তুমি অতঃপর তুমিই
Writer -Taniya Sheikh
২১.
অনেক ভেবে ভেবেও এখান থেকে বের হওয়ার উপায় খুঁজে পেল না ইমা। বাধ্য হয়ে শানের সাথে এই বাড়ি থাকার সিদ্ধান্ত নিল। স্থায়ী নয় অস্থায়ী ভাবে। সুযোগ পেলে ঠিকই চলে যাবে এই ঘৃণিত মানুষটার সান্নিধ্য ছেড়ে। ততদিনে সহ্য ক্ষমতা বাড়াতে হবে ইমাকে। নিজের আবেগ,অনুভূতির ছিটেফোটাও প্রকাশ করা যাবে না এই শানের সামনে। দু’হাতে কাউচের গদি খামচে ধরে শক্ত হয়ে বসে। কিছুক্ষণ পর ফার্স্ট এইড বক্স হাতে শান নিচে এলো। পাশে বসতেই ইমা সরে বসে। আড়চোখে সেটা খেয়াল করে মৃদু হাসে শান। ঘুরে বসে বলে,
” নাও ব্যান্ডেজ করো।”
অপ্রস্তুত হয়ে তাকায় ইমা। ভ্রুকুটি করে চেয়ে বলে,
” কী?”
” বাংলায় তো বললাম। আজকাল বাংলা বুঝতেও খুব সমস্যা হয় নাকি?”
” বলেছি না আমার সাথে ফাজলামি করবি না।” দাঁত কিড়মিড়িয়ে বলে ইমা। শান চট করে ঝুঁকে আসতেই হেলে পড়ে খানিকটা।
” স্বামীর সাথে তুই তোকারি করা বেয়াদবী। তওবা করো।”
ইমা মুখ বাঁকিয়ে সরে বসতেই শান হাত ধরে কাছাকাছি বসায়। পুনরায় বলে,
” ঘা যখন তুমি দিয়েছ, মলমও তুমিই দেবে।”
” কোনোদিন না।”
” আচ্ছা!” শান মোবাইল হাতে তুলতেই ইমা কটমট করে তাকিয়ে শানকে ধাক্কা দিয়ে দূরে সরিয়ে বলে,
” করছি।”
আঘাত করার সময় মাথা ঠিক ছিল না ইমার। ক্রোধান্বিত সে হিতাহিতজ্ঞানশূন্য হয়ে পড়েছিল সে’সময়। ক্রোধ বশতঃ নিষ্ঠুর আচরনের কারনে অনুতাপ হচ্ছে ইমার। আর সেই অনুতাপ বড়োই যন্ত্রণার। ভেতরটা অসহনীয় পীড়ার ভারে ভারী হচ্ছে সামনে বসা মানুষটার বুকের দিকে তাকিয়ে। জমাট বেঁধে আছে শানের বুকের রক্ত। সেটা পরিষ্কার করে ক্ষত স্থানে মেডিসিন লাগাতে লাগাতে অজান্তেই দু’চোখ বেয়ে নোনাপানি পড়ল। নীরবে শুধু দেখছে শান। বুকের ক্ষতে এতোক্ষণ ততটা ব্যথা অনুভব করেনি যতটা এই মুহূর্তে ইমার মুখটা দেখে হচ্ছে। শানের ইমা বদলে গেছে। গত চার বছর ইমাকে বদলে দিয়েছে। কিন্তু কী এমন ঘটেছিল চার বছর পূর্বে? যার কারনে ভালোবাসা আজ ঘৃণিত! শান স্থির, শীতল দৃষ্টি মেলে ইমাকে দেখছে। মলিনা চেহারার সুশ্রী মেয়েটি তারই স্ত্রী। তার সম্পদ। সেই প্রিয়তমা স্ত্রীকে সে নিজের অগোচরেই আঘাত করেছে। কেড়ে নিয়েছে ঐ গোলাপ রাঙা ঠোঁটের মিষ্টি হাসি। বিষন্নতার নৌকায় দুলে দুলে মাঝ সমুদ্রে ভাসছে শান। ইমাকে শান চেনে, এতো সহজে সবটা ওর কাছ থেকে জানতে পারবে না। তার জন্য ধৈর্যশীল হতে হবে। ভালোবাসলে ধৈর্য্য রাখতে হয়। ইমা আড়চোখে তাকানোর পূর্বেই দু’চোখ বন্ধ করে আধশোয়া হয় শান। সেই সুযোগে পূর্ণ দৃষ্টি মেলে দেখছে ইমা। এতোদিনের তৃষিত চক্ষু একটু একটু জলে ভরে ওঠে। শূন্যতা পূর্ণতা পায় কেবল চাহনিতেই। তবুও এই পূর্ণতার মাঝে সেই সুখ নেই, যে সুখ চার বছর আগে ছিল। এই এতো কাছে থেকেও সহস্র, অযুত মাইলের দূরত্বের অবসান ঘটেনি। একে কি পাওয়া বলে? শানের অর্ধনির্মীলিত নয়ন দেখে সামনে বসা রমণীর চোখের জল। ভরা প্লাবনের ধারার মতো অবিরাম ঝরছে। সমস্ত মলিনা মুখশ্রী জুড়ে কী এক পীড়িত ভাবের প্রকাশ!
“কিসের কষ্ট তব বক্ষপিঞ্জরে? কিসের লাগি এই বক্ষআঘাত? আমি তো কারণ খুঁজে খুঁজে হয়রান আজি। তোমার বদলে যাওয়ায় হতবুদ্ধি হয়ে করি গড়াগড়ি।”
শান যাই করুক কিন্তু তার জন্য এমন করে আঘাত কেন করতে গেল ইমা? বয়সের সাথে সাথে ধৈর্য্য, প্রত্যুৎপন্নমতিতা মোটেও যেন বাড়েনি। তারই ফল বুঝি আজকের এই অঘটন। কাঁদতে কাঁদতে উঠে দাঁড়াতেই আচমকা হাত টেনে ধরে শান৷ কিছুটা বেসামাল হয়ে ওর বুকের উপরে আছরে পড়ে ইমা। এক হাতের ভর অসতর্কে চেপে ধরে সদ্য ব্যান্ডেজ করা স্থানটার উপর। যা হবার তাই হলো- ব্যান্ডেজ খুলে ফের রক্তক্ষরণ। মুভির মতো লা,,লা,, ব্যাকগ্রাউন্ড বাজল না মোটেও। বরং একরাশ বিরক্তি আর রাগে চোখ দু’টো লাল হয়ে ওঠে ইমার। মুভি,সিনেমা তো জীবনেরই প্রতিরূপ। কাছাকাছি এসে একেবারেই যে অনুভূতিহীন ছিল তা নয়। দু’জনের বুকের ভেতরটা আন্দোলিত হয়েছে। কিন্তু ঐ যে ইমার হাতে লাগা রক্তটা- ওতেই যেন সব অনুভূতি ভেস্তে গেল। চটজলদি নিজেকে তুলে উঠে দাঁড়াতে চাইল ইমা। বাধা পেল আবার। দু’হাতে সজোরে চেপে ধরেছে ইমার বাহুদ্বয় শান। নির্বাক,স্থির সে। যেন কারো হুকুম তামিল করছে এভাবে ধরে রেখে৷ এই কেউ টা হলো হৃদয়! মন বলে, না যেতে দেবো তোমায়। এই তো পেলাম এক্ষণে। এক্ষুণি কেন যেতে চাও দূরে। থাকো না প্রিয়া এমন করে আরেকটু ক্ষণ, কয়েকটি প্রহর।
” ছাড়ুন বলছি।”
নিশ্চুপ, মৃদু হাসি দু-ঠোটের কোনে শানের। ওদিকে ইমা নিজেকে ছাড়ানোর আপ্রাণ চেষ্টা করছে। রক্ত রঞ্জিত হাতটার দিকে তাকিয়ে কাঁদতে কাঁদতে নিজের সকল চেষ্টায় ক্ষান্ত দিল। কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলল,
” আমাকে ছাড়ুন,প্লিজ।”
শান এবারও ছাড়ল না, জবাবও দিল না। ইমা কান্না থামিয়ে নত মুখে বলল,
” প্লিজ আমাকে ছেড়ে দিন, আপনার ব্লিডিং হচ্ছে আবার।”
ইমাকে দু’হাতে বুকের মাঝে নিয়ে সোজা হয়ে বসল শান। অবনত মুখে তখনো ফুঁপিয়ে যাচ্ছে ইমা। ওর লজ্জা হচ্ছে। নিজেকেই নিজে ধিক্কার দিচ্ছে। নিজ হাতে বক্ষছেদন অতঃপর আহা! আহা নাটক। শান ডান হাতে জড়িয়ে ধরে, বা’হাতে ইমার মুখের সম্মুখের অগোছালো চুলগুলো আলগোছে সরিয়ে কানের কাছে মুখ নিয়ে বলল,
” খুব কষ্ট হচ্ছে? কষ্ট পেয়ো না। তোমার আমার বিয়েতে তো মেহেদী পরোনি। এটা না হয় তাই হলো।” আলতো করে ইমার গালে চুমু দিয়ে উঠে দাঁড়ায়। একদন্ড সেখানে না থেকে চলে যায় উপরে। অপরাধীর মতো মুখ করে স্তব্ধ ইমা বসে রইল। এই রক্ত ওর হাতের মেহেদী! এর চেয়ে এ হাত কেটে যেত।হাতটা ওড়না দিয়ে মোছার চেষ্টায় অপর হাতটাতেও রক্ত লাগিয়ে ফেলল। শব্দ করে কেঁদে ওঠে নিচে উপুড় হয়ে ইমা।
মোবারক গ্যারেজে গাড়ি দেখে শানের সাথে দেখা করতে এলো। এসে দেখল শান ঘর মুছছে কানে হেডফোন লাগিয়ে৷ মোবারককে দেখেই চিরাচরিত মুচকি হাসি দেয়। হাতের কাজটা সেরে দু’জনে সুইমিংপুলের পাশের চেয়ার দুটোয় বসল। শানের মুখের দিকে আড়চোখে চেয়ে মোবারক বলল,
” স্যার,কিছু হয়েছে কী?”
” তোর কী মনে হয় মোবারক?” সামনে ঝুকে বসে নির্নিমেষ দৃষ্টিতে সুইমিংপুলের নীল জলের চেয়ে রয় শান। মোবারক কথা খুঁজে পায় না। আসার পর কয়েকবার উঁকি ঝুকি মেরে ইমাকে খুঁজেছে সে। কিন্তু দেখা মেলেনি। দু’জনে চুপচাপ কিছুসময় বসে থাকে। নীরবতা ভেঙে একসময় মোবারক তোতলাতে তোতলাতে বলে,
” ভাবি ঠিক আছে তো স্যার?”
” তোর কী ধারণা তাকে আমি কিছু করব?”
” না, আমি সেটা বলতে চাইনি। আসার পর থেকে তাকে দেখছি না তো তাই জিজ্ঞেস করলাম।” মোবারক থেমে লম্বা শ্বাস নিয়ে গতকাল ইমার এখানে আসার ঘটনা খুলে বলে। শানকে কয়েকবার কল করেও পাওয়া যায়নি বিধায় সে জানাতে পারেনি। বলা শেষ হতেই কিছুটা ভীত দেখা যায় তাকে। শান নির্বিকার বসে আছে। কোনোরকম প্রতিক্রিয়া না পেয়ে বিস্মিত হলো মোবারক। সভয়ে বলল,
” স্যার, ভাবির উপর রাগ করে থাকবেন না। আপনি তো জানেন বয়স অপেক্ষা তার মধ্যে ম্যাচুরিটি কম। একটু হট মেজাজি। সেই তুলনায় আপনি বুঝদার বেশি। ছাড় দেন এবারের মতো। ক্ষমা করে দেন স্যার। একজনকে তো একটু ছাড় দিতেই হয়।”
” মোবারক, সংসার, সম্পর্ক একজনের কম্পোমাইজে টেকে না৷ দুজনকেই দু’দিক থেকে অবদান রাখতে হয়। সবসময় আমি ছাড় দেবো, আমিই বুঝব আর সে? তুই বলছিস ওর ম্যাচুরিটি কম। আমি মানলাম, কিন্তু এর মানে এই নয়, বার বার করা ওর আঘাত আমি বিনা প্রতিবাদে মেনে নেব। ওর অবিশ্বাস, অপবাদ কী করে মানবো? যাচাই -বাছাই ছাড়া অবিশ্বাস করে আঘাতের পর আঘাত করে যাওয়াকে যদি তুই ইম্ম্যাচুরিটির নাম দিস, তবে আমি শান, সেটা কিছুতেই মানবো না৷ ইমা হয় এবার আমাকে বুঝবে নয়ত ভবিষ্যতে খুঁজবে। সেদিন হাতের লাগালে আর পাবেনা আমাকে ও।” চোয়াল শক্ত হয়ে ওঠে শানের। শ্বাস ভারী হয়। ইমার আচরণ তাকে কতটা আঘাত করেছে কেবল সেই জানে। চোখের কোনের পানিটুকু সাবধানে লুকিয়ে উঠে দাঁড়ায়। সাথে সাথে মোবারকও। সে বলে,
” কী করবেন তাহলে এখন?”
” ভাবিনি। ভাবতে চাইওনা। শুধু দেখে যাব, যখন যেটা জরুরি মনে হবে সেটাই করব।” ওরা পাশাপাশি হেঁটে এগোয়। মোবারক কিছুক্ষণ চুপ করে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে,
” আল্লাহ পাক আপনাদের পথটা মসৃণ করে দিন। এই কঠিন সময়টা যেন সহজ হয়ে যায় সেই দোয়া করি।”
শান মৃদু হেসে মোবারকের কাঁধে হাত রাখে। দুজনে লিভিং রুমে এসে দাঁড়ায়। মোবারক বিদায় নেবে ঠিক সেসময় শানের মোবাইল বেঁজে ওঠে। মোবাইলের ওপাশে ইমরোজ। সে ইমা-শানের মধ্যেকার সমস্যা মিটেছে কিনা জানতে চায়। মোবারককে যা বলেছে -তাই ঘুরে ফিরে বলল শান। ইমরোজ বেশ চিন্তিত ওদের নিয়ে। এ সময় এতোদূরে আসতেও পারছে না সে। শানকে বুঝাতে লাগল। যদিও জানে এসবে কাজ হবেনা। শানের মনে যা আছে সে তাই করবে। কথা বলার মাঝে হঠাৎ ইমরোজ মাহিবের নাম উচ্চারণ করে। শান এর কারণ জিজ্ঞেস করতেই ইমরোজ জানাল -নেশায় বুঁদ মাহিবকে ধরে গাড়ির দিকে নিয়ে যাচ্ছে একটি মেয়ে। শানের কাছে বিষয়টা কমন। ইমরোজ একদৃষ্টিতে ওদের দিকে চেয়ে আছে। অবাক হলো মেয়েটিকে দেখে। মেয়েটি দেখতে একদম সাধারণ পরিবারের ভদ্র, সুশীলা মেয়েদের মতো। গায়ের কাপড়ে তো তাই বলছে। ইমরোজ দ্রুত কথা শেষ করে। তারপর পিছু নেয় মাহিবের গাড়ির। বন্ধুর শত্রু মানে নিজেরও শত্রু। তার উপর এই মেয়েটাকে ফাঁদে ফেলছে কি’না সেটাও জানা জরুরি। বাইক ছুটিয়ে মাহিবের গাড়ি অনুসরণ করে ইমরোজ।
” মাহিব স্যারের কোনো উন্নতি হলো না। আজ তো বড়ো স্যারের মিলাদ ছিল। আজকের দিনেও তিনি নেশা আর মেয়ে নিয়ে আছেন! এমন সন্তানের বাপ হওয়ার চেয়ে নিঃসন্তান থাকা ভালো।” কথাটা বলেই জিহ্বা কাটল মোবারক। সলজ্জে সামনে তাকায়। শান এমনভাবে বসে আছে যেন মোবারকের কথা সে শোনেইনি। শানের এই নির্লিপ্ত ভাবের পেছনের কষ্টটা কেবল মোবারক জানে। মোবারক আর কোনো কথা না বলে বিদায় নিল। আধশোয়া হয়ে নির্নিমেষ চোখে শূন্যে তাকিয়ে আছে শান। একটু একটু করে উদ্ভাসিত হচ্ছে তার অতীত। ছোট্ট শান, বয়স সবে এক বছর। প্রবাসী ইঞ্জিনিয়ার নাফিস খান ও কুসুম আহমেদের প্রথম সন্তান। নাফিস খান ছিলেন মঈন খানের সৎ ভাই। নাফিস এবং তার মা সৎভাবে জীবনযাপন করতে চেয়েছিল। সেই মতেই নাফিসের মা নাহার স্মাগলার স্বামীকে ছেড়ে চলে আসেন আশুলিয়া, নাফিসের নানাবাড়ি। নাফিসের নানাজান ভালো লোক ছিলেন৷ জ্বামাতার অবৈধ কাজকে তিনি অপছন্দ করতেন,জ্বামাতাকেও। সুতরাং মেয়ে যখন ছেলের হাত ধরে স্বেচ্ছায় চলে এলো -তিনি খুশিই হলেন। অনেক মামলা-মোকদ্দমা করে মেয়েকে ছাড়িয়ে আনেন। তারপর বিয়ে দেন সুইডেন প্রবাসী এক ছেলের সাথে। নাফিস মায়ের সাথে সুইডেন চলে যায়। এরপর পার হয় বহুবছর। নাহার আগের স্বামীর সাথে কোনোরকমের সম্পর্ক রাখেনা কিংবা ছেলেকেও রাখতে দেয়নি। হঠাৎ একদিন বাংলাদেশ থেকে কল গেল। নাফিসের নানাজান ভীষণ অসুস্থ। শেষ সময়ে মেয়ে,জ্বামাতাকে দেখতে চান। ফিরে এলো ওরা। ততক্ষণে নানাজানের মৃত্যু হয়েছে। নাহার পিতার মৃত্যু শোকে শয্যা নিলেন। ওরা ফিরে যেত কিন্তু হঠাৎ যেন সবকিছু এলোমেলো হয়ে গেল। সাজানো, গুছানো ওদের জীবনে নেমে এলো আরেক দূর্ঘটনা। নাফিসের সৎ পিতা রোড এক্সিডেন্টে মারা গেলেন। এই শোক কাটাতে সময় লাগল ওদের। মা একেবারে প্যারালাইসিস হয়ে গেল। একমাত্র ছোটো বোনটাকে নিয়ে তাই আর ফেরা হলো না নাফিসের। যুবক নাফিস তখনো জানত না ওদের জীবনে পরপর ঘটে যাওয়া এই দূর্ঘটনা কাকতালীয় ছিলনা। পুরোটাই ছিল তার আসল পিতার নিষ্ঠুর ষড়যন্ত্র। নাফিসের মায়ের উপর প্রতিশোধ নিচ্ছিলেন তিনি। এরপরের টার্গেট ছিল নাফিসের বোন। নাফিসের ক্ষতি তিনি করতে চাননি। হাজার হোক ঔরসজাত সন্তান তো! ছোটো বোন, অসুস্থ মাকে দেখাশোনার জন্য একজন মেয়েলোকের প্রয়োজন দেখা দিল। দূরসম্পর্কের এক বিধবা ফুপুকে এক কন্যা সহ ঘরে আশ্রয় দিল নাফিস। ধীরে ধীরে এই আনকোরা স্থানে নাফিস মানিয়ে নিতে শিখল। বহু ঘাত-প্রতিঘাত ইঞ্জিনিয়ারিং শেষ করে সে। আশ্রিত ফুপুর মেয়েটিকে বিয়ে করে ফের সপরিবারে চলে আসে সুইডেন। এদিকে নাফিসের বাবা চূড়ান্ত প্রতিশোধ নেওয়ার পূর্বেই আততায়ী হামলায় মৃত্যুবরণ করেন। নাফিস এসবের কিছুই জানত না। সে প্রায় ভুলেই গিয়েছিল আসল পিতার কথা। বিয়ের বছরখানেক বাদে নাফিস পুনরায় দেশে ফেরে। স্ত্রীর নামে জমি খরিদ করে জনপদ থেকে দূরের এই স্থানে। দিনরাত এক করে তৈরি করে খামার বাড়ির আদলে অনিন্দ্য সুন্দর রিসোর্ট। রক্ত কথা বলে। দু’দিন আগে হোক কিংবা দু’দিন পরে। মঈনের বিছানো জালে সে নিজের সততা বেঁচে দেয়। এই বিলাসবহুল বাড়ি তৈরির পেছনে যে টাকা এসেছিল তার একটা বৃহৎ অংশ ছিল অন্যায় পথে। নাফিস সেটা প্রথমে বোঝেনি। যখন বুঝতে পারল তখন সেই বোঝাটা অর্থহীন। মায়ের শেষ সময়ের অনুরোধ রক্ষার্থে হোক অথবা বিবেক যাতনায়। নাফিস মঈনের মুখোমুখি হয়। সে প্রায়শ্চিত্ত করার জন্য পুরোপুরি তৈরি ছিল। কিন্তু মঈন খানের প্লান ছিল ভিন্ন। পৈতৃক সম্পদ এবং এই অনিন্দ্য সুন্দর বাড়ির প্রতি তার লোভ জন্মায়। তাছাড়া সৎ মায়ের প্রতি ছিল প্রচণ্ড ঘৃণা। মঈন খানের ধারণা নাফিসের মায়ের কারণেই তার মা অবহেলিত ছিল পিতার কাছে। যা সত্যি ছিলনা। এই ঘৃণার বশবর্তী হয়ে নাফিসকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয়। নাফিস যাদের সাথে কাজ করছিল কিংবা বলা যায় মঈন কাজ যুগিয়ে দিয়েছিল, ওরা ছিল অপরাধ জগতের স্থায়ী বাসিন্দা। নাফিসের প্রায়শ্চিত্তের অর্থই ওদের জন্য বিপদ। মঈন খানের মিথ্যা আশ্বাস এবং ভরসায় নাফিস নিজের পাপমোচনের পথে এগোতে থাকে। যার ফলশ্রুতিতে নিষ্ঠুরভাবে সপরিবারে মরতে হয় তাকে। ভাগ্যক্রমে একটুকরো কাপড়ের তলে পড়ে বেঁচে যায় ছোট্ট শান। সেও হয়তো একা একা এই মৃত্যু পুরীতে শেয়াল,কুকুরের খাদ্য হয়ে যেত৷ কিন্তু মঈন খানের দয়া হলো ওর উপর। সৎ ভাইয়ের পরিবারের পরিণতি নিজ চক্ষে দেখতে এসে শানকে পায়। ফেলে রেখে এসেছিল এতিম খানায়। ক্রমেই তার মনে হতে লাগল একটা ডান হাতের প্রয়োজন। যাকে ঢাল করে এগিয়ে যাওয়া যাবে। সেই ভাবনায় মহৎ সেজে তুলে আনলেন শানকে। গোলাম ধীরে ধীরে আপন হয়ে উঠল। শানের গোলামিতে মঈন খান খুশি হলেন। প্রিয় ও বিশ্বস্ত হয়ে উঠল তার কাছে শান। মাঝে মাঝে ভয়ও হতো। যে সিংহ তিনি বানিয়েছেন। অতীত জেনে তার এবং তার উপর না ঝাঁপিয়ে পড়ে! মৃত্যুর আগ পর্যন্ত এই ভয়ে কাটিয়েছিলেন। তিনি জানতেনই না সিংহটি তার জীবিতকালেই সব জেনে গিয়েছিল। সত্য চাপা থাকে না। সে আপন রশ্মিতে ঠিকই জ্বলে ওঠে৷ নিজে জ্বললেও এই প্রতিশোধ তাকে জ্বালায়নি শান। যাকে বড়ো বাবা বলে পিতার স্থানে বসিয়েছিল তাকে মারতে পারেনি সে। ভালোবাসার কাছে প্রতিশোধ হেরে যায়। সবাই এক পথে চলে না। শান সেই ভিন্ন পথের পথিক। সে হারিয়ে কষ্ট পেতে রাজি, সেই কষ্ট অপরকে দিতে রাজি নয়।
তুমি অতঃপর তুমিই
২২.
Writer Taniya Sheikh
“ইমা দরজা খোলো। ইমা তুমি কী শুনতে পাচ্ছ আমার কথা? ইমা!” কয়েকবার দরজায় আঘাত করেও ইমার সাড়াশব্দ পেল না শান। এবার চিন্তা হতে লাগল। এই মেয়ের বুদ্ধির তুলনায় নেই। যদি উল্টো পাল্টা কিছু করে বসে! শানের বুক কেঁপে ওঠে। ঘন ঘন দরজায় আঘাত করে ইমা, ইমা বলে। না সাড়াশব্দ পাওয়া গেল আর না দরজা খুললো ভেতর থেকে ইমা। চিন্তায় মাথা ধরে যাচ্ছে শানের। একটু পিছিয়ে যেই না দরজা ভাঙার জন্য রেডি হচ্ছিল – অমনি খুট করে দরজা খুলে এককোনে দাঁড়াল ইমা৷ স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে শান এগিয়ে এসে ধমকে বলল,
” দরজা খুলছিলে না কেন?”
কেঁদে কেঁদে নাক,মুখ লাল করে ফেলেছে ইমা। মুখ ফুলিয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল জবাব না দিয়ে। ইমার এই অবস্থা দেখে খারাপ লাগে শানের। নিজেকে শান্ত করে মৃদু হাসার চেষ্টা করে। হাসি ঠিক আসে না। কাছাকাছি গিয়ে ইমার চিবুক ধরে মুখ তোলে। বলে,
” আ’ম সরি। চলো খাবে।”
নিজের কর্মের অনুশোচনায় দগ্ধ হলেও ক্রোধ একটু শান্ত হয়নি ইমার। বরঞ্চ ঐ ঘটনার পর আরও যেন বেড়েছে। ঘুরে ফিরে সব দোষ সে শানকে দিচ্ছে মনে মনে। ক্রোধান্বিত রক্তিম চোখে চেয়ে ঝটকা মেরে শানের হাত সরিয়ে দেয়। চেঁচিয়ে ওঠে,
” কতবার বলেছি আমাকে ছোঁবেন না। কথা কানে যায়না আপনার?”
ধৈর্য্যের বাঁধ ভাঙে শানের। ছুটে গিয়ে ইমার চুলের মুঠি ধরে বিছানায় ফেলে জোরপূর্বক স্পর্শ করে। কপাল,ওষ্ঠ,চিবুক ছুঁয়ে বুকের দিকে ঝুঁকে যায়। শানের চুলের ঘ্রানে এতক্ষণের অশান্ত ইমা মুহূর্তে শান্ত, নিথর হয়ে গেল। সমস্ত শরীর শক্ত করে পড়ে আছে বিছানায়। ইমা চেয়েও বাধা দিতে পারছে না। শক্তি, ভাষা সে হারিয়ে ফেলল এই মুহূর্তে। শান রাগে দিশেহারা। কী করছে কোনো হুশজ্ঞান নেই। হঠাৎ সকালের কথা মনে পড়ল। ভালোবাসলে ধৈর্য্যশীল হতে হয়। এতো তাড়াতাড়ি কী করে ভুলে গেল সে? চট করে উঠে দাঁড়াল শান। শান উঠে দাঁড়াতে উপুড় হয়ে দু’হাতে চাদর খামচে শব্দ করে কেঁদে ওঠে ইমা। লজ্জায় মরে যেতে ইচ্ছা হচ্ছে শানের। এই তার ধৈর্য্য! এই কী তার ভালোবাসা? সে সরি বলতে চাইল। কিন্তু কিছুতেই মুখ দিয়ে বের করতে পারল না। ইমার গায়ে চাদর টেনে চুপচাপ চলে এলো বাইরে৷ নিজের উপর প্রচন্ড রাগ হচ্ছে। দু’হাত মুষ্টিবদ্ধ করে বসে রইল লিভিং রুমে। বিকেলটাও দুজনে অভুক্ত রইল। নিজেকে প্রস্তুত করে সন্ধ্যায় আবার ইমার রুমে গেল শান। এবার দরজা খোলা ছিল। ভেতরে ঢুকতেই দেখল খাটের এককোনে দু’ হাটু জড়িয়ে বসে আছে ইমা। দৃষ্টি সামনের জানালার বাইরে। ওড়না ঠিক আগের জায়গায় পড়ে আছে। চুলগুলো এলোমেলো। ওড়নাটা হাতে তুলে শান ধীর পায়ে পাশে গিয়ে বসল,কিছুটা দূরত্ব রেখে। শানের উপস্থিতি টের পেয়েও নড়ল চড়ল না ইমা। সে দু’হাঁটুতে মুখ গুঁজে অপলক সামনে তাকিয়ে আছে। দু’জনে ওভাবে অনেক্ষণ বসে রইল। দুজনের চোখ থেকে নীরবে,নিভৃতে দু’ফোটা জল গড়িয়ে পড়ে।
” আমার ভুল হয়ে গেছে ইমা। ওয়াদা করছি তুমি না বলা পর্যন্ত আর এমন কিছু করব না আমি।”
ইমা পলক ফেলে একইভাবে বসে থেকে। শানের কাতর কণ্ঠ তার মন বিন্দুমাত্র গলাতে পারেনা। শান সামনে তাকিয়ে ওড়নাটা ওর দিকে বাড়িয়ে পুনরায় বলে,
” স্পর্শ করব না বলেছি বলে ভেবো না তোমাকে সহজে ছেড়ে দেবো। না,কোনোদিন না। আমার অপরাধ আমাকে খুলে না বলা পর্যন্ত তোমার মুক্তি নেই। সুতরাং যত তাড়াতাড়ি তুমি সব খুলে বলবে আমাদের উভয়ের জন্যেই সেটা ভালো হবে।” ইমা হাত বাড়িয়ে ওড়না নেয়না। কোনোরকমের প্রতিক্রিয়া দেখায় না সে। শান নীরবে উঠে দাঁড়ায় ওড়নাটা পাশে রেখে। দরজা পর্যন্ত এসে বলে,
” আমি তো তোমার চোখে নীচ। আশা করব আর বেশি নীচ হতে বাধ্য করবে না আমাকে। চুপচাপ খেতে এসো।”
শান বেরিয়ে যেতেই ইমা ফের নিঃশব্দে কাঁদে হাঁটুতে মুখ ঠেসে। আধঘণ্টা পার হলেও ইমা ডাইনিং টেবিলে আসে না। প্রচণ্ড রাগ হয় শানের। টেবিলসুদ্ধ খাবার দু’হাতে ঠেলে ফেলে বাড়ির বাইরে চলে যায়। রাগান্বিত শানকে বেরিয়ে আসতে দেখে দ্রুত গেট খুলে সরে দাঁড়ায় মতিন। শান হন্তদন্ত হয়ে হেঁটে চলে যায় পুবদিকের রাস্তা ধরে। মতিন সভয়ে উঁকি দিয়ে একবার দেখে চুপচাপ নিজের জায়গায় বসল।
ইমরোজ মাহিবের গাড়ি ফলো করতে করতে এসে পৌছাল একটা বহুতল অ্যাপার্টমেন্টের পাশে। ভালো করে আশপাশটা দেখে বুঝতে পারল এটাও মাহিবের বাবা মঈন খানের সম্পত্তি। মাহিবকে ধরে গাড়ি থেকে নামাচ্ছে মেয়েটি। একা কিছুতেই সামলে উঠছে না। ইমরোজ একবার ভাবল এগিয়ে যাবে কিন্তু সামনে মাহিবের বডিগার্ড দেখে গেল না। বডিগার্ডের সাহায্যে মাহিবকে ভেতরে নিয়ে যাওয়া হলো। মেয়েটি এখনো ফেরেনি। ইমরোজ অপেক্ষা করতে লাগল। মিনিট পাঁচেক পরেই দেখল বিধ্বস্ত চেহারায়, ছেঁড়া পোশাকে মেয়েটি পাগলের মতো ছুটে বেরিয়ে এলো অ্যাপার্টমেন্ট থেকে। পেছন পেছন বডিগার্ডগুলো ছুটে আসছে। ইমরোজের ধারণা তবে ঠিক ছিল! ইমরোজ বডিগার্ডদের পেছনে ফেলে মেয়েটির কাছে গিয়ে হাজির হয়। দ্রুত দুজন একটি বিল্ডিংএর আড়ালে লুকিয়ে পড়ে। মেয়েটি আতঙ্কিত মুখে সবটা দেখছে আর হিচকি টেনে টেনে কাঁদছে। বডিগার্ডরা এদিকে না পেয়ে অন্যদিকে খুঁজতে চলে গেল। ইশরায় নিজের আইডি কার্ড দেখিয়ে মেয়েটিকে নিয়ে সতর্কে নিরাপদ স্থানে চলে এলো ইমরোজ।
” আপনি চলুন আমার সাথে।”
” কোথায়?” মেয়েটি অসহায় মুখে ফুঁপিয়ে বলল। ইমরোজ বলল,
” মাহিব খানের নামে থানায় কমপ্লেইন করতে।”
মেয়েটি চমকে ওঠে। আতঙ্কিত হয়ে ইমরোজের হাতটা ধরে অনুরোধ করে,
” প্লিজ, এমনটা করবেন না। আমার মান সম্মান সব শেষ হয়ে যাবে তাহলে। এসব জানাজানি হলে আমার বাবা-মা মরেই যাবেন। প্লিজ আমাকে যেতে দিন। আমারই ভুল। আমি কেন বান্ধবীদের প্ররোচণায় ক্লাবে গেলাম। কেন ঐ বদ লোকটাকে সাহায্য করলাম। সব দোষ আমার।”
মেয়েটি কাঁদতে কাঁদতে নিচে বসে পড়ে। ইমরোজ তাকিয়ে দেখে মেয়েটির হাতার,পেটের অনেকখানি কাপড় ছিঁড়ে গেছে। ওড়নাটাও নেই দেহের উপর। দৃষ্টি সরিয়ে নিজের গায়ের ব্লেজার খুলে মেয়েটির দিকে এগিয়ে দেয়,
” নিন,এটা পড়েনিন।”
মেয়েটির লজ্জিত মুখে এক হাত বাড়িয়ে ব্লেজার টা নেয়। গায়ে জড়িয়ে নাক টেনে টেনে বলে,
” আমার বাবা গ্রামের সামান্য স্কুল মাস্টার। আমাদের দুই বোনকে বহু কষ্টে বড়ো করেছেন তিনি। অনেক চেষ্টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ হয়েছে আমার। এখানে আপনজন বলতে কেউ নেই। হলে যাদের সাথে থাকতাম ওরাই আজ জোর করে ক্লাবে নিয়ে এসেছিল। ঐ লোকটি মাতাল হয়ে নিজেকে সামলাতে পারছিল না। আমাকে দেখেই হেল্প চাইল। আমি গ্রামের মেয়ে। শহরের মানুষের প্যাঁচ বুঝতে পারিনি।” এতোটুকু বলে আবার কাঁদতে লাগল। দু’হাতে শরীরের ব্লেজারটা আঁকড়ে ধরে বলল,
” উনার বডিগার্ডদের কাছে দিয়ে চলেই আসতাম। হঠাৎ হাতটা ধরে অনুরোধ করলেন বাসা পর্যন্ত যেন দিয়ে আসি। আমার মোটেও ভালো লাগছিল না তার স্পর্শ। আমি চলে আসতে চাইলাম। ওমনি জোর করে লিফটে টেনে নিলেন। চিৎকার করার পূর্বেই মুখ চেপে ধরে আমার। লিফট থেকে বেরোতেই উনার সাথে ধস্তাধস্তি হয় আমার। জানেন, আমার মনে হচ্ছিল আমি বুঝি মরেই গেলাম। অনেক কষ্টে তাদের হাত থেকে ছুটে পালিয়ে আসি।” মেয়েটি কান্নায় ভেঙে পড়ে। ইমরোজ এমন পরিস্থিতির সম্মুখীন বহুবার হয়েছে। মেয়েটির কান্না তাকে ভীষণ ভাবে আলোড়িত করল। ইমরোজ মেয়েটির হাত ধরে এক স্থানে বসল। এক বোতল পানি এনে দিল পাশের দোকান থেকে। সেটা দু’হাতে কোলের মধ্যে ধরে মেয়েটি কাঁদছে, ইমরোজ চুপচাপ পাশে বসে আছে। আড়চোখে দেখছে কিন্তু সান্ত্বনার ভাষা আজ খুঁজে পাচ্ছে না। কিছুক্ষণ পর কান্না থামিয়ে মেয়েটি বলল,
” আমি জানি আপনি আমার ভালোর জন্যেই রিপোর্ট করতে বলছেন, কিন্তু আমি নিরুপায়। আমাদের মতো মধ্যবিত্ত ঘরের মেয়েদের সম্মানটাই সব। এটা চলে গেলে বেঁচে থাকা কষ্টকর হয়ে যাবে সমাজে। প্লিজ বুঝুন আমাকে,আমার অসহায়ত্বকে।”
ইমরোজ কিছুক্ষণ ভেবে অবশেষে বলল,
” ঠিক আছে। ”
মেয়েটি ওকে অনুরোধ করল এই কথা যেন কাওকে না বলে সে। কেন যেন কথাটা না চাইতেও মেনে নেয় ইমরোজ। মেয়েটি নত মুখে বলল,
” এই অবস্থায় হলে উঠতে পারব না আমি। মিরপুর আমার এক বান্ধবী থাকে। আপনি যদি দয়া করে সেখানে পৌঁছে দিতেন!”
” জি,অবশ্যই।”
মেয়েটিকে বাইকে চড়িয়ে মিরপুর দশের একটি বিল্ডিংএর সামনের এসে থামে। বাইক থেকে নেমে মেয়েটি বলে,
” ধন্যবাদ আপনাকে।”
” ধন্যবাদের প্রয়োজন নেই,এটা আমার দায়িত্ব। কোনো সমস্যা হলে আমাকে বলবেন।” এক টুকরো কাগজে নিজের নাম্বার লিখে মেয়েটির হাতে দেয়। কাগজে লেখা নাম্বারটায় দৃষ্টি রেখে মেয়েটি বলল,
” চলি তাহলে।”
” ঠিক আছে।”
সামনের গেট পার হতেই একবার ফিরে তাকাল ইমরোজের দিকে। অসহায় সে চাহনী ইমরোজের ভেতর পর্যন্ত নাড়া দেয়। চোখে চোখ পড়তেই মেয়েটি মাথা নুয়ে ভেতরে চলে গেল। বেশকিছুক্ষণ সেখানে ঘুরে ফিরে ইমরোজ বাসার উদ্দেশ্যে রওনা হয়। ইমরোজের বাইকে যেতেই ভেতর থেকে বেরিয়ে আসে মেয়েটি। তখনই একটা অটো এসে হাজির হয় সামনে। অটোতে চড়ে বিপরীত দিকে রওনা হয় সে। অটোওয়ালার মোবাইল বেঁজে ওঠে৷ স্ক্রিনে ভেসে ওঠা নামটা দেখে রিসিভ না করেই মেয়েটির দিকে বাড়িয়ে দেয়। এতোক্ষনের অসহায় মেয়েটিকে চেনায় যায়না। ব্যঙ্গাত্মক হাসি ফুটে ওঠে ঠোঁটে। ব্লেজারটা গা থেকে খুলে সামনে ধরে মোবাইল রিসিভ করে। ঘাড় কাত করে ক্রুর হাসি হেসে ব্লেজারটা দেখছে। হাসি থামিয়ে মোবাইলের ওপর পাশের মানুষটাকে বলে,
” প্লান এ সাকসেসফুল, বেবি।” ফের এক অদ্ভুত হাসিতে চোখ মুখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে মেয়েটি সহ অটো ড্রাইভারের।
রাত ঘন হতেই শান ফিরে আসে। মলিন, অবসন্ন ভাব এসেছে চেহারায় সারাদিনের অভুক্তি,ক্লান্তিতে। দরজা খুলে উপরে উঠে যায় সোজা। লম্বা শাওয়ার শেষে বিছানায় গা এলিয়ে দেয়। খুব তাড়াতাড়িই ঘুম নেমে আসে দু’চোখে। ক্ষুধার্ত শানের কাঁচা ঘুম ভেঙে যায় কিছু পড়ার আওয়াজে। ভ্রু কুঁচকে অন্ধকারে তাকিয়ে বুঝতে চেষ্টা করে আওয়াজটা। এবার স্পষ্ট শব্দ শুনতে পেল শব্দটা। নিচে কেউ কাজ করছে। প্লেট,গ্লাস নাড়াচাড়ার শব্দ পাওয়া যাচ্ছে এখান থেকে। চট করে বিছানা ছেড়ে নিচে নেমে এলো। ডাইনিং হলে লাইট জ্বলছে। শান এগিয়ে যেতেই ইমাকে দেখল। রান্নাঘর থেকে খাবার এনে এক এক করে টেবিলে সাজাতে ব্যস্ত সে। একবার শুধু শানের দিকে তাকিয়ে তাচ্ছিল্যের সাথে সঙ্গে সঙ্গে দৃষ্টি সরিয়ে নেয়। টেবিল সাজানো শেষ। শান অপেক্ষা করছে কখন ইমা ওকে খেতে ডাকবে। অপেক্ষার পালা শেষ হয়না। হঠাৎ তখনকার কথা মনে পড়ে যায়। বাসা থেকে বেরিয়ে যাওয়ার আগে ডাইনিং এরিয়ায় খাবার ফেলে যাচ্ছে তাই অবস্থা করে গিয়েছিল। পুরো ডায়নিংএ চোখ বুলিয়েও ময়লা,উচ্ছিষ্ট চিহ্ন দেখল না শান। বুঝে নিল এসব ইমায় পরিষ্কার করেছে। কিন্তু কেন? তার তো রাগ,ক্ষোভ শানের উপর৷ বিকেলের ঘটনা এতো সহজে ভুলে গেল? শানের কিছুটা অদ্ভুত লাগে ইমার হঠাৎ পরিবর্তন। তবে খুশি হয় এই ভেবে যে, ইমা স্বাভাবিক হয়েছে। অনেক্ষণ অপেক্ষা করেও যখন ইমা খেতে ডাকল না-শানের অভিমান হলো। মনে মনে বলল,
” এতোকিছু করতে পারছে, অথচ একটু খেতে ডাকতে পারছে না। কী ভেবেছে ও? শান ক্ষুধায় পাগল হয়ে খেতে বসে যাবে? এতো সহজ নয় ম্যাডাম। খাবার সাজিয়ে থাকেন রান্নাঘরে দাঁড়িয়ে। আমি চললাম।”
ইমা রান্নাঘর থেকে উঁকি দিতেই দেখল শান ফিরে যাচ্ছে। মেজাজ বিগড়ে গেল। বিরবির করে বলল,
” এতো কষ্ট করে মাঝরাতে উনার জন্য রান্না করলাম, টেবিল সাজালাম। আর উনি। দেমাগে বাঁচে না। মন তো চায়,, উফ!” নিজের রাগ কিছুটা দমিয়ে রান্না ঘর ছেড়ে বেরিয়ে আসে। গলা চড়িয়ে বলে,
” যাচ্ছেন কই? খাবার দিয়েছি চোখে পড়েনা?”
শান মুচকি হেসে দাঁড়িয়ে যায়। না ঘুরেই গম্ভীর গলায় বলে,
” চোখে তো কতকিছুই পড়ে, তাতে কী?”
” কতবড়ো বদ, আমি বলি এক আর উনি বলেন পাঁচ। আমি ভালো বলে বেঁচে গেলি তুই শানের বাচ্চা। আমার জায়গায় অন্য কেউ হলে তোর,,, ” ইমার বিরবিরানি থেমে যায় শান সিঁড়িতে পা দিতেই। দাঁতে দাঁত পিষে ইমা বলে,
” খেতে বসুন।”
শানের হাসি যদি তখন কেউ দেখত! একটু ভাব নিয়ে দাঁড়িয়ে রইল কিছুক্ষণ। তা দেখে ইমা বলল,
” এখন কী ঝুঁকে কুর্নিশ করে বলতে হবে?”
” নো,নো। ইটস ওকে। আমি তো খেতে আসতামই। মোবাইল আনতে যাচ্ছিলাম আরকি। এতো অনুরোধ করার কী ছিল? তুমিও না।” শান ঘুরে দাঁড়িয়ে সোজা খাবার টেবিলের চেয়ারে এসে বসে। শানের ভাব দেখে আর কথা শুনে ইমার ইচ্ছা করছে চুল টেনে ছিঁড়তে। নিজের না, শানের। শান ইমার রাগে শক্ত হওয়া মুখটা দেখে মনে মনে হাসলেও বাহিরে স্বাভাবিক। ভাত প্লেটে বাড়তে বাড়তে শান বলল,
” তুমি খাবে না?”
” সাহেবদের খাওয়ার পরে কাজের লোকেরা খায়।”
প্লেট ঠেলে উঠে দাঁড়ায় শান৷ ইমার গলা শুকিয়ে যায় শানের রক্তচক্ষু দেখে। এই ভয় পাওয়াটা যেন শান বুঝতে না পারে তাই সাথে সাথে অন্যদিকে তাকায়।
” আমি খাব না ” শান যেতে উদ্যত হতেই ইমা মিথ্যা বলে,
” আমি আগেই খেয়েছি।”
” মিথ্যা বলছ তুমি।”
” মিথ্যা বলছি! আপনি কী করে বুঝলেন মিথ্যা বলছি? সবজান্তা শমসের আপনি? আজাইরা। খেলে খাবেন না খেলে নাই।” ইমা রান্নাঘরে চলে যায় রেগে। শান উঁচু গলায় বলে,
” সত্যি বলছ তো?”
” না, মিথ্যা বলছি। খাইয়েন না আপনি। এক গ্লাস পানি খেয়ে রোজা রাখেন,যান।”
” ভালো করেও তো বলা যেত কথাটা।”
” আমি ভালো কথা জানিনা৷ পছন্দ হলে কাজে রাখবেন নয়তো রাখবেন না।”
” বার বার কাজের লোক,কাজের লোক কেন বলছ নিজেকে?”
” আমার ইচ্ছা হইছে তাই। আপনার কী?”
“তোমার এই তর্কের স্বভাব আমার অপছন্দ ইমা। মেজাজ খারাপ করে দাও এসব করে তুমি।”
” হু, তাতে আমার বয়েই গেল।”
শান দেখল কথায় কথা বাড়ছে। যা কি’না ধীরে ধীরে ঝগড়ায় পরিবর্তন হতে সময় লাগবে না। সুতরাং চুপ হয়ে গেল শান। চেয়ারে বসে খেতে লাগল। বরবটি ভাজা চোখে পড়তেই সেটা পাতে তুলে নেয়। বউয়ের হাতের বাঙালিয়ানা রন্ধনের স্বাদ আয়েশ করে নিতে গিয়ে আস্ত মরিচে কামড় দিল। পুরো মুখ জ্বলছে ঝালে। তড়িঘড়ি গ্লাস উঠাতেই হাত ফসকে পড়ে গেল সেটা। ছুটে এলো ইমা।
” কী হয়েছে আপনার?”
” ঝাল, ঝাল।” মাছি তাড়ানোর মতো হাত নাড়িয়ে বলল শান। চোখ মুখ লাল হয়ে গেছে ঝালে। জগ থেকে পানি গলায় ঢেলেও ঝাল কমাতে ব্যর্থ হলো। ইমার মায়া হচ্ছে শানের অবস্থা দেখে। যখন কিছুতেই কিছু হচ্ছে না, শান ইমার দিকে এগিয়ে এসে বলল
” ইমা কিস মি।”
” অ্যাআআআ।” ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে সরে দাঁড়ায় ইমা।
” শুধুমাত্র একটা ডিপ কিস তারপর সব ঝাল ভ্যানিশ, মুভিতে দেখোনি তুমি?”
ইমার কেন যেন মনে হচ্ছে শান এবার চালাকি করছে ওর সাথে। সাথে সাথে এখানে আসার প্রথম রাতের ঘটনা মনে পড়ে গেল। কী বিশ্রী একটা মুভি চলছিল। কটমট করে তাকিয়ে ইমা বলল,
” ওসব ফালতু,লুইচ্চা মার্কা ছবি ইমা দেখে না৷”
” প্লিজ ইমা, কিস মি। নয়তো ঝালে মরে যাব আমি।”
অবস্থা সুবিধার না দেখে দৌড়ে রুমের দরজার কাছে গিয়ে দাঁড়াল ইমা। দরজা খুলে ভেতরে ঢুকে মাথা বের করে বলল,
” কিস,কুসে ভিটামিন নেই। ঝালে ভিটামিন সি আছে। আপনার মধ্যে ভিটামিন সি’র মারাত্মক ঘাটতি দেখা যাচ্ছে। একটু জ্বলাতে যদি ভিটামিন ঘাটতি পূরণ হয় তবে ক্ষতি কী? সহ্য করেন। বাই।”
শান অসহায় মুখ করে এগোতেই দাড়াম করে দরজা লাগিয়ে দেয় ইমা। হাতের গ্লাসটা দরজা দিকে ছুঁড়ে মারতে গিয়ে নিজেকে সামলে নেয় শান। বিরবির করে বলে,
” আমাকে কাইষ্টা বলত। আর নিজে কী, কাইষ্টার বউ কাইষ্টি? কাইষ্টি বলে কী কোনো শব্দ বাংলা অভিধানে আছে? ধুর শালা! কী কপাল করে একটা বউ পেয়েছিলি! ঝালে মরে গেলেও ঝাল নিবারক একটা কিস দিতে চায়না। একটা কিস দিলে কী হতো ইমা? আমার ভিটামিন সি চাইনা,কিস চাই কিস। ঝাল নিবারক কিস।”
চলবে,,,,
চলবে,,,