#তুমি_হাতটা_শুধু_ধরো
#পর্বঃ৩৮
#Jhorna_Islam
” সংসারে সুখের স্থানই সবচেয়ে সং’কী’র্ণ– কোথাও তাহাকে সম্পূর্ণ নি’র্বি’ঘ্নে রাখিবার অবকাশ নাই।
(রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)।
সংসার মানুষকে যেমন সুখের সাগরে ভাষাতে পারে।তেমনি শে’ষ ও করে দিতে পারে।সবার ভাগ্যে সংসার জিনিসটা থাকেনা। কেউ সব কিছু পেয়েও হেলায় হারায়।সঠিক মানুষটার গুরুত্ব থাকতে বোঝে না।
সোহা বোনের হাত পা গুলো ধরে ধরে দেখছে।আঘাতের চিহ্নে ভর পুর। চোখ থেকে আপনা আপনিই পানি ঝরছে।কতোটা কষ্ট পেয়েছে তার বোনটা।
বোনের হাতে চুমু খেতে খেতে শব্দ করে কেঁদে উঠে সোহা।
নোহা সোহার দিকে তাকিয়ে বলে,, কাদতেছিস কেনো বোন? কি হয়েছে আমার সোনা বোনটার? আমি ঠিক আছিতো বাবু দেখ।কিছু হয়নি আমার।
আপুরে আমি খুব ভ’য় পেয়ে গিয়েছিলাম।তোর যদি কিছু হয়ে যেতো?
কিছু হয়নিতো।
তোর অনেক কষ্ট হয়েছে তাই না আপু? এখনও হচ্ছে আমি জানি। তোকে ওরা একটুও শান্তি দেয়নি। তুই একটু ও ভালো ছিলিনা ওখানে।আমি এখন বুঝতে পারছি।আমি ওদের কাউকে ছাড়বোনা দেখিস।শ’য়/তান গুলো যেনো জেলে পঁচে ম’রে তার ব্যবস্থা করাবো।বলেই নোহার হাত ধরেই হাউমাউ করে কাঁদতে থাকে। নোহা অনেক বলেও থামাতে পারে না।
কলিজাটা ফেটে যাচ্ছে সোহার বোনের এ অবস্থা দেখে। কিছুতেই কান্না নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না।সোহার বাবা মা ও বলে থামাতে পারছে না।
কাঁদতে কাঁদতেই বলে,,তর বাবুটার জন্য খুব কষ্ট হচ্ছে তাই না আপু?
নোহা সোহার মাথায় ক্যা’নু’লা লাগানো হাতটা আস্তে করে রেখে বলে,, নারে বোন একটুও কষ্ট হচ্ছে না। ভালোই হয়েছে সে এই পৃথিবীতে আসেনি।ওমির কোনো যোগ্যতাও ছিলোনা ওর বাবা হওয়ার।পৃথিবীতে আসলে আরো কষ্ট পেতো।যে ওর বাপ একটা কা/পুরুষ । আমি যতোই ওকে নিয়ে আলাদা হয়ে যেতাম না কেন, ঐ লোকের র’ক্ত তো ওর শরীরে থাকতো।প্রথমে একটু খারাপ লাগলেও এখন এটা ভেবেই শান্তি পাচ্ছি।
নোহার মা নোহার কপালে চুমু খেয়ে বলে আম্মা এসব বলে না।আমিতো মা আমি তোমার কষ্ট টা ঠিক বুঝতে পারছি।নিজের সন্তান হারানোর কষ্ট টা একটা মা ই উপলব্ধি করতে পারে। তোমার যে ভিতর টা কষ্টে ছারখার হয়ে যাচ্ছে। আমি বুঝতে পারছি।
নোহা চোখ বন্ধ করে ফেলে।দু চোখের কোণ বেয়ে অবিরাম ধারায় অশ্রু বেরিয়েই যাচ্ছে। কিছু সময় পর নোহা নিজেকে স্বাভাবিক করে চোখ খোলে।সোহা বোনের দিকেই তাকিয়ে আছে।
আপু তুই এতো অ’ত্যা’চার কেনো সহ্য করলি? কেনো আমায় কিছু জানালি না আপু? কেন ঐখানে মুখ বুঁজে পরেছিলি।বলেই আবার কেঁদে উঠে।
দায়ান এতোসময় চুপ করে থাকলেও,এখন সোহার কান্না আর তার সহ্য হচ্ছে না। এমন করে কাদলেতো মেয়েটার শ্বাস আবার বেরে যাবে।তাই নিজেকে আর আটকাতে পারে নি।সোহার পাশে এসে ঘাড়ে হাত রাখে।সোহা ঘাড় ঘুরিয়ে দায়ানের দিকে তাকায়। দায়ান চোখের পানি সযত্নে মুছে দিয়ে বলে,,আর কাদেনা। তোমার আপু সুস্থ হয়ে যাবে।আর তোমার আপুর অপরাধীদের কঠিন শাস্তির ব্যবস্থা আমি করবো। জে’ল থেকেই যেনো মুক্তি না পায় সেটা আমি দেখবো। তুমি শান্ত হও।তোমার জন্য তোমার আপুও কাঁদে। তাহলে তুমিও অসুস্থ হয়ে পরবা তোমার আপুও।এটা কি তুমি চাও?
সোহা মাথা নাড়িয়ে না বোঝায়।সে চায়না তার আপু আর কোনো কষ্ট পাক।
দায়ান এবার নোহার দিকে তাকায়,, এখন কেমন আছেন? কোনো অসুবিধা হচ্ছে না তো?
নোহা মাথা নাড়িয়ে জানায় সে ঠিক আছে। তারপর দায়ানের দিকে তাকিয়ে রয়। সে এখনো পর্যন্ত দায়ানকে সামনা-সামনি বা ছবিতেও দেখেনি।মনে মনে ভাবছে, এইটাই হয়তো বোনের বর।
সোহা বোনের দিকে তাকিয়ে হয়তো বুঝতে পারছে।তাই নিজেই বলে,,,আপু উনি হচ্ছে,,,, পরের টুকু বলতে যাবে তার আগেই নোহা বলে,,,তর বলতে হবে না বোন। আমি বুঝতে পারছি উনি আমার পা’গল বোনের হাসবেন্ড। আর তাছাড়া পরিচয় দিতে গিয়ে যেভাবে ব্লা’সিং হচ্ছিলি যে কেউই বুঝতে পারবে।বলেই মুচকি হাসে নোহা। তারপর দায়ানকে বলে কেমন আছেন আপনি ভাই?
দায়ান বলে,,আমরা সকলে ভালো আছি।এবার আপনি তারাতাড়ি ভালো হয়ে যানতো।তাহলে আরো ভালো হয়ে যাবো।
আমাকে আপনি বলতে হবে না।সম্পর্কে বড় হলেও,বয়সে ছোটোই হবো।তাই তুমি ই বইলেন।আপনি টা যেনো শুনতে কেমন লাগে।তাছাড়া আপনিতো আমার ভাইয়ের মতোই।
আচ্ছা ঠিক আছে।
আরেকবার দায়ান আর বোনের দিকে তাকায় নোহা। তার বোনের জন্য দায়ানের চোখে অপার ভালোবাসা দেখতে পাচ্ছে নোহা।বোন তার খাঁটি হিরা পেয়েছে।তার বোন ভালো আছে।যে তার বোনের চোখের পানি দেখে এতো উৎক’ন্ঠা হয়ে পরেছে,সে যে তাকে সারা জীবন বুকে আগলে রাখবে নোহা বুঝে গেছে।
নোহা উপরের দিকে চোখ রেখে বলে,,,
বাবা তুমি এতোদিন বলতেনা এ সম্পর্ক থেকে বেরিয়ে আসতে? আমি শুনিনি এড়িয়ে গেছি।আজ আমি তোমাকে বলছি,,আমি এই সম্পর্ক থেকে মুক্তি চাই।অনেক হয়েছে। আমি আরো আগেই ভেবে রেখেছিলাম।কিন্তু বাচ্চাটা আসায় চুপ ছিলাম।একটা সুযোগ দিতে চেয়েছিলাম ওদের।যেটার জন্য সুযোগ দিয়ে ছিলাম সেইটাই যখন নেই তাহলে,এই সম্পর্কের কোনো মানেই হয় না। ওদের মতো মানুষের সঙ্গে আর থাকতে পারবোনা।
অনেক কষ্ট সহ্য করেছি।ব’ন্দি জীবন থেকে এবার মুক্তি চাই। খোলা আকাশে পাখির মতো উড়তে চাই।পায়ে কোনো শি’কল চাই না।এবার নিজের জন্য বাঁচবো। মাথা উঁচু করে বাঁচবো।
যাদের কাছে আমার কোনো মূল্য নাই।তাদের কাছে আর না।
ডি’ভো’র্সের ব্যাবস্থা করো বাবা যতো দ্রুত সম্ভব। কথাটা বলার সময় নোহার গলায় কি যেনো একটা জোর ছিলো।সবাই অবাক হয়ে নোহার দিকে তাকিয়ে আছে। এটা বলতে যেমন নোহার একটুও কষ্ট হয় নি।সে একদম স্বভাবিক। ওদের জন্য ভিতরে মায়ার ছিটে ফোটাও নেই।
আসলেই নেই।ওদের প্রতি নোহার মায়া আগেই কেটে গেছে। এতোটাও দূর্বল নোহা নয় যে এতো কিছুর পরও ওদের ক্ষমা করে দিবে।ওদের কাছে আবার ফিরে যাবে।বা সবকিছু শে’ষ হয়ে গেছে বলে,,কেঁদে কেটে বুক ভাসাবে। এতোদিন পারেনি বোনটার জন্য। বোনটা মানুষের কথার আঘা’ত সহ্য করতে পারতো না।তারপর বাচ্চাটার কথা ভেবে সব ঠিক করতে চেয়েছিলো।এখন যখন বোন সুখে আছে।বাচ্চাটা ও আর নেই।তাহলে আর প্রশ্নই ওঠেনা।ফিরে যাওয়ার বা ওদের ক্ষমা করার। এখন নোহার কোনো পিছুটান নেই।
নোহার বাবা বলে,,,আমাকে তুই মা’ফ করেদিস মা।সব কিছু আমার জন্য হয়েছে।সব দোষ আমার।আমিই তোকে তর ইচ্ছার বিরুদ্ধে বিয়ে দিয়েছিলাম।তর মতামতের কোনো দা’ম দেইনি।
এসব বলো না বাবা তোমার কোনো দোষ নেই এতে।তুমিতো আমার ভালোই চেয়েছ।আর মানুষের মনের ভিতর তো আর যাওয়া যায় না।এটা আমার ভাগ্য ছিলো।তুমি নিজেকে দোষী ভেবো না।যতদ্রুত সম্ভব ডি’ভো’র্স এর ব্যবস্থা করো।এই বিয়ে থেকে মুক্তি পেলে আমি প্রান ভরে শ্বাস নিতে পারবো।
ঠিক আছে মা।তুই যা চাস তাই হবে।কিন্তু এতো তারাতাড়ি তো সম্ভব না।অনেক ঝামেলার বিষয় টাইম লাগবে তো।
দায়ান বলে,,আংকেল আপনি চিন্তা করবেন না।আমি এই বিষয় টা দেখছি।খুব তারাতাড়ি ই হয়ে যাবে।
সবকিছুর মাঝে রুশ নিরব দর্শকের ভূমিকা পালন করেছে।কিইবা বলবে ও। তাই চুপচাপ দরজার পাশেই দাঁড়িয়ে ছিলো ।
এতো কথার মাঝে সোহা রুশের কথা ভুলেই গিয়েছিল। আহারে তার ভাইটা দরজার পাশে কিভাবে দাঁড়িয়ে আছে।
— রুশ ভাইয়া এদিকে এসো।
রুশ সোহার কথায় চমকে উঠে। এতো ঝামেলার মাঝে সোহার বাবা মা ও রুশ কে জানতে ভুলে গেছে। এখন সবার দৃষ্টিই রুশের দিকে।
— না বোন।আমি ওখানে গিয়ে কি করবো? তরা কথা বল।আমি এখানেই ঠিক আছি।
সোহা এবার উঠে গিয়ে রুশের হাত ধরে ভিতরে নিয়ে আসতে আসতে বলে,,আরে আসো তো।আমার একটামাত্র ভাই তুমি সকলের সাথে পরিচিত হবা না?
সবাইকে উদ্দেশ্য করে বলে,,সবাই শোন এইটা আমার একমাত্র ভাই।আমার ভাইয়ের সাথে সবাই পরিচিত হও।সবাই সোহার দিকে এখনো তাকিয়ে আছে।
সোহা এবার হেসে বলে চিনতে পারলে না তো? আরো ভালো ভাবে বুঝিয়ে দিচ্ছি আমি।উনার নাম রুশ। তোমাদের জামাইয়ের একমাত্র বন্ধু। আর আমার একমাত্র ভাই।এবার সবাই বুঝতে পারলো। সোহার বাবা মা রুশের সাথে পরিচিত হয়। রুশ সবার ব্যবহারে অনেক খুশি হয়।এরা সবাই কতো সহজে আপন করে নেয়।
এর মধ্যে নোহা রুশের দিকে একবার তাকায় রুশ ও ঐ সময় নোহার দিকে তাকায়। দুজনেরই চোখাচোখি হয়ে যায়। তারপর নোহা চোখ ঘুরিয়ে নেয়।হাই তুলতে থাকে তার প্রচুর ঘুম পেয়েছে।ডাক্তার ঘুমের ঔষধ ও দিয়েছে। চোখ বুঁজে ঘুমিয়েও যায় নোহা।
সবাই নোহার দিকে তাকিয়ে দেখে ঘুমিয়ে গেছে।তাই ক্যাবিনে কথা না বাড়িয়ে সবাই বেরিয়ে আসে।এখন নোহার প্রচুর ঘুমের দরকার।
———————————————
রাতে নোহার সাথে কে থাকবে তা নিয়ে ছোটো খাটো একটা কান্ড ঘটেগেছে।
সোহা বলছে সোহা থাকবে।সোহা থাকলে দায়ান ও থাকবে।দায়ান সোহাকে একা ছাড়বে না।
সোহার বাবা মা বলতেছে ওনারা থাকবে।সোহাকে থাকতে হবে না।জামাই সেই সকালে আসছে।ওদের বাড়ি গিয়ে রেস্ট নেওয়া উচিত। তাছাড়া রুশ তো আছেই।ছেলেটা ওদের রেখে একা বাড়িতে গেলেও আনইজি ফিল করবে।
সব কিছু ভাবনা চিন্তা করে ঠিক করেছে,সোহার বাবা মাই নোহার সাথে থাকবে।ওরা বাড়ি চলে যাবে।অবশ্য রাতে ওরা ক্যানটিন থেকেই খাবার খেয়ে নিয়েছে। তাই খাওয়া দাওয়া নিয়ে চিন্তা নেই।এজন্য সোহার মা আর যায়নি।কাল সকালে ওরা যাবে তখন যেনো সোহা এসে থাকে।
সোহা সবকিছু ভেবে নিজেও রাজি হয়ে যায়।
তারপর তিনজন সোহার বাড়ির উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পরে।
———————————————-
বাড়িতে এসে সোহা রুশকে নোহার রুমটাতেই থাকতে দেয়।বাবা মার রুমেতো আর থাকতে দেওয়া যায় না।
রুশ ও ফ্রেশ হয়ে রুমে ঢুকে যায় । রুমে ঢুকে চার পাশটা ভালো করে ঘুরে ঘুরে দেখছে।রুমের ভিতর যদিও তেমন কোনো আসবাবপত্র নেই।তাও সুন্দর পরিপাটি করে সাজানো। চার দেয়ালে নানা রকম জিনিসপত্র টাঙানো।দেখেই বোঝা যায় সব হাতে বানানো।
রুমটা রুশের খুবই পছন্দ হয়েছে। পাশে একটা বুক সেলফ আছে।তাতে কয়েক প্রকার বই রাখা।রুশ বই গুলোতে গিয়ে হাত ছুইয়ে দেয়।
তারপর রুমটাতে আরেকটু চোখ বুলিয়ে খাটে গিয়ে শুয়ে পরে।প্রচুর ঘুম পেয়েছে।
———————————————-
সোহা পানি নিয়ে নিজের রুমে প্রবেশ করে। রুমের লাইট নিভানো কেনো? আপনিকি ঘুমিয়ে পরেছেন?
কোনো সারা শব্দ না পেয়ে সোহা একটু ভ’য় পেয়ে যায়। আবার দায়ানকে ডাক দেয় কই আপনি? দেখেন সারা দেন বলছি।আমার কিন্ত ভ’য় করছে।
তখনই পিছন থেকে একটা হাত কোমড় আঁকড়ে ধরে। আরেক হাত দিয়ে সোহার ঘার থেকে চুল গুলো সরিয়ে মুখ ডুবায়।ছোটো ছোটো চুমু খেতে থাকে সোহার ঘাড়ে দায়ান।
সোহা চোখ বন্ধ হয় কাঁপা কাঁপা গলায় বলে,, কি শুরু করেছেন? ঘুমাবেন না। চলুন অনেক ঘুম পেয়েছে আমার।
এখনতো ঘুমাতে পারবানা জা’ন। তোমার শাস্তি আছেতো।
শা- শাস্তি কিসের শাস্তি?
ভুলে গেলে? কোনো ব্যাপার না।আমি মনে করিয়ে দিচ্ছি। এক সকালে আমার কথা শুনোনি।মরে যাওয়ার কথা বলেছো।আর দুই আমাকে কিছু না বলে হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে একা একা ঐ বা/জে লোকদের বাড়িতে গিয়েছো।
আমার ভুল হয়ে গেছে। আর হবে না।এবারের মতো ছেড়ে দেন।বলেই ঠোঁট উল্টায় সোহা।
দায়ান সোহাকে কিছু না বলতে দিয়ে কোলে তুলে নেয়।
বিছানায় নিয়ে শুইয়ে দেয়।
আর করবোনা বলছিতো।শাস্তি দিয়েন না প্লিজ।
হুসসসস শাস্তি তো তুমি পাবা।তবে ভালোবাসাময় শাস্তি। আর একটা কথাও না।
#চলবে,,,,,,,#তুমি_হাতটা_শুধু_ধরো
#পর্বঃ৩৯
#Jhorna_Islam
আজ সকালটা অন্য রকম। কোলাহলহীন শুনশান নীরবতায় ঘেরা।নাকে এসে বারি খাচ্ছে ধানের মিষ্টি সুবাস।শরীর ছুঁয়ে দিয়ে যাচ্ছে সকালের স্নিগ্ধ বাতাস।
রুশ সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে বাইরে বেরিয়ে আসে। গ্রামে তার এই প্রথম আসা।এর আগে কখনো আসা হয়নি।তাই যখন সুযোগ পেয়েছে গ্রাম টা ঘুরে দেখার হাত ছাড়া করেনি।বেরিয়ে পরেছে আশেপাশে ঘুরে দেখার জন্য। গ্রামীন জীবনের আলাদা একটা ছন্দ আছে।রুশের খুব ভালো লাগছে গ্রাম টা দেখতে।এতোটাও সেকেলে নয়।গ্রামে ও এখন শহরের ছোঁয়া লেগেছে। সব কিছু উন্নতি হচ্ছে।
এসবই ঘুরে ঘুরে দেখছে রুশ।
সোহা ও সকাল সকালই উঠে পরেছে ঘুম থেকে।রান্না ঘরে গিয়ে রুশ ও দায়ানের জন্য কফি বানিয়ে বের হতেই দেখতে পায় রুশ বাড়িতে ঢুকছে।সোহা অবাক হয়ে বলে,,,
— রুশ ভাইয়া তুমি বাইরে গেলে কখন? আর এতো সকালে তোমার ঘুম ভেঙে গেলো?
— আজ অনেক সকালে ঘুম ভেঙে গেছে বোন।আর গ্রামে আমার এই প্রথম আসা।ভাবলাম ঘুরে দেখি। আবার ভাগ্য হয় কিনা দেখার কে জানে?
— সে বেশ করেছো ঘুরে দেখেছো।ভাগ্য হবে না কেনো দেখার? আমরা যতোবার আসবো তোমাকে সাথে করে নিয়ে আসবো।
— সে দেখা যাবে।
— আমি তোমার কাছেই যাচ্ছিলাম কফি নিয়ে।
— ওহ দে আমার কাছে আমি ফ্রেশ হয়ে খেয়ে নিবো।
— আচ্ছা নাও।বলেই কফিটা রুশের হাতে দেয়।
— দায়ান উঠে নি।
–নাহ এখন গিয়ে ডেকে তুলবো।
–আচ্ছা। আমি রুমে যাই।বায় দা ওয়ে তোদের গ্রামটা অনেক সুন্দর। আমার ভালো লেগেছে।
বিনিময়ে সোহা মুচকি হেসে রুমে ঢুকে যায়।
দায়ান এখনো মনের সুখে ঘুমে বিভোর। সোহা আস্তে করে কফির কাপটা রেখে দায়ানের পাশে গিয়ে বসে। মাথায় দুষ্টু বুদ্ধি আসে,ওড়নার কোন পেচিয়ে দায়ানের কানে শু’ড়’শু’ড়ি দেয়।দায়ান নরেচরে কানে হাত দেয় কয়েকবার। সোহা বেশ মজা পায়।আবার দিতে যায়।তার আগেই দায়ান সোহার হাতটা খপ করে ধরে ফেলে।একটানে বিছানায় সোহাকে শুইয়ে দেয়। তারপর সোহার উপরে উঠে সোহার ঘাড়ে মুখ ডুবিয়ে শুয়ে থাকে।
সোহা কাঁপা কাঁপা গলায় বলে উঠে,,, কি শুরু করেছেন সকাল সকাল? আপনি কিন্তু দিন দিন লু’চু হয়ে যাচ্ছেন।
ছাড়ুন আমায়।রান্না করতে হবে।খাবেন না? রুশ ভাইয়া ও কিন্তু বাড়িতে।
তো? এখনতো আমি অন্য কিছুর মুডে আছি।
এই সরেন বলছি। কফি এনেছি খেয়ে নিন ঠান্ডা হয়ে যাবে।
আর হাসপাতালে যাবো তো উঠে তৈরি হয়ে নিন।তারাতাড়ি যেতে হবে।
যাচ্ছি বলেই দায়ান সোহার ঘাড়ে কা’মড় বসিয়ে দেয়।
ও আল্লাহ রা/ক্ষস একটা।
———————————————
সকালের খাওয়া দাওয়া শেষ করে সকলে হাসপাতালে যাবার জন্য বেরিয়ে পরে। হাসপাতালের সামনে গাড়ি আসতেই দায়ান আর সোহা নেমে পরে।
রুশ গাড়ি নিয়ে ঢাকা ফিরে যাবে এখন। অফিসটা কয়দিন রুশই সামলাবে।
দায়ান কিছুদিন এখানেই থাকবে সোহার সাথে।রুশকে বলে দিয়েছে ঐদিকটা সামলে নিতে।
রুশ বিদায় নিয়ে চলে গেলে দায়ান আর সোহা হাসপাতালে চলে যায়। তারপর সোহা তার বাবা মাকে হাসপাতাল থেকে বাড়িতে পাঠিয়ে দেয়।ওনাদের খেয়ে দেয়ে,বিশ্রাম প্রয়োজন। কাল থেকে অনেক ধ’কল গিয়েছে উপর দিয়ে।নয়তো অসুস্থ হয়ে পরবে।
ওনারা ও সোহা আর দায়ানকে সব বুঝিয়ে দিয়ে বাড়ির উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পরে।
দায়ান সোহা কে বলে ডাক্তারের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে যায় নোহার ব্যাপারে কথা বলার জন্য । আর সোহা খাবার নিয়ে ক্যাবিনে ঢুকে যায়। খাইয়ে ঔষধ খাওয়াতে হবে।
— গুড মনিং আপু।ভালো আছিস?
— গুড মনিং সোহা সো’না। ভালো আছি।
— এই দেখ আমি নিজ হাতে রান্না করে তর জন্য নিয়ে এসেছি।খেয়ে ঔষধ খেয়ে নিবি তাহলে আরো ভালো হয়ে যাবি।
তারপর বোন কে খাবার খাইয়ে ঔষধ খাইয়ে দেয় সোহা।এর মধ্যে হ’ন্ত দ’ন্ত হয়ে ক্যাবিনে প্রবেশ করে নোহার শ্বশুর।
এসব আমি কি শুনছি নোহা? তুমি তোমার শ্বাশুড়ি আর ওমিকে জেলে দিয়েছো? তাদের নামে খু/নের আর নারী নির্যা’ত’নের কেস দিয়েছো? পা’গল হয়ে গেছো তুমি?
আমি বাড়িতে ছিলাম না আমায় জানাতে পারতে।তাই বলে তুমি এসব করবে? ওদের ছাড়াতে গিয়েছিলাম।পুলিশ তো আমার কোনো কথাই শুনছে না।কে’স নাকি কোর্টে উঠবে।নিজের পরিবারের লোকের সাথে কেউ এসব করে?
ওরা না হয় একটা ভুল করেই ফেলেছে তাই বলে তুমি?
সোহার শরীর রাগে জ্বলে উঠে। কিছু বলতে নিবে তার আগেই নোহা হাত দিয়ে ইশারা করে সোহা কে থামিয়ে দেয়।
“বাহ্ বাবা বাহ্ নিজের স্বার্থ ছাড়া আপনি কিছুই বুঝলেন না।আমার এই অবস্থা আর আপনি এসে আমাকে ঝাড়ছেন? একবার আমার কি অবস্থা জিজ্ঞেস করার প্রয়োজন ও মনে করেন নি। আর ভুল একটা মেয়েকে নি’র্যা’তন করে তার পেটেই তার অনা’গত সন্তান কে মে’রে ফেলা ভুল? দিনের পর দিন একটা মেয়ের উপর মা’নসিক,শা’রী’রিক নি’র্যা’তন করা ভুল?এগুলা যদি ভুল হয়ে থাকে তাহলে ভুলের শাস্তি ও পেতে হবে।
দায়ান ও তখন ক্যাবিনে এসে ঢুকে।
আপনারা অনেক ব্যবহার করেছেন আমায় আর না। আপনি ব্যবহার করেছেন রা’জ’নৈতিক কারনে। আপনার বউ ব্যবহার করেছে কাজের মেয়ে হিসাবে।আর আপনার ছেলে ব্যবহার করেছে নিজের চা’হিদা মিটাতে।বলেই নোহা চোখ বন্ধ করে ফেলে।এই কথা গুলো বলতেও নিজের রু’চি তে বাঁধছে। কিন্ত এই লোক গুলো বারবার বাধ্য করে।
বাহ্ কথা ফুটেছে মুখে দেখতে পাচ্ছি।
কথা মুখে আগেই ছিলো।এতোদিন সম্মানের খা’তিরে কিছু বলিনি। এখন আমার আফসোস হচ্ছে যাদের আমি সম্মান দিতে গিয়েছি ষোল আনার,,তারা এক আনা সম্মানের যোগ্য ও না।
নোহা তুমি ভাবতে পারছো না এর ফল কি হবে।এতো বাড়াবাড়ি করে লাভ আছে? সেইতো আমাদের দুয়ারেই তোমাকে ফিরতে হবে।
কে বলেছে আপনাদের দুয়ারে ফিরবো? আপনার ছেলেকে আমি ডি’ভো’র্স দিবো।অমন কা/পুরুষ স্বামী থাকার চেয়ে না থাকা ঢের ভালো। আর কে’স তো কোর্টে উঠবেই আপনার ছেলেকে ভেবেছেন দয়া দেখিয়ে ছেড়ে দিবো?
অতি বাড় বেড়োনা।এর ফল কিন্তু ভালো হবে না।ওদের তো আমি ছাড়িয়ে আনবো। আমার পাওয়ার সম্পর্কে তোমার কোনো ধারনা নেই।এর ফল ভোগ করতে হবে।
এবার দায়ানেট মাথায় রা’গ চড়ে যায়।তাই নাকি? আপনার ছেলে কি করে ছাড়ান আমিও দেখে নিবো।ভেবেছিলাম সবটা নোহার উপর ছেড়ে দেব ও যা করতে চায় তাই হবে।বাট,,,এখন আমিও দেখে নেবো আপনার মতো একটা মে’ম্বা’র কি করে আপনার ছেলেকে ছাড়ান।কঠিন শাস্তির ব্যবস্থা করাবো।ঐরকম জা/নো’য়ারদের বাইরের পরিবেশে মানায় না।ওরা চৌদ্দ শি’কের ভিতরেই ঠিক আছে। পারলে নিজের ছেলেকে ছাড়িয়ে দেখাবেন।
এবার ওমির বাবা একটু দ’মে যায়।ভেবেছিলো হু’মকি ধা’মকি দিলে ভয়ে ওদের ছাড়িয়ে আনবে।কিন্তু এরা দেখি এবার দ’মার পাত্র নন।তাই কিছু না বলে,, রাগে হনহন করে বেরিয়ে যান।
নোহা শ্বশুরের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে একটা দীর্ঘ শ্বাস ফেলে।সোহা একপাশ দিয়ে সাবধানে বোনকে জড়িয়ে ধরে রাখে।
দায়ান নোহার দিকে তাকায়,,, তুমি কোনো চিন্তা করো না নোহা।এরা কিছুই করতে পারবে না।আমি এদের যতাযথ শাস্তির ব্যবস্থা করবো।আর আমি উকিলের সাথে কথা বলেছি।ডি’ভো’র্স টা খুব শিঘ্রই হচ্ছে। তুমি নিশ্চিত থাকো।ওমি তার পা’পে’র যথাযথ শাস্তি পাবে।
—————————————————-
দেখতে দেখতে আরো পাঁচ ছয়দিন কেটে যায়। নোহাকে তিনদিন পরই বাড়িতে আনা হয়েছে।
এখন অনেকটাই সুস্থ নোহা।হাটা চলা সব কিছুই করতে পারে।শরীরে মারের দা’গ গুলো আস্তে আস্তে মিশে যাচ্ছে।
তবে পেটে সেলাই করা জায়গাটা শুকাতে একটু টাইম লাগবে।
আজ সকলে এক সাথে দুপুরে খেতে বসেছে। সোহা নোহা,ওদের বাবা আর দায়ান।সোহার মা বেড়ে দিচ্ছে। সবাই অনেকবার বলেছিলো বসে পরার জন্য উনি এখন খাবেন না।পরে খাবেন বলে জানিয়েছে। তাই কেউ আর জোর করেনি।
সোহার মা দায়ানকে নিয়ে ব্যস্ত।এটা ওটা এগিয়ে দিচ্ছে। নিজে প্লেটে তুলে দিচ্ছে। দায়ান না করার পর ও। দায়ান সোহার দিকে তাকায় অসহায়ের মতো।সোহা মিটমিট করে হেসে বলে আরে খেয়ে নিন।
জামাই আদর।শ্বাশুড়ির এমন আদর আর কই পাবেন?
সোহার হাসি দেখে দায়ান চোখ গরম করে তাকায়।
সোহার মায়ের দিকে তাকিয়ে বলে,, আন্টি প্লিজ আর দিয়েন না।
সোহার মা দায়ানের দিকে তাকিয়ে বলে,, আমরা কি তোমার এতোই পর বাবা? যে আন্টি ডাকছো।মা কি ডাকা যায় না?
আমিতো তোমার মায়ের মতোই।দায়ান ছলছল চোখে তাকায় সোহার মায়ের দিকে।
হ্যা রমিলা ছোটো আব্বা মনে হয় আমাদের আপন ভাবতে পারেনি।তাইতো আংকেল আন্টি বলে।
সোহা দায়ানের মনের অবস্থাটা বুঝতে পারে।দায়ানের বাম হাতটা নিজের হাতের মঠোয় নেওয়ার চেষ্টা করে। দায়ান আবার সোহার দিকে তাকায়। সোহা দায়ানকে চোখের ইশারায় ভরসা দেয়।
দায়ান নিজেকে স্বাভাবিক করে বলে,,, আজ থেকে আমি তোমাদের বাবা-মা বলেই ডাকবো।তোমাদের ও আমাকে নিজের ছেলের মতো ভাবতে হবে।
সোহার মা দায়ানকে এক পাশ থেকে জড়িয়ে ধরে মাতায় হাত বুলিয়ে দেয়। কখনো নিজেকে একা ভেবো না।
এই যে আমরা আছি।এখন থেকে আমাদের উপর তোমার সোহার থেকেও বেশি অধিকার।
তুমিতো কিছুই খাওনি বাবা।আসো আমি তোমায় খাইয়ে দেই।বলেই প্লেট টা হাতে নিয়ে নেয়।খুব স্নেহের সাথে খাইয়ে দিতে থাকে।
সোহা ঠোঁট উল্টে বলে,,হ্যা এখনতো উনিই তোমার সব।আমি আর আপুতো তোমার কেউ না।তাই আমাদের খাইয়ে দেয়না,কেউ।নোহা সোহার দিকে তাকিয়ে মাথায় টোকা দিয়ে বলে,,নে’কি কা’হিকা।
সোহার বাবা বলে,,কে বলেছে আমার আম্মাদের কেউ ভালোবাসে না।আমি আছি না? আমি আমার দুই আম্মা কে খাইয়ে দিবো।এসো এসো আমার পাশে এসে বসো।
নোহা আর সোহা দু’জন বাবার দুপাশে বসে পরে। দুইবোন বাবার হাতে আর দায়ান সোহার মার হাতে খাচ্ছে।
দায়ান মনে মনে বলে,,, কে বলেছে আমার কেউ নেই,,এই যে বাবা মা পেলাম।হাসি খুশি একটা পরিবার পেলাম।এতো ভালোবাসা পেলাম।নিজেকে কেমন সুখী লাগছে,,এই পরিবারের একটা সদস্য হয়ে উঠতে পেরে।কতো হাসি খুশি, আনন্দ। এই আনন্দ কখনো যেনো ফুরিয়ে না যায়।সবাই যেনো এমন হাসি খুশি হয়ে থাকে।দায়ান নিজের সবটুকু দিয়ে আগলে রাখবে এই পরিবারটাকে।
————————————————–
খাওয়া দাওয়া শেষ করে দুপুরে সবাই বিশ্রাম নিচ্ছে যে যার রুমে। দায়ান আর সোহা ও শুয়ে ছিলো। এমন সময় দায়ানের ফোনটা বেজে উঠে। সোহা টেবিল থেকে ফোনটা নিয়ে দায়ানের কাছে দেয়।
তারপর দায়ান কল টা রিসিভ করে কথা বলতে থাকে।সোহা এই ফাঁকে রুম থেকে বের হয়ে বাড়ির পিছনের পুকুর পাড়ের দিকে চলে আসে ।
হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ করে সামনে কাউকে এসে দাঁড়াতে দেখে সোহা থেমে যায়। সামনের ব্যক্তিটার দিকে কপাল কুঁচকে তাকায়।
#চলবে,,,,,,