#তুমি_আছো_তুমি_রবে
#পর্বঃ৫
#রেহানা_পুতুল
বসন্ত বিদায় নিচ্ছে সবুজ প্রকৃতিকে মাখো মাখো যৌবনের উম্মাদনা দিয়ে। উদাম বৃক্ষশাখায় নবপল্লব গজিয়ে উঠার আশীর্বাদ। ডালে ডালে কোকিলের কুহুতান। প্রকৃতিতে যেন আলোর নাচন। সাজ সাজ রব। গ্রামে থেকে এই বসন্তকে পুরোদমে উপভোগ করছে ঝিনুক। খালা ফুফুর হাতের মজার সব রান্না খেয়ে হালকা স্বাস্থ্যবতী ও হয়েছে ।
একমাসের ও বেশীসময় অতিবাহিত হয়ে গিয়েছে ঝিনুক গ্রামে গিয়েছে। এখন তার ঢাকায় আসতে মন সায় দিচ্ছেনা কিছুতেই। মন চাচ্ছে গ্রামেই রয়ে যেতে। রেজাল্ট ও দিয়ে দিয়েছে। খুব ভালো রেজাল্ট করলো সে। ঢাকায় আরশাদ ছাড়া দুই পরিবারের বাকি সবাই তাকে মিষ্টি মুখ করানোর জন্য মুখিয়ে আছে।
এ ভিতরে দায়সারাভাবে মাঝে মাঝে ফোন দিয়ে কথা বলেছে আরশাদ ঝিনুকের সাথে। ঝিনুক ও কম যায়না। নিজ থেকে ইচ্ছে করে একবার ও আরশাদকে ফোন দেয়নি। তা কিন্তু আরশাদ গায়েও মাখলোনা।
যাকে ভালো লাগেনা তার কাছে কোন প্রত্যাশা ও থাকেনা। আর যেখানে প্রত্যাশা নেই। সেখানে না পাওয়ার শূন্যতাটুকুও নেই।
আরিশা আরশাদের কাছে গিয়ে গা ঘেঁষে দাঁড়ালো আবদারের ঢালি নিয়ে।
ভাইয়া তোমার মুড অন না অফ?
কারণ?
আহ প্লিজ বলনা।
অন।
তুমি ইজি না বিজি?
ইজি। এইই কাহিনী কিরে তোর? ঘোড়ার ডিম পেয়েছিস মনে হয়?
পাইনি। পেলে তোমাকে বাদ দিয়ে খাবোনা। একটা গুরুত্বপূর্ণ আর্জি পেশ করতে চাই।
ন্যাকামি করবিনা। ঝেড়ে কাশি দে বলছি।
তুমি আর আমি গ্রামে যাবো। রাজী?
কয়দিন আগে গ্রাম থেকে ঘুরে আসলাম আমি। এখন কেন যাবো?
এই গ্রামে তুমি এর আগে আর ভুলেও পা রাখনি। আমরা ঝিনুককে আনতে যাব। ও হয়তো রিলেটিভ কারো সাথে লোকাল বাসে করে আসবে। তার চেয়ে বর ননদের সাথে আসলে সুন্দর হয়না? বলেই আরিশা শুকনো ঢোক গিললো।
তুই আমার সামনে থেকে দূর হ বলছি। নয়তো ধাক্কা দিয়ে বের করে দিবো। চোয়াল শক্ত করে বলল আরশাদ।
ইসসস! বললেই হলো। তোমার কি মনে হয় এটা কেবল আমার চাওয়া?
কিইই? মুহুর্তেই আরশাদ জিভ দিয়ে উপরের ঠোঁটকে ভিজিয়ে নিলো।
জ্বি মিস্টার। এবার বলেন যাবেন না?
কাইন্ডলি আমাকে এক পেয়ালা বিষ এনে দিতে পারবি বোন?
খুব পারবো। একমাত্র বড় ভাইয়ের অনুরোধ রক্ষা করা একমাত্র ছোট বোনের জন্য ফরজ।
ইয়ার্কি মারছিস আমার সাথে?
কোন স্বার্থে ভাইয়ু? বলে আরিশা উঠে দাঁড়ালো। পিছন দিয়ে জোবেদা বেগম প্রবেশ করলেন রুমের ভিতরে।
আম্মু ও কি বলছে এসব? আমার নাকে তাদের গ্রামে যেতে হবে?
জোবেদা বেগম বিরক্তি নিয়ে, এমন অবাক হয়ে বলছিস মনে হয় আরিশা তোকে গলায় ফাঁস দিতে বলছে।
আম্মু ফাঁসের চেয়েও যদি বেশি কিছু থেকে থাকে। তবে তাই । না পারছি গলা থেকে দড়ি খুলে বাঁচতে। না পারছি দড়িকে হ্যাঁচকা টান দিয়ে মরে যেতে।
আচ্ছা যা মন চায় করিস। কি বলি কান পেতে শোন। কথাগুলো আমার নয়। আমি এখানে মাধ্যম হিসেবে আছি। তোর বাবা জামান খান কড়া নির্দেশ জারী করেছে তোর জন্য।
আরশাদ থম মেরে আছে। তার এই মুহুর্তে মনে হচ্ছে কোন এক অচেনা দৈত্য এসে তার গলাটাকে চেপে ধরেছে। সে দম ফেলতে পারছেনা।
মেয়েটা এত ভালো রেজাল্ট করলো। তুই গেলে তার আনন্দ দিগুণ হয়ে যাবে। তোর বাবা বলছে তুই গাড়ি নিয়ে গিয়ে ঝিনুককে নিয়ে আসতি। সাথে ঝিনুক ও যাবে। তার বাবাই তাকে আনতে যেতো। কিন্তু তোর বাবা তাকে মানা করে দিয়েছে। আর আমাদের এদিকের কলেজেই ওকে ভর্তি করিয়ে দিস। এ বাসায় থেকেই পড়াশোনা করতে পারবে। কোন সমস্যা নেই। আর তাদের কারোই আমাদের বাসায় আসায় হয়নি। তাই সময় সুযোগ করে তাদের সবাইকে দাওয়াত দিবো। যতজন আসার আসবে। মেয়ের শ্বশুরবাড়ি দেখার অধিকার তাদের আছে।
তাকে ঢাকায় এনে কি তাদের বাসায় ঢালবো না আমাদের বাসায় ঢালবো?
কি ধরনের কথা এসব? ঢালবো কি? সে কি ধান চালের বস্তা যে ঢালবি? তিক্তস্বরে বললেন আরশাদের মা।
আরিশা দুম করে হেসে ফেলবো। পাশ থেকে না বুঝে তাদের বাসার সবর্দা সাহায্যকারী সালেহাও হেসে ফেললো। আরশাদের মুখ দিয়েও বাঁকা হাসি বেরিয়ে এলো। বলল, মা ওই মেয়ে আমার লাইফে ওজনদারী বস্তা ছাড়া আর কিছুই নয়।
জোবেদা বেগম মুখ মলিন করে ফেললেন। আরশাদ মাকে জড়িয়ে ধরে, রাগ করোনা। যাবোও। আনবোও।
আরিশা মনে মনে মজা লুটছে। আজ যাকে বস্তা বলছো, দুদিন বাদে তাকে কোলে তুলে হালকা তুলা বললা। যেই সেই তুলা নয়। শিমুল তুলা। কি নরম! কি মসৃণ। কি আরামদায়ক। যেন হাজির কাচ্চি বিরিয়ানি।
ফরমুলা আপাতত পাঁচটা রেডি। এক বছর ধরে প্রেম করছি শাওনের সাথে। সো এ বিষয়ে আমি পাক্কা খেলোয়াড়। প্রতিপক্ষকে ধরাশায়ী করার যাদু আমার মুঠোয় । আসুক বিবিসাব বাসায়।
______
সারাবাড়িজুডে একটা খুশীর আমেজ। পুরোঘর পরিপাটি করে গোছানো। ভিন্ন ভিন্ন স্বাদের পিঠাপুলি তৈরি হলো । নিজেদের বিশাল একা বাড়ি। নিজস্ব পুকুর। পুকুর থেকে জাল ফেলে বড় রুই মাছ ধরা হলো। পালা মুরগী ও রাজহাঁস বেছে বেছে বড় সাইজের দুইটা করে জবা হলো।
এতসব কাজকর্মের হুলুস্থুল দেখে আরিশা কৌতুহল নিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
কি ব্যাপার খালামনি দুদিন ধরে ঘরদোর গোছাচ্ছো? এত বাজার করলে? কোন স্পেশাল গেস্ট আসবে মে বি ?
হ্যাঁ। তোর আংকেলের অতিথি। আজ আসবে। পরিপাটি হয়ে থাকিস ।
আমি পরিপাটি এমনিতেই হবো। বের হয়ে যাচ্ছি শায়লাসহ।
কোথায় যাবি তোরা?
চড়কমেলায় ঘুরতে? এখন নাকি অনেক সুন্দর হয়েছে। সেই ছোটবেলায় গিয়েছি এই মেলায়। মনেও নেই।
আর দিন খুঁজে পেলিনা। আচ্ছা যা। তাড়াতাড়ি চলে আসিস।
ঝিনুক তার মতো করে তৈরি হয়ে খালাতো বোন শায়লার সাথে বেরিয়ে পড়লো।
ঝিনুকের খালাকে তার শাশুড়ী জোবেদা বেগম অনুরোধ করেছে, ঝিনুককে যেন না বলে। এটা তার জন্য সারপ্রাইজড।
তবে মূল বিষয় হলো ইতঃপূর্বে আরশাদ যে ঝিনুককে পছন্দ করেনা এটা বাসায় খোলাসা হয়ে গিয়েছে স্বচ্ছ কাঁচের ন্যায়। ঝিনুক শুনলে হয়তো পালাবে সে বাড়ি থেকে।
মানুষ মিথ্যে অভিনয় দীর্ঘসময় ধরে করতে পারেনা। তার স্বরুপ প্রকাশ পাবেই।
ঝিনুক ছাড়া সবাই জানে আজ কে আসতেছে অতিথি হয়ে। সে উপলক্ষে মামা, মামি, নানু, অন্য খালারাও আসছে। নানা পদের লোভনীয় সব রান্না হলো ।
বাড়ির ফুল বাগান ও আনাচে কানাচে থেকে সংগ্রহ করা ফুল আর লতা দিয়ে ফুলের কয়েকটি তোড়া সাজিয়ে নিলো। সবার পুরোদমে প্রস্তুতি নেয়া শেষ।
ভর দুপুরের হলদে রোদের মায়াকে সঙ্গী করে আরশাদ ও আরিশা গাড়ি নিয়ে ঝিনুকের খালার বাড়ি পৌঁছে গেলো। তাদের বাড়ির সামনে পর্যন্ত ঢালাই করা পথ। তাই গাড়ি নিয়ে ঢুকতে কোন বেগ পেতে হয়নি।
ড্রাইভারকে নেয়া মানে বাড়তি ঝামেলা। বাড়তি তদারকি। তাই তাকে না নিয়ে আরশাদ নিজেই গাড়ি ড্রাইভ করে চলে গেলো। গাড়ি কাচারি ঘরের সামনে বিশাল খোলা স্থানে পার্কিং হলো।
গাড়ির আওয়াজ শুনেই বাড়ির ভিতর থেকে ছুটে এলো ঝিনুকের ছোট ছোট খালাতো ও মামাতো ভাইবোনেরা। নিজেদের বানানো ফুলের তোড়া উপহার দিয়ে আরশাদ ও আরিশাকে রিসিভ করলো।
হাস্যোজ্বল ভঙ্গিতে দুই ভাইবোন হায় হ্যালো করলো বাচ্চাদের সাথে।
একে একে সব বাচ্চাদের হাতে আরশাদের আনা উপহারসামগ্রী ও ফলমূল, দই মিষ্টির প্যাকেটগুলো দিলো আরিশা। কার জন্য কি নিবে সব জোবেদা বেগম পুত্রকে শিখিয়ে দিয়েছে। আর সাথে আরিশাকে দেয়া হলো আরশাদের দিকে খেয়াল রাখার জন্য। যেন সেখানেও ঝিনুকের সাথে কোন অশোভনীয় আচরণ না করতে পারে।
তারা ঘরের ভিতরে ঢুকলো। ড্রয়িংরুমে বসলো। মুরব্বি সবাইকে সালাম দিলো হাসি হাসি মুখ করে। সবাই নিজ থেকে পরিচিত হয়ে নিলো আরশাদের সাথে। এবং আরশাদকে কেউ সোনার আংটি দিলো। কেউ সালামী দিলো ক্যাশ।
ভাবি কোথায় আন্টি?
মেলায় ঘুরতে গিয়েছে আমার মেয়েসহ। চলে আসবে। বলল ঝিনুকের খালা।
ইসসস! আজ না গেলে আমিও যেতে পারতাম।
তোমাকে আর জামাইকে নিয়ে কাল যেতে বলবো। মিষ্টি হেসে জানালো ঝিনুকের খালা।
নতুন জামাই। নতুন পরিবেশ। তাই শরবত থেকে শুরু করে দুপুরের লাঞ্চ ও বিকেলের নাস্তা সবমিলিয়ে ভরপুর আতিথেয়তায় আরিশা ও আরশাদ চমকিত! অভিভূত!
সবাই ভিতরে গেলে আরিশা ভাইকে ফিসফিসিয়ে বলল,
দেখলে এরা কত বড় মনের? আপ্যায়নে কতটা যত্নের ছাপ? আমাদের লেবেল ম্যাচ করে বিয়ে করলেও এমনটা আদর কদর পেতেনা।
আরশাদ মুখে সন্তুষ্টির প্রলেপ এঁকে,
একদম ঠিক বলছিস। কত পদের খাবার বানিয়েছে লক্ষ্য করেছিস? আম্মু আসলে আরো মজা হতো।
___
পড়ন্ত বিকেল। শেষ বিকেলের গোলাপি আভা মিলিয়ে যাচ্ছে। কিছুসময় বাদেই আকাশে উঁকি দিবে সন্ধ্যাতারা। অথচ ঝিনুক ও শায়লার আসার নাম নেই।
রসুই ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে খালা,নানু,মামী রাগ হয়ে যাচ্ছে।
আরিশা ও আরশাদ দুইজন দুই রুমে বিশ্রাম নিচ্ছে। সবাই ইচ্ছে করেই শায়লার রুম রেডি করেছে আরশাদের জন্য। কারণ ঝিনুক থাকে শায়লার রুমেই।
চারদিকে আঁধার নেমে আসছে। এমন সময় ঝিনুকরা এলো। রসুই ঘরের সামনে গিয়ে,
চোখ বড় করে নানু,মামি,কখন এলে তোমরা? খালা তোমাদের জন্য এত আয়োজন করলো? আংকেলের না অতিথি আসার কথা? শায়লা জানে তাই কিছুই বললনা। পুকুরে হাত মুখ ধোয়ার জন্য চলে গেলো।
ঝিনুকের মামী বললো, অতিথি এইমাত্র চলে গিয়েছে। ভালো রান্নার আয়োজন হলো। তাই আপা আমাদের সবাইকে দাওয়াত দিয়েছে। কেনরে মেয়ে আমরা কি বাজারের সস্তা আলু পোটল? আমাদের জন্য এসব করা যায়না? যা হাতমুখ ধুয়ে খেয়ে নে তাড়াতাড়ি।
ঝিনুক নাকি নাকি করে,ওহ সুইট মামি। মাইন্ড করো কেন। এমনিতেই মজা করে বলছি। জানো আমরা ফাটাফাটি মজা করেছি।
তার মামী উওর দিলো,আমরাও অতিথিদের সাথে কাঁপা-কাঁপি মজা করেছি।
ঝিনুক খিলখিল হাসি ছড়িয়ে চলে গেলো। শায়লাকে নিয়ে ভাত খেয়ে নিলো।
এদিকে সবাই লুকিয়ে চোখ টিপাটিপি করছে সারপ্রাইজড দেখার জন্য।
ঝিনুক বলল,
উফফ! ঘুরলাম। এবার বেশী করে খেলাম আয়েশ করে। পেট ফেটে যাচ্ছে। যাই রেস্ট নেই। এই শায়লা আর তোর রুমে।
আপু তুমি যাও আমি আসছি ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে।
শায়লার রুমের দরজা চাপানো ভিতর থেকে। আরশাদ পেপার পড়ছে বালিশে হেলান দিয়ে।
ঝিনুক দরজা খুলে আরশাদকে দেখেই আৎকে গেলো । কাঁপাকন্ঠে চিৎকার দিয়ে আপনি কেএএ? খালামনি ভুউউউত..! বলে লাফিয়ে বের যাচ্ছে।
অমনি আরশাদ ঝিনুকের মুখ চেপে ধরে ভিতর থেকে দরজা বন্ধ করে দিলো।
চলবে…৫