#তোমাতেই_পরিপূর্ন
#অনুগল্প (প্রথম অংশ)
–“জব পাওয়ার এক বছরের মধ্যেই দুই দুইটা প্রমোশন পেয়েছো, এইবার তোমার থেকে বড় সড় একটা ট্রিটের আশা তো করতেই পারি, তাইনা মেহু?”
কথাটা শুনে সামনের চেয়ারে হাসি মুখে বসে থাকা শেফা নামের মেয়েটার দিকে মুখ তুলে তাকালো মেহু। তারপর আলতো হেসে বললো
–“হ্যাঁ অবশ্যই। কবে ট্রিট চাও বলো।”
শেফা খুশীতে গদগদ হয়ে কিছুটা দুষ্টুমির ছলে বললো
–“চাইলে এখনই দিতে পারো। আমি মাইন্ড করবো না। আমার আবার ফ্রি’তে খেতে ভালোই লাগে।”
শেফার কথা শুনে মেহু শব্দ করে হাসলো। তারপর হাসি মুখেই শেফাকে উদ্দ্যেশ্য করে বললো
–“আচ্ছা চলো! তুমি আজকে যা যা খেতে চাও আমি তোমাকে তাই, তাই খাওয়াবো।”
মেহুর কথা শেষ হতেই কেবিনের দরজা খুলে কেউ একজন ভিতরে ঢুকতে ঢুকতে মেহুর কথার রেশ ধরেই বলে উঠলো
–“ওহ আচ্ছা, শেফার একার জন্যেই শুধু ট্রিট বরাদ্দ হয়েছে, তাইনা? আমরা বুঝি তোমার কেউ না? আমরা বুঝি কেউ তোমার থেকে ট্রিট পাবো না?”
তনয়ের অভিমান মিশ্রিত কন্ঠের কথা শুনে মেহু বলে উঠলো
–“সবার জন্যেই ট্রিট বরাদ্দ আছে। শুধু একমাত্র তুমি ছাড়া। তুমি যদি একটু কম, কম খেতে তাহলে তোমাকেও ট্রিট দেওয়ার কথা চিন্তা করতাম। কিন্তু তুমি যেই পরিমান খাও তাতে দেখবো সবার জন্যে বরাদ্দ করা খাবার তুমি একাই সাবার করে দিয়েছো। তাই তুমি যাই বলো না কেনো এইবার আমি ভুলেও তোমাকে ইনভাইট করছি না।”
তনয় দাত বের করে হেসে বললো
–“তোমার ইনভাইট দেওয়ার আশায় আমি কী বসে আছি না-কি? আমি অলরেডি ইনভাইট পেয়ে গেছি।”
মেহু ভ্রু কুচকে বললো
–“কীসের ইনভাইট পেয়ে গেছো?”
–“তোমার প্রমোশনের! জিজু একটু আগেই আমাদের সবাইকে কল করে সন্ধ্যায় তোমাদের বাসায় যাওয়ার জন্যে ইনভাইট করেছে। বলেছে, উনি নিজের হাতে রান্না করে আমাদের সবাইকে খাওয়াবেন।”
তনয়ের কথা শুনে মেহু অবাক কন্ঠে বলে উঠলো
–“হোয়াট?”
তনয় এগিয়ে এসে শেফার পাশের চেয়ারটায় বসে উৎফুল্ল কন্ঠে বললো
–“আমি তো ভিষন এক্সাইটেড হয়ে আছি জিজুর সাথে দেখা করার জন্যে। এই এক বছরে তোমাকে কতোবার বলেছি আমাদেরকে জিজুর সাথে আলাপ করাও। কিন্তু আলাপ করানো তো দূরের কথা তুমি ওনার একটা পিক অবদি আমাদের দেখতে দেওনি। আচ্ছা মেহু একটা বলো তো, তোমার বর’কে দেখতে দিলে আমরা কী ওনাকে খেয়ে ফেলতাম না-কি?”
তনয়ের কথা শেষ হতে না হতেই মেহু দ্রুত উঠে দাড়ালো। তারপর নিজের জিনিস-পত্র গুলো ব্যাগে ঢোকাতে ঢোকাতে ব্যস্ত স্বরে বলে উঠলো
–“এই লোকটাকে কতোবার বলেছি কিচেনে না যেতে, তাও যদি আমার একটা কথা শোনে! হাত-পা কেটে ফেললে কি যে হবে একমাত্র আল্লাহ মাবুদ-ই জানে। আল্লাহ তুমি রহমত করো।”
মেহু একা একাই বিরবির করে কথা গুলো বলে সাইড ব্যাগটা কাধে ঝুলিয়ে দ্রুত কেবিনের দরজার দিকে পা বাড়ালো। পিছন থেকে তনয় মেহুকে উদ্দ্যেশ্য করে অবাক কন্ঠে বলে উঠলো
–“কোথায় যাচ্ছো মেহু? জিজু আমাদের রান্না করে খাওয়াতে চেয়েছে তাই জিজুকে পে*টা*তে যাচ্ছো না-কি?”
তনয়ের কথা শুনে মেহু অসহায় কন্ঠে বললো
–“আমাকে কী তোমার এতোটা ছোট মনের মানুষ মনে হয় তনয়? এর আগে কখনো সুযোগ হয়নি তাই তোমাদের কাউকে বাসায় ডাকিনি। তবে আজকে যখন সুযোগ হয়েছে তখন তোমরা সবাই অবশ্যই আজকে সন্ধ্যায় আমাদের বাসায় এসো। আজকে আমি তোমাদেরকে আমার লাইফের সবচেয়ে ইম্পরটেন্ট ব্যক্তির সাথে আলাপ করিয়ে দিবো। আপাততো আমি যাচ্ছি। হৃদয় বাসায় একা আছে, একা একা রান্না করতে গিয়ে কি থেকে কি করে ফেলবে আল্লাহ জানে!”
কথাটা বলে মেহু আর এক মিনিটও ওখানে দাড়ালো না। কেবিনের দরজা খুলে দ্রুত কেবিন থেকে বের হয়ে গেলো। তনয় মেহুর যাওয়ার দিকে কিছুক্ষন ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো। এসব দেখে এখন আর ওরা কেউ অবাক হয় না। কারন গত এক বছর ধরেই ওরা সবাই মেহুর এই পাগলামি গুলো দেখে আসছে। মেয়েটা নিজের কাজের প্রতি যথেষ্ট সিনসিয়ার। খুব মনোযোগ দিয়ে এবং গুছিয়ে নিজের কাজ গুলো করে। কিন্তু যখন ওর হাসবেন্টের কোনো খবর শোনে তখন যেনো মেয়েটা অন্য একটা জগতে চলে যায়। এইতো কিছুদিন আগের কাহিনী।
মেহু, তনয়, শেফা সহ ওদের আরো কিছু কলিগ দুপুর বেলা একসাথে বসে লাঞ্চ করছিলো। তখনই মেহুদের বাসার সাভেন্ট ওর কাছে কল করে জানায়, হৃদয় নাকি মেহুকে সারপ্রাইজ দেওয়ার জন্যে বিরিয়ানি রান্না করছিলো। তখন নাকি হৃদয়ের হাতে তৈল ছিটকে পড়ে ওর হাত পুড়ে গেছে। কথাটা শোনার সাথে সাথে মেহু পুরো পাগলের মতো হয়ে গেছিলো। চারপাশে কি হচ্ছিলো সেদিকে ওর বিন্দুমাত্রও খেয়াল ছিলো না। ‘ও’ খাবার দাবার ওখানেই সব ফেলে রেখে ছুটি চাওয়ার জন্যে দ্রুত দৌড়ে বসের কেবিনে চলে গিয়েছিলো। কিন্তু বস ওকে ছুটি দেওয়ার জন্যে সাফ-সাফ মানা করে দেয়। বস মানা করে দেওয়ায় মেহু সেদিন ফ্লোরে হাটু ভেঙে বসে ওনার পা ধরে হাউমাউ করে কেদেঁছিলো। মেহুর কান্না দেখে ভদ্রলোক নিজেও কেদেঁ দিয়েছিলেন। সাথে তনয়, শেফা ওদেরও গাল গড়িয়ে অনবরত পানি পড়ছিলো। একজন স্বামীকে যে তার স্থি এতোটা ভালোবাসতে পারে সেটা ওদের ভাবনারও বাহিরে ছিলো। ওরা অবাক হয়ে তাকিয়ে সেদিন শুধু মেহুর পাগলামি গুলো দেখেছে।অতঃপর বস ছুটি দেওয়ায় মেহু দ্রুত সেদিন বাসায় যাওয়ার জন্যে বেড়িয়ে পড়ে। আর পিছনে ফেলে রেখে যায় কিছু মানুষকে, যারা অশ্রুসিক্ত চোখে অবাক হয়ে শুধু ওর যাওয়ার দিকেই তাকিয়ে ছিলো।
এই এক বছরে মেহুর এরকম আরো অনেক অনেক পাগলামি দেখেছে তনয়। এসব দেখে ওর মনে হৃদয়কে দেখার তীব্র ইচ্ছে জেগেছে। তনয় দেখতে চায় কে সেই হৃদয় যার সামান্য একটু খানি আঘাত লাগলেও এই মেহু নামের ভদ্র, ম্যাচিউর মেয়েটা পাগলের মতো বিহেব করতে শুরু করে। দুনিয়ার সবকিছু ভুলে গিয়ে সেই হৃদয়ের কাছে ছুটে যায়। দুনিয়ার কোনো কিছুতে তখন তার হুশ থাকে না। তনয়ের এসব ভাবনার মধ্যেই পাশ থেকে শেফা বলে উঠলো
–“কি ব্যাপার মিঃ ভাবন্তি কুমার? তখন থেকে কি এতো ভেবে যাচ্ছো?”
শেফার কথায় তনয় ভাবনার জগত থেকে বের হয়ে একটা হতাশ নিঃশ্বাস ফেলে বলে উঠে
–“ভাবছি তোর সাথে বিয়ে ক্যান্সেল করে মেহুর মতো বর পাগল একটা মেয়েকে খুজবো। তোকে দিয়ে আর যাই হোক, সংসার’টা কখনো হবে না।”
তনয়ের কথা শুনে শেফা দাঁত বের করে হেসে বললো
–“ছাগলের গলায় ডায়মন্ডের মালা মানায় না রে তনয়। তাই এমন রাম ছাগল মার্কা চেহারা নিয়ে মেহুর মতো সর্বগুন সম্পূর্ণা টাইপ মেয়েকে বিয়ে করার স্বপ্ন দেখিস না। তোর জন্যে আমিই ঠিক আছি।”
শেফার কথা শুনে তনয় চোখ ছোট ছোট করে শেফার দিকে তাকালো। শেফা একটা ভেংচি কেটে কেবিন থেকে বের হয়ে গেলো। তনয় শেফার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে বিরবির করে বললো
–“এক হচ্ছে মেহু, যে বর ছাড়া কিচ্ছু বোঝে না। আরেক হচ্ছে এই মেয়ে, রিলেশনের চার বছর হয়ে গেলো, এ্যানগেজমেন্ট হয়ে বিয়েও ঠিক হয়ে গেলো, অথচ আজ অবদি আমাকে চার আনা দিয়েও পাত্তা দিলো না। খবীচ মেয়ে একটা! একে বিয়ে করলে যে আমার কী অবস্থা হবে সেটা একমাত্র আল্লাহ-ই জানে।”
_________________________
অটো এসে পাঁচ তলা একটা বিল্ডিংয়ের সামনে থামতেই ঝটফট অটো থেকে নেমে ভাড়া মিটিয়ে দিয়ে বাসার দিকে পা বাড়ালো মেহু। তারপর সিড়ি বেয়ে উপরে উঠে চার তলার একটা ফ্লাটের সামনে দাড়িয়ে বারবার কলিংবেল টিপতে লাগলো। এভাবে কলিংবেল কয়েক বার বেজে উঠতেই ভিতর থেকে একজন মধ্য বয়সী ভদ্র মহিলা এসে দরজা খুলে দিলেন। মেহু ভদ্র মহিলাটির দিকে তাকিয়ে ব্যাতিব্যস্ত কন্ঠে বলে উঠলো,
–“আম্মা আপনি? কখন আসলেন?”
মেহুর প্রশ্নের উওরে ভদ্র মহিলাটি স্মিত হেসে বললো,
–“গতকাল রাতে হৃদয় ফোন করে বললো, তোমার নাকি প্রমোশন হয়েছে। তাই ‘ও’ তোমার কলিগদের ইনভাইট করে বাসায় নিয়ে এসে ট্রিট দিতে চায়। আমাকে আর তোমার আব্বাকে আসতে বললো। তাই সকাল, সকাল উঠেই আমি আর তোমার আব্বা এখানে চলে এসেছি। এসে দেখি আমার ছেলে বসে বসে ছুড়ি দিয়ে পেয়াজ কাটছে আর হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে চোখ মুচ্ছে। ভাবো, কতো গুনবতী ছেলে আমার!”
কথাটা বলে হৃদয়ের মা শব্দ করে হেসে দিলেন। কিন্তু ওনার কথা শুনে মেহুর মুখটা ভয়ে একদম চুপসে গেলো। হৃদয়ের মা মেহুর ভয়ার্ত মুখটার দিকে একবার তাকিয়ে ওর পা থেকে মাথা অবদি ভালো করে নজর বুলিয়ে নিলেন। তারপর চিন্তিত কন্ঠে বললো
–“তোমাকে এমন বিধ্বস্ত দেখাচ্ছে কেনো মা? কিছু কি হয়েছে? কেউ কিছু বলেছে?”
মেহু হৃদয়ের মাকে সাইড কাটিয়ে বাসার ভিতরে ঢুকে শুকনো কন্ঠে বলে উঠলো
–“না আম্মা আমার কিছু হয়নি। তুমি আগে এটা বলো হৃদয় কোথায় আছে?”
হৃদয়ের মা চিন্তিত মুখে বললেন,
–“হৃদয় তো ওর রুমেই আছে দেখলাম। কিন্তু কে….”
হৃদয়ের মা পুরো কথাটা শেষ করার আগেই মেহু দ্রুত পায়ে বেড রুমের দিকে ছুটে গেলো। গিয়ে দেখলো হৃদয় বেডের সাথে হেলান দিয়ে বসে আড়ামচে ফোন স্ক্রল করছে। হৃদয়কে এতোটা রিলেক্স হয়ে বসে থাকতে দেখে মেহুর মেজাজ তুঙ্গে উঠে গেলো। ‘ও’ ওর হাতে থাকা ব্যাগটাকে তুলে হৃদয়ের গায়ের উপর ছুড়ে মারলো। আচমকা আক্রমণে হৃদয় হকচকিয়ে উঠে সামনে তাকালো। সামনে তাকিয়ে মেহুকে দাড়িয়ে থাকতে দেখে ওর ভ্রু কিঞ্চিৎ কুচকে এলো। মেহু রাগে চিল্লিয়ে বললো,
–“এইদিকে আমি টেনশনে ম*রে যাচ্ছি, আর তুমি এখানে বসে ফোন টিপছো? আমাকে টেনশনে রাখতে না পারলে তোমার শান্তি লাগে না, তাইনা?”
মেহুর কথা শুনে হৃদয় অবাক কন্ঠে বললো,
–“যাহ বাবা, আমি আবার কী করলাম মেহু? কথা নেই বার্তা নেই তুমি এসে অযথা আমাকে বকাবকি শুরু করলে কেনো বলো তো?”
মেহু তেড়ে হৃদয়ের কাছে এগিয়ে গিয়ে বললো,
–“কি করেছো, সেটা আবার আমাকে জিজ্ঞেস করছো? তোমাকে আমি কতোবার বলেছি যে তুমি রান্না ঘরের চারপাশেও যাবে না। তারপরেও তুমি কোন সাহসে রান্না ঘরে গিয়েছিলে? যদি তোমার কিছু একটা হয়ে যেতো, তখন কী হতো?”
মেহুর কথা শুনে হৃদয় চোখ ছোট ছোট করে মেহুর দিকে তাকালো। তারপর এক ভ্রু উপরে উঠিয়ে বললো,
–“তখন যা হবার হতো! এখন তো কিছু হয়নি, তাইনা? আর আমি রান্না ঘরে গিয়ে বেশি কিছু করিনি। শুধু সবজি আর মশলা গুলো ফ্রিজ থেকে বের করে রেখেছি আর একটু পেয়াজ কেটেছি। এর মধ্যেই মা চলে এসেছে। তারপর আর আমাকে কিছু করতে হইনি।”
মেহু জোড় গলায় বললো,
–“ওই গুলোই বা তুমি কেনো করতে গেছো হৃদ? এসবের কী কোনো দরকার ছিলো? তুমি সবাইকে ট্রিট দিতে চাও সেটা আমাকে বলতে পারতে। আমি সবকিছু গুছিয়ে রেখে যেতাম। তুমি কেনো এই অযথা প্রেশার গুলো মাথায় নিতে গেলে?”
মেহুর কথা শুনে হৃদয় ওর দিকে কিছুক্ষন নিশ্চুপ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে একটা হতাশ নিঃশ্বাস ফেললো। তারপর বললো,
–“এইটুকু কাজ করলে আমি ম*রে যাবো না মেহু। আমি কোনো বাচ্চা নই যে এই সামান্য কাজ করতে গিয়ে একটা অ্যক্সিডেন্ট ঘটাবো। তুমি হয়তো ভুলে যাচ্ছো যে আমি যখন তোমাকে বিয়ে করে এই ফ্লাটে নিয়ে এসেছিলাম তখন তুমি একটা অবুঝ মেয়ে ছিলে। নিজের কাজটাও নিজে ঠিক ভাবে করতে পারতে না। ওই সময়টায় তোমার রান্না থেকে শুরু করে তোমার যাবতীয় সব কাজ আমিই করে দিতাম কিন্তু।”
হৃদয়ের কথার রেশ ধরেই মেহু আনমনা হয়ে বলে উঠলো
–“তখনকার মধ্যের আর এখনকার মধ্যের ব্যপার’টা সম্পূর্ন আলাদা হৃদ। তখন তুমি হেঁটে-চলে খুব ইজিলি সবকিছু করতে পারতে। কিন্তু এখন তো তুমি ….”
কথা’টা পুরো শেষ করার আগেই মেহুর চোখ পড়লো হৃদয়ের উপর। হৃদয় স্থির দৃষ্টিতে মেহুর দিকেই তাকিয়ে আছে। ঝোঁকের বশে কি বলে ফেলেছে সেটা বুঝে উঠতেই মেহুর কলিজার মধ্যে ধক করে উঠলো। ‘ও’ শুকনো একটা ঢোক গিলে হৃদয়ের থেকে দৃষ্টি সরিয়ে ফ্লোরের দিকে তাকাতেই হৃদয় গম্ভীর কন্ঠে বলে উঠলো,
–“তখন তো সক্ষম ছিলাম। তাই আমি কোনো কাজ করতে গেলে তোমার টেনশন হতো না। বরং আমাকে মেয়েদের মতো কাজ করতে দেখে তুমি হাসতে। কিন্তু এখন তো অক্ষম হয়ে গেছি। তাই আমার জন্যে তোমার ভীষন চিন্তা হয়। অবশ্য চিন্তা বললে ভুল হবে। এ্যাকচুলি আমার অক্ষমতা দেখে তোমার আমার প্রতি দয়া হয়। তাইনা? সেইজন্যেই তো এখন তুমি আমাকে কাজ করতে দেখলে এমন উদগ্রীব হয়ে উঠো।”
হৃদয়ের কথা শেষ হতেই মেহু মাথা উঠিয়ে অশ্রুসিক্ত চোখে ওর দিকে তাকালো। ‘ও’ মেহুর দিক থেকে মুখ ঘুড়িয়ে অন্যদিকে তাকিয়ে রইলো। মেহু অসহায় দৃষ্টিতে হৃদয়ের দিকে কিছু সময় তাকিয়ে থেকে হুট করেই ছুটে গিয়ে হৃদয়কে জড়িয়ে ধরলো। হৃদয় আগের মতো করেই মুখ ঘুড়িয়ে শক্ত হয়ে বসে রইলো। মেহু ওকে শক্ত করে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরে ফুপিয়ে কান্না করতে করতে বলে উঠলো,
–“আমি ওভাবে কথাটা বলিনি হৃদ। তুমি আমাকে ভুল বুঝো না প্লিজ। আগে তো আমি সব সময় তোমার সাথেই থাকতাম। তোমার কী হয়েছে, না হয়েছে সেটা নিজের চোখে দেখতে পারতাম। তাই তখন আমার তোমাকে নিয়ে এতো ভাবতে হতো না। কিন্তু এখন তো দিনের বেশিরভাগ সময়ই বাইরে থাকি। ঠিকমতো তোমার যত্ন নেওয়ারও সময় পাই না। তুমি সারাদিন বাসায় বসে কী করো সেটাও আমার জানা থাকে না। তাই আজকাল তোমাকে নিয়ে আমার ভীষন চিন্তা হয়, ভয় হয়। মনে হয়, আবারও তোমাকে হারিয়ে ফেলবো না তো?”
কথাগুলো বলে মেহু হিচকি দিয়ে কাদঁতে লাগলো। হৃদয় নিজের এক হাত মেহুর মাথার উপরে আলতো করে রেখে নরম স্বরে বললো,
–“আই অ্যাম স্যরি! আমি তোমাকে আঘাত করতে চাইনি মেহু। আসলে তোমাকে আমি সারপ্রাইজ দিতে চেয়ে ছিলাম। তাই এই ব্যপারে তোমাকে আগে থেকে আমি কিছুই জানাই নি। প্লিজ তুমি এভাবে কেদোঁ না। আজকের দিনটায় তুমি এভাবে কাদঁলে আমার সব সারপ্রাইজ মাটি হয়ে যাবে।”
হৃদয়ের কথা শুনেও মেহু নিজের কান্না থামালো না। হৃদয়ের বুকে মুখ খুজে ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাদঁতে লাগলো। কাদঁতে কাদঁতে মেহুর রীতিমতো হেচকি উঠে গেছে। হৃদয় নিজের দু-হাত দিয়ে মেহুকে জড়িয়ে ধরে ওর কপালে আলতো করে ঠোঁট ছোয়ালো। তারপর আদুরে গলায় বললো,
–“আরেহ এতো কাদার কি হলো? আমি কি তোমাকে বকেছি? তুমি তো নিজেই আমাকে বকা দিলে। আর এখন নিজেই আবার আমাকে জড়িয়ে ধরে কাদছো। এসবের কোনো মানে হয় মেহু? কান্না থামাও বলছি।”
হৃদয়ের এবারের কথাতেও মেহুর কোনো ভাবান্তর হলো না। ‘ও’ আগের মতো করেই ফ্যাচফ্যাচ করে কেদেঁ যাচ্ছে। হৃদয় এবার খানিকটা বিরক্ত হওয়ার ভান করে বললো,
–“দিনকে দিন তুমি একটা ছিচ কাদুনে হয়ে যাচ্ছো মেহু। আজকাল তোমাকে কিছু বললেই তুমি ভ্যাঁ ভ্যাঁ করে কান্নাকাটি শুরু করে দেও। আর একবার শুরু হয়ে গেলে তোমার এই ফাটা রেডিওর মতো কন্ঠ থামতেই চায় না। চিল্লিয়ে-চিল্লিয়ে আমার কানের সব পোকা গুলোকে আধমরা বানিয়ে দেয়। এভাবে যদি চলতে থাকে না? তাহলে তোমার এই বেসুরো কন্ঠের চিৎকারের হাত থেকে বাচাঁর জন্য আমাকে তোমার রিপ্লেসমেন্ট নিয়ে আসতে হবে।”
হৃদয়ের লাষ্টের কথা’টা শুনে মেহুর কান্না হুট করেই একেবারে বন্ধ হয়ে গেলো। ‘ও’ হৃদয়ের বুক থেকে মাথা উঠিয়ে ওর মুখের দিকে তাকিয়ে কপালে ভাজ ফেলে বললো,
–“আমার রিপ্লেসমেন্ট নিয়ে আসতে হবে মানে? কী বলতে চাইছো তুমি?”
হৃদয় দাঁত বের করে হেসে বললো,
–“মানে খুব সোজা, তোমাকে তাড়িয়ে দিয়ে আমি আরেক’টা সুরেলা কন্ঠি মেয়েকে বিয়ে করবো। রোজ-রোজ তোমার এই বাচ্চাদের মতো ফ্যাচফ্যাচ করে কান্নাকাটি দেখতে দেখতে আমি বিরক্ত হয়ে গেছি।”
হৃদয় কথা’টা শেষ করতে না করতেই মেহু অগ্নিমূর্তি ধারন করলো। ওর কান্নাভেজা ভেঁজা চোখ জোড়া মুহূর্তের মধ্যে রাগে লাল হয়ে গেলো। ‘ও’ রাগে ফুসতে-ফুসতে দু-হাতে হৃদয়ের টি-শার্টের কলার শক্ত করে চেপে ধরে দাঁতে দাঁত পিষে বলতে লাগলো,
–“খবরদার আজকে যা বলেছিস, বলেছিস! ভবিষ্যতে যদি এমন কথা মাথাতেও আনিস তাহলে সেদিন তোর একদিন কী আমার যতোদিন লাগে। আমাকে ছেড়ে অন্য কাউকে বিয়ে করার কথা স্বপ্নেও ভাবলে তোকে আমি কু!চি কু!চি করে কে!টে রোদে শুকাতে দিবো বলে দিলাম।”
মেহুর কথা শুনে হৃদয় ফিক করে হেসে দিলো। ‘ও’ বেশ ভালো করেই জানতো যে মেহুকে এসব কথা বললে মেহুর কান্নাকাটি সব মুহূর্তের মধ্যে জানালা দিয়ে পালিয়ে যাবে। তাই ‘ও’ ইচ্ছ করেই এসব বলেছে। আর যেটা ভেবেছিলো সেটাই হয়েছে।
________________
এতোক্ষন দরজার পাশে দাড়িয়ে দাড়িয়ে মেহু আর হৃদয়ের সব কথাই শুনেছেন হৃদয়ের মা। কথা গুলো শুনতে শুনতে কখন যে ওনার নিজের চোখের পাপড়ি গুলোও পানিতে ভিজে উঠেছে সেটা উনি নিজেই খেয়াল করেন নি। এই এতো গুলো বছরে মেহুকে উনি যতোবার দেখেছেন ততোবার মেয়েটার ব্যবহার দেখে উনি শুধু অবাকই হয়ে গেছেন। কী অদ্ভুত এই মেয়েটা! ছোট্ট একটা অ্যক্সিডেন্টের কারনে যখন পুরো পৃথিবীর মানুষ ওনার ছেলের দিক থেকে মুখ ঘুড়িয়ে নিয়েছিলো, তখন এই মেয়েটা নিজেকে শক্ত করে ওনার ছেলের পাশে এসে দাড়িয়ে ওর দিকে নিজের কাধ বাড়িয়ে দিয়েছিলো। সেই কাধে ভর দিয়েই হৃদয় দ্বিতীয় বার আবার উঠে দাড়িয়ে ছিলো। নিজের অক্ষমতা ভুলে আরেকবার বেঁচে থাকার চেষ্টা করেছিলো। মেয়েটা প্রত্যেকটা পদে-পদে হৃদয়কে বেঁচে থাকার জন্যে সাহস যুগিয়েছে। অথচ ওনারা এই মেয়েটাকেই হৃদয়ের বউ হিসেবে অযোগ্য বলেছিলেন। মেহু অনাথ বলে হৃদয়ের সাথে ওর বিয়েটা ওনারা মেনে নিতে চাননি। কিন্তু এতোদিন ধরে মেহুকে দেখার পর ওনারা এইটুকু বেশ ভালো করেই বুঝে গেছেন যে হৃদয়ের লাইফ পার্টনার হিসেবে মেহুর চেয়ে যোগ্য মেয়ে আর কেউ হতেই পারে না। হৃদয়ের মা বেশ ভালো করে বুঝতে পারছে যে ওনার ছেলে সবার যাথে যুদ্ধ করে, সবার বিরুদ্ধে গিয়ে, যাকে নিজের বউ করে নিয়ে এসেছে সে আসলেই কোনো কয়লা না, আস্ত একটা হিরে। যাকে ওনারা চিনতে ভুল করলেও ওনাদের ছেলের চিনতে ভুল হয়নি। সে বেছে, বেছে ঠিক মানুষকেই নিজের জীবনসঙ্গী হিসেবে নির্বাচন করেছে।
#চলবে……