#তি_আমো
পর্ব ২২
লিখা- Sidratul Muntaz
নিহার বেডরুমের সামনের ঘরটায় গোল হয়ে বসে আছি আমরা, মানে মেয়েরা। সবাই গল্পে মশগুল থাকলেও আমি নিশ্চুপ। আমাকে নিয়ে কারো তেম মাথাব্যথাও নেই এখানে। নিজেকে বিচ্ছিন্ন কোনো বস্তু মনে হচ্ছে। কারো সাথে কথা বলতেও মন চাইছে না। তবে নিহা থাকলে এভাবে মনখারাপ করে থাকতে হতো না আমাকে। ঠিকই আমার মনোরঞ্জনের চেষ্টায় নানান কান্ড করতো সে। কিন্তু আজ নিহা বড্ড ব্যস্ত। আজ সে বিয়ের কনে।
প্রায় ঘণ্টা দুয়েক আগে নিহাকে মেকআপ করানোর জন্য পার্লার থেকে মেয়েরা এসেছে। তারা এখনও মেকাপ করেই যাচ্ছে। কি এতো সাজাচ্ছে কে জানে? আমার খুব অসহ্য লাগছে। তার উপর আশেপাশের মেয়েদের ঘ্যানঘ্যানানি আমার বিরক্তির মাত্রা তীব্র করে তুলছে। এর প্রধান কারণ সামিয়া। সে আমার মাথা অর্ধেক খেয়ে নিচ্ছে। ঈশানের কথা আমি ভুলে থাকতে চাইলেও এই মেয়েটার জন্য একদমই পারছি না।
সামিয়া প্রত্যেকটা বাক্যে কমপক্ষে তিন থেকে চারবার করে ঈশানের নাম নিচ্ছে। বাকিরা খুব মনোযোগ দিয়ে গিলছে সামিয়ার বকবকানি। ঈশানের সাথে সে চৌদ্দটা সেল্ফি তুলে ইন্সট্রাগ্রামে আপ্লোড করেছে। সেই ছবিগুলোয় আবার ঈশান লভ রিয়েক্টও দিয়েছে। এইসব নিয়েই চলছে আলোচনা।
হঠাৎ মাহাথি ভাইয়ার আগমন ঘটল। উনি সামিরাকে ডাকতে এসেছেন। ঈশান নাকি সামিরাকে খুঁজছে। কথাটা শুনে সামিরার মুখে পূর্ণিমার চাঁদের মতো হাসি ফুটে উঠল। কিন্তু আমার মুখটা অমাবস্যার মতো অন্ধকার হয়ে গেল। অন্যসময় হলে এ নিয়ে আমি মাথা ঘামাতাম না। কিন্তু এখন এই সামান্য বিষয়টাও মানতে কষ্ট হচ্ছে। যেখানে আমি সকাল থেকে যন্ত্রণায় ছটফট করছি, সেখানে ঈশান কিনা সামিয়ার সাথে সময় কাটিয়ে সুযোগের সদ্ব্যবহার করছে! সব ছেলেমানুষ একরকম। আসলেই একরকম। আমার প্রচন্ড রাগ লাগছে।
সামিয়ার মতো একটা কিউট মেয়ে ঈশানের পেছনে ঘুরছে, ঈশান কি তাকে পাত্তা না দিয়ে পারে! শত হলেও পুরুষ মানুষ বলে কথা। নিশ্চয়ই সে খুব আনন্দিত। মনে একেবারে লাড্ডু ফুটছে! এতো এতো সুন্দরীদের ভীড়ে আমার কথা কি আর তার মনে আছে? যাইহোক, এসব ভেবে দুঃখ পাওয়াও বোকামি। সে যখন আমাকে অবহেলা করছে তাহলে আমি কেনো শুধু শুধু তার পেছনে কষ্ট পেয়ে মরব? আমারও উচিৎ তাকে ভুলে থাকা। যেভাবেই হোক, ভুলে থাকা।
নিহার বেডরুমের দরজা এতোক্ষণে খোলা হলো। আমি সুযোগ পেয়েই ঢুকে পড়লাম। কতক্ষণ ধরে নিহার সাথে দেখা হচ্ছে না! মনটা আনচান করছিল। আমি ঘরে ঢুকতেই নিহা সর্বপ্রথম বলল,
“এই তারু, দেখতো আইল্যাশটা ঠিক আছে কি-না? চোখটা কেমন জ্বালাপোড়া করছে।”
আমি নিহার আইল্যাশ ঠিক করে দিতে লাগলাম। মনে মনে একটা বিষয় চিন্তা করছি, নিহাকে কালরাতের ঘটনাটা জানাবো কি-না! আমার জানানোর প্রয়োজন হলো না। নিহা নিজে থেকেই বলল,” তোর কি মনখারাপ? এমন গুম মেরে আছিস কেন?”
আমি সংকোচ কাটিয়ে বলে ফেললাম কাল রাতে যা যা হয়েছিল। কিছুই বাদ দিলাম না। সামিয়ার ব্যাপারটাও খোলাশা করলাম। নিহা হাসতে হাসতে বলল,” তুই কি পাগল? সামিয়া আর ঈশান ভাইয়া? ইম্পসিবল! ”
” তাহলে ঈশান কেন সকাল থেকে সামিয়ার সাথে চিপকে রয়েছে? আমাকে জ্বালানোর জন্য?”
নিহা ভ্রু কুচকে কিছু চিন্তা করে বলল,” না। ঈশান ভাইয়া এতো চীপ কাজ করবে না। তোর উনার সাথে ঝগড়া হয়েছে তো, সেজন্যই এমন মনে হচ্ছে।”
” কিন্তু সামিয়ার বিহেভিয়ার দেখে মনে হচ্ছে ঈশান তার বয়ফ্রেন্ড।”
নিহা কৌতুকপূর্ণ কণ্ঠে বলল,” তুই অনেক বেশি পজেসিভ হয়ে যাচ্ছিস তারু। এতো জেলাস করছিস কেন? মাই গড!”
আমি থতমত খেয়ে বললাম,” জেলাসের কি আছে? চোখের সামনে যা দেখছি তাই তো বলছি।”
” আচ্ছা শোন, যা করেছিস ভালো করেছিস। কালরাতের ঘটনায় তোদের দু’জনেরই ভুল ছিল। তুই ভালোভাবে বুঝিয়ে নিষেধ করতে পারতি। হুট করে চড় মারা ঠিক হয়নি। তবুও তুই তোর ভুলের জন্য ‘স্যরি’ বলে দিয়েছিস। তাহলে তোর দিক থেকে তুই ক্লিয়ার। যদিও তোর জায়গায় আমি হলে জীবনেও ‘স্যরি’ বলতাম না।”
আমি মৃদু হেসে বললাম,” তোর ‘স্যরি’ বলার প্রয়োজনই হতো না। কারণ সাফিন ভাইয়া ঈশানের মতো এগ্রেসিভ না। তিনি খুবই সুইট।”
নিহা সামান্য হেসে বলল,” তা অবশ্য ঠিক বলেছিস।”
আমি নিহার হাত ধরে প্রশ্ন করলাম,” এখন আমার কি করা উচিৎ? ”
” যেভাবে চলছে, চলতে দে। তুইও কিছু বলিস না। দেখবি ঈশান ভাইয়া নিজে থেকেই তোর সাথে কথা বলবে।”
” আমিও তাই ভাবছি৷ উনি নিজে থেকে না এলে আমিও যাব না।”
” ভেরি গুড।”
আমি আবার চিন্তিত হয়ে বললাম,” কিন্তু ঈশানকে নিয়ে সামিয়ার এই ঢংটা আমি সহ্য করতে পারছি না।”
নিহা খিলখিল করে হেসে বলল,” তাহলে তুইও ঢং শুরু কর!”
” মানে?”
” ঈশান ভাইয়া যেমন সামিয়ার সাথে ঢলাঢলি করছে, তেমনি তুইও অন্যকারো সাথে ঢলাঢলি কর। টিট ফর ট্যাট। ”
নিহার বুদ্ধিটা আমার পছন্দ হলো। সবার আগে ফাহিম ভাইয়ের নামটাই মাথায় এলো। ঈশানের সামনে আমি ফাহিম ভাইয়ের হাত ধরে হাঁটছি, আর ঈশান জ্বলে-পুড়ে মরছে। এর চেয়ে মজার দৃশ্য আর কি হতে পারে?
আমি ঈশানের উপহার দেওয়া লাল শাড়িটা নিয়ে এসেছিলাম। সেটাই বের করলাম। এই শাড়ি পরে সুন্দরমতো সেজে-গুজে ঈশানের মাথা ঘুরিয়ে দিতে হবে। তারপর দেখব, কতক্ষণ সে কথা না বলে থাকে।
বাগানে স্টেজ সাজানো হয়েছে। আমি তৈরী হয়ে যখন বের হলাম তখন ঈশান ক্যামেরাম্যানের সাথে গেইটের সিন ভিডিও করার ব্যাপারে আলাপ করছে। কোন এংগেল থেকে ভিডিও করতে হবে, কাদের বেশি ছবি তুলতে হবে, কিভাবে লাইট আসবে, হেনতেন। আমি একদম ঈশানের সামনে দিয়ে যাচ্ছিলাম। আর প্রত্যাশিতভাবেই তার নজর আমার উপর পড়ল। ঈশান ঝড়ের গতিতে ঘাড় ঘুরিয়ে আমার দিকে তাকাল। এমনভাবে তাকাল, যেন কোনো ভূত দেখছে! আমি জানি, যেখানে সব মেয়েরা ভারী লেহেঙ্গা পরে হুলুস্থুল বাঁধিয়েছে সেখানে আমি লাল শাড়ি পরে সাধারণ সাজে বের হবো এটা হয়তো ঈশান কল্পনাও করেনি। আর শাড়িটাও তো তারই দেওয়া! ঈশান আমার দিকে এমনভাবে তাকিয়ে আছে যেন তার দিন-দুনিয়ার কোনো হুশ নেই। ক্যামেরাম্যান কিছু প্রশ্ন করছেন। ঈশান উত্তরও দিচ্ছে না। তার সমস্ত মনোযোগ আমার দিকে। আমি মিষ্টি করে হাসলাম। অতঃপর ঈশানকে চমকে দিয়ে তাকে পাশ কাটিয়েই ফাহিম ভাইয়ের কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম।
” ফাহিম ভাইয়া, কি করছেন?”
ফাহিম ভাইয়া আমাকে দেখে বিস্ফোরিত দৃষ্টিতে বলল,” তারু, ইউ আর লুকিং মারভেলাস! তোমাকে মারাত্মক লাগছে!”
আমি একহাতে চুল কানে গুজে লাজুক কণ্ঠে বললাম,” থ্যাঙ্কিউ। ”
” সম্পর্কে ভাবী না হলে তোমার প্রেমে পড়ে যেতাম।”
আমি ভ্রু কুচকে বললাম,” মানে? আমি আপনার ভাবী কেন হবো? ছি, ছি!”
ফাহিম ভাই মুখ গোজ করে বলল,” হয়েছে আর ড্রামা করতে হবে না। তোমার আর ঈশান ভাইয়ের ব্যাপার সব জানি আমি।”
আমি অবজ্ঞার সুরে বলল,” আরে ধূর, ওইসব কিছুই না। আপনি ভুল জানেন। ঈশান ভাইয়ের সাথে কি আমার যায় বলুন? বদমেজাজি একটা রাক্ষস টাইপ মানুষ। আমার জন্য পারফেক্ট আপনার মতো সুইট কেউ।”
ফাহিম ভাই বিভ্রান্ত হয়ে বলল,” আমার সাথে ফ্লার্ট করছ না তো?”
আমি আঁড়চোখে পেছনে চাইলাম। ঈশান এখনও এদিকে দেখছে। কাজেই ফাহিম ভাইয়ের কাঁধে হাত তুলে দিয়ে বললাম,” একদম না। ফ্লার্ট কেন করব? আপনার মতো মানুষের সাথে কি ফ্লার্ট করা যায়?”
ফাহিম ভাই অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। আমি অভিমানী দৃষ্টিতে বললাম,” আপনি না বলেছিলেন আমাকে গিটার বাজিয়ে শুনাবেন? এখনও কিন্তু শোনালেন না। কষ্ট পেয়েছি।”
ফাহিম ভাই আবেগে গলে গিয়ে বলল,” শুনাবো তো। কখন শুনতে চাও, বলো?”
” এখনি চলুন।”
আমি ফাহিম ভাইয়ের হাত ধরলাম। ঠিক সেই মুহূর্তে ঈশান আমাদের সামনে এসে দাঁড়াল।।ঈশানকে দেখে ফাহিম ভাইয়ের মুখ কাঁচুমাচু। সঙ্গে সঙ্গে আমার হাতটা ছেড়ে দিল। আমি মৃদু গলায় বললাম,” এক্সকিউজ মি, আপনি একটু সামনে থেকে সরুন। আমরা একটা জরুরী কাজে যাচ্ছি।”
ঈশান হাত ভাজ করে গম্ভীর কণ্ঠে বলল,” তার আগে তোমার সাথে আমার জরুরী কথা আছে।”
আমি কঠিন গলায় বললাম,” স্যরি। আমি এই মুহূর্তে আপনার সাথে কথা বলতে আগ্রহবোধ করছি না। ”
ঈশান এবার ফাহিম ভাইয়ের দিকে চেয়ে বলল,” তুই এখানে কি করছিস? ওদিকে সাউন্ডবক্সে কি যেন প্রবলেম হচ্ছে। গিয়ে দেখে আয়।”
ফাহিম ভাই নিম্ন কণ্ঠে বলল,” কিন্তু সাউন্ডবক্স তো ঠিকঠাকই চলছে..”
ঈশান গরম দৃষ্টিতে তাকানো মাত্রই ফাহিম ভাই দ্রুত ‘আচ্ছা যাচ্ছি’ বলে চলে গেল।
আমি বিড়বিড় করে বললাম,” ভীতুর ডিম একটা! ”
ফাহিম ভাই চলে যাওয়ার পর ঈশান আমার হাত টেনে ধরে বলল,” এদিকে এসো।”
আমি রেগে বললাম,” আমার হাত ছাড়ুন। আমি আপনার সাথে কোথাও যাব না।”
ঈশান হেসে বলল,” তোমাকে যেতেই হবে।”
আমিও কম জেদী না। ঝটিতে হাত ছাড়িয়ে বললাম,” যাব না মানে যাব না।”
আমি সামনে হাঁটতে লাগলাম৷ ঈশানও আমার পেছন পেছন আসছে। আমি পাত্তা দিলাম না। তবে আমি চাই, সে এভাবেই আমার পেছন পেছন ঘুরুক। ঈশান ফিসফিস করে বলল,” তারিন বোঝার চেষ্টা করো, কথাটা সত্যি জরুরী।”
আমি হৃষ্টচিত্তে জবাব দিলাম,” আমি শুনতে চাই না!”
স্টেজে উঠতেই মেঘলা আমার হাত টেনে ধরে বলল,” এই তারু, তোর এই অবস্থা কেন?”
আমি অবাক হলাম,” কি অবস্থা?”
মেঘলা আমার কানের কাছে মুখ এনে বলল,” পেছন থেকে সেফটিপিন খুলে গেছে। পুরো পিঠের অর্ধেক অংশ দেখা যাচ্ছে।”
আমি সাথে সাথে পিঠে হাত দিলাম। অস্বস্তিতে লাল হয়ে এলো আমার মুখ। ঈশানকে দেখলাম আমার দিকেই চেয়ে আছে। এতোক্ষণে বুঝলাম তার জরুরীর কথা আসলে কি ছিল! আমি তাড়াহুড়ো করে ঘরে ঢুকে গেলাম।
মোহনা আন্টিকে আজ অত্যন্ত সুন্দর লাগছে। এমনিতেও ভদ্রমহিলা যথেষ্ট সুন্দরী। তার উপর আজ সেজেছেনও বেশ জাঁকজমকপুর্ণভাবে। পেস্ট কালার সিল্কের শাড়ির সাথে কলারওয়ালা গোল্ডেন ব্লাউজ। তবে স্লিভলেস। মোহনা আন্টিকে আমি স্লিভলেস ব্লাউজ ছাড়া অন্যকোনো ব্লাউজ জীবনে পড়তেই দেখলাম না। অবশ্য তাকে এভাবেই সবচেয়ে ভালো মানায়। ঠিক যেন বলিউডের কোনো নায়িকা। আমি মোহনা আন্টির পাশে বসলাম। আন্টি ব্রাউনিশ চুলগুলো এক সাইডে সরাতে সরাতে বললেন, “কেমন আছো তারিন?”
আমার বলতে ইচ্ছে হল, ” আপনার গুণধর ছেলের জন্য কি ভালো থাকা যায়?” কিন্তু চাইলেই তো সবকিছু বলা যায় না। আমি ঠোঁট প্রসারিত করে জবাব দিলাম,” ভালো আছি।”
মোহনা আন্টি মলিন কণ্ঠে বললেন,” ঈশানের সাথে কথা বলেছিলে?”
আমি ইতস্তত হয়ে বললাম,” জ্বী না। এই বিষয়ে কথা বলা হয়নি।”
মোহনা আন্টির চেহারা মুহূর্তেই গাঢ় বিষাদের ছায়ায় ঢেকে গেল। আমি হাসিমুখে বললাম,” মনখারাপ করবেন না। আমি ঈশানকে বোঝাব। সব ঠিক হয়ে যাবে।”
মোহনা আন্টি মৃদু হাসলেন তবে আমার কথায় খুব একটা ভরসা পেলেন না সেটা বোঝা গেল। হঠাৎ করেই কোথ থেকে যেন আরিশা ছুটে এলো। মোহনা আন্টিকে জড়িয়ে ধরেই বলে উঠল,” কেমন আছ মাদার ইন লো।”
আরিশার কথা শুনে আমার চোখ বড় বড় হয়ে গেল। মোহনা আন্টি হাসতে হাসতে বললেন,” খুব ভালো। আমার ডটার ইন লো কেমন আছে?”
” ভেরি ফাইন। কিন্তু আমি তোমার কাছে একটা কমপ্লেইন নিয়ে এসেছি।”
” কমপ্লেইন?”
” হ্যাঁ। তোমার ছেলের নামে। সে আমাকে আইসক্রিম কিনে দিবে বলে কোথায় হারিয়ে গেছে। আর খুঁজেই পাচ্ছি না।”
” আহারে, আচ্ছা আমি তোমাকে আইসক্রিম কিনে দেব কিউটি। মনখারাপ করে না।”
তারপর মোহনা আন্টি আমার দিকে চাইলেন। আমি এতোক্ষণ হা করে আরিশার কথা গিলছিলাম৷ মোহনা আন্টি তাকাতেই আমি জোরপূর্বক হাসলাম। মোহনা আন্টি বললেন,” এটা হচ্ছে আমাদের পাকনি বুড়ি।”
আরিশা আমার দিকে একবার আঁড়চোখে চেয়েই মোহনা আন্টিকে প্রশ্ন করল,” তুমি তারি আপুকে চেনো?”
” হ্যাঁ চিনি তো।”
তারপর মোহনা আন্টি একটু দুষ্টমি করেই বললেন,” তুমি যেমন ঈশানের ছোট গার্লফ্রেন্ড তেমনি তারিন আপু হলো ঈশানের বড় গার্লফ্রেন্ড।”
আরিশা ভ্রু কুচকে আমার দিকে চেয়ে বলল,” তুমি ঈশানের গার্লফ্রেন্ড?”
আমি মাথা নেড়ে বললাম,” না তো।”
আরিশা হেসে বলল,” জানতাম। ঈশান আমার সাথে চিট করতেই পারে না।”
তার এই কথা শুনে মোহনা আন্টি হেসে ফেললেন। আর আমি কেমন রিয়েকশন দেওয়া দরকার খুঁজে পেলাম না। শুধু মনে হলো, আরিশার বয়সে থাকতে আমি প্রেমের অর্থটাও বুঝতাম না। আর এই মেয়েকে দেখে মনে হচ্ছে মায়ের পেট থেকেই প্রেমের বিষয়ে পিএইচডি করে বেরিয়েছে। ইঁচড়েপাকা!
বরযাত্রীর সামনে লাল ফিতা বেঁধে দাঁড়িয়ে আছি আমরা। আমি সামনে দাঁড়াতে চাইনি, কিন্তু মেঘলার জোরাজোরিতে দাঁড়াতে হল। কারণ মেঘলার ধারণা, আমি নাকি তর্ক খুব ভালো জানি৷ সামিয়া আমার বাম পাশটায় দাঁড়িয়ে। তার হাতে শরবত। মেঘলার হাতে বাটিভর্তি রসগোল্লা। এসব দিয়ে বরযাত্রীকে বরণ করা হবে। মেঘলা কাটাচামচ দিয়ে একটা রসগোল্লা তুলে সাফিন ভাইয়ার মুখের সামনে ধরল। সাফিন ভাইয়া হা করতেই মেঘলা হাত গুটিয়ে নিয়ে বলল,
” উহুম। আগে বায়না দিতে হবে। তারপরেই না মিষ্টিমুখ!”
রিফাত ভাইয়া তাচ্ছিল্যের সাথে বলল, ” কিসের বায়না আবার?”
সামিয়া জবাব দিল,” বাঃ রে! এতো কষ্ট করে আয়োজন সাজিয়েছি। মিষ্টি, শরবত বানিয়েছি। আর আমাদের কিছু দিবেন না?”
ঈশান তখন বলল, “আয়োজন তোমরা সাজাওনি। সাজিয়েছে ডেকোরেটরটা। আর মিষ্টি- শরবত এসব কিছুই তোমরা বানাও নি। শুধু হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকলেই হলো? যারা আসলেই পরিশ্রম করেছে পারিশ্রমিক কেবল ওরাই পাবে। এবার এসব ঝামেলা সরাও। ভিতরে আসতে না দিলে কিন্তু হামলা হবে।”
ঈশানের সাথে তাল মিলিয়ে ছেলেরা সবাই আওয়াজ তুলল।
মেঘলা হাত বাড়িয়ে বলল, “ওয়েট, ওয়েট। তার মানে আপনি কি বলতে চান আমরা কোনো কাজ করিনি? এইযে এই শরবত আমি বানিয়েছি। মিষ্টি আমাদের তারু বানিয়েছে। এই ফিতা, ফুল এইসব কিছু আমরাই অ্যারেঞ্জ করেছি। আপনাদের ওয়েলকাম করার জন্য এতোকিছু করলাম অথচ আপনারা কিপটামি করছেন?”
সামিয়া ক্ষুব্ধ হয়ে বলল, “আর তাছাড়া এটাও তো ঠিক না ঈশান ভাইয়া। আপনি বউয়ের কাজিন। তাই আপনার উচিৎ ছিল আমাদের সাইড নেওয়া। তা না করে আপনি বরপক্ষের সাইড নিচ্ছেন কেন?”
মাহাথি ভাইয়া গলা উঁচিয়ে বলল,” নিবে না কেন? আগে হলো ফ্রেন্ডশীপ, তারপর অন্যকিছু।”
মেঘলা হাত ঠেঁকিয়ে বলল,” সে যাই হোক, আমরা আদর-আপ্যায়নের কোনো কমতি রাখিনি। তাই আমাদের ন্যায্য পাওনা দিতেই হবে। নয়তো গেইট ছাড়ছি না। ”
ঈশান ভ্রু কুচকে বলল,” তোমাদের এক্সট্রা আদর-আপ্যায়ন দেখানোর প্রয়োজন নেই৷ এসব শরবত, রসগোল্লা দূরে সরাও। দেখেই তো কেমন লাগছে!আল্লাহই জানে কি দিয়ে বানিয়েছ। খেলে আবার পেটখারাপ হবে না তো? ”
ঈশানের কথায় হাসির রোল পড়ে গেল। আমি ক্রুদ্ধ স্বরে বললাম,” এতো সমস্যা মনে হলে আপনি খেয়েন না। এমনিতেও কুকুরের পেটে ঘি হজম হয় না৷ ”
আমার এই কথায় মেয়েরা হেসে উঠল। ঈশান রাগী দৃষ্টিতে বলল,” হোয়াট ডু ইউ মিন বাই কুকুর? তুমি কাকে কুকুর বলছ?”
আমি মুচকি হেসে বলল,” কথা হয় সবার মাঝে, যার কথা তার প্রাণে বাজে। আফসোস!”
ঈশান আরও কিছু বলতে নিচ্ছিল। তখন সাফিন ভাই থামালেন,” আরে, তোরা কি ঝগড়া করেই রাত পার করে দিবি নাকি? ওরা যা চায় তা দিয়ে দে ভাই। দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে পা ব্যথা হয়ে যাচ্ছে।”
রিদিতা মজা করে বলল,”অয়হয়, দুলাভাইয়ের মনে হয় বউয়ের কাছে যাওয়ার জন্য আর তর সইছে না। আচ্ছা যান, আপনাদের উপর দয়া করলাম। বেশি না মাত্র পঞ্চাশ হাজার টাকা ছাড়ুন। আমরা গেইট ছেড়ে দিব।”
টাকার পরিমাণ শুনে ছেলেদের চোখ কপালে গিয়ে উঠল। অবশেষে অনেক তর্কাতর্কির পর আমরা ত্রিশ হাজার টাকা আদায় করতে সক্ষম হলাম। তারপর বরকে মিষ্টি, শরবত খাওয়ানো হলো। সামিয়া ঈশানের মুখেও একটা মিষ্টি তুলে দিতে চাইল। ঈশান বাঁধ সেধে বলল,” উহুম। আমি এসব থার্ডক্লাস মিষ্টি খাই না।”
আমি রেগে তাকালাম। মেঘলা ভ্রু কুচকে বলল,” কি বললেন? এটা থার্ড ক্লাস মিষ্টি?”
ঈশান অতি স্বাভাবিক স্বরে বলল,” নো ডাউট।”
সামিয়াকে দেখলাম ঠোঁট বাঁকা করে হাসছে। যেন ঈশানের এই কথায় সে খুব মজা পেয়েছে। আমি আর সেখানে দাঁড়ালাম না। রাগে শরীরটা চিড়বিড় করে উঠছিল। স্টেজের পেছনে একটা চেয়ার নিয়ে বসলাম। বিশ্বাস হচ্ছে না, ঈশান এইভাবে ইনসাল্ট করল আমাকে? তাও আবার সামিয়ার সামনে? প্রচন্ড রাগ হচ্ছে। ভুল তো আমারই। ঈশানের সাথে সম্পর্কে জড়ানোই আমার সবথেকে বড় ভুল। ওমন আবেগমাখা চিঠি, মিষ্টি মিষ্টি বুলি সবাই আওরাতে পারে। কিন্তু সত্যিকারভাবে কয়জনই বা ভালোবাসতে পারে? শুধুমাত্র একটা চড়কে কেন্দ্র করে ঈশান আমার সাথে যা করছে, সত্যিকারের ভালোবাসলে কখনোই এমনটা করতে পারতো না। তার মতো ছেলের জন্য সামিয়াই ঠিকাছে। আমি তো তার কাছে থার্ড ক্লাস। তাহলে সে ফার্স্ট ক্লাস নিয়েই ভালো থাকুক!
পাঠক হিসেবে আপনি কাকে সাপোর্ট করেন? ঈশান নাকি তারিন? একটা ভোট হয়ে যাক। টিম ঈশান অথবা টিম তারিন।
চলবে
সকল পর্ব https://m.facebook.com/story.php?story_fbid=175675935125922&id=100080505484003#তি_আমো
পর্ব ২৩
লিখা- Sidratul Muntaz
ফাহিম ভাই আমার সামনে রসগোল্লা ভর্তি পেয়ালা এনে বলল,” একটা খাও তারিন।”
আমি অবাক হলাম। এগুলো তো আমার বানানো মিষ্টি। ঈশান একটু আগে যেগুলো দেখে বলছিল থার্ড ক্লাস। আমি প্রশ্ন করলাম,” কেন? আপনি খান। নাকি আপনারও এই মিষ্টি থার্ড ক্লাস মনে হয়?”
” ছিঃ, ছিঃ, সেরকম কেন হবে? আমি খেয়েছি। অনেক ভালো মিষ্টি। তুমিও একটা খাও।”
আমি গোমরা মুখে বললাম,” রাখুন।”
” হ্যাঁ? ”
” রেখে দিন।”
ফাহিম ভাই আমার সামনে মিষ্টির পেয়ালা রাখল। আমি প্রথমে একটা মিষ্টি মুখে দিলাম। তারপর আরেকটা নিলাম। ফাহিম ভাই তড়িঘড়ি করে বলল,” এতো খাওয়ার দরকার নেই। সবাই একটা একটা।”
আমি রেগে বললাম,” কেন? একটা একটা কেন? আমার যতগুলো ইচ্ছা আমি ততগুলো খাব।”
এই কথা বলেই দ্বিতীয় মিষ্টি মুখে দিলাম। ফাহিম ভাই বিপদগ্রস্ত দৃষ্টিতে আমাকে দেখছে। মনে হচ্ছে আমার সামনে মিষ্টি এনে সে বিরাট ভুল করেছে। আমি ফাহিম ভাইয়ের কাঁধে হাত রেখে বললাম,” সত্যি করে বলুন, আমার মিষ্টি কি খেতে খারাপ?”
ফাহিম দুইপাশে মাথা নেড়ে বলল,” একদম না তারিন৷ তুমি আর খেও না।”
” খাবো না কেন? আমার মিষ্টি আমিই খাব। আর কেউ খাক না খাক সেটা আমার দেখার দরকার নেই৷ ভালো জিনিস মানুষের সহ্য হয় না। আমি কত কষ্ট করে বানিয়েছিলাম জানেন? অথচ এমনভাবে বলা হলো, যেন আমি মিষ্টি বানাতেই জানি না। একবার আমাদের কলেজে ক্লাস পার্টি হয়েছিল। আমি মিষ্টি বানিয়ে নিয়ে যাওয়ার পর সবাই হামলে পড়েছিল। আর সেই মিষ্টিকে ঈশান বলল..”
ফাহিম ভাই ইতস্তত হয়ে বলল,” ঈশানের কথা থাক। আমার খুব ভালো লেগেছে মিষ্টি।”
” তাই? তাহলে খান!”
ফাহিম ভাই সঙ্গে সঙ্গে নিজের মুখে হাত চেপে বলল,” না, না, আমি খাব না।”
আমি ক্ষেপে বললাম,” থাক। বুঝেছি। আপনারও ভালো লাগেনি। আমার মিষ্টি আমিই খাব।”
এই কথা বলে একসাথে আরও চার-পাঁচটা মুখে দিলাম৷ ফাহিম ভাই মিনতির স্বরে বলল,” আর খেয়ো না তারিন। প্লিজ। অনেক বেশি হয়ে যাচ্ছে।”
আমি খেতে খেতে বললাম,” মিষ্টিগুলো কেমন তেঁতো লাগছে ফাহিম ভাই। লেবুর রস মিশিয়ে এনেছেন নাকি?”
” না তো।”
” এখন বলবেন না আমি বাসী মিষ্টি বানিয়েছি৷ কমলার মা সাক্ষী। আমি আজ সকালেই সব মিষ্টি বানিয়েছি। আপনার বিশ্বাস না হলে রান্নাঘরে গিয়ে কমলার মাকে জিজ্ঞেস করে আসুন।”
ফাহিম ভাই বিনীত কণ্ঠে বলল,” আরে, তোমাকে কেউ বাসী মিষ্টি বানানোর অপবাদ দিচ্ছে না। মিষ্টি যথেষ্টই ভালো হয়েছে। কিন্তু তেঁতো লাগছে অন্য একটা কারণে।”
ততক্ষণে আমার সব মিষ্টি খাওয়া শেষ। আমি আঙ্গুল চাটতে চাটতে প্রশ্ন করলাম,” কি কারণ শুনি?”
ফাহিম ভাই আমতা-আমতা করে বলল,” আসলে রিফাত ভাইয়ের প্ল্যান ছিল। সব মেয়েদের এলকোহল মেশানো মিষ্টি একটা করে খাওয়ানো হবে। এজ আ প্র্যাংক। প্রথমে আমি তোমার কাছেই এনেছি। আর তুমি একাই সব খেয়ে ফেলেছ। এখন আমি জানি না কি হতে চলেছে।”
আমি ইতোমধ্যে চোখে ঝাপসা দেখতে শুরু করলাম। আমার শরীর নিজস্ব গতিতে দুলছে। ফাহিম ভাইয়ের কথা আমার মাথায় ঢুকল না। চোখ-মুখ কুচকে বললাম,” কি?”
” মিষ্টিগুলো খেয়ে তোমার নেশা হয়ে গেছে।”
” কি!” আমি হতভম্বের মতো তাকিয়ে রইলাম৷ তারপর উঠে দাঁড়াতে নিলেই দুনিয়া ঘুরে উঠল। ফাহিম ভাই ঝটপট এসে আমাকে দুইহাতে আগলে ধরল। আমি দূর্বল কণ্ঠে বললাম,” আমার খুব অদ্ভুত লাগছে ফাহিম ভাই।”
ফাহিম ভাই অপরাধী গলায় বলল,” আই এম স্যরি। আমার জন্য সব হয়েছে। কিন্তু আমিও তো তোমাকে নিষেধ করেছিলাম। তুমি শুনলে না।”
আমি ফাহিম ভাইয়ের বুকে ঢলে পড়লাম৷ চোখমুখ সব বন্ধ হয়ে আসছে। হাত-পা নাড়াতে পারছি না। শরীরটা ভীষণ হালকাবোধ হচ্ছে। আমি হেসে বললাম,” আমি কি মঙ্গল গ্রহে চলে এসেছি? এতো হালকা লাগছে কেন আমার? আচ্ছা ফাহিম ভাই বলেন তো, মঙ্গল গ্রহের গ্র্যাভিটি বেশি নাকি পৃথিবীর গ্র্যাভিটি বেশি?”
” আমি জানি না।”
আমি ধপ করে পড়ে যেতে নিচ্ছিলাম। ফাহিম ভাই আমাকে কোলে তুলে নিল। আমার খুব লজ্জা লাগছে কিন্তু আমি কিছু বলতে পারছি না। ফাহিম ভাই ফিসফিস করে বলল,” তোমাকে আমি ঘরে রেখে আসব। তুমি কিছুক্ষণ চুপচাপ শুয়ে থাকবে, ওকে? ভুলেও ঘর থেকে বের হয়ো না প্লিজ।”
আমি বিরস কণ্ঠে বললাম,” জানেন ফাহিম ভাই, ঈশান আমাকে খুব দুঃখ দিয়েছে। আমি তাকে এতো ভালোবাসি অথচ সে..”
ঈশান ঠিক তখনি ফাহিম ভাইয়ের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। ফাহিম ভাই আমাকে এটা বলতে নিলেই ঈশান হাতের ইশারায় চুপ থাকতে বলল। আর এদিকে আমি কথা বলে যেতে লাগলাম,” সে আমাকে একটুও বুঝল না ফাহিম ভাই৷ অন্যকারো সাথে তাকে কথা বলতে দেখলেও আমার হিংসা হয়। কিন্তু সে সারাক্ষণ সামিয়ার সাথে ঘুরঘুর করছে। সামিয়ার সামনে আমাকে কিভাবে ইনসাল্ট করল দেখলেন? শুধু একটা চড় মেরেছিলাম বলে আমার সাথে এমন করবে? আমি তো তাকে স্যরিও বলেছি। ভুল কি শুধু আমার ছিল? সে কি কোনো ভুল করেনি?”
ঈশান গম্ভীর গলায় প্রশ্ন করল,” ওর কি হয়েছে?”
ফাহিম ভাই আড়ষ্ট কণ্ঠে পুরো ঘটনা বলল। আমি আবছা দৃষ্টিতে ঈশানের দিকে চাইলাম। তাকে দেখেই আমার মেজাজ গরম হয়ে গেল৷ আমি উচ্চ কণ্ঠে বলতে লাগলাম,” আপনি এখানে কি করছেন? যান আপনার সামিয়ার কাছে। আই হেইট ইউ। আপনি আমার সামনে আসবেন না।”
ঈশান আমার হাত ধরে বলল,” তারিন, এদিকে এসো। তোমার অবস্থা একদম ঠিক নেই।”
আমি হাত ছাড়িয়ে বললাম,” উহুম। আমি যাবো না। আপনি ভালো না।”
ফাহিম ভাই আমাকে ঈশানের কাছে রেখে নিজে চলে গেল। আমি দাঁড়িয়ে থাকতে পারছি না। ঈশান আমাকে ধরতে এলেই আমি ধমক দিয়ে বললাম,” ডন্ট টাচ মি।”
” আচ্ছা, টাচ করব না। তুমি আমার হাতটা ধরো তারপর আমার সাথে চলো।”
” না। আপনি ফাহিম ভাইকে ভাগিয়েছেন কেন? কোথায় ফাহিম ভাই?”
” আমি ভাগাইনি। ও নিজেই চলে গেছে।”
” মিথ্যা কথা। আপনি একটা মিথ্যুক। সবার সাথে মিথ্যা বলেছেন। আমার সাথেও মিথ্যা বলেছেন। মিথ্যা বলে বলে আমার মন ভেঙেছেন।”
ঈশান কোমল গলায় বলল,” আই এম স্যরি।”
আমি মাথা নেড়ে বললাম,” আপনার স্যরি গ্রান্টেড হলো না। আমি আপনাকে এতো সহজে মাফ করবই না। আমি যত কষ্ট পেয়েছি ঠিক তত কষ্ট আপনাকেও পেতে হবে।”
ঈশান একহাতে বাউন্ডারির মতো আমার কোমর জড়িয়ে রেখেছে যেন আমি হেলে পড়ে না যাই৷ আশেপাশের মানুষ আমাদের বিস্ময় নিয়ে দেখছে। ঈশান বিড়বিড় করে বলল,” প্লিজ ঘরে চলো তারিন৷ ফাহিমকে আমি পরে দেখে নিব। কি অবস্থা করেছে তোমার!”
” ফাহিম ভাই যা করেছে একদম ঠিক করেছে। আমার তো বেশ লাগছে। বিন্দাস আছি আমি। আকাশে উড়ছি। কিন্তু আপনি আমাকে ধরে আছেন কেন? আমাকে উড়তে দিবেন না?”
” না।”
” আমি উড়ব। অবশ্যই উড়ব।”
হঠাৎ মেইন গেইটের সামনে সিএনজি এসে থামল। আমি ঝাপসা চোখে দেখলাম সিএনজি থেকে নামছে একজন লোক আর তারপাশে বোরখ পরিহিত দু’জন মহিলা। তারা এদিকেই আসছে। আমি অবাক হয়ে বললাম,” আরে দেখুন, লোকটাকে একদম আমার ভাইয়ার মতো লাগছে না।”
ঈশান বিষমচিত্তে বলল,” ওহ শিট! ওটা সত্যিই তোমার ভাই তারিন। তোমাকে এইভাবে দেখলে কেলেংকারী হয়ে যাবে। প্লিজ ঘরে চলো।”
মুহূর্তেই ঈশান আমাকে কোলে তুলে দৌড়াতে লাগল। আর আমি খিলখিল করে হাসতে লাগলাম৷ দুই হাত বাড়িয়ে চিৎকার করলাম,” উড়ালপঙ্খী, আমি উড়ালপঙ্খী। এখন তারু উড়ে যাবে আকাশে৷ পারবে না কেউ ছুঁতে৷ আপনিও ছুঁতে পারবেন না।”
ঈশান আমাকে নিয়ে একটা ঘরের ভেতর এসে দরজা আটকাল। তারপর আমাকে বিছানায় বসিয়ে হতাশ দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে রইল। আমি হেসে বললাম,” আপনি এভাবে কেন তাকিয়ে আছেন? একটু হাসুন না। হাসলে আপনাকে কিউট লাগে।”
ঈশান বিষণ্ণ কণ্ঠে বলল,” হাসার পরিস্থিতি কি এখন আছে?”
আমি কিছু বললাম না। ধপ করে বিছানায় শুয়ে পড়লাম। চোখ বন্ধ করলাম। ঈশান উঠে দাঁড়িয়ে বলল,” এখানে চুপচাপ শুয়ে থাকো। আমি না আসা পর্যন্ত বের হবে না। ওকে?”
আমি ঈশানকে হাতের ইশারায় কাছে ডাকলাম। ঈশান আমার মুখের কাছে ঝুঁকে প্রশ্ন করল,” কি?”
আমি ফিসফিস করে বললাম,” আমি ভাবছি ছাদে গিয়ে লাফ দিব। আপনার কাছে প্যারাস্যুট আছে?”
ঈশান এই কথা শুনে দরজা বাইরে থেকে লক করে বের হয়ে গেল। আমি দ্রুত দরজার কাছে ছুটে গেলাম। জোরে জোরে ধাক্কাতে লাগলাম দরজাটা। কিন্তু ঈশান ততক্ষণে চলে গেছে। আমি হতাশ হয়ে ফ্লোরে বসে পড়লাম। এতো খারাপ কেন ঈশান? নিজে সারাক্ষণ সামিয়ার সাথে ঢলাঢলি করছে সেটা কিছু না? নিজের বেলায় ষোলআনা আর আমার বেলায় কাচকলা? না, তা হবে না। ওই সামিয়াকে আমি উচিৎ শিক্ষা দিয়েই ছাড়ব। ঈশান কি এখন আবার সামিয়ার কাছে গেছে? আমি জানালার সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। যদি কাউকে পাই তাহলে বলব দরজা খুলে দিতে। তখনি দেখলাম আরিশাকে। মাথার লম্বা ঝুঁটিটা এপাশ-ওপাশ দুলিয়ে কোথায় যেন হেঁটে যাচ্ছে। আমি হাত বাড়িয়ে ডাকলাম,” আরিশা বেবি!”
আরিশা থেমে দাড়ালো। এদিকে-ওদিক তাকিয়ে শব্দের উৎস খুঁজছে লাগল। আমি আবার বললাম,
” এইযে দেখো, এদিকে জানালায়। আমি তারিন আপু।”
আরিশা জানালা বরাবর তাকাল। মুচকি হেসে ছোট্ট হাত নাড়িয়ে বলল, “হাই তারি আপু!”
” এদিকে একবার এসো না আরিশা!”
আরিশা জানালার কাছে আসতেই আমি বললাম,” একটা হেল্প করতে পারবে?”
আরিশা ভ্রু কুচকে ঠোঁটের কোণে আঙুল রেখে বলল,
“হেল্প? ওকে। আই ক্যান হেল্প ইউ। বাট ইউ হেভ টু গিভ মি দ্যা রিটার্ন গিফট।”
” রিটার্ন গিফট?আচ্ছা আমি তোমাকে চকলেট দিবো। আগে তুমি দরজাটা একটু খুলে দাও?”
আরিশা মাথা নাড়িয়ে বলল, “উহুম! আগে চকলেট দাও।”
এই বলেই সে হাত পাতল। আমি কি করব বুঝতে পারলাম না। আরিশা বলল,” চকলেট না পেলে আমি হেল্প করতে পারবো না। বা বায়!”
সামনের দিকে ঘুরে হাঁটতে লাগল আরিশা।
আমি চোখ সরু করে তাকালাম। মেয়ে তো খুব শেয়ানা! তবে আমিও কিছু কম না।আমি পুনরায় ডাকলাম,
“আরিশা বেবি! আমি তোমাকে চকলেট দিবো প্রমিস। কিন্তু চকলেট টা খুব বড়। জানালা দিয়ে দেওয়া যাবে না। তুমি দরজাটা খুলো, তারপর আমি দিচ্ছি।”
আরিশা কিছু একটা ভেবে বলল,” এতোবড় চকলেট? সত্যি দিবে তো? নাকি ঢপ মারছ?”
“হ্যাঁ সত্যি দিবো।”
“ঠিকাছে আমি দরজা খুলছি।”
আরিশা দৌড়ে দরজার দিকে গেল। আমিও দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। দরজা খোলার আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। আমি কান পেতে রইলাম। কয়েক মিনিট পর আরিশা বলল,
“তারি আপু! আমি খুলতে পারছি না।খুব শক্ত।”
“পারবে আপু। একটু চেষ্টা করো!”
আরো কয়েক মিনিট মোচড়ামোচড়ির পর অবশেষে খুলে গেল দরজা। আমি হালকা নিচু হয়ে আরিশা কপালে চুমু দিলাম। বললাম,”থ্যাঙ্কিউ বেবি।”
“এবার আমার চকলেট দাও।”
“চকলেট ঈশানের কাছে আছে। তুমি ওর থেকে নিয়ে নিও কেমন?”
এই কথা বলেই ডানদিকে ছুট লাগালাম আমি। আরিশা পেছন থেকে কিছু একটা বলছিল, আমি শুনলাম না।