তোমাকে শুধু তোমাকে চাই
ষষ্ঠ পর্ব
নাইট কোচ এর সমস্ত যাত্রীরা ঘুমে বিভোর হয়ে আছে I শুধু একজনের চোখে কোন ঘুম নেই I বারবার চোখ ঝাপসা হয়ে আসছে I গতকাল ভোর বেলা পঞ্চগড় পৌঁছেছিল মুনির I অনিমাদের বাসা খুঁজে বের করে পৌছাতে পৌছাতে বেশ বেলা হয়ে গেছিল I মুনির ঠিক করে রেখেছিল অনিমা যতই রাগ করুক ,অপমান করুক ওকে না নিয়ে কিছুতেই ফিরবে না I কিন্তু বাসায় যাবার পর এরকম কিছু শুনতে হবে এটা ও ভাবতেই পারেনি I
পঞ্চগড় বাস টার্মিনালে নেমে ওদের বাসা খুঁজে বের করতে করতে অনেকটা সময় লেগে গেল I বাড়ি গিয়ে কাউকে পেলনা মুনির I তালা দেখে ভাবল হয়তো কোথাও বাইরে গেছে , চলে আসবে I বাইরে সিঁড়িতেই বসে রইল অনেক্ষণ I মুনিরের পরনে জ্যাকেট ,কাঁধে ব্যাগ প্যাক I ওকে এই অবস্থায় বসে থাকতে দেখে প্রতিবেশী একজন কাছে এসে বললেন
– খবর পেয়ে আসছ ?
– কি খবর ? মুনির আশ্চর্য হয়ে জানতে চাইল
– হাসান ভাই তো স্ট্রোক করেছে
– কি ? কবে ?
-কালকে দুপুরে
-এখন কোথায় ?
– সদর হাসপাতালে নেয়া হয়েছে
মুনিরা সময় নষ্ট করলনা I সরাসরি হাসপাতালে চলে গেল I তন্ন তন্ন করে পুরো হাসপাতাল খুঁজেও অনিমার বাবাকে কোথাও খুঁজে পেল না I মুনির ,অনিমার বাবার পুরো নামও জানে না I শুধু এতোটুকু জানে যে ওর বাবা আর মা দুজনেই তুলাডাঙ্গা প্রাইমারি স্কুলের টিচার I সেখানে গেলে হয়ত ওর বাবার পুরো নাম জানা যেত কিন্তু এখন ফিরে গেলে অনেকটা সময় নষ্ট হবে I অনেক অনুরোধ করার পর রিসেপসনিস্ট চায়না যে সেই সময় ওর শিফট ছিল না যার ছিল সে বিকেলবেলায় আসবে I ততক্ষন পর্যন্ত অপেক্ষা করতে I বাধ্য হয়ে ওকে বসে থাকতে হলো I এর মধ্যে অনেকবার অনিমাকে ফোন করার চেষ্টা করেছে I ওর ফোন বন্ধ I মুনিরের অসম্ভব চিন্তা হচ্ছে I কি জানি কিভাবে এত কিছু ম্যানেজ করছে I ওর তো কোন ভাইবোন নেই I
বিকেলের শিফট এর রিসেপশনিস্ট অনিমাদের চিনতে পারল I রিপোর্ট দেখে বলল ওনারা তো আজকে দুপুরে চলে গেছেন I রোগীর অবস্থা ভাল ছিল না I
– অবস্থা ভাল ছিল না ,তাহলে কোথায় গেছে ?
– বলছিল রংপুর মেডিকেলে যাবে I সেখানে গিয়ে দেখতে পারেন
মনির চেষ্টার কোন কমতি করেনি I রংপুর মেডিকেলে গেছে I কিন্তু এত বড় হাসপাতালের ওদেরকে খুঁজে পাওয়াটা খড়ের গাদায় সুচ খোঁজার মতন I তবুও চেষ্টার ত্রুটি করি নি I যতদূর সম্ভব করেছে I অবশেষে ক্লান্ত বিধ্বস্ত হয়ে রাতের বাস ধরতে বাধ্য হয়েছে I
মুনির মোবাইল বের করে সময় দেখল I সাড়ে তিনটা বাজে I কি জানি অনিমা কি করছে এখন I এমন বিপদের সময় ওর পাশে থাকতে পারলো না I এই আক্ষেপ ওর সারাজীবন থাকবে I
***********
হাসপাতালের বারান্দায় বেঞ্চিতে অনেকক্ষণ ধরে বসে আছে অনিমা I বাবাকে ঘন্টা দুয়েক আগে কেবিনে শিফট করা হয়েছে I দুবার স্ট্রোক করেছেন উনি I প্রথমটা বাড়িতে আর দ্বিতীয়টা সদর হাসপাতালে I গত আটচল্লিশ ঘন্টা দুঃস্বপ্নের মতো মনে হচ্ছে অনিমার I জলের মতন টাকা খরচ হয়েছে I ভাগ্যিস অনিমার বিকাশ একাউন্টটা ছিল I তাছাড়া হল থেকে আসার সময় ও সব টাকা নিয়ে এসেছিল I তারপরেও ,এতটাও প্রস্তুত ছিল না I রংপুর আসার আগে বাড়ি থেকে টাকা এবং প্রয়োজনীয় কিছু জিনিসপত্র নিয়ে এসেছিল I খরচের কথা ভেবে খুব একটা বড় কেবিন নেওয়া হয়নি I অনিমা মাকে কেবিনের মেঝেতে বিছানা করে দিয়ে, নিজে বাইরে করিডরে একটা বেঞ্চে বসে রইল I রাতে প্রায় শেষ হয়ে এসেছে I কেমন শীত শীত করছে I অনিমা ওর ব্যাগের ভেতর থেকে একটা লাল সল বের করে গায়ে জড়িয়ে নিল I বেশ আরাম লাগছে এখন I একটু একটু ঘুম পাচ্ছে I হঠাৎই মনে মনে পরল এই সলটা মুনিরের মা ,রেহানা আন্টি ও কে দিয়েছিল I এখনো স্পষ্ট মনে আছে মুনির দুদিন ক্লাসে আসেনি I মা আর নাজমাকে নিয়ে সিলেটে গিয়েছিল I সেদিন একটাই ক্লাস ছিল, হঠাৎ করে সেটা ক্যানসেল হওয়াতে সবাই হৈহৈ করতে করতে কোথায় যেন চলে গেল বেড়াতে I অনিমাকে কেউ কিছু বলল পর্যন্ত না I বললেও অবশ্য ও যেত না ওদের সঙ্গে I
অনিমা করিডরে বসে একটা বই পড়ছিল I হঠাৎ মুনির পাশে এসে বসতে বসতে বলল
– ক্লাস হচ্ছে না কেন আজকে ?
– আজকের ক্লাসটা ক্যানসেল হয়েছে
– তুমি এখানে একা একা বসে কি করছো ?
– আমার বাস আর এক ঘন্টা পর I তাই এখানে বসে অপেক্ষা করছিলাম
– ভালোই হলো I তোমাকে পেয়ে গেলাম I মা তোমার জন্য এটা পাঠিয়েছে
মুনির একটা কাগজের প্যাকেট এগিয়ে দিল I প্যাকেট খুলে অনিমার মুখ আনন্দে ঝলমল করে উঠল I ভিতরে কি সুন্দর একটা লাল টুকটুকে সল I তখন সবে শীত পড়তে শুরু করেছে I অনিমা সলটা গায়ে জড়িয়ে বলল
– কেমন লাগছে ?
– ঠিক অ্যাংরি বার্ড এর মত
অনিমা গাল ফুলিয়ে ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে রইল
– এই যে I ঠিক এই এক্সপ্রেশনটা দেবে ভেবেছিলাম I এখন একেবারেই অ্যাংরি বার্ড লাগছে I
– তুমি ভালো কিছু বলতে পারোনা I তোমার বাসার সবাই এত নাইস , অথচ তুমি একটা বিচ্ছিরি মানুষ
– আচ্ছা আমি আবার এখন বিচ্ছিরি হয়ে গেলাম I এমন কি খারাপ বললাম ? আমার কাছে তো লাল অ্যাংরি বার্ড খুব কিউট লাগে I
– কিউট না ছাতা
-আচ্ছা আর বলবো না I এটা ধরো I এটা আমি তোমার জন্য এনেছিI
মুনির একটা ছোট বক্স এগিয়ে দিল I বক্সটা খুলে খুশি হবার বদলে অনিমা অবাক হয়ে গেল I ভেতরে একজোড়া রুপালী নুপূর I অবাক হয়ে বলল
– তুমি এটা আমার জন্য এনেছ ?
– হ্যাঁ I নাজমা আমাকে জোর করে ধরে নিয়ে গেল দোকানে I তারপরে বাধ্য হয়ে ওকে কিনে দিতে হলো I তখন মনে হল তোমার জন্য এক জোড়া নেই I নাজমা অবশ্য বলেছিল যে , এই ধরনের গিফট নাকি মানুষ তার গার্লফ্রেন্ডকে দেয় I কথাটা অবশ্য ঠিকই I তুমি তো গার্ল আর আমার ফ্রেন্ড ও I তুমি আবার কিছু মনে করোনা I
অনিমা হেসে ফেললো I তারপর বলল
– আমি কিছু মনে করিনি I আমার মত একটা মেয়ে যে তোমার গার্লফ্রেন্ড হবে না এটা আমি জানি
– তোমার মতন মেয়ে মানে ? মুনির ভুরু কুঁচকে জানতে চাইল
– মানে ,এই আমার মত গেঁয়ো , অসুন্দর এবং ফালতু টাইপের একজন
– এসব কি ধরনের বাজে কথা
মুনির রাগ করে উঠে চলে গেল I
– বস মুনির I এত রাগ করার কিছু নেই I এটা বাজে কথা নয় I সত্যি কথা I দেখো আজকে ক্লাস ক্যান্সেল হল বলে সবাই হৈ হৈ করতে করতে বেড়াতে গেল অথচ কেউ আমাকে কিছু বলল পর্যন্ত না I
– খুব ভালো হয়েছে I ওদের সঙ্গে তোমার যেতে হবে না I চলো আমি তোমাকে মিউজিয়াম দেখিয়ে নিয়ে আসি I
– আমার যেতে ইচ্ছা করছে না
– আরে চলতো I সারাক্ষণ এত না না করো কেন ?
মুনির সেদিন ওকে জোর করে ধরে নিয়ে গিয়েছিল I অনেক জায়গায় ঘুরতে নিয়ে গিয়েছিল I পুরনো বইয়ের দোকান, লালবাগের কেল্লা , পুরনো ঢাকার তারা মসজিদ I ওর মন ভালো করার জন্য কত মজার মজার গল্প যে বলেছিল I অনিমার সবসময় মনে হয় মুনির হয়তো ওর প্রেমে পড়েনি কিন্তু খুব ভালোবেসেছিল I ভালোবাসা কি শুধু প্রেমিক প্রেমিকাদের মধ্যে হয়? বন্ধুদের মধ্যে ভালোবাসা থাকে না ? আমরা আমাদের বাবা-মা ভাই-বোনকে ভালবাসি না I তেমনিভাবে মনির ওকে খুব ভালোবাসতো , অনেকযত্ন করতো I এই বিচ্ছিরি কান্ডটা না হলে আজকে অনিমা অবশ্যই ওর সঙ্গে কথা বলত I কেন জানিনা এই দুঃসময় ওর কথা খুব মনে পড়ছে I
অনিমা ফোনটা ওপেন করল I চার্জ শেষ হয়ে যাবে বলে স্যুইচ অফ করে রেখেছিলে I রাত প্রায় সাড়ে তিনটা বাজে I কি আশ্চর্য এত রাতে মুনির অনলাইনে কি করছে ?
চলবে……….