তুমিময় পর্ব ৭+৮

#গল্প-তুমিময়
#Aysha_khan
#পার্ট ৭
বেশকিছু ক্ষণ দরজা ধাক্কালাম কেউ খুলোনা।আদনান ভাইয়ের রুমের সামনে বাড়ির সবার গলার স্বর শুনতে পেলাম তবে স্পষ্ট কিছুই শুনতে পেলাম না। চেষ্টা করেও না। প্রথমে চিন্তা হলেও পরে ভাবলাম উনার রাগ সর্বদাই উঠে থাকে! তাই সেদিকে পাত্তা না দিয়ে আমি ভাবলাম একটু ঘুমিয়ে নেই! সারারাত না ঘুমানোর ফলে ঘুমঘুম ভাব আর চোখ জ্বালা করছে। আমি ক্লান্ত শরীরে বিছানায় ধপাস করে শুয়ে পরলাম।

এক রাত্রী জেগে থাকার দরুন শুতেই রাজ্যের ঘুম চোখে নেমে এলো! কিন্তু ঘুম ভাঙার আগেই দরজা তীব্র শব্দে খুলে যাওয়ার আওয়াজে আমার ঘুম ভাঙলো! আমি লাফিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে গেলাম। আদনান ভাই ততক্ষণে আমার হাত টেনে বাহিরে নিয়ে যাচ্ছেন। আমি শুধু ওড়নাটা ঠিকঠাক করলাম। উনাকে কিছু বলার সাহস টুকু করলাম না। কেননা উনাকে দেখতে নরমাল লাগছেনা। রুম থেকে বেরুতেই নানু আদনান ভাই এবং আমার সামনে এসে দাঁলালেন। তাকে এভাবে দাঁড়াতে দেখে আমি আদনান ভাইয়ের দিকে একবার, একবার বাকি সবার দিকে তাকালাম। আদৃতা আপু কাঁদছে তাকে তার মা ধরে রেখেছে। উনার বাবা মাহাদ আঙ্কেল এর মুখে দাম্ভিকতার ছাপ। বাসায় সবার মুখ থমথমে! আমার বুকে অজানা ভয়ে মোচড় দিয়ে উঠলো।

আমাদের সামনেই নানু দাঁড়িয়ে। নানুকে পাশ কাটিয়ে আদনান ভাই আমাকে নিয়ে নিচে দিকে যেতে গেলেই। নানু বৃদ্ধা ভাঙা ফ্যাকাসে গলায় চেঁচিয়ে বললেন,

‘ আদনান তুই এই মেয়েকে বিয়ে করলে আমি এখুনি মরে যাবো! ‘

ঘুম থেকে উঠেই এমন পরিবেশ তার উপর নানুর কথাটা আমার কানে বার বার বেজে ওঠে। কয়েক মূহুর্ত সময় লাগে এই কথার মানে কী? আমি অবাক চোখে আদনান ভাইয়ের দিকে তাকাতেই আদনান ভাই নানুর থেকে দ্বিগুন চেঁচিয়ে বললেন,

‘ দাদু আমি ওকে আমার চাই! আমি আর কিছু শুনতে চাইনা। ‘

আদনান ভাই থামলেন বড় বড় শ্বাস ফেলেও রাগ কন্ট্রোল করতে না পেরে আকাশ পাতাল কাঁপিয়ে চেঁচিয়ে বললেন,

‘ আমি বিয়ে করলে এক মাত্র ওকেই বিয়ে করবো! কারোর প্রবলেম থাকলে আমাকে জানিয়ে দেবে। আমি আর আপনাদের বাড়ি যাবোনা! ব্যাস এটাই আমার লাস্ট কথা!’

কথাটা বলে আমার হাত ছেলে বড় মামীর সামনে গিয়ে তাকে জরিয়ে ধরে ভাঙা গলায় বলল,

‘ মা আমি অনেক চেষ্টা করেছি! পারিনি প্লিজ আমাকে ক্ষমা করে দিও! ‘

বড় মামী ছেলের এহেন অবস্থা দেখে কেঁদে ফেললেন। আদনান ভাইয়ের কপালে চুমু খেয়ে বললেন,

‘ আমার বাবা যেটাতে খুশি আমিও তাতেই খুশি। তোর ইচ্ছে গুলো মেনে নিতে আমার কখনওই দ্বিমত ছিলোনা থাকবেওনা! ‘

আদনান ভাই ফ্যাকাসে মুখে স্মিথ হাসলেন। মার কপালে চুমু খেয়ে আমার কাছে এসে শক্ত হাতে হাত ধরলেন আবারও। সত্যি বলতেই নানু এই মেয়ে বলতে কি বুঝিয়েছেন আমি বুঝার চেষ্টা করছি। নানুর দিকে তাকিয়ে। কিন্তু উনি আমার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে যেন ভস্ম করে দিবে আমাকে এখুনি! আদনান ভাই আমাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছেন নিচে। কিন্তু আমি এখনও পিছনেই তাকিয়ে নানু দৃষ্টির অগোচর হতেই সবগুলো কাজিনকে দেখতে পেলাম। তাদের মুখে বিশ্বজয় করা হাসি। হায়াদের মুখ সেই হাসির রেশ মাত্রাধিক বেশি! সেদিকে বেশি তাকাতে পারলাম না সিঁড়ি দিয়ে নামার সময় আদনান ভাইয়ের সাথে তাল মিলিয়ে নামতে কষ্ট হচ্ছিলো। তাই উনার থেকে হাত ছাড়াবার জন্য চেষ্টা করছিলাম ছাড়লেন না। দ্বিগুণ জোরে হাত চেপে নেমে একেবারে তার কালো গাড়িটার সামনে থামলেন। গাড়ির দরজা খুলে একবার তাকালো আমার দিকে। এত ধারালো দৃষ্টি ছিলো দেখে ভয়ে চুপচাপ বসে গেলাম। আদনান ভাই নিজেও ড্রাইভিং সীটে বসে গাড়ি স্টার্ট দিলেন।

টু শব্দ করতে পারলাম না কিন্তু মনে হাজারো প্রশ্ন রয়ে গেলো কি হচ্ছিলো উপরে? আদনান ভাইয়ের কথা নানুর কথা মামীর কথা সব মিলিয়ে তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে আমার কাছে৷ মাথায় প্রেশার তৈরি হচ্ছে আর তাতে আমি হিতাহিতজ্ঞান শূন্য হয়ে অস্ফুট স্বরে বললাম,

‘ আদনান ভাই নানু কী বললো এগুলো? আমাকে বলেছে না আদৃতা আপুকে? ‘

আদনান ভাই কিছুই বললেন না। উনি ফ্যাকাসে শুকনো মুখে ড্রাইভ করে যাচ্ছেন! হঠাৎ উনার দিকে গভীর দৃষ্টিতে তাকালাম অনেকটা দিন পর আজ! উনাকে দেখে মনে হলো উনি অনেক রাত নির্ঘুম কাটিয়েছে। চোখের নিচে লাল আভা জ্বলজ্বল করছে যা উনার নির্ঘুম থাকার প্রমান দিচ্ছে। কিছু দিনে পর দেখেই মনে হচ্ছে আদনান ভাই শুকিয়ে গেছেন৷ সিল্কি চুল গুলো নির্জিব আর এলোমেলো লাগছে আজ যা সব সময় পরিপাটি দেখে এসেছি আমি! তবুও কালো টি শার্টে ব্ল্যাক জিন্সে চমৎকার লাগছে তাকে। শুধু সুন্দর মুখশ্রীটা আজ বড্ড বিষন্ন উনাকে এভাবে দেখে মাথা নিচু করে কেঁদে ফেললাম আমি। আমার কান্নার আওয়াজ তার কানে যেতেই গাড়ি কষে ব্রেক করলেন উনি! কঠোর স্বরে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন,

‘ আজ আমার মন গলবে না অয়ত্রী! সব তোর জন্য হয়েছে। কি জাদু করেছিস আমাকে? দাদু ঠিকি বলে তুই একটা…..! ‘

তার মানে আদৃতা আপুকে নয় নানু ঐ কথা আমাকেই বলেছেন? আদনান ভাই আমাকে বিয়ে করতে চাইলে নানু…. উনাকে থেমে যেতে দেখে দ্রুত বললাম,

‘ আমি একটা কী আদনান ভাই। নানু কখনওই আমাকে বাজে কথা বলতে পারেনা! আজ উনি এসব কথা আমাকেই বলেছেন? কিন্তু কেন? ‘

আদনান ভাইয়ের চোখের কোণা বেয়ে এক ফোঁটা অশ্রুকণা গরিয়ে পরলো। উনি ভাঙা গলায় চেঁচিয়ে বললেন,

‘ শুধু আমার শাসন আমার চেঁচামেচি আমার অসত্যতা, নির্দয়তা আমি খারাপ এগুলোই তোর চোখে পরে? আর কারো কুটিলতা চোখে কেন পরেনা তোর? ‘

তার গাড়ি কাঁপিয়ে চিৎকারে ভয়ে সীটে আরও এঁটে বসলাম। চোখ ফেটে জল গলাচ্ছে। নানু? নানু কী কিছু করেছে আমাকে? আমি আবার প্রশ্ন করলাম,

‘ নানু কী কিছু করেছে নানু ঐ কথা কেন বললেন? ‘

আদনান ভাই রক্তিম চোখে আমার দিকে ভয়ংকর চাহুনি ছুঁড়ে মারলেন। দাম্ভিক কণ্ঠে বললেন,

‘ তোর নানু কী করেছেন সেটা আর তোর না জানলেও হবে! আগে নিজের জান বাঁচা! সব তোর জন্য হয়েছে। আমি মানা করেছিলাম হায়াদের সাথে তোকে কথা না বলতে! বাট ইউ? ‘

তার কথায় কিছু একটা ছিলো। আমি স্তম্ভিত হয়ে গেলাম ভয়ে ভেতরটা কেঁপে উঠলো। আজ যা যা হলো শুধু মাত্র আমি হায়াদের সাথে কথা বলেছি দেখে। সেটা বুঝতে বাকি নেই আমার। কিন্তু আদনান ভাই তো বললেন আমাকে ভালোবাসেন না তাহলে এসব ড্রামা কেন। আর আমাকে বিয়ের কথা উঠলোইবা কেন আজ। মাথাটা ফেটে যাচ্ছে কিছু বুঝতে পারছি না? আমার কি হলো এসব আর নিতে না পেরে রেগে চেঁচিয়ে বললাম,

‘ আমি বাসায় যাবো! না আপনাদের বাসায় না আমি আমার বাবার কাছেই চলে যাবো! ‘

আদনান ভাই সীটে হেলাম দিয়ে চোখ বন্ধ করে ছিলেন আমার কথায় আমার দিকে শীতল চোখে চাইলেন। আমার রাগ চলে গেলো নড়েচড়ে বসলাম। উনি ঠান্ডা কণ্ঠে বললেন,

‘ আমার রাগটা বাড়াস না অয়ত্রী! তোর জন্য আমার রাগটা ভালো হবেনা! ‘

আমি চুপ মেরে গেলাম গাড়ির সীটে মাথা হেলিয়ে চুপ করে বসে কাঁদতে লাগলাম। আদনান গাড়ি স্টার্ট দিলেন আবারও। কই যাচ্ছি যানার ইচ্ছে নেই। আমি শুধু ভাবছি নানুর কথাটা! মাথায় গেঁথে গেছে একদম। কি মানে সেটার। মামীর কথাগুলো আন্দাজ করতে পারছি কিন্তু আদনান ভাইয়ের তো শিওর নেই তাই সেটা নিয়ে ভাবছিনা। শুধু নানুর কথা গুলো পিরা দিচ্ছে! নিরবতা গাড়িতে আছড়ে পড়লো আদনান ভাই সেই নিরবতা ভেঙে বলল,

‘ আমি অনেক কষ্ট পেয়েছি। এবার তুমিও পাবে ভালোতো আমি একা বাসিনি! কষ্ট কেন একা পাবো? তোমাকেও পেতে হবে! সাথে নিজের করা ভুল গুলোর শাস্তি গুলোও পেতে হবে.. গেট রেডি! ‘
#গল্প-তুমিময়
#Ayaha_khan
#পার্ট ৮

তিন দিন হয়ে গেলো রুম বন্দী আছি। খুব একটা খারাপ লাগছেনা এভাবে রুম বন্দী থাকতে। তবে মনে থাকা প্রশ্ন গুলো নিশপিশ করছে জানতে! কিন্তু উত্তরের কোঠা বরাবরের মতোই শূন্য! দীর্ঘশ্বাস ফেলে বেডে ছেড়ে উঠে ফ্রেশ হতে চলে গেলাম।

এটা আদনান ভাইয়ার এপার্টমেন্ট যেটা কক্সবাজারের নিকটে অনেকটা! আদনান ভাই আমাকে ঐদিন রাতে এখানেই নিয়ে এসেছেন। আহি বান্দরবনে ছিলো আদনান ভাই তাকে খবর দিলে। আহি আয়াত ভাই এখানে চলে আসে। তাদের চোখে কোনও বিস্ময় ছিলো না। আদনান ভাই আমাকে এখানে নিয়ে আসাতে। তবে আমি কারোর সাথে কোনও কথা বলিনি। আহি আয়াত ভাই চেষ্টা করেছে আমার সাথে কথা বলতে। আমার মনে হয়েছে অদের সাথে কথা বললে আরও এক ঝুড়ি প্রশ্ন আমার মাথায় বাড়বে! তাই আমি অপেক্ষায় আছি আদনান ভাই আমাকে সবটা এক্সপ্লেইন করবেন! কিন্তু তিন অপেক্ষায় করেও তার মুখ দেখতে পাইনি! কি আজব সে কি আমাকে এখানে ফেলে ঘুরতে চলে গেলো?

আজ একটু মেজাজ খারাপি হচ্ছে। ফ্রেশ হয়ে বেরিয়ে দেখলাম আহি ব্রেকফাস্ট নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এসব শুকনো খাবার আর ভালো লাগছেনা। আমি খেতে পারছিনা। এলোমেলো প্রশ্ন গুলো না জানা অব্ধি গলা দিয়ে কিছুই নামছেনা। সেটা আমি কাউকে বলতেও পারছিনা। আহি আমাকে দেখে বলল,

‘ কেন এমন মন খারাপ করে আছিস! ‘

আমি রেগে গেলাম তিরিক্ষি মেজাজে বললাম,

‘ তাহলে কি আমার নাচা উচিৎ? নাকি গান গেয়ে বেরানো উচিৎ! ‘

আহির মুখ ভোতা হয়ে গেলো আমার কথা তব্দা মেরে বসে রইলো। ওকে কথা বলতে না দেখে আরও রাগ হলো। পুনোরায় মেজাজ গরম করে বললাম,

‘ তোর গুনধর ভাই কোথায়? ‘

আহি মিন মিন করে বলল,

‘ ভাই তিন দিন ধরে এক নাগাড়ে ঘুমে! কিভাবে না খেয়ে দেয়ে এভাবে ঘুমাচ্ছে আমি জানি না! ‘

মেজাজ মাত্রাধিক খারাপ হয়ে গেলো লোকটার কাহিনী শুনে। আমার জীবনটা জাস্ট ত্যাজপাতা বানিয়ে এখন উনি ঘুমোচ্ছে পরে পরে। এদিকে প্রশ্নের বেড়াজালে আটকে আমি। কিলবিল করা প্রশ্নের উত্তর জানতে আমার মস্তিষ্ক মন! কিন্তু তাতে তার কী! সে তার মতো দিব্বি আছে। মন বলছে পালিয়ে যাই কোথাও৷ নিজের সামলালাম কিছুটা ধাতস্থ হয়ে বললাম,

‘ বাসায় সবাই….! ‘

আহি আমার কথা এড়িয়ে গিয়ে বলল,

‘ খেয়েনে তুই আগে! আমাকে আয়াত ডাকছে। তোদের জন্য আমার হানিমুন মাটি হলো সেদিকে কারো খেয়াল নেই। একজন ঘুমুতে আরেক জন প্রশ্ন খুজতে মসগুল! ‘

আমি বিরক্তিকর চাহুনি দিয়ে বললাম,

‘ তো আমি তোকে বলেছি এখানে আসতে? হানিমুন মাটি করে এলি কেন এখানে?’

আহি আমার কথা শুনে রেগে চলে যেতে নিলে আমি ওর হাত ধরলাম। মোলায়েম কণ্ঠে বললাম,

‘ আহি নানু…!’

আহি শেষ করতে দিলেন না আমাকে! জোরে শ্বাস নিয়ে বসে বলল,

‘ বাসায় সব ঠিক আছে তুই চিন্তা করিস না! খেয়েনে নাহলে আদনান ভাই রেগে যাবেন! ‘

আর কিছু বললাম না জানি শান্তনা ছিলো কিছুই ঠিক নেই। তবে না খেলে সত্যি আদনান ভাই রেগে যাবেন। তাই চুপচাপ খেয়ে নিলাম!
সারাদিন শুয়ে-বসেই কেঁটে গেলো আহি সঙ্গ দিতে এলেও ওকে ধাক্কিয়ে পাঠিয়ে দিয়েছি আয়াত ভাইয়ার কাছে বেচারা আমাদের জন্য হানিমুনে এসেও শান্তি পেলো না!

রাতে ফ্লোরে বসে হাটুতে মাথা রেখে কাঁদছিলাম তখন রুমে কেউ এলো আহি ভেবে রাগী গলায় বললাম,

‘ আহি চলে যা ভালো লাগছেনা আমার! ‘

জবাবে আদনান ভাইয়ের শীতল ঠাণ্ডা কণ্ঠ শুনতে পেলাম,

‘ এভাবে নাম মুখ ফুলিয়ে কাঁদতে ভালো লাগে শুধু? ‘

হুট করে তার কণ্ঠ শুনে থমকে মাথা তুলে দ্রুত দরজায় তাকালাম! আদনান ভাই স্লিভলেস ব্ল্যাক গেঞ্জি, ধূসর রঙের টাউজার পরে দাঁড়িয়ে চুল থেকে টপটপ পানি পরছে। একা ধারে ঘুমানোর জন্য বিষন্নতার কেটে গিয়ে যেন চোখ মুখের উজ্জ্বলতা দ্বিগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। মাত্র শাওয়ার নিয়ে আশায় মাত্রাধিক স্নিগ্ধ, সতেজ এবং নিষ্পাপ লাগছে। আমি রূপে মুগ্ধ হয়ে গেলাম! বলতেই হবে দেখতে সে মাত্রাধিক চমৎকার পুরুষালী সুদর্শন সুপুরুষ! কিন্তু তার অভ্যাস রাগ সব কুপুরুষ হুহ! মুখ ঘুরিয়ে নিলাম উনার থেকে! আড়চোখে দেখলাম উনি ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসলো আমার অবস্থা দেখে। আদনান ভাই চলে যেতে যেতে আবার বললেন,

‘ আমি খেয়ে আসছি। তার পর তোমার সাথে ডিল করছি? ‘

আমিও উঠে উনার পিছনে পিছনে এই প্রথম বাহিরে গেলাম। এই এপার্টমেন্টে মামা বাড়ির সবাই অসংখ্যবার এসেছি চট্রগ্রাম ঘুরতে। ব্যাপারটা এমন হয়েছে বাসার কারো মন খারাপ থাকলেও তাকে এখানেই নিয়ে আসে আদনান ভাই তার চট্রগ্রাম খুব পছন্দের তাই এখানে তাকে বড় মামী এই ফ্ল্যাট গিফট করেছিলেন সেটা আমি আসার আগেই। সেই সুত্রে এখানে অসংখ্যবার আসা এবং প্রত্যেকটা কোণা কোণা চেনা। আহি আয়াত ভাইয়ের রুমের দরজা খোলা দেখে উঁকি দিলাম একটু সাথে সাথে আদনান ভাই বলে উঠলেন,

‘ তোমার দেখছি লজ্জা নেই বিবাহিত দম্পতির রুমে উঁকিঝুকি দিচ্ছো তাদের রোমান্স দেখতে! ‘

বলেই উনি ডাইনিং এ বসে প্যাকেট খোলায় মনোযোগ দিলেন খাবারের। আমি উনার কথায় পাত্তা না দিয়ে আহির রুমে ঢুকেই গেলাম। মাথায় আকাশ ভেঙে পরলো রুম ফাঁকা কেউ নেই রুমে! আহি আয়াত ভাইয়ার কোনও জিনিস পত্রও নেই। আমি দ্রুত পায়ে ডাইনিং এ যেতেই আদনান ভাই বললেন,

‘ তোর নানু অসুস্থ। তাই আহি আয়াত বাড়ি চলে গিয়েছে। আমরাও যাবো আমাদের বিয়ের পর! ‘

উনার শীতল কণ্ঠে স্বাভাবিক ভাবে কথা গুলো বলে কাচ্চি প্লেটে তুলে খেতে লাগলেন যেন অমরিত খাচ্ছেন। আমি হতভম্ব হয়ে গেলাম। আদনান ভাই দাদু বলতে পাগল। কারোর কথা না শুনলেও দাদুর কথা উনি কখনওই ফেলেন না আর সেই লোক তিন দিন আগে তার উপর চেঁচিয়ে কথা বলে উনার কথা না শুনে আমাকে এখানে নিয়ে এলেন। এখানেই শেষ নয়। সেই দাদু অসুস্থ শুনেও উনি এখানে আরামে কাচ্চি গিলছেন! আমার চোখ ছানাবড়া!

আমি দৌড়ে আদনান ভাইয়ের রুমে গিয়ে উনার ফোন খুঁজতে লাগলাম বাসায় ফোন দিতে হবে নানু কেন এভাবে বললেন আমাকে সেটা তো জানিনা। কিন্তু আমার জন্য উনার কিছু হয়ে যাক আমি চাইনা! উনার এলোমেলো বেডের উপর ফোন পেয়েও গেলাম। কিন্তু ফোনে লক দেওয়া রাগ লাগছিলো খুব! ফোন হাতেই ডাইনিং গেলাম আদনান ভাই এখনও খাচ্ছেন! তাকে আজ ভয় লাগছে না তাই রাগী রাগী গলায় বললাম,

‘ আমাকে বাবার কাছে দিয়ে আসুন প্লিজ। আর আপনিও বাসায় জান তানাহলে নানু আরও অসুস্থ হয়ে পরবে! ‘

আদনান ভাই খাওয়া বন্ধ করে দিলেন। হাত ধুয়ে উঠে দাঁড়িয়ে আমার দিকে ক্রোধ নিয়ে তাকিয়ে বললেন,

‘ তুমি অয়ত্রী ভালো ব্যাবহার ডিজার্ভ করো না! তোমার পানিশমেন্ট পেতে বড্ড ভালো লাগে! দ্যান অল রাইট। তোমাকে আমি অতিরিক্ত ভালোবাসি এবং তোমার ভালোলাগার গুরুত্ব দেওয়া আমার কর্তব্য….!’

আদনান ভাইয়ের কথায় গাঁ শিওরে উঠলো! আদনান ভাই এগিয়ে এসে আমার হাত চেপে ধরলো। আমি চেঁচিয়ে উঠলাম ভয়ে। আমাকে ভয় পেতে দেখে হাসলেন। আমার হাতের ফোন নিয়ে উনি চলে গেলেন নিজের রুমে। আমি বড় বড় শ্বাস নিতে লাগলাম ভয় পেয়েছি প্রচণ্ড যদি গালে চড় মেরে দিত!

—————-

রুমের এক কোণায় বসে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে ভাসাচ্ছি আমি। বাইরে আদনান ভাই প্রান্ত ভাইয়া আশিক, অভি ভাইরা চিল্লাচিল্লি করছেন! আদনান ভাই বিয়ে করবেন সেই খুশিতে। হ্যাঁ আদনান ভাই ঘোষণা করেছেন আমাকে বিয়ে করেই ঢাকা ফিরবেন! নির্দয় লোকটার বন্ধু গুলো ও নির্দয় এতকরে বললাম আমাকে একটু হেল্প করতে আমি বাসায় যেতে চাই। সম্পূর্ণ পরিবারের মত ছাড়া আমি কিছুতেই বিয়ে করবোনা। কিন্তু কিছুই করছে না কেউ আমার কথা শুনছেনা। বরং বিয়ে হবে সেই খুশিতে নাচানাচি করছে সকলে! আর আদনান ভাই তার কথা বাদ দিলাম ভাবতেও কষ্ট হচ্ছে উনার মতো নির্দয় লোককে আমি ভালোবাসি! কি করে নানু অসুস্থ শুনেও উনি এই মুহূর্তে বিয়ের কথা ভাবেন? ভেবেই জোরে জোরে কেঁদে উঠলাম আমি!

শুধুই আদনান ভাইয়ার বন্ধুরা? আমার কাজিন সব গুলো সকাল সকাল এখানে হাজির শুধু আহি আয়াত, হায়াদ ভাইয়া বাদে। আহির হয়তো ওর শ্বশুর বাড়ি চলে যেতে হয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন একটা থেকেই যায়। আদনান ভাই নির্দয় তাই বলে কাজিন গুলোও নির্দয় হয়ে গেলো সবাই ঐ অবস্থায় বাড়িতে বড়দের একা ফেলে এখানে চলে এলো? কি করে সম্ভব এসব মাথায় ঢুকছেনা।

পিহু আপু রুমে ঢুকে আমাকে এভাবে কাঁদতে দেখে বলল,

‘ এভাবে কাঁদছিস কেন? কে মরে গেছে তোর? ‘

আমি কাঁদতে কাঁদতে বললাম,

‘ আপু নানু কেমন আছে, উনি অসুস্থ! তোমরা উনাকে এভাবে ফেলে কেন চলে এলে! ‘

কিছুটা থেমে আবার বললাম,

‘ আপু নানু ঐদিন আমাকে এভাবে কেন বলল? ‘

আপু শক্ত চোখে আমার দিকে তাকিয়ে বলল,

‘ এতো ন্যাকা সাজছিস কেন। তুই কী এখনও বুঝিস না নানু তোকে পছন্দ করে না! বাকি সব আদনান নিজেই তোকে বলবে। আমি এখন শুধু তোকে এত টুকু বলতে পারি আদনান তোকে অতিরিক্ত ভালোবাসে। আমি জানি তুই ও বাসিস ভাইকে। তাহলে বিয়ের কথা শুনে কাঁদছিস কেন? ন্যাকামি বন্ধ কর! ‘

এত রুক্ষভাষী মেয়ে আমি আর একটা দেখিনি। পিহু আপু এতটা স্ট্রেইট ফরওয়ার্ড কী বলবো! কোমল হৃদয়ে নানু আমাকে পছন্দ করে না শুনেই রক্তক্ষরণ হতে শুরু করেছে তার উপর পিহু আপুর রুক্ষভাষী কথায় আমি দ্বিগুণ জোরে কাঁদতে লাগলাম। পিহু আপু তাতে বিরক্ত বোধ করে বললেন,

‘ দাদু মিথ্যে শুনিয়েছে উনি সম্পূর্ণ সুস্থ যেন আদনান ভাই তোকে বিয়ে না করে বাসায় ফিরে যায় তাই এসব রটিয়েছে। কাঁদিস না স্যরি তো! ‘

কিছুতেই কান্না থামাতে পারছিনা এত সুন্দর অভিনয় নানু কি করে করলো। আদনান ভাইয়ের অভিনয় তাও আমি ধরে ফেলতাম। কিন্তু নানুর অভিনয়ে কোনও খাদ ছিলোনা। কখনো বুঝতে দেননি উনি আমাকে পছন্দ করেন না। তবে আমি বেশ বুঝতে পারছি আদনান ভাইয়ের ভয়েই উনি আমাকে কিছু বলতেন না। ইনফেক্ট সেদিন সকালেও সেই সাহস করেননি আমাকে কিছুই বলেননি। যা বলার আদনান ভাইকেই বলেছেন। তবে নানুর কথা রাখতেই আদনান ভাই আমাকে মেনে দিতে পারেননি কখনও?

বুক ফেঁটে চিৎকার করে কাঁদতে লাগলাম আদনান ভাই ধোকা দিলেও মনে হয় এতো কষ্ট পেতাম না। হুট করেই নিজের প্রতি ঘৃণায় ভরে উঠলো মন! পিহু আপু আমার কাঁন্না দেখে ভরখে গেলো। আমাকে শান্ত করতে নান কিছু বলতে লাগলো। কিন্তু আমার চোখে শুধু নানুর সাথে কাটানো সময় গুলো চোখে ভাসছে কত নিখুঁত অভিনয় ছিলো!

পিহু আপু আমাকে শান্ত করতে না পেরে বাহিরে চলে গেলেন তার কিছু মুহূর্তে মধ্যেই হন্তদন্ত হয়ে আদনান ভাই রুমে ঢুকে দরজা আটকে আমার দিকে এগুলেন। উনাকে দেখে আমি দৌড়ে উনাকে জরিয়ে ধরে কাঁদতে লাগলাম। আদনান ভাই আমাকে ঝাপটে ধরে চুপ করে রইলেন। আমাকে কাঁদতে সময় দিলেন আদনান ভাই! বেশকিছু ক্ষণ পর বললেন,

‘ অয়ত্রী আমি জানি তুমি তোমার নানুকে অনেক ভালোবাস তাই তো তার এই রূপ আমি চাইনি কখনো তোমার সামনে আসুক। তাই উনার সব কথা মেনে নিয়েছিলাম! কিন্তু যখন তোমার মুখেই শুনলাম তুমি আমাকে ভালোবাস আমি আর নিজেকে আটকাতে পারিনি। পারিনি তোমার বিষন্ন ভগ্নহৃদয়ের চেহারা দেখতে। কিন্তু বিশ্বাস করো তুমি যতটুকু কষ্ট পেয়েছ আমি তার কয়েকগুণ বেশি কষ্ট পেয়েছি…. ৪ বছর ধরে লাগাতার পাচ্ছি! আই এ্যাম সরি অয়ত্রী! ‘

চলবে!
চলবে!

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here