তি আমো পর্ব -৪২+৪৩

#তি_আমো
পর্ব ৪২
লিখা- Sidratul Muntaz

উপরের দ্বিতীয় বেডরুমে বুড়ি আর ফাহিম ভাই জমিয়ে গল্প করছে। এই বাড়িতে যে কেয়ার টেকারের পরিবার থাকেন, তাদের সঙ্গে সময় কাটাচ্ছে মা। ডিনারের আয়োজনও করছে মা। মাঝে মাঝে রেহেনা অথবা নীরা এসে মাকে সাহায্য করছে। আনিকা আর সামিয়া ইউটিউবে ভ্লগ তৈরী করতে ব্যস্ত। তারা কিছুক্ষণ আগে বাইরেও যেতে চেয়েছিল; সিয়াম ভাইয়া আর রিফাত ভাইয়াকে নিয়ে। কিন্তু তারিফ ভাই নিষেধ করে দিল। পরামর্শ দিল সকালে যাওয়ার। এই নিয়ে মুখ ফুলিয়ে বসে আছে আনিকা আর সামিয়া। তারা ভাইয়াকে একদম সহ্য করতে পারছে না। যেমনটা আমাকেও সহ্য করতে পারে না।

বুড়ি যে ঘরে বসেছিল, আমি সেখানে গেলাম৷ ফাহিম ভাই বুড়ির সাথে তার মেয়ে বেস্টফ্রেন্ডের বিষয়ে গল্প বলছে। আর বুড়ি সেই মেয়েটিকে গালা-গাল দিয়ে চৌদ্দ গুষ্টি উদ্ধার করছে। মেয়েটি নাকি ফাহিম ভাইয়ের সরলতার সুযোগ নিয়ে অনেক টাকা হাতিয়েছে, প্রতারণা করেছে। তারপর হুট করেই যোগাযোগ বন্ধ করে শহর ছেড়ে পালিয়ে গেছে। কিন্তু সৌভাগ্যবশত ফাহিম ভাই মেয়েটির প্রেমে পড়েনি। যদি প্রেমে পড়তো তাহলে নির্ঘাত একটা জটিল ছ্যাঁকা খেতো। বুড়ি আনন্দিত গলায় বলল,” আলহামদুলিল্লাহ! ভালা করছ ওই ছেড়ির লাইগা পাগল হওনাই। এসব নইট্টা ছেড়িগো তো কামই এমন। ব্যাডা ধরবো, তারপর টাকা-পয়সা হাতায় লইয়া ভাগবো। আর এইসব নইট্টা ছেড়িগো লগে মিশবা না। এডি একদম ভালা না।”

ফাহিম ভাই গর্ব করে বলল,” সেই মেয়ে আমাকে আবারও ফোন দিয়েছিল। সে নাকি ঢাকায় এসেছে, দেখা করতে চায়। আমি ব্লক করে দিয়েছি। ঠিক করেছি না দাদী মা?”

” একদম ঠিকই আছে। ফাস্ট কেলাস কাম করছ। তুমি খুব ভালা পোলা। এসব নইট্টা ছেড়িগো পিছে ঘুইরা সময় নষ্ট করনের কাম নাই। তুমি একটা লক্ষী মন্ত মাইয়া দেইকখা বিয়া করবা। আমার নাতনির বিয়া ঠিক না হইলে তোমার লগেই বিয়া দিতাম।”

ফাহিম ভাইয়ের চেহারা আরক্ত হলো। লজ্জিত কণ্ঠে খানিকটা আক্ষেপ মিশিয়ে বললেন,” সেই সৌভাগ্য আমার নেই। আপনি যে বলেছেন এটাই অনেক।”

আমি ভেতরে ঢুকে কাশলাম। ফাহিম ভাই আমাকে দেখেই প্রসঙ্গ ঘুরানোর উদ্দেশ্যে বলল, ” আরে তারু। আসো, বসো না! তোমার দাদীকে কোম্পানি দিচ্ছিলাম৷ একা একা বসে আছেন। বললাম আমাদের সঙ্গে নিচে চলেন.. বার-বি-কিউ পার্টি হচ্ছে। কিন্তু তিনি যাবেন না। পোড়া মাংসের গন্ধ নাকি তিনি শুনতেই পারেন না।”

আমি মুচকি হাসলাম। বুড়ি সন্দিহান কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল,” তুই কি কিছু কবিনি? বয় আমগো লগে..”

আমি দ্বিধাভরা গলায় আওড়ালাম,” তোমার সাথে একটু কথা ছিল দাদী..”

আমি আমার দাদীর সাথে আলাদা কথা বলতে চাই, ফাহিম ভাই বিষয়টা বুঝে নিল। সে সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাঁড়িয়ে বলল,” আমাকে মনে হয় কেউ ডাকছে। নীরা অথবা সামিয়া হবে.. আমি আসছি।”

ফাহিম ভাই চলে যেতেই আমি উদগ্রীব হয়ে বুড়ির সামনে হাঁটু গেঁড়ে বসলাম। বিচলিত গলায় প্রশ্নের পর প্রশ্ন করতে লাগলাম,” দাদী, বলো না দাদী! ভাইয়া যে মেয়েটিকে ভালোবাসতো সেই মেয়েটি এখন কোথায়? সে কেন ভাইয়াকে ছেড়ে চলে গেল? ভাইয়া সেই মেয়েটিকে ফেরানোর চেষ্টা করেনি? ভাইয়া কি তাকে এখনও মনে করে?”

বুড়ির আমার প্রশ্নগুলো সাথে সাথে বুঝল না। ভ্রু কুচকে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে বলল,” কার কথা কস?”

আমি ভারী কণ্ঠে উচ্চারণ করলাম,” ওইযে.. মাধবীলতা!”

বুড়ির চোখে ক্রোধের আগুন জ্বলে উঠল। খিটমিট করে বলে উঠল,” ওই নডির কথা আমারে জিগাইতে আইছোস? সর সামনের থেকা। এসব কইলেও মুখ নোংরা হয়া যাইবো। ছি, ছি, ছি!”

আমি করুণ গলায় বললাম,” তুমি তাকে এতো ঘৃণা কেন করো দাদী?”

” ঘিন্না করমু না তো কি করমু? ওই নডি তো একটা ডাইনি। আমগো সংসারটা ধংস কইরা সাড়ছে৷ ওই নডির লাইগাই তোর বাপে মরছে। তোর ভাইয়ের জীবনটা কি হইছে দেখছোসনি? সব ওই ডাইনির লাইগা। পাগল করব এক পোলারে, বিয়া করব আরেক ব্যাডারে। নইট্টাগিরির একশেষ! ”

” কিভাবে হয়েছিল এসব? আমাকে বলো!”

” এতো কথা আমি জানি না। এডি আমি কইতে চাই না। তুই হঠাৎ আজকা এডি জিগাইতাছোস ক্যান? কি হইছে তোর? আয়েশা, আয়েশা, জলদি এদিকে আয়ো।”

আমার কলিজার পানি শুকিয়ে গেল। উতলা হয়ে বললাম,” মাকে ডাকছ কেন?”

” তুই এডি কইত্তে শুনছোস? তর মায়রে জিগামু।”

” মা কিছু জানে না। তোমরাই আগে বলা-বলি করতে। আমি শুনেছিলাম, সব মনেও আছে আমার। শুধু মাধবীলতা নামটা মনে পড়ছিল না। আজকে ভাইয়ার ফোনে…”

আমি থামলাম। আত্মার আকৃতি ছোট হয়ে গেল। জোরে জোরে লাফাতে লাগল হৃৎপিন্ড। বুড়ি বিস্মিত দৃষ্টিতে বলল,” ওই ছেড়ির লগে আইজও কথা হয় তারিফের? এল্লিগাই তো পোলা এহনো বিয়া করে না..”

আমি দ্রুত বললাম,” না। ভাইয়া কথা বলে না। আমি তো..”

বুড়ি আমার কথা না শুনেই চেঁচামেচি শুরু করল। আমি ভাবতেও পারিনি যে বিষয়টা এতো বিপজ্জনক হয়ে যাবে। মা ছুটে এলো। বিচলিত গলায় জিজ্ঞেস করল,” কি হয়েছে?”

বুড়ি রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে মাকে বলল সবকথা। মা আমার দিকে গরম দৃষ্টিতে তাকাল। আমি মাথা নিচু করে ফেললাম। মা বুড়িকে শান্ত করে আমার হাত ধরে বলল,” এদিকে আয় তারু।”

বুড়ি বাঁজখাই গলায় বলল,” ওরে বোঝাও। ওই ডাইনির নাম যেন আর কখনও আমার সামনে না লয়। তাইলে ওরে আমি চড় মাইরা বয়রা বানায় দিমু। বেদ্দব!”

আমি ভয়ে শিটিয়ে গেলাম। মা আমাকে নিয়ে দ্রুত অন্যঘরে এলো। তারপর দরজা বন্ধ করেই প্রশ্ন করল,” এসব কি তারু? তুই হঠাৎ মাধবীলতার কথা কেন জিজ্ঞেস করলি তোর দাদীকে? তুই জানিস না তোর দাদী যে ওই মেয়ের নাম শুনতে পারে না?”

আমি কাঁদো কাঁদো স্বরে বললাম,” ওই মেয়ের তো কোনো দোষ ছিল না, মা। তোমরা শুধু শুধুই তাকে এতো ঘৃণা করো।”

মা আক্রমণাত্মক ভঙ্গিতে আমার দিকে এগিয়ে এলো। আমি পিছিয়ে গেলাম। মা কটমট করে বলল,” আমার থেকে বেশি জানিস তুই? কে বলেছে ওই মেয়ের দোষ ছিল না?ওই মেয়ের জন্য আমার তারিফের জীবনটাই ছাড়খাড় হয়ে গেছে। আজ পর্যন্ত তারিফ বিয়ে করেনি এমনকি সে বিয়ের কথাও শুনতে চায় না। ভালোবাসার উপর থেকে বিশ্বাস উঠে যাওয়ার মানে বুঝিস?”

আমি রুদ্ধ কণ্ঠে বললাম,” মা, তুমি কি জানো ওই মেয়েটি কে?”

” জানি। তোর মোহনা আন্টি।”

মায়ের কণ্ঠ একদম নির্বিকার। আমি বিস্ময়ের সুরে বললাম,” তুমি সব জানো?”

” জানব না কেন? তারিফ আমাকে না বলে থাকেনি।”

আমি কাঁদতে শুরু করলাম৷ মা নিশ্চুপ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। আমি কাঁদতে কাঁদতে নুইয়ে পড়েছি। হঠাৎ মাথা তুলে জানতে চাইলাম,” ভাইয়া কি তাহলে এজন্যই নিহাদের বাড়ি থেকে চলে গিয়েছিল সেদিন? আমাদের কাউকে কিছু না জানিয়ে এভাবে এতোদিন যোগাযোগ বন্ধ করে রাখল এজন্য?”

” হ্যাঁ। ”

” তুমি তাহলে সব জানতে? তাহলে ভাইয়াকে নিয়ে দুশ্চিন্তা করছিলে কেন? আমাকে কেন জিজ্ঞেস করলে ভাইয়া কোথায়?”

” আমি পরে জানতে পেরেছি।সিলেট আসার জন্য যেদিন আমরা বাসে উঠব সেদিন সন্ধ্যায় তারিফ আমাকে ফোন করেছিল। তারপর সবকিছু বলেছে।”

আমার মনে পড়ল, সিলেট আসার আগে মায়ের মনখারাপ ছিল। বাসে এতো মজার মজার কান্ড হয়েছে। কিন্তু মা একটুও হাসেনি। আমি কেন তখন খেয়াল করলাম না ব্যাপারগুলো?

আমি উঠে দাঁড়িয়ে বললাম,” তাহলে এতোদিন কেন ভাইয়া চুপ ছিল? সেদিনই কেন তোমাকে বলল?”

” এতোদিন বলবে কি করে? সে তো আগে মোহনাকে চিনতে পারেনি। আমিও চিনতে পারিনি। কোনোদিন দেখা হয়েছিল নাকি তাদের?”

আমি বাকরুদ্ধ হয়ে তাকিয়ে রইলাম৷ মা বলে যেতে লাগল,

” পনেরো বছর আগের ঘটনা তারু। অনেক সময়। তখন তোদের মতো এমন ইউটিউব, ফেসবুক ছিল না। মানুষ এক জেলার থেকে অন্য জেলার মানুষের সাথে ফোনেই কথা বলতো। তারিফের সাথে মোহনার যোগাযোগ হয় কল সেন্টারের মাধ্যমে। তোর ভাই চাকরি করতো সেখানে। মোহনাই তাকে বার-বার ফোন করতো। তারপর ধীরে ধীরে তাদের প্রেম হয়। তারিফ সবই বলতো আমাকে। আমি ভেবেছিলাম ব্যাপারটা শুধুই টাইমপাস। কিন্তু তোর ভাই যে ওই মেয়ের জন্য এমন পাগল হয়ে যাবে সেটা আমি কি করে বুঝব? মোহনার বাড়িতে তখন বিয়ের কথা চলছিল। মোহনা একদিন বলল, তার যেকোনো সময় বিয়ে হয়ে যেতে পারে। তারিফ তখন মাত্র ইউনিভার্সিটিতে উঠেছে। বয়স বিশ কি একুশ। হঠাৎ আমায় এসে বলল,’ মা আমি বিয়ে করব। সিলেট যাচ্ছি বউ আনতে। দোয়া করো আমার জন্য।’ সেদিন আমার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল। তুই তখন অনেক ছোট। তোর বাবা অসুস্থ। তোর দাদী এসব শুনলে আমাকে ঘর থেকেই বের করে দিবে। আমি মহাবিপদে পড়ে গেলাম। সারাটি রাত তাহাজ্জুদ পড়ে আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করতাম যেন আমার ছেলেটা ফিরে আসে। ”

আমি চুপচাপ চোখের জল ফেলছি। কারণ এরপরের ঘটনাগুলো আমার জানা। ভাইয়া ঠিকই ফিরে এসেছিল৷ কিন্তু বহুদিন পর। ততদিনে ভাইয়ার নামে নিখোঁজ বিজ্ঞপ্তিও দেওয়া শুরু হয়েছে। বাবা ভাইয়ার শোকে স্ট্রোক করে মারা গেলেন। আমাদের পুরো পরিবারের অবস্থা দেউলিয়া। আমরা তো আশা ছেড়েই দিয়েছিলাম৷ তারপর হঠাৎ করেই একদিন ভাইয়া উপস্থিত হলো। কাঁদতে কাঁদতে মাকে জড়িয়ে ধরে ভাইয়া শুধু একটা কথাই বলেছিল,” তারা অনেক বড়লোক মা। আমি তার যোগ্য না। কোনোদিন হতে পারব না। ”

সেদিন ভাইয়া কি ভীষণ কান্নাটাই না করেছিল! সেটাই ছিল ভাইয়ার শেষ কান্না৷ এরপর আর কোনোদিন ভাইয়াকে আমি কাঁদতে দেখিনি। কি আশ্চর্য! যে মেয়েটিকে ভাইয়া জীবনে কোনোদিন চোখের দেখা দেখল না তার শোক নিয়েই কাটিয়ে দিল পনেরোটি বছর। আর নিয়তি এতোই নির্মম যে, তাদের সত্যিই দেখা হলো। কিন্তু এমনভাবেই দেখাটা হলো কেন? যেই মুহূর্তে ভাইয়া বুঝতে পারল মোহনা আন্টিই মাধবীলতা, ঠিক সেই মুহূর্তে ভাইয়া সবকিছু ছেড়ে-ছুড়ে পালিয়ে গেল। সেদিন আমি আর ঈশান ভাইয়াকে গাড়িতে তুলে দিতে গিয়ে একবারের জন্যেও বুঝতে পারলাম না যে ভাইয়া কতটা চাপা কষ্ট নিয়ে পালিয়ে যাচ্ছে। এমনকি ঈশানই ভাইয়ার মাধবীলতার ছেলে এই কথা শুনে ভাইয়া কত কষ্ট পেয়েছিল কে জানে! তবুও ভাইয়া আমাদের বিয়ের অনুমতি দিয়েছে। অন্যকেউ হলে কি দিতো? এই মুহূর্তে আমি ভাইয়ার প্রতি কতটা শ্রদ্ধাবোধ করছি তা আমি নিজেও জানি না৷ একই সাথে ভাইয়ার জন্য আমার বুক পুড়ে যাচ্ছে। ইশ, তখন যদি ভাইয়াকে একবার আটকানো যেতো! অবশ্য আটকে রেখেই বা কি হতো? কষ্ট ছাড়া আর কি পেতো ভাইয়া? তখন আমি ঈশানকে পাওয়ার খুশিতে অন্ধ ছিলাম। তাই ভাইয়ার চোখের নিদারুণ কষ্ট দেখেও দেখিনি। এখনও কি আমার অন্ধ হয়ে থাকা উচিৎ?

আমি চোখের জল মুছতে মুছতে বললাম,” মা, তুমি তো জানো মোহনা আন্টির সাথে ঈমান আঙ্কেলের ডিভোর্স হয়ে গেছে। মোহনা আন্টি কখনোই ঈমান আঙ্কলকে মানতে পারেনি। কারণ সে ভাইয়াকে ভালোবাসে!”

মা তাচ্ছিল্যের হাসি হাসল। ভর্ৎসনার সুরে বলল,” এসব ফালতু কথা বলিস না তারু। সে তারিফকে ভালোবাসলে ওই লোককে বিয়ে করল কেন? তোর ভাইকে দূর দূর করে তাড়িয়ে দিল কেন? তার সামনে পর্যন্ত এলো না। মোহনার বাবা তোর ভাইকে কুকুরের মতো অপমান করেছিল। সব ভুলেও আমি ঈশানের সাথে তোর বিয়েতে মত দিয়েছি কেন জানিস? কারণ তারিফের মতো তোর পরিণতি হোক সেটা মা হয়ে আমি কিভাবে চাইব?”

মায়ের দৃষ্টি সিক্ত হয়ে এলো। আমার বিশ্বাস হচ্ছে না। মাথা ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। মোহনা আন্টি এমন করতেই পারেন না! তিনি কত কোমল, স্নেহময়ী, তিনি আমার ভাইয়ার সাথে এতো নিষ্ঠুর আচরণ কিভাবে করলেন? আমি খুব কাঁদলাম। কাঁদতে কাঁদতে আমার মাথা ধরে গেল। ফাঁকা একটা ঘরে আমি দরজা বন্ধ করে লাইট নিভিয়ে শুয়ে রইলাম। সবকিছু অসহ্য লাগছে। কারো সঙ্গে কথাও বলতে ইচ্ছে করছে না।

মোহনা আন্টির প্রতি এতোদিন আমার যত ভালোবাসা আর শ্রদ্ধা ছিল, সবকিছু ধীরে ধীরে বিলীন হয়ে যাচ্ছে যেন। আমি ভাইয়ার দুঃখে দুঃখবিলাস করছি। আর মোহনা আন্টির প্রতি অভিমানে আমার চোখ দিয়ে অহর্নিশ অশ্রুপাত হচ্ছে। আচ্ছা, মোহনা আন্টি যদি ভাইয়াকে ভালো না বাসে তাহলে কেন সেদিন আমাকে বলল, তিনি কারো জন্য অপেক্ষায় ছিলেন! অপেক্ষা কষ্টকর! ভাইয়া তো তার কাছে এসেছিল। তবুও সে কেন বলল, তার অপেক্ষা শেষ হয়নি? ভাইয়া আর মোহনা আন্টি ঝগড়ার পর হুট করেই যখন শান্ত হয়ে গেল তখনি খটকা লেগেছিল, বিশাল কিছু একটা ঘটে গেছে তাদের মাঝে। এখন আমি বুঝতে পারছি সেই বিশাল কিছুটা কি! হয়তো তখন মোহনা আন্টি ভাইয়ার ফোনে নাম্বার লিখতে গিয়েই খুঁজে পেয়েছিল নিজের নাম! ভাইয়াও বুঝতে পেরেছিল সব। তারপর দু’জন আর একটা শব্দও করল না। নিঃশব্দে একে-অন্য থেকে দূরত্ব বাড়িয়ে নিল। আমি যখন মোহনা আন্টিকে সবকিছু বলতে গেলাম, তখন তিনি আমাকে জড়িয়ে ধরে কিভাবে ফুঁপিয়ে কাঁদছিলেন! সেটা কি অপরাধবোধের কান্না ছিল? নাকি ভাইয়াকে তিনি এখনও ভালোবাসেন?

দরজায় খটখট শব্দ হচ্ছে। আমি কান্না মুছে গলা পরিষ্কার করে বললাম,” কে?”

” আমি।” ভরাট কণ্ঠে শব্দ এলো। ঈশানের গলা। আমার বুকটা ধ্বক করে উঠল। এই মুহূর্তে ঈশানের সামনে যেতে ইচ্ছে করছে না। সে যদি আমাকে প্রশ্ন করে কেন কাঁদছি? তখন কি উত্তর দিবো? আমি তার চোখের দিকে তাকিয়ে মিথ্যা বলতেই পারব না। সে সব বুঝে ফেলবে! ভয়ে বুকে কম্পন সৃষ্টি হলো আমার। ওইপাশ থেকে দরজায় খটখট শব্দ তুলে আবার ডাকল ঈশান,

” তারিন দরজা খোলো। অনেকক্ষণ ধরে ঘরে বসে আছো। কি হয়েছে তোমার? শরীর খারাপ নাকি?”

‘ বেশি বেশি লেখা কমেন্ট করুন সবাই। পেইজের রিচ একদম কমে গেছে। কেউ পর্ব পায় না।’🥺

চলবে#তি_আমো
পর্ব ৪৩
লিখা- Sidratul Muntaz

” তারিন দরজা খোলো। অনেকক্ষণ ধরে ঘরে বসে আছো। শরীর খারাপ নাকি?”

” আমার মাথা ব্যথা করছে। ”

” হঠাৎ মাথাব্যথা কেন? মেডিসিন নিয়েছো?”

” না, এমনি শুয়ে আছি। সেরে যাবে।”

” দরজা খোলো।”

আমি চোখ-মুখ ঠিক করে মুছে নিয়ে দরজা খুলতে গেলাম। ঈশানের সামনে আমাকে একদম স্বাভাবিক থাকতে হবে; যেন বুঝতেই না পারে আমি কাঁদছি।দরজা খোলার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই ঈশান আমাকে দেখে বলল,” কাঁদছিলে নাকি?”

আমি মনে মনে আৎকে উঠলেও স্বাভাবিক কণ্ঠে বলার চেষ্টা করলাম,” কই, নাতো!”

ঈশান একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। তার গাঢ় কৌতুহলের সামনে অসহায় হয়ে আমি বাধ্য কণ্ঠে বললাম,” দাদী বকেছে।”

ঈশান এই কথা শুনে হেসে উঠল। আমি বেকুব হয়ে গেলাম৷ দাদী বকেছে এটা কি কাঁদার কোনো বিষয় হলো? ঈশান আমার চেহারার বিমর্ষতা লক্ষ্য করে হাসি থামিয়ে প্রশ্ন করল,” কেন বকেছে?”

আমি দরজার সামনে থেকে বিছানায় এসে বসলাম। যাক, ঈশান কথাটা বিশ্বাস করেছে। স্বস্তির নিশ্বাস ছেড়ে বললাম,” পরে বলব।”

ঈশান আমার পাশে এসে বসল। আমি তার চোখের দিকে ইচ্ছাকৃতই তাকালাম না। মাথা নুইয়ে চুপচাপ বসে আছি। একটু পর ঈশান আবার বলল,” মন কি বেশি খারাপ?”

আমি ঠান্ডা কণ্ঠে জবাব দিলাম,” ঈশান, আমার মন খারাপ না৷ শুধু মাথাব্যথা করছে।”

” তাহলে আমার দিকে তাকাও।”

আমি একটা অদ্ভুত কান্ড করলাম। ঈশানের দিকে তাকানোর বদলে তাকে জড়িয়ে ধরলাম। তার বুকে মাথা গুজলাম। ঈশান লম্বা নিশ্বাস ছেড়ে বলল,” এবার তো আমি হান্ড্রেড পারসেন্ট শিউর। কিছু একটা হয়েছে।”

আমি উত্তর দিলাম না। মনটা ভার হয়ে গেল। ঈশান বলল,” আচ্ছা, তোমার বলতে ইচ্ছা না করলে থাক।”

” ওকে।”

” এখন বলো আমি তোমার কে হই?”

হঠাৎ এই প্রশ্নে আমি একটু চমকালাম৷ তারপর ভেবে-চিন্তে বললাম,” আপনি হলেন আমার ভালো থাকা।”

” তাই?”

” উমম.. হুম।”

ঈশান তার দুই হাতে আমার মাথাটা উপরে তুলে অনুরোধ মিশ্রিত গলায় বলল,” এই তারিন, বলো না কি হয়েছে?”

আমি একটু ভেবে বললাম,” কি হবে?”

” আমি জানি না। কিন্তু তোমার মুখে হাসি নেই।”

আমি জোর করে হাসলাম। ঈশান দুইপাশে মাথা নেড়ে বলল,” হয়নি। এটা নকল হাসি।”

” তাহলে আসল হাসি কাকে বলে?”

” যেই হাসি মানুষের চোখ পর্যন্ত পৌঁছায় সেটা আসল হাসি।”

আমি বিভ্রান্ত হয়ে বললাম,” হাসি আবার কিভাবে চোখ পর্যন্ত পৌঁছাবে? কি মুশকিল!”

আমি এই কথা বলে অযথাই হাসতে লাগলাম।কিন্তু ঈশান হাসছে না৷ দৃঢ়চিত্তে বলল,” তোমার মন ভালো করার জন্য কি করতে পারি আমি?”

আমি একটু দুষ্ট কণ্ঠে বললাম,” কিস করুন।”

ঈশান একটু অবাক হলো। আমি লজ্জায় মাথা নিচু করতেই সে তুমুল গতিতে আমাকে কাছে টানল। আমি পড়িমরি করে ঈশানের কাঁধ খামচে ধরলাম। চোখ বড় বড় করে তাকালাম। ঈশান মুচকি হাসল। তার এমন হাসি দেখলেই লজ্জাময় আতঙ্ক জেগে উঠে মনে। সেই আতঙ্ক বাড়াতেই ঈশান তীব্র স্পর্শে আমার ঠোঁট আঁকড়ে ধরল। আমি কেঁপে উঠলাম হালকা। ভাবিনি সে সত্যি এটা করবে। আমি চোখ বন্ধ করে নিলাম। মনে হলো, আমার শরীরের স্নায়ুগুলি তাদের যাবতীয় কাজ বন্ধ করে দিয়েছে। আমি অসাড় হয়ে পড়লাম। ঈশান তার সবটুকু তৃপ্তি ঢেলে দিচ্ছে আমার ঠোঁটে। আমি ছটফট করছিলাম… কত পেরিয়ে গেল জানি না। হঠাৎ দরজার কাছ থেকে আওয়াজ এলো,

” এহেম এহেম, কেমিস্ট্রি ক্লাস চলছে নাকি?”

আমি আর ঈশান এলোপাতাড়িভাবে সরে পড়লাম দুই প্রান্তে। নিহা হাসতে শুরু করেছে। ঈশান অপ্রস্তুত ভাবে উঠে দাঁড়াল।

নিহা রসিকতাপূর্ণ কন্ঠে বলল,”ছোট একটা এডভাইজ দেই কেমন? এরপর থেকে দরজাটা একটু লাগিয়ে নিবেন। এমন খোলামেলা পরিবেশে ক্লাস করা ঠিক নয়।”

ঈশান শক্ত গলায় বলল,” আমিও তোকে একটা এডভাইস দেই। এরপর থেকে ঘরে ঢোকার আগে শব্দ করে ঢুকবি।”

নিহা ফিচেল হাসি দিয়ে বলল ” আমি বুঝি বেশি ডিস্টার্ব করে ফেললাম?এখন কি তাহলে আমাকে পানিশমেন্ট দেওয়া হবে?”

আমি মাথা নিচু করে হাসছিলাম। আবার লজ্জাও লাগছে। এই প্রথম নিহার সামনে লজ্জা লাগছিল।
ঈশান চলে যাওয়ার আগে ত্যাড়া গলায় বলে গেল,” আগে ম্যানার শেখ তুই, ম্যানারলেস।”

নিহা ন্যাকা কণ্ঠে বলল,” উফফ, ঈশান ভাইয়া দেখি খুব রেগে গেলেন… ”

ঈশান ঘর থেকে বের হয়ে যেতেই সে খিলখিল করে হাসতে লাগল। আমি নিহার পিঠে জোরে একটা ঘুষি মেরে বললাম,” খুব মজা লাগছে তাই না?”

নিহা তেতে উঠে বলল,” মজায় তো আছিস তুই। বিয়ের আগেই হানিমুন শুরু করে দিয়েছিস একদম। ঈশান ভাইয়া কি রোমান্টিক.. আহা! আর আমার গাঁধাটাকে দ্যাখ! সকাল থেকে একবার খোঁজও নেয়নি। সারাক্ষণ ঈশান ভাইয়ের সঙ্গে থেকেও কিছু শিখতে পারল না।”

আমি আহ্লাদ করে বললাম,” আহারে, খুব দুঃখ তাই না?”

নিহা আমার চেয়েও দ্বিগুণ আহ্লাদ করে বলল,” হুম। অনেক দুঃখ।”

আমার হঠাৎ মনে পড়ায় জিজ্ঞেস করলাম,” আচ্ছা নিহা শোন, ভালোই হলো তুই এসেছিস। একটা কথা জানতে চাইছিলাম।”

” বল।”

” আজ সকালে যখন আমরা এখানে এলাম, তুই বাড়ি বিক্রির বিষয়ে কিছু বলতে চেয়েছিলি। ঈশান ভাইয়ের কারণে হয়তো বলিসনি।”

নিহা উত্তেজিত কণ্ঠে উচ্চারণ করল,” ও হ্যাঁ, মনে পড়েছে। তখন আমি বলেছিলাম আমি কিছু জানি না। আসলে ঈশান ভাইয়ের সামনে এমনি বলেছিলাম। সত্যিটা তোকে এখন বলি। মোহনা আন্টি একটা ছেলের সাথে প্রেম করতো। সেই ছেলে এই বাড়ির ঠিকানা জানতো৷ এজন্যই বাড়ি বিক্রি করা হয়েছিল। ”

আমার হৃৎপিন্ড দিয়ে শীতল স্রোত প্রবাহিত হলো। আড়ষ্ট গলায় বললাম,” ওই ছেলে ঠিকানা জানলে কি প্রবলেম?

” আরে, প্রবলেম না? যদি এসে বিরক্ত করে? ছেলেটা তো একটা প্রতারক ছিল।

আমি অগ্নি কণ্ঠে বললাম,” তুই কেমন করে জানলি?”

নিহা মলিন কণ্ঠে বলল,” তুই মোহনা আন্টির সাথে কখনও এই বিষয়ে আলাপ করিস না, প্লিজ! তোকে আমি খুব সিকরেট একটা কথা বলতে যাচ্ছি।”

” আচ্ছা, বল।”

নিহা আমার কাছে এসে ফিসফিস করে বলল,” ওই ছেলেটা এসেছিল, যার অপেক্ষায় মোহনা আন্টি ছিল।”

” কবে?”

” অনেক আগের ঘটনা। বিয়ের আগে। মানে মোহনা আন্টির বিয়ের আগেই ওই ছেলেটা এসেছিল মোহনা আন্টির সাথে দেখা করতে। কিন্তু হামিদ নানা তাকে অপমান করে বের করে দিয়েছিল। সেই কথা মোহনা আন্টি আজও জানেন না। তিনি তো ছেলেটাকে প্রতারক ভাবেন। কিন্তু আমি মায়ের কাছে শুনেছিলাম। ছেলেটা প্রতারক নয়। সে মোহনা আন্টিকে বিয়ে করার জন্যই এসেছিল। কিন্তু ছেলেটা নাকি খুব দরিদ্র হওয়ায় হামিদ নানা তাকে পছন্দ করেননি। আর মোহনা আন্টির বিয়ের পর হামিদ নানা বাড়ি বিক্রি করেছেন এক প্রকার ভয়েই। ছেলেটা যদি আবার ফিরে আসে? এই বাড়ির ঠিকানা তো জানতো সে।”

” তাহলে এই কারণেই এতো সুন্দর বাড়িটা বিক্রি করে দিল? শুধুমাত্র গরীব বলেই ছেলেটাকে রিজেক্ট করা হলো? এভাবে একটা ভালোবাসা হেরে গেল টাকার কাছে!”

” এমনই তো জীবন।”

” ঈশানও কি এই কথা জানে?”

” হয়তো জানে। সে পুরোটা জানে কি-না তা আমি বলতে পারব না।”

” আমার ছেলেটার জন্য খুব খারাপ লাগছে। মোহনা আন্টি সারাজীবন তাকে প্রতারক ভেবে যাবে। কোনোদিন জানতেই পারবে না যে ছেলেটা এসেছিল তার কাছে। কিন্তু তার বাবাই ছেলেটিকে অপমান করে তাড়িয়ে দিয়েছিল। এটা কি অন্যায় নয়?”

” কিছু বিষয় না জানাই ভালো। এখন জানলেও আর কি? মোহনা আন্টি শুধু শুধুই আফসোস করবেন। ওই ছেলেকে তো আর খুঁজে আনতে পারব না আমরা।”

” এমনও তো হতে পারে যে ওই ছেলেটা এখনও বিয়ে করেনি। মোহনা আন্টির অপেক্ষায় আছে! চাইলেই কিন্তু মোহনা আন্টি তার কাছে ফিরে যেতে পারে।”

” হিন্দি সিনেমা নাকি? আর মোহনা আন্টি চলে গেলে ঈশান ভাইয়ের কি হবে?”

” ঈশান তো আর বাচ্চা নয় যে মা ছাড়া ম’রে যাবে। মোহনা আন্টি ঈশানের মা নয়। তাই তার কোনো দায়বদ্ধতাও নেই ঈশানের সঙ্গে থাকার।”

নিহা বিস্মিত গলায় বলল,” এটা তুই কি বললি তারু? স্বার্থপরের মতো কথা বলছিস। আপন মা না হলেও মোহনা আন্টি ছাড়া ঈশান ভাইয়ের এই পৃথিবীতে কেউ নেই। যদি মোহনা আন্টি চলে যায় তাহলে ঈশান ভাই অবশ্যই মরে যাবে।”

আমি চুপ রইলাম। আসলেই তো, ভাইয়ার কথা ভাবতে ভাবতে ঈশানের কথা আমি ভুলেই গেছিলাম। সেও মোহনা আন্টিকে খুব ভালোবাসে।সে কি করে থাকবে?

নিহা অবজ্ঞার সুরে বলল,” তাছাড়া ওই ছেলেটাও মোহনা আন্টির যোগ্য ছিল না। মোহনা আন্টি তাকে এতো ভালোবাসল, কিন্তু সে কি করল মোহনা আন্টির জন্য? শুধু ছুটে এলেই ভালোবাসা প্রমাণ হয় না। বিয়ের পর কিন্তু সে মোহনা আন্টির একবারও খোঁজ নেয়নি।”

আমি রোষপূর্ণ কণ্ঠে বললাম,” এমনও তো হতে পারে, ছেলেটা অতিরিক্ত শোকে অসুস্থ হয়ে পড়েছিল। তারপর সে নিজের বাড়িও ফিরতে পারেনি৷ কোনো সহৃদয়বান মানুষ তাকে হসপিটালে ভর্তি করিয়েছিল। দীর্ঘদিন চিকিৎসাধীন থেকে সে যখন বাড়ি ফিরল, তখন সেদিকের অবস্থা খুব খারাপ। তার পরিবারটা অথৈ জলে ভেসে যাচ্ছে। বাবার মৃত্যু, মায়ের আহাজারি, ভালোবাসা হারানোর দুঃখ, সব মিলিয়ে নিদারুণ অবস্থা। ওই সময় সে কি সংসারের হাল ধরবে নাকি ভালোবাসার পেছনে ছুটবে? বাস্তবতা কি বলে? আবেগ দিয়ে তো আর পেট ভরানো যায় না।”

আমার চোখ দিয়ে ঝরঝর করে পানি পড়ছে। নিহা অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে রইল। আমি মুখে হাত দিয়ে কাঁদতে লেগেছি। একেবারে নিশ্বাস আটকে আসা কান্না। নিহা আমার বাহু চেপে ধরে উচ্চারণ করল,” তারু, কি হয়েছে তোর?

আমি নিহাকে জড়িয়ে ধরে সবকিছু বলতে লাগলাম। নিহা স্তব্ধ হয়ে গেল। তারপর একসময় সেও আমার মতো কেঁদে ফেলল।

গেস্ট হাউজের পেছনের জঙ্গলে জোরালো শব্দে গিটারের আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে। ফাহিম ভাই গান গাইছে। ঈশান তাকে নিয়ে নাচছে। সবাই করতালি বাজাচ্ছে। আমি সেখানে গিয়ে বসলাম৷ নিহা কোমর দুলিয়ে নাচতে নাচতে বলল,” হঠাৎ এতো উৎসব কেন? কি হয়েছে সবার?”

সাফিন ভাই জবাব দিল,” তারুর নাকি খুব মনখারাপ। তাই ঈশানের অনুরোধে আমর ডান্স করছি। তুমিও আমাদের সাথে আসতে পারো।”

” না থাক, তোমরাই ডান্স করো। ”

নিহা আমার পাশে এসে বসল। ঈশান আর সাফিন ভাইয়ের নাচ দেখে আমরা হেসে পেট ব্যথা করে ফেলতে লাগলাম। পেছন থেকে শুনলাম সামিয়া কাঠখোট্টা স্বরে বলছে,” ঈশান ভাই দিন দিন চার্লি হয়ে যাচ্ছে। একটু বেশি বেশি ন্যাকামি। তারুর মন ভালো করার জন্য গাঁধার মতো নাচতে হবে নাকি? এটা কেমন কথা! রিডিকিউলাস!”

নিহা শুনতে পেয়ে ঠিক জবাব দিয়ে দিল,” প্রিয় মানুষকে হাসি-খুশি রাখা রিডিকিউলাস? আগে জানতাম না তো!”

আনিকা বলল,” হাসি-খুশি রাখা রিডিকিউলাস না। কিন্তু সবার সামনে এমন জোকারের মতো করা অবশ্যই রিডিকিউলাস। ”

নিহা দীর্ঘ নিশ্বাস ছেড়ে বলল,” তাও ভালো। ঈশান ভাইয়া তো শুধু জোকার সেজেছে। অন্যসব টক্সিক মানুষের মতো জাজমেন্টাল হয়নি। যারা কথায় কথায় দোষ ধরে আর হিংসায় জ্বলে।”

আনিকা রুঢ় স্বরে বলল,” এখানে কে হিংসায় জ্বলছে?”

” জানি না। কিন্তু আমি তো পোড়া পোড়া গন্ধ পাচ্ছি। তারু তুই পাচ্ছিস না?”

আমি নিহাকে ইশারায় অনুরোধ করলাম, প্লিজ চুপ কর। নিহা খিটমিট করে বলল,” তুই কি ভয় পাস? যা বলবে তাই মেনে নিবি নাকি? জবাব দিবি না?”

আমি ফিসফিস করে বললাম,” যেখানে জবাব দিলে ঝগড়া হবে, সেখানে নিশ্চুপ থাকাই ভালো। ”

নিহা আমার গাল টিপে চুমু দিয়ে বলল,” এতো সুইট কেন তুই?”

বৃষ্টি শুরু হয়ে যাওয়ায় বেশিক্ষণ নাচ দেখা সম্ভব হলো না। সবাই দৌড়ে ঘরে ঢুকে যেতে লাগল। কেবল যাচ্ছে না ঈশান। কেউ তাকে টেনেও ঘরে নিতে পারল না। সে মনের আনন্দে বৃষ্টিতে ভিজছে। আমিও ঈশানের পাশে গিয়ে দাঁড়ালাম। মৃদু কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলাম,” ঘরে যাবেন না?”

” উহুম। এখানেই ভালো লাগছে আমার।”

” জ্বর আসে যদি?”

” বৃষ্টিতে ভিজলে আমার জ্বর আসে না৷ তোমার খারাপ লাগলে চলো ভেতরে চলে যাই।”

” না থাক, আমারও ভালো লাগছে।”

খুব জোরে বজ্রপাতের শব্দ হলো। আমি ঈশানকে জড়িয়ে ধরলাম। ঈশান হাসতে লাগল। আমি ফিসফিস করে বললাম,” আমি যদি আপনার কাছে কিছু চাই, আপনি কি দিবেন?”

ঈশান অকপটে বলল,” অবশ্যই দিবো। কি চাও বলো? তোমার জন্য জান কোরবান।”

” যদি আমি বলি আপনার সবচেয়ে প্রিয় মানুষটি আমার জন্য ছেড়ে দিতে, আপনি কি পারবেন?”

ঈশান সন্দিহান গলায় বলল,” মমের কথা বলছ?”

আমি চমকে উঠলাম। মাথা তুলে তাকিয়ে বললাম,” আপনার এটা কেন মনে হলো?”

ঈশান একটু গম্ভীর হয়ে বলল,” কারণ মম ছাড়া এই পৃথিবীতে আমার কেউ নেই।”

বজ্রপাতের ওই শব্দটা আবার হলো। তবে এবার আকাশে নয়; আমার মনে।

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here