তোমাকে চাই পর্ব ১

‘প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পরও কেন বিয়ে করতে চাইছো না? বলবে বলবে করেও কেন পরিবারকে বলতে পারছো না আমার কথা? তোমার সমস্যাটা কোথায়? নাকি কখনো আমাকে ভালোই বাসোনি?’

তৌকিরের শার্টের কলার টেনে দাঁতে দাঁত পিষে বলল অনন্যা। চোখের কোণে উপচে পড়া মেঘরাশি আনাগোনা।

তৌকির আশেপাশে নজর বুলায়। উপস্থিত সবার মনোযোগ এখন তাদের দিকে। কেমন বাঁকা চোখে তাকিয়ে আছে মানুষগুলো। কলার থেকে হাত সরিয়ে মিনমিনে গলায় বলে,

‘মানুষ দেখছে অনন্যা।’

তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠে অনন্যা। অগ্নি ঝরা কন্ঠে বলে,

‘দেখুক মানুষ।’

তৌকির শান্ত স্বরে বলল,

‘পাগলামি করো না। মাথা ঠান্ডা করো তুমি। পাবলিক প্লেস এটা। সবার সামনে সীন ক্রিয়েট করো না।’

নরম হয়ে এলো অনন্যার গলার স্বর।

‘কেন শান্ত হবো বলতে পারো? আমার বয়স টা কি আমার বাড়ছে না কমছে? বাবা মা আমার জন্য টেনশন করে ম*রছে। একের পর এক অজুহাতে আর কত বিয়ে ভাঙবো আমি? সমবয়সী সবাই স্বামী সন্তান নিয়ে বাবার বাড়ি বেড়াতে আসে। আর আমি? আমি এখনো নিজের বিয়ে ঠেকাই তোমায় পাওয়ার আশায়। সবার কটু কথা শুনি। সুযোগ পেলেই কথা শুনাতে ভুল করে না লোকজন। তুমি তো বেকার নও। যদি বেকার হতে তাও মনকে বুঝাতে পারতাম। বেকারত্বের জন্য কিছু করতে পারছো না। কিন্তু এমনটা তো না। ভালো মানের চাকরি করার পরও কেন পিছিয়ে যাচ্ছো? বিয়ে ভাঙতে ভাঙতে আমি ক্লান্ত। আর পারছি না।’

নিজের সমস্ত অভিযোগ নির্দ্বিধায় বলে দু’হাতে চোখের পানি মুছে নিলো অনন্যা। চোখের কাজল লেপ্টে গেল আশেপাশে। তৌকির লেপ্টে যাওয়া কাজল সযত্নে মুছে দিতে চাইলে পিছিয়ে আসে সে। মলিন স্বরে পুনরায় বলে,

‘তোমার সমস্যাটা আসলে কোথায় আমি তোমায় বলছি। তোমরা প্রেম করার সময় খুঁজো ম্যাচিউরিটি। আর বিয়ে করার সময় খুঁজো ষোড়শী কিশোরী। একেবারে কচি মেয়ে। এক বছর, দুই বছর আমায় বিয়ে করবে বলে ঘুরাবে। তারপর বলবে বাবা মা মানবে না। তোমার বয়স বেশি। আমায় ভুলে যাও। নয়তো কোনো কচি চাচাতো, মামাতো কিংবা ফুফাতো বোন এসে হাজির হবে তোমায় বিয়ে করার জন্য।’

‘অনন্যা তুমি আমায় ভুল বুঝছো। আমি তোমায়,,,,

ফিচেল হাসে অনন্যা। তৌকির কে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে আবারও বলে,

‘আমি ভুল বুঝতেছি না। যে প্রেমিক প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পরও নিজের প্রেমিকাকে বিয়ে করে না। সে আর কোনোদিন বিয়ে করবেও না। তাই একেবারে ভেঙে গুড়িয়ে যাওয়ার আগেই নিজেকে সামলে নিচ্ছি। তুমি মুখ ফুটে কিছু বলার আগেই তোমার পথ থেকে সরে দাঁড়ালাম। আত্মসম্মানবোধ আমার একটু বেশি কিনা।’

কথাগুলো বলে যত্ন করে রাখা তৌকিরের দেওয়া উপহারগুলো তার হাতে দিয়ে উল্টোপথে হাঁটা ধরে।

স্তম্ভিত, হতবিহ্বল তৌকির। অবাক চোখে তাকিয়ে আছে।

‘কিসব পাগলামি করছো অনন্যা? আমার কথাটা তো শুনবে।’

দাঁড়ায় অনন্যা কিন্তু পিছু ফিরে না।

‘আজ আমি শুনতে আসিনি। এসেছি বলতে। আমার বলা শেষ। ভালো থেকো নতুন কাউকে।’

অনন্যার যাওয়ার পানে নিষ্প্রভ চোখে তাকিয়ে আছে তৌকির। পিছু ডাকতে গিয়েও ডাকে না। আশেপাশের মানুষ কেমন অদ্ভুত চোখে দেখছে। মুখে মাস্ক লাগিয়ে সেও চলে গেল নিজ গন্তব্যে।

__________________________

ত্রিশ রোজা শেষ হওয়ার পর ঈদের দিন আজ। উৎসব উৎসব আমেজ সবদিকে।

অনন্যার মা হরেক রকম পদ রান্না করছেন। ভোরে উঠে রান্না শুরু করছেন তিনি। ন’টা বাজতে চলল এখনো রান্না শেষ হয়নি।

ভ্রু কুঁচকে তাকায় অনন্যা। কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম। গরমে ঘেমে গায়ের জামা ভিজে চুপ চুপে।

‘এতোকিছু কেন রান্না করছো আম্মু? এতোসব কে খাবে? মেহমান যারা আসে কেউ এক চামচ খায়। আবার কেউ খায়ও না। আমি আর অর্পা তো এসব মিষ্টি জাতীয় খাবার পছন্দও করি না। কেন শুধু শুধু এতো কষ্ট করছো?’

‘ত্রিশটা রোজা রাখলাম আর আজ ঈদের ভালোমন্দ রান্না করবো না? আমাদের উৎসব মানেই তো ঈদ।’

‘ভালোমন্দ রান্না করতে তো নিষেধ করিনি। তাই বলে এতোকিছু রান্না করবে? অপচয় হবে তো মা।’

ফুস করে নিঃশ্বাস ফেলে অনন্যার মা।

‘তোর ভালো না লাগলে তুই তোর রুমে চলে যা। এটা ওটা বলে জ্বালাবি না একদম। আমার রান্নায় ভুল হয়। তোর কথা শুনতে গিয়ে কি থেকে কি দেউ মনে থাকে না।’

কথা আর বাড়ায় না অনন্যা। নিজের কাজে নন দেয়।

সহসা তিনি অনন্যাকে বলেন,

‘তোর আর কিছু করতে হবে না। ঈদের দিন গোসল করে পরিপাটি হয়ে থাক।’

‘কাজটা শেষ করে যাই?’

পেঁয়াজ গুলো নিজের হাতে নিয়ে তিনি পুনরায় বলেন,

‘আমি সামলে নিতে পারবো তুই যা।

রাস্তায় ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা নতুন জামা গায়ে জড়িয়ে ছুটোছুটি করছে। কেউ আইসক্রিম খাচ্ছে। কারো হাতে হাওয়াই মিঠাই। জানালা দিয়ে একমনে এসব দেখে চলেছে অনন্যা। পলকহীন চাহনি। অন্তঃস্থলে বয়ে যাচ্ছে কাল বৈশাখী ঝড়। চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে যাচ্ছে সব।

আকস্মিক হাতের স্পর্শে ধ্যান ভঙ্গ অনন্যার। অর্পা গোসল সেরে নতুন জামা পরেছে।

‘আমায় কেমন লাগছে আপু?’

বোনের দিকে তাকিয়ে একগাল হাসে সে।

‘খুব সুন্দর।’

‘তাড়াতাড়ি তুমিও গোসল সেরে নাও।’

বলেই সে ড্রেসিং টেবিলের সামনে গেল সাজার জন্য।

অর্পা সামনে থেকে যেতেই তপ্ত শ্বাস ফেলে অনন্যা। হাতে থাকা মোবাইলের দিকে তাকায়। সেইদিনের পর মোবাইল বন্ধ রেখেছিল সে। সমস্ত সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম থেকে ছিল দূরে। আজ সকালে ঘুম থেকে উঠেই আগে মোবাইল অন করেছে। মনের মধ্যে যেই মানুষটার বাস তার একটা বার্তা পাওয়ার জন্য। আমরা প্রিয় মানুষের সাথে যতই রাগ করি না কেন। যতই মুখে বলি না কেন তোমার সাথে আমার সম্পর্ক নেই। তারপরও আশা রাখি সে আমাদের রাগ ভাঙাবে। আমাদের অভিমান বুঝবে। একবার বলবে, ‘তুমি বললেই বুঝি সব শেষ হয়ে যাবে?’ আফসোস এমনটা সব সময় হয় না।

তৌকির অনন্যাকে কল থাক একটা ছোট্ট মেসেজও দেয়নি। বলনি পাগলামি করো না। আমি তোমায় অনেক ভালোবাসি। কান্না পেয়ে গেল তার। তার মানে তৌকির তাকে ভালোবাসে না। সবটা অভিনয় তার। টাইম পাস করেছে। ভালবাসলে এক মাসে অন্তত যোগাযোগের চেষ্টা করতো।

_______________________

দুপুরে গড়িয়ে বিকেল হওয়ার পথে। মায়ের বকুনি শুনে শেষ পর্যন্ত গোসল সেরে নতুন জামা পরেছে অনন্যা। চুল থেকে টপটপ করে পানি ঝরছে। অনন্যার মা তার চুল মুছতে মুছতে আপনমনে বকবক করছে।

‘মা যেভাবে বকাঝকা করে খাওয়াই। গোসল করতে বলি। পরের মা করবে এসব? নিজের যত্ন নিজেই নিতে শিখ। বড় হয়ে গেলি এখনো নিজের যত্ন নিস না। ঈদের দিন এখনো অব্দি কিছু মুখে দিলি না। আমি মা। সন্তান কিছু না খেলে আমার ভালো লাগে?’

‘আহ্! থামবে মা? আমার তো খিদেই পাচ্ছে না। কি খাবো আমি?’

তন্মধ্যে অনন্যার বাবা এসে উপস্থিত হয় সেখানে।

‘তুমি এখানে? ওইদিকে উনারা চলে এসেছে।’

‘তুমি যাও আমি আসছি।’

অনন্যা তার মাকে প্রশ্ন করে,

‘কে আসবে মা?’

‘ছেলে পক্ষ।’

চট করে বসা থেকে দাঁড়িয়ে পড়ে অনন্যা।

‘কি? ঈদের কে মেয়ে দেখতে আসে মা? এসব কি ধরনের কথাবার্তা? এইজন্য তুমি এতো রান্নাবান্না করছো?’

‘আমরাই বলেছি ঈদের দিন আসার জন্য। তুই রেডি হয়ে নে মা।’

বলেই তিনি চলে গেলেন।

কিংকর্তব্যবিমূঢ় অনন্যা। মায়ের কথা শুনে স্তব্ধ হয়ে গেল। তিনি চলে যেতেই সমস্ত রাগ, অভিমান ভুলে তৌকিরের নাম্বারে ফোন লাগায় সে। তবে তার আশায় এক বালতি জল ঢেলে ওপাশ থেকে ভেসে এলো মেয়েলি কন্ঠস্বর।

‘আপনি যে নম্বরে কল করেছেন এই মুহুর্তে তা বন্ধ আছে। দ্য নাম্বার ইউ হ্যাভ ডায়াল ক্যান নট বি রিচড।’

কান থেকে মোবাইল নামায় সে। চোখে টলমল করছে অশ্রুকণা। ভেজা কন্ঠে বলে,

‘তুমি আমায় কখনো ভালোবাসোনি তৌকির। ভালবাসলে আমার একটা কথায় এভাবে ছেড়ে দিতে পারতে না। না এতোদিন আমার সাথে যোগাযোগ বিহীন থাকতে৷ তুমি চেয়েছিলে আমি যেন তোমায় নিজ থেকে মুক্তি দেই। তবে নাও মুক্তির স্বাদ।’

#তোমাকে_চাই (০১)
রূপন্তি রাহমান (ছদ্মনাম)

দুই পর্বের অণুগল্প এটা। পরের পর্বে শেষ করে দেওয়া হবে। আশা করি রেসপন্স করবেন। আর ভুলত্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here