#তোমাতেই_পরিপূর্ণ
লেখিকা-জান্নাতুল ফারিয়া প্রত্যাশা
২৩.
~
আমিরা বেগম খুব যত্ন সহকারে মিথিকে সাজিয়ে দিলেন। তার একটা লাল কাতান শাড়ি আছে, যেটা মিথির খুব প্রিয়। সেই শাড়িটাই আজ তিনি মিথিকে পরিয়ে দিয়েছেন। মিথি এখনও কিছু বুঝতে পারছে না তার সাথে কি হচ্ছে। তবে মনের ভেতর একটা সূক্ষ্ণ আতংক কাজ করছে তার। সাধারনত মায়েরা পাত্রপক্ষের সামনে নিয়ে যাওয়ার জন্য মেয়েদের এইভাবে সাজায়। কিন্তু মা তো বলেছেই রাদিত স্যারের মার এই বিয়েতে মত নেই। তারা তো কোনোভাবেই তাকে দেখতে আসতে পারে না। তবে কে? বিরাট এক প্রশ্ন, যেই প্রশ্নের উত্তর এখন হাজার চেষ্টা করেও মিথি খুঁজে পাবে না। মিথি সন্দিহান দৃষ্টিতে মায়ের দিকে তাকায়। তিনি মিথির কুঁচি ঠিক করাতে ব্যস্ত। কুঁচিগুলো ঠিক করে উপরে তাকাতেই দেখলেন মিথি সরু চোখে তার দিকে তাকিয়ে আছে। তিনি মুচকি হেসে মিথির গালে হাত রেখে বললেন,
‘কি রে এইভাবে কি দেখছিস?’
মিথি গম্ভীর সুরে বললো,
‘মা, তোমার হাব ভাব আমার ভালো ঠেকছে না। হঠাৎ কি হয়েছে বলতো? আমাকে এত তোড়জোড় করে শাড়ি পরাচ্ছো কেন? কারা আসছে?’
মিথির মা আলতো হেসে শাড়ির আঁচলটা টেনে মিথির মাথায় ঘোমটা দিলেন। তারপর বললেন,
‘এত অধৈর্য হলে কি করে হবে মা? জানো তো সবুরে মেওয়া ফলে। তাই সবুর করো। সময় হলে সব জানতে পারবে।’
কিন্তু এই সবুরটাই যে মিথির মাঝে নেই। মন তো তার অস্থির। হাজারো চিন্তা তার মস্তিষ্কের প্রান্তে প্রান্তে ছড়িয়ে আছে। এই সময় নেহাটাও ফোন ধরছে না। এতে তো তার দুশ্চিন্তা আরো বেড়েছে। কিন্তু করার মতোও কিছু খুঁজে পাচ্ছে না সে। এমন কোনো উপায়ও আওড়াতে পারছে না যেটা দিয়ে নিমিষেই সে সবকিছু বুঝে ফেলবে।
মিথিকে বিছানায় বসিয়ে দিয়ে আমিরা বেগম গেলেন রান্নাঘরে। মিথি বসে বসে ফোন ঘাটে। অনেকটা সময় পাড় হয়। মিথির গভীর দৃষ্টি তখন মোবাইলের স্ক্রিনে। সেই সময়ই তাদের দরজার বেলটা বেজে উঠে। আতাউর সাহেব গিয়ে দরজা খুললেন। সেই স্পেশাল মেহমান চলে এসেছে। মিথি দরজার সামনে গিয়ে উঁকি দিতে যাবে ঠিক তখনই তার মা তাকে ঠেলে নিয়ে বিছানায় বসিয়ে দেয়। মিথি ব্রু কুঁচকে বলে,
‘মা, কারা এসেছে?’
‘স্পেশাল মেহমান।’
বলেই মুচকি হাসলেন আমিরা বেগম। মিথি বিরক্ত হলো এবার। বললো,
‘কারা এই স্পেশাল মেহমান বলতো? আমিই বরং গিয়ে একটু দেখেই আসি।’
এই বলে মিথি উঠতে নিলেই তার মা তাকে আবারও জোর করে বসিয়ে দেয়। কিছুটা ধমকের সুরে তিনি তখন বলেন,
‘একদম উঠবি না। বললাম তো সব দেখতে পারবি। এত অস্থির হচ্ছিস কেন? চুপচাপ এখানে বসে থাক। আমি এসে তোকে ঐ রুমে নিয়ে যাবো। ততক্ষণে এক চুলও যেন জায়গা থেকে নড়া না হয়।’
এই বলে আমিরা বেগম রুম থেকে বেরিয়ে গেলেন। আর মিথি অসহায় হয়ে বসেই রইল। কি জানি, তার সাথে কি হতে চলছে?
অনেকক্ষণ পর আমিরা বেগম এলেন। তিনি আস্তে করে মিথির পাশে বসে বললেন,
‘শোন মা ভেতরে গিয়ে আগে সালাম দিবি। তারপর চুপচাপ একটা চেয়ারে বসবি আর উনারা যে যে প্রশ্ন করে তার ঠিক ঠিক জবাব দিবি। কোনো দস্যিপনা যেন না হয়। বুঝেছিস?’
এবার মিথি সিউর হয়ে যায় যে নির্ঘাত তাকে দেখতে এসেছে। ঘাবড়ে যায় সে। কারা এলো? মা তো বলেছিল নৈরিথই আমাকে বিয়ে করবে তবে কি নৈরিথ? কিন্তু এমন হলে তো সে অবশ্যই আগে থেকে সব জানতে পারতো। নেহা তো অবশ্যই তাকে সবকিছু বলতো। তবে? মিথি এবার কাঁদো কাঁদো মুখে বলে,
‘মা, কারা এসেছে বলোনা?’
‘চল, এখনই দেখতে পাবি।’
‘কিন্তু মা..’
‘উম্ম, কোনো কিন্তু না। চুপচাপ আমার সাথে আয়।’
মিথি বুঝে উঠতে পারে না কি করবে? সে ভয়ে ভয়ে মায়ের সাথে সাথে লিভিং রুমে যায়। তার দৃষ্টি নিমজ্জিত। সামনের মানুষগুলোর দিকে তাকানোর সাহস পাচ্ছে না সে। কাঁপা কাঁপা সুরে সালাম দিল। সালামের জবাবের সুরে শুনতে পেল একটা গম্ভীর মহিলা কন্ঠ। আমিরা বেগম মিথিকে একটা চেয়ারে বসালেন। সে এখনও নিচের দিকেই তাকিয়ে আছে। সামনের মানুষগুলোর পা ছাড়া আর কিছুই চোখে পড়ছে না তার। হঠাৎ তার চোখ আটকে যায় এক জোড়া উজ্জ্বল ফরসা রঙের পায়ের উপর। যার কনিষ্ঠা আঙ্গুলটাতে সিলভার রঙের একটা রিং পরা। মিথির মনে হয় সে এই সেইম রিংটা আগে কোথাও দেখেছে অন্য কারোর পায়ে। বেশি সময় নেয়নি এটা মনে হতে যে সে এই সেইম রিংটা নেহার পায়েও দেখেছে। মিথি তখন ফট করেই সে পা জোড়ার অধিকারী মানুষটির দিকে তাকায়। চেঁচিয়ে উঠে বলে,
‘তুই? তুই এইভাবে এখানে..?’
মিথি কথা বলতে বলতে আশে পাশে তাকাল। দেখল নেহার পাশেই নৈরিথ বসা। ফর্মাল ড্রেসআপ তার। আর অন্য একটা সোফাতে নৈরিথের আম্মু বসা। কিছুক্ষণের জন্য যেন মিথির মস্তিষ্ক কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে। সে অবাক চোখে মানুষগুলোকে দেখে।
নেহা নাক মুখ কুঁচকে বলে,
‘এই মেয়েকে জীবনেও আমি আমার ভাইয়ের বউ বানাবো না। যার মধ্যে নূন্যতম কোনো ভদ্রতা নেই। প্রথম দেখাতেই নিজের হবু ননদের সাথে তুই তুকারি শুরু করেছে। কি সাংঘাতিক মেয়ে! না, না এই মেয়েকে বাড়ির বউ করা যাবে না। ভাই তুই চিন্তা করিস না। আমরা তোর জন্য আরো ভালো মেয়ে দেখব।(নৈরিথের দিকে তাকিয়ে)’
নেহার কথা শুনে সকলেই হেসে উঠে। মিথি ক্রুদ্ধ দৃষ্টিতে নেহার দিকে তাকায়। নেহা দুই ব্রু নাচিয়ে বলে,
‘কেমন দিলাম সারপ্রাইজটা?’
মিথির এখনও যেন কিছু বিশ্বাস হচ্ছে না। তবে কি নৈরিথের সাথেই তার বিয়ে ঠিক হতে যাচ্ছে? সিরিয়াসলি? মিথি এবার লজ্জায় মাথা নুইয়ে ফেলে। নৈরিথের মা বললেন,
‘আমার তো মিথিকে আগে থেকেই পছন্দ। এখন শুধু বিয়ে পড়ানোই বাকি। এখন আপনারা যা সিদ্ধান্ত নিবেন তাই হবে (মিথির বাবার দিকে তাকিয়ে)’
নেহা বলে উঠল,
‘আরে দাঁড়াও দাঁড়াও মা। এইভাবেই মেয়ে পছন্দ হয়ে গেল কি করে? আমাদের আগে চেক করতে হবে না যে মেয়ে আসলেই সবদিক দিয়ে পারফেক্ট কিনা?’
তারপর সে মিথির দিকে তাকিয়ে বললো,
‘এই মেয়ে তোমার দাঁতগুলো একটু দেখিতো?’
মিথি রাগি লুকে নেহার দিকে তাকাল। নেহা ব্রু কুঁচকে বললো,
‘ওভাবে তাকাচ্ছো কেন? তোমাকে ভাইয়ের বউ বানাবো তো একটু দেখে নিতে হবে না। দেখি দেখি তোমার দাঁত দেখাও। তারপর চুল দেখাবা। তারপর একটু হেঁটে দেখাবা। আর কি কি রান্না জানো বলতো? আদৌ কিছু জানো নাকি একেবারেই অকর্মণ্য?’
মিথি দাঁতে দাঁত চেপে নেহার দিকে তাকায়। অগ্নি চক্ষে তাকে হুমকি দেয় একা পেলেই তার জান শেষ। নেহা তাকে চোখ মারে। মিথি নাকের পাল্লা ফুলিয়ে বলে,
‘এত কিছু দেখে নিয়ে যাওয়ার চেয়ে ভালো অনলাইন থেকে একটা বউ অর্ডার করে ফেলেন। তাহলে আর এত ঝামেলা পোহাতে হবে না।’
‘ওহ ভালো আইডিয়া দিয়েছো তো। এই ভাই অনলাইন থেকে একটা বউ অর্ডার করবো? নাকি এনাকেই হলে চলবে?’
নৈরিথ স্মিত হেসে বলে,
‘ইনি হলেই চলবে।’
নেহা দাঁত কেলিয়ে হাসে। বাকি সবাইও মুচকি হাসে। মিথি মাথা নিচু করে ফেলে। চোখ বুজে একটা নিশ্বাস নেয়। মনটা প্রশান্তিতে ভরপুর। এই তো তার ভালোবাসা তার খুব কাছে। হাত বাড়ালেই ছুঁতে পারবে।
.
.
মিথি আর নৈরিথ অন্য রুমে। লিভিং রুমে বড়োরা কথা বলছে। নৈরিথ মিথির টেবিলটার সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে সেই উপন্যাসের বইটা দেখছে। আর মিথি বিছানায় বসে বসে নৈরিথকে আড়চোখে খেয়াল করছে।
কিছুটা সময় পর নৈরিথ বইটা বন্ধ করলো। তারপর মিথির পাশে গিয়ে বসলো। চুলগুলোতে একটু হাত বুলিয়ে দিয়ে মিথির দিকে তাকাল। হুট করেই বললো,
‘সুন্দর লাগছে।’
মিথির গালগুলো লজ্জায় লাল হলো। লজ্জাবতী গাছের মতো আরো কিছুটা নুইয়ে পড়ল সে। নৈরিথ হাসল। বললো,
‘যেই মেয়ে সামন্য প্রশংসা শুনে এমন লজ্জায় লাল হতে পারে সেই মেয়ে আবার মনে মনে মা হওয়ার প্লেনিংও করে ফেলেছে? হাউ?’
মিথি বাঁকা চোখে নৈরিথের দিকে তাকায়। মারাত্মক অসভ্য ছেলে। এই এক কথা নিয়ে এখনও তাকে জ্বালিয়ে যাচ্ছে। আর হয়তো ভবিষ্যতেও তাকে জ্বালাবে। মিথি চোখ মুখ কুঁচকে নিচের দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর হঠাৎ কি ভেবে নৈরিথকে বললো,
‘হঠাৎ আমায় বিয়ে করতে চাইছেন কেন? আমাকে না আপনার পছন্দ না?’
নৈরিথ বাঁকা হেসে বললো,
‘তোমাকে পছন্দ না ঠিকই কিন্তু, তোমার ইচ্ছের কথা শোনার পর থেকেই না শুধু মনে হচ্ছে তোমার এই ইচ্ছেটা আমার পূরণ করা উচিত। বেশি কিছু না তো মা’ই তো হতে চেয়েছো। এটা আর এমন কি বড়ো ব্যাপার? তাই আরকি বলতে পারো এই জন্যই এই বিয়েটাতে মত দিয়েছি?’
সিরিয়াসলি? এই অসভ্য মানুষটা তাকে মা বানানোর জন্য বিয়ে করছে? ও আল্লাহ! মিথি জোরে জোরে নিশ্বাস নিতে থাকে। কবে জানে এর কথা বার্তা শোনে তার দম বেরিয়ে যায় এক আল্লাহই জানেন।
#তোমাতেই_পরিপূর্ণ
লেখিকা-জান্নাতুল ফারিয়া প্রত্যাশা
২৪.
~
‘সবকিছু যখন ঠিক ঠাক তখন আর অপেক্ষা করে কি হবে? আজই বরং ওদের কাবিনটা করিয়ে ফেলি? কি বলেন ভাই?’
আতাউর সাহেব খুশিতে ঝলমলিয়ে উঠলেন কথাটা শুনে। বললেন,
‘অবশ্যই অবশ্যই আপা। আমার তো কোনো আপত্তি নেই। তবে আমাদের ছেলে মেয়ের সিদ্ধান্তটাও তো জানতে হবে। নেহা মা যাও তো ওদের একটু এই রুমে নিয়ে এসো।’
‘ঠিক আছে আংকেল, যাচ্ছি।’
নেহা মিথির রুমে গেল। নেহাকে দেখা মাত্রই মিথি ছুটে গিয়ে তার হাতটা চেপে ধরল। কর্কশ গলায় বললো,
‘খুব বড়ো বড়ো কথা বলছিলি তাই না? কুত্তি, এক আছাড় মেরে তোকে চ্যাপ্টা বানিয়ে ফেলব। অসভ্য কোথাকার। কিচ্ছু বলেনি আমাকে, আর আমি এইদিকে টেনশন করতে করতে শেষ।’
নেহা দাঁত বের করে হাসল। বললো,
‘আগে থেকে বলে দিলে কি আর সারপ্রাইজ থাকতো, হু? আর এখন আরো একটা সারপ্রাইজ আছে। ঐরুমে চলো তাড়াতাড়ি। ভাই তুইও চল।’
মিথি ব্রু কুঁচকে বললো,
‘আগে বল কি সারপ্রাইজ তারপর যাবো।’
নেহা তার দুই হাত মিথির কাঁধের উপর রেখে মিহি কন্ঠে বললো,
‘তোমাদের এখন কাবিন হবে। মা আর আংকেল সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে। তাই তোমাদের মতামত জানতেই ডাকা হয়েছে। চলো চলো।’
মিথি বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে রইল। মানে আজই কাবিন? প্রথম সারপ্রাইজটা সামলে উঠতে পারলেও এটাতে সে আটকে গেছে। উদ্ভুত লাগছে সবকিছু। সে নৈরিথের দিকে তাকাল। নৈরিথ স্বাভাবিক। মিথি কিছু একটা ভাবল। নেহাকে বললো,
‘তুই যা নেহু। আমরা এখনই আসছি।’
‘কেন, আমার সাথে আয়?’
‘না আমার একটু উনার সাথে কথা আছে। তুই যা আমরা আসছি।’
নেহা চোখ মেরে বললো,
‘ওহহো উনি! ঠিক আছে ঠিক আছে তুমি তোমার উনার সাথে কথা শেষ করে জলদি এসো। আমি গেলাম।’
নেহা চলে যেতেই মিথি নৈরিথের সামনে গিয়ে দাঁড়াল। নৈরিথের কপালে ভাঁজ পড়ল। মিথির মুখ দেখেই সে বুঝতে পারছে মেয়েটা কোনো গভীর চিন্তায় মগ্ধ। নৈরিথ তাই জিগ্যেস করলো,
‘কি হয়েছে?’
মিথি মাথা নিচু করে নিশ্বাস নিল। ক্ষীণ সুরে বললো,
‘আমি শারীরিক ভাবে সুস্থ নয়। আমার একটা কিডনী নেই। আমি জানি বেঁচে থাকার জন্য কেবল একটা কিডনীই যথেষ্ঠ। কিন্তু, সেক্ষেত্রে আমাকে অনেক কিছু বেছে চলতে হবে। সবসময় ডক্টরের কাছে দৌঁড়াতে হবে। কারি কারি ঔষধকে আগলে ধরে বাঁচতে হবে। আর এইসব কিছু আপনিও জানেন। একটা অসুস্থ মানুষকে নিয়ে সারাজীবন কিভাবে পার করবেন? এক সময় হাঁপিয়ে উঠবেন। মনে হবে সবকিছু অসহ্য লাগছে, মনে হবে আর পারছেন না। কিন্তু তখন চাইলেও সবকিছু থেকে বেরিয়ে আসতে পারবেন না। একটা কিছু আটকে দিবে আপনাকে। আপনি জোর করে নিজেকে মানিয়ে নিবেন। কষ্ট হলেও সহ্য করে নিবেন। তবুও কিছু বলবেন না। হয়তো আমার কষ্টের কথা ভেবে। একদিন তো এমনটাই হবে, তাই না?’
মিথির কন্ঠ শেষে ধরে আসছিল। এখন তার মনে হচ্ছে সে নিজেকে নৈরিথের উপর চাপিয়ে দিচ্ছে না তো? তার জন্য নৈরিথের স্বাভাবিক জীবনটা নষ্ট হয়ে যাবে না তো? আপাত দৃষ্টিতে সবকিছু যতটা সহজ বাস্তবে ঠিক ততটাই কঠিন।
নৈরিথ অনেকক্ষণ চুপ করে রইল। চেয়ে রইল তার সামনে দণ্ডায়মান এই নিখুঁত সুন্দর মানবীটার দিকে। নৈরিথ জিভ দিয়ে তার ঠোঁট ভিজিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলল। তারপর সে মিথির হাতদুটো নিজের হাতের মুঠোতে নিল। মিথি অবাক হয়ে তাকাল। চোখ দুটি বিস্ময়ে তার চিক চিক করছে। নৈরিথ নরম সুরে বললো,
‘একটা মানুষ বিয়ে কেন করে বলতে পারো? আচ্ছা, একটা পুরুষ মানুষ কেন বিয়ে করে? নিজের শারিরীক চাহিদা মেটানোর জন্য? নিজের মানসিক শান্তির জন্য? নাকি এই দুটোর জন্যই? আচ্ছা এই দুটো জিনিস কি বিয়ে ছাড়া পাওয়া যায় না? যায় তো, এই যে আজকালকার সো কলড গার্লফ্রেন্ড বয়ফ্রেন্ডরা তারা কিন্তু বিয়ে না করেও এই দুটো জিনিসই উপভোগ করতে পারছে। তবে মানুষ বিয়ে কেন করে?(একটু থেমে) মানুষ বিয়ে করে একটা বন্ধু পাওয়ার জন্য। যেই বন্ধু বিনা স্বার্থে আজীবন তার পাশে থাকবে। যেই বন্ধু তার সবথেকে খারাপ সময়েও তাকে ছেড়ে যাবে না। যেই বন্ধু এটা ভাববে না যে এই মানুষটা অসুস্থ তার সাথে কিভাবে সারাজীবন পার করবো। বরংচো সে এটা ভাববে এই মানুষটাকে সারাজীবন কিভাবে আগলে রাখবে, কিভাবে ভালো রাখবে। তার সমস্ত চিন্তা জুড়ে থাকবে তার এই বিয়ে করা বন্ধু। যাকে নিয়ে সে দিব্যি তার জীবন কাটিয়ে দিতে পারবে। তো এখন বলো, বউ না বন্ধু হবে আমার? আমি জানি আমাকে তোমার প্রয়োজন নেই। কিন্তু আমার তোমাকে প্রয়োজন। বন্ধু হিসেবে প্রয়োজন। যখন জীবনের এক পর্যায়ে গিয়ে সবকিছু অসহ্য লাগবে তখন যেন তোমাকে পাশে পায়। যখন মনে হবে আর পারছি না তখন যেন তোমাকে পাশে পায়। পাশে থাকবে তো আমার?’
মিথি কেঁদে ফেলল। লজ্জায় আর সংকোচে মাথা নুইয়ে ফেলল। নৈরিথ মুচকি হেসে বললো,
‘কাঁদতে হবে না। আমি জানি তোমার সম্মতি আছে। তবে চলো আমাদের বন্ধুত্বকে পাকাপাকি করার জন্য এগ্রিমেন্টে সই করা যাক।’
মিথি চোখ বুজে জোরে শ্বাস টানলো। নিজেকে শক্ত করে বললো,
‘ঠিক আছে, চলুন।’
.
.
কিছুক্ষণ আগেই মিথি আর নৈরিথের কাবিন সম্পন্ন হয়েছে। মিথি কেঁদে কেটে এখন পড়ে ঘুমাচ্ছে। ঐদিকে টেবিলে সবাই খেতে বসেছে। নৈরিথের জামাই আদর চলছে। বেচারা লজ্জায় লাল। নতুন জামাই বলে কথা।
.
জীবন বড় অদ্ভুত! কখন কার সাথে কি ঘটে তার কোনো ঠিক ঠিকানা পাওয়া যায় না। এই যেমন আজ সকালেও কি মিথি জানতো তার আজ বিয়ে হয়ে যাবে? জানতো না। এমন অনেক কিছুই প্রত্যেকটা মানুষের জীবনে প্রতিনিয়ত ঘটে যাচ্ছে। হুট করেই এমন কিছু হয়ে যাচ্ছে যেটা আমরা কোনোদিন কল্পনাও করেনি। এই বাড়ির মেয়েটা এখন সময়ের ব্যবধানে অন্য বাড়ির বউ। আসলেই জীবন বড়ই অদ্ভুত!
.
ঘুমের মাঝেই মিথি টের পায় তার পা টা সিড়সিড় করছে। বিরক্ত হয়ে নড়ে উঠে সে। তবুও সেই সুড়সুড়ানিটা কমছে না। বিরক্ত হয়ে চোখ মেলে তাকায় সে। পায়ের সামনে নেহাকে দেখে লাথি মারে। নেহা বড়ো বড়ো চোখ করে চেঁচিয়ে উঠে বলে,
‘কত বড় বেয়াদব মেয়ে! নিজের একমাত্র ননদকে লাথি মারে? ও মাই গড! এ কার সাথে আমি আমার ভাইয়ের বিয়ে দিয়েছি? হায় খোদা, আমি জেনে বুঝে এই বেয়াদব মেয়েটার সাথে আমি আমার ভাইয়ের বিয়ে কি করে দিতে পারলাম?’
নেহা ন্যাকা কান্না জুড়ে বসলো। মিথি তখন চেঁচিয়ে উঠে বললো,
‘উফফ, নেহু। আমার প্রচন্ড পেটে ব্যাথা করছে। আমাকে একটু উঠে বসা প্লীজ, আমি উঠতে পারছি না।’
নেহা লাফিয়ে মিথির কাছে গিয়ে তাকে ধরে উঠে বসায়। তারপর অস্থির হয়ে বলতে থাকে,
‘হঠাৎ পেটে কেন ব্যাথা করছে? সেলাইটাতে কোনো সমস্যা হয়েছে? ঔষধ খাসনি আজকে? দাঁড়া, আমি ভাইকে ডেকে নিয়ে আসছি।’
নেহা উঠতে নিলেই মিথি তার হাত ধরে ফেলে। তারপর দাঁত কেলিয়ে হেসে বলে,
‘আরে বেবি এত হাইপার হচ্ছো কেন? এসব কিছু আমার এক্টিং ছিল তোমার ন্যাকামো থেকে বাঁচার জন্য।’
নেহা মিথির বাহুতে চড় মেরে বললো,
‘শয়তান মেয়ে, আমি তো সত্যি সত্যিই খুব ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম।’
মিথি হাসে। তারপর হঠাৎ মনে পড়ে, আরে তার তো বিয়ে হয়ে গিয়েছে। কাবিন নামাতে সাক্ষর করতে গিয়ে কাঁদতে কাঁদতে একেবারে ঘুম। এমন অদ্ভুত কাজ আজ পর্যন্ত কোনো বউ করেছে কিনা সন্দেহ। মিথি আশেপাশে চোখ বুলিয়ে বলে,
‘এই নেহু, তোর ভাই কই? আর আমার শ্বাশুড়ি মা, উনি আবার রেগে টেগে যাননি তো আমি এইভাবে ঘুমিয়ে পড়াতে?’
নেহা বিরক্ত হয়ে বললো,
‘না কেউ রাগে নি কারণ সবাই জানে তুমি যে ঘুম ছাড়া আর কিছু পারো না। মা আর ভাই লিভিং রুমে। খাওয়া শেষ করে এখন মিষ্টি খাচ্ছে বোধ হয়। আর আমাকে আন্টি পাঠিয়েছে তোকে ডাকার জন্য। কিছুক্ষণ পরেই আমরা চলে যাবো তাই।’
মিথি কিছুটা অস্বস্তি বোধ করছে। এইভাবে কেউ ঘুমিয়ে পড়ে? তার শ্বাশুড়ি মা কি ভাবল তাকে নিয়ে কে জানে? মিথিকে কিছু ভাবতে দেখে নেহা ফিসফিসিয়ে বললো,
‘কি রে কি ভাবছিস, বাসরের কথা? ভাবছিস বিয়ে তো হয়ে গিয়েছে এবার বাসরের পালা। কিন্তু শোন, কাবিনের পরে কিন্তু ছেলে তার বাড়ি ব্যাক করে ওসব বাসর টাসর তখন হয় না। সেসব হয় একদম অনুষ্ঠানের পর। তবে তুই যদি বলিস আমি কিছু একটা করে দেখতে পারি। আই মিন আমাকে শুধু পাঁচশ টাকা ঘুষ দিয়ে দে আমি এক্ষুণি তোর বাসরের ব্যবস্থা করে ফেলছি।’
মিথি তাচ্ছিল্যের সুরে বললো,
‘থাক বেবি তোমার কোনো কষ্ট করতে হবে না। আমার না বাসর করার কোনো ইচ্ছে নেই। আর আমার মনে হয় তোমার ভাইয়েরও সেই ইচ্ছে নেই। তাই অযথা তোমার কোনো কষ্ট করতে হবে না। জাস্ট চিল বেবি।’
নেহা নাক মুখ কুঁচকে বললো,
‘যা ফকিন্নি। আমার কথার দাম দিলি না তো, ওকে ফাইন। আমিও আর যেচে পড়ে কাউকে সাহায্য করতে যাবো না।চললাম আমি।’
নেহা উঠে দাঁড়িয়ে দরজার সামনে গেল। আবার কি ভেবে পেছনে তাকিয়ে বললো,
‘ফ্রেশ হয়ে তাড়াতাড়ি লিভিং রুমে আয়। আমার ভাইটা তার বউকে দেখতে না পেয়ে কষ্টে মরে যাচ্ছে।’
চলবে..
চলবে..