তোমাকে শুধু তোমাকে চাই পর্ব -১৩+১৪

তোমাকে শুধু তোমাকে চাই

ত্রয়োদশ পর্ব
ক’দিন ধরে মুনিরের খুব ব্যস্ততার মধ্যে দিন কাটছে I ও দেশে ফিরেছে এক সপ্তাহ I গত পাঁচ বছরে একবারের জন্য আসেনি I বাবা-মা একবার এসে ঘুরে গেছেন I কয়েকবার ভেবেছে সে দেশে যাবে কিন্তু কেন যেন হয়ে ওঠেনি I

সেই রাতে রংপুর থেকে ফিরে বাড়ি এসেছিল গা ভর্তি জ্বর নিয়ে I বাড়ির সবাই চমকে গিয়েছিল ওকে দেখে I সারারাত অজ্ঞান হয়ে ছিল জ্বরের ঘোরে I বেশ অনেকদিন ভুগিয়েছিল জ্বরটা ওকে Iতবে জ্বর যতটা না বেশি কষ্ট দিচ্ছিল তার চেয়ে বেশি কষ্ট হচ্ছিল অনিমা ওর ফোন ধরছেনা বলে I তবুও মনে মনে আশা করে ছিল হয়তো কদিন পর ফিরে আসবে I কিন্তু এক মাস হয়ে গেল অনিমা ফিরল না I
জ্বর ছেড়ে যাবার পর ভার্সিটিতে আবার ক্লাস শুরু করলো মুনির I কিন্তু মন বসাতে পারল না I এক মাস পর আবার পঞ্চগড়ে গেল I কিন্তু এবারো হতাশ হয়ে ফিরে আসতে হলো I অনিমাদের বাসাটা ভাড়া হয়ে গেছে I নতুন ভাড়াটিয়া উঠেছে I আশেপাশের কারো কাছ থেকে কিংবা ভাড়াটিয়ার কাছ থেকে ওদের ঠিকানা যোগাড় করতে পারল না I মন খারাপ করে আবারো ফিরে এলো I
ডিপার্টমেন্টের সবাই ভেবেছিল অনিমা চলে গেছে এবার মুনিরের ফার্স্ট হওয়া আর আটকায় কে I কিন্তু আদতে সেটা হয়নি I বরং ওর সেকেন্ড ও পজিশনে চলে গেল I রেজাল্ট খারাপ হতে শুরু করল I থার্ড ইয়ার ফাইনালে পজিশন দশেক পরে চলে গেল I ফাইনাল ইয়ারে ওঠার পর একবার ভাবলো পড়াশোনা ছেড়ে দেবে I ক্যাম্পাসে যেতে ইচ্ছা করে না I ক্লাস করতে ভালো লাগেনা I লাইব্রেরীতে গেলে অসহ্য লাগে I একা একা পড়ায় মন বসে না I আগে সবসময় ওরা দুজন গ্রুপ স্টাডি করত I ডিপার্টমেন্টের সবাই এই ব্যাপারটাতে খুব অবাক হতো I সাধারণত যারা ফার্স্ট সেকেন্ড হয় তাদের মধ্যে কখনোই বনিবনা হয় না I এরা কখনো একজন আরেকজনের সঙ্গে পড়াশোনা শেয়ার করে না I অথচ ওরা দুজনে একসঙ্গে পড়ত I অনিমা লিখতে ভালোবাসতো তাই সব নোটপত্র ওই তৈরি করতে I দুজনে একসঙ্গে বসে রেফারেন্স ঘাটাঘাটি করে সব গুছিয়ে নিত Iমুনির আলাদা করে কখনো নোট তৈরি করত না I শেয়ার করতো দুজন I কিন্তু তারপরও কি করে যেন অনিমার নাম্বার বেশি আসত I মুনির একবার ওকে জিজ্ঞেস করেছিল
– আচ্ছা, আমরা দুজন তো একি নোট পড়ি I তাহলে কি করে তোমার নাম্বার বেশি আসে বলতো I
– নোটের মধ্যে তো শুধু ইনফরমেশন গুলো থাকে কিন্তু পরীক্ষায় অ্যানসার করি কোশ্চেন অনুযায়ী I
অনিমার লেখায় কিছু একটা তো ছিল যেটা সবার চেয়ে আলাদা I মুনিরের ওর প্রথম হওয়া নিয়ে কখনো কোনো আফসোস ছিলনা I বরং কেমন একটা গর্ব হত সব সময় I সেই অনিমার কিনা পড়াশোনা বন্ধ হয়ে গেল I এই ব্যাপারটা কিছুতেই মেনে নিতে পারছিল না মুনির I ও রেজিস্টার বিল্ডিং এ খোঁজ নিয়েছে অনিমা ওর মার্কশিট সার্টিফিকেট কিছুই তুলিনি I তারমানে ও অন্য কোথাও ভর্তি হয়নি I এর একটাই অর্থ দাঁড়ায় ও আর পড়াশোনা করছে না I এ ব্যাপারটা কিছুতেই মানতে পারছিল না মুনির I
অনার্স ফাইনালের রেজাল্ট ও আশানুরূপ হয়নি মুনিরের I কোনমতে দশের মধ্যে পজিশন ধরে রাখতে পেরেছিল এইটুকু যা I আর মন টিকছিলো না ,তাই ঠিক করলো দেশের বাইরে চলে যাবে I টরোন্টোতে মুনিরের মামা থাকে I ইচ্ছে করেই ইউনিভার্সিটি অফ টরোন্টোতে এপ্লাই না করে ওয়াটার লু ইউনিভার্সিটিতে অ্যাপ্লাই করল I মাস্টার্স ফলোড বাই পিএইচডি I সব গুছিয়ে কিছুদিনের মধ্যেই পাড়ি জমালো সুদূর ক্যানাডা I
ইউনিভার্সিটির কাছেই একটা এপার্টমেন্ট ভাড়া করল , আরো তিনজন স্টুডেন্ট এর সঙ্গে I ভালোই চলছিল প্রথমদিকে I ক্লাসে ও বেশ এডজাস্ট করে গিয়েছিলI গ্রিক একটা ছেলে ওর রুমমেট নাম ডিমিত্র পাশের রুমে থাকে দুজন ভারতীয় ছেলে অনিস আর রোহিত I সবাই খুব মিশুক আর প্রাণখোলা Iনতুন দেশ নতুন পরিবেশ, চমৎকার আবহাওয়াI সব মিলিয়ে মনে হয়েছিল হয়তো নিজের অতীত ঝেড়ে ফেলে সামনে এগিয়ে যেতে পারবে I কিন্তু ভাগ্য বোধ হয় সেটা চাইনি I
সেবার সামার ব্রেকে বন্ধুরা মিলে পাহাড় দেখতে যাবে ঠিক করল I চারজন মিলে বেরিয়ে পড়ল I রকি মাউন্টেন এর কাছে দাঁড়িয়ে নিজের ক্ষুদ্রতাকে প্রত্যেকে অনুভব করে I মুনির ও করল I কিন্তু যা কেউ অনুভব করেনি সেদিন সেটাই অনুভব করেছিল ও I যখন বিমোহিত হয়ে সবাই রকি মাউন্টেন এর ছবি তুলছে হঠাৎ করে মনে হল কেউ ওর কানের কাছে এসে বলল
একা একা পাহাড় দেখছো ?
চমকে পিছন ফিরে তাকালো মুনিরI কেউ নেই চারপাশে I বন্ধুরা ছবি তোলায় ব্যস্ত I যাত্রাপথের গাড়ি থামিয়ে নেমেছিল ওরা I যেখানে মেঘের আড়ালে বারবার পাহাড় ঢেকে যাচ্ছে I সেই অপরূপ দৃশ্য দেখে সবাই বিমোহিত I মুনির কিছুতেই পারল না নিজেকে সামনে রাখতে I হঠাৎ করে চোখে জল এসে গেল I ওর বন্ধু দেখে বললো
– আর ইউ ক্রইং ম্যান ?
মুনির জবাব দিল না Iএক হাতে চোখ মুছলো I
– হোয়াট হ্যাপেনড ?
– নাথিং I জাস্ট রিমাইন্ড মি সাম ওয়ান
– ইওর গার্লফ্রেন্ড ?
মুনির হেসে ফেললো I ফেলল মাথা ঝাকিয়ে বলল
– ইয়াপ
পরবর্তী কয়েক দিন অনেক জায়গায় ঘুরলো ওরা কিন্তু কোথাও মন বসাতে পারলনা ওI শুধু মাথায় একটা কথাই ঘুরতে লাগলো
একা একা পাহাড় দেখছো ?
এই পাহাড় দেখা নিয়ে কত ঝগড়াও হত ওদের I মুনির অনিমাকে রাগানোর জন্য বলতো
– তুমি যেমন বোরিং কাঠখোট্টা তেমনি তোমার পাহাড়ের মতন স্থানু জিনিস পছন্দ I আমার একটুও ভালো লাগে না I
অনিমা খুব রাগ করত I বলতো তুমি আমাদের পঞ্চগড়ে এস I ওখান থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখা যায় I একবার দেখলে বুঝবে কি তার সৌন্দর্য I আমার খুব শখ কাছে থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখার I
ঠিক হয়েছিল অনার্স ফাইনালের পর পুরো ক্লাস মিলে দার্জিলিংয়ে যাবে I যাওয়া হয়েছিল ঠিকই কিন্তু অনিমা যেতে পারেনি আর মুনির ইচ্ছে করেই যায়নি I
এক সপ্তাহ পর মুনির মন খারাপ করে ফিরে এসেছিল I ভেবেছিলো সাময়িকভাবে এমনটা হচ্ছে কদিন পর ঠিক হয়ে যাবে I কিন্তু সেটা হলো না I বরং বারবার প্রতিবার একই ঘটনা ঘটতে লাগল I
পরের মাসে রোহিতের জন্মদিনে ঠিক হল রাত বারোটার সময় বিচে গিয়ে কেক কাটা হবে I ভাগ্যক্রমে সেদিন ছিল ফুল মুন I কেক স্নাক্স আর ড্রিঙ্কস নিয়ে প্রায় দেড় ঘন্টার ড্রাইভ শেষে যখন বিচে পৌঁছলো , তখন প্রায় সাড়ে এগারোটা বেজে গেছে I আকাশ পরিষ্কার I চমৎকার জোৎস্না I লেকের পাড় ঘেঁষে হাটতে লাগল ওরা I দূরে আরো কিছু লোকজন এসেছে ক্যাম্পিং এর জন্য I আবছা অন্ধকারে ওদের তাবু দেখা যাচ্ছে I হাসির গুঞ্জন শোনা যাচ্ছে Iওরা বোধ হয় ফানুস নিয়ে এসেছে I আকাশের একটা অংশ ফানুসে ছেয়ে আছে I ওর বন্ধুরা ক্যাম্প করার আয়োজন করছে I মেঝেতে ম্যাট বিছানা হচ্ছে I ক্যান্ডেল জ্বালানোর প্রস্তুতি চলছে I বাতাসের কারণে জ্বলছে না ঠিক মতন I বারবার নিভে যাচ্ছে I এই নিয়ে খুব হাসাহাসি চলছে তিন জনের I মুনির হাঁটতে হাঁটতে অনেকটাই এগিয়ে গেল I খুব বাতাস দিচ্ছে আজ I তবে ঠান্ডা নেই I মুনির মুগ্ধ হয়ে চাঁদের দিকে তাকিয়ে ছিল I হঠাৎই এক ঝলক হাওয়ার মতন কেউ যেন ওর কানের কাছে বলে গেল
তোমার পান্ডুর চাঁদ দেখি
মুনির আশেপাশে তাকিয়ে কাউকে খুঁজে পেল না I হাঁটতে হাঁটতে অনেক দূর এগিয়ে গেছে ও I পকেট এ ফোনের ভাইব্রেশন টের পেল I বন্ধুরা ফোন করছে I ফিরে যাওয়ার জন্য পা বাড়ালো মুনির I কিন্তু মাথা থেকে ওই একটা লাইন কিছুতেই বের হচ্ছে না I ‘তোমার পান্ডুর চাঁদ দেখি ‘I মুনির দু হাতে কান চেপে ধরে বালির উপর বসে পড়ল I কেনো এসব হচ্ছে ? কি হয়েছে ওর ?
******** ***
অনেক বছর পর নিজের ফেসবুক আইডিটা ওপেন করল অনিমা I এতদিন ধরে সবার কাছ থেকে নিজেকে লুকাতে ফেসবুকে লগইন করতো না I এখন আর পালিয়ে থেকে কি লাভ ? যার কাছ থেকে পালাতে চাইছিল তার সঙ্গেই তো দেখা হয়ে গেল I আর শুধু মুনির নয় অন্যান্য অনেকেই ওর সঙ্গে যোগাযোগ করছে I গতকাল রাতে হাসিব ফোন করেছিল I ওর ছেলের প্রথম জন্মদিন I খুব করে যেতে বলেছে I অনিমা অনেক এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছে ,পারেনি I শেষমেষ ওকে রাজি করানোর জন্য হাসিব বলেছে মুনিরকে বলবে ওকে নিয়ে আসতে I রাতের পার্টি শেষে আবার পৌঁছে দেবে I বাধ্য হয়েই অনিমাকে বলতে হয়েছে যে ও আসবে এবং একাই আসবে I কাউকে পৌঁছে দিতে হবে না I
ফেসবুক ওপেন করে হতভম্ব হয়ে গেল অনিমা I মেসেঞ্জার ভর্তি মুনিরের মেসেজ I এত মেসেজ যে পড়তে গেলে রাত ভোর হয়ে যাবে I শেষ ম্যাসেজটা এসেছে গতকাল I লিখেছে

বিলবোর্ড নিষিদ্ধ এক শহরে বুকভর্তি ‘তোমাকে চাই’ বিজ্ঞাপন নিয়ে ঘুরে বেড়াই।

চলবে…
শেষ লাইনটা সাদাত হোসাইন এর আমার না I
আজকের পর্ব টা খুব মন খারাপ করা I তবে আমি কিছু মন ভালো করা কমেন্ট চাই I পাবো তো ?তোমাকে শুধু তোমাকে চাই

চতুর্দশ পর্ব
প্রথমে যাবেনা ঠিক করলেও পরে অনিমা সিদ্ধান্ত নিল জন্মদিনের অনুষ্ঠানে যাবে I তা না হলে দেখা যাবে হাসিব আবার মুনিরকে পাঠিয়ে দিয়েছে I এটা হতে দেয়া যাবে না I মুনির এমনিতেই যথেষ্ট বাড়াবাড়ি করছে I আর ওকে কোন সুযোগ দেয়া যাবে না I

অনেকগুলো খাতা জমে আছে মিডটার্মের I কালকে জমা দিতে হবে I সকাল থেকে উঠে ওই নিয়েই ব্যস্ত ছিল ও I ঘুম থেকে উঠেই খাতা নিয়ে বসেছে I রুবিনা ঘরে ঢুকে দেখলেন মেয়ে বিছানায় বসে খাতা দেখছে I সমস্ত বিছানায় খাতা ছড়িয়ে আছে I এই এক সমস্যা মেয়েটার I ছোটবেলায় পড়াশোনা ও করত এভাবেই I সারা বিছানায় বইপত্র ছড়িয়ে রাখত I রুবিনা মেয়ের কাছে এসে সস্নেহে মাথায় হাত রেখে বললেন
– নাস্তা খাবি না ?
– এখন সময় নেই মা I
– চা দেই ?
– দাও
রুবিনা চা এনে দেখলেন মেয়ে খাতা নিয়ে বুঁদ হয়ে আছে I আজ ওর মনটা খুব ভালো I অনেকদিন পর একটা চিঠি এসেছে I ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে একটা সার্কুলার হয়েছে I মেয়েটার বহুদিনের স্বপ্ন ছিল I একবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরি শুরু করলে ওর কাজের প্রেসার কমবে I বড্ড পরিশ্রম করতে হয় মেয়েটাকে I আরো কত স্বপ্ন দেখেছিলেন I মেয়ে পড়াশোনা শেষ করে পিএইচডি করতে যাবে দেশের বাইরে I এখন ও চাইলে যেতে পারে I যাচ্ছে না শুধুমাত্র বাবা-মায়ের কারণেই I এসব নিয়ে কথা বলতে গেলে রেগে যায় I কথা বলতে চায় না I রুবিনা মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললেন
– তোর একটা চিঠি এসেছে
– কোনটা ?
– ওইযে সার্কুলার হয়েছে ? তুই এপ্লাই করবি না ?
– না
– কেন ?
– ওখানে চাকরি করলে আর বাসা চেঞ্জ করতে পারবোনা মা ? প্রাইভেটের স্যালারি বেশি I
রুবিনা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন I মেয়েটার জীবনটা কেমন হয়ে গেল I বিয়ের কথা ও বলতে পারেন না I যদি এমন কোন ছেলে পাওয়া যেত যে বিয়ের পর একসঙ্গেই থাকলো I মিনহাজ ভাই অবশ্য সেদিন টেলিফোনে বলছিলেন তার ছেলেটা গ্রাজুয়েশন কমপ্লিট করেছে I ঢাকায় কোন একটা ইউনিভার্সিটি থেকে যেন এম বিএ ও করেছে I এখনো তারা বিয়ের ব্যাপারে আগ্রহী I বিয়েটা হলে সবাই একটা বাড়ি নিয়ে থাকতে পারবে I এটাও বলেছে যে , তখন অনিমা পিএইচডি করতে বাইরে যেতে পারবে I প্রয়োজন হলে তৌহিদ ও যাবে সঙ্গে I কিন্তু বাপ মেয়ের সামনে এখনো এই কথা তুলতে পারেননি রুবিনা I দেখা যাক আস্তে আস্তে তুলতে হবে I এভাবে তো আর মেয়েকে বসিয়ে রাখতে পারবেন না I
অনিমা চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে দ্রুত খাতায় চোখ বুলাচ্ছে I চোখ দুটো জ্বলছে I কাল সারারাত ঘুমায়নি I মুনিরের মেসেজ গুলো পড়ছিলো I প্রায় প্রতিদিন মেসেজ পাঠিয়েছে ও I প্রথম দিকের গুলো ছিল বিশাল আকারের I চিঠির মতন I পরের গুলো কোনোটা দু চার লাইনের কোনটা আবার কবিতা কিংবা গানের লাইন I পড়তে পড়তে কখন সকাল হয়ে গেছে টেরই পায়নি I ভোরবেলা ঘুমিয়েছে I এখন চোখ জ্বালা করছে I কিন্তু খাতা গুলো শেষ করতে হবে I তা না হলে সন্ধ্যাবেলা যেতে পারবেনা I খাতায় মন বসছে না Iবারবার একটা মেসেজ চোখের সামনে ভেসে উঠছেI গত বছর ওর জন্মদিনের দিন পাঠিয়েছিল Iমুনির লিখেছে

“কেন ভালোবাসি, কেন কষ্ট পাই
তুমিও যেমন জানো আমিও তো তাই!
তবু ভালোবাসি, তবু ভেজে চোখ
এভাবেই বেঁচে থাকা, এভাবেই শোক!”

বিকেল নাগাদ অনিমা একটা উবার নিয়ে চলে গেল I হাসিবের বাসা উত্তরায় I বাড়িতেই অনুষ্ঠান I পুরনো আমলের দোতলা বাড়ি I ছাদেই প্যান্ডেল করে আয়োজন করেছে I অনেকটা সময় লেগে গেল পৌঁছাতে I মুনির অবশ্য ফোন করেছিল I বলেছিল নিতে আসবে I অনিমা নিষেধ করে দিয়েছে I কি দরকার শুধু শুধু মায়া বাড়িয়ে I ও তো আর কদিন পর চলেই যাবে I অনিমা শুনেছে যে পিএইচডির পর ওকে পোস্ট ডক এর জন্য অফার দিয়েছে I শুধু শুধু নিজেদের জীবন গুলোকে জটিল করে কোন লাভ আছে ? অনিমা ঠিক করেছে বেশি ঝগড়া করবেনা আবার ওকে কাছে আসতে ও দেবে না I কিন্তু কাল রাতে মেসেজ গুলো পড়ার পর থেকে খুব খারাপ লাগছে I কষ্ট হচ্ছে ভীষণ I জীবনটা একটু অন্যরকম হলে কি ক্ষতি ছিল ? আর দশজনের মত যদি স্বাভাবিক কত I

অনিমা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে সিঁড়ি দিয়ে উঠে গেল I আজ একটা জাম রঙের জামদানি পড়েছে ও I সোনালি কাজ I সঙ্গে হালকা সোনালী গয়না I সবসময়ের মতোই এলো খোঁপা করে কাটা দিয়ে আটকে দিয়েছে I উপরে উঠে প্রথমে দেখা হল নাজমার সঙ্গে I এই মেয়েটা ঠিক আগের মতই আছে I এখন ও দেখা হলেই উচ্ছ্বাস নিয়ে জড়িয়ে ধরে I আজ ও তাই করল I আরো পরিচিত অনেকের সঙ্গেই দেখা হলো I দেশে যারা ছিল সবাই মোটামুটি সংসারী হয়ে গেছে I দেশের বাইরে যারা ছিল তাদের মধ্যেও কয়েকজন দেশে এসেছে ক্রিসমাসের ছুটিতে I এরকম কজনের সঙ্গে দেখা হলো I

স্নাক্স সার্ভ করা হচ্ছে I নাজমা অনিমার জন্য ড্রিঙ্কস আর চিকেন সাসলিক নিয়ে এলো I ছাদের রেলিং এ হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে দুজনে গল্প করতে করতে খাচ্ছিল I নাজমা হঠাৎ অনিমার কানে কানে বললো
– তুমি কি ভাইয়াকে কিছু বলেছ, আপু ?
– না তো I কেন ?
– ভাইয়া খুব আপসেট হয়ে আছে
ঠিক তখনই মুনির আর হাসিবকে সিগারেট হাতে হাসতে হাসতে ছাদে উঠতে দেখা গেল I অনিমা অগ্নি দৃষ্টিতে নাজমার দিকে তাকালো I মুনির অনিমাকে দেখে থমকে গেল I জাম রঙের শাড়িতে ওকে অপ্সরীর মতো লাগছে I কাছে এসে বলল
-তোমাকে খুব সুন্দর লাগছে অনিমা I শুধু একটা সমস্যা
– কি ? অনিমা অবাক হয়ে জানতে চাইলো
মুনির হাত বাড়িয়ে ওর চুলের কাঁটাটা খুলে দিল I রেশমের মতো চুলগুলো আলগোছে কাঁধের উপর ঝাপিয়ে পড়ল I মুনির ওটা পকেটে রাখতে রাখতে বলল
– এবার ঠিক আছে
– এটা কি করলে ? আমার চুলের কাঁটা দাও ? আমার অন্য কাঁটাটা ও হারিয়ে গেছে
– কোনটা ? গোল্ডেনটা ?
– হু
মুনির হাসতে হাসতে বলল
– আমার কাছে আছে I সময় মত ফেরত দেবো
মুনির হাসছে ঠিকই, কিন্তু অনিমা লক্ষ্য করলো ওর আসলেই বিধ্বস্ত অবস্থা I কুচকানো পাঞ্জাবি , এলোমেলো চুল I ঘুমের অভাবে লাল হয়ে যাওয়া চোখ I অনিমা বলল
-তোমার এই অবস্থা কেন ?
– কি অবস্থা ? এলোমেলো চুলগুলো ঠিক করতে করতে মুনির জানতে চাইলো
– এভাবে কেউ পার্টিতে আসে ?
– ও তুমি বুঝবে না
– কেন বুঝব না ?
মুনির একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল
– বুঝতেই যদি ,তাহলে এখানে আজকে হাসিবের না, আমাদের মেয়ের জন্মদিনের অনুষ্ঠান হত
– আমাদের মেয়ের জন্মদিন !? কি সব অসভ্যের মতন কথা বল
– আরে ? আমি তো জানতাম সভ্য লোকেরাই বিয়ে করে I ছেলে মেয়ের জন্মদিন পালন করে I অসভ্য লোকেরা বিয়ে না করেই…. I তুমি কি সেই রকমই চাইছো নাকি ?
– ডিসকাস্টিং I দিনকেদিন লিমিট ক্রস করে যাচ্ছ I
অনিমা রেগেমেগে নিচে চলে গেল I মনির হো হো করে হাসতে লাগলো I হাসিব দূর থেকে জিজ্ঞেস করল
– কি হয়েছে ?
– ওকে এখন ও রাগিয়ে দিতে আমার এত ভালো লাগে

খাওয়া-দাওয়া শেষ হতে হতে দশটার বেশী বেজে গেল I অনিমা চলে যেতে চাইলে হাসিব বলল
– এরপরে গানের অনুষ্ঠান হবে I মুনির তোমাকে পৌঁছে দিয়ে আসবে I চিন্তা করো না I
ছাদের আরেকটা অংশে গানের আসর বসেছে I বাচ্চারা সব ঘুমিয়ে পড়েছে I হাসিবের স্ত্রী কেয়া ওদের ডিপার্টমেন্ট এর জুনিয়ার I মেয়েটা বেশ ভালো গান করে I হারমোনিয়াম গিটার সব উঠে এল ছাদে I মেঝেতে চাদর বিছিয়ে গোল করে বসা হয়েছে I আধুনিক, রবীন্দ্র সংগীত, হিন্দি গান কিছুই বাদ গেলোনা I সবাই অনিমাকে অনুরোধ করল গান গাইবার জন্য I কিন্তু ও রাজি হলো না I অনেক বছর প্র্যাকটিস নেই I হঠাৎ হাসিব উঠে দাঁড়িয়ে বলল
– আজকে আমাদের মাঝে একজন নতুন শিল্পী আছে I আমরা এখন তার গান শুনবো I
অনিমা ভীষণ অবাক হল যখন মাইকটা মুনিরের হাতে দেয়া হলো I মনির বসেছে ঠিক অনিমার উল্টোদিকে I মুনির মাইক হাতে নিয়ে লাজুক গলায় বলল
– প্রবাসে থাকলে যেটা হয় , দেশের স্মৃতিচারণ করে আমরা একটু আধটু গান করি I এখানে অনেক গুণী শিল্পীরা আছেন I আমার মতন আনকোরা একজনের গান শুনে হাসাহাসি করবেন না যেন I
এরপর অনিমার দিকে অপলক চেয়েই গান ধরল

তোমার টানে সারা বেলার গানে
ভোরের অন্তমিল নিশীথ জানে
তোমার টানে সারা বেলার গানে

নিষেধ মানবে দিবা নিশি হৃদয়
তোমার কান্না সেকি আমারও নয়
কালের হিসাব দেবে কোন সঞ্চয়
কি যন্ত্রনা পথিক প্রানে
তোমার টানে সারা বেলার গানে

তোমার সঙ্গে একা দেখে হবে
আমার সুজন তুমি কথা দেবে
ঝড়ের খোঁজে তুমি সঙ্গী হবে
তুমিই পাবে অধীর প্রানে

তোমার টানে সারা বেলার গানে
ভোরের অন্তমিল নিশীথ জানে
তোমার টানে সারা বেলার গানে

চলবে ……

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here