তোমাকে শুধু তোমাকে চাই
একাদশ পর্ব
সোমবার সকাল থেকেই অনিমার খুব অস্থির লাগতে লাগলো I স্নান সেরে তৈরি হতে গিয়ে বুঝলো , আজ অন্য দিনের চেয়ে বেশি সময় নিচ্ছে শাড়ি বাঁছতে I নিজের উপর বিরক্ত হয়ে, একটা বাটা মেহেদী রঙের মনিপুরী তাঁতের শাড়ি টেনে নিল আলমারির তাক থেকে Iসাধারণত ক্লাসে যাবার আগে ও সাজে না I আজও সাজলো না I শুধু গারো করে কাজল দিল I এলো খোপা বেঁধে , রুপালি কাটা দিয়ে আটকে নিল I সোনালী কাটাটা সেদিন হারিয়ে গেছে বিয়ের অনুষ্ঠানে I
ক্লাসে ও মন বসাতে পারল না অনিমা I সারাদিন মাথার মধ্যে একটাই চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছিল Iকি কারনে ডেকেছে ওকে ? এতদিন বাদে কি আর বলার থাকতে পারে I
ঠিক চারটায় মুনির মেসেজ দিল নিচে নামতে I অনিমা নিচে নেমে এলো I এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখল রাস্তার উল্টাদিকে গাড়িতে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে মুনির I আজ ওর পরনে একেবারে ক্যাজুয়াল পোশাক I অফ হোয়াইট ফতুয়া-জিন্স আর চটি I অনিমাকে দেখে একটু হাসল I আজও আগের মতোই গাড়ির দরজা খুলে দিল I তবে পেছনের না সামনেরটা I
– লাঞ্চ করেছো ? গাড়িতে উঠার পর মুনির জানতে চাইল
– হ্যাঁ ? তুমি ?
– হ্যাঁ I চলো তাহলে যাওয়া যাক
অনিমা আর কিছু বলল না I ও ঠিক করে রেখেছে আজ একটু ও ঝগড়া করবে না I এখন আর সেই সম্পর্ক নেই ও I ঝগড়া তো তার সঙ্গে করা যায় ,যার প্রতি অধিকার থাকে I এখন আর কিছুই অবশিষ্ট নেই ওদের মধ্যে I আগেতো নিত্যদিন ঝগড়া লাগতো I মাঝে মাঝে তো অনিমার মনে হতো মুনির ইচ্ছা করে ঝগড়া বাধায় I একবার মিউজিয়াম দেখানোর নাম করে ওকে অন্য জায়গায় নিয়ে যাওয়াতে অনিমা ভীষণ রেগে গিয়েছিল I বিশাল তুলকালাম হয়েছিল সেবার I
সেদিন ক্লাস ক্যান্সেল হয়ে গিয়েছিল I অনিমা তড়িঘড়ি বাস ধরার জন্য যাচ্ছিল Iহঠাৎ করেই মুনির এসে বলেছিল
– কোথায় যাচ্ছ ?
– কার্জন হলে I বাস ধরতে
– এত তাড়াতাড়ি ফিরে গিয়ে কি করবে ? চলো তোমাকে মিউজিয়াম দেখিয়ে আনি
ঢাকার মিউজিয়াম এর ব্যাপারে অনেক শুনেছে অনিমা I ওর খুব শখ ছিল দেখার I তাই রাজি হয়ে গেল I রিক্সায় উঠে গল্প করতে করতে খেয়াল ছিল না I যখন রিকশা থামল অবাক হয়ে বলল
– এটা কোথায় নিয়ে এসেছ ? এটাতো মিউজিয়াম না I এটাতো লালবাগের কেল্লা
– চলোই না ভিতরে
মুনির টিকেট কেটে ওকে ভিতরে নিয়ে গেল I সামনে বেশ বড় একটা বাগান মাঝখানে ইট বিছানো পথ I বাগানটা পার হয়ে একটা পাথরের বাঁধানো চত্বর I মুনির ব্যাগ রেখে বসে পড়ল I তারপর বলল
– কি হলো ? বস
– আমি এখানে বসবো না I
– কেন ?
– তুমি মিউজিয়ামের কথা বলে আমাকে এখানে কেন আনলে ?
– এখানে ও একটা মিউজিয়াম আছে I দেখাচ্ছি I আগে একটু বসো
অনিমা বসলো I আশেপাশে তাকিয়ে বলল
– এটা কি ?
– এটা পরিবিবির মাজার I
– মাজার দেখার কি আছে ?
– তাজমহল ও কিন্তু মাজার
– তুমি নিশ্চয় আমাকে তাজমহলে আনোনি
– তুমি একটা বেরসিক মানুষ I যত্তসব কাঠখোট্টা জিনিস পছন্দ
– আর তোমার সব ভৌতিক জিনিস পছন্দ
– এখানে ভৌতিক এর কি আছে ? তোমার মাথা নষ্ট
– আমার মাথা নষ্ট ? আমার ?
– শুধু মাথা নষ্ট না তুমি একটা বদ্ধ উন্মাদ I
অনিমা রেগেমেগে গটমট করে হাঁটতে হাঁটতে গেটের দিকে চলে গেল I মুনির ও আর রাগ করে ওকে আটকালো না I কিন্তু চলে যাবার পর খুব মন খারাপ লাগতে লাগলো I ধুর ! কেন যে ও শুধু শুধু ওকে রাগায় I তারপর নিজেরই মন খারাপ লাগে I
দু দিন পর্যন্ত অনিমা রাগ করে মুনিরের ফোন ধরল না I এমনকি ক্লাসে ও গেল না I তৃতীয় দিনের দিন রাত জেগে পড়াশোনা শেষ করে যখন ঘুমোতে যাওয়ার আয়োজন করছে তখন মুনিরের মেসেজ এল I মেসেজ দেখে রাগ করার বদলে হেসে ফেললো অনিমা I মুনির লিখেছে
তুই নাই বলে ওরে উন্মাদ
পান্ডুর হল আকাশের চাঁদ
কেঁদে নদী–জল করুণ বিষাদ
কেঁদে নদী–জল করুণ বিষাদ
ডাকে, “আয়, ফিরে আয়”
অনিমার মনে হল এর পরের দুটো লাইন লিখলে কি হতো ? তাহলেই তো ওর সব রাগ চলে যেত I
এত কথা বলতে পারে আর একটা সামান্য কথা বলতে পারছেনা I অনিমার মনটাই ভালো হয়ে গেল Iপরের লাইনগুলি গুনগুন করতে করতে ও বারান্দায় চলে গেল I
শূন্য এ বুকে পাখি মোর আয়
ফিরে আয়, ফিরে আয়
তোরে না হেরিয়া সকালের ফুল
অকালে ঝরিয়া যায়
আকাশে সেদিন বিশাল থালার মতন চাঁদ I অনিমা মুগ্ধ চোখে চেয়ে রইল I হঠাৎই খুব ইচ্ছে হলো একটু কথা বলতে I কি জানি কি যোগাযোগ ছিল ওদের মধ্যে I সেই সময়ই ফোনটা এলো I মুনির হালকা গলায় জিজ্ঞেস করলো
– কি করো ?
– তোমার পান্ডুর চাঁদ দেখি
– বল কি ? তুমি চাঁদ ও দেখ নাকি ? আমি তো ভেবেছিলাম তুমি শুধু মমি আর ফসিল দেখতেই পছন্দ করো
ভালো মেজাজটা আবার খারাপ হয়ে গেল অনিমার I থমথমে গলায় বলল
– তুমি আমাকে ফোন করেছ কেন ? সুস্থ মস্তিস্কের কাউকে পাওনি ?
– না I মনে হচ্ছে তোমার সঙ্গে থাকতে থাকতে আমি ও উন্মাদ হয়ে গেছি I
– হয়ে যাও নি ,তুমি আগে থেকেই ছিলে
-আগে থেকেই কি ছিলাম ?
অনিমা চমকে পাশ ফিরে তাকালো I তারপর এক হাতে কপাল চেপে ধরে বলল
– কিছু না
মুনির হাসতে হাসতে সামনে তাকিয়ে ,স্টীয়ারিং-এ হাত রেখেই বলল
– তোমার পুরোনো স্বভাব এখনো যায়নি, তাই না ? এখনো মনে মনে কথা বলতে বলতে জোরে বলে ফেলো ?
অনিমা জবাব দিল না I মনটাই খারাপ হয়ে গেল I কত কত স্মৃতি আছে মনের অতলে তলিয়ে I কখনো তোদের নেড়েচেড়ে দেখে না ও I সব পাথর চাপা দিয়ে রাখে I শুধু শুধু কেন এতদিন পরে এসে আবার সেই পাথর চাপা স্মৃতি গুলিকে জাগিয়ে তুলছে ও ?
গাড়ি থেকে নেমে চমকে গেল অনিমা Iমুনির ওকেএখানে কেন এনেছে এত বছর পর আবার ? আজও আগের দিনের মতোই মুনির টিকিট কেটে ওকে ভিতরে নিয়ে গেল I তারপর পাথরে বাঁধানো চত্বরে এসে স্যান্ডেল খুলে বসতে বসতে বলল I
– আজকে বসবে তো ? নাকি সেদিনের মতো রাগ করে চলে যাবে ?
অনিমা বসলো Iপাথরের মেঝেটা বেশ ঠান্ডা Iডিসেম্বরের শেষ , বাতাসে শীতের আমেজ I বসার পর শীত করতে লাগল অনিমার I মুনির হঠাৎ কোত্থেকে একটা চাদর এনে পেছন থেকে ওর গায়ে দিয়ে দিল I হঠাৎই চোখে পানি এসে গেল অনিমার I এই ছেলেটা মাঝে মাঝে এমন সব কাণ্ড করে I
অনেকক্ষণ দু’জনের কেউ কোনো কথা বললো না I শীতের বিকেল I প্রায় সন্ধ্যা হয়ে এসেছে I অনিমা হাঁটুর উপর চিবুক রেখে অন্য দিকে তাকিয়ে বসে রইল I তারও অনেকক্ষণ পর আঁধার নেমে আসছে দেখে বলল
– রাত হয়ে যাচ্ছে আমাকে ফিরতে হবে I
-বাসায় ফোন করে দাও I বল ফিরতে দেরী হবে I
মুনির আজও আগের মতোই অধিকার নিয়ে কথা বলে I অনিমা জড়তা ঝেড়ে ফেলে সামনের দিকে তাকালো I আজ এটা শেষ করতে হবে I এভাবে চলতে দেয়া যায় না I নিজে থেকেই বললো
-আমাকে এখানে কেন নিয়ে এসেছো ? কিছু বলতে চাইলে বলো I
– বলতে না ,শুনতে চাই
– কি শুনতে চাও ?
-আমাকে বিয়ে করবে ?
চলবে………..তোমাকে শুধু তোমাকে চাই
দ্বাদশ পর্ব
অনিমা একটু কেঁপে উঠে বলল
– কি বললে ?
– বিয়ে করবে আমাকে ?
অনিমা ওর সমস্ত দুর্বলতা ঝেড়ে ফেলে কর্কশ কন্ঠে বলল
– না
মুনিরের কোন ভাবান্তর দেখা গেল না I যেন ও জানতই যে এমনি একটা কিছু শুনতে হবে I
ও আগের মতোই স্বাভাবিক কন্ঠে বলল
– বিয়ে করতে চাও না , নাকি আমাকে বিয়ে করতে সমস্যা ?
– বিয়ে করতে চাই না, আর তোমাকে তো একেবারেই না
– প্রথমটার কারন বুঝলাম ,কিন্তু দ্বিতীয়টার কারণ ঠিক বুঝতে পারলাম না
– কেন ? তুমি কি এমন রসগোল্লা যে তোমাকে বিয়ে করার জন্য নাচ্তে থাকবো
– সাত বছর আগে যদি তোমাকে এই প্রস্তাবটা দিতাম তখনো কি তুমি এই উত্তর দিতে ?
– সাত বছর অনেকটা সময় মুনির I এই সাত বছরে অনেক কিছু বদলে গেছে I কোন কিছুই আর আগের মতন নেই I আমি ও না
এরপর উঠে দাঁড়িয়ে বলল
– আমাকে যেতে হবে অনেক দেরি হয়ে গেছে I আশা করি তুমি তোমার জবাব পেয়ে গেছো I
-দাঁড়াও অনিমা
অনিমা থামল I মুনির কাছাকাছি এসে ওর মুখোমুখি দাড়িয়ে বললো
– আমাদের মধ্যে কি আর কিছুই নেই ? এমন কি আমাদের বন্ধুত্ব ও না ?
– না I বন্ধুত্ব তুমি নিজের হাতে নষ্ট করেছো I
– আমি ? আমি নষ্ট করেছি ?
– হ্যাঁ তুমি I বন্ধুত্বের মধ্যে দয়া করুণার কোন জায়গা থাকে না I তুমি সেটাই আমাকে দেখিয়েছো
– তুমি তো আমাকে সেটা ও দেখাও নি I
-মানে ?
– তোমাকে আমি কতবার মেসেজ করেছি, যে কোথায় আছো একটু বল I তোমাদের বাসায় গেছি ,সদর হাসপাতালে আছি I তুমি দয়া করে আমাকে তোমার ঠিকানাটা বলতে পারলে না ?
অনিমা বিস্ময় হতবাক হয়ে গেল I তারমানে মুনির ওকে খুঁজতে এসেছিল I আর এতোগুলো দিন ধরে ও ভাবছে মুনির ওকে ভুলেই গেছে I অনিমা বিস্ফোরিত চোখে তাকিয়ে থেকেই কোনমতে বলল
– তুমি পঞ্চগড় এসেছিলে ?
– শুধু পঞ্চগড় না আমি রংপুরে ও গিয়েছিলাম I সারা হসপিটাল তোমাদেরকে তন্ন তন্ন করে খুঁজেছি I তোমাকে হাজার বার মেসেজ করেছি যে কোথায় আছো একটু বল I তুমি কোন জবাব দাওনি I আর আমাকে শোনাচ্ছো যে আমি বন্ধুত্ব নষ্ট করেছি
– আমার ফোন হারিয়ে গিয়েছিল I আর যাই হোক I এত যদি আমাকে বন্ধু মনে করো , তাহলে নীলার কথা আমাকে বলোনি কেন ? তাহলে তো আর এত ভুল বোঝাবুঝি হতো না I
– আমি তোমাকে বলতাম I
– কবে বলতে ? তোমাদের বিয়ে পর ?
– আমি তোমাকে কয়েকবার বলতে চেয়েছি I কিন্তু
– কিন্তু কি?
মুনির আরো একটু কাছে এগিয়ে এসে বলল
– না বলে তো ভালোই হয়েছে I বললে তো জানতেই পারতাম না যে তুমি আমাকে ভালোবাসো I তুমিও তো কখনো বলোনি I
অনিমা জবাব দিল না অস্বস্তি নিয়ে অন্য দিকে তাকিয়ে রইল I তারপর একসময় বলল
– বললে কি হত ? তুমিতো আর আমাকে ভালোবাসতে না
– এটা সত্যি না I আমি নিজেকে বুঝতে পারিনি Iআমি শুধু তোমাকেই ভালোবেসেছি I যতবার তোমার কাছে …..
– তোমার এই ব্যাপারটাই আমার অসহ্য লাগে I
– কোনটা ?
– আমাকে একটা কথা বলI তিন ঘণ্টা আগে তুমি একটা মেয়েকে প্রপোজ করলে আর তিন ঘন্টা পর তোমার মনে হল তুমি অন্যজনকে ভালোবাসো ?এর মানে কী ?
– আমি জানতাম তুমি এরকমই করবে I আমি তোমাকে যতই বোঝাই না কেন তুমি বুঝবে না I আমি তখনও তোমাকে বলতে চেয়েছি ,তুমি শোনোনি I এখনো শুনতে চাইছো না I তোমার মত ঘাড়ত্যড়া একটা মেয়ে এরকমই করবে I এটাই স্বাভাবিক I
অনিমা রাগে কাঁপতে কাঁপতে বলল
– আমি ঘাড়ত্যড়া ?
– কেন ? এর আগে কেউ তোমাকে এই কথা বলেনি ?
রাগে অনিমার সমস্ত শরীর জ্বলতে লাগলো I এই কথা ওর মা ওকে সবসময় বলে I সারাক্ষণই বলে তোর মত ঘাড়ত্যড়া মেয়েকে যে বিয়ে করবে সেই বুঝবে I অনিমা কোনমতে নিজেকে ঠান্ডা করে বলল
– তাহলে আমার মত ঘাড়ত্যড়া মেয়েকে বিয়ে করার জন্য ব্যস্ত হচ্ছ কেন ? আর কাউকে খুঁজে পাচ্ছো না ?
মুনির যেন এই প্রশ্নটার অপেক্ষাতেই ছিল
– এটাই তো সমস্যা Iগত সাত বছর ধরে চেষ্টা করেও তোমাকে আমার মাথা থেকে বের করতে পারছিনা I অনেক চেষ্টা করেছি I বারবার চেয়েছি যে তোমাকে নিয়ে আর ভাববো না I আর তোমাকে মনে করবো না I কিন্তু পারিনি I বিশ্বাস করো যখন যেখানে গেছি এক মুহূর্তের জন্য তোমাকে ভুলে থাকতে পারিনি I নিজের কাছ থেকে পালাতে এত দূরে চলে গেছি I তবু পারিনি I আমার ভেতরে পুরোটা জুড়ে আসন গেড়ে বসে আছো তুমি I আমার চাইতে অসহায় মানুষ এই পৃথিবীতে আর একটিও নেই I
অনিমা বিস্ময়ে হতবাক হয়ে তাকিয়ে রইল I মুনিরের চোখ ভিজে উঠেছে I এক হাত তুলে ও চোখ মুছে বলল
– আমি জানতাম তুমি বুঝবে না I বোঝার কথা নয় I এতগুলো বছর তোমার থেকে দূরে ছিলাম এর থেকেও কোন জিনিসটা আমাকে বেশি কষ্ট দেয় জানো, যে তোমার দুঃসময় আমি তোমার পাশে থাকতে পারলাম না I
অনিমা কেমন স্তব্ধ হয়ে গেল I চারিদিকে তখন আধার নেমে এসেছে I আবছা অন্ধকারে মুনিরের মুখের দিকে তাকিয়ে বহুকাল আগের স্মৃতি গুলো ফিরে আসছে Iকি ভীষণভাবে চেয়েছিল ও মুনিরকে I কখনো ভাবতেই পারিনি যে ও অন্য কাউকে ভালবাসতে পারে I মুনির এগিয়ে এসে ওর একটা হাত ধরে বলল
– চল তোমাকে বাড়ি পৌঁছে দেই I
পুরোটা পথ দুজনের কেউই কোনো কথা বলল না I মুনির ওকে বাড়িতে নামিয়ে দিয়ে চলে গেল I সারারাত ধরে ছটফট করল অনিমা I সকালে পরপর তিনটা ক্লাস I ঘুমানো দরকার I কিন্তু এক ফোঁটা ঘুম এলো না I
ক্লাস শেষ করে অফিস রুমে ঢুকেই অনিমা বুঝল কিছু একটা সমস্যা হয়েছে I সবাই নিচু স্বরে কথা বলছে I অনিমা এগিয়ে এসে একজনকে জিজ্ঞেস করল
– কি হয়েছে ?
– রাবেয়া ম্যাডাম তোমাকে ডাকছে
ম্যাডামের রুমে ঢুকে অনিমা একটু অবাক হলো Iম্যাডামের মুখ থমথমে I উনি বাইরে যাবার জন্য তৈরি হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন I ওকে দেখে বললেন
– অনিমা জানি তুমি আজকে চারটা ক্লাস নিচ্ছো I কিন্তু আমার থার্ড ইয়ারের ক্লাসটা তোমাকে নিতে হবে I আমি হসপিটালে যাচ্ছি I আর দেবরের ছেলেটা এক্সিডেন্ট করেছে I এখনই বের হতে হবে I
অনিমার মনে হল চার পাশটা কেমন যেন শূন্য হয়ে গেছে I কোনমতে ঘাড় কাত করে ও ঘর থেকে বেরিয়ে এলো I পা টলছে I পা দুটো অনেক ভারী মনে হচ্ছে I অনিমা প্রথমে ধীর পায়ে কয়েক পা এগুলো তারপর দৌড়াতে দৌড়াতে করিডরে চলে গেল I এলিভেটর এর সামনে এসে টের পেল দুই চোখ বেয়ে জলের ধারা রয়েছে I এলিভেটর এর সামনে অনেক ভিড় I ছাত্র-শিক্ষক সবাই দাঁড়িয়ে আছে I ওকে এই অবস্থায় দেখে অনেকেই একটু অবাক হয়ে গেল I অনিমা পিছিয়ে গেল I তারপর পেছনের দিকে সিঁড়ির দিকে দৌড়ে গেল I এই সিঁড়িটা সচরাচর কেউ ব্যবহার করে না I আলো তেমন একটা নেই I লোক চলাচল ও কম I অনিমা দৌড়াতে দৌড়াতে নিচে নামতে লাগলো I চোখ ঝাপসা হয়ে আছে I তিনতলার কাছাকাছি এসে হঠাৎ শাড়িতে পা বেঁধে গেল I নিজের উপর কোন নিয়ন্ত্রন নেই I পা পিছলে কয়েকটা ধাপ একটানে পার হয়ে একেবারে নিচের ধাপে এসে কারো সঙ্গে সজোরে ধাক্কা খেলো I যে উপরে উঠছিল সে ওকে দু’হাতে আগলে নিয়ে অবাক কন্ঠে বলল
– কি হয়েছে অনিমা ?
অনিমা হতভম্ব হয়ে কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে রইল Iতারপর দুই হাতের করতলে মুনিরের মুখটা ধরে বলল
– তুমি ঠিক আছো ?
মুনির আশ্চর্য হয়ে বলল
– আমি তো ঠিকই আছি i তুমি তো পড়ে গেলে
অনিমা দুই হাতে মুনিরকে আকড়ে ধরল I তারপর বুকের মধ্যে মুখ গুঁজে হু হু করে কেঁদে উঠলো I মুনির ভয় পাওয়া গলায় বলল
– কি হয়েছে অনিমা ? কি হয়েছে বল আমাকে ?
অনিমা ওইভাবেই কাঁদতে কাঁদতে বলল
– ম্যাডাম বলছিল তোমার অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে
মুনির হেসে ফেললো I অনিমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলল
– আমার না ,শুভর এক্সিডেন্ট হয়েছে I গাড়ির সঙ্গে ধাক্কা লেগে পা ভেঙে ফেলেছে I আমি চাচীকে নিতে এসেছি I
অনিমা হঠাৎ করে নিজেকে সামলে নিল I সরে গিয়ে দেয়ালে হেলান দিয়ে দাড়াল I তারপর আস্তে আস্তে বলল
– তুমি সিড়ি দিয়ে উঠছিলে কেন ?
– এলিভেটরে অনেক ভিড় ছিল I ভাগ্যিস সিঁড়ি দিয়ে উঠছিলাম তা না হলে তো তুমি পড়েই যেতে I
অনিমা ঐভাবেই মাথা নিচু করেই বললো
– ঠিক আছে তুমি উপরে যাও I
মুনির একধাপ উঠে আবার নিচে নেমে এল I তারপর কাছে এসে অনিমার চিবুক ধরে মুখটা উপরে তুলে বললো
– এখনো আমাকে এত ভালোবাসো ?
চলবে………