তোমাকে শুধু তোমাকে চাই পর্ব -০৭

তোমাকে শুধু তোমাকে চাই

সপ্তম পর্ব

এরপর সাত বছর কেটে গেছে I এই সাত বছরের জার্নিটা অনিমার জন্য সহজ হয়নি I অনেক কাঠ-খড় পুড়িয়ে আজকে এই অবস্থানে আসতে হয়েছে I সেই রাতে মুনিরের সঙ্গে আর যোগাযোগ করা হয়ে ওঠেনি ওর I যখন সব অভিমান সঙ্কোচ ঝেড়ে ফেলে ভেবেছিল ,একটাইতো বন্ধু ওর একবার একটু কথা বলা যেতেই পারে I ঠিক সে সময়ই অনিমার মা রুবিনা ছুটে এসে বললেন যে হাসান সাহেবের শরীর আবার খারাপ করেছে I হন্তদন্ত হয়ে ছুটে গিয়েছিল অনিমা I পরবর্তী দুই ঘন্টা কিভাবে পার হয়েছে মা মেয়ে কেউ বলতে পারবে না I যখন সব কিছু স্বাভাবিক হয়ে এলো , অনিমা ওর ফোনটা আর কোথাও খুঁজে পেল না I হয়তো দৌড়ে যাওয়ার সময় ফোনটা কোথাও পড়ে ভেঙে গেছে, কিংবা হারিয়ে গেছে I ও মনে করতে পারলো না I তবে ফোনের সঙ্গে হারিয়ে গেল পরিচিত-অপরিচিত সবার সঙ্গে সংযোগের উপায় I

অনিমা এখন একটা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ফ্যাকাল্টি হিসেবে আছে I খুব বেশি দিন হয়নি চাকরীটার I নতুন জয়েন করেছে বলেই হয়তো কাজের অনেক চাপ I পরীক্ষার ডিউটি , টিউটোরিয়াল এর কোশ্চেন করা , ল্যাব , এছাড়া ক্লাস তো আছেই I সিনিয়র শিক্ষকেরা প্রায়ই ছুটিতে গেলে কিংবা অসুস্থ থাকলে ,সব ক্লাস গুলো ওকেই নিতে হয় I যেহেতু অনিমার এডুকেশনাল ব্যাকগ্রাউন্ড অনেক স্ট্রং, কোন রকম প্রস্তুতি ছাড়াই ও যেকোনো ইয়ারের যে কোন ক্লাস নিতে চলে যেতে পারে I তাই সবাই ওকে ক্লাসের দায়িত্ব দিয়েই নিশ্চিন্ত হয় I

আজ শুক্রবার I পাঁচ দিন টানা ক্লাসের পর এই একটা দিন ছুটি পায় অনিমা I শনিবার চলে যায় সাপ্তাহিক বাজার ,বাবাকে নিয়ে ডাক্তার দেখানো ,রান্নাবান্না আরো এরকম নানান কাজে I প্রতিদিন সকালবেলা ক্লাস থাকে, তাই অভ্যাসবশত শুক্রবারে ও বেশিক্ষণ ঘুমিয়ে থাকতে পারে না অনিমা I কিন্তু আজ শরীরটা ভালো লাগছিলো না I কাল রাত থেকেই কেমন জ্বর জ্বর লাগছে I নভেম্বর শেষ হয়ে এসেছে I একটু একটু শীত পড়তে শুরু করেছে I তবে এত বেলা হয়ে গেছে ভাবতে পারেনি ও I চোখ খুলে দেখল নয়টা বাজে I রুবিনা চা নিয়ে এসে দেখলেন মেয়ে সবে ওয়াশরুম থেকে বের হয়েছে I খাটে বসতে বসতে বললেন
– আয় একসঙ্গে চা খাই
অনিমা চায়ের কাপ হাতে নিল I একটু বিরক্ত হয়ে বলল
– আমাকে ডাকোনি কেন ? বাবা খেয়েছে ?
– হ্যাঁ I আমাদের খাওয়া শেষ I তোর বাবা বলছিল একটা দিন ঘুমাচ্ছে ঘুমাক Iকি পড়ে যাবি ঠিক করেছিস ?
– কোথায় ? অনিমা অবাক হয়ে জানতে চাইল
– বিয়েতে I আবার কোথায় ?
– ওI যেতে ইচ্ছা করছে না I শরীরটা ভালো লাগছেনা মা
রুবিনা মেয়ের কপালে হাত দিয়ে বললেন
– কি হয়েছে দেখি ? ও কিছু না I এমনি ঠান্ডা পড়েছে বলে I সন্ধ্যা পর্যন্ত ঠিক হয়ে যাবে I
– দেখি
– দেখাদেখির কিছু নেই I কোথাও তো যাস না I যা ঘুরে আয় I ভালো লাগবে

সারাটা দিন কেমন আলসেমিতে কেটে গেল I অনেকদিন পর এমন একটা অলস দিন কাটালো অনিমা I দুপুরের খাবারের পর বাবা-মার সঙ্গে বসে চা খেতে খেতে গল্প করল অনেকক্ষণ I এখন বেশ ঝরঝরে লাগছে I আজ ওর কলিগ রাবেয়া ম্যাডামের ছেলের বৌভাত I রাবেয়া ম্যাডাম ওদের ডিপার্টমেন্টের হেড I এড়িয়ে যাবার অনেক চেষ্টা করেছিল অনিমা I কিন্তু শেষ পর্যন্ত পারেনি I এড়িয়ে যাবার অবশ্য একটা কারন ও ছিল I বৌভাতের অনুষ্ঠানের পর ছেলে তার বউকে নিয়ে শশুর-বাড়িতে চলে যাবে I আর ঠিক হয়েছে রাবেয়া ম্যাডাম সহ বাকি কলিগেরা তার বাসায় থাকবে I ছাদে বিশাল অনুষ্ঠান হবে I মেহেদী নাইট, গানের আসর ইত্যাদি ইত্যাদি I রাতে বাড়ির বাইরে থাকাটা ভালো লাগেনা ওর I কি জানি কি হয় ? যদি হঠাৎ বাবার শরীর খারাপ করে? শেষমেষ রাবেয়া ম্যাডাম বলেছেন অনুষ্ঠান শেষে ওকে পৌঁছে দেবেন I অগত্যা অনিমা আর না করার কোন কারণ খুঁজে পেল না I

বিকেল বেলা মা একটা মিষ্টি গোলাপি রঙের জামদানি শাড়ি এনে বললেন
– এটা পড়ে যা I অনিমা অবাক হয়ে গেল
– এটা কার ?
– আমার I একবারই মাত্র পড়েছি I

অনিমা সাধারণত ইউনিভার্সিটিতে শাড়ি পড়েই যায় Iএমনিতেই ওর ছোটখাটো ছিপছিপে গড়ন I ড্রেস পরলে স্টুডেন্ট দের থেকে আলাদা করা যায় না I তাছাড়া ওর মাও স্কুলে শাড়ি পড়ে যেতেন I সেই সুবাদে ওর মায়ের সুতি শাড়ির ভালো কালেকশন আছে I এক দিক দিয়ে ভালই হয়েছে I খরচ বেঁচে গেছে I সব শাড়ির মধ্যে অনিমার সবচেয়ে প্রিয় মনিপুরী তাঁত আর জামদানি শাড়ি I শাড়ীটা দেখে ভালো লাগলো I শাড়ির সঙ্গে কয়েকটা ম্যাচিং অর্নামেন্টস ও দিয়েছে মা I দুটো বালা , একজোড়া ঝুমকা I সব অবশ্য সিটি গোল্ডের I রাতের বেলা একা একা যাবে I সোনার গয়না না পড়াই ভালো I তাছাড়া সোনার গয়না কিছু নেই ও I বাবার অসুখের সময় সব বিক্রি হয়ে গেছে I শুধু মা তার বিয়ের ঝুমকাটা রেখে দিয়েছেন I অনিমার জন্য I ঐটা বিক্রি করতে পারেননি I দুই পাল্লার একটা ঝুমকা I মায়ের খুব প্রিয় I অনিমার খুব ইচ্ছা সেলারি আরেকটু বাড়লে মাকে একজোড়া বালা বানিয়ে দেবে I বিয়ের বালাটা বিক্রি করার সময় মার খুব মন খারাপ হয়েছিল I

বিকেলের দিকে শরীর ভালো থাকলেও সন্ধ্যার পর থেকে আবারো জ্বর জ্বর ভাবটা ফিরে এলো I অনিমা খাটে বসল হেলান দিয়ে I আলোটা খুব লাগছে চোখে I হলে থাকতেও একবার এরকম হয়েছিল I সন্ধ্যা হলেই কেমন জ্বর জ্বর লাগতো I এর মধ্যেই একবার মুনির ওদের বাসায় ইনভাইট করলো I অনিমা প্রথম যেতে চায়নি I পরে নাজমা ফোন করে বলেছিল ওর জন্মদিন I একটু সময়ের জন্য হলেও আসতে I সেদিন ও শুক্রবার ছিল I বিকেল নাগাদ মুনির ফোন করে বলেছিল রেডি হয়ে থাকতে I অনিমা একটা জলপাই সবুজ ড্রেস পরেছিল I সাধারণত এই রংটা ওকে খুব মানায় I অনিমা আশা করেছিল মুনির হয়তো আজকে ওকে দেখে ভালো কোনো মন্তব্য করবে I কিন্তু মুনির ওকে দেখে ভ্রু কুঁচকে ফেলল I কাছে এসে বলল
– তোমার কি শরীর খারাপ ?
– তেমন কিছু না I কদিন থেকে সন্ধ্যার পর একটু জ্বর আসে
মুনির অবলীলায় ওর কপালে হাত রেখে বলল
– কই জ্বর নেই তো
– ওষুধ খেয়েছি একটু আগে
– আচ্ছা চলো I তোমাকে তাড়াতাড়ি আবার পৌঁছে দিয়ে যাব I

অনিমা নাজমার জন্য এক বোতল আচার আর একটা মনিপুরী ওড়না নিয়ে এসেছিল I অনিমা ভেবেছিল হয়তো অনেক লোকজন থাকবে I কিন্তু ওখানে গিয়ে দেখল আর কেউ নেই I অবাক হয়ে বলল
– আর কেউ আসবেনা ?
– আমার ফ্রেন্ডরা সবাই সকালে এসেছিল আপু I আর রাতে শুধু তোমাকেই বলেছি I অনিমা খুব অবাক হয়েছিল I রাতে খেতে বসে মনে হয়েছিল ফ্যামিলি ডিনার I অনিমা বিশেষ একটা খেতে পারেনি I মুখ তেতো হয়ে আছে I সবাই জোরাজুরি করলে মুনির বলল
– থাক মা I ওর শরীরটা ভালো নেই I আমি বরং ওকে পৌঁছে দিয়ে আসি I
রেহানা বেগম আপত্তি করেননি I মেয়েটাকে আসলেই খুব কাহিল লাগছিল I
রিক্সায় উঠে মুনির বলল
– কি হয়েছে ? খারাপ লাগছে ?
– না ঠিক আছে
পুরো পথ অনিমা কোন কথা বলল না I মনেপ্রাণে চাইছিল যে জ্বরটা যেন এখন না উঠে I নীলক্ষেত পার হয়ে রিকশা যখন ইউনিভার্সিটি এরিয়ায় ঢুকলো মনিরের হঠাৎ খটকা লাগলো I পাশে তাকিয়ে বলল
– অনিমা , বেশি খারাপ লাগছে ?
অনিমা জবাব দিল না Iমুনির ওর হাতের উপর হাত রেখে চমকে গেল I শরীরের তাপমাত্রা অস্বাভাবিক রকমের বেশি I ও রিক্সাওয়ালাকে রিক্সা ঘোরাতে বলল I যতক্ষণে বাসার কাছাকাছি পৌঁছালো ততক্ষনে অনিমার শরীরে কাঁপন ধরে গেছে I ও জ্ঞান হারিয়েছে আরো অনেক আগেই I মুনিরের খুব ভয় করছে I ও একহাতে অনিমাকে শক্ত করে ধরে রেখেছে I

বাসার নিচে পৌঁছে মুনির ওর মাকে ফোন করল I রেহানা বেগম নাজমা আর মনিরের বাবা তিনজনই নেমে এলেন I রাত তখন ভালোই হয়েছে I অনিমাকে নাজমার ঘরে নিয়ে যাওয়া হলো I রেহানা বেগম মাথায় পানি ঢালার ব্যবস্থা করলেন I ডাক্তার কে খবর দেওয়া হল I জ্বর নামতে নামতে প্রায় রাত শেষ হয়ে গেল I মুনির সারারাত অনিমার মাথার কাছে বসে রইল I অনেকবার বলার পরেও ঘুমাতে গেল না I রেহানা বেগম রাতে ওর সাথেই থাকলেনI ফজরের আযানের পর উঠে নামাজ পড়তে গেলেন I
অনিমার যখন ঘুম ভাঙ্গলো ততক্ষণে ভোরের আলো ফুটে উঠেছে I অনিমা চোখ খুলে কিছু চিনতে পারল না I জানালার ফাঁক গলে ভোরের আলো এসে পড়েছে I পাশ ফিরে তাকিয়ে চমকে গেল ওI বিছানার পাশে চেয়ারে বসে খাটে হেলান দিয়ে ঘুমিয়ে আছে মুনির I সকালের নরম রোদ এসে ওর মুখে পড়েছে I অনিমা তাকিয়ে থাকতে পারল না Iওর চোখে জল এসে গেল I

চলবে………

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here