#তুমিময়_প্রেম🥀♥
#PART_06
#FABIYAH_MOMO🍁
বিকেল চারটা। কড়া রোদের দাপুটে দেখিয়ে স্বর্নবর্নের প্রতিভা ফুটিয়ে পুরো আকাশ ছেয়ে আছে। ভেসে বেড়াচ্ছে সাদা তুলোর পেজো পেজো মেঘ। ফোন নিয়ে জানালার পাশে বিছানায় বসে আছি। শরীরে ক্লান্তি ভর করেছে প্রচুর। এখন টিউশনিতে যেতে হবে আমার। সাড়ে চারটায় রওনা দিলে পাচঁটার আগেই ছাত্রের বাসায় পৌছাবো আমি। আম্মু ছোট ভাইকে নিয়ে মামার বাসায় গিয়েছে। তালা মেরে চাবি নিয়ে পাশের বাসার আন্টির কাছে দিয়ে আমিও বেরিয়ে পড়বো একটু পর। ঘড়িতে চারটা পাচঁ। মনের ক্লান্তি, শরীরের একঘেয়েমি নিয়েই রেডি হচ্ছি। গা এলিয়ে ঘুমাতে ইচ্ছে করছে। চোখ দুটোতে ঘুম। বেজায় ঘুম। ইচ্ছা বিরুদ্ধে দ্রুত নিজেকে সংযত করছি। আয়নার সামনে দাড়িয়ে নিজেকে নিয়ে মাতোয়ারা হওয়ার সময় নেই, এখন খুব করে জলদি জলদি বেরুতে হবে। রিকশা নিব না। নিলেই টাকা জমাতে পারবো না। আব্বুর ফোনটা নষ্ট।একটা ফোনের খুবই দরকার। মাথায় ঘোমটা টেনে ঘরের ইলেকট্রিসির লাইন সব চেক করে দরজায় তালা লাগিয়ে চাবিটা পাশের ফ্লাটে দিয়ে বেরিয়ে পড়লাম।
রোদের তপ্তটা বেশি। কপাল ঘিমে কানের পাশ দিয়ে টপ টপ করে ঘামের বিন্দু কনা গড়িয়ে পড়ছে। পায়ে শক্তি কম। আস্তে আস্তে হাটছি। ব্যাগে দশ টাকার একটা নোট ছাড়া বেশি টাকা নিয়ে বের হইনি। আগে ভার্সিটি ছিলো না, যাওয়া-আসা নিয়ে শরীর ক্লান্ত হতো না। এখন আমার খাটাখাটনি করতে হবে বেশি। চওড়া রাস্তার ফুটপাত ধরে যাচ্ছি। রাস্তায় আজ মানুষ কম। চলাচলের গাড়িও কম। সম্ভবত গরমের জন্যে এমনটা হয়েছে। অলস জাতি বাড়ি বসে অলসতা যাপন করছে। খুব করে মনে হচ্ছিলো পেছন থেকে কেউ অনুসরন করছে। কিন্তু আমি ঘাড় বাকাইনি। আপনমনে নিজগতিতে হেটে চলছি।
–এই শুনো? একটু দাড়াবে?
আচমকা কারোর অনুনয় সুর শুনে হাটা থামালাম। কপালকুচকে চিন্তা করছি পিছনে কি তাকাবো? কে না কে ডাকছে তাকানো ঠিক হবে? না..থাক। একবার দেখে নেই। আমি কপালের কাছে ঘোমটা একটু টেনে নিলাম। পেছন ঘুরে দেখি তন্ময়। ক্যাম্পাসে যে পোশাকে দেখেছিলাম তা এখন ভিন্ন। গায়ে কালো টিশার্ট , জিন্স প্যান্ট পড়নে।
–তুমি আমাকে ডেকেছো? তুমি এখানে কি করে? তোমার বাসা না ধানমন্ডি?
তন্ময় আমার কথায় স্বাচ্ছন্দ্যসূচক হাসি দিলো।
–হ্যা ধানমন্ডি। তুমি কি করে জানো??
–আশ্চর্য! তোমাদের ব্যাপারে ফুল তথ্য পুরো ক্যাম্পাস জানে আর আমি সেটা জানবো না? জবাব দাও! তুমি আমার পেছনে কি করছো? মতলব কি তোমার? আমায় ফলো করছো নাতো?
–নো নো…ফলো করছি না। এইতো নারায়ণগঞ্জ শহরে ঘুরতে এলাম। তোমাদের শহর নিয়ে অনেক আর্টিকেল পড়েছি। দেখতে ইচ্ছে করলো, তাই চলে এলাম।
–আসছো ভালো কথা। আমার পেছনে কি!
–তোমার পেছনে কি হবে ? আমি ঘুরতে এসেছি আর দেখি তুমি এই কাঠফাটা রোদের মধ্যে হেটে হেটে যাচ্ছো।
–মানুষ তো হেটেই গন্তব্যে যায় তাইনা? আমিও হেটেই যাচ্ছি। আমায় ডাক দিবে না। আমি রাস্তায় অপরিচিত মানুষদের ডাকাডাকি পছন্দ করিনা। আল্লাহ হাফেজ।
তন্ময় কোন্ নেকি উদ্দেশ্য নিয়ে হঠাৎ করে নারায়ণগঞ্জ আসলো বুঝলাম না। ওর হুট করে আসাটা ভালো কিছুর পূর্বাভাস দেখাচ্ছে না। টানা পচিঁশ মিনিট পায়ে হেটে মেইন রোড ক্রস করে ছাত্রের বাসায় এসেছি। নাম জোবায়ের, অষ্টম শ্রেনীতে পড়ছে। মাথাভর্তি গোবর, পড়া বাদে সব কুটনামি ওর মাথায় ঢোকে। সপ্তাহে ছয়দিন পড়াই, বেতন দুইহাজার। আজ মাসিক বেতন দেওয়ার কথা, তিনমাসের ছয়হাজার টাকার বেতন আমার আটকে আছে। মুখ ফুটে বলতেও পারছিনা, আন্টি আমার বেতনের টাকাটা দরকার। আব্বুর স্যালারিতে সচ্ছল ভাবে কাটলেও আমার নিজের টাকায় শ্বাস নিতে বেশি শান্তি লাগে।মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়েদের জন্য একমাত্র সুখ- তার টিউশনির টাকা, নিজের টাকা। টানা দুইঘন্টা পড়ালাম। সকালে ক্লাসের চাপে, বতর্মানে ছাত্রকে পড়িয়ে টনটন করে মাথাব্যথা করছে। হাসি দিয়ে মুখোশ পড়ে আছি কেউ যাতে না দেখে। সবকিছু সবাই দেখার যোগ্যতা পায়না। আমি মনে করি এটা। । চায়ের কাপটা জোড়ালো শব্দ করে টেবিলে রাখলেন আন্টি। বুঝে গেছি, আমার কষ্টের প্রাপ্যটা চেয়ে মস্ত বড় ভুল করে ফেলেছি। মনটা আবেগপ্রবন হওয়া থেকে বিরত করছি, কিছুতেই কেদে দিবি না। না মানে একদম না। মানুষের কাছে হক চাইতে লজ্জায় কান্না করা শোভা পায় না। তুই কাদবি না!
.
.
বাথরুমের দরজা লাগিয়ে বসে আছি, মনটা ভেঙ্গে চুরমার কাচের মতো ক্ষতবীক্ষত। সবার সাথে লড়াই, হেনস্ত, অপমান, উপেক্ষা করে দিনশেষে চোখ ভিজে কান্না চলে আসে। মনের মধ্যে অজানা কি পাওয়ার বাসনায় কান্না চলে আসে, বুঝিনা, জানি না। নিজের অক্ষমতা নয়তো ক্ষতচিহ্নের চোটে কান্না জুড়ে আসে। কি নিয়ে কান্না করি আমি, কি নিয়ে হাসি, কি নিয়ে নতুন দিন দেখি, কি নিয়ে পলক ঝাপটাই। মাথায় পানি ঢেলে বাথরুম থেকে বেরিয়ে ভেজা চুলে তোয়ালে লাগাই। চুলের দিকে তাকাতে আমি ফুপিয়ে কেদে দেই, আমার চুলের একতালু পরিমান দৈর্ঘ্যতা নেই। কোনো ভুল ছাড়াই ওরা আমার চুল কেটে দিয়েছে। ওরা বড়লোক, আমি মধ্যবিত্ত। আমার স্ট্যাটাসের লঘুতায় ওরা আমাকে ছোটলোক ভাবে। ওদের খুব টাকা, কাড়িকাড়ি টাকা। আমার মতো না, একবেলা রিকশা দিয়ে গেলে আরেকবেলা খালি ব্যাগ পড়ে থাকে। সত্য এটাই, আমার জন্য খালি ব্যাগের শূন্যতাই শ্রেয়। রোদে হেটে টিউশনি করে টাকা ইনকাম ওদের করা লাগেনা। এসির নিচে বসেই ওরা কষ্টের ভোগান্তি বোঝেনা। আমার গালিগালাজ এবং আমার রূঢ় ব্যবহার সবাই আচ করে দেখে, কিন্তু হাসি শেষে নিবরতা দেখে না কেউ। নেই কেউ যে দেখবে। চোখ বন্ধ করে বিছানায় বসে চুল মুছে নিচ্ছি। বন্ধ চোখের পাপড়ি বেয়ে গালের সমিখে পানি পড়ে যাচ্ছে। শ্বাসরুদ্ধকর কান্না। বেতনের চারহাজার টাকা হাতে পেয়েছি, বাকি টাকায় আশাহত । ওগুলো পাব না। নতুন বইয়ের কেনার লিস্টে দাম উঠেছে সাড়ে চার হাজার। খাতার রিম এবং কলমের পাতার হিসাব বাদই দিলাম। আব্বুর কাছে টাকা চাইতেই হিমশিম খেতে হচ্ছে, এ মাসের কারেন্ট বিল পূর্বের তুলনায় দেড়গুন বেশি এসেছে। ছোট ভাইয়ের স্কুল ফিস, মাসের বাজার সদাই, বাসাভাড়া নিয়ে আম্মু-আব্বুর সাথে আমিও চিন্তামগ্ন।কাউকে বোঝতে দিচ্ছি না আদৌ। আব্বুর প্রেসার বেড়ে যাওয়ার সমস্যা আছে, আম্মুর হার্টের সমস্যা, ছোট ভাইয়ের সাইনাসে সমস্যা,আমার পায়ের সমস্যা। এমন মেয়ের জন্য ভার্সিটি গিয়ে প্রেমপরায়ণ হওয়ার টাইম থাকে? লুতুপুতু চুটিয়ে প্রেম? বাবার টাকার ফূর্তিবাজ হওয়ার উপায় থাকেনা। বিলাসিতা দেখানোর প্রভাব বিস্তার করেনা। মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়েরা জীবনসদৃশে বাপের বাড়ি-শ্বশুড়বাড়ি দুই বাড়িতে যোদ্ধা। মানুষ তা কখনো জানবে না।
বালিশে মাথা দিয়ে সটান হয়ে বিছানায় শুয়ে আছি। মাথা ভারী ভারী ঠেকছে, গলায় ঠান্ডাজনিত খুশখুশ। পায়ের হাটু থেকে গোড়ালী পযর্ন্ত অমাত্রিক ব্যাথা। ফোন বাজছে, হাতে নিলাম। নাম্বার চিনি না অপরিচিত।
–আসসালামু আলাইকুম, কে বলছেন?
–আমি কি মমর সাথে কথা বলছি?
–কে আপনি!
–মমকে দিন, ও চিনবে।
–চিনাচিনি বাদ! পরিচয় দিন!
–বলুন ওর সিনিয়র ব্যাচ থেকে কল করেছে। নাম রাদিফ মুগ্ধ।
ধরফরিয়ে উঠে বসি, চোখে মুখে পানসে লাগছে। কানে আঙ্গুল দিয়ে নাড়াচাড়া করে ফোনের স্ক্রিনে তাকালাম। কানে ভুল শুনছি?আমি নিজের কানে ভুল শুনছি? মুগ্ধ? এই নাম বললো ? কান থেকে আঙ্গুল সরিয়ে ফোনে কান বসালাম। ওপাশ থেকে কন্ঠ না পেয়ে রীতিমতো ‘হ্যালো হ্যালো’ করছে।
–কি চাই! চার বছরের জুনিয়র মেয়ের সাথে ইটিসপিটিস করতে মন চায়? কল কেন করছেন!
–শুনো, আমার রিলেশন করার জন্য মেয়ের কমতি নেই। তুমি নিজেকে নিয়ে কি ভাবো ইউ নো বেস্ট!
–তো? কোন্ খাজনার বাজনা দিতে ফোন করছেন!
–কি বললে? বুঝলাম না আবার বলো।
–তুই ফোন রাখবি! নাকি আবার তোর মাথায় ঢোল বাজাবো!
–আর একটা বাজে ওয়ার্ড বলবে, ইন্সট্যান্ট আমি তোমার রুমে এসে খারাপ কিছু করে ফেলবো! আই সয়ার!
–বলুন কি বলবেন!
–এইতো লাইনে এসেছো। আমার ভাতিজির জন্য একটা টিউটর লাগবে।
–তোহ্? টিউটর লাগবে আমার কি কাজ?
–এই মেয়ে চিল্লাচিল্লি বন্ধ করো! কানের পর্দা ফাটিয়ে চড় লাগাবো! চুপ করে কথা শুনতে পারো না!! শোনো! আমার ভাতিজি তোমার ভাইয়ের স্কুলে পড়ে, তোমার ভাইয়ের ক্লাসমেট ও। ইনফরমেশন পেয়েছি, ইউ আর এ্যা গুড টিউটর। দ্যাটস হোয়াই আই নিড ইউ…আই মিন আই নিড ইউ ফর মাই নিস। কাল দুইটায় ক্যাম্পাস শেষে আমার গাড়িতে চড়ে বাসায় আসবে।
–মগের মুল্লুক? আপনি আমায় গাধা ভেবেছেন? আমি কেন আপনার বাসায় আপনার ভাতিজিকে পড়াতে আসবো!
–ও হ্যালো হ্যালো! পুরো কথা না শুনে মনের মধ্যে ঘুড়ি উড়ানো বন্ধ কর! আমার ভাতিজিকে তোমার চেয়ে ভালো কোয়ালিফিকেশনের মেয়ে এসে পড়াতে পারবে! ভালো করেই জানো, আমরা টাকার হিসাব করে চলিনা। মান্থলি স্যালারি সাতহাজার টাকা, মাসে মাসেই পেয়ে যাবে। সো, প্রবলেম হচ্ছে আমাকে নিয়ে।
–আপনি মেয়ে? রেপ করে ইজ্জত লুটবে আপনার? ভয় যে পাচ্ছেন ছেলে হয়েও আপনাকে গনধর্ষন করবে!
–ঠাটিয়ে একটা চড় দেওয়া দরকার ফালতু মেয়ে! কথা পুরোটা শেষ না করতেই কথা শুরু!
–আচ্ছা বলুন,
— এ যাবৎ পাচঁজন টিউটর চেন্জ করতে হয়েছে। আমি আমার ভাতিজিকে ছেলে দ্বারা পড়াই না। মেয়ে টিউটর রেখেছি সবগুলো ইডিয়ট! ড্যামিস!
–উল্টা চড় তো আপনার খাওয়া উচিত দেখছি! কেমন মানুষ রে বাবা!
–এগেইন কথায় বেঘাত ঘটালে!
–নো বলুন,
— ওরা পড়াতে এসে আমার খোজখবর রাখে। এভ্রিটাইম আমার দিকে তাকিয়ে থাকে। আমি এসব মেয়েদের দেখতে পারিনা। আর তুমি তো মাশাআল্লাহ ফাস্টদিনেই জিরো টলারেন্স !আই নিড ইউ!
–ঠিকাছে ঠিকাছে আম্মুকে বলে দেখি তারপর জানাবো। খবরদার! টিউটর বানাতে গিয়ে প্রেমিকা বানানোর প্রয়াস চালাবেন না! ঘাড় মটকে ফ্যানের সাথে ঝুলিয়ে দিবো!
–বি রেডি !
-চলবে
-FABIYAH_MOMO🍁