তুমি_নামক_ব্যাধি পর্ব ৩

#তুমি_নামক_ব্যাধি
#মুন্নী_আরা_সাফিয়া
#পর্ব_০৩
.
.
ভাইয়া বইটি হাতে নিয়ে নেড়েচেড়ে দেখতেই মেরুন রঙের খামে মোড়া চিরকুটটা নিচে পড়ে গেল। মুহূর্তেই আমার হৃদপিণ্ডের লাব-ডাব বন্ধ হওয়ার উপক্রম হলো।তিহাম ভাইয়া চিরকুটটা সঙ্গে সঙ্গে হাতে উঠিয়ে মুচকি হেসে বলল,

–‘ লাভ লেটার?’

তিথিও এক দফা হাসতে হাসতে বলল,

–‘তাই নাকি! তা কে দিয়েছে? ‘

আমি ছোঁ মেরে বই আর চিরকুটটা একসাথে নিয়ে দিলাম এক দৌঁড়। এক দৌঁড়ে একদম কর্ণারের রুমে গিয়ে বইটা লুকিয়ে রাখলাম।

আমি কিছুতেই চাই না,কালকের ঘটনা নিয়ে তিথি বিন্দুমাত্র কষ্ট পায়।লুকিয়ে যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম।বিছানার উপর ধপ করে বসে পড়লাম।ক্ষুধা লেগেছে প্রচুর।নাড়িভুড়ি সব জট পাকিয়ে যাচ্ছে যেনো।

শায়লা ভাবীকে ডাকতে নিয়েও কেন জানি ডাকলাম না।বার বার মনে হচ্ছে, না চাইতেও অনেক বড়সড় ঝামেলার মধ্যে নিজেকে জড়িয়ে ফেলেছি যেন।কিন্তু আমার সচেতন মন বার বার বলছে, তুমি তো কোনো ঝামেলাকে জীবনে ঝামেলা মনে করো না।হাঁসের মতো গা ঝেড়ে নিজেকে মুক্ত করো। তাহলে এবার কেনো তোমার চোখে মুখে চিন্তার ছাপ?

দু’হাতে মাথাটা চেপে ধরলাম।মনের একটু গভীরে তলিয়ে দেখলাম,এবারের ঝামেলা থেকে অতি সহজে মুক্তি মিলবে না।যতদূর সম্ভব নিজেকে তিহাম ভাইয়ার থেকে দূরে রাখতে হবে। ভাইয়া যেন কিছুতেই আমার নাগাল না পায়। নিজের অজান্তে ছোট্ট একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো।

কিছুক্ষণ পর শায়লা ভাবী ডাক দিলো খাওয়ার জন্য। আহ! শুনেই মনটা ভালো হয়ে গেল।সেকেন্ডের মধ্যে সব চিন্তা উবে গেল।মনে হলো এই ডাকটার জন্য দীর্ঘদিন ধরে অপেক্ষার প্রহর গুনছি।জীবনে সব সহ্য করার ক্ষমতা থাকলেও এই ভয়ংকর বস্তু ক্ষুধাকে সহ্য করার ক্ষমতা আমার নেই। ক্ষুধা লাগলে মনেই থাকে না আমার চারপাশে কে বা কারা আছে। একদম নিজের উপর কন্ট্রোল হারিয়ে ফেলি।

প্রায় দৌঁড়িয়ে ডাইনিং এ গিয়ে একটা চেয়ারে ধপ করে বসে গেলাম।ভাবী খাবার সার্ভ করছে।বললাম,

–‘ ভাবী তাড়াতাড়ি খেতে দাও।ক্ষুধায় মরে গেলাম।’

ভাবী হেসে বললো,

–‘ এতবেলায় ঘুম থেকে উঠলে ক্ষুধা তো লাগবেই।সকাল বেলা নাস্তা করার জন্য ডাকতে ডাকতে আমি কোমায় চলে গেছিলাম।’

আমি পেটে হাত দিয়ে হাসতে হাসতে বললাম,

–‘মনে হচ্ছে কত যুগ ধরে খাই না আমি।কম সে কম ৩ কেজি চালের ভাত খাব এখন। ‘

–‘আপু তোমার ননদকে তাড়াতাড়ি খেতে দাও। নইলে সে আমাকে আই মিন আমাদেরকে আস্ত খেয়ে ফেলবে।’

বলতে বলতে তিহাম ভাইয়া রুমে ঢুকলো। চোখটা ধ্বক করে জ্বলে উঠলো আমার।না চাইতেও কপাল কুঁচকে গেল।তিহাম ভাইয়া আমার মুখ বরাবর একটা চেয়ারে বসে পড়লো। আঙ্কেল আন্টিও বসল। তিথির মা বাবাও বসল আমাদের সাথে।সবার মুখ হাসিহাসি। অনেক কষ্টে নিজের বিরক্ত ভাব লুকিয়ে রাখলাম।

তিথিকে বললাম,

–‘ তিথি, বোস আমাদের সাথে। একসাথে খাই।’

–‘ আরে,আমি একটু আগে খেয়েছি। ‘

ওর অনিচ্ছা সত্ত্বেও টেনে বসালাম পাশে।তিথির মামা খেতে খেতে আমার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো,

–‘পড়াশোনা কমপ্লিট হয়েছে ?’

খাবার খাওয়ার সময় কথা বলা আমার অতি অপছন্দের কাজগুলোর মধ্যে একটি।কিন্তু এরা মুরুব্বি মানুষ। কি আর করা! অগত্যা বলেই ফেললাম,

–‘ বিএসসি কমপ্লিট।এখন মাস্টার্সের জন্য ফরেনে অ্যাপ্লাই করেছি।’

–‘ কোন বিষয়ে? ‘

–‘ পদার্থবিজ্ঞান।’

আমার কথা শুনে তিহাম ভাইয়ার হেঁচকি উঠে গেল।গ্লাস থেকে পানি টপাটপ মুখে দিয়ে রাজ্যের বিস্ময় নিয়ে বললো,

–‘ মাই গড!! আই কান্ট বিলিভ দিস।ফিজিক্স!! কেউ মাথায় পানি ঢালো।’

আমি ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আছি।উনি কি আমাকে অপমান করার ব্যর্থ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে?
তিহাম ভাইয়ার বাবা সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠলো,

–‘ কেন? ফিজিক্স তোর চিরশত্রু বলে কি ভাবিস সবাই ফিজিক্সে ভয় পায়? ফিজিক্স তো অনেকের প্রিয় বিষয়। তা মা,তুমি কোন কোন দেশে আবেদন করেছ?’

–‘আমেরিকা,ফিনল্যান্ড আর ইতালি। ‘

–‘অনেক ভালো। অনেক ভালো। ইতালিতে আসলে আরো ভালো হবে।ওখানে তিহাম থাকে ওর খালামনি আর খালুর সাথে। তুমিও ওদের সাথে থাকতে পারবে।’

নির্লিপ্তে বলার সাথে সাথে তিহাম ভাইয়া আরেক দফা কাশতে শুরু করল।ধৈর্য্যের চরম সীমায় পৌঁছে গেছি প্রায়।এটা কোন ধরনের অশিষ্টাচার? নিজে ফরেনে স্টাডি করে বলে ভেবেছে কি আর কেউ ফরেনে পড়তে পারে না?

আর আমি ইতালি পড়লেও তো ওনাদের সাথে থাকতে যাচ্ছি না।কোনোদিনও না।রেগে ভাতের প্লেট রেখে উঠে যাওয়া আমার নিত্যদিনের কাজ।কিন্তু এখন আত্মীয় বাড়ি আছি।ওসব করা যাবে না।ভাবীর দিকে তাকিয়ে দেখি তিনি অসহায় ভাবে চেয়ে আছে। অনেক কষ্টে নিজেকে সামলালাম।

রাগে প্লেটে চাপ দিতেই মাছের কাঁটা ফুটে গেল।হুম, কাঁটা ফুঁটেছে। মানুষের গলায় ফুঁটে আর আমার হাতের আঙ্গুলে ফুটেছে। মুখ দিয়ে অস্ফুট একটা শব্দ করতেই সবাই আমার দিকে তাকাল।হাতে কাঁটা ফুটেছে দেখে সবাই হাসতে হাসতে শেষ।মানুষের গলায় কাঁটা ফুটে আর আমার হাতে!

আমি কয়েক সেকেন্ড ভেবেও খুঁজে পেলাম না এতে হাসার কি আছে।বরাবরের মতো আমি মাছ খেতে ভীষণ ভয় পাই।মাছ খেতে নিলে হয় গলায়, না হয় হাতে কাঁটা ফুটবেই।এটা খুবই কমন।কম বেশি সবার হয়।তো এতে দাঁত কেলিয়ে হাসার কি আছে? আমি কাঁটাটা বাম হাত দিয়ে তুলতে নিতেই আউচ্ করে শব্দ করে উঠলাম।মনে হলো সবার হাসি থেমে গেছে।

তিহাম ভাইয়া নিজের আসন থেকেই আমার সামনে ঝুঁকে হাত দিয়ে কাঁটাটা তুলে ফেলতেই গলগল করে রক্ত বেরিয়ে আসল।মুহূর্তের মধ্যে মাথার ভেতর একটা চড়ক দিয়ে উঠে। আমার রক্তে ফোভিয়া আছে। কোনো কারণ ছাড়াই কাটা ছেঁড়া ভয়ানক ভাবে ভয় পাই।এটা শুধু আমার না।বেশিরভাগ মানুষের একই অবস্থা।

ভাবী জানে সেকথা। প্রায় দৌঁড়িয়ে এসে আমার হাত চেপে ধরল। আমি খাবারের প্লেট রেখে ভাবীর হাত ধরে উঠে বেসিন থেকে হাত ধুয়ে সোফায় বসলাম।ভাবী হাত বেঁধে দিল।

একটু পর তিহাম ভাইয়া এসে সোফার একপাশে বসে অনেকটা করুন সুরে বলল,

–‘দিয়ানা,ব্যথা করছে?’

তার এই কন্ঠের সাথে আমার পরিচয় নেই।তাই অনেকটা ভ্যাবাচ্যাকা খেলাম।না চাইতেই তার মুখের ওপর আমার নজর গেল। মুখে স্পষ্ট এক ধরনের অপরাধবোধ ফুটে উঠেছে যেন আমার এই হাতে ব্যথা পাওয়ার জন্য সে দায়ী। হেসে দিতে গিয়েও নিজেকে কন্ট্রোল করলাম।

শান্ত কন্ঠে বললাম,

–‘ফিলিং বেটার।’

তিহাম ভাইয়া আর কিছু বললো না।মনে হয় উঠে ওয়াশরুমে গেল।আমিও চুপচাপ বসে রইলাম।তিথি আসতেই ওকে বললাম,

–‘ঘুম পাচ্ছে খুব।ঘুমিয়ে পড়ব আবার।’

তিথি নাক শিটকে বলল,

–‘আর কত ঘুমাবি?’

–‘ঘুম ছাড়া তো কাজ নেই এই মুহূর্তে। যদিও ঘুম কোনো কাজ নয়।’

–‘চল ঘুরতে যাই।তিহাম ভাইয়ার সাথে। ‘

আমি ভ্রু কুঁচকে বললাম,

–‘ ভাইয়া? হু ইজ ভাইয়া? দুদিন পর বিয়ে যার সাথে তাকে এখনো ভাইয়া ভাইয়া করছিস? আর যেন না শুনি।হুহ!’

তিথি মুচকি হেসে চুপ করে রইল। বললাম,

–‘ তোরা নিজেদের মতো টাইম স্পেন্ড কর। আমারে ছাড়।আমি ঘুমাবো।গুড নাইট।’

বলেই তিথির রুমে আসলাম।ঝাপ দিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়তেই নিজেকে পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মনে হলো। কি শান্তি! জানালা দিয়ে পায়ের উপর এক চিলতে রোদ এসে পড়েছে।

আজ খুব করে আমার সেই কল্পনার শহরটাতে যেতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু সে শহর তো দিনের বেলা কল্পনাতে আসে না।দুচোখ বন্ধ করলাম।আমার এই শহর অনেক ছোটবেলা থেকে ছিল। কিন্তু বড় হওয়ার পর যখন “ময়ূরাক্ষী ” বইটি পড়ি,তখন হিমুর সেই কল্পনার নদী ময়ূরাক্ষীর মতো আমিও আমার সেই নিজস্ব শহরটাকে অনেক ভালো মতো আবিষ্কার করি।কিন্তু চোখ বন্ধ করলেই যখন তখন সেখানে প্রবেশ করতে পারি না। আমার সেই শহরটার একটা নাম দিয়েছি। ‘নিস্তব্ধপুরী’,হ্যাঁ ‘নিস্তব্ধপুরী’।কারণ সে শহরে কোনো মানুষ নেই।নেই কোনো পশুপাখি। একদম নিরিবিলি। শুধু গাছপালার সবুজত্ব চারিদিকে। সে শহরে আ………ভাবতে ভাবতে ঘুমরাজ্যে তলিয়ে যাচ্ছি ধীরে ধীরে।

★★★★★

ঘুমের মধ্যে বেশ টের পাচ্ছি কেউ একজন আমার দিকে গভীর ভাবে তাকিয়ে আছে। তার ভারী নিঃশ্বাসের শব্দ আমার মুখে আছড়ে পড়ছে।মস্তিষ্ক সচল।কিন্তু শরীর অচল হয়ে আছে। মস্তিষ্ক বার বার চোখকে হুকুম দিচ্ছে খোলার জন্য। কিন্তু কে শোনে কার কথা! দরজার কাছে হালকা একটা শব্দ হতেই চোখ খুলে দেখি……………….

(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here