#গল্প-তুমিময়
#Aysha_khan
#পার্ট ৯
‘ অয়ত্রী আমি জানি তুমি তোমার নানুকে অনেক ভালোবাস তাই তো তার এই রূপ আমি চাইনি কখনো তোমার সামনে আসুক। তাই উনার সব কথা মেনে নিয়েছিলাম! কিন্তু যখন তোমার মুখেই শুনলাম তুমি আমাকে ভালোবাস আমি আর নিজেকে আটকাতে পারিনি। পারিনি তোমার বিষন্ন ভগ্নহৃদয়ের চেহারা দেখতে। কিন্তু বিশ্বাস করো তুমি যতটুকু কষ্ট পেয়েছ আমি তার কয়েকগুণ বেশি কষ্ট পেয়েছি…. ৪ বছর ধরে লাগাতার পাচ্ছি! তাই তোমার কষ্টটা আমি সব থেকে ভালো বুঝেছি। আমি তোমাকে ভালোবাসি সেটা অদৃশ্য ভাবেই হোক। আমার প্রিয়শীর কষ্ট আমি সহ্য করতে পারিনি তাই সেদিন….. আই এ্যাম সরি অয়ত্রী! ‘
আমি কাঁদতে কাঁদতে মাথা তুলে বললাম,
‘ কিন্তু নানু কেন আমাকে পছন্দ করে না? কি করেছি আমি? ‘
আদনান ভাই দীর্ঘশ্বাস ফেলল! অতঃপর বললেন,
‘ তোমার কোনও দোষ নেই অয়ত্রী। তুমি নিশ্চয়ই জানো! তোমার বাবা হিন্দু ধর্মের ছিলেন। কিন্তু ফুপিকে বিয়ে করার আগে তোমার দাদুবাড়ির সবাই ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন! কারণ তোমার বাবা এবং তোমার চাচ্চু দু’জনেই মুসলিম মেয়ের প্রেমে পরেছিলেন। তোমার দাদু ভালো মানুষ ছিলেন উনি সব মেনে নেন। আমাদের বাসায় বাবারা মেনে নিলেও সব ফুপির জন্য৷ দাদু কখনওই এসব মানতে পারেনি। তার মতে তোমার বাবা ফুপিকে বড় ঘরের মেয়ে বলে ফাঁসিয়েছেন। দাদু কখনওই তোমার বাবাকে পছন্দ করতেন না। আর যখন ফুপি মারা গেলেন তুমি হওয়ার পর। দাদুর একটাই কথা তোমার জন্যেই ফুপি মারা গিয়েছেন। এসব লেইম কথা বাবারা মেনে নিতে পারেনি। কিন্তু মা বলে কিছু বলতেও পারতেন না।
তারপর অনেক বছর চলে গেলো! তোমার বিয়ের কথা শুনে আমাকে বাবাই বললেন তোমাকে নিয়ে আসতে… আর আমিও নিয়ে এলাম কিন্তু তোমাকে একা নিয়ে আসিনি প্রেমে রোগ নিয়ে এসেছিলাম সাথে সেই প্রেম রোগে আক্রান্ত হয়ে গেলাম আমি ৷ কিশোরী অয়ত্রীর প্রেমে পরতে যেন বাধ্য ছিলাম আমি। একা একা প্রেমে পরা বড্ড মজার অয়ত্রী। আমার সময় বেশ ভালো যাচ্ছিলো প্রেয়সীকে চোখ দেখা জ্বালাত্বন করা অভ্যাস হয়ে দাঁড়ালো। আর তোমার মনে আমার জন্য কাজ করতো ভয়। তোমার ভীতু ফেইসের প্রেমে আমি বার বার ঘায়েল হতাম।
এসবের মধ্যে বছর চলে গেলো আমি প্রেমে ডুবে আছি। তোমায় কারোর সাথেই মেনে নিতে পারতাম না আলাদা টেক কেয়ার করতাম এসব সবার চোখেই পরতো! কেউ কিছু না বললেও মনে মনে সবাই বুঝতো আমার মনের অবস্থা। কারোর প্রবলেম ছিলোনা। কিন্তু দাদুর ছিলো। সে কখনওই খুশি ছিলেন না তুমি এ বাড়িতে থাকছো। শুধু আমার ভয়ে কিছু বলেনি। কিন্তু যখন বুঝলো আমি তোমাকে ভালোবাসি। উনি আদৃতার সাথে আমাকে পরিচয় করালেন। অতঃপর কিছু দিন যেতেই বললেন। আদৃতাকে উনি আমার বউ হিসেবে আমাদের বাড়ি চায়৷ আমি বরাবরই মতোই রেগে গেলাম কিন্তু দাদুকে আমি শ্রদ্ধা করতাম অনেক তাই বেশিকিছু বলতে পারছিলাম না। দাদু বেশকিছু দিন আমাকে বোঝালেন। আমি মানতে নারাজ একসময় আমি নিজ মুখে বলেই ফেলি আমি তোমাকে ভালোবাসি। তখন দাদু রেগে গেলেন ভয়ংকর ভাবে এবং আমাকে উনার ছোট মনমানসিকতার সব কথা খুলে বললেন। আমি হতভম্ব ছিলাম। আমি তখনই যানতাম তুমি এসব জানলে মারাত্মক কষ্ট পাবে৷ দাদু আমাকে বললেন তোমাকে ভুলে যেতে। নাহলে উনি এসব আমাকে বলতে এবং আমাদের বাড়ি থেকে তারিয়ে দিতে বাধ্য হবেন। বাবারা তখন চুপ ছিলেন মার উপর কথা বলতে পারছিলেন না। আমি কিছুটা ভয়েই মেনে নেই উনার কথা। কারণ একটাই তুমি ছোট্ট ছিলে ঐ মুহূর্তে আমাদের বাসা থেকে চলে গেলে তোমার লাইফ নষ্ট হয়ে যেতো বাসায় অশান্তি হতো। তাছাড়া তোমার অতীত তোমার পিছু ছাঁড়েনি তখনও। সব থেকে বড় কথা তুমি কষ্ট পেতে তাই আমি চুপচাপ দাদুর কথা মেনে নেই। ভেবেছিলাম এদিন সব ঠিক হয়ে যাবে।
তারপর আস্তে আস্তে চোখে পরলো তুমি আমাকে পছন্দ করোনা। এক কথায় দেখতেই পারোনা। আমি তোমাকে ভালোসলেও তুমি কখনওই আমাকে মেনে নিতে পারবেনা ভয় পাও তুমি আমাকে। তার কারণ ও আমি নিজেই। কেননা দাদুকে বিশ্বাস করাতে আমি তোমাকে ভুলে গেছি বা যাব! শক্ত ব্যাবহারই করতাম আমি তোমার সাথে। কষ্ট হতো অয়ত্রী প্রেয়সীর চোখে নিজের জন্য ভয় দেখতে কিন্তু পরিস্থিতি অন্য ছিলো। তুমি আমাকে ভাই ভাবতে দাদু তোমাকে পছন্দ করতেন না। আমিও তোমাকে ভালোবাসি বলতে পারতাম না। বাবারাও আমার সাপোর্টে ছিলো না। দাদু প্রতিনিয়ত নিজের সিদ্ধান্তে অটল। আমি সব দিক থেকে হাঁপিয়ে গেলাম ক্লান্ত ছিলাম একা লড়াই করতে করতে সবার সাথে!
তখন ভাবলাম তুমি যখন আমাকে ভালোবাসইনা তাহলে শুধু শুধু তোমাকে কষ্ট দিয়ে কী হবে। আমি শুধু তোমাকে আগলে রাখতাম। বাকি সব দাদুর কথা মতোই হতে লাগলো। আদৃতার সাথে সম্পর্কে জরাতে বাধ্য করলেন দাদু আমি মেনে নিলাম। কিন্তু তোমাকে কারোর পাশে সহ্য হতোনা উল্টো পালটা করে বসতাম। এভাবেই চলে গেলো কয়েকটা বছর। এতো সবের মাঝে তোমার ভীতু মনে কি চলছিলো আমি ধরতে পারিনি। তবে আমি জানতাম আমি তোমার অভ্যাসে মিশে গেছি। কিন্তু ভালোবাসো আমাকে কখনওই বুঝতে দাওনি আমাকে তুমি। আর সেদিন যখন নিজ মুখে বললে আমাকে ভালোবাসো। এত রাগ হলো। মনে হলো আরও আগে যদি বলতে আমি একটু কম কষ্ট পেতাম। তুমি বলোনি। আর যখন বললে আমি দাদুর এই বেড়াজালে আটকে থাকতে পারলাম না। অনেক চেষ্টা করেওনা। তাতে হোক তোমার কষ্ট এখন তুমি বড় হয়েছে সব কষ্ট সহ্য করার কিছু ক্ষমতা হয়েছে নিশ্চয়ই! আমি আর এসব মেনে নিতে পারতাম না। আমার তোমাকে চাই! আমি তো সেই রাতটার অপেক্ষায় ছিলাম কিন্তু সেটা স্বপ্নের মতোই কাল্পনা মনে হতো আমার যা কখনও সত্যি হবেনা ভাবতাম। কিন্তু দেখ সেটাও সত্যি হয়েছে। আমি কিছুতেই ছাড়তে পারবোনা দাদুর বিকৃত চিন্তার জন্য! প্লিজ অয়ত্রী আমি তোমাকে জোর করবোনা আমাকে বিয়ে করতে। শুধু বলবো আমাকে আর কষ্ট দিওনা তোমরা! ‘
সব শুনে কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে গেলাম। আদনান শেষের কথা গুলো এতটাই মিনতির স্বরে বলল, যে হু হু করে কাঁন্না বেরে গেলো। আমি এই নির্দয় লোকটার এতো করুণ স্বর আগে গুনিনি। সর্বদা কঠিক স্বরেই কথা বলেন আদনান ভাই। কিন্তু সব শোনার পর আমি কিছুতেই আদনান ভাইয়ের কষ্ট হয়তো কমাতে পারবোনা! কিছুতেই এভাবে উনাকে বিয়ে করতে পারবোনা! এভাবে এই পরিস্থিতিতো কখনওই না! আমি আস্তে করে নিজেকে ছাড়িয়ে নিলাম উনার থেকে। কষ্টে বুক ফেঁটে যাচ্ছে! তবুও নিজেকে ধাতস্থ করে চোখ মুখ মুছে বললাম,
‘ আপনি আমাকে জোর করবেন না বলছেন? ‘
আদনান ভাই তার রক্তিম চোখ জোরা আমার মুখে নিবদ্ধ করলেন স্মিত কন্ঠে বললেন,
‘ করবোনা! ‘
আমি একটু ভরসা পেলাম তার কণ্ঠে! তাই কাত কচলাতে কচলাতে। নিচের ঠোঁট কামড়ে বললাম,
‘ এভাবে আমি বিয়ে করতে চাইনা! আমাদের যতই কষ্ট হোক তাতে! নানু না চাইলে আমি আপনাকে বিয়ে করবোনা! আপনি আমাকে এখুনি আমাকে বাবার কাছে দিয়ে আসুন! প্লিজ!’
বলেই আদনান ভাইয়ের দিকে একবার তাকালাম উনার চোয়াল শক্ত হয়ে গিয়েছে ইতিমধ্যে! ভয়ে দুকদম পিছিয়ে গেলাম! আদনান ভাইয়ের ফর্সা মুখ রক্তিমবর্ণ ধারণ করেছে! মারবেন আমাকে ভেবেই আমি দ্রুত বললাম,
‘ আপনি বলেছেন আপনি আমাকে জোর করবেন না! তাহলে আমার মতামতে আপনি রেগে যেতে পারেন না! ‘
আদনান ভাই ভয়ংকর রাগী অবস্থায় ও শীতল হাসলেন। বললেন,
‘ জোর করবোনা বলেছি! এটাতো বলিনি তুমি যা বলবে আমি মেনে নিবো? ‘
ধপ করে বসে পরলাম ফ্লোরে। আদনান ভাই শক্ত করে হাত মুঠিবদ্ধ করে রেখেছেন হাতের রোগ গুলো স্পষ্ট দৃশ্যমান! আমি মাথা নিচু করে বসে রইলাম। আদনান ভাই বেশকিছু ক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলো সেভাবেই। আমি জানি সে রাগ কন্ট্রোল করার চেষ্টায়। অতঃপর হঠাৎ ধুপ ধাপ পায়ে চলে যেতে যেতে বললেন,
‘ ঠিক আছে জোর করবোনা। কিন্তু যতক্ষণ অতিরিক্ত ভালো মেয়ে সাজার ইচ্ছে চলে না যায়। তুমি এখানেই বন্দী থাকবে! ‘
চোখ দিয়ে গরিয়ে পানি পরছে! লোকটা নির্দয়, নির্দয়, নির্দয়। জোর করবেনা অথচ বুঝিয়ে গেলো বিয়ের জন্য রাজিনা হলে আমাকে বন্দি করে রাখবেন! আমি পাত্তা দিলাম না আদনান ভাই বাইরে দিয়ে লক করে চলে গেলেন। আমি জানি আদনান ভাই যেতেই হুরমুর করে সব কাজিন রুমে ঢুকে যাবে। তাই অশ্রুসিক্ত চোখে ভাবতে লাগলাম। আমরা যাকে যেমন ভাবি সবাই তেমন নয়! মানুষ ভেতরে এক বাইরে আরেক! কি আশ্চর্য তবুও বুঝার উপায় নেই কিছুই? এমন যদি হতো সব বুঝা যেতো আর কোনও দুঃখ থাকতো নাকো!
আজ বড্ড মাকে মনে পরছে তাকে আমি কল্পনায় ছাড়া কখনও দেখিনি বাস্তবে। আর দেখেছি ছবিতে! আমার মা বড্ড সুন্দরী ছিলেন। ছবিতেও মারাত্মক সুন্দরী লাগতো তাকে। আমার দাদু বলতেন মা বড় ঘরের মেয়ে হলেও কখনওই তার মধ্যে অহংকারের ছিটে ফোঁটা ছিলোনা। বাবা যেভাবে রাখতেন মা তাতেই খুশি ছিলো। সুন্দর করে মানিয়ে নিতে পারতেন সবকিছুর সাথে নিজেকে। দাদু বলতেন সেই গুণ আমার মধ্যেই আছে আমিও মানিয়ে নিতে পারি সব কিছুর সাথে। কিন্তু আজ নানুর চিন্তা ভাবনা গুলো মেনে নিতে বড্ড কষ্ট হচ্ছে। ছোট মনে সত্যি আঘাত পেয়েছি। আচ্ছা আজ মা বেঁচে থাকলেও কি নানু এমন করতেন? না! হয়তো ভালো মানুষের একটা মুখোশ পরে থাকতেন। যা হয় ভালোই হয় হয়তো। মিথ্যে ভালোবাসার চেয়ে ঘৃণাও ভালো!
মা বাবাকে জরিয়ে খুব করে কাঁদতে ইচ্ছে করছে। আজ নিজেকে বড্ড অসহায় লাগছে! যা কখনো ফিল হয়নি। বাবা মাকে এই মুহূর্তে পাওয়া সম্ভব নয়। অন্তত আদনান ভাইকে জড়িয়ে কাঁদতে চাই আমি। উনিইতো এটাই চায় কিন্তু কি করে বুঝাই আমি যে আর মেনে নিতে পারছিনা!
——–
রাত পেরিয়ে সকাল হয়ে গেলো কাঁদতে কাঁদতে কখন ঘুমিয়ে পরেছি মনে নেই৷ আমি ভেবেছিলাম ঘুম থেকে উঠে সবাইকে দেখবো কিন্তু সেকি দরজা খুলেনি কেউ আমি এখনও ফ্লোরেই পরে আছি। আদনান সত্যি তার সিদ্ধান্তে অটল নয়তো। ইয়া আল্লাহ, এই নির্দয় লোকটার মনে একটু মায়া দয়ার ফুঁল ফুটিয়ে দাও! পিহু আপু আর আদনান ভাই তিক্ততার গোডাউন আর এতই স্ট্রেইট ফরওয়ার্ড নিজের কথায় নরচর মরে গেলেও হতে চায়না! আমি গিয়ে দরজা ধাক্কাতে লাগলাম।
বেলা তখন ১১ টা। বাহিরে এখুনি কাঠ ফাটা রোদ্দুর আজ। সারা ঘরে রোদের উত্তাপে ঝলমল করছে সেই আলোতেই আমার ঘুম ভেঙেছে! পেটে খিদের জ্বালাও ফিল করতে পারছি। উফফ… কিছুদিন যাবত জীবনের মানেটাই বদলে গেলো আমার! বেডে গিয়ে উল্টো হয়ে ধপ করে শুয়ে পরলাম আবার ঠিক তখন বুঝলাম বারান্দায় কেউ দাঁড়িয়ে!
প্রথমে ভয় পেলেও দৌড়ে গেলাম কে ওখানে দেখতে!
আদনান ভাই দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে স্মোক করার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। ঠোঁটে সিগারেটের স্টিকটা রাখতেই টেনে ফেলে দিলাম বাহিরে ছুঁড়ে! আদনান ভাই দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন,
‘ সব ছেড়ে দিবো তুই আমার হয়ে যা প্লিজ! ‘
চলবে!