাকে এতোরাতে দেখলে নিহার পিলে চমকে উঠবে। নিজের হাতে কেক বানালাম। বুড়ি রাত দশটার মধ্যে ঘুমিয়ে পড়ে। তাই মাকে শুধু রাজি করাতে হলো। মা অল্পতেই কনভিন্স হয়ে যায়। আমাকে খুব বেশি কষ্ট করতে হলো না।
রাত এগারোটা পঞ্চান্ন। আমি নিহাদের বাড়ির মূল ফটকে দাঁড়িয়ে আছি। গেইট বন্ধ। দারোয়ান শুয়ে পড়েছে। আমি নিহাকে ফোন করতে বাধ্য হলাম৷ এতোরাতে জেগে আছে কি-না কে জানে? প্রথম রিং-এই ফোন ধরল নিহা। অর্থাৎ সে জেগেই ছিল। আমি বললাম, ” একবার বারান্দায় আয়।”
নিহা বিস্মিত হয়ে বলল,” বারান্দায় কেন? তুই কি বাড়ির সামনে?”
” এসেই দ্যাখ!”
নিহা বারান্দায় আসতেই আমি হাত নেড়ে বললাম,” হ্যাপি বার্থডে!”
নিহা প্রচন্ড জোরে একটা চিৎকার দিল। আমি সাবধানী কণ্ঠে বললাম,” আরে কি করছিস? পুরো পাড়া জাগাবি নাকি?”
” তুই এক মিনিট দাঁড়া।”
নিহা দ্রুত নিচে নেমে এলো। গেইট খুলে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে বলল,” থ্যাঙ্কিউ দোস্ত। আমি ভাবতেও পারিনি তুই এতোরাতে চলে আসবি। বাড়িতে ম্যানেজ কিভাবে করলি?”
” তোর জন্য সব করতে পারি।”
” সত্যি? আমার এখনও বিশ্বাস হচ্ছে না।”
আমি নিহার ডানগালে জোরে চিমটি কাটলাম। নিহা হাসতে হাসতে বলল,” খুব ভালো সময় এসেছিস। আমাদের বাড়িতে তো পার্টি হচ্ছে৷”
” পার্টি মানে? তোর বার্থডের পার্টি?”
” হ্যাঁ। সারপ্রাইজ পার্টি। সব কাজিনরা একসাথে এসে আমাকে সারপ্রাইজ দিয়েছে। আর এখন তুইও এসে পড়লি। এবারের বার্থডেটা সবচেয়ে স্পেশাল। কাল সাফিনও আসবে।”
নিহার গালে লাজুক আভা দেখা যাচ্ছে। আমি বললাম,” বাহ, দারুণ তো! আচ্ছা, ঈশান ভাইয়াও কি এসেছে?”
” না। ঈশান ভাইয়া এই রাতের বেলা আসবে? তাও আমাকে সারপ্রাইজ দিতে? অসম্ভব! তার কাছে ঘুম অনেক ইম্পোর্ট্যান্ট।”
আমি বুকে হাত রেখে বললাম,” উফ, বাঁচলাম।”
নিহা হেসে বলল,” তবে কাল আসতে পারে।”
” তাহলে সকাল হতেই আমি চলে যাব।”
নিহা খিকখিক করে হাসল,” সবাই সকাল পর্যন্ত থাকতে চাইছে ঈশান ভাইয়া আসবে বলে। আর তুই কি-না চলে যেতে চাইছিস? তুই উনাকে এতো অপছন্দ করিস কেন?”
” জানি না।”
রাতে সবাই খুব মজা করলাম। হাসি-আনন্দে কেটে গেল সময়। ঘুমাতে গেলাম রাত দুইটা বাজে। আমি আর নিহা একই ঘরে শুলাম। বাকিরা শুলো গেস্টরুমে। নিহা সারারাত জেগে সাফিন ভাইয়ার সাথে ফোনে কথা বলল। তার কথার যন্ত্রণায় আমি ঘুমাতেই পারলাম না। ফজরের আযান পর্যন্ত জেগে রইলাম। তারপর ঘুমালাম। সেই ঘুম ভাঙল সকাল এগারোটায়। আমি হাই তুলে আড়মোড়া ভাঙলাম। পাশ থেকে একজন বলল,” গুড মর্ণিং।”
আমি ঘুম জড়ানো কণ্ঠে জবাব দিলাম,” গুড মর্ণিং..”
মানুষটি জিজ্ঞেস করল,” চা না কফি?”
আমি একটু ভেবে বললাম,” কফি!”
তারপর কিছুক্ষণ কাপে চামচ নাড়ার শব্দ পেলাম। পাশ ফিরে মানুষটিকে দেখতেও আমার আলসেমি লাগছে। একটু পর মানুষটি বলল,” তোমার কফি।”
আমি কফি নিয়ে চুমুক দিলাম। মনে হলো যেন অমৃত খাচ্ছি।
” চিনি ঠিকাছে?”
আমি বিরবির করে বললাম,” একদম পারফেক্ট। থ্যাংকিউ!”
এতোক্ষণ পর পাশ ফিরে তাকালাম আর ঈশানকে দেখেই ভীষণ জোরে চিৎকার করে উঠলাম। আমার হাত থেকে কফির কাপ পড়ে ভেঙে গেল। বিছানার চাদর নোংরা হয়ে গেল। নিহা দৌড়ে এসে বলল,
” তারু কি হয়েছে? দুঃস্বপ্ন দেখেছিস নাকি?”
দরজার কাছে দেখলাম নিরা আর সামিয়াও দাঁড়িয়ে আছে। তারাও অবাক দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমি আমতা-আমতা করে বললাম,” ঈশান ভাইয়া এসেছিল।”
” হোয়াট?”
” হ্যাঁ। এইতো, আমাকে কফি দিয়ে গেল।”
আমার কথা শুনে নিরা আর সামিয়া হাসতে শুরু করল। নিহা আমার মাথায় গাট্টা মেরে বলল,” তুই পাগল হয়ে যাচ্ছিস তারু। ঈশান ভাইয়া আমার বেডরুমে আসবে তাও তোকে কফি দিতে? হাস্যকর! ”
” আমি সত্যি বলছি। নাহলে আমার কাছে কফির কাপ কিভাবে এলো?”
সামিয়া বলল,” কফির কাপটা তো সাইড টেবিলেই ছিল। ঘুম থেকে উঠে হয়তো তুমি নিজেই নিয়েছো।”
আমি উত্তপ্ত কণ্ঠে বললাম,” আমি নিজে কেন নেব? কেউ আমাকে দিয়েছে। আর সে ঈশান। তোমাদের কি মনে হয় আমি মিথ্যা বলছি?”
নিহা বলল,” না। তুই মিথ্যা বলছিস না৷ তুই হয়তো স্বপ্ন দেখেছিস।”
” আমার ঘুমের মধ্যে কথা বলার অভ্যাস নেই নিহা। কফি খাওয়ারও অভ্যাস নেই। যখন আমি কফিতে চুমুক দিলাম তখন ঈশান ভাইয়া আমাকে জিজ্ঞেস করল, চিনি ঠিকাছে কি-না। সেটাও কি তাহলে স্বপ্নে ঘটেছে?”
আমার কথায় আবার হাসতে লাগল সবাই। নিহা হাসতে হাসতেই বলল,” এটা তোর হ্যালুসিনেশন।”
আমার অতিরিক্ত রাগে কান্না পেয়ে যাচ্ছে। কল্পনা এতো বাস্তব কিভাবে হয়? তাদের কিছুতেই বিশ্বাস করানো গেল না যে ঈশান সত্যিই এসেছিল!
ব্রেকফাস্ট করতে সবাই ছাদে গেলাম। সেখানে টেবিল সাজানো হয়েছে। রাতে অনুষ্ঠান হবে৷ সাফিন ভাইয়ার সাথে দেখা হল। তার পাশে ঈশানও ছিল। তাই আমি আর সেদিকে গেলাম না। পাশ কাটিয়ে চলে আসতে চাইলাম। কিন্তু সাফিন ভাইয়া আমায় দেখে ফেললেন। সাথে সাথে ডেকে জিজ্ঞেস করলেন,” আরে তারিন, কি খবর?”
” এইতো ভাইয়া। ভালো। আপনি কেমন আছেন?”
” আমিও খুবই ভালো। তোমার ঘড়িওয়ালার কি অবস্থা? শুনলাম তোমাকে নাকি চিঠিও লিখেছে?”
আমি লজ্জা পেয়ে বললাম,” এসব আপনাকে নিহা বলেছে তাই না? ওর পেটে একটা কথাও থাকে না।”
” সাবধানে থেকো। যদি পরিচিত কেউ হয় তাহলে সে কিন্তু আজকেও আসবে।”
আমি আঁড়চোখে ঈশানের দিকে চেয়ে বললাম,” আসুক। চোরের দশদিন হলেও গৃহস্থের একদিন। খুব শীঘ্রই দেখবেন ধরা পড়ে গেছে।”
সাফিন ভাইয়া হেসে ফেললেন। আমি টেবিলে এসে বসলাম। এখনও টেবিলে কেউ আসেনি। আমি একাই বসে মোবাইল ঘাটছি। পেছন থেকে হঠাৎ কেউ বলল,” তুমি কি চাও আমি ধরা পড়ি?”
আমি পেছনে তাকিয়ে দেখলাম ঈশান ঠিক দ্বিতীয় টেবিলের প্রথম চেয়ারে বসে আছে। একদম আমার পিঠের কাছে। তবে দুইজন দুইদিকে মুখ করে আছি। দূর থেকে কেউ দেখলে বুঝবেই না যে আমরা কথা বলছি। আমি বললাম,” নিশ্চয়ই চাই৷ আপনার এই খেলা আমার ভালো লাগছে না।”
” আমি কখন খেললাম? খেলছ তো তুমি আমাকে নিয়ে।”
” আমি খেলছি মানে? আমি কি করেছি আপনাকে?”
” করেছ। আমার খুব বড়-সড় ক্ষতি করেছ। এই ক্ষতি পূরণ করতে গেলে সারাজীবন লেগে যাবে তোমার।”
” আপনার ধাঁধার মতো কথা বোঝার মতো জ্ঞান আমার নেই।”
” এটাই তো প্রবলেম। তুমি অবুঝ।”
” আমি অবুঝ না। আপনি কৌশলী। সকালে কি করলেন এটা?”
” কি করলাম?”
” আমাকে কফি দিতে এসে পালিয়ে গেলেন কেন?”
” তুমি চিৎকার করলে কেন?”
” আমি তো ভয়ে চিৎকার করেছি।”
” আমিও ভয়ে পালিয়েছি। ওই অবস্থায় কেউ রুমে ঢুকে আমাকে দেখলে তো গণপিটুনি খেতাম।”
আমি হেসে বললাম,” সেটাই ভালো হতো।”
” আমাকে মার খেতে দেখার এতো শখ তোমার?”
” হ্যাঁ। খুব শখ।”
এই পর্যায় নিহা আর সাফিন ভাইয়া চলে এলো। ঈশান তাদের দেখেই নিশ্চুপ হয়ে গেল। একটু পরেই টেবিল ভরে গেল মানুষে। চারদিকে হৈচৈ। ঈশান আর আমার মাঝে নীরবতা। তবে হঠাৎ লক্ষ্য করলাম, ঈশান তার পা দিয়ে আমার পায়ে খোঁচা মারছে। আমি রেগে বললাম,” হোয়াটস রং উইদ ইউ?”
ঈশান কোমল কণ্ঠে বলল,” স্যরি।”
সবাই নিজেদের কাজে ব্যস্ত। আমাদের কথা কেউ শুনছে না। পাঁচমিনিট পর ঈশান আবারও একই কাজ করল। আমি দ্বিগুণ তেজে বললাম,” আপনি আরেকবার এমন করলে কিন্তু আমি উঠে চলে যাব।”
” আহা, স্যরি। আমি ইচ্ছে করে দিচ্ছি না।”
” তাহলে কি আপনার পা অটোমেটিক আমার পায়ের কাছে চলে আসছে?”
” হয়তো।”
” একদম ফাজলামি করবেন না। আপনি এই নিয়ে দুইবার খোঁচা দিয়েছেন।”
” স্যরিও তো দুইবারই বলেছি।”
” শুধু স্যরি বললেই কি প্রবলেম সোলভ হয়ে যায়?”
” তাহলে কি কিস করতে হবে?”
” নির্লজ্জ!”
ঈশানের শেষ কথাটা নিরা শুনে ফেলল। সাথে সাথেই বোম ব্লাস্টের মতো উচ্চস্বরে বলে উঠল,” এখানে কে কাকে কিস করছে?”
আমি আর ঈশান একসাথে বিষম খেলাম।#তি_আমো(রিপোস্ট)
পর্ব ৮
লিখা- Sidratul Muntaz
ছাদে সামিয়ানা টানিয়ে জন্মদিনের অনুষ্ঠানের আয়োজন হয়েছিল। শ’খানেক বেলুন ফুলানো হয়েছিল। ব্যান্ড পার্টি ভাড়া হয়েছিল। কিন্তু বৃষ্টিটা এসে সবকিছু ভেস্তে দিল। নিহা মনখারাপ করে বসে আছে৷ সাফিন ভাইয়া হাঁটু গেঁড়ে তারই সামনে, হাতটা শক্ত করে ধরে বসা। নিহা কাঁদতে কাঁদতে চোখ মুছে বলল,”একসাথে কাপল ডান্স করব ভেবেছিলাম, কিচ্ছু হলো না। আজকেই কেন বৃষ্টিটা হতে হলো?”
সাফিন ভাইয়া সান্ত্বনার সুরে বললেন,” বৃষ্টি হয়েছে ভালো হয়েছে। চলো তুমি আর আমি একসাথে বৃষ্টিতে ভিজি।”
” অসম্ভব! আমার মেকাপ নষ্ট হয়ে যাবে।”
” তুমি মেকাপ ছাড়াই অনেক সুন্দর জান!”
” এসব বলে কি আমাকে কনভিন্স করতে চাইছ?”
” এছাড়া আর কি করব? তোমার জন্য তো বৃষ্টি থামাতে পারি না!”
” কেমন প্রেমিক তুমি? যদি আমার জন্য বৃষ্টিই থামাতে না পারো?”
” অ্যাঁ! কি বলছ এসব?”
আমি হাসতে হাসতে বারান্দায় এলাম। মুষলধারে বৃষ্টি পড়ছে। স্নিগ্ধ দেখাচ্ছে প্রকৃতি। অল্প অল্প পানির ঝাপটা আমার নাক-মুখ ভিজিয়ে দিচ্ছে। বেশ লাগছে! মাঝে মাঝে ব্যতিক্রম কিছু হলে ভালোই লাগে। হঠাৎ কেউ এসে দাঁড়ালো আমার পাশে। আমি প্রথমে ভাবলাম ঈশান। তাই ইচ্ছে করেই তাকাচ্ছিলাম না। তারপর সে কথা বলল,” এখানে কি করছ তারিন?”
আমি চেয়ে দেখলাম ফাহিম ভাইয়া। নিহার চাচাতো ভাই হয় সে। এই বাড়িতে অনেক আসা-যাওয়ার সুবাদে তার সাথে আমার মোটামুটি পরিচয় আছে। কিন্তু সেভাবে কথা হয়নি কখনও। আমি মুচকি হেসে বললাম,” বৃষ্টি দেখছি ভাইয়া। কি আর করব?”
” নিহার কপালটাই খারাপ। আজকের মতো ঝকঝকে দিনে বৃষ্টি হবে এটা আমরা চিন্তাই করিনি।”
” আমার কিন্তু ভালোই লাগছে। বৃষ্টিটা আলাদা উৎসবের মতো। তাছাড়া ব্যান্ড পার্টির ভ্যাজর ভ্যাজর শোনার চেয়ে বৃষ্টির এই ঝমঝমে শব্দ শোনা অনেক ভালো। ”
” নিহার সামনে এই কথা বলতে যেও না আবার। সে ভাববে তার অনুষ্ঠান নষ্ট হওয়ায় তুমি খুশি হয়েছ।”
আমি খিলখিল করে হাসলাম। ফাহিম ভাই বলল,” গান শুনবে?”
” আপনি গান জানেন?”
” অতটা ভালো না। আমি তো মিউজিক প্লেয়ারে গান ছাড়ার কথা বলছিলাম।”
” না। মিউজিক আমার ভালো লাগে না। মাথা ধরে যায়। তবে খালি গলায় গান শুনতে আপত্তি নেই।”
ফাহিম ভাইয়া ঠোঁট টিপে হাসল। কিছু একটা ভেবে বলল,” তোমার জন্য চেষ্টা করে দেখতে পারি। ভালো না লাগলে বলে দিও।”
আমি হেসে বললাম,” আচ্ছা।”
ফাহিম ভাই গান শুরু করল। আমার প্রিয় গান,” খামোশিয়া।” মন দিয়ে শুনছিলাম। বেশ ভালোই গলা তার। এমন সময় সাফিন ভাইয়া ছুটে এলেন। হন্তদন্ত হয়ে বললেন,” ফাহিম এদিকে আয় ভাই, কথা শোন।”
” কি হয়েছে?”
” গ্যারেজে ঈশানের গাড়িতে একটা গিফট প্যাকেট আছে। নিহার বার্থডের জন্য এনেছিলাম। প্ল্যান ছিল অনুষ্ঠান শেষ হলে সবার সামনে সারপ্রাইজ দিব। কিন্তু সেটা তো আর হলো না৷ তাই ভাবছি এখনি দিব। তুই শুধু গ্যারেজ থেকে জিনিসটা নিয়ে আসবি।”
ফাহিম ভাই চোখ-মুখ কুচকে বলল,” গ্যারেজ যেতে হলে এখন বাগান পেরিয়ে ওইসাইডে যেতে হবে। আমার সাদা পাঞ্জাবী৷ কাঁদা লাগলে মহা সমস্যা। আমি পারব না। তুমি কোনো কাজের লোককে পাঠাও। ”
” কাজের লোক পাঠানো যাবে না। ঈশানের গাড়িতে অনেক দামী জিনিস থাকে। আমি কি কাজের লোকের হাতে গাড়ির চাবি দিয়ে দিব? আর সে কি তালা খুলে আনতে পারবে? তাছাড়া ঈশানকেও কোথাও পাচ্ছি না। সে থাকলে তো সমস্যাই ছিল না।”
আমি এগিয়ে এসে বললাম,” সমস্যা নেই। আমাকে দিন। আমি নিয়ে আসছি।”
সাফিন ভাই দ্বিধান্বিত স্বরে বললেন,” তুমি মেয়ে মানুষ। এতোদূর যাওয়ার দরকার নেই।”
” নো প্রবলেম। আমার এমনিতেও বাইরে যেতে ইচ্ছে করছে। এই বাহানায় একটু বৃষ্টিতে ভেজা হবে!”
আমার কথায় সাফিন ভাই হেসে দিলেন। পকেট থেকে চাবি বের করে বললেন,” সাবধানে যেও। আর্চিসের লাল একটা প্যাকেট পাবে। সেটাই আনবে। আর গাড়ির রং রয়্যাল ব্লু। এই রঙের একটাই গাড়ি আছে।”
” ওকে।”
ফাহিম ভাইয়া বলল,” আচ্ছা আমিও যাই ওর সাথে?”
সাফিন ভাইয়া নিচের ঠোঁট কামড়ে ধমকের সুরে বললেন,” এখন তোর সাদা পাঞ্জাবীতে কাঁদা লাগবে না?”
” কাঁদা লাগলে ধুঁয়ে নিব! নো প্রবলেম।”
” এখন নো প্রবলেম? আর একা যাওয়ার সময় তো খুব প্রবলেম হচ্ছিল!”
আমি হেসে দিলাম। ফাহিম ভাইয়া আমার সাথেই এলো। কিন্তু শেষমেষ সে বের হতে পারল না। রুবা আন্টি মানে নিহার মা ফাহিম ভাইকে অন্যকাজে লাগিয়ে দিলেন। আমি একাই ছুটলাম গ্যারেজের দিকে। দারোয়ান তখন গ্যারেজের গেইট বন্ধ করে দিচ্ছে। কারণ বৃষ্টি হচ্ছিল। সে নিজের ঘরে ফিরে যাবে। আমি বললাম,” মামা দাঁড়ান, গেইট বন্ধ করবেন না। আমি গাড়ি থেকে একটা জিনিস নিব।”
দারোয়ান মামা বলল,” আমি টয়লেটে যাচ্ছি আপামণি। আপনার কাছে চাবি দিয়ে গেলাম৷ কাজ শেষ করে তালা লাগায় দিয়েন।”
” কিন্তু আমি যদি লাগাতে না পারি?”
” তাহলে চেয়ারের এইখানে চাবি রাইখা দিয়েন।”
দারোয়ান এই কথা বলেই তাড়াহুড়ো করে চলে গেল। আমি কথাটা পুরোপুরি বুঝলাম না। চাবিটা কি চেয়ারে রেখে দিলেই হবে? তাহলে হাতে নিয়ে ঘোরার দরকার কি? আমি চেয়ারে চাবি রেখেই গ্যারেজে ঢুকে গেলাম। ঘুটঘুটে অন্ধকার চারদিকে। নিজের বোকামির কথা স্মরণ করে নিজের উপরেই বিরক্ত হলাম। মোবাইলটা সাথে থাকলে ভালো হতো। অন্ধকারে তেমন কিছু দেখতেই পাচ্ছি না। আরচিসের লাল প্যাকেট কিভাবে খুঁজব? আর ঈশানের গাড়ি কোনটা? এতোবড় গ্যারেজে প্রায় বিশের অধিক গাড়ি দেখা যাচ্ছে। কিভাবে বুঝব কোনটা রয়্যাল ব্লু? আমি হাঁটছি তো হাঁটছি! মনে হচ্ছে ফাঁকা মাঠে হারিয়ে গেছি। একটা গাড়ির দরজা খোলা ছিল৷ আমি ধাক্কা খেয়ে পড়ে গেলাম৷ শব্দ শুনে কেউ একজন বলল,” কে ওখানে?”
আমি ভয়ে চিৎকার দিয়ে উঠলাম। আমি ছাড়া এখানে দ্বিতীয় কেউ থাকার কথা নয়। তাহলে কথা কে বলছে? হঠাৎ একটা আলোর রশ্মি আমার চোখে লাগল। আমি তখনও মেঝেতে পড়ে আছি। দুইহাতে চোখ ঢাকলাম। কণ্ঠস্বরটি বিস্মিত সুরে বলল,” তারিন! এখানে কি করছ?”
আমি ঈশানের কণ্ঠ শুনে ভড়কে গেলাম। অবাক হয়ে বললাম,” আপনি এখানে কি করছেন?”
ঈশান মোবাইলের ফ্ল্যাশলাইট নিয়ে এগিয়ে এলো। আমার কাছে এসে হাঁটু গেঁড়ে বসল, ” ওঠো।”
আমি ঈশানের হাত ধরে উঠে দাঁড়ালাম। ঈশান পুনরায় প্রশ্ন করল,” এখানে কেন এসেছ?”
তার কণ্ঠস্বর কিছুটা ভারী শোনাচ্ছে। আমি বললাম,” সাফিন ভাইয়া আমাকে পাঠিয়েছে। আপনার গাড়িতে একটা জিনিস ছিল। সেটা নেওয়ার জন্য৷ এইতো চাবি।”
” সাফিন তোমাকে পাঠিয়েছে এই বৃষ্টির মধ্যে? আর কেউ ছিল না?”
” আমি নিজেই এসেছি। কেন? আপনার কোনো সমস্যা?”
” না। আমার কি সমস্যা থাকবে?”
” আপনি এই অন্ধকারে ভূতের মতো এখানে বসে আছেন কেন? কি করছিলেন?”
” দ্যাটস নান অফ ইউর বিজনেস। তুমি যেটার জন্য এসেছিলে সেটা নিয়ে চলে যাও।”
আমার মেজাজ খারাপ হলো। আশ্চর্য মানুষ তো! নিজে সারাক্ষণ ছ্যাঁচড়ামি করে বেড়ায় আর এখন ভাব ধরা হচ্ছে। আমিও কিছু বললাম না। গাড়ি থেকে লাল রঙের প্যাকেটটা খুঁজে নিলাম। ঈশান বলল,” পেয়েছ?”
” হ্যাঁ। এইতো।”
” ঠিকাছে। যাও এখন।”
” আচ্ছা, একটা কথা..”
” কি?”
” গাড়ির চাবি তো আমার কাছে। তাহলে আপনি কিভাবে লক খুললেন?”
” ডুপ্লিকেট চাবি ছিল। আর কোনো প্রশ্ন?”
” না।”
আমি চলে এলাম। মনে মনে ঈশানকে জঘন্য কয়টা গালি দিলাম। অসভ্য লোক! এতো ভাব দেখাচ্ছে কেন হঠাৎ? খুব অবাক হলাম। ঈশানের এই স্বভাব বিরুদ্ধ আচরণটা যেন আমি মেনে নিতে পারছি না। সে আগে যেমন ছিল, ঠাট্টা-মশকরা করতো, তেমন ভাবেই তাকে মানাতো। এখন এই গম্ভীর ঈশানকে আমার একদম ভালো লাগছে না। নাকি আমি ট্রিগারড হয়ে যাচ্ছি? ঈশান আগের মতো আমার পেছনে লাগছে না বলে! সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতে দরজার কাছে এলাম। কিন্তু হায়! দরজা বন্ধ! বন্ধ কি করে হলো?
আমি দুই হাতের সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে দরজা ধাক্কাতে লাগলাম। চিৎকার করে বললাম,” কেউ আছেন? প্লিজ দরজাটা খুলুন!”
গ্যারেজ রুমটা এতো বিশাল যে আমার চিৎকার প্রতিধ্বনিত হয়ে আবার আমার কানেই ফিরে এলো। আমি আরও জোরে চিৎকার করতে লাগলাম। নিশ্চয়ই দারোয়ান মামার কাজ এটা। তিনি চেয়ারে চাবি দেখে ভেবেছেন আমি চলে গেছি৷ তাই তিনিও গেইট আটকে ঘরে গিয়ে বসে আছেন। আর এই বৃষ্টির মধ্যে কেউ বাগানের এই পাশে আসবেও না। অর্থাৎ আমার চিৎকার শোনার কেউ নেই! এই কথা ভেবে ভয়ে আরও জোরে চিৎকার করতে লাগলাম। ঈশান ছুটে এসে বলল,” প্রবলেম কি তোমার? এমন করছ কেন?”
আমি অসহায় সুরে বললাম,” গেইট.. লক।”
” চিৎকার করলে কি গেইট খুলে যাবে?”
” না। আপনি আপনার ফোনটা দিয়ে কাউকে কল করে আসতে বলুন না প্লিজ। এই অন্ধকারে আমার দম আটকে আসছে।”
ঈশান গম্ভীরমুখে বলল,” গ্যারেজরুমে নেটওয়ার্ক নেই। ফোন করা সম্ভব না।”
আমি আতঙ্কে অস্থির হয়ে বললাম,” তাহলে কি করব?”
” অপেক্ষা করো।”
” কিন্তু কতক্ষণ অপেক্ষা করব?”
” জানি না।”
আমি আবার চিৎকার শুরু করলাম। ঈশান হঠাৎ আমার মুখ চেপে ধরল। আমার নিশ্বাস আটকে এলো। ঈশান থমথমে কণ্ঠে বলল,” প্লিজ তারিন, অন্তত কিছুক্ষণের জন্য চুপ করে থাকো। আমার মাথা ধরেছে। প্লিজ! পায়ে পড়ি তোমার।”
আমি চুপ করে মেঝেতে বসে পড়লাম। ঈশান দেয়ালের সাথে পিঠ লাগিয়ে দাঁড়িয়ে রইল। মাথাটা ফাঁকা ফাঁকা লাগছে আমার। কিভাবে এখান থেকে বের হবো? কতক্ষণ আটকে থাকতে হবে? গরমে, অন্ধকারে ঘেমে-নেয়ে একাকার হয়ে যাচ্ছি। অথচ ঈশান কি নির্বিকার! যেন কোনো রোবট দাঁড়িয়ে আছে আমার সামনে। কিছুক্ষণ এভাবেই কেটে গেল। সহসা একটি অদ্ভুত শব্দে আমি কেঁপে উঠলাম। ভারী একটা জিনিস আমার কোলের উপর দিয়ে লাফিয়ে গেল। আমি দেখলাম ইঁদুর। ভুবন কাঁপানো চিৎকার দিয়ে উঠে দাঁড়ালাম। ছুটে গিয়ে জড়িয়ে ধরলাম ঈশানের গলা। আমার শরীরের ধাক্কায় ঈশান দুই কদম পিছিয়ে গেল৷ তার পিঠ মিশে গেল দেয়ালে। আমি চোখমুখ খিচে প্রাণপণে বলতে লাগলাম,” ইঁদুর, আমাকে বাঁচান। ইঁদুর!”
ঈশান কোনো কথা বলল না। একটা শব্দ পর্যন্ত না। আমি তাকে ওভাবেই কয়েক মুহূর্ত জড়িয়ে ধরে থাকলাম। একটু পর আমার ভয় কাটলে আমি তাকে ছেড়ে তার মুখের দিকে তাকালাম। সে শান্ত সুরে বলল,” গাড়িতে গিয়ে বসো। ইঁদুর আসবে না।”
আমি সংকুচিত কণ্ঠে বললাম,” ভয় লাগছে।”
ঈশান আমার হাত ধরে আমাকে গাড়িতে নিয়ে এলো। দু’জন ভেতরে ঢুকে বসলাম। ঈশান গাড়ির লাইট জ্বালিয়ে দিল। এসি ছাড়ল। আমি প্রাণ ভরে শ্বাস নিলাম। এখন কিছুটা ভালো লাগছে। গাড়ির সাথে মাথা হেলিয়ে নিজেকে ধাতস্থ করলাম। নিজের কাজের জন্য নিজেরই লজ্জা লাগছে। অথচ ঈশান কিছুই বলল না। অদ্ভুত! জড়পদার্থের মতো সে গুম মেরে বসে আছে এখনও। আমি তার কাঁধে হাত রেখে প্রশ্ন করলাম,” আপনার কি হয়েছে?”
ঈশান বিরস কণ্ঠে পাল্টা প্রশ্ন করল,” শুনে কি করবে?”
” কিছু তো করতে পারব না। অন্তত টাইমটা পাস হবে।”
ঈশান মুচকি হাসল। আমি অনুরোধ করলাম,” বলুন প্লিজ!”
ঈশান বিষাদসিক্ত কণ্ঠে জানাল,” আমার বাবা-মায়ের ডিভোর্স হয়ে যাচ্ছে তারিন!”
আমি খুব অবাক হয়ে তাকালাম।
চলবে