#তুমি_নামক_ব্যাধি
#মুন্নী_আরা_সাফিয়া
#পর্ব_০৮
অন্ধকারের মধ্যে হাত সরানোর চেষ্টা করতে করতে বললাম,
—‘হু দ্যা হেল আর ইউ?’
—‘বউ, আস্তে কথা বলো।নইলে তোমার কন্ঠনালি আর আমার কান,দুটোরই দফারফা হয়ে যাবে।’
তিহাম ভাইয়ার কন্ঠ কানে আসতেই চমকে উঠলাম। অন্ধকারের মধ্যেই দ্রুত বললাম,
—‘ভাইয়া,আমি দিয়ানা।মৃদুলা তাবাসসুম দিয়ানা।তিথি নই।আপনি আবারো সেইম ভুলটা করতে যাচ্ছিলেন।হাত ছাড়ুন।আর লাইট অন করুন। ‘
তিহাম ভাইয়া হাত ছাড়লেন না।উল্টো আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরলো।কয়েক সেকেন্ড যুদ্ধ করে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে লাইট অন করে নিজের মুখের কাছে আঙুল নিয়ে বললাম,
—‘এই দেখুন,আমি দিয়ানা।ভালো করে দেখুন, দিয়ানা।নট তিথি।’
তিহাম ভাইয়া শব্দ করে হেসে উঠলো।আমি ভ্রু কুঁচকে তাকাতেই বললো,
—‘আজ কোনো ভুল হচ্ছে না।সেদিনের ভুলটাকে শুধু শুধরানোর চেষ্টা করছি আজ।’
—‘ভুল?’
—‘হুম।ভুল।সেদিন তোমায় ও ভাবে চলে আসতে দিয়ে যে ভুল করেছিলাম সে ভুলের কথা বলছি।তোমায় ওই দিনই সব বলে দেয়া উচিত ছিল।যদিও তুমি তখন মানতে চাইতে না।আজকেই মানবে কিনা তাতে আমার ঢের সন্দেহ! ‘
—‘আচ্ছা, আপনি কি এই সন্ধ্যারাতেই ডেট ফেইল গাঞ্জা খেয়েছেন?কি বলছেন তার আগামাথা কিছুই মাথাতে ঢুকছে না।’
—‘হা হা।সব বুঝবে আস্তে আস্তে।ও হ্যাঁ,তোমায় বলে রাখি! গাঞ্জার কখনো ডেট এক্সপায়ার্ড হয় না।তার আগে বলো রুমটা সাজানো কেমন হয়েছে!জানো,অনেক ধকল সইতে হয়েছে এত অল্প সময়ে এসব করতে।’
তিহাম ভাইয়ার কথা শুনে ভালো করে তাকালাম চারপাশে।এতক্ষণ উত্তেজনায় কিছু খেয়াল করা হয়নি। চারপাশ তাকিয়ে অবাক না হয়ে পারলাম না।পুরো রুম সাদা গোলাপ দিয়ে সাজানো।অন্য কোনো ফুল নয়,শুধু সাদা গোলাপে ভরপুর। চার দেয়াল ফুলে ছেয়ে আছে।
বেডের উপর সাদা পাপড়ি দিয়ে বিশাল বড় একটা লাভ আঁকা।আর তার ভিতরে অনেক বড় একটা সাদা গোলাপের তোড়া সাজানো।ফ্লোরে চোখ পড়তেই দেখি পায়ের নিচেও সাদা পাপড়ি।সারা রুম গোলাপের গন্ধে টালমাটাল অবস্থা।তীব্র গন্ধে মাথা ধরার উপক্রম হলো।টেবিলের ফুলদানিটার উপর নজর গেল।মনে হচ্ছে একগুচ্ছ সাদা গোলাপ ফুটে আছে।
নিজের অজান্তেই হেঁটে গিয়ে হাত দিয়ে স্পর্শ করলাম।একটু নিচু হয়ে মন মাতানো ঘ্রাণ নিলাম। সাদা তো শুভ্রতার প্রতীক।এতদিন অবধি আমি হাজার ভেবেও আমার প্রিয় ফুল কোনটি তা বের করতে পারিনি।তবে আজ এই শুভ্রতার স্নিগ্ধতা নিজের অজান্তেই এতটা ভালো লেগেছে যে মনে হলো সাদা গোলাপই আমার একমাত্র প্রিয় ফুল।হঠাৎ তিহাম ভাইয়ার কন্ঠ শুনে ঘোর কাটলো।
—‘কি, পছন্দ হয়েছে রুম সাজানো?’
দ্রুতপায়ে উঠে দাঁড়িয়ে সোজা হয়ে বললাম,
—‘তিথির অনেক ভালো লাগবে আর ও অনেক খুশি হবে।’
তিহাম ভাইয়া মনে হলো একটু রেগে গেল।বলল,
—‘আমি তোমার মতামত জানতে চেয়েছি।বলো তোমার কেমন লেগেছে। ভালো লেগেছে? ‘
—‘আশ্চর্য! আমার ভালো লাগা না লাগা দিয়ে কার কি যায় আসে?’কপাল কুঁচকে বললাম।
তিহাম ভাইয়া গম্ভীর গলায় বললেন,
—‘কার কি আসে, যায় না দৌঁড়ায় তা জানা নেই আমার। কিন্তু আমার অনেক কিছু আসে যায়। ‘
—‘আপনার মস্তিষ্কের সব স্নায়ুকোষ কি জট পাকিয়ে গেছে? কিসব চাইল্ডিশ কথাবার্তা বলছেন?হু?’
—‘শোনো,তোমায় এখন কিছু সিরিয়াস কথা বলবো।মন দিয়ে শুনবে।আর মাঝখানে থামিয়ে দিয়ে বিরক্ত করবে না।এমনিতেই আজকের এই দিনের জন্য সাহস যোগাতে আমার বছরের পর বছর লেগেছে। তুমি কি শোনার জন্য মানসিক ভাবে প্রস্তুত?’
শরীরের মধ্যে শীতল রক্ত বয়ে গেল মনে হলো।উপরে ভ্রু কুঁচকে স্ট্রোং হয়ে থাকলেও ভেতরে বুকের মধ্যে ঢিপঢিপ শব্দ হচ্ছে অজানা এক আশংকায়।
মনে হচ্ছে যদি এই মুহূর্তটা আমার জীবনে কোনোদিন না আসতো!আমায় চুপচাপ থাকতে দেখে তিহাম ভাইয়া বেডের উপর থেকে ফুলের তোড়া হাতে নিল।বুক পকেট থেকে একটা বক্স বের করে আচমকা আমার সামনে হাঁটু গেড়ে বসে পড়লো। অনেকটা আবেগ মাখা কন্ঠে বলল,
—‘কিভাবে শুরু করবো বুঝতে পারছি না।এই কয়েক দিনে বেশ বুঝে গেছি যে তুমি অনেক চাপা স্বভাবের। চোখের পলকে রেগে যাও।কথা কম বলো।সবকিছু নিজের মতো করো আর নিজের মধ্যে সব রাখো।কাউকে নিজের খারাপ লাগা বা অনুভূতির সাক্ষী করো না।
নিজের একান্ত অনুভূতি গুলোকে স্বযত্নে শুধুমাত্র নিজের মধ্যেই লালন করো।তোমার একলা রাজ্যে সমস্ত দুঃখ, কষ্ট, বেদনা,হতাশা,ক্ষুদ্র পাওয়া না পাওয়া সমস্ত অনুভূতি তুমি “অনলি মি” করে রেখেছ।যেটা দেখার ক্ষমতা কারো সাধ্যে নেই।তুমি কি তোমার জীবনের সমস্ত “অনলি মি” করে রাখা অনুভূতিগুলোকে “অনলি তিহাম ” করবে? তোমার নিজস্ব ব্যক্তিগত একক রাজ্যে আমায় প্রবেশের এক্সেস অধিকার দিবে?’
নিশ্চল হয়ে দাঁড়িয়ে আছি।এখন মনে হচ্ছে, তিহাম ভাইয়ার নয়, আমার নিজের সমস্ত স্নায়ুকোষ কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে।মন মস্তিষ্কের দরজায় হাজার বার কড়া নেড়েও মুখ খোলাতে পারলো না।তিহাম ভাইয়া আবার বলল,
—‘তোমার এই যে সেকেন্ডে সেকেন্ডে কপাল কুঁচকে থাকা,ভ্রু কুঁচকে কথা বলা,নাক ফুলিয়ে মাঝে মাঝে বসে থাকা এই সব কিছুর প্রেমে পড়ে গেছি।এই কয়দিনে তুমি আমার অভ্যাস হয়ে গেছো আর আমি তোমাতে অভ্যস্ত হয়ে গেছি।
আমি তোমার মতো এত গল্পের বই পড়ি না।তাই হয়তো তোমাকে প্রপার ভাবে প্রোপোজ করতে পারবো না।তবে এইটুকু মাথায় রেখো তোমার প্রতি আমার অনুভূতিতে কোনো খাঁদ নেই।আর আমার এ অনুভূতি দুইদিনের নয়।ভালোবাসি তোমায়।অনেক বেশি ভালোবাসি। ভালোবাসি।ভালোবাসি।ভালোবাসি।’
ছিটকে দুপা পিছনে সরে আসলাম।ভাবতে পারছি না এই ছেলের চরিত্র কতটা নিচ!এতদিন তিথির সাথে প্রেম ভালোবাসার অভিনয় করে, মাত্র কিছুদিন হলো আমাকে দেখে বলছে আমায়ও নাকি ভালোবাসে।রাগে মাথার চুলশুদ্ধ গরম হয়ে গেছে। চেঁচিয়ে বললাম,
—‘ছি!আপনার চরিত্র এই পর্যায়ে নেমে গেছে তা ধারণাতে ছিল না।স্মরণ করিয়ে দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ মি. তাজবীর আজমাইন তিহাম।এই কদিনে আমায় ভালোবেসে ফেললেন?ছি!ভালোবাসা আপনার কাছে এত ঠুনকো?আপনি তো গিরগিটির থেকেও দ্রুত রঙ পাল্টান।আমার সাধ্যে থাকলে তিথির সাথে আপনার বিয়ে কোনোদিনও হতে দিতাম না!’
—‘বলছি তো,তোমার প্রতি আমার অনুভূতি দুদিনের নয়।’
—‘আমার প্রতি আপনার অনুভূতি দুদিনের নয়!তার মানে আপনি বুঝাতে চাচ্ছেন যে আমায় বহু বছর আগে থেকে পছন্দ করেন!আর সেটা আমাকে বিশ্বাস করতে হবে?তিথি মেয়েটা আপনাকে এত ভালোবাসে আর আপনি!কি সুন্দর সাজিয়ে সাজিয়ে মিথ্যে বলে যাচ্ছেন।কাল সকালে আমি বাসায় যাচ্ছি। গুড লাক।’
এখানে দাঁড়ানো এখন আমার রুচিতেও বাঁধছে।কেন জানি নিজেকে বার বার অপরাধী মনে হচ্ছে। তিথি জানতে পারলে কি হবে!ছি!দরজার উপর হাত রাখতেই তিহাম ভাইয়া সব নিচে রেখে দৌঁড়ে এসে দরজার উপর ঠেস দিয়ে দাঁড়ালো।
বললো,
—‘আমি কি তোমায় যেতে বলেছি?বলিনি!আমার কথা এখনো শেষ হয়নি।আমার অনেক কিছু বলার আছে তোমায়।তুমি শুধু আমায় একটু সময় দাও।আমার বলা শেষ না হওয়া পর্যন্ত কোথাও যেতে পারবে না।’
দিলাম ঠাস করে এক চড় বসিয়ে। চেঁচিয়ে বললাম,
—‘সব কিছুরই একটা লিমিট থাকে।ঘৃণা হচ্ছে আপনাকে আমার!শুনতে পাচ্ছেন আপনি?বেয়াদব, বেহায়া, ক্যারেক্টারলেস ব্রাট কোথ……….।’
বাকিটুকু বলার আগেই তিহাম ভাইয়া তার ঠোঁট দিয়ে আমার মুখ বন্ধ করে দিল।এত দ্রুত কি হয়ে গেল মাথাতেই ঢুকছে না যেন।এটা আমার ধারণাতেই ছিল না যে তিহাম ভাইয়া এতটাও নিচে নামতে পারে।ধাক্কা সরিয়ে নাক বরাবর দিলাম এক ঘুষি।ছিটকে নাকে হাত দিয়ে ফ্লোরে বসে পড়লো।
আমি ওড়না দিয়ে ঘষতে ঘষতে ঠোঁটের প্রায় চামড়া উঠিয়ে ফেললাম।মুহূর্তে অভিমানের জল তার চোখ নামের ছোট্ট অথই মহাসাগরকে কানায় কানায় ভরে দিল।যখন তখন বাঁধ ভেঙে চারপাশ প্লাবিত করবে।মুখ দিয়ে কোনো কথা বের হচ্ছে না।
কিন্তু আমি এই ক্রেজি ব্রাটের সামনে কিছুতেই চোখের জল ফেলবো না।দরজা খুলে দৌড়ে গেস্ট রুমে ঢুকে ওয়াশরুমে দরজা আটকালাম।কান্না করবো, আজ আমি মন খুলে কান্না করবো।
____________________________
—‘মা,ভাইয়া কাল সকালে এসে আমায় নিয়ে যাবে, নাকি আমি একাই রওনা দিবো?প্রথম এবং শেষবারের মতো বলছি।’
অনেকটা রুড কন্ঠে বললাম।মা আমার এই কন্ঠের সাথে পরিচিত। শুধু বললো,
—‘ব্যাগ গুছিয়ে রাখ।তোর ভাই রাতেই রওনা দিবে।’
ফোন কেটে দিলাম কিছু না বলে। ব্যাগ গুছিয়ে বাগানের দিকে রওনা দিলাম।নইলে সবার হাজারটা প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে।
তুহিন সবাইকে কি বলেছে জানা নেই। কিন্তু এতক্ষণ পর আসলাম কেউ কোনো প্রশ্ন করলো না।তিথি ডেকে ওর পাশে বসাল।ওর দিকে মায়াভরা দৃষ্টিতে তাকিয়ে মনে মনে বললাম,নিজের অজান্তেই যদি কখনো বিন্দুমাত্র কষ্ট দিয়ে থাকি,তবে ক্ষমা করে দিস প্লিজ।তোকে ভীষণ ভালোবাসি রে!
_________________________
লঞ্চের ডেকে দাঁড়িয়ে আছি।হালকা ঝিরিঝিরি বাতাসে মাথার চুল উড়ছে।আজ ইচ্ছে করে চুল বাঁধিনি।মন বলল, খোলা চুল আমার অনুভূতিগুলোকে লুকিয়ে রাখবে লোকচক্ষুর আড়ালে।ঘন কালো চুলে বিলীন হয়ে যাবে কাল রাতের সব ঘটনা।
ডান হাতের দিকে তাকালাম। মেরুন রঙের খামে মোড়া সেই চিঠিটা।তিহাম ভাইয়া বার বার বলেছিল চিঠিটা পড়তে।কেন?তা আমার জানা নেই। কিন্তু আমার বিবেক পড়তে দেয়নি।তিথিকে লেখা চিঠি আমি যে কিছুতেই পড়তে পারি না।
ডেকের নিচে আমার চুলের মতোই কুচকুচে কালো পানিকে লঞ্চ চলছে আপন গতিতে।পানিতে হালকা ঢেউ নিয়ম মেনে খেলছে।জগতের সবকিছুই নিজেকে নিয়মের মধ্যে রাখলেও মানুষ তা পারে না।ঢেউ খেলানো পানির দিকে তাকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে চিঠিটা ফেলে দিলাম।বাতাসের সাথে যুদ্ধ করতে করতে দুলতে দুলতে পানিতে গিয়ে পড়ল।এত উঁচু থেকে কেমন ভেলার মতো লাগছে চিঠিটাকে।মনে হচ্ছে, বেহুলার মনের সমস্ত গোপন কথা ভেলায় ভেসে লক্ষীন্দরের কাছে যাচ্ছে।
আল্লাহ কেন যে মানুষের মনে এত মায়া দিয়ে পৃথিবীতে পাঠালো! মাত্র কয়েকটা দিন ছিল চিঠিটা আমার কাছে। কিন্তু মনে হচ্ছে বড্ড মায়া পরে গেছে! আর তাকালাম না।কেবিনে চলে আসলাম।বড় ভাইয়া পরম শান্তিতে ঘুমাচ্ছে। তবুও কেন জানি মনে হলো………………….
(চলবে)
1/