#তি_আমো
পর্ব ৪০
লিখা- Sidratul Muntaz
ফাহিম ভাইয়ের হাতে গিটার। তিনি টুংটাং শব্দ তুলছেন। কিছুক্ষণের মাঝেই গান শুরু করবেন। আমরা সবাই দূর্বাঘাসের উপর মাদুর বিছিয়ে গোল হয়ে বসে আছি। ভাইয়া গেছে মায়ের সঙ্গে দেখা করতে। বুড়িও সেদিকেই আছে। এক কথায় বড়রা সকলেই বাড়ির ভেতর। আর আমরা ছেলে-মেয়েরা বাইরে। আমাদের সামনে জামশেদ নামের যে লোকটি বসে আছেন তার হাতে বড় একটি শ্যাম্পেনের বোতল। তিনি শীতকালে এই জায়গায় আসেন আরামে ড্রিংক করতে। এখানে নাকি পাখিও শিকার করেছেন কয়েকবার। নাম শুনে তাকে মুসলিম মনে হচ্ছে। জামশেদ ইকবাল, নিঃসন্দেহে মুসলিমই হবেন। আমি ভদ্রলোককে প্রশ্ন করলাম, শিকার করা পাখি খাওয়া হারাম নাকি হালাল? কারণ শিকারের সময় তো পাখিকে জবাই করা হয় না। তাহলে এই অবস্থায় পাখি খাওয়া হালাল হবে কেন?
ভদ্রলোক আমার কাঁধে হাত রেখে বললেন,” শোনো মিষ্টি বালিকা, শিকার করা পাখি সবসময় হারাম না। শিকার মানে যেই জিনিস আমরা হ/*ত্যার উদ্দেশ্যে আক্রমণ করি। পাখি যদি তীর দিয়ে শিকার করা হয় আর তৎক্ষণাৎ সে প্রাণ হারায় তাহলে সেই পাখি অবশ্যই হারাম। কিন্তু যদি জাল বিছিয়ে রেখে শিকার করি, জীবিত অবস্থায় জবাই করা হয় তাহলে হারাম হবে কেন?”
নিহা হাত তালি বাজাল। উত্তেজনা মিশ্রিত কণ্ঠে বলল,” তাহলে জামশেদ ভাই, আমাদের আজ পাখি শিকার করে খাওয়ান না!”
জামশেদ নামক লোকটি হো হো করে হাসলেন। আমার দিকে একটু ঝুঁকে এসে বললেন,” নিশ্চয়ই খাওয়াবো।”
নিহা ইতোমধ্যে ভদ্রলোকের সাথে ভালো খাতির জমিয়ে ফেলেছে। আমি অবশ্য এর কারণটা বুঝতে পারছি। সে চায় জামশেদ সাহেব গেস্ট হাউজ বিক্রি করুক। ভাইয়া বলেছিল, জামশেদ সাহেব রাজি হবেন না। আর নিহা প্রতিজ্ঞা করেছে, সে জামশেদ সাহেবকে রাজি করিয়েই ছাড়বে। সেজন্যই ভদ্রলোকের সাথে খোশমেজাজে এতো আড্ডা দিচ্ছে সে। সময় সুযোগ বুঝে আসল কথাটা বলবে। জামশেদ নামের লোকটি অতিরিক্ত কথা বলেন। আর তিনি ভীষণ হাসি-খুশি মানুষ। ঠিক ভাইয়ার বিপরীত। শুনেছি বিপরীত দুই সত্তা মিলেই নাকি বন্ধুত্ব হয়। যেমন আমি আর নিহা একে-অপরের বিপরীত। আমি অন্তরে যা মুখেও তা। আমি কাউকে তেল দিতে পারি না। কিন্তু নিহা চরম শত্রুর সামনেও মুখে মধু মিশিয়ে কথা বলে শত্রুকে চমকে দিতে পারবে।
ঈশান দূরে বড়ই গাছের সাথে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তার চেহারা গম্ভীর। সে ফাহিম ভাইদের সাথে আড্ডাতেও বসছে না। সাফিন ভাই তাকে কয়েকবার ডাকলেন। কিন্তু সে যাচ্ছে না। কি হয়েছে মশাইয়ের? মনখারাপ নাকি? আমি জামশেদ সাহেব আর মেয়েদের আড্ডার মাঝখান থেকে উঠে ঈশানের কাছে গেলাম। ঈশান আমার উপস্থিতি টের পেয়েও আমার দিকে তাকাল না। আমি তার মনোযোগ আকর্ষণ করতে মৃদু কাশলাম। ঈশান আমার দিকে না তাকিয়েই বলল,” কোনো দরকার?”
আমি মুখ হা করে অভিমানী স্বরে বললাম,” আজব! আমি কি আপনার কাছে শুধু দরকারেই আসি?”
ঈশান শান্ত দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকাল। আমি তার মুখের কাছে চুটকি বাজিয়ে বললাম,” কি হয়েছে বলেন তো আপনার? এমন গুম হয়ে আছেন কেন? ভাইয়া আসার পর থেকেই আপনার এই অবস্থা।”
ঈশান আশেপাশে একবার দেখে নিয়ে আমার হাত ধরল। অকপটে বলল,” এদিকে এসো।”
আমি সানন্দে ঈশানের সাথে হাঁটতে লাগলাম। ঈশান মাথা নিচু করে হাঁটতে হাঁটতে বলল,” ওই লোকের সামনে তুমি আর যাবে না।”
আমি সরল হেসে জানতে চাইলাম,” কোন লোক? জামশেদ আঙ্কেলের কথা বলছেন?”
ঈশান একটু অবাক হয়ে বলল,” তোমার ভাইয়ার ফ্রেন্ড। তুমি আঙ্কেল ডাকছ কেন?”
আমি দুষ্ট হেসে বললাম,” একটু বুড়ো তো! আঙ্কেলের মতো লাগে। ”
” কিন্তু সে তোমার ভাইয়ার বয়সীই হবে।”
আমি অহংকার করে বললাম,” আমার ভাইয়া তো হিরো! ভাইয়ার মতো কয়জন হয়?”
ঈশান থেমে দাঁড়াল। দৃঢ় কণ্ঠে বলল, ” ওই লোকের তাকানোর ধরণ ভালো লাগেনি আমার। তুমি আর তার সামনে যাবে না। কথায় কথায় তোমার গায়ে হাত দিচ্ছিল।”
ঈশানের কথা শুনে আমার পেট ফেটে হাসি বেরিয়ে আসতে চাইল। নেহায়েত ঈশানের চোখমুখ রাশভারী, তাই আমি হাসার সাহস করলাম না। মুখ ফুলিয়ে বললাম,” এতো পজিসিভনেস ভালো না আবার!”
ঈশান রেগে বলল,” এটা পজিসিভনেস না তারিন। ওইখানে এতো মেয়ে ছিল। কিন্তু লোকটা তোমাকেই টেনে তার পাশে বসাবে কেন? কেন বার-বার তোমার গায়েই হাত দিবে? হোয়াট রাবিশ! ক্যান ইউ এক্সপ্লেইন!”
ঈশানের রাগ দেখে আমি হতভম্ব! হাসি-খুশি মানুষটা যে এভাবে রেগে যেতে পারে তা আমি জানতাম না। প্রশমিত কণ্ঠে বললাম,” আচ্ছা বাবা, যাবো না। সারাক্ষণ আপনার কাছে থাকব। আপনার হাত ধরে বসে থাকব। যে যা খুশি বলুক।”
ঈশান ঘাড়ত্যাড়ার মতো বলল,” সেটাও ভালো। ”
এবার আমার সত্যিই হাসি পেয়ে গেল। আমি জোরে হাসতে লাগলাম। ঈশান গম্ভীর হয়ে তাকিয়ে রইল। হঠাৎ নীরার কণ্ঠ শুনতে পেলাম। সে ঘোষণা দেওয়ার মতো সবাইকে কি যেন বলছে। আমি আর ঈশান দ্রুত হেঁটে গেলাম। নীরা ঈশানকে দেখা মাত্রই বলল,” ভাইয়া তুমি কি যাবে?”
ঈশান প্রশ্ন করল,” কোথায়?”
” মোহনা আন্টি বাড়ি ফিরে যেতে চাইছে। তার শরীর খুবই অসুস্থ। সকাল থেকেই তো বমি করছিল। রুবা আন্টি আর সিয়াম ভাইয়া উবার ডেকে এনেছে।”
ঈশান এই কথা শুনে দৌড়ে বাড়ির দিকে যেতে লাগল। আমিও তার পেছনে ছুটলাম। আমাদের সাথে নিহা, সাফিন ভাইসহ আরও অনেকে এলো। কিন্তু আমরা পৌঁছানোর আগেই মোহনা আন্টিদের গাড়ি চলে গেছে। ঈশান ভারী কণ্ঠে বলল,” শিট! কয়জন গেছে?”
রেহেনা উত্তর দিল,” রুবা আন্টি, মোহনা আন্টি আর সাজিদ আঙ্কেল।”
ঈশান বিচলিত গলায় বলল,” অদ্ভুত! আমার সাথে দেখা না করে মম চলে গেল কেন এভাবে?”
রিফাত ভাই পরামর্শ দিল,” তুই আন্টিকে ফোন করে কথা বলে নে। তাহলেই হলো।”
ঈশান চলে গেল মোহনা আন্টিকে ফোন করতে। নিহা দুশ্চিন্তাগ্রস্ত কণ্ঠে বলল,” হঠাৎ এতো অসুস্থ কেন হলো আন্টি? যে একেবারে আমার বাবা-মাকে নিয়ে বাড়ি চলে যেতে হবে?”
সিয়াম ভাই বলল,” তেমন সিরিয়াস ইস্যু না। হয়তো ভালো লাগছিল না এজন্য চলে গেছে। আমাদের থাকতে বলে গেছে।”
ঈশান ফিরে এসে বলল,” অসুস্থতা কিছু না গায়েজ। মম একদম ঠিকাছে। কিন্তু বাড়িতে নাকি কি কাজ আছে। এজন্য…”
কথার মাঝেই প্রশ্ন করল নিহা,” কি এমন কাজ?”
রিফাত ভাই বলল,” আচ্ছা বাদ দে না৷ যার যার চয়েজ। হয়তো ওয়েদারটা শ্যুট করছে না। মোহনা আন্টি তো সহজে সব জায়গায় থাকতে পারে না। তার অভ্যাস নেই।”
ব্যাপারটা নিয়ে আমরা আর মাথা ঘামালাম না। জামশেদ সাহেব আমাদের তার গেস্ট হাউজে ডিনারের দাওয়াত দিয়েছিলেন৷ যে কারণে আমাদের রাত পর্যন্ত থাকতেই হবে। আমি মায়ের কাছে গিয়ে বসলাম৷ ভাইয়া তখন সেখান থেকে চলে গেছে। আমি মাকে প্রশ্ন করলাম,” মোহনা আন্টির কি হয়েছে মা? ওভাবে চলে গেল কেন?”
মা ভ্রু কুচকে বলল,” কিছুই হয়নি। ”
” কিছু না হলে হুট করে চলে যাবে কেন? আমি আরও ভাবলাম ভাইয়া আর মোহনা আন্টি এবার একসাথে আছে। বিয়ের বিষয়ে একটু কথা-বার্তা হবে..”
আমার দিকে আঁড়চোখে তাকিয়ে মা বলল,” নির্লজ্জ হয়ে যাচ্ছিস তারু। নিজের বিয়ে নিয়ে এতো মাতামাতি ভালো না। বিয়ে যখন হওয়ার হবে।”
” হ্যাঁ বুঝেছি তো, হবে। তারপরেও কেমন যেন একটা লাগছে।”
মা একটু চিন্তিত হয়ে বলল,” তবে আমার মনে হচ্ছে জামশেদ নামের লোকটাকে পছন্দ করেনি তোর মোহনা আন্টি।”
” কেন, কেন?”
” জানি না। লোকটার কথা-বার্তা শুনিসনি? একটু আত্ম-অহংকারী ভাব। আবার বাড়ি বিক্রি নিয়েও নাকি কি ঝামেলা.. তোর মোহনা আন্টি তো এই বাড়ি আবার কিনতে চায়। কিন্তু লোকটা বিক্রি করতে চায় না। এই নিয়ে দু’জনের মাঝে আবার ঝগড়া বাঁধতো। চলে গেছে, ভালোই হয়েছে।”
আমি হেসে উঠলাম। মজা করে বললাম,” জানো মা, নিহা কিন্তু লোকটাকে হাত করার চেষ্টায় আছে। রাজি হয়ে গেলেই বাড়িটা কেনা যাবে।”
” ধূর, এসবের কোনো দরকার নেই তারু। ঘুরতে এসেছিস, ঘুরে-ফিরে চলে যা। বাড়ি কিনতে হবে কেন? আর এতোই যদি বাড়ির প্রতি মায়া তাহলে বিক্রি করল কেন?”
আমি দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললাম,” সেটা তো আমিও জানি না মা। থাক বাদ দাও৷ বড়লোকদের ব্যাপার-স্যাপার! আচ্ছা মা, তুমি জামশেদ সাহেবকে আগে থেকে চেনো?”
” হ্যাঁ চিনি৷ কেন?”
” মানে লোকটা কেমন? ভালো না খারাপ?”
মা ঠোঁট উল্টে কি যেন ভেবে বলল,” তা বলতে পারব না। কিন্তু আমার পছন্দ না।”
” কেন?”
” ওসব তোর জানার দরকার নেই।”
আমি ন্যাকামি শুরু করলাম৷ মায়ের হাত-পা ধরে বাচ্চারা যেভাবে বায়না করে সেভাবে বায়না করতে লাগলাম,” বলো না, মা। প্লিজ বলো না! ও মা, বলো না… তুমি আমার মা না..”
মা বিরক্ত হয়ে বলল,” সর তো.. যখন তুই ক্লাস এইটে পড়িস তখন এই লোক তোকে বিয়ে করার প্রস্তাব দিয়েছিল।”
কথাটা শুনে আমার চেহারার সব রঙ উধাও হয়ে গেল। আমি নিষ্প্রাণ কণ্ঠে বললাম,” সত্যি?”
” হ্যাঁ। ”
আমার পুরো শরীর এবার শিরশির করছে। যে জায়গায় লোকটা স্পর্শ করেছিল, সেই জায়গা নোংরা মনে হচ্ছে। আমি একদলা বিতৃষ্ণা নিয়ে বললাম,” এরপরেও ভাইয়া এই নোংরা লোকের সাথে বন্ধুত্ব রেখেছে?”
মা একটু থেমে বলল,” না। পরে অবশ্য সে ক্ষমা চেয়েছিল। তারপর তো সে বিদেশেই চলে গেল।এসব নিয়ে অনেক ঘটনা আছে। এখন ভুলে গেছি। যা তো.. বিরক্ত করিস না।”
আমি ছুটে ঈশানের কাছে গেলাম। বারান্দায় বেতের চেয়ারে বসে কারো সাথে কথা বলছিল ঈশান। আমি তার সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে ফিসফিস করে বললাম,” আই এম স্যরি ঈশান। তখন আপনার কথা হেসে উড়িয়ে দিয়েছি। এক্সট্রিমলি স্যরি। এখন থেকে আপনি যা বলবেন তাই শুনবো।”
ঈশান মোবাইলটা একটু হোল্ডে রেখে আমার দিকে ঘুরে প্রশ্ন করল,” কি বললে?”
আমি হাতজোড় করে মাথাটা একটু ঝুঁকিয়ে উচ্চারণ করলাম,” বলেছি আপনি গুরু। আমি শিষ্য, বুদ্ধি আমার কম।”
ঈশান আমার কথার অর্থ না বুঝে ভ্রু কুচকে চেয়ে রইল। কিন্তু আমি আর ঈশানকে মায়ের থেকে শুনে আসা গা গুলানো ঘটনাটি বললাম না। কারণ এতো সুন্দর নির্মল পরিবেশে আমি তামিল মুভির ফাইটিং সিন দেখতে চাই না।
চলবে#তি_আমো
পর্ব ৪১
লিখা- Sidratul Muntaz
সন্ধ্যায় বার-বি-কিউ পার্টি। পরিকল্পনা অনুসারে জঙ্গলে ক্যাম্প-ফায়ারের ব্যবস্থা হয়েছে। পোড়া মাংসের মশলাদার সুঘ্রাণে জমে উঠেছে পরিবেশ। আমরা মেয়েরা সবাই মাদুরে বসেছি। ছেলেরা চেয়ার-টেবিল পেতে ক্যারাম খেলছে। জামশেদ নামের লোকটি এদিকে নেই। তিনি ঘরের ভেতরে সন্ধ্যা থেকেই নেশায় বুঁদ হয়ে ঘুমিয়ে আছেন। সেজন্য নিহার মনটা খুব খারাপ। সে লোকটার সঙ্গে বাড়ির বিষয়ে কথাই বলতে পারেনি। আমি নিহাকে সান্ত্বনা দেওয়ার জন্যে বললাম,” থাক, মনখারাপ করিস না৷ এখন থেকে তো তুই এখানেই মানে সিলেটেই থাকবি। যখন ইচ্ছা এই গেস্ট হাউজে চলে আসতে পারবি। আর লোকটার সঙ্গে দেখা করাও তেমন কঠিন কাজ হবে না।”
নিহা দ্বিধান্বিত স্বরে বলল,” কিন্তু তারিফ ভাই বলছেন এই লোক নাকি জার্মানি থাকেন। একবার চলে গেলে বছরের পর বছর কেটে গেলেও আসেন না। কালও নাকি চলে যাবেন। এই লোকটাকে এখানে রাখার ব্যবস্থা কর না, তারু!”
” আমি কিভাবে ব্যবস্থা করব? আমি বললেই কি এই লোক এখানে থেকে যাবে? আজব!”
অবজ্ঞার সুরে কথাটি বলে জুসের গ্লাসে চুমুক দিলাম। নিহা ঠোঁট উল্টে কিছু একটা চিন্তা করছিল। হঠাৎ ফট করে বলে উঠল,” আইডিয়া পেয়েছি। তুই বিয়ে কর।”
নিহার কথায় আমি বিষম খেলাম। নাকে জুস ঢুকে এতো জোরে কাশি পেতে লাগল যে চোখমুখ লাল হয়ে এলো। নিহা আমার মাথায় আলতো দু-একটা চাপড় মেরে দিল। আমি তার হাত সরিয়ে রোষাবিষ্ট কণ্ঠে বললাম,” তুই কি বললি আমাকে এটা? ওই বুড়ো ভামকে আমি বিয়ে করব? ছিঃ! এতো ফালতু কথা তুই আমার সাথে কিভাবে বলতে পারলি?”
আমার রেগে যাওয়া দেখে নিহা ভ্যাবাচেকা খেল। কয়েক মুহূর্ত হাঁ করে চেয়ে থেকে পানসে কণ্ঠে বলল,” যা বাবা, আমি তোকে ওই ব্যাটাকে বিয়ে করতে বলব কেন আজব! আমি বলেছি তুই আর ঈশান ভাই বিয়ে কর। তাহলে ওই লোক তোদের বিয়ে উপলক্ষ্যে থেকে যাবে। কাল সকালে তার যাওয়াটা ক্যান্সেল হবে আর কি!”
আমি শান্ত হলাম। মৃদু কণ্ঠে বললাম,” ও আচ্ছা। তো এটা বুঝিয়ে বলবি না?”
” বুঝিয়ে বলার কি আছে? আমি কি জানি তোর চিন্তা-ধারায় যে এমন গলদ? ওই বুইড়া ব্যাটার সাথে আমি তোকে বিয়ে করতে কেন বলব? কি আজব!”
আমাদের কথা-বার্তা শুনে বাকিরা হাসতে লাগল। আমি লজ্জিত ভঙ্গিতে জুসের গ্লাসে চুমুক দিলাম। রেহেনা বলল,” নিহার আইডিয়াটা কিন্তু খারাপ না তারু। তোমরা যেহেতু বিয়ে করবেই, এই সিলেটেই বিয়ে করে ফেলছ না কেন? ঈশান ভাইও তোমাকে প্রপোজ করে দিল। আবার তোমার ভাইয়াও চলে এলো। আমরা সবাই এখানে আছি। তাহলে বিয়ে করতে প্রবলেম কি?”
আমি হাসার ভাণ ধরে সংকুচিত কণ্ঠে বললাম,” আমার তো কোনো প্রবলেম নেই। এখন বড়রা যদি বিয়ের ব্যাপারে কিছু না বলে তাহলে আমার কি করার আছে বলো?”
আমার বেখেয়ালে বলা এই কথাতেই সবার মাঝে হল্লা-হল্লি শুরু হলো। সবাই উৎসাহী ভঙ্গিতে চিৎকার করে উঠল। নিহা আমার কাঁধে ধাক্কা দিয়ে বলল,” এইবার বুঝেছি। তুই তাহলে লজ্জায় তারিফ ভাইকে বিয়ের কথা বলতে পারছিস না, তাইতো? আরে এটা আমাকে বললেই হতো! আমি আছি তো! আমি থাকতে তোর এতো চিন্তা কিসের?”
আমি বিপর্যস্ত কণ্ঠে প্রশ্ন করলাম,” তুই আছিস মানে? কি করবি তুই?”
” তারিফ ভাইয়ের সাথে কথা বলবো।”
আমি আতঙ্কিত হয়ে উঠলাম। সঙ্গে সঙ্গে নিহার হাত চেপে ধরে অনুরোধ করলাম,” এসব করার দরকার নেই। ভাইয়া ভাববে আমি তোকে শিখিয়ে দিয়েছি।”
নিহা আমার হাত ছাড়িয়ে বলল,” তোর ভাইয়া এমন কিছু ভাববে না। আমি সেভাবেই বলব। টেনশন নট মাই ডার্লিং!”
আমি আগেও বলেছিলাম, নিহা একবার যেটা বলে সেটা করেই ছাড়ে। পৃথিবীর সব ধরণের পাগলামির কাজ এই মেয়ের পক্ষে সম্ভব। ভাইয়াকেও সে রাজি করিয়েই ছাড়ল। নিহার কথা-বার্তা আর যুক্তি শুনে ভাইয়া সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল আগামীকাল এই গেস্ট হাউজেই আমার গায়ে হলুদ আর মেহেন্দীর অনুষ্ঠান হবে। এই খবর শুনে সবাই উল্লাসে চিৎকার দিল। ছেলেরা ‘ওয়াও’ বলে করতালি বাজাতে লাগল। আমাকে আর ঈশানকে ‘অভিনন্দন’ জানানো হলো। কিন্তু এতোকিছুর মাঝে বাঁধ সাধল ঈশান। ভদ্র কণ্ঠে সে বলল,” কিন্তু মম তো এখানে নেই। ”
তারিফ ভাই ঈশানের দিকে চেয়ে সন্দিহান গলায় বলল,” তোমার মম বিয়েতে রাজি আছে তো?”
ঈশান উত্তর দেওয়ার আগেই পেছন থেকে অতি উৎসাহ নিয়ে জবাব দিল রিফাত ভাই,” রাজি মানে? অনেক বেশি রাজি। আপনার অপেক্ষাতেই তো মোহনা আন্টি দেরি করছিলেন। নাহলে তিনি নিজেই বিয়ে দিয়ে দিতেন ওদের। ”
তারিফ ভাইয়া সহজ হেসে বলল,” আমার অপেক্ষাতেই যদি থাকেন.. তাহলে তিনি চলে যাবেন কেন?”
আমরা সবাই চুপ হয়ে গেলাম। ঈশান বিব্রত কণ্ঠে বলল,” ইমারজেন্সী ছিল হয়তো। মম অসুস্থ হয়ে পড়েছিল।”
তারিফ ভাইয়া সোজাসাপ্টা গলায় বলল,” তুমি এখন কি করতে চাও ঈশান?”
” আমার মনে হয় মমের সাথে ডিসকাস করে নিলে ভালো হতো। ভাইয়া, আমি মমকে ফোন করে আপনার সাথে কথা বলতে বলি?”
” দরকার নেই। তুমি তোমার মমকে এখানে আসতে বলো।”
ঈশান ফোন করার পরেও মোহনা আন্টি আসতে রাজি হলেন না। কিন্তু তিনি অনুষ্ঠান করার অনুমতি দিলেন। আমি বললাম,” এটা কিভাবে হয় ঈশান? মোহনা আন্টিকে ছাড়া আমরা কিভাবে অনুষ্ঠান করব? তিনি কেন আসবেন না? যদি তিনি না আসেন তাহলে আমরা সবাই ওই বাড়িতে যাবো। অনুষ্ঠান সেখানে হবে।”
তারিফ ভাইয়া বাঁজখাই গলায় বলল,” না। অনুষ্ঠান এখানেই হবে। এটাই একদম পারফেক্ট প্লেস। ছবি তোলার জন্যেও বেস্ট এই জায়গা।”
” তাহলে মোহনা আন্টি?”
ঈশান আমার দিকে তাকিয়ে বলল,” আমি ঠিক করেছি সকালে গিয়ে মমকে নিয়ে আসব। ”
আমি আগ্রহী গলায় বললাম,” তাহলে আমিও আপনার সঙ্গে যাবো।”
নিহা হাত তালি বাজিয়ে বলল,” প্রবলেম তাহলে সোলভ। আজকে রাতে আমরা এখানেই থাকছি। ইয়ে!”
নীরা উল্লাসিত কণ্ঠে বলল,” সাচ আ বিউটিফুল প্লেস! আমার অনেক খুশি লাগছে..”
নিহা নীরাকে জড়িয়ে ধরে ফিসফিসিয়ে বলল,” এই বিউটিফুল প্লেস খুব জলদি আমাদের হবে।”
নীরা করুণ গলায় বলল,” ইনশাআল্লাহ। ”
আমি তাদের কথা শুনে হাসছিলাম। কিন্তু মনে মনে একটা দুশ্চিন্তা কাজ করছিল। আমি জানি, ঈশানও আমার মতো দুশ্চিন্তায় আছে। মোহনা আন্টি হুট করে চলে গেলেন। তিনি অনুষ্ঠানেও আসতে চাইছেন না। সবকিছুর পেছনেই জামশেদ নামক লোকটার হাত আছে বলে আমার মনে হয়। কিন্তু এই ব্যাপারটা আমি ঈশানকে বলতে পারছি না। কারণ এমনিতেই সে লোকটার উপর ক্ষেপে আছে।
আমি বাড়ির ভেতরে ঢুকে একটা ফাঁকা ঘরে বসলাম। ছোট্ট বিছানার পাশে ল্যাম্পশেড আর টেবিল। টেবিলের উপর সিগারেটের কিছু প্যাকেট আর মোবাইল ফোন। এগুলো ভাইয়ার জিনিসপত্র। কিছুক্ষণ আগেও ভাইয়া এখানে ছিল। আমি বাথরুম থেকে বের হতেই মনে হলো, মোহনা আন্টিকে এখন একটা ফোন করা উচিৎ। হতে পারে তিনি আমাকে কিছু বলবেন।
যেই মানুষটি আমার আর ঈশানের বিয়ে নিয়ে এতো উৎসাহী ছিলেন তিনি হঠাৎ অনুষ্ঠানেই আসতে চাইছেন না। কেন? একটা বড়সড় ঘাপলা তো আছেই। আর আমি নিশ্চিত, জামশেদ নামক লোকটিই সকল সমস্যার মূল। এই বিষয়ে কি আমি সরাসরি মোহনা আন্টিকে প্রশ্ন করব? কিন্তু তিনি যদি রেগে যান? মোহনা আন্টি ঈশানের মতো রাগবেন বলে মনে হয় না। তিনি তো খুব নরম স্বভাবের।
আমার মোবাইলে ব্যালেন্স ছিল না। তাই আমি ভাইয়ার মোবাইল নিয়ে মোহনা আন্টির নাম্বারটা ডায়াললিস্টে তুলে নিলাম। তারপর যেটা দেখলাম সেটা নিতান্তই অবিশ্বাস্য একটি ব্যাপার। আমার দুনিয়া থমকে গেল এক মুহূর্তের জন্য। মনে হলো, আমি বুঝি কোনো দুঃস্বপ্ন দেখছি। বুকের মধ্যে অগ্নিকুন্ডের মতো কিছু একটা বিঁধে গলা অবধি উঠে এলো। ভাইয়ার ফোনে মোহনা আন্টির নাম্বার আগে থেকেই সেইভ করা। আমি স্তব্ধ হলাম নামটি দেখে। মাধবীলতা! আমার চোখের সামনে নাম্বারটা আমি দুইবার মিলিয়ে নিলাম। হ্যাঁ, এটাই মোহনা আন্টির নাম্বার। আমাদের কাছে যিনি মোহনা আন্টি, ভাইয়ার কাছে তিনি মাধবীলতা। কিন্তু এটা কি করে সম্ভব? আমি স্তব্ধ হয়ে বসে রইলাম কিয়ৎক্ষণ।
আমাদের জীবনে কত-শত অদ্ভুত ঘটনা ঘটে যায়। কিন্তু তাই বলে বুঝি নিয়তিকে এতোটাই নিষ্ঠুর হতে হবে! যে মেয়েটির জন্য ভাইয়া পনেরো বছর আগে ত্যাগ করেছিল সব সুখ, স্বপ্ন, আশা, সেই মেয়েটিই মোহনা আন্টি! আমার চোখ থেকে একফোঁটা জল অচিরেই গড়িয়ে পড়ল। মিশে গেল ফোনের স্ক্রিনে।
চলবে