তুমি_নামক_ব্যাধি পর্ব ৪+৫

#তুমি_নামক_ব্যাধি
#মুন্নী_আরা_সাফিয়া
#পর্ব_০৪
.
.
দরজার কাছে হালকা একটা শব্দ হতেই চোখ খুলে দেখি দুটো চোখ খুব কাছ থেকে আমার উপর নিবদ্ধ। ঘোরলাগা সে দৃষ্টিতে প্রাণের ছিটেফোঁটা নেই যেন।কয়েক সেকেন্ড লাগলো ব্যাপারটা বুঝতে।

ধড়মড়িয়ে উঠতে নিতেই তিহাম ভাইয়া আমাকে বিছানার সাথে চেপে ধরলো।বললো,

–‘চুপচাপ থাক।’

–‘হোয়াট? ‘

–‘চেঁচামেচি করবে না।বাংলায় বলেছি চুপচাপ থাক।’

–‘ হোয়াট দ্যা হেল আর ইউ ওয়ান্টিং টু ডু?’

আমার প্রশ্নের জবাব না দিয়ে বলল,

–‘আমি তো অনেক কিছুই করতে চাই।আপাতত হাত দেখাও।এখনো কি ব্যথা করছে?’

রাগে মাথার চুল ছিঁড়তে ইচ্ছে করছে।সামান্য একটা কাঁটা ফোটার জায়গা নিয়ে এত আদিখ্যেতার কি আছে?আমার ভাবনায় ছেদ পড়ল যখন উনি আমার আঙুল টা নিজের হাতের তালুতে নিল।কিছু বুঝে উঠার আগেই নিজের ঠোঁট ছোঁয়াল তাতে।দ্বিতীয়বার চিন্তা না করে দিলাম এক ধাক্কা।

তাল সামলাতে না পেরে নিচে পরে গেল।কিছুটা অনুযোগের সুরে বলল,

–‘দেখা হওয়ার পর থেকেই ধাক্কা ধাক্কি করছো কেন?এটা ঘোর অন্যায়।’

রেগে বললাম,

–‘একদম চুপ।এসব কি করছেন আপনি?ছি! ইটস জাস্ট আনটলেরেবল।মি. তাজবীর আজমাইন তিহাম,আপনি এখন ইতালিতে নেই। এটা বাংলাদেশ।নাকি বানান করে উচ্চারণ করবো?এতদিন বিদেশে যাচ্ছে তাই করেছেন।দয়া করে এখানে তেমন কিছু করার চেষ্টা করবেন না।তিথি মেয়েটাকে কষ্ট দিলে আমি কিন্তু আপনাকে ছেড়ে কথা বলবো না।আমি মেয়েটাকে ভীষণ ভালোবাসি।

আমার সামনে আর আসবেন না।প্লিজ!’

মুখ ঘুরিয়ে নিলাম।তিহাম ভাইয়া কিছু বলল না।তার চোখ ছলছল করছে। হয়তো কেঁদে দিবে এক্ষুনি। দ্রুতপায়ে উঠে ওয়াশরুমের দিকে গেল। কাঁটা ফোটা আঙুলটা সমানে ঘষতে লাগলাম।মনে হচ্ছে, চামড়া ছিঁড়ে ফেলি।ওনার সাহস কি করে হয়,সুস্থ মস্তিষ্কে আমার গায়ে হাত দেওয়ার?

নিজের রাগটাকে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টায় পায়ের বুড়ো আঙুলের মাথায় চিমটি দিয়ে বসে রইলাম।আস্তে আস্তে মাথাটা একটু ঠান্ডা হতেই অবাক নামের পাহাড়ের শিখরে নিজেকে আবিষ্কার করলাম।

কোনো পুরুষ মানুষের চোখে আমি এত সহজে জল আসতে দেখিনি।পুরুষ মানুষের চোখে পানি দেখতে আমাদের সমাজ নারাজ।কারণ লজ্জা যেমন নারীর ভূষণ,তেমনি চোখের জলও নারীর ভূষণ যা পুরুষ জাতির চোখে একদম বেমানান লাগে।আমি নিজে অনেক চাপা স্বভাবের।

যেকোনো পরিস্থিতিতে শক্ত থাকার শক্তি আমার আছে।লোকের সামনে কেঁদে বেড়ানো মানুষ আমার অতি অপছন্দের। হঠাৎ করে তিহাম ভাইয়ার এরকম অদ্ভুত অাচরণের যুক্তিযুক্ত কোনো অর্থ খুঁজে পাচ্ছি না।এর একটাই অর্থ হতে পারে।তার চরিত্রের ঠিক নেই হয়তো!

একদিনেই সো মাচ বোরড হয়ে গেছি।বালিশের নিচ থেকে ফোনটা নিয়ে আমার বেস্ট ফ্রেন্ড জাকিয়ার নাম্বার ডায়াল করলাম।কল দিতে নিয়েই কি মনে হয়ে দিলাম না।থাক,শুধু শুধু ওকে টেনশন দিবো না।তাছাড়া আমি নিজের সমস্যা নিজে সমাধানের চেষ্টা করি সবসময়।

খুব ছোটবেলায় চার্লি চ্যাপলিনের একটা কথা পড়েছিলাম।

” I have many problems in my life. But my lips don’t know that. They always smile.”

—–CHARLIE CHAPLIN

কথাটা গেঁথে নিয়েছিলাম মনে সেই ছোটবেলায়। যদিও মুখে হাসি সবসময় অতিরিক্ত রাগের জন্য ধরে রাখতে পারি না,তবে সমস্যা গুলো কখনো কাউকে মুখ ফুটে বলিনা।মাকে ফোন দিলাম।দুইবার রিং হতেই ওপাশ থেকে মিষ্টি কন্ঠ ভেসে আসল।

–‘কেমন আছ, মা?’

–‘ভালো রে। তোর কি খবর?’

–‘হুম, ভালো। কিন্তু আমার এখানে থাকতে ইচ্ছে করছে না।বাসায় যাবো।’

–‘এতদূরের পথ।একা আসবি কিভাবে? তোর বাবা তো ব্যবসার কাজের জন্য যেতেও পারবে না।তোর বড় ভাইও তো অফিস নিয়ে ব্যস্ত।কি করা যায়? ‘

মা চিন্তিত হয়ে বললো। সত্যি তো!ভেবে দেখিনি বিষয়টা। ভাবীর বাপের বাড়ি বরিশাল। এই বরিশাল সিটি থেকে লঞ্চে করে নারায়ণগঞ্জ আমার বাসায় যাওয়া চাট্টিখানি কথা নয়। মাকে বললাম,

–‘আহ।আমার ভালো লাগছে না।দাঁড়াও আগে ভাবীকে বলি।’

–‘রাগারাগি করিস না কারো সাথে। তোকে কোথাও পাঠিয়ে শান্তিতে থাকতে পারি না।কখন কি করিস, ভয় লাগে সবসময়। তোর যে রাগ? একটু মাথা ঠান্ডা রাখিস মা।’

–‘বাদ দাও তো।চিন্তা করো না।আমানের কি খবর মা?’

এরপর মা যা বললো তার জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিলাম না।হাসবো না কাঁদবো বুঝতে পারছি না।ফোনটা রেখে দিলাম।আমান আমার ছোট ভাই। ক্লাস সিক্সে পড়ে সবেমাত্র। সে এই হাঁটুর বয়সেই ভয়ানক তাজ করেছে।

সে তার ক্লাসমেট বৃষ্টি নামের মেয়েটাকে লাভ লেটার দিয়েছিল।সেজন্য মেয়েটা তার দুই বান্ধবীকে সাথে করে তিনজন মিলে ওকে কেলিয়েছে।টিচার বাসায় খবর দিয়ে গার্ডিয়ানকে যেতে বলেছে।আমি নাক মুখ শিটকে গভীর ভাবনায় ডুব দিলাম।

সেই নার্সারি থেকে কম্বাইন্ড ক্লাস করেও সিঙ্গেল একটা প্রেম না করা এই আমার প্রতি নিজেরই রাগ লাগছে।নিজেকে অনেক ব্যাকডেটেড, আদিম যুগের মানুষ বলে মনে হচ্ছে। একে তো আমি যে আজ অবধি একটা প্রেম করিনি,সেটা কেউ বিশ্বাস করতে চান না।যারা করে তারা আমাকে অস্বাভাবিক বলে আখ্যা দেয়।

কিন্তু সেই অস্বাভাবিক জিনিসটাকে আমি লজিক দিয়ে ভেবে স্বাভাবিক করেছি।আমার এক ক্লোজ ফ্রেন্ড অনি বলেছিল,

“ছোটবেলা থেকে যাদের জীবনের অধিকাংশ সময় হুমায়ূন আহমেদের বই পড়ে কেটেছে তাদের প্রেমে পড়া কঠিন।তারা আলমারি থেকে জীবন পর্যন্ত গোছানো ছেলে চায় না। তারা এমন একজন অগোছালো মানুষকে চায় যে ঝুম বৃষ্টিতে মধ্যরাতে জাগিয়ে বলবে,চলো,আজ সারারাত বৃষ্টিতে ভিজবো দুজন।”

ও মিথ্যে বলেনি।আমার জীবনের অধিকাংশ বললে ভুল হবে,প্রায় পুরোটা সময়ই হুমায়ূনকে পড়ে কেটেছে। কিছু কিছু বই পড়তে পড়তে প্রায় মুখস্ত হয়ে গেছে। তবুও যতবার পড়তে নেই প্রতিটা শব্দ নতুন মনে হয়। এভাবেই পড়তে পড়তে প্রতিটা চরিত্রের প্রেমে পড়তাম বার বার।কিন্তু ঐ যে, বাস্তব জীবনে আজও কারো প্রেমে পরলাম না।

মাঝে মাঝে ভাবি,প্রকৃতি যেহেতু শূন্যতা পছন্দ করে না, তবে কি আমার ভালো লাগার জায়গাটা শূন্য নেই? কেউ কি সত্যি আছে আমার অবচেতন মনে?এই রহস্যের কুল-কিনারা বের করতে পারিনি আজো।কে-ড্রামা,সি-ড্রামা দেখে মনে মনে কল্পনা করতাম,কারো সাথে ধাক্কা লাগবে, বা কারো ঘড়ির সাথে ওড়না জড়িয়ে যাবে,বা কারো শার্টের বোতামে চুল আটকে যাবে!তারপরেই প্রেম হবে।

কিন্তু এসব কিছু হলো না আমার সাথে। অবশ্য ক্লাস টেনে থাকতে সিঁড়ি দিয়ে উঠার সময় এক ছেলের শার্টের সাথে আমার…………!ভেবেছিলাম চুল আটকে গেছে। কিন্তু নাহ!ব্যাগের চেইন গেঁথে গেছে। তবুও রোমাঞ্চকর একটা বিষয়।আমার মনে রোমান্টিক কোনো গান না বেজে ভ্রু কুঁচকে গেল বিরক্তিতে।

ছেলেটার ভীতু মুখের দিকে তাকিয়ে কোনো ভালো লাগার অনুভূতি হলো না।বরং রেগে গিয়ে ব্যাগ দিলাম একটান।সঙ্গে সঙ্গে ছেড়ে গেল,আর ছেলেটা পড়ি কি মরি করে পালাল সেখান থেকে। বান্ধবীরা হেসে উঠলো আশায়। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যে যখন কিছুই হলো না, তাদের আশার ঘরে ঘুণে ধরলো।

তারপর এইচএসসি পরীক্ষার পর একদিন ভর্তি পরীক্ষা দিয়ে বাসে ফিরছি বান্ধবীদের সাথে ।একে তো পরীক্ষা ভালো হয়নি,দুই হলো প্রচন্ড মাথা ব্যথা।আর তার সাথে আমার কারসিকনেস তো দুধে-ভাত।সব মিলিয়ে একদম নাজেহাল অবস্থা। চোখ বন্ধ করে এক হাত বাসের হাতলে দিয়ে মরার মতো পরে আছি।একটা ছেলে ঠাস্ করে হাতের উপর হাত রাখছে।আরে,ভাই!ভুলবশত যদি হাতের উপর হাতটা রেখেই থাকিস,স্যরি তো বলবি! না, সে কিছু না বলে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলো। মাথায় গেল রক্ত চেপে।

দাঁড়িয়ে পেট বরাবর দিলাম এক ঘুষি। একটাতেই কুপোকাত।তিনবার স্যরি বলল।ব্যস,এখান থেকে প্রেম হলেও পারতো।না হয়নি।বস্তুত, কোনো ছেলেকে ভালো লাগল না আজ পর্যন্ত। কেউ প্রোপোজ করলে ওই ছেলের আর মুখ দর্শন করতাম না।কেন,জানি না।

হুমায়ূন আহমেদ স্যারের বহুব্রীহি বইতে পড়েছিলাম,

“প্রেমের ক্ষেত্রে দ্বৈব কখনোই সহায় হয় না।গল্প – সিনেমায় হয়। জীবনটা গল্প- সিনেমা নয়।জীবনের নায়িকারা নায়কদের সাথে রাস্তায় দেখা হলেও চিনতে পারে না।”

কথাটা এতদিনে বুঝেছি আমি।সত্যি জীবনটা গল্প, উপন্যাস বা নাটক, সিনেমা নয়।আর আমিও নায়িকা নই।তবুও মাঝে মাঝে যখন ভাবি,যদি কোনো লেখক আমাদের নিয়ে গল্প লিখে তবে অনায়াসে তিথি হবে নায়িকা। ওর নামটা যেনো তৈরি হয়েছে উপন্যাসের মূল চরিত্র হওয়ার জন্য। সাথে নম্র,ভদ্র,শান্ত একটা মেয়ে।

হুমায়ূন আহমেদের উপন্যাস “তিথির নীল তোয়ালে” অসাধারণ একটি বই।তবে আমি লেখকের কল্পনার জগতের নায়িকা হতে না পারলেও আমার নিজের জীবন নামের অসমাপ্ত উপন্যাসের প্রধান চরিত্র। চাইলেও আমি এই রোল থেকে নিজেকে মুক্ত করতে পারবো না।

ঘুরেফিরে তিহাম ভাইয়ার কথা মনে পড়ল। যে বিন্দু থেকে শুরু করেছিলাম,দিনশেষে সেখানেই এসে থেমে গেলাম।তিহাম ভাইয়া কি করতে চাচ্ছে কিছুই বুঝে উঠতে পারছি না।তিথি যদি কোনোভাবে ওনার এই ভিত্তিহীন কর্মকান্ড বুঝতে পারে তাহলে কি হবে? ও তো আর ঘাসে মুখ দিয়ে চলে না।যে করে হোক কালকের মধ্যে আমায় বাসায় যেতে হবে।তিথি যেন কিছুতে কষ্ট না পায়।উঠে হাতমুখ ধুয়ে আসলাম।

___________

প্রায় বিকেল হয়ে গেছে। টি টেবিলে রাখা প্লেট থেকে বিস্কিট আর ফল খেয়ে বাইরে বের হলাম।ভাবীর মাকে জিজ্ঞেস করে জেনে নিলাম ভাবী কোথায়। ভাবীকে ডাকতে বাগানে গেলাম।সবাই বাগানে চেয়ার পেতে বসে আছে।

তিহাম ভাইয়া কি কথায় যেন উচ্চস্বরে হাসছে।আমাকে দেখে তার হাসি সামান্যতম কমল না।তাকে দেখে বুঝা যাচ্ছে না, এই পোলা কিছুক্ষন আগে আমার কাছে এতগুলো কথা শুনেছে।ইশ!একটা চড় দিতে পারলে কি যে ভালো লাগতো!

আরেকবার তিহাম ভাইয়ার দিকে তাকালাম।শেষ বিকেলের পড়ন্ত আলো তার মুখে এসে পড়েছে। তাকে বড্ড অচেনা লাগছে। আমি চোখ নামিয়ে নিলাম।

তিথি একটা চেয়ার এগিয়ে বসতে বলল।দো মোনা করতে করতে বসে পড়লাম। ভাবী বলল,

–‘এই মেয়ে ঘুমাতে ঘুমাতে জীবন কাবাবের হাড্ডি বানিয়ে ফেলবে।’

আমি ঠোঁট উল্টিয়ে ভাবীর কানের কাছে মুখ নিয়ে বললাম,

–‘আমি বাসায় যাবো কাল।’

সবাই আকাশ থেকে পড়ল।মনে হলো আমি ওদের বলেছি,কাল জনসম্মুখে আমি সুইসাইড করবো।তিহাম ভাইয়ার মা বললেন,

–‘একদমই বাসায় যাওয়ার কথা মুখে আনবে না।কাল তোমরা সবাই আমাদের সাথে আমাদের বাসায় যাবে।’

এইবার আমি আকাশ থেকে পড়লাম।তোতলাতে তোতলাতে বললাম,

–‘না,না আন্টি।আমি বাসায় যাবো জলদি।ভালো লাগছে না।’

–‘কোনো কথা না আর।কাল আমাদের সাথে যাচ্ছো তুমি।’

অসহায়ের মতো ভাবীর দিকে তাকালাম।ভাবী বললো,

–‘দিয়ানা,একগুঁয়েমি করে না।তুমি তো এত রাস্তা একা যেতে পারবে না।দিনকাল ভালো নয়।তোমায় একা ছাড়তে পারবো না।তারচেয়ে চলো, কাল আমরা তিহামদের বাসা থেকে ঘুরে আসি।’

কিছু না বলে রুমে গেলাম।মনটা খারাপ হচ্ছে আস্তে আস্তে। নিজেকে খাঁচায় বন্দি বাঘের সাথে থাকা পাখি মনে হচ্ছে। ওয়াশরুমে গেলাম দৌঁড়িয়ে। আমি চাই না আমার চোখের জল অন্য কেউ দেখুক।

টেবিলের উপর রাখা ছোট্ট কাগজটার উপর নজর গেল।গুটিগুটি হাতে লেখা……………….
#তুমি_নামক_ব্যাধি
#মুন্নী_আরা_সাফিয়া
#পর্ব_০৫
.
.
রুমে ঢুকে বিছানায় বসতেই টেবিলের দিকে চোখ পড়ল।একটা কাগজের টুকরো ভাঁজ করা।দেখে বোঝা যাচ্ছে কেউ একজন এইমাত্র রেখে গেল।হাতে নিয়ে সামনে মেলে ধরতেই গুটিগুটি অক্ষর সামনে ভেসে উঠলো।

“স্যরি ফর এভরিথিং। আসলে কি থেকে কি হয়ে গেল কিছুই যেন মাথাতে ঢুকছে না।তোমার হাতের রক্ত দেখে নিজেকে সামলাতে পারিনি।বার বার মনে হচ্ছিল তোমার শরীরে সামান্য ফুলের টোকা পড়লেও আমি বেসামাল হয়ে যাবো।তুমি যখন ঘুমিয়ে ছিলে তখন প্রতিটা সময় তোমায় চোখে চোখে রেখেছি।যেনো আমি চোখ সরালেই তোমার কিছু একটা হয়ে যাবে।যাইহোক, আমাকে ক্ষমা করে দিও প্লিজ। তোমাকে আর বিরক্ত করবো না।আর একটা অনুরোধ,প্লিজ কাল যেও আমাদের সাথে। নইলে আমি অপরাধবোধে ভুগবো। কথা দিচ্ছি তোমার থেকে নিজেকে দূরে রাখবো।”

কিছুক্ষণ চুপচাপ ভাবলাম। তারপর চিঠিটা কয়েক টুকরো করে জানালা দিয়ে ফেলে দিলাম।বেশ কিছু ড্রেস গুছিয়ে ব্যাগে ঢুকালাম।ল্যাপটপ টাও ব্যাগে রাখলাম।

___________

সকাল বেলা তিথির ডাকে ঘুম ভাঙলো।ও ভেজা চুলের পানি মুছতে মুছতে পাশে বসল।ঘুমঘুম চোখে বললাম,

–‘তিথি আমি তোদের এখানে থাকি।না গেলে হয় না?’

ও অনেকটা কঠিন স্বরে বললো,

–‘না, হয় না।’

–‘আমার ঘুম পাচ্ছে। আরেকটু ঘুমিয়ে নেই তাহলে।’

–‘এ,তুই একদম ঘুমাবি না আর। উঠে পর এখন।গোসল করবি?আমি একেবারে গোসল সেরে নিলাম।’

–‘ফোট!এত ভোরবেলা গোসল করবনি!’

–‘আচ্ছা, যা তাইলে।এমনি ফ্রেশ হয়ে নাস্তা কর।’

–‘আমি ডাইনিং এ যাবো না।নাস্তাটা এখানে দিয়ে যা না।’

তিথিকে একটু চিন্তিত দেখালো।পরমুহূর্তেই বলল,

–‘ঠিক আছে।আমি পাঠিয়ে দিচ্ছি। তুই ওয়াশরুমে যা এখন।’

নীল একটা ড্রেস পরে মাথার চুল কাঁটা দিয়ে আটকালাম।সামনের ছোট করে কাটা কিছু অবাধ্য চুল চোখে আছড়ে পড়ছে বার বার।জেনেশুনেই ওদের এই অধিকার দিয়েছি বলে তেমন খারাপ লাগছে না।

ব্যাগটা হাতে নিয়ে রুমের বাইরে পা রাখতেই তিহাম ভাইয়ার চোখে চোখ পড়ল। দ্রুত পাশ কেটে বাইরে বের হয়ে দেখলাম সবাই রেডি। ভাবীকে উদ্দেশ্য করে বললাম,

–‘ভাবী আমি গাড়িতে গিয়ে বসলাম।আসো তোমরা সবাই। ‘

–‘দিয়ানা,এটা কি হচ্ছে?? একটু তো সাজগোজ করবে নাকি?’

–‘আহ্,ভাবী! আজ থাক ওসব।মুড নেই একদম।’

ভাবীর মা হেসে বলল,

–‘দিয়ানা এমনিতেই অনেক সুন্দর। ওকে না সাজলেও পরীর মতো লাগে।’

অনেক কষ্টে কপাল কুঁচকানো প্রতিরোধ করলাম।কিছু একটা বলতে নিতেই দেখলাম তিহাম ভাইয়া বাইরে বের হয়েছে।পলকহীন দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আমার দিকে।মনে হচ্ছে আমি তার কয়েক যুগ আগে হারিয়ে যাওয়া প্রেয়সী,থুক্কু বোন।

হ্যাঁ,হারিয়ে যাওয়া অতি আদরের ছোট বোন।ওনার চোখ থেকে পালিয়ে বাঁচার জন্য ভাবীকে বলে দ্রুত গেটের কাছে দাঁড় করানো গাড়িতে গিয়ে উঠলাম। পিছনের সিটে আরাম করে বসে বাইরে তাকালাম।বেশ লাগছে এটা ভেবে যে আমি সবাইকে দেখতে পাচ্ছি কিন্তু কেউ আমাকে দেখতে পাচ্ছে না।তিহাম ভাইয়াকে হঠাৎ করেই খুব বেশি খুশি লাগছে।ভ্রু কুঁচকে গেল আমার।তার মনের আকাশে কখন রোদ, কখন বৃষ্টি তা বুঝার ক্ষমতা আমার নেই।

ভাইয়ার গায়ে কফি কালারের হুডি।দূর থেকেই গলার সাদা লকেটটা দেখা যাচ্ছে। আচ্ছা, লকেটের ভেতর কি তিথির নাম লেখা?হয়তো!তার সিল্কি চুলগুলো বাতাসের সাথে পাল্লা দিয়ে উড়ছে।

কাচের ভেতর মনে হচ্ছে ল্যাপটপে কোনো কোরিয়ান হিরোকে দেখছি।যাকে শুধু দেখতে পারার অধিকার আছে,কিন্তু ছুঁয়ে দেখার অধিকার নেই।যার পরনে…………..। আর তাকালাম না।অন্যের বরের দিকে নজর দেয়া একদমই ঠিক না।

তিথি আর ভাবীর দিকে তাকালাম।দুজনেই হোয়াইট ড্রেস পড়েছে। সাথে হালকা সাজ।ওদের আর ভাইবোন নেই। দু বোনের মধ্যে বন্ধনটা অনেক গাঢ়।তিহাম ভাইয়ার মা-বাবা, তিথির মা-বাবা সবাই এসে গেছে। ভাবী এগিয়ে এসে আমি যে গাড়িতে বসে আছি সেটা অভারটেক করে সামনের গাড়ির দিকে এগিয়ে যেতেই আমি গাড়ির কাচ নিচে নামিয়ে ডাক দিলাম।

–‘কই যাচ্ছো?এই গাড়িতে আসো।’

–‘তোমরা ওই গাড়িতে যাও।আমরা এইটাতে আসি।সবাই উঠে পরো।’

ভাবী বলতে বলতে সামনে রাখা গাড়িতে উঠে গেল।তোমরা বলতে কাকে কাকে বুঝালো তার সমীকরণ কষছি।দুই লাইন না লিখতে উত্তর মেলানোর আগে তিথি এসে ড্রাইভিং সিটের পাশে বসল।আর তিহাম ভাইয়া ড্রাইভিং সিটে বসল।দুঃখে কারো মাথার মুড়িঘণ্ট বানাতে ইচ্ছে করছে।ইচ্ছে হচ্ছে সময়কে থামিয়ে তার কালো অন্ধকার গহ্বরে তিহাম ভাইয়াকে নিক্ষেপ করি।ব্যস সব ঝামেলা চুকে যাবে।

ওড়নার দুই পাশ শক্ত করে ধরে রাগ থামানোর চেষ্টা করছি।তিথি পিছনে তাকিয়ে বলল,

–‘মুখ অমন করে রেখেছিস কেন?’

–‘কেমন করে রাখতে হবে?’

দ্বিরুক্তি না করে জিজ্ঞেস করলাম।তিথি কিছু না বলে হেসে ফেলল।তিহাম ভাইয়া গাড়ির ব্যাক মিরোর ঠিক করতে করতে তিথিকে উদ্দেশ্য করে বলল,

–‘তিথি, ওকে একটু হাসি খুশি থাকতে বলো।নইলে মানুষ ভাববে আমরা ওকে কিডন্যাপ করে নিয়ে যাচ্ছি। ‘

কুঁচকানো ভ্রু আরো একটু কুঁচকে সিটে হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করলাম।।কিছু বলতে ইচ্ছে করছে না।একটুপরে এমনিতেই আমার যাচ্ছেতাই অবস্থা হবে।গাড়ি চলতে শুরু করেছে। তিহাম ভাইয়া এসি অন করে তিথিকে বলল,

–‘কি গান শুনবে তিথি?’

–‘ইংলিশ সঙ দিন।’

তিথির কন্ঠ শুনলাম।সঙ্গে সঙ্গে “We don’t talk anymore “গানটি কানে বাজতে লাগলো।

কতক্ষণ কেটে গেছে এভাবে খেয়াল নেই। এক ধরনের ঘোরের মধ্যে চলে গেছি যেন।শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। চারপাশের সব অক্সিজেন যেনো নিমেষে উধাও হয়ে গেছে। মনে হচ্ছে, বুকের উপর ভয়ঙ্কর কেউ একজন গলা চেপে বসে আছে। কথা বলার শক্তি টুকু হারিয়ে ফেলেছি।

কেউ একজন সামনে থেকে বার বার বলছে,” দিয়ানা,ঠিক আছো তুমি? গাড়ি থামাব?” আরো একটা কন্ঠ শুনতে পেলাম।”দিয়ানা কি হয়েছে তোর?কথা বল?”
আমি আর কত সহ্য করব?সমুদ্রের যে ঢেউ গুলো বালিতে আছড়ে পরার কথা সেগুলো বুকে এসে লাগছে।আর পারলাম না।অনেক কষ্টে বললাম,

–‘তিথি আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে।’

সেকেন্ডের ন্যানো ভাগের এক ভাগ সময় লাগলো গাড়ি থামতে।কেউ একজন আমায় হেঁচকা টান দিয়ে প্রায় বুকের সাথে মিশিয়ে রাস্তার পাশে নিয়ে দাড় করালো।সঙ্গে সঙ্গে কারো গা ভরে হড়হড় করে বমি করে বড়বড় শ্বাস নিলাম।কানের কাছে তিহাম ভাইয়ার কন্ঠ শুনতে পেলাম।

–‘তিথি গাড়ি থেকে পানির বোতল নিয়ে আসো। কুইক।’

বোতলের মুখ খুলে সামনে রাখতেই কুলি করে বসে পড়লাম। পা আর শরীরের ভর রাখতে চাইছে না।বামপাশে তাকিয়ে দেখলাম তিহাম ভাইয়া এক হাতে বোতল ধরে অন্য হাত দিয়ে আমায় বুকের সাথে জড়িয়ে আছে। ওনার কাছ থেকে নিজেকে মুক্ত করে তিথির হাত ধরলাম। ও ভয়াতুর দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। ও আমাকে জড়িয়ে ধরলো।ওর দিকে তাকিয়ে একটু হাসার চেষ্টা করতে ব্যর্থ হলাম।

তিহাম ভাইয়া দৌড়ে গাড়ি থেকে মেডিসিন আনলো।তিথি বলল,

–‘ও তো বমি করে সব বের করে দিয়েছে।কিছু একটা খাইয়ে ওষুধ খেলে ভালো হতো।’

তিহাম ভাইয়া আবার দিলেন ছুট।প্রায় সঙ্গে সঙ্গে মুখের সামনে কিটক্যাট চকলেট দেখতে পেলাম।ভ্রু কুঁচকে গেল।মেয়ে হওয়ার পরো আমার অপছন্দের খাদ্যের তালিকায় চকোলেট প্রথম।এই অবস্থায় দেখে বমি আসছে।মাথা নেড়ে বললাম,

–‘খাবো না আমি।’

তিহাম ভাইয়া বললো,

–‘একগুঁয়েমি করবে না।খেয়ে নাও তাড়াতাড়ি।আমি চাই না আমার গাড়ি নষ্ট হোক। ‘

–‘বলছি তো খাবো না।জোর করছেন কেন?’

ডাইনোসরের মতো একটা চিকন কন্ঠ চিৎকার করে উঠলো।

–‘জাস্ট শাট আপ।ঠাস করে এক চড় বসিয়ে দিব।একদম আমার রাগ উঠাবে না বলে দিলাম। কতবার জিজ্ঞেস করেছি যে খারাপ লাগছে কিনা, খারাপ লাগছে কিনা? না ও পণ করেছে কিচ্ছু বলবে না।এসিতে বদ্ধ কারে তোমার শ্বাস নিতে প্রোবলেম হচ্ছে সেটা কেন আগে বললে না?চুপ কেন?’

পরমুহূর্তেই ধমকিয়ে বলল,

–‘স্পিক আপ!ভেরি ফাস্ট।’

ভয়ে আমি সামান্য কেঁপে উঠলাম।তিথির হাত শক্ত করে ধরে সামনের মানুষটির দিকে তাকালাম।কুচকুচে দুচোখ এখন রক্তের লাল রঙকেও হার মানাচ্ছে। মনে হচ্ছে তার চোখের সামনে এইমাত্র অতি প্রিয়জন কেউ পাকিস্তানির হাতে নিহত হয়েছে।

কিছু না ভেবে সামনে বাড়িয়ে রাখা চকলেটে দিলাম এক কামড়।চোখ বন্ধ করে খেয়ে নিলাম।দুটো ট্যাবলেট খুলে মুখে ঢুকিয়ে দিল তিহাম ভাইয়া।বাঁধা দিলাম না।লাভ নেই। তিথি বেচারাও ভয়ে চুপসে গেছে। হয়তো ভাবছে এরকম একটা ডাইনোসরের বংশধরের সাথে কিভাবে বাকি জীবন কাটাবে।কেন জানি ওর জন্য সমবেদনা হচ্ছে। বললাম,

–‘তিথি আমি ঘুমাবো।আর বাসায় পৌঁছাতে কতক্ষণ লাগবে?’

ও বললো–‘চল।বেশিক্ষণ লাগবে না।অর্ধেকের বেশি চলে এসেছি। ‘

গাড়িতে উঠতে নিতেই তিহাম ভাইয়া নরম স্বরে বললো,

–‘স্যরি।চিল্লানো উচিত হয়নি।ভেরি স্যরি।’

এক নজর তাকালাম তার দিকে।লাল চোখ দুটো এখন ছলছল করছে। দেরি করলো না আর।ড্রাইভিং সিটে বসে সানগ্লাস পড়ল।হয়তো চোখের জল লুকানোর জন্য। তার এই মুড সুইং যেনো পারদের উঠানামাকেও হার মানাবে।তিথিকে নিয়ে পেছনের সিটে বসে ওর কাঁধে মাথা রেখে ঘুমিয়ে গেলাম।

গাড়ি এসে বাসার সামনে থামতেই তিথি ডেকে উঠাল।ভিতরে গিয়ে সোফায় বসলাম।মাথাটা প্রচন্ড ভারী।ঘুম দিতে হবে।ওরা কেউ এখনো আসেনি।ভাইয়া বোধ হয় গাড়ি অনেক দ্রুত চালিয়েছে।একটুপর তিহাম ভাইয়া সামনে দাঁড়াতেই নাকে একটা গন্ধ এলো।কপাল কুঁচকে নাক ধরতেই তিথি হেসে বললো,

–‘নিজের বমিতে নিজেই নাক কুঁচকাচ্ছ?তাহলে তিহাম ভাইয়ার কি অবস্থা, ভাব একবার!’

তাকিয়ে দেখলাম ওনার পুরো গেঞ্জি ভেজা।লজ্জার বদলে কেন জানি দেখে ভালো লাগল।অকারণে আমার উপর রাগ দেখানো। বেশ হয়েছে!
তিথিকে বললাম,

–‘ঘুমাবো আমি!’

–‘ফ্রেশ হয়ে নে আগে।’

–‘না।একটু ঘুম দিলে ভালো লাগবে।’

তিহাম ভাইয়া বললো,

–‘সিঁড়ির উপরের সব রুম ফাঁকা। একটাতে গিয়ে ঘুমিয়ে পরো।’

আর দ্বিতীয় কথা না বলে উপরে উঠে প্রথম রুমটাতে ঢুকে বিছানায় দিলাম এক ঝাপ।অন্যের বাসা বলে দরজা লক করলাম না।

(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here