তি আমো পর্ব -৪৪+৪৫

#তি_আমো
পর্ব ৪৪
লিখা- Sidratul Muntaz

ঈশান আমার হাত ধরে ব্রীজের কাছে নিয়ে এলো। ধুপধাপ শব্দে দৌড়াতে দৌড়াতে জিজ্ঞেস করল,” তুমি সাতার জানো?”

চারপাশে বৃষ্টির টাল-মাটাল শব্দ। হাওয়া বইছে উত্তালভাবে। অন্ধকারাচ্ছন্ন শব্দময় রাত। মেঘের গর্জন৷ আমি শুনতে পেলাম না ঈশানের কণ্ঠ। সে কি প্রশ্ন করল সেটাও বুঝলাম না। কোনোকিছু না বুঝেই মাথা নেড়ে বললাম,” হ্যাঁ। ”

তারপর যে কি হলো! ঈশান হুড়মুড়িয়ে আমার দিকে ধেঁয়ে আসছিল। আমি ভাবলাম সে জড়িয়ে ধরবে। কিন্তু ঈশান করল সবচেয়ে অদ্ভুত কাজ। আমাকে ধাক্কা দিয়ে ঝিলে ফেলে দিল। আমি চিৎকার দিয়ে উঠলাম৷ ততক্ষণে ঈশান নিজেও ঝাঁপিয়ে পড়েছে। আমি ডানা ভাঙা পাখির মতো তড়পাতে লাগলাম। মুখ দিয়ে পানি ঢুকে নাকানিচুবানি খাওয়ার অবস্থা। ঈশান মনের আনন্দে সাতরাচ্ছে। এদিকে আমার দম আটকে যাচ্ছে। ঈশান তা লক্ষ্য করেই দ্রুত আমার কাছে এলো। আমি তো ডুবেই যাচ্ছিলাম। পড়িমরি করে দুইহাতে ঈশানের কাঁধে ভর দিয়ে মুখ উপরে তুললাম। বড় বড় শ্বাস নিতে লাগলাম। ঈশান আমার কোমর চেপে ধরে উঁচু করে রাখল। আমার চোখমুখ লাল হয়ে উঠেছে। নিশ্বাস আটকে যাওয়ার উপক্রম হয়েছিল। কাশতে লাগলাম জঘন্যভাবে। ঈশান বিস্ময়ের সুরে বলল,” তুমি সাঁতার জানো না?”

আমি সঙ্গে সঙ্গে দুইপাশে মাথা নাড়লাম৷ কড়া গলায় উচ্চারণ করলাম,” আপনি এটা কেন করলেন আমার সাথে? আরেকটু হলেই আমি মরে যেতাম..”

ঈশান চট করে আমার ঠোঁটে তার আঙুল চেপে ধরে বলল,” শশশ!”

তারপর তার কপাল আমার কপালে ঠেকিয়ে ফিসফিস করে বলল,” মরবে কেন? আমি আছি না? ”

আমি হাসলাম। দুই পা দিয়ে ঈশানের কোমর জড়িয়ে ধরে বললাম,” ইয়েস। এখন আমার ভয় একটু কমেছে। জানেন? জীবনে এই প্রথমবার আমি পানিতে নেমেছি।”

” কি বলো? সত্যি?”

” হুম।”

” তাহলে তো পানির মজা তোমাকে বোঝাতেই হবে।”

ঈশান এই কথা বলে নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরল। আমি হেসে জিজ্ঞেস করলাম,” কিভাবে?”

” আমাকে শক্ত করে ধরে থাকো। সাতার কাটবো।”

আমি রুদ্ধ কণ্ঠে বললাম,” আমার ভয় লাগে।”

ঈশান আমাকে ভরসা যোগাতে বলল,” রিল্যাক্স! আমার উপর বিশ্বাস নেই?”

” আছে। কিন্তু পানির উপর বিশ্বাস নেই। নিজের উপরেও বিশ্বাস নেই।”

ঈশান হেসে ফেলে আমাকে নিয়েই দূর্দান্ত ভঙ্গিতে সাতার কাটতে লাগল। আমি তার গলা ধরে ঝুলে রইলাম। মনে হচ্ছিল এতো আনন্দ আমি কখনও পাইনি৷ সারাজীবন পানির মধ্যে থাকলেও এই আনন্দের স্বাদ মিটবে। হুট করেই খুব আফসোস হলো আমার। কেন মাছ হয়ে জন্মালাম না? ছোটবেলায় ফেইরিটেইল দেখে জলপরী হওয়ার ইচ্ছেটা আবার জেগে উঠল। ঈশান প্রশ্ন করল, ” কেমন লাগছে?”

আমি স্বপ্নময় কণ্ঠে বললাম,” খুব মজা। সুইমিং এতো দারুণ আমি তো জানতামই না। প্লিজ আমাকেও সুইমিং শেখান!”

” সুইমিং এ কষ্ট আছে। সাইকেল চালানোর চেয়েও বেশি কষ্ট। অন্যের উপর দিয়ে ভাসছ বলে টের পাচ্ছো না।”

” আহারে, আপনার বুঝি খুব কষ্ট হচ্ছে আমাকে নিয়ে সুইমিং করতে?”

” পরিশ্রম তো হচ্ছেই। কিন্তু ভালো লাগছে। এতো মজা করে আমি আগে কখনও সুইমিং করিনি।”

” সত্যি? তাহলে আমার আর সুইমিং শেখার দরকার কি? সবসময় না হয় এভাবেই আপনি আমাকে নিয়ে সুইমিং করবেন।”

ঈশান নিরামিষ কণ্ঠে বলল,” তবুও সুইমিং শেখা উচিৎ তারিন। সবসময় তো আমি লাইফ জ্যাকেট হয়ে পাশে থাকব না।”

আমি অভিমানী ভঙ্গিতে বললাম,” থাকতেই হবে৷ আপনি আমার লাইফ জ্যাকেট। সবসময় পাশে থাকবেন। আর আমি আপনার কি বলুন তো?”

ঈশান হাসতে হাসতে বলল,” লাফিং গ্যাস!”

আমিও হেসে উঠলাম। হঠাৎ শিষ বাজানোর শব্দ আর করতালির আওয়াজ শুনে আমরা দু’জনেই একটু চমকালাম। তারপর উপরে তাকিয়ে দেখলাম নিহা, সাফিন ভাই, নীরা, রেহেনা, রিফাত ভাই, সিয়াম ভাই, নাশফী আপু, সবাই বারান্দায় সমবেত হয়েছে। তারা আগ্রহ নিয়ে আমাদের সাঁতার কাটা দেখছে। লজ্জায় গাঁট হয়ে ঈশানের গলায় মুখ লুকিয়ে ফেললাম আমি। অথচ ঈশানের কোনো তোয়াক্কাই নেই। সে বরং হাত নাড়িয়ে সবাইকে ‘হায়’ বলছে। আমি হতভম্ব হয়ে তাকালাম। হঠাৎ ফ্ল্যাশ লাইটের আলো জ্বলে উঠল। নিহা শয়তানি করে আমাদের ছবিও তুলছে। রাগে ফুঁসে উঠে বললাম,” প্লিজ ওদের নিষেধ করুন। এসব কি?”

ঈশান প্রশমিত কণ্ঠে বলল,” থাক না, ছবি তোলাটা খারাপ কি? একটা মেমোরি থাকল।”

” ছবিতেই কেন মেমোরি থাকতে হবে? স্মৃতিতে থাকলে হয় না? এই ছবি আপনি কাকে দেখাতে চান?”

” আমাদের যখন বিয়ে হবে তখন বেডরুমের দেয়ালে টানানো থাকবে।”

” ছিঃ, অসম্ভব!”

উপর থেকে মিশ্র কণ্ঠদের আওয়াজ এলো, ” ঈশান ভাই থামলেন কেন? ক্যারি অন!”
” এতো রোমান্টিক সুইমিং কনটেস্ট আমরা আগে কখনও দেখিনি।”

বাকিরা খিকখিক করে হাসল। ছেলেদের মধ্যে কেউ বলল,” কনটেস্ট কেন বলছিস তোরা? এটা তো রোমান্টিক সুইমিং রোমান্স হচ্ছে!”

সবাই এই কথায় আরও জোরে হেসে উঠল। বৃষ্টির শব্দ আর হাসির শব্দ মিলে একটা উৎসবমুখর পরিবেশ তৈরী হয়েছে। ফ্ল্যাশলাইট তখনও জ্বলছিল। নিহা উঁচু গলায় বলল,” তারু, তোর মুখ দেখা যায় না। একটু হেসে এদিকে তাঁকা না মা!”

আমি চিৎকার করে বললাম,” তুই যদি ছবি তোলা বন্ধ না করিস তাহলে আমি তোকে পানি মারব।”

নিহা অট্টহাসিতে ফেটে পড়ল,” তুই ওখান থেকে পানি মারলে আমার কিছুই হবে না। বরং আমি চাইলে তোকে উপর থেকে অনেক কিছু ছুঁড়ে মারতে পারব। তাই বলছি, ঠিকঠাক পোজ দে। নাহলে কিন্তু…”

কথা শেষ করার আগেই অতি উত্তেজনাবশত নিহা তার ফোনটাই ফেলে দিল। আমি জিতে যাওয়ার মতো চিৎকার করলাম,” ইয়াহু!”

উপর থেকে নিহা আর্ত চিৎকার করল,” আমার ফোন!”

আমি দ্রুত ঈশানকে বললাম,” ফোনটা খুঁজে পেলেও কিন্তু দেবেন না।”

ঈশান ফোন খোঁজায় ব্যস্ত হলো। কিছুক্ষণের মধ্যেই পাওয়া গেল। আমি ঈশানের হাত থেকে ফোন ছিনিয়ে নিলাম,” ফোন দেবেন না। আগে ছবি ডিলিট করতে হবে।”

নিহা তড়িঘড়ি করে বলল,” খবরদার তারু, তুই কিন্তু ছবি ডিলিট করবি না।”

” অবশ্যই করব। তুই বিনা অনুমতিতে ছবি তুলেছিস। তাই শাস্তিস্বরূপ তোর গ্যালারির সব ছবি আজ ডিলিট করব।”

নিহা চেঁচিয়ে উঠল,” তারিফ ভাই.. তারু তুই ফোন না দিলে আমি কিন্তু তারিফ ভাইকে ডাকব। সে এসে দেখুক তার বোন কিভাবে সুইমিং শিখছে!”

আমার প্রাণটা এসে গলার কাছে আটকে গেল যেন। ভাইয়া দেখলে যদিও কিছু বলবে না। কিন্তু আমি আর লজ্জায় ভাইয়ার সামনে দাঁড়াতে পারব না। ঈশান মৃদু ধমক দিয়ে বলল,” এটা বেশি হচ্ছে, নিহা। শাট আপ।”

” তাহলে তারুকে বলুন আমার ফোন দিতে।”

আমি অনেকটা হিঁচকি তোলার মতো উচ্চারণ করলাম,” তুই ফোন নিয়ে যা, বিচ্ছু। সময় আমারও আসবে।”

নিহা হৈহৈ করতে লাগল। তখনি শুনলাম ভাইয়ার আওয়াজ,” এখানে কি হয়েছে? কেউ পানিতে পড়ে গেল নাকি? এতো হৈচৈ কেন?”

ভাইয়ার গলা শুনে আমার আত্মায় তখন একফোঁটা পানি নেই। ঈশানকে এমনভাবে জড়িয়ে ধরলাম যেন অদৃশ্য হয়ে যেতে চাইছি। ঈশান দ্রুত কণ্ঠে বলল,” নিশ্বাস আটকে তুমি কতক্ষণ থাকতে পারো?”

আমি অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকালাম। বিরক্ত হয়ে বললাম,” মানে? এইসময় আপনি কি আজগুবি প্রশ্ন করছেন? ভাইয়া আমাদের দেখে ফেললে কি হবে সেটা ভাবুন।”

আমি কিছু বোঝার আগেই ঈশান আমাকে নিয়ে পানিতে ডুব দিল। ভাইয়া ততক্ষণে বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছে। কাউকে দেখতে না পেয়ে কিছুক্ষণ এদিক-ওদিক তাকিয়ে বলল,” সবাই এখানে কি করছ? এতো হল্লাহল্লি কেন? কিছু হয়েছে?”

সাফিন ভাই ইতস্তত করে জবাব দিল,” নিহার ফোন পড়ে গেছে নিচে। কে আনতে যাবে সেটা নিয়েই তর্ক হচ্ছিল।”

তারিফ ভাই ধমকের সুরে বলল,” কে আনতে যাবে মানে? বউটা কার? তোমার না? তোমারই যাওয়া উচিৎ। ”

” কিন্তু আমি সাঁতার জানি না ভাইয়া।”

” এই যুগের ছেলে হয়েও সাঁতার জানো না? এইটা কোনো কথা হলো?”

নিহা অসহায় সুরে বলল,” থাক ভাইয়া, বাদ দিন। আমিই গিয়ে খুঁজে আনব। আর পাওয়া না গেলে তো কিছু করার নেই।”

ভাইয়া রুষ্ট হয়ে উঠল,” পাগল নাকি? এতোগুলো ছেলে থাকতে তুমি মেয়ে হয়ে পানিতে নামবে ফোন খুঁজতে? এটা কোনো কথা হলো না। আমি যাচ্ছি।”

নিহা বিনীতভাবে বাঁধা দিল,” ছি,ছি ভাইয়া। আপনার কষ্ট করতে হবে না। রিফাত ভাই সাঁতার জানে তো! সে গিয়ে নিয়ে আসবে।”

” আশ্চর্য! আমি কি তোমার ভাই না? আমি আনলে প্রবলেম কি?”

ভাইয়া সত্যি সত্যি নিচে নামছে। আমি আর ঈশান ততক্ষণে পারে উঠার প্রাণপণ চেষ্টা শুরু করলাম৷ ভাইয়া আসার আগেই এখান থেকে উঠতে হবে। কিন্তু আমি উঠতে নিয়েও পা পিছলে আবার পড়ে গেলাম। অগত্যাই ঈশানকে নেমে আমাকে আবার তুলতে হলো। ভাইয়া যখন নিচে নেমে গেছে, তখন আমি আর ঈশান কাকভেজা অবস্থায় স্থলে উঠে দাঁড়িয়েছি। বৃষ্টিও থেমে গেছে। মাঝে মাঝে টুপটপ করে কয়েক ফোঁটা করে ঝরছে। আমাদের দু’জনকে এভাবে দেখে ভাইয়ার চক্ষু চড়কগাছ। আমি লজ্জায় আড়ষ্ট, ঈশান কাঁচুমাচু। ভাইয়া হতভম্ব কণ্ঠে বলল,” তোমাদের এই অবস্থা কেন?”

আমি চোখ বন্ধ করে ফেললাম। ঈশান অপ্রস্তুতভাবে বলল,” নিহার ফোন পড়ে গেছিল সেটাই তুলতে এসেছিলাম।”

এই কথা বলে ঈশান নিহার ফোনটা বের করল। ভাইয়া আরও অবাক হয়ে বলল,” ফোন খোঁজার জন্য দু’জনকে একসাথে পানিতে নামতে হবে কেন?”

ঈশান আর কোনো অযূহাত খুঁজে পাচ্ছিল না হয়তো। তার নীরবতা দেখে আমিই বললাম,” আসলে ভাইয়া, নিহার ফোনের সাথে আমিও পানিতে পড়ে গেছিলাম। ঈশান আমাকেই তুলতে এসেছিল।”

তারিফ ভাই বিভ্রান্ত হলো। ভ্রু কুচকে খানিক রাগ নিয়ে বলল ,” যেকোনো একটা বল। ফোন পড়ে গেছিল নাকি তুই পড়ে গেছিলি?”

ঈশান বলল,” ফোন আর তারিন একসাথেই পড়ে গেছিল।”

ভাইয়া এবার রাগী দৃষ্টিতে বলল,” তাহলে তুমি প্রথমে ফোনের কথা বললে কেন? কে বেশি ইম্পোর্ট্যান্ট তোমার কাছে? ফোন নাকি আমার বোন?”

ঈশান ভ্যাবাচেকা খেয়ে বলল,” আমার বোন.. মানে আপনার বোন, আমার বউ.. মানে তারিন!”

আমি ঈশানের দিকে চাইলাম বাঁকা দৃষ্টিতে। ভাইয়ার প্রশ্নবাণের সামনে সে এমনভাবেই ভড়কে গিয়েছে যে কি বলবে সেটাই স্থির করতে পারছে না। হাঁদারাম! ভাইয়া যে কিভাবে তখনও না হেসে গম্ভীরমুখে তাকিয়ে ছিল কে জানে? কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে শান্ত কণ্ঠে বলল,” ভেতরে যাও। ড্রেস চেঞ্জ করো। এভাবে দাঁড়িয়ে থাকলে নিউমোনিয়া হবে। সামনে তোমাদের বিয়ে…”

ভাইয়ার কথা শেষ হওয়ার আগেই আমি দ্রুত ঘরে ঢুকে গেলাম।

প্রথমে বৃষ্টিতে ভেজা তারপর পানিতে নেমে সাতার কাটা; আমার সর্দি হওয়ার জন্য এই দুইটি কাজই যথেষ্ট ছিল। সকালে যখন ঘুম ভাঙল তখন দুই নাকের একটাও খোলা যাচ্ছে না। শ্বাস নেওয়া তো দূরের কথা। মুখ দিয়ে হা করে শ্বাস নিতে হচ্ছে। ঈশানের কি অবস্থা কে জানে? সে সকাল সকাল উঠেই মোহনা আন্টিদের আনতে গিয়েছিল। আমাকেও ডাকা হয়েছিল। কিন্তু আমি ঘুমে এতো বিভোর ছিলাম যে যেতে পারিনি।এতোক্ষণে মোহনা আন্টিরা চলে এসেছে। নিহা আমার ঘরে এসে ফিসফিস করে বলল,” তারু, মোহনা আন্টি এসে গেছে। কথা বলবি?”

আমি মাথা নত করে বললাম,” কি বলব?”

” গতকাল রাতে ঈশান ভাইকে সবকিছু বলেছিলি?”

” উহুম। বলতে পারিনি। বজ্রপাত হলো।”

” মানে? বজ্রপাত হওয়ার জন্য বলতে পারিসনি? এইটা কেমন কথা?”

” আকাশের বজ্রপাত না। বজ্রপাত হয়েছিল আমার মনে। মেঘেদের গর্জনে মুখে তালা লেগে গেল। আমি কিছু বলতেই পারলাম না!”

নিহা মুখ কুচকে বলল,” মানে? কি বলছিস আবোলতাবোল? ”

আমি বেদনা মিশ্রিত কণ্ঠে বললাম,” ঈশানকে যখন আমি জিজ্ঞেস করলাম, সে আমার জন্য কোনো প্রিয় জিনিস ছাড়তে পারবে নাকি? তখন সে বলল সব পারবে। কিন্তু মোহনা আন্টি ছাড়া তার এই পৃথিবীতে কোনো প্রিয় জিনিস নেই। এই কথার পর আমি কিভাবে বলি যে সেই একমাত্র প্রিয় জিনিসটিই আমার জন্য ছেড়ে দিতে! এই কথা আমার মুখ দিয়ে আসেনি৷ আমার কণ্ঠরুদ্ধ হয়ে গেল। তারপর আমি প্রসঙ্গ ঘুরিয়ে ফেললাম৷ আর ওই বিষয়ে কথা হয়নি।”

” তুই কাকে বেশি ভালোবাসিস তারু? তোর ভাইয়াকে নাকি ঈশান ভাইকে?”

” খুবই জটিল প্রশ্ন। এমন প্রশ্নের উত্তর হয় না।”

নিহা কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল,” নেক্সট প্ল্যান কি? এবার কি করবি?”

” ঈশানকে আমি কিছু বলতে চাই না। তার আগে আমি জানতে চাই ভাইয়া আর মোহনা আন্টির মধ্যে এখনও কিছু আছে নাকি! তারা কি আবারও এক হতে চায়? এটা কি সম্ভব?”

” কেন সম্ভব না? যেভাবে তারা একে-অন্য থেকে পালিয়ে বেড়াচ্ছে তাতে আমার মনে হয় তাদের মনে এখনও কিছু আছে। এই ভয়েই তারা মুখোমুখি হতে পারছে না। কারণ মুখোমুখি হলে তারা হয়তো নিজেদের সামলাতেই পারবে না।”

নিহার এই কথা শুনে আমি একটু আশার আলো খুঁজে পেলাম। উৎসাহিত কণ্ঠে বললাম,” তাহলে কি করা যায়?”

” আমার মাথায় একটা আইডিয়া এসেছে।”

নিহার উপর আমার কখনোই ভরসা থাকে না। কারণ এই মেয়ে সবসময় পাগলামি কান্ড করে। তবুও এইবার কেন যেন তার উপর আমার ভরসা করতে ইচ্ছে হলো। সকালে সব মেয়েরা যখন একত্রে নাস্তা করতে বসেছি তখনি নিহা ভাইয়াকে ধরে আনল। আমি লক্ষ্য করলাম, ভাইয়া ঘরে প্রবেশ করার সাথে সাথেই মোহনা আন্টির হিঁচকি উঠে গেল। তিনি দ্রুত পানি খেয়ে পালানোর পায়তারা করতে লাগলেন। নিহা সেই সুযোগ দিল না। সঙ্গে সঙ্গে বলল,” মোহনা আন্টি, তারিফ ভাইয়া কালরাত থেকে আপনার অপেক্ষায় ছিলেন। এখন আপনি এসে গেছেন, আবার ভাইয়াও আছে! তাই দু’জন মিলে ঈশান ভাই আর তারুর বিয়ের পরিকল্পনা করুন।”

নিহার সাথে তাল মেলাতে নীরা বলল,” দ্যাটস আ গুড আইডিয়া!”

মোহনা আন্টির চোখমুখ তখন লাল হয়ে গেছে। ভাইয়াও যথেষ্ট বিব্রত। আর মায়ের মুখের অবস্থা তো একদম অন্ধকারাচ্ছন্ন। সে আমার দিকে এমনভাবে তাকাল, যেন সব দোষ আমার। এর মাঝেই রুবা আন্টি বললেন,” হ্যাঁ। এবার কিন্তু ঈশান আর তারিনের বিয়েটা নিয়ে ভাবা উচিৎ। ওরা যেহেতু ঠিক করে নিয়েছে বিয়ে করবেই তাই তোমাদের আর দেরি করা ঠিক হবে না। কি বলো মোহনা?”

মোহনা আন্টি জবাব দিলেন না। ভাইয়া বলল,” আমি ঠিক করেই রেখেছি। আজকে হলুদের ফাংশন হবে। জালাল চাচাকে মার্কেটে পাঠালাম। ফুল-টুল কিনে আনবে। বিকালে মেয়েরা সবাই শপিং করতে যাবে। সব তো ক্লিয়ার।”

নিহা হাসি-খুশি গলায় বলল,” তবুও মোহনা আন্টির একমাত্র ছেলের বিয়ে বলে কথা! আন্টি আপনি কিছু বলবেন এই বিষয়ে?”

মোহনা আন্টি ভ্রু উঁচু করে বলল,” আমি আর কি বলবো? সব তো ঠিক করাই আছে। ”

নিহা আমার দিকে চাইল। আমি ইশারায় তাকে কিছু বলে দিলাম। নিহা আমার কথা না বুঝেই বলল,” আমার মনে হয় তারু আপনাদের সাথে একটু আলাদা কথা বলতে চায় এই বিষয়ে।”

ভাইয়া আর মোহনা আন্টি দু’জনেই আমার ঘুরে দিকে তাকাল। মায়ের অগ্নিদৃষ্টিও আমারই দিকে। আমি আসামীর মতো হাসলাম। ভাইয়া প্রশ্ন করল,” কি বলতে চাস তুই?”

নিহা আগ বাড়িয়ে বলল,” ওই রুমে আসুন ভাইয়া। তারু, এদিকে আয়।”

আমি মায়ের ভয়ংকর দৃষ্টি উপেক্ষা করে নিহার পেছন পেছন গেলাম। তারিফ ভাইয়া আমাদের সাথে এলো। নিহা আমাকে আর তারিফ ভাইয়াকে ঘরে রেখে বের হয়ে গেল। ভাইয়া নরম সুরে আমাকে জিজ্ঞেস করল,” কি হয়েছে? কোনো সমস্যা?”

আমি অপ্রস্তুতভাবে বললাম,” মোহনা আন্টি আসুক, তারপর বলব।”

ভাইয়া অস্বস্তির সাথে উচ্চারণ করল,” তাকেও ডাকতে হবে?”

” হ্যাঁ। হবে।”

পাঁচমিনিট পরেই নিহা মোহনা আন্টিকে সঙ্গে নিয়ে এলো। ভাইয়াকে দেখেই মোহনা আন্টি দরজায় দাঁড়িয়ে গেল। ভাইয়াও বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো। যেন বিকর্ষণ বল কার্যত হয়েছে দু’জনের মাঝে। একজন-অন্যজনের সামনে এক মুহূর্তও থাকতে রাজি নয়। নিহা অতি সহজভাবে বলল,” ভাইয়া দাঁড়ালেন কেন? বসুন। আন্টি, বসুন। এই তারু এদিকে আয় তো।”

নিহা আমার হাত ধরে টেনে আমাকে ঘর থেকে বের করে নিয়ে যাচ্ছিল। মোহনা আন্টি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল,” এটা কি হচ্ছে? তারিন তুমি আবার চলে যাচ্ছ কেন?”

আমার হয়ে নিহা উত্তর দিয়ে দিল,” ওকে ঈশান ভাই ডাকছে। শুনেই চলে আসবে। পাঁচমিনিট।”

আমি আর নিহা বের হয়ে গেলাম। নিহা আমার দিকে চেয়ে খুব হাসতে লাগল। আমিও হাসছি। নিহা বলল,” মিশন সাক্সেসফুল।”

আমি আগ্রহ নিয়ে বললাম,” ওরা যদি আবার বের হয়ে যায়? আমাদের পাহারা দেওয়া উচিৎ। চল শুনি কি কি বলে! ”

” ঠিক বলেছিস।”

আমি আর নিহা আলগোছে দরজার কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম। শুনতে পেলাম ভাইয়ার কণ্ঠ, ” আমার কিছু বলার নেই। আপনি যা বলতে চান, বলুন।”

” আমি কি বলব? তাছাড়া আপনার এটা কেন মনে হলো যে আমি আপনাকে কিছু বলতে চাই?”

মোহনা আন্টির কণ্ঠ খঞ্জরের মতো ধারালো। ভাইয়া বলল,” স্যরি।”

নিহা বিড়বিড় করে বলল,” এই প্রথম তারিফ ভাইকে দেখলাম কাউকে স্যরি বলতে। আমেইজিং!”

আমিও একই সুরে উচ্চারণ করলাম,” ঠিকই তো!”

মোহনা আন্টি বলল,” এখানে স্যরি বলার কিছু নেই।”

” আপনি এতোদিন আমার অপেক্ষায় না থেকে ওদের বিয়েটা দিয়ে দিলেও পারতেন। ”

” আমি কারো অপেক্ষায় থাকিনি। তারিন আপনাকে ছাড়া বিয়েতে রাজি ছিল না।”

” অপেক্ষা না করে ভালোই করেছেন। ঈশানও আপনাকে ছাড়া বিয়েতে রাজি না।”

মোহনা আন্টি নিশ্চুপ। ভাইয়াই আবার বলল,” ওদের বিয়ে দেওয়ার জন্য হলেও আমাদের মুখোমুখি থাকতে হবে।”

” আমার তো কোনো সমস্যা নেই এতে।”

ভাইয়া একটু খোঁচা মারার মতো বলল,” সমস্যা না থাকলে কাল পালিয়ে গেলেন কেন?”

মোহনা আন্টি তৎক্ষণাৎ ফুঁসে উঠে জবাব দিল,” স্কিউজ মি, আগে আপনি পালিয়েছিলেন!”

” ওহ, স্যরি। তাহলে আমারই ভুল। পালানো উচিৎ হয়নি।”

” কাল ওইভাবে চলে যাওয়া আমারও উচিৎ হয়নি। আমিও স্যরি।”

নিহা বিরক্ত হয়ে বলল,” এরা দেখি এখনও স্যরিতেই আটকে আছে।”

আমি বললাম,” তুই কি চাস প্রথমদিনই আই লভ ইউ বলুক?”

” পনেরো বছর পর দেখা! একটু তো ইমোশন থাকা উচিৎ। ”

“ইমোশন তো নিশ্চয়ই আছে। কিন্তু তারা মন খুলে কথা বলতে পারছে না৷ একটা অদৃশ্য দেয়াল তৈরী হয়ে গেছে তাদের মধ্যে। ”

” একটা কাজ করলে কেমন হয়? তাদের মধ্যে ঝগড়া বাঁধিয়ে দেই। তখন দু’জনেই মন খুলে কথা বলবে। আর প্রবলেম সোলভ হয়ে যাবে।”

নিহার বুদ্ধিটা আমার ভালো লাগল। ঝগড়া লাগলেই তাদের ভুল বুঝাবুঝি পরিষ্কার হবে। কিন্তু ঝগড়া লাগানোর উপায়টা কি?

চলবে#তি_আমো
পর্ব ৪৫
লিখা- Sidratul Muntaz

” ভালো বুদ্ধি পেয়েছি। তুই আর ঈশান ভাই ঝগড়া শুরু কর!”

বসার ঘরের এই মাথা থেকে ওই মাথায় পায়চারী করছিলাম। নিহার কথা শুনে থেমে দাঁড়ালাম,” মানে?”

” মানে তুই আর ঈশান ভাই ঝগড়া করবি। তারপর আমি মোহনা আন্টি আর তারিফ ভাইকে সেখানে ডেকে আনব। তোদের ঝগড়া থামাতে গিয়ে তাদের মধ্যেও ঝগড়া বেঁধে যাবে৷ তারপর ধীরে ধীরে তারা তাদের মনের সব কথা বলতে শুরু করবে। আর ঝগড়ার পরেই কিন্তু ভাব হয়।”

নিহা বুদ্ধিমতীর মতো হাসি দিয়ে চোখ টিপল। আমি কিছুক্ষণ চুপ থেকে বিষয়টা নিয়ে চিন্তা করলাম। অতঃপর ঠোঁট উল্টে বললাম,” না, এটা সম্ভব নয়।”

নিহা মুখ গোজ করে বলল,” কেন?”

” ঈশানের সাথে আমি কি নিয়ে ঝগড়া করব? একটা কারণ তো লাগবে! অকারণে ঈশান নিশ্চয়ই আমার সাথে ঝগড়া করবে না! তাহলে ঘুরে-ফিরে একই ব্যাপার হলো। ঝগড়ার কারণ খুঁজে বের করতে হবে।আমাদের মধ্যে ঝগড়া লাগানোর বদলে সরাসরি মোহনা আন্টি আর ভাইয়ার মধ্যে ঝগড়া লাগানোর আইডিয়াটাই বের কর!”

নিহা আমার কাছে এসে আমার কাঁধ চেপে ধরে বলল,” এই তারু, এই গাঁধী, আমার কথা বোঝার চেষ্টা কর। ভাইয়া আর মোহনা আন্টি নিজে থেকে ঝগড়া না করলে তো আমরা জোর করে ঝগড়া লাগাতে পারছি না। কিন্তু তুই চাইলেই নিজে থেকে ঈশান ভাইয়ের সাথে ঝগড়া করতে পারিস। নাহলে তুই এমন একটা কাজ কর যেটা ঈশান ভাইয়ের খুব অপছন্দ। তারপর দেখবি সে নিজেই এসে তোর সঙ্গে ঝগড়া করছে।”

” বুঝলাম। মানে ঈশানকে রাগাতে হবে? এইটা তো দুনিয়ার সবচেয়ে সহজ কাজ!”

” এক্সাক্টলি।”

তারপর আমি আবার চিন্তা করতে করতে বললাম,” কিন্তু ঈশানকে কিভাবে রাগানো যায়? কাজের সময় কিছু মাথায় আসে না। ”

নিহা বলল,” আমি একটা আইডিয়া দেই?”

আমি বেজার মুখে বললাম,” দে। সব আইডিয়া তো তুই-ই দিচ্ছিস। আইডিয়ার গোডাউন!”

নিহা আমার হাত ধরে কোথাও একটা নিয়ে যেতে লাগল। আমিও বাধ্যের মতো তার সঙ্গে হাঁটছি। হঠাৎ মা রণচণ্ডী রূপ নিয়ে আমার সামনে এসে দাঁড়ালো,” এই তারু, থাম।”

নিহা তাড়াহুড়ো করে বলল, “পরে থামবে আন্টি। আমরা এখন একটা জরুরী কাজ করছি।”

মা আমার আর নিহার হাতের বাঁধন ছাড়িয়ে দিল৷ ঝারি মেরে বলল,” তারু, তুই কি শুরু করেছিস? খবরদার কোনো উল্টা-পাল্টা করবি না। ওই বিষয় নিয়ে যদি একটুও বাড়াবাড়ি হয় তাহলে কিন্তু আমার থেকে খারাপ কেউ হবে না।”

আমি সরল হাসি দিয়ে বললাম,” কিছু হবে না, মা। সত্যি বলছি! আমার উপর ভরসা রাখো।”

এই কথা বলেই আমি দ্রুত নিহাকে নিয়ে কেটে পড়লাম৷ পেছন থেকে মা চিৎকার করে বলল,” তোর কিছু করারই দরকার নেই। আমি যেন না শুনি।”

নিহা জিজ্ঞেস করল,” আন্টি কি বিষয়ে বলছিল?”

” কোনো বিষয় না। তুই তোর আইডিয়ার কথা বল।”

নিহা থেমে দাঁড়াল। তারপর সামনে ইশারা করে বলল,” এইতো আইডিয়া!”

আমি নিহার ইশারা বরাবর তাকিয়েই চমকে উঠলাম,” এটা তো জামশেদ সাহেব।”

” হ্যাঁ ঠিক৷ তুই-ই না বলেছিলি? ঈশান ভাই তোকে জামশেদ সাহেবের আশেপাশে যেতে নিষেধ করেছে? তুই এখন উনার ঘরে গিয়ে বসে থাক। আমি চুপিচুপি ঈশান ভাইকে ডেকে এনে দেখাব। তারপর আমরা যা চাইছি তাই হবে।”

আমি হেসে উড়িয়ে দেওয়ার মতো বললাম,” ইম্পিসিবল, এটা সবচেয়ে ফালতু আইডিয়া৷ আমি ওই লোকের ঘরে যাবো না।”

” এর চেয়ে বেটার আইডিয়া আমার কাছে আর নেই। ঈশান ভাই তোর উপর সহজে রাগ করবে না। তুই তার গলায় ছুঁরি ধরলেও উনি হেসে বলবেন, আই লভ ইউ।”

আমি দুইপাশে মাথা নেড়ে বললাম,” তবুও এটা পারব না। অন্য যেকোনো কিছু পারব। কিন্তু আই হেইট জামশেদ ভাই!”

” কেন হেইট করিস? কত ভালো একজন মানুষ! ”

” তুই কচু জানিস। উনি আস্তো একটা খচ্চর। মায়ের কাছে শুনেছি, আমি যখন ক্লাস এইটে পড়তাম তখন উনি আমাকে বিয়ে করতে চেয়েছিলেন।”

নিহা আমার কথাটা শুনে তুমুল আনন্দিত স্বরে বলল,” ওয়াও। সত্যি?”

” তুই ওয়াও বলছিস কেন? তোর ইয়াক বলা উচিৎ। থু মারা উচিৎ। ”

” এইটা আরও ইন্টারেস্টিং হয়ে গেল না? আগুনে ঘি ঢালার মতো ব্যাপার। ঈশান ভাই শুনলে তো…”

আমি আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে বললাম,” এই কথা আবার ঈশানকে বলবি না প্লিজ।”

” না বললে তো খেলা জমবে না!”

” অনেক বড় বিপদ হয়ে যাবে। উনি ভাইয়ার বন্ধু হয়।”

” কিন্তু এখন হবে ঈশান ভাইয়ের শত্রু।”

আমি ভীত কণ্ঠে বললাম,” এসব কিছু করার দরকার নেই। শুধু শুধু সকালবেলা একটা কেলেংকারী হবে।”

আমাদের বাক-বিতন্ডা চলছিল। এরই মাঝে জামশেদ সাহেব ডাকলেন। অনিচ্ছা সত্ত্বেও আমাকে থামতে হলো। কারণ ভদ্রলোক আমার নাম ধরেই ডেকেছেন। আমি জোরপূর্বক মুখে হাসি এনে বললাম,” কিছু বলবেন আঙ্কেল?”

লোকটি দরজার কাছে এসে ভ্রু কুচকে বললেন,” তুমি আমার ছোটবোনের মতো। আঙ্কেল কেন ডাকছ?”

” স্যরি, ভাইয়া।”

” আচ্ছা সমস্যা নেই। যেটাই তুমি ডাকো সেটাই শুনতে ভালো লাগে।”

নিহা বিদ্রূপের দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকাল। আমার গায়ে আগুন জ্বলছে। কৃত্রিম হাসি দিয়ে বললাম,” ধন্যবাদ।”

” তোমরা দু’জন অনেকক্ষণ ধরে বাইরে দাঁড়িয়ে আছো৷ একটু ভেতরে আসো না, কথা বলি!”

নিহা আমাকে ঠেলে দিয়ে বলল,” যা।”

আমি নিহার হাত ধরে বললাম,” তুইও আয়।”

দু’জন একসাথে ভেতরে ঢুকলাম। নিহা হাসি-খুশি কণ্ঠে বলল,” গেস্ট হাউজ খুব সুন্দর করে সাজিয়েছেন ভাইয়া। আপনার রুচির প্রশংসা করতে হয়।”

জামশেদ সাহেব ঠোঁট উল্টে বললেন,” আমি কিছুই করিনি। সব তারিফের কামাল।”

আমি অবাক হয়ে বললাম,” ভাইয়ার কথা বলছেন?”

” হ্যাঁ। এই জায়গা আগে এতো সুন্দর ছিল না। তোমার ভাই-ই এখানে মাসের পর মাস এসে থাকতো, সবকিছু দেখে-শুনে রাখতো। তার তদারকিতেই এই জায়গা এখনও এতো সুন্দর।”

আমি বিস্ময় নিয়ে বললাম,” ভাইয়া এখানে মাসের পর মাস এসে থাকতো? কেন?”

জামশেদ সাহেব বেশ অবাক হয়ে বললেন,” তোমরা জানতে না?”

আমি কাঁধ ঝাঁকিয়ে উচ্চারণ করলাম,” কই না তো! কিভাবে জানব? ভাইয়া তো কখনও বলেনি। সে এইখানে কেন আসতো?”

জামশেদ সাহেব জীভ কেটে বললেন,” শিট, তাহলে তো আমার বলে দেওয়া উচিৎ হয়নি। সিকরেট ফাঁস করে দিলাম। তোমার মা মানে আন্টি কিন্তু সব জানে। আমি ভাবলাম তুমিও হয়তো জানো। যাইহোক, তোমার দাদীকে বোলো না। তিনি জানলে রাগ করতে পারেন।”

” দাদীকে আমি কিছু বলব না। প্রমিস করছি। আপনি আমাকে বলুন না, ভাইয়া এখানে কেন আসতো? কারো অপেক্ষায়?”

জামশেদ সাহেব দ্বিধান্বিত দৃষ্টিতে নিহার দিকে তাকালেন। নিহা বলল,” আমার সামনে বলতে অসুবিধা হলে আমি চলে যাই।”

আমি সঙ্গে সঙ্গে নিহার হাত ধরে আটকালাম,” না। ও আমার বেস্টফ্রেন্ড৷ আমি যা জানি তার সবকিছু সেও জানে। তাই ওর সামনেই বলুন। কোনো অসুবিধা নেই।”

নিহা হাত ছাড়িয়ে বলল,” তবুও আমি যাই। ভাইয়া হয়তো আনকমফোর্টেবল ফীল করছে।”

এই প্রথম নিহা আমাকে বিপদের মাঝে একা রেখে পালিয়ে গেল। আর জামশেদ নামক লোকটি বাঁধাও দিলেন না৷ তিনি অন্তত ভদ্রতার খাতিরে হলেও নিহাকে থাকতে বলতে পারতেন। আস্তো অভদ্র লোক! নিহা চলে যাওয়ার পর জামশেদ সাহেব বললেন,” তোমাকে আমি খুব সিকরেট একটা কথা বলতে যাচ্ছি তারু। তোমার আসলে এগুলো জানা দরকার।”

জামশেদ সাহেব আমার কাছে এলেন। আমি একটু পিছিয়ে গেলাম। তিনি আমার কানের কাছে মুখ এনে বললেন,” খুব গোপন কথা।”

আমি একটু সরে গিয়ে বললাম,” এইখানে কেউ নেই। আপনার এভাবে ফিসফিস করে বলতে হবে না৷”

লোকটি আমার হাতের বাহু টেনে ধরে বললেন,” দেয়ালেরও কান আছে।”

আমি হাত ছাড়িয়ে বললাম,” কথা বলার সময় গায়ে হাত দেওয়া আমার পছন্দ না।”

লোকটি আমার অপমান গায়ে মাখলেন না। বেহায়ার মতো হেসে বললেন,” আমি তোমার ভাইয়েরই মতো। আনইজি ফীল করার কিছু নেই। ”

আমি বরফের মতো শীতল কণ্ঠে বললাম,” আপনি মোটেও আমার ভাইয়ার মতো হতে পারবেন না।”

লোকটি আমার মুখের কাছে ঝুঁকে এসে বললেন,” ঠিক বলেছ। আমি তোমার ভাইয়ার মতো হতেও চাই না। তোমার ভাইয়া একটা চালবাজ লোক।”

” মুখ সামলে কথা বলবেন ভাইয়া সম্পর্কে। ”

লোকটি হো হো করে হেসে উঠলেন। আমার গা শিরশিরে অনুভূতিটা আবার হচ্ছে। আমি যেকোনো সময় এই লোকের মুখের উপর বমি করে দিতে পারি। জামশেদ সাহেব বললেন,” এই গেস্ট হাউজের আসল মালিক তোমার ভাইয়া।এই কথা কি জানো?”

আমার চোখ বড় বড় হয়ে গেল। তিনি আরেকটু কাছে এসে বললেন,” আগে এই গেস্ট হাউজের মালিক আমি ছিলাম৷ তোমার ভাইয়ার অনুরোধে দশ বছর আগে আমি বাড়িটা কিনেছিলাম। কিন্তু এমন বাড়ির কোনো প্রয়োজনই ছিল না আমার। তবুও কেন কিনেছিলাম বলো তো? ”

” ভাইয়ার অনুরোধে কিনেছিলেন?”

” হুম। কারণ তোমার ভাইয়া কথা দিয়েছিল পাঁচ বছরের মধ্যে সে এই বাড়িটার টাকা শোধ করে দিবে। আর যদি না পারে, তাহলে আমি যা চাইব তাই দিতে হবে। কিন্তু তোমার ভাইয়ার টাকা শোধ করতে দশ বছর লেগে গেল।”

আমি কোনো জবাব দিলাম না। শুধু শুনছি। জামশেদ সাহেব বললেন,”তোমার ভাইয়া টাকা এখন সম্পূর্ণ শোধ করে দিয়েছে। কিন্তু নিজের কথা রাখেনি। পাঁচ বছরের জায়গায় দশ বছর লেগেছে। শর্ত অনুযায়ী আমি যা চাই তাই পাওয়ার কথা ছিল।”

আমি ঘামতে লাগলাম৷ লোকটি হাসলেন। কিন্তু হাসিটা আমার কাছে প্রচন্ড বিদঘুটে লাগল। জামশেদ বললেন,” তোমার ভাইয়া যেহেতু কথা রাখেনি সেহেতু আমি যা চেয়েছিলাম তা পাইনি।”

আমি ক্রুর দৃষ্টিতে তাকালাম। লোকটির বীভৎস নজর আর বিশ্রী হাসির সামনে ক্রোধ আর অস্বস্তি দু’টোই কাজ করছে। জামশেদ বললেন,” তারু তুমি কি জানো আমি কি চেয়েছিলাম?”

” জানি। মা বলেছে।”

” আন্টি বলে দিয়েছে?”

” হুম। আপনার যেটা পাওনা সেটা আপনার অবশ্যই পাওয়া উচিৎ। ”

আমি এই কথা বলেই সটান করে জামশেদ সাহেবের গালে চড় মারলাম। তখনি দরজা ঠেলে ঘরে ঢুকল ঈশান। তার পেছনে নিহা। ঈশান রাগী কণ্ঠে প্রশ্ন করল,” কি হয়েছে তারিন?”

আমি শান্ত কণ্ঠে বললাম,” কিছু হয়নি।”

” আই সুয়্যার! আই উইল কিল হীম।”

ঈশান আক্রমণাত্মক ভঙ্গিতে জামশেদ সাহেবের দিকে এগিয়ে গেল।

নিহা আমার কাছে এসে গদগদ হয়ে বলল,” ওয়েট ফর দ্যা একশন সিন!”

ঈশান ততক্ষণে অভদ্রলোকের কলার চেপে ধরেছে। জামশেদ কঠিন গলায় বললেন,” ছাড়ো।”

ঈশান চোয়াল বরাবর ভীষণ জোরে একটা ঘুষি মারল। আমি ছুটে এসে বললাম,” উনি কিছু করেননি। প্লিজ ছেড়ে দিন।”

ঈশান চোয়াল শক্ত করে বলল,” কিছু না করলে তুমি চড় মারলে কেন?”

আমি ঢোক গিলে বললাম,” আমার যেটা করার আমি করেছি। আপনি কিছু করবেন না।”

ঈশান জামশেদ সাহেবকে ছাড়ল তবে প্রচন্ড জোরে ধাক্কা মেরে। জামশেদ সাহেব একটুর জন্য দেয়ালে আঘাত খাওয়ার থেকে বাঁচলেন। আমি ঈশানের হাত ধরে ঘর থেকে বের হয়ে এলাম। এতোবড় ঘটনার পর জামশেদ সাহেব চুপ করে থাকলেন না। এসব নিয়ে সকাল সকাল অনেক ঝামেলা হলো। তাঁর অভিযোগ, আমি আর ঈশান বিনা অপরাধে তাকে আঘাত করেছি। তাকে অপমান করা হয়েছে। যদি ক্ষমা না চাওয়া হয় তাহলে তিনি চলে যাবেন। ব্যাগ-পত্র গুছিয়েও নিলেন। হয়তো তিনি ভেবেছিলেন ভাইয়া বাঁধা দিবে। কিন্তু মজার বিষয়, ভাইয়াও তেমন কিছু বলল না। জামশেদ সাহেব সত্যি বাড়ি ছেড়ে চলে গেলেন।

সন্ধ্যায় মেহেন্দীর অনুষ্ঠান। আমি মেজেন্টা রঙের শাড়ি পরেছি। নীরা আর রেহেনা প্রায় দুইঘণ্টা ধরে আমার মুখে মেকাপের স্তর বসালো। বেলীফুলের গাজরা, দুল আর মালায় আমাকে সাজানো হলো। আয়নাতে দেখে নিজেই নিজেকে চিনতে পারছিলাম না। মেহেন্দীর আর্টিস্ট আমার পুরো একহাতে বিভিন্ন নকশায় ‘ঈশান’ লিখে ভরিয়ে ফেলল। জঙ্গলের মতো জায়গায় প্যান্ডেল টানানো হয়েছে। সেখানে সবাই নাচ-গান করছে। অনলাইনে খাবার অর্ডার করা হয়েছে। সবার মনেই ফুরফুরে আমেজ। শুধু দু’জন মানুষের মনে চলছে অবাধ ঝড়। ভাইয়া অযথাই সবার সঙ্গে চেঁচামেচি করছে। ছোট্ট একটা বিষয় নিয়েও খুব রেগে যাচ্ছে। মোহনা আন্টি যেখানে সবসময় হাসি-খুশি থাকেন সেখানে আজ তিনি সবচেয়ে শান্ত। নিহা আমার কাছে এসে ফিসফিস করে এসব বলছিল। আমি মনখারাপ করলাম। নিহা বলল, “তারু জানিস, ঈশান ভাই কিন্তু একটা লেমন কালার পাঞ্জাবী পরেছে।”

” তো এই কথা এমন ফিসফিস করে বলার কি আছে? তুই দিন দিন আঁতেল হয়ে যাচ্ছিস।”

” আরে, কেন বলছি সেটা আগে শোন!এই পাঞ্জাবী চয়েজ করেছে সামিয়া। আমি বললাম তারুর লেমন কালার পছন্দ না। সাদা রঙের পাঞ্জাবী পরুন। কিন্তু তিনি আমার কথা শুনলেন না।”

” কি আশ্চর্য! সামিয়ার পছন্দের এতো মূল্য আর আমার পছন্দের মূল্য নেই?”

” সেটাই তো।”

” আচ্ছা থাক, বাদ দে।”

” তুই এতো সহজে বাদ দিবি?”

” তো এখন কি এই ছোট-খাটো বিষয় নিয়ে আমি ঝগড়া করব?”

” অবশ্যই করবি। আমরা তো ঝগড়া করার কারণই খুঁজছিলাম।”

আমি চট করে নিহার দিকে তাকালাম। নিহা বলল, ” ঈশান ভাই ব্রীজের কাছে আছেন। সেখানে আর কেউ নেই। তুই গিয়ে ঝগড়া শুরু কর। আমি তারিফ ভাই আর মোহনা আন্টিকে ডেকে আনছি।”

” তুই কি শিউর যে আমাদের ঝগড়া থামাতে এসে তারাও ঝগড়ায় লেগে যাবে?”

” নাইন্টি পার্সেন্ট শিউর। এটলিস্ট ট্রাই তো করি!”

ঈশানকে লেমন কালার পাঞ্জাবীতে এতো সুন্দর লাগছে যে আমার একটুও ঝগড়া করতে ইচ্ছে হলো না। ঈশান তো আমাকে দেখে হাঁ করেই তাকিয়ে রইল। আমি খিটমিট করে বললাম,” কি? চিনতে পারছেন না? আমি তারিন।”

ঈশান হেসে বলল,” চিনতে পারব না কেন? কিন্তু তোমাকে অন্যরকম লাগছে।”

” জানি। মেকাপ করার পর আমার চেহারাই বদলে গেছে।”

” না, সুন্দর লাগছে।”

আমি ঝারি মেরে বললাম,” কিন্তু আপনাকে একদম সুন্দর লাগছে না।”

ঈশান আহত কণ্ঠে বলল,” কেন?”

” এটা কি পরেছেন আপনি? এতো বিশ্রী রঙ আমি আগে কখনও দেখিনি।”

” আচ্ছা৷ তাহলে কি চেঞ্জ করে ফেলব?”

” থামুন। চেঞ্জ করবেন কেন? আপনি এটা কার পরামর্শে পরেছেন সেটা বলুন।”

” সবাই বলছিল তাই।”

” সবাই বলছিল নাকি সামিয়া বলছিল?”

” হ্যাঁ সামিয়াও বলেছে। কিন্তু প্রবলেমটা কি?”

” অবশ্যই প্রবলেম আছে। আপনি সামিয়ার কথা কেন শুনবেন?”

ঈশান অবাক হয়ে তাকাল। আমি অগ্নি কণ্ঠে বললাম,” আমি আপনাকে সাদা পাঞ্জাবী পরতে বলেছিলাম। আমার কথার চেয়েও কি সামিয়ার কথার মূল্য বেশি?”

” তারিন, তুমি আমাকে এই বিষয়ে কিছুই বলোনি।”

” অবশ্যই বলেছি। আপনি ভুলে গেলে সেটা কি আমার দোষ? এখনি আমার কথা ভুলে যান। মানে কোনো গুরুত্বই নেই। বিয়ের পর তো মনে হয় আমার নামও ভুলে যাবেন। ”

ঈশান হাসতে হাসতে বলল,” তোমার কি শরীর ঠিকাছে? সামান্য একটা বিষয় নিয়ে এমন করছ কেন?”

” এটা আপনার কাছে সামান্য বিষয় মনে হয়? ওহ, আমি তো ভুলেই গেছিলাম। আপনি লন্ডনে বড় হয়েছেন। আপনার কাছে তো বিয়ের মতো একটা বিষয় সামান্যই মনে হবে।”

” হোয়াট রাবিশ! কিসের সাথে কি মেলাচ্ছো তারিন?”

ঈশান রেগে যাচ্ছে। পেছনে দেখলাম মোহনা আন্টি আর ভাইয়া এদিকেই আসছে। তাদের চেহারায় দুশ্চিন্তার ভাঁজ। নিহা আমাকে ইশারায় থাম্বস আপ দেখালো। আমি আরও চেঁচিয়ে ঝগড়া শুরু করলাম,” এখন আমার সাথে আপনি গলা উঁচু করেও কথা বলছেন? বিয়ের আগেই এই অবস্থা? বিয়ের পর তাহলে কি করবেন? আমার গায়ে হাত তুলবেন? আমিও তুলতে পারি। ছোটবেলা থেকে একশন মুভি দেখতে দেখতে বড় হয়েছি। অনলাইনে ক্যারাটের কোর্সও করেছি। আপনি একটা দিলে আমি দশটা দিবো।”

আমাদের এতো সুন্দর পরিকল্পনায় জল ঢেলে ঈশান এই তুমুল ঝগড়ার মাঝেই আমার কোমর চেপে ধরে আমার ঠোঁটে চুম্বন করল। তার এমন আচরণে আমি বরফের মতো জমে গেলাম।

*

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here