তি আমো পর্ব -২৪+২৫

#তি_আমো
পর্ব ২৪
লিখা- Sidratul Muntaz

আমি খুব ধীরে দৌড়াচ্ছি কিন্তু তবুও আমার মনে হচ্ছে যেন পা দু’টো বাতাসের গতিতে ছুটছে। আর শরীরটা দোলনার মতো দুলছে। বাড়ি এখন ফাঁকা বললেই চলে। সবাই স্টেজে আনন্দ করতে ব্যস্ত। আমি নিহাদের ড্রয়িংরুমের সামনে এসে থামলাম। তখনি খেয়াল করলাম সাফিন ভাই ছুটে এদিকেই আসছেন। আমি কোমরে হাত গুজে বললাম,

” আরে সাফিন ভাই, আজ না আপনার বিয়ে? আপনি অলিম্পিকের দৌড় দিচ্ছেন কেন?”

আমাকে দেখে সাফিন ভাই বিপর্যস্ত কণ্ঠে বললেন,” আচ্ছা তারিন, নিহা তো বলেছিল তোমার বাড়ির কেউ বিয়েতে আসবে না। তাহলে তোমার ভাইয়াকে স্টেজে দেখলাম কেন? তিনি এখানে কি করছেন?”

সাফিন ভাইয়ের ভয়ে চুপসে যাওয়া মুখটি দেখে আমি ঠোঁট টিপে হেসে উঠলাম। মজা করে বললাম,” ও বুঝেছি। ভাইয়া তাহলে আপনাকে দৌড়ানি দিয়েছে?”

সাফিন ভাই চেহারার ঘাম মুছতে মুছতে বললেন,” আরে না, কিন্তু দেখা হলে তো মনে হয় সত্যি চোর চোর বলে দৌড়ানি দিবে। ”

আমি হাসতে হাসতে বললাম,” ও বুঝেছি। এজন্য আপনি আগে থেকেই দৌড়ানোর প্র্যাকটিস করে নিচ্ছেন?”

আমার উচ্চ শব্দের হাসি দেখে সাফিন ভাইয়া অদ্ভুত ভাবে চেয়ে রইলেন। প্রশ্ন করলেন,” তোমার কি হয়েছে তারিন? আর ইউ ওকে?”

আমি সঙ্গে সঙ্গে সোজাভাবে দাঁড়িয়ে বললাম,” অভিয়াসলি! আই এম এবসুল্যুটলি ফাইন। দেখবেন আমি ইয়োগাও করে দেখাতে পারব। ওয়ান, টু, থ্রি…”

আমি কোমর বাকিয়ে বাম হাত দিয়ে ডান পায়ের তালু স্পর্শ করলাম। তারপর আবার ডানহাত দিয়ে বামপায়ের তালু। সাফিন ভাইয়া হত বিস্মিত দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে চলে গেলেন। আমিও তার পেছন পেছন গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম,

” এখন আপনি কি করবেন সাফিন ভাইয়া?”

সাফিন ভাই দিশেহারার মতো মাথা চুলকে বলতে লাগলেন,” জানি না। আপাতত ওয়াশরুমের কথা বলে স্টেজ থেকে পালিয়ে এসেছি। কিছুক্ষণ ওয়াশরুমে বসে থাকব। এর মধ্যে তুমি একটু চেষ্টা করে দেখো তোমার ভাইকে বের করতে পারো কি-না। নাহলে তো আমার বিয়ে মাটি হয়ে যাবে। নিজের বিয়েতে কেউ আমাকে চোর বলে ধাওয়া করছে, ও মাই গড! চিন্তা করতেই কেমন লাগে! মানুষ কি ভাববে?”

আমি হাসতে হাসতে পাগল হয়ে যাচ্ছি। পরিস্থিতিটা আমার এতো মজা লাগছে কেন? সাফিন ভাই বাথরুমে ঢুকে পড়ার আগে আমাকে বললেন,” ঈশান কোথায়? তাকে খুঁজে আনো। শালা নিজে আমাকে ফাঁসিয়ে এখন গায়ে হাওয়া লাগিয়ে ঘুরছে।”

আমি বাগানের দিকে যাওয়ার জন্য পা বাড়ালাম। তখনি দেখলাম ঈশান হন্তদন্ত হয়ে এদিকে ছুটে আসছে। আমি তাকে দেখে দেয়ালের আড়ালে লুকিয়ে পড়লাম। কোথ থেকে যেন আরিশা এসে ঈশানকে থামাল। আমি কেবল আরিশার কণ্ঠ শুনলাম,

” থামো বয়ফ্রেন্ড। তোমার সাথে আমার একটা জরুরী কথা আছে।”

আমি দেয়ালের আড়াল থেকে উঁকি মারলাম। ঈশান নিচু হয়ে আরিশার গাল টিপে দিয়ে বলল,” তোমার সাথে আমি পরে কথা বলব, গার্লফ্রেন্ড। এখন আমার খুব জরুরী একটা কাজ আছে।”

ঈশান চলে যেতে নিলেই আরিশা তার হাত চেপে ধরল। জেদী গলায় বলল,” না। আমি তোমাকে যেতে দিবো না। কেউ আমার সাথে চিট করেছে। তোমার তাকে পানিশমেন্ট দিতে হবে।”

” আচ্ছা পরে পানিশমেন্ট দেই? এখন আগে জরুরী কাজটা করি?”

” না। এখনি পানিশমেন্ট দিতে হবে। নইলে আমি খুব জোরে চিৎকার করে কাঁদব।”

ঈশান উপায়ন্তর না পেয়ে হাঁটু গেঁড়ে বসল। ধৈর্য্য নিয়ে বলল,” ওকে। আগে তোমার কথাই শুনি। বলো কি হয়েছে?”

” তারি আপু আমাকে বলেছে আমি যদি দরজার লক খুলে দেই তাহলে আমাকে চকলেট দিবে।”

ঈশান বিস্ফোরিত দৃষ্টিতে বলল,” তারপর? তুমি কি দরজা খুলে দিয়েছ?”

আরিশা বিষণ্ণ মুখে মাথা নেড়ে বলল,” হ্যাঁ। কিন্তু এখন সে আমাকে চকলেট দিচ্ছে না।”

ঈশান রাগে উঠে দাঁড়িয়ে দরাজ কণ্ঠে বলল,” তোমাকে মার দেওয়া উচিৎ স্টুপিড মেয়ে। দরজা খুলেছ কেন তুমি? কি সর্বনাশ হলো, আল্লাহ!”

ঈশান আরিশার হাত ছেড়ে দ্রুত এদিকে আসতে লাগল। আমি সাথে সাথে দেয়ালের সাথে মিশে দাঁড়িয়ে রইলাম। ঈশান আমাকে খেয়াল করল না। আমি হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। আরিশাকে দেখলাম মাথা নিচু করে চোখের জল ফেলছে। আমি তার কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম। তার চিবুক স্পর্শ করে বললাম,” কি আরিশা বেবি? ঈশান বকেছে?”

আরিশা নিচের দিকে চেয়ে মাথা নাড়ল। আহ্লাদে ঠোঁট বেঁকিয়ে কাঁদার চেষ্টা করছে। আমি হাসতে হাসতে বললাম,” একদম ঠিকাছে। পারফেক্ট! আর করবি ইঁচড়েপাকামি?”

আরিশা আমার কথায় অবাক হয়ে তাকাল। আমি হাসছি। অপমানে, অভিমানে এবার ঠোঁট ভেঙে শব্দ করে কেঁদে ফেলল আরিশা। আমি কড়া গলায় বললাম,” আবার কাঁদে! বল ঈশান আমার ভাই। ঈশানকে আমি বিয়ে করব না। দ্রুত বল।”

আরিশা কটমট করে আমার দিকে চাইল। আমি নিচের ঠোঁট কামড়ে হুমকি দেওয়ার মতো বললাম,” কি হলো? বল!”

আরিশা দাঁত কিড়মিড়িয়ে উচ্চারণ করল,” জীবনেও বলব না।”

আমি ক্ষীপ্ত কণ্ঠে বললাম,” তাহলে একদম ঠিকাছে। আরও বকা খাবি তুই।”

আরিশা চিল্লিয়ে কাঁদতে লাগল এবার। এখন এই মেয়ের কান্না শুনে যদি ঈশান চলে আসে? তাহলে আবার আমাকে ধরে আটকে রাখবে। সেই ভয়ে আমি দ্রুত বাথরুমে ঢুকে গেলাম। সাফিন ভাইয়া আমাকে দেখে ফট করে প্রশ্ন করলেন,” ঈশান কই?”

আমি মুখ টিপে হেসে বললাম,” চাঁদের দেশে!”

সাফিন ভাই ভ্রু কুচকে বললেন,” মানে? তারিন আজকে তোমার কি হয়েছে? আমার এমন একটা বিপদের দিনে সবাই এতো অদ্ভুত আচরণ কেন করছ?”

আমি সাফিন ভাইয়ের কথার জবাব না দিয়ে বাথরুমে পায়চারী করতে লাগলাম। নিহাদের বাড়ির বাথরুমটা একদম রেস্টুরেন্টের মতো। সারিবদ্ধভাবে অনেকগুলো বেসিন। বেসিনের সাথে সংযুক্ত বিশাল বড় দুইটা আয়না। তারপর কিছু দূরে তিন রুমের আলাদা তিনটা বাথরুম। আমি আর সাফিন ভাই বেসিন রুমে দাঁড়িয়ে আছি। আমি আয়নার দিকে চেয়ে মুখ ভেংচাতে লাগলাম৷ একবার চোখ ট্যারা করছি, একবার জিহ্বা বের করছি, অন্যবার চুল দিয়ে মুখ ঢেকে ভূত সাজার চেষ্টা করছি। সাফিন ভাই হতবাক দৃষ্টিতে আমার এসব কান্ড দেখতে লাগলেন। একটু পর দেয়ালে মাথা ঠুঁকে বললেন,” হে আল্লাহ, রক্ষা করো। এসব কি হচ্ছে আজ? বিয়েটাও কি শান্তিমতো কপালে ছিল না?”

আমি হঠাৎ শুনলাম জানালার বাইরে কেউ কথা বলছে। একদম ভাইয়ার মতো গলা। আমি জানালা দিয়ে মাথা বের করে চাইলাম। কিছুটা দূরে স্টেজের ডান সাইডে দাঁড়িয়ে তারিফ ভাইয়া কথা বলছে নিহার বাবার সাথে। আঙ্কেল প্রশ্ন করলেন,” তোমার দাদীর শরীর এখন কেমন?”

তারিফ ভাইয়া মুচকি হেসে বললেন,” এখন অনেকটা ভালো। এজন্যই তো সবাইকে নিয়ে চলে এলাম। নিহা এতো করে বলছিল! তারুর মতো আমি তাকেও খুব স্নেহ করি। না এলে সে খুব মনখারাপ করত।”

আঙ্কেল খোশমেজাজে বললেন,” খুব ভালো করেছ। তারুর সাথে দেখা হয়েছে?”

” না। তাকে খুঁজছি। কোথায় যে আছে মেয়েটা?”

আমি সাথে সাথে জানালা দিয়ে হাত বের করে বললাম,” এইতো ভাইয়া, আমি এখানে!”

আমার কণ্ঠ শুনে তারিফ ভাই আশেপাশে খুঁজতে লাগল। সাফিন ভাই পেছন থেকে আমার মুখ চেপে ধরে দ্রুত জানালা আটকে দিল।

মাঝরাতে সবাইকে হাসানোর জন্য এই পর্ব দিলাম৷ কালকে থেকে ১ পর্বই দিব।
#তি_আমো
পর্ব ২৫
লিখা- Sidratul Muntaz

সাফিন ভাইয়ের সাথে জোরাজুরি করার মতো শক্তি আমার দূর্বল শরীরে নেই। তাই সে যখন আমার মুখ চেপে ধরে মেঝেতে বসাল তখন আমিও চুপচাপ বসে পড়লাম। সাফিন ভাই অতি রাগ নিয়ে আমার মাথায় গাট্টা মেরে বলতে লাগল,” এই মেয়ে, তুমি হুঁশে আছ তো? বেহুঁশের মতো আচরণ কেন করছ?”

আমি হাসলাম। সাফিন ভাই ভারী বিরক্ত হয়ে বলল ” কি খেয়েছ তারিন? এই অবস্থা তোমার কি করে হলো? তোমাকে কিন্তু আমি ভালো মেয়ে ভাবতাম!”

ঈশান তখন দরজা খুলে ভেতরে ঢুকেছে। তাকে দেখে আমি পালানোর জন্য উঠতে নিলেই সাফিন ভাই আমার হাত চেপে ধরল। আমি পালাতে ব্যর্থ হলাম। ঈশান কোমরে হাত গুজে আমার দিকে চেয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। তারপর হতাশ গতিতে আমার কাছে এসে চিন্তিত স্বরে বলল,” তারিন, তুমি ঠিকাছ? ঘর থেকে আমি বের হতে নিষেধ করেছিলাম। তবুও কেন বের হলে? ”

সাফিন ভাই দেয়ালে মাথা ঠেকিয়ে বলল,” আজ-কালকের ভালো মেয়েরাও সব নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। এসব কি? শেষ-মেষ তারুও? আমার বিশ্বাস হচ্ছে না।”

ঈশান সাফিন ভাইয়ের দিকে চেয়ে হতাশ গলায় বলল,” তারিনের দোষ নেই। ফাহিম এই কাজ করেছে। মিষ্টির সাথে এলকোহল মিশিয়েছিল। তারিন সেই সব মিষ্টি খেয়ে এখন এই অবস্থা।”

সাফিন ভাই মুখ কুচকে বলল,” মিষ্টির সাথে এলকোহল? এই ফাহিম তো খুব ফাজিল!”

ঈশান পাশ কাটানো গলায় বলল,” ওরও দোষ নেই। রিফাতের প্ল্যান ছিল। সব মেয়েকে একটা করে এলকোহল মেশানো মিষ্টি খাওয়িয়ে প্র্যাংক করা। কিন্তু তারিন একাই সব মিষ্টি খেয়ে ফেলল।”

” তাহলে তো ঘুরে-ফিরে দোষ তারিনেরই হলো। সে এতো মিষ্টি খেতে গেল কেন?”

ঈশান আবারও হতাশ কণ্ঠে বলল,” আমার জন্য হয়েছে সব। আমি যদি তখন মিষ্টি নিয়ে বাড়াবাড়ি না করতাম তাহলে তারিনও এমন পাগলামি করতো না। ভুলটা আমারই!”

ঈশান এবার আমার মাথায় স্পর্শ করে বলল,” আই এম স্যরি তারিন। প্লিজ ঘরে চলো।”

আমি হাই তুলতে তুলতে বললাম,” আমার খুব ঘুম পাচ্ছে। আপনি কি আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিবেন?”

ঈশান মৃদু হেসে বলল,” এদিকে এসো।”

তারপর সে আমাকে কোলে নিল। আমি রাগী কণ্ঠে বললাম,” আবার সামিয়ার কাছে চলে যাবেন না তো?”

ঈশান অদ্ভুত ভঙ্গিতে হেসে বলল,” তুমি কি সামিয়ার প্রতি জেলাস?”

আমি ঈশানের প্রসারিত ঠোঁট স্পর্শ করে বললাম,” আরিশাও আপনাকে বিয়ে করতে চায়। কেন? পৃথিবীতে কি আর কোনো ছেলে নেই?”

ঈশান আরও জোরে হেসে উঠে বলল,” ওহ মাই গড তারিন! শী ইজ জাস্ট আ লিটল বেবি। তার কথাও তুমি ধরে বসে আছ?”

” কেন ধরব না? সে আমার হৃদয়ে হাত দিয়েছে।”

ঈশান গভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,” কে তোমার হৃদয়?”

আমি ঈশানের গজদাঁতের উপর আঙুল রেখে বললাম,” এই গজদন্তওয়ালাই আমার হৃদয়।”

ঈশান আরও গাঢ় করে হাসল। আমি মুগ্ধ হয়ে তার অদ্ভুত সুন্দর হাসির দিকে তাকিয়ে রইলাম। ভাবতেই ভালো লাগে যে এই মানুষটি শুধু আমার! তার পাশে অন্যকারো কথা আমি চিন্তাও করতে পারি না। এক মুহূর্তের জন্যেও না। ঈশান হঠাৎ আমার দিকে চেয়ে সিরিয়াস হয়ে বলল,” শোনো তারিন, আরিশা বলো কিংবা সামিয়া। তারা দু’জনই আমার বোন। এছাড়া অন্য কিছু না। তাই ওদের নিয়ে তোমার ইনসিকিউরড ফীল করার কোনো প্রয়োজন নেই। আর শুধু ওরা কেন? কাউকে নিয়েই ইনসিকিউরড ফীল করার প্রয়োজন নেই। ঈশান শুধু তারিনের।”

আমি ঠোঁট উল্টে বললাম,” তাই বুঝি? ওরা শুধুই আপনার বোন?”

” হ্যাঁ মহারাণী!”

আমি ঘাড়টা একটু হেলিয়ে প্রশ্ন করলাম,” আর আমি আপনার কি?”

ঈশান গাঢ় কণ্ঠে বলল,” তুমি আমার জান।”

আমি খুশিতে গদগদ হয়ে ঈশানের গলা জড়িয়ে ধরলাম। ঘরে ঢুকে পড়ার সময় দেখলাম ড্রয়িংরুমের ঠিক সামনে সামিয়া দাঁড়িয়ে আছে। ঈশান যে আমাকে কোলে নিয়ে ঘরে ঢুকছে, এই দৃশ্য সে হতবিস্ময় নিয়ে দেখছে। আমি তাকে দেখানোর জন্য ইচ্ছে করেই ঈশানের গালে চুমু দিলাম। এই মেয়ে আজ সারাদিনে অনেক জ্বালিয়েছে আমাকে। তাই দিনশেষে আমারও উচিৎ তাকে একটু জ্বালিয়ে দেওয়া। আর মজার বিষয়, সামিয়ার চোখ-মুখ দেখে তখন মনে হচ্ছিল সত্যিই সে ঈর্ষার আগুনে জ্বলে-পুড়ে যাচ্ছে!

ঠিক একই সময় সাফিন ভাইয়ের সাথে কি হচ্ছিল? ওই ঘটনাগুলো আমি স্বচক্ষে দেখিনি। কিন্তু নিহার থেকে পরে সব শুনেছিলাম। পুরো ব্যাপারটাই কৌশলে সামলে নিয়েছিল ঈশান। তারিফ ভাই স্টেজে যখন প্রথমবার সাফিন ভাইকে দেখল, তখনি বলে উঠল,” আরে, এই ছেলেটাকে আমি কোথায় যেন দেখেছি।”
ঈশান তখন বলল,” হ্যাঁ দেখেছেন। আপনার বাড়িতে।”

তারিফ ভাই চোখ বড় করে বলল,” চোরটা!”

” না, চোর না। ও আমার বেস্টফ্রেন্ড। যেই ফ্রেন্ড আমাকে জামিনে ছাড়িয়ে এনেছিল তারপর আমাকে তার গাড়ি দিয়েছে উবার ড্রাইভিং এর জন্য। যখনই আমার কোনো অসুবিধা হয়, সে ঢাল হয়ে আমার পাশে থাকে। হি ইজ দ্যা বেস্ট ম্যান।”

তারিফ ভাই আঁড়চোখে চেয়ে প্রশ্ন করল,” তাহলে আমার বাড়িতে চুরি করতে এলো কেন তোমার বেস্টম্যান?”

” আরে ভাইয়া, চুরি করতে আসেনি। ওর উদ্দেশ্য ছিল আমাকে সারপ্রাইজ দেওয়া। কিন্তু আমি যে ওইদিন আপনাদের বাড়ি ছেড়ে চলে গেছি এটা সে জানতোই না। চেয়েছিল আমার ঘরে বসে থেকে আমাকে সারপ্রাইজ দিবে। ও মানুষকে চমকে দিতে খুব ভালোবাসে। আপনাদের সবাইকেও চমকে দিয়েছিল, তাই না?”

” তোমার এই ফ্রেন্ড তো আস্তো গাঁধা। আমার সবাই তাকে চোর ভেবে কি ভয়টাই না পেয়েছিলাম।”

” গাঁধা হলেও ওর মনটা খুব ভালো। ”

” তা অবশ্য ঠিক বলেছ। এই যুগে বন্ধুকে খুশি করার জন্য কেউ এমন রিস্ক নেয়? ছেলেটা একদম সরল। ”

ঈশানের এইটুকু কাজই যথেষ্ট ছিল। তারপর ফাঁকা স্টেজে ‘বর কই’, ‘বর কই’ করে সবার মাঝে যখন হল্লা বেঁধে গেল তখন সাফিন ভাই বাধ্য হয়েই স্টেজে উপস্থিত হলো। কিন্তু তার মুখে চাপানো ছিল একটি সাদা রুমাল। মানুষ জামাইয়ের মুখে রুমাল চাপা দেখে সে কি হাসাহাসি! এগুলো অনেক পুরনো রেওয়াজ। আজ-কাল কোন জামাই মুখে রুমাল চেপে বসে থাকে? তাছাড়া ক্যামেরাম্যানও ছবি তোলার জন্য বার-বার অনুরোধ করতে লাগল রুমাল সরানোর।

নিহা ফিসফিস করে বলল,” এসব কি হচ্ছে সাফিন? প্লিজ রুমাল সরাও। তোমাকে উইয়ার্ড লাগছে।”

সাফিন ভাই দুই পাশে মাথা নাড়ল। সে রুমাল ছাড়বে না কিছুতেই। নিহা চোখ পাকিয়ে বলল,” আমি বলছি, তাও তুমি আমার কথা শুনবে না? আমার জন্য সামান্য রুমাল সরাতে পারবে না?”

সাফিন ভাই করুণ গলায় বলল,” তোমার জন্য চাইলে জান দিয়ে দিব। তাও রুমাল দিতে পারব না। প্লিজ, আমাকে ক্ষমা করে দাও।”

নিহার তখন ইচ্ছে করছিল রাগে স্টেজ ভেঙে ফেলে। সবাই হাসতে হাসতে মরে যাচ্ছে এদিকে সাফিনের যেন কোনো হেল-দোল নেই। নিহার নিজের বিয়েতেই নিজেকে কমেডিয়ান মনে হচ্ছিল। এটা কি আসলেই বিয়ের মন্ডপ নাকি কমেডি শো? বাধ্য হয়ে নিহার বাবাও সাফিন ভাইকে অনুরোধ করলেন,” মুখ থেকে রুমালটা সরাও, বাবা। মানুষ খুব হাসাহাসি করছে।”

সাফিন ভাই কাঁদো কাঁদো স্বরে বলল,” হাসাহাসি করুক আঙ্কেল। দৌড়াদৌড়ি করার চেয়ে হাসাহাসি করা বেটার অপশন।”

আঙ্কেল অবাক হয়ে বললেন,” দৌড়াদৌড়ির প্রসঙ্গ কেন এলো?”

সাফিন ভাইয়া বিপর্যস্ত কণ্ঠে বলল,” জানি না আঙ্কেল। আমাদের জীবনটাই এমন অনিশ্চিত। যা ঘটার কথা নয় তাই ঘটে যায়। যার আসার কথা নয় সে এসে সামনে দাঁড়িয়ে পড়ে। তখন দৌড়ানো ছাড়া আর উপায় থাকে না।”

আঙ্কেল বিব্রত হয়ে বললেন,” তুমি এসব কাকে ইন্ডিকেট করে বলছ?”

নিহা জবাব দিল,” আমি বুঝেছি। এই সাফিন, তুমি এখনি রুমাল সরাও।”

সাফিন ভাই অনুরোধ করে বলল,” এমন করে না নিহা। বিয়ের পর তোমার সব কথা শুনব। অন্তত আজকে তুমি আমার একটা কথা শোনো!”

নিহা নিজের আসন থেকে উঠে সাফিন ভাইয়ের সামনে দাঁড়িয়ে বলল,” আমি কিচ্ছু শুনব না। তোমাকে রুমাল সরাতেই হবে। না সরালে এমন একটা ঘুষি মারব যে নিজেও নিজেকে চিনবে না।”

সাফিন ভাই হতাশ হয়ে বলল,” সেটাই ভালো। আমিও নিজেকে চিনতে চাই না। আর আমাকে কেউ চিনুক সেটাও চাই না। তুমি বরং আমাকে ঘুষিই মারো।”

নিহা ” ধ্যাত” বলে জোর করে সাফিন ভাইয়ের হাত থেকে রুমাল কেঁড়ে নিল। সাফিন ভাই নিভু নিভু দৃষ্টি নিয়ে আশেপাশে তাকাতে লাগল। তারিফ ভাই কি তাকে দেখে নিল? এখনই কি ‘ চোর’ ‘চোর’ বলে চেঁচিয়ে তার ইজ্জতের ফালুদা করে দিবে? কিন্তু তেমন কিছু হলো না। তারিফ ভাইকে আশেপাশে দেখা গেল না। সাফিন ভাই কাঁপা বুক নিয়ে বসে রইল। কিছুক্ষণ পরেই পেছন থেকে কেউ আচমকা এসে তার কাঁধ চেপে ধরল। সাফিন ভাই পেছনে ঘুরতেই দেখল তারিফ ভাইকে। সে যেন কারেন্টের শক খাওয়ার মতো উঠে দাঁড়াল। তারিফ ভাই হাসতে হাসতে বলল,” আরে আবার দাঁড়াও কেন? বসো, বসো। তোমার কিন্তু অনেক প্রশংসা শুনেছি আমি। নিহা খুব ভাগ্যবতী যে তোমার মতো ছেলে পেয়েছে। আই জাস্ট প্রাউড অফ ইউ। ”

সাফিন ভাই হতবিহ্বলের মতো বলল,” কি?”

” কি আবার? বলো জ্বী! তোমাকে দেখার খুব ইচ্ছে ছিল ভাই। আজ ইচ্ছেটা পূরণ হয়ে গেল। এমন উদারমনের মানুষ এখনও পৃথিবীতে আছে, ভাবতেই আমার ভালো লাগে। জিও ভাই, জিও।”

তারপর তারিফ ভাই ক্যামেরামেনের দিকে ইশারা করে বলল,” ভাই, আমাদের দুইভাইয়ের একটা সুন্দর ছবি তুলে দেন তো! আমি আমার দেয়ালে বাঁধাই করে রাখব।”

সাফিন ভাইয়ের চেহারা তখন পুরো উজবুকের মতো। সে হা করে তাকিয়ে আছে। ছবিতেও তার ঠোঁট হা করা উঠল। তারিফ ভাই হেসে বলল,” এতো অবাক হওয়ার কিছু নেই। আমি তো তোমার ফ্যান!”

সাফিন ভাই হতভম্ব হয়ে বলল ” ও।”

একটু পর ভাইয়া সাফিন ভাইয়ের কানের কাছে মুখ নিয়ে বলল,” সেদিনের জন্য স্যরি। তোমাকে চিনতে পারিনি আসলে। সব ভুলে যাও৷ আমিও কিন্তু ভুলে গেছি।”

সাফিন ভাই আমতা-আমতা করে বলল,” জ্বী।”

তারিফ ভাই স্টেজ ছেড়ে চলে যাওয়ার পরেও সাফিন ভাইয়ের মাথা পুরো ফাঁকা হয়ে রইল। সে কিছুই বুঝতে পারছিল না। তারপর নিহা সাফিন ভাইকে আসল কথা জানাল। সেদিন সাফিন ভাইকে চোর বলে ঠেঙানোর জন্য ভাইয়া লজ্জিত ছিল। কয়েকবার ঝুঁকে ক্ষমাও চাইল।সাফিন ভাই ইতস্তত করে বলল,” ইটস ওকে, ইটস ওকে।”

এভাবে নিহা আর সাফিন ভাইয়ের সমস্যার সমাধান হয়ে গেল। কিন্তু আমার আর ঈশানের জন্য তখন এর চেয়েও বড় ঝামেলা অপেক্ষা করছিল। মিথ্যা মানুষের জীবনে শুধু বিপদই ডেকে আনে।পৃথিবীর একটি অসম্ভব কাজ হলো মিথ্যা দিয়ে সত্যকে ঢেকে রাখা। এই ব্যাপারটি আমরা ওইদিনই বুঝতে পারলাম। কিন্তু সেটা বুঝতেই আমাদের খুব দেরি হয়ে গেছিল।

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here