#তুমি_নামক_ব্যাধি
#মুন্নী_আরা_সাফিয়া
#পর্ব_০২
ঘুমের মধ্যে স্বপ্ন দেখছি।আমি রুমে শুয়ে আছি।জানালা দিয়ে অনেক চেঁচামেচি আসছে।সবাই বলতেছে,ওমা! তিহাম দেখো কত বড় হয়ে গেছে। তাকে তো এখন আর চেনাই যাচ্ছে না।একদম রাজপুত্রের মতো দেখতে হয়েছে।
কে যেন বলছে,দেখতে হবে না, নাতজামাইটা কার? সুন্দর তো হবেই।এ কথা বলার সাথে সাথে অনেক গুলো কন্ঠ হেসে উঠল।একটা কন্ঠ গানে পিয়ানোর মতো বাজছে।আহ্! কি সুন্দর হাসির শব্দ।কানে যেন মৃদু ঝংকার তুলে যায়।
স্বপ্নের মধ্যে হেসে উঠলাম আমি।কে যেন ধাক্কাচ্ছে।চোখ খোলার কোন ইচ্ছে নেই। পিয়ানোর সুমধুর সুরটা আরো শুনতে মন চাইছে। কিন্তু ধাক্কার বেগ ক্রমেই বেড়ে চলেছে। আর থাকতে না পেরে বিরক্ত হয়ে চোখ খুলে দেখি ভাবী সামনে। সে হাঁপাচ্ছে প্রায়।
কপাল কুঁচকে বললো,
–‘বাব্বাহ তোমার ঘুম।সেই কখন থেকে তোমায় ডেকে চলছি।মরা কাঠের মতো পড়ে আছো।তিথিও কতবার ডেকেছে। উঠো এখন।ওরা সবাই এসে গেছে। ‘
ঢুলুঢুলু চোখে জিজ্ঞেস করলাম,
–‘ ওরা বলতে কারা এসে গেছে ভাবী?’
–‘ হা হা।সব ভুলে গেছো।আরে তিহাম আর ওর ফ্যামিলি এসেছে। ‘
মুহূর্তের মধ্যেই স্প্রিংয়ের মতো নড়ে উঠলাম।থ্যালামাছ কাজ করা শুরু করে দিয়েছে।এখন জেগে উঠার পরও সেই পিয়ানোর শব্দ শুনতে পারছি।থুক্কু,ইট ভাঙানো মেশিনের সেই বিদঘুটে শব্দ কানে আসছে। ভাবী দিকে বড় বড় করে তাকিয়ে বললাম,
–‘ওনারা এত তাড়াতাড়ি এসে গেছে?’
–‘ এত তাড়াতাড়ি? বেলা দশটার বেশি বাজে বোন আমার।উঠো এখন।ফ্রেশ হও তাড়াতাড়ি। আমি যাই এখন। ‘
ভাবী চলে যেতে নিতেই পেছন থেকে ডাক দিলাম।ভাবী দরজার কাছে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করলো,
–‘কি হলো আবার?’
–ভাবী, ওনাদেরকে প্লিজ আমার কথা বলো না।আমি যে এ বাড়িতে আছি এটা বলো না।কেমন?’
–‘ টেনশন নিয়ো না।ওরা অলরেডি জেনে গেছে।
আর তিহামই তো আমাকে পাঠালো তোমায় ডেকে নিয়ে যাওয়ার জন্য। আসো তাড়াতাড়ি।’
ভাবী চলে যেতেই বুকের মধ্যে ধ্বক করে উঠল।মনে হলো হার্ট,ব্রেন,ফুসফুস, কিডনির একসাথে অ্যাটাক-ফ্যাটাক হয়ে যাবে।
ওয়াশরুমে অনেকক্ষণ চিন্তা ভাবনা করে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হলাম যে,ওটা একটা দুঃস্বপ্ন ছিল।আর সেটা আমি মাথা থেকে ভ্যানিশ করে দিয়েছি।তারপর চোখে মুখে হাসির ঝিলিক ফুটিয়ে একটা ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে ওয়াশরুম থেকে বের হলাম।
রুমে ঢুকতেই তিথি আমাকে হুরহুর করে টানতে টানতে পাশের রুমে নিয়ে গেল।আমি ওকে অন্য হাত দিয়ে বাধা দিতে দিতে বললাম,
–‘আরে হাত মুখ তো মু….’
বললেই আমার চোখ সোজা যে মানুষটি বসে আছে তার দিকে নজর আটকে গেল। হ্যাঁ,তিহাম ভাইয়া।দেখে চেনার উপায় নেই। শুধু তার চোখটা আগের মতোই আছে।
সেও আমার দিকে পলকহীন দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। হয়তো অনেকদিন পর দেখছে তাই।নাকি রাতের ঘট…..। মনে পড়তেই চোখ অন্যদিকে সরিয়ে মুখে হাসি ফুটিয়ে আঙ্কেল আন্টিকে সালাম দিলাম।তিহাম ভাইয়ার ছোট ভাই নাকি আছে।সে পরীক্ষার জন্য নাকি আসেনি!
তারপর তিহাম ভাইয়ার দিকে একটু এগিয়ে নিচের দিকে তাকিয়ে নিচুস্বরে একদমে বললাম,
–‘আসসালামু আলাইকুম ভাইয়া।লং টাইম নো সি।কেমন আছেন??’
তিহাম ভাইয়া রহস্যময় হেসে বললেন,
–‘ওয়ালাইকুম সালাম।হুম,সত্যি! লং টাইম নো সি।আলহামদুলিল্লাহ্।তুমি কেমন আছো?’
–‘আলহামদুলিল্লাহ। আমিও ভালো। ‘
–‘তুমি তো বেশ বড় হয়ে গেছো।আমি চিনতেই পারছি না।তুমি কি বিয়ে টিয়ে করেছ নাকি?’
আমি হাত মুঠ করে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলাম।তিথি হেসে বলল,
–‘আজব!তুমি কিসব বলছো ভাইয়া!ও তো পড়াশোনা করছে।একদম টপ রেজাল্ট বরাবর।ও তো..…’
তিথির হাতে চিমটি দিতেই ও থেমে গেল।শায়লা ভাবী কিচেন থেকে জোরে ডাক দিতেই তিথি দৌঁড়ে গেল।
আমি এখনো দাঁড়িয়ে আছি।চলে যাবো কি না বুঝতে পারছি না।যদি বেয়াদব ভাবে?আঙ্কেল আন্টিরা একটু দূরে সবাই গল্প করছে।
তিহাম ভাইয়ার দিকে এক নজর তাকিয়ে বললাম,
–‘আমি যাই!’
পেছন ঘুরতেই তিহাম ভাইয়া বলল,
–‘এত যাই যাই করছো কেন?এত গুলো বছর পর দেখা।একটু সুখ দুঃখের আলাপ করি।’
–‘আলাপচারিতায় আমি খুবই অপরিপক্ক।আমি বরং তিথিকে পাঠিয়ে দিচ্ছি।’
–‘তুমি তো বড় হয়ে ভারী মুডী হয়েছো।ছোটবেলায় তো আমি কত নাক দিয়ে সিকনি পড়তে দেখেছি!বয়ফ্রেন্ড আছে?’
–‘ছি!এসব কোন ধরনের কথাবার্তা? ‘
–‘আচ্ছা যাও,বলতে হবে না।এখন এটা বলো যে তোমার মুখ থেকে তো ফোঁটা ফোঁটা পানি পড়ছে কেন?এইমাত্র ফ্রেশ হয়ে আসলে নাকি?’
হুট করে কেন জানি মেজাজ খারাপ হয়ে যাচ্ছে।একপ্রকার বিরক্তি উঠে যাচ্ছে বলা চলে।তবুও শান্ত গলায় বললাম,
–‘বুঝতেই তো পারছেন।আলাদা করে প্রশ্ন করার কি আছে?ঘুম থেকে উঠলাম মাত্র। ‘
–‘এত দেরিতে!! সারারাত কি করেছ?’
অনেকটা ব্যঙ্গ সুরে বলল এবং এই প্রথম আমার ডোন্ট কেয়ার ভাবে ফাটল ধরলো এবং বুঝতে পারলাম যে রাতের ওসব স্বপ্ন ছিল না।ঘোর কাটতেই সবাইকে উদ্দেশ্য করে বললাম,
–‘আচ্ছা, থাকেন আপনারা। আমি হাত মুখ মুছে আসি।’
বলেই আর এক মুহূর্ত দেরি করলাম না।ঝড়ের বেগের চেয়েও বেশি বেগে ও স্থান ত্যাগ করলাম।রুমে এসেই হাত দিয়ে নিজেকে হাওয়া করতে করতে আনমনে ভাবতে লাগলাম।
মি. তাজবীর আজমাইন তিহাম!ড্যাম কিউট। হুম দুলাভাইটা একটু বেশিই সুন্দর।কিন্তু কেন জানি মনে হচ্ছে ব্যাটা ফাজিলও!আহারে!তিথি বেচারার জন্য বড্ড মায়া হচ্ছে!
সকাল সকাল মনটা কেমন যেন ঝরঝরে মনে হচ্ছে যদিও কোথায় যেন একটা লজ্জার বলিরেখা। আর সেটা তিহাম ভাইয়াকে নিয়ে। তার সামনে পড়লে একটা অস্বস্তিকর পরিস্থিতিতে পড়তে হবে।’সো হোয়াট দিয়ানা।ইট’স জাস্ট অা সিলি মিসটেক।ডোন্ট থিঙ্ক টু মাচ’।
নিজেই নিজেকে অনেকটা জোরে শুনালাম।ঠিক সেই মুহূর্তে তিহাম ভাইয়া রুমে ঢুকে বললো,
–‘তুমি আবার কি সিলি মিসটেক করলে?’
দরজার দিকে তাকিয়ে দেখি তিহাম ভাইয়া আর তিথি।দুজনের মুখেই হাসি।তিহাম ভাইয়ার মুখে হাসির বন্যা বয়ে যাচ্ছে যেন।সারা ঘর পিয়ানোর সুরে ভরে উঠেছে।ওহ্, স্যরি।ইট ভাঙা মেশিনের শব্দ। আমি টেবিলের উপর রাখা কচ্ছপের জারের কাছে যেতে যেতে বললাম,
–‘তেমন কিছু না।গতকাল রাতে একটা জিরাফ কর্মচারিদের চক্ষুকে ফাঁকি দিয়ে চিড়িয়াখানা থেকে পালিয়ে যাওয়ার সময় আমার সাথে দেখা হয়েছিল অনেকটা ভুলবশত। আমার উচিত ছিল কর্তৃপক্ষকে জানানো। হাজার হলেও দেশের সম্পত্তি। কিন্তু সেটা না করে তার ভয়ংকর চেহারা দেখে ভয়ে আমি নিজেই পালিয়ে এসেছি। ‘
তিথি আমার কথা শুনে শব্দ করে হেসে উঠলো।বলল,
–‘এমন উদ্ভট জিনিস শুধু তোর স্বপ্নেই ধরা দেয়। এটাও স্বপ্নে দেখেছিস নিশ্চয়।’
আড়চোখে তাকিয়ে দেখলাম তিহাম ভাইয়া বিছানার উপর বসে ভ্রু কুঁচকে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমি মুখে মধু ঢেলে বললাম,
–‘ইয়াপ।একদম ঠিক।ভয়াবহ রকমের দুঃস্বপ্ন বলতে পারিস।ওহো।তোমার রুমেও কি তোমাকে আমায় বসতে বলতে হবে নাকি? দাঁড়িয়ে আছিস কেন? বোস্। আমি আসি একটু।’
আমি বাইরের দিকে পা রাখতে নিতেই তিহাম ভাইয়া বলল,
–“নিঃসঙ্গতার একশ বছর ” বইটা কার? ‘
পেছন ঘুরে তাকাতেই দেখি তিহাম ভাইয়ার নজর গেছে টেবিলের কোণায় রাখা বইয়ের দিকে।তিথি হেসে বলল,
–‘ দিয়ানার বই।ওর বই কাউকে ধরতে দেয় না।পারমিশন নিন পড়তে চাইলে। ‘
–‘ কিসের পারমিশন! আমি এখনি বইটা পড়া শুরু করলাম। ‘
বলেই ভাইয়া আমার দিকে তাকিয়ে বইটা আনার জন্য টেবিলের দিকে এগোয়।আমি কিছুটা দ্রুত হেঁটে বইয়ের উপর হাত রাখতেই ওনার হাতের উপর আমার হাত পরে।উনি মুচকি হেসে দেয়। আমি অতি দ্রুত হাতটা সরিয়ে নেই।ভাইয়া বইটি হাতে নিয়ে নেড়েচেড়ে দেখতেই……………..
(চলবে)
/