#তোমাতেই_পরিপূর্ণ
লেখিকা-জান্নাতুল ফারিয়া প্রত্যাশা
২৯.
~
কালো রঙের এক থ্রি পিস পরেছে মিথি। চুলগুলো বেণি করা। চোখে মুখে একরাশ শুভ্রতা। সাধারণের মধ্যে অসাধারণ লাগা বলে একটা ব্যাপার আছে না, মিথি কে দেখেও এখন তাই মনে হচ্ছে। নৈরিথ চোখ নামাল। বেশি তাকালে নজর লেগে যেতে পারে। তাই সে ছোট্ট একটা নিশ্বাস ফেলে বললো,
‘গাড়িতে বসো।’
মিথি পেছনের সিটে মাহির সাথে বসলো। ড্রাইভিং সিটে নৈরিথ বসা। লুকিং গ্লাস দিয়ে সে একবার বিরক্ত চোখে মিথির দিকে তাকাল। কিন্তু মিথির দৃষ্টিতে পড়ল না সেই বিরক্ত চোখ জোড়া। সে আরাম করে বসলো। নৈরিথ গাড়ি স্টার্ট করলো।
কোচিং সেন্টারটা বেশি দূর না। পনেরো মিনিটের রাস্তা। দুতলা বিল্ডিংটাতে প্রথম তলাতে অফিস আর দ্বিতীয় তলায় ক্লাস। মিথি আর মাহিকে নিয়ে নৈরিথ প্রথম অফিসরুমে ঢুকে। সেখানে গিয়ে এই কোচিং এর প্রধান মালিকের সঙ্গে কথা বলে। নৈরিথের তার কথা বার্তা পছন্দ হলো। সেখানকার পরিবেশও বেশ ভালো। সব কথাবার্তা শেষে একজন স্যার তাদের নিয়ে দুতলায় গেলেন ক্লাস দেখানোর জন্য। ক্লাসগুলোও পছন্দ হলো তাদের। মিথিকে নিয়ে তার ক্লাসের সকলের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন। পরিচয় করানো শেষে স্যার মিথিকে বললো,
‘যাও ঐ বেঞ্চটাতে গিয়ে বসো।’
মিথি চুপসানো মুখে নৈরিথের দিকে তাকায়। নৈরিথ ইশারায় জিগ্যেস করে,
‘কি হয়েছে?’
মিথি আস্তে করে নৈরিথকে বলে,
‘কাল থেকে ক্লাস করি?’
নৈরিথ ব্রু কুঁচকে ফেলল। বললো,
‘কেন? আজকে ক্লাস করলে কি সমস্যা?’
মিথি কাঁদো কাঁদো মুখে বললো,
‘না না আজকে না প্লীজ। কালকে থেকে ক্লাস করবো, প্লীজ।’
নৈরিথ দীর্ঘশ্বাস ফেলে। এই মেয়ে জীবনেও শোধরাবে না। নৈরিথ তখন সেই টিচারকে বললো,
‘স্যার, আজ থাক। কাল থেকে প্রতিদিন ও ক্লাস করতে আসবে। আর হ্যাঁ, যদি ও কোনোরূপ ফাঁকিবাজি করে তবে সঙ্গে সঙ্গে আমাকে বলবেন। বাকি ব্যবস্থা আমি করবো।’
মিথির পছন্দ হয়নি নৈরিথের কথাটা। সে মুখ বাকিয়ে অন্যদিকে ঘুরে তাকাল। টিচার জবাবে বলেন,
‘ঠিক আছে, সমস্যা নেই। কাল থেকেই ক্লাস করুক।’
‘আচ্ছা স্যার, আজ তাহলে আসি।’
কোচিং সেন্টার থেকে বেরিয়ে বাইরে দাঁড়ায় মিথি আর মাহি। নৈরিথ তখন পার্কিং লট থেকে গাড়িটা আনতে যায়। মিথি এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখতে থাকে আশে পাশে কি কি আছে। মাহিকেও খেয়াল করছে বার বার। ছেলেটা তখন থেকেই কি যেন ভাবছে। মিথি ঠোঁট উল্টে কিছুক্ষণ মাহির দিকে তাকিয়ে থেকে যেই না তাকে বলতে যাবে কি হয়েছে তার আগেই সা করে একটা বাইক এসে তাদের পাশে থামে। মিথি ভয় পেয়ে খানিকটা পিছিয়ে যায়। মনে হচ্ছিল যেন বাইকটা তার গায়ে উঠে যাবে। মিথি বেশ রেগে যায়। বাইকের মালিকের দিকে তাকিয়ে বজ্র কন্ঠে বলে,
‘এই যে মিস্টার, চোখে দেখেন না নাকি? আরেকটু হলেই তো বাইকটা গায়ে তুলে দিতেন।’
অদ্ভুত ভাবে বাইকের ছেলেটা তাকে পাত্তাই দিল না। সে বাইক থেকে নেমে বাইকের চাবিটা সুন্দর করে পকেটে পুরে কোচিং সেন্টারের দিকে পা বাড়াল। মিথি আশ্চর্য! কত বড়ো বেয়াদব ছেলে। রাগে শরীর রি রি করে উঠে তার। মিথি ঘুরে তার বাইকটার দিকে তাকাল। রাগে শরীর জ্বলে যাচ্ছে তার। একে তো প্রথমে ফাতরামি করেছে তারপর আবার বেয়াদবি। এত সহজে বেটাকে ছেড়ে দিলে চলবে না। মিথির মাথায় এক শয়তানি বুদ্ধি এল। সে এগিয়ে গিয়ে বাইকের চাকার সামনে হাঁটু ভাজ করে বসলো। চাকায় হাওয়া ঢুকানোর স্ক্রুটাতে হাত দিতেই পেছন থেকে নৈরিথ কড়া গলায় বলে উঠল,
‘এই মেয়ে কি করছো?’
মিথি ভড়কে যায়। অপ্রস্তুত হেসে পেছন ফিরে তাকিয়ে বলে,
‘এই স্ক্রুটা খুলছিলাম।’
নৈরিথ ব্রু কুঁচকে বললো,
‘এটা কেন খুলছো? এটা খুললে তো চাকার হাওয়া বেরিয়ে যাবে।’
মিথি দাঁত কেলিয়ে হেসে বললো,
‘আমিও তো এটাই চায়। এই ফাজিল বেদ্দপ লোকের বাইকের সব হাওয়া বেরিয়ে যাক। পারলে তো এরও সব হাওয়া বের করে ফেলতাম।’
মিথির কথার আগা মাথা বুঝে উঠতে পারেনা নৈরিথ। সে মাহির দিকে তাকিয়ে ইশারায় জিগ্যেস করে কি হয়েছে। মাহি তাকে সবকিছু খুলে বলে। নৈরিথও এবার রেগে যায়। চেঁচিয়ে উঠে বলে,
‘ছেলেটা কোথায় গিয়েছে? চলো আমার সাথে। আমি ওর বেয়াদবি এক্ষুণি বের করছি।’
মিথি ড্যাপ ড্যাপ করে নৈরিথের দিকে তাকায়। নৈরিথ তো তাকে নিয়ে বেশ পোসেসিভ। মিথি সবকিছু ভুলে লাফিয়ে উঠে দাঁড়ায়। খুশি খুশি মনে বলে,
‘ওকে পেয়ে কি করবেন? হিরোদের মতো ধুমাধুম ফাইটিং করবেন নাকি?’
নৈরিথ চোখ মুখ বিরক্তিতে কুঁচকে ফেলে। তেতো কন্ঠে বলে,
‘পাগল নাকি? আমি অযথা কোনো ছেলেকে মারতে কেন যাবো। ও একটা মেয়ের সাথে বেয়াদবি করেছে, তাই বলে কি ওকে মেরে ধরে ওর ভুল ধরিয়ে দিতে হবে নাকি? মুখে বলেও বোঝানো যায়। আর সবচেয়ে বড়ো কথা হলো আমি কোনো হিরো না যে কথার আগে হাত চলবে বেশি।’
মিথি রাগে ক্ষোভে অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে মিনমিনিয়ে বলে,
‘আমার বেলায় তো খুব হাত চলতো। কিছু থেকে কিছু বললেই ঠাস ঠাস। এখন আসছে ঢং করতে।’
নৈরিথ ব্রু উঁচিয়ে বললো,
‘কিছু বললে নাকি?’
মিথি বিরক্ত ভরা হাসি দিয়ে বললো,
‘জ্বি, বললাম আপনাকে আর কষ্ট করতে হবে না। ঐ ছেলেকে খুঁজে এনে বসে বসে লেকচার না দিলেও হবে। এমনিতেই ও বুঝে যাবে। তার চেয়ে বরং আপনি আমাকে আর মাহিকে কোথাও ঘুরতে নিয়ে যান। সেটাই আপনার জন্য ভালো হবে।’
নৈরিথ ভাবুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,
‘কিন্তু ছেলেটার সাথে তো কথা বলা প্রয়োজন।’
মিথি এবার রেগে যায়। বলে,
‘না কোনো প্রয়োজন নেই। আর আমি ঐ ছেলেটাকে এখন চিনবোও না। হেলমেট পরা ছিল চেহারা দেখিনি। তাই এখন অযথা এত ঝামেলা করার দরকার নেই। চলুন।’
নৈরিথ আর কিছু বললো না। মাহি আর মিথি গাড়িতে গিয়ে বসলে সে গাড়ি স্টার্ট দেয়। গাড়িটা সোজা গিয়ে থামে মিথিদের বাড়ির সামনে। মিথি জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে অবাক হয়ে বললো,
‘ওমা, এটাতো আমাদের বাড়ি। এই আপনাকে বললাম আমাদের নিয়ে ঘুরতে যেতে। আপনি বাড়িতে কেন নিয়ে এলেন?’
নৈরিথ সিট বেল্টটা খুলে পেছন ফিরে তাকাল। মিথি ব্রু কুঁচকে তার দিকে তাকিয়ে আছে। নৈরিথ ঠোঁট ছড়িয়ে হেসে বলে,
‘আমি অফিস থেকে বসকে বলে এসেছি। আমার এখন ফিরতে হবে। দুপুরের পর একটা মিটিং আছে। তোমাদের নিয়ে ঘুরতে যাওয়া এখন আমার পক্ষে পসিবল না। অন্যদিন না হয় নিয়ে যাবো।’
মিথি মুখ কালো করে ফেলল। আষাঢ়ের কালো মেঘে নিমিষেই ঢেকে গেল তার চোখ মুখ। নৈরিথের সাথে কোনপ্রকার কথা না বলে সে মাহিকে নিয়ে গাড়ি থেকে নেমে সোজা বাসায় চলে গেল। নৈরিথ গাড়ি নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে কিছুক্ষণ। সে জানে মিথি যতই রাগ দেখাক না কেন সে ঠিক এখন তার রুমে গিয়ে বারান্দা থেকে লুকিয়ে লুকিয়ে তাকে দেখবে। সবসময়ই এমন করে এসেছে। আজও তাই করে। মিথি যতই পর্দার আড়ালে নিজেকে লুকাক না কেন নৈরিথ তাকে ঠিকই দেখে ফেলে। এখনও তাই। মিথিকে দেখে মুচকি হেসে নৈরিথ তার গাড়ি স্টার্ট করে। তারপর ছুটে যায় তার অফিসের উদ্দেশ্যে।
বিকেলের দিকে, কমলা রঙের সূর্যটা ঠিক মিথির বারান্দা বরাবর। মিথি তখন সেখানে এক কোণে দাঁড়িয়ে কিছু একটা ভাবতে মগ্ন। রাস্তার ধারের বড়ো বড়ো দুই পিলারের তারের উপর দুটো কাক বসা। অযথায় কাক দু’টো কা কা করে চলছে। তাদের নিচে একজন ভিক্ষুক বসা। তার দুটো পা নেই। হাত দুটো বাড়িয়ে পথচারীদের কাছ থেকে ভিক্ষা খুঁজছেন। কেউ কেউ দুই পাঁচ টাকা দিচ্ছে তো কেউ কেউ আবার তাকে ইগনোর করে চলে যাচ্ছে। মিথি তাকিয়ে তাকিয়ে এসব দেখছে। কোনো কারণ ছাড়াই এসব দেখছে। তার হঠাৎই এখন সেই বাইকের ছেলেটার কথা মনে পড়ছে। ছেলেটা অদ্ভুত। কেমন যেন ব্যবহার তার। মুখটাও দেখতে পেল না। ছেলেটা কি এই কোচিং এই পড়ে? তাহলে তো আবারও তার সাথে দেখা হতে পারে। মিথি একপর্যায়ে বিরক্ত হয়। এই ছেলেটাকে নিয়ে হঠাৎ কেন সে ভাবছে? আর এই ছেলেটাকে নিয়ে ভাবতে গেলেই তার সিফাতের কথা কেন মনে পড়ে যাচ্ছে? আশ্চর্য!
মিথির ভালো লাগছিল না। তাই সে নেহাকে কল দেয়। কিন্তু তার নাম্বার বিজি। মিথির কেন যেন মন বলছে মেয়েটা লুকিয়ে লুকিয়ে প্রেম করছে। আর এই প্রেমটা ইদানিং শুরু হয়েছে। আগে কখনো এই মেয়ের নাম্বার সেই ভাবে বিজি পাওয়া যেত না। কিন্তু এখন যখনই ফোন দিচ্ছে তখনই বিজি। কার সাথে এত কথা বলে? মিথি ছাড়া তো সে আর কারো সাথে এত কথা বলে না। তবে?
মিথির ভাবনার সুতো কাটলো তার ফোনের রিংটোনের শব্দে। তাকিয়ে দেখল নেহা। কলটা রিসিভ করেই মিথি প্রথমে তাকে ইচ্ছেমত ভাষণ দিল। নেহা চুপচাপ সব শুনে গেল। স্বাভাবিক, তার উপর রাগ হওয়াটাই এখন স্বাভাবিক। নেহা শান্ত কন্ঠে বললো,
‘আমাকে তো কিছু বলতে দিবি দোস্ত।’
মিথি তাতে আরো জ্বলে উঠল। বললো,
‘ঐ কে তোর দোস্ত? তোর কোনো দোস্ত নেই। আমি তোর দোস্ত না। আজকে থেকে তোর আর আমার পথ আলাদা। খবরদার যদি আমাকে কোনো কল দিয়েছিস। তোর সাথে আমার সমস্ত সম্পর্ক শেষ। ফিনিসড, টোটালি ফিনিসড।’
রাগে সে ফোঁস ফোঁস করছে। নেহা ছোট্ট একটা ঢোক গিলে বললো,
‘আলাবু বেবি। প্লীজ, বাবু আমার রাগ করেনা। আমি সব বলছি তো তোমায়। একটু শান্ত হয়ে সবকিছু শুনো। প্লীজ!’
মিথি দাঁতে দাঁত চেপে বললো,
‘কি শুনবো হ্যাঁ কি শুনবো? এই যে, তুমি আমার থেকে লুকিয়ে লুকিয়ে প্রেম করছো? এটাই বলবে তো? আমি জানি সবকিছু, তোমার আর কষ্ট করে বলতে হবে না।’
নেহা জোরে নিশ্বাস নিল। বললো,
‘তুই কি করে জানলি?’
ব্যস, হয়ে গেল। তারপর আর কি? যত প্রকারের ঝড় আছে সব বয়ে গেল ফোনের ভেতর দিয়ে। বেচারি নেহা প্রেম করে যেন মহা বিপদে পড়েছে সে। মিথির এক গাদা গালি গালাজ হজম করলো নিরবে। তাও মিথি একটু শান্তি পাক। পেলও। অনেক কিছু বলে মিথি একটু দম নিল। তারপর গম্ভীর সুরে বললো,
‘ছেলেটা কে?’#তোমাতেই_পরিপূর্ণ
লেখিকা – জান্নাতুল ফারিয়া প্রত্যাশা
৩০.
~
নেহা কাচুমাচু করতে করতে বললো,
‘ পরে বলি?’
মিথি কর্কশ গলায় বললো,
‘ না পরে কেন এখনি বল।’
‘ না আসলে, ও বলেছে এখনি যেনো আমি কাউকে ওর ব্যাপারে না বলি। ও নাকি কিছুদিন পর নিজ থেকে এসেই সবার সাথে কথা বলবে। তার আগে ওর পরিচয় কাউকে দিতে বারণ করেছে।’
মিথি চেঁচিয়ে উঠলো। নেহা চোখ বুজে ফেলল। মিথি রাগ দেখিয়ে বললো,
‘ কোথাকার কোন প্রধানমন্ত্রী উনি, যে উনার পরিচয় জানতে আমাদের এত অপেক্ষা করতে হবে। কে এই ছেলে বল? কোথায় থাকে? পড়াশোনা করে নাকি চাকরি? মা বাবা কি করেন? ছেলে দেখতে কেমন? খুব সুন্দর নাকি মোটামুটি?
মিথির এত এত প্রশ্নের তোড়ে নেহা অনেক বিরক্ত হলো। কিন্তু সেটা প্রকাশ করলো না। মিথির এই আচরণ স্বাভাবিক। আজ যদি সেও মিথির জায়গায় থাকতো তবে সেও এমনি করতো।
নেহা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো,
‘ এত হাইপার হচ্ছিস কেন? বলেছি তো সব বলবো তোকে। আমাকে কিছুদিন সময় দে প্লীজ!’
কথাটা একেবারেই পছন্দ হলো না মিথির। একে তো এই মেয়ে এতদিন তার থেকে লুকিয়ে লুকিয়ে প্রেম করে গিয়েছে এখন আবার বলছে তার আরো সময় লাগবে। সে এখনি তার প্রেমিক পুরুষের পরিচয় তাকে দিতে পারবে না। কত বড়ো মাপের বেয়াদব মেয়ে। এই মেয়েকে তো এক্ষুনি ফাঁসিতে চড়ানোর দরকার। মিথির রাগ কমলো না। সে খানিক চুপ থেকে বললো,
‘ তাহলে তুই কিছু বলবি না তাইতো?’
নেহার যদিও কষ্ট হচ্ছিল তাও সে বললো,
‘ না রে দোস্ত।’
মিথি আর কথা বাড়ালো না। প্রচন্ড অভিমান নিয়ে ফট করে কলটা কেটে দিলো। মুখ ভার হলো তার। আজ পর্যন্ত সে একটা সুতোও নেহার কাছ থেকে লুকাইনি। অথচ নেহা, কি সহজেই সব কিছু তার থেকে লুকিয়ে গেছে। ইনফ্যাক্ট এখনও তাকে কিছু বলছে না। অদ্ভুত!
বন্ধুত্বে এসে হানা দিলো অভিমানের বীজ। মিথি কষ্ট পেয়েছে খুব। কান্না পেয়ে যাচ্ছিল। কি করে নেহা তাকে এত কিছু না বলে থাকলো? কি করে? মিথি ফোনটা সঙ্গে সঙ্গেই বন্ধ করে দেয় যেনো নেহা তাকে আর কল দিয়ে বিরক্ত করতে না পারে। ও থাক ওর বয়ফ্রেন্ডকে নিয়ে। মিথিও আর কিছু বলবে না। আর কোনো কথা বলবে না। কারো সাথে কথা বলবে না। মিথি রুমে গিয়ে চুপচাপ বিছানায় শুয়ে পড়লো। একপর্যায়ে ঘুমিয়েও গেলো সে।
‘জল ছবি, রঙমশাল, স্কুল ছুটির হজমিরা
রূপকথার পায়রাদের গল্প বল
বন্ধু চল,
রামধনু, ঝালমুড়ি, হাফ টিকিট, আব্বুলিশ
বিটনুন আর চুরমুরের গল্প বল
বন্ধু চল,
বন্ধু চল রোদ্দুরে,
মনকেমন মাঠজুড়ে
খেলবো আজ ওই ঘাসে
তোর টিমে তোর পাশে
ফুটকড়াই, এন্টেনা, হাতচিঠি, হাফ পেডেল
আয়না আর জলপরীর গল্প বল
বন্ধু চল,
সাপ লুডো, চিত্রহার, লোড – শেডিং, শুকতারা
পাঁচসিকের দুঃখদের গল্প বল
বন্ধু চল,
,,,
…..
ঘুম ভেঙে গেলো মিথির। চোখের ভারী পাতা গুলো মেলে সামনের দিকে তাকালো। অবাক হলো। চমকালো। কিছুক্ষণের জন্য স্তব্দ হয়ে তাকিয়ে রইল। তার সামনে নেহা বসা। হাতে গিটার, তার মিষ্টি সুর। কণ্ঠে তাদের প্রিয় গান। এ যেনো মিথির এক কল্পনার জগৎ। আসলেই বন্ধুত্ব সুন্দর। ভীষণ সুন্দর। নেহা গানটা মাঝপথে থামিয়ে দিল। তারপর সে উঠে মিথির পাশে বসলো। হেসে বললো,
‘ চল একসাথে গাই?’
মিথি হাসলো। সুর তুললো দুই বন্ধু,
বন্ধু চল, বলটা দে
রাখবো হাত তোর কাঁধে
গল্পেরা ওই ঘাসে
তোর টিমে তোর পাশে,,,
মিথি নেহাকে জড়িয়ে ধরলো। নেহাও জড়িয়ে ধরলো তাকে। অনেকক্ষণ দুইজন ঐভাবেই জড়িয়ে ধরে বসে রইলো। মিথি ছাড়লো। অভিমানটা আবারও মাথা চেরে উঠলো তার। সে নাক ফুলিয়ে বললো,
‘ কেন এসছিস এখানে?’
নেহা ঠোঁট উল্টে বললো,
‘ এখনও রেগে আছিস বান্ধবী? আমি সরি।’
মিথি মুখ ঘুরিয়ে নিল। বললো,
‘ থাক সরি বলতে হবে না। আমি রেগে থাকি বা না থাকি তাতে কি কারো কিছু যায় আসে নাকি?’
নেহা মিথির গাল দুটো টেনে আহ্লাদীর সুরে বললো,
‘ আহারে আমার বাবুটা রাগ করেছে? আচ্ছা বাবু এই দেখো কানে ধরছি। আর এমন করবো না। আর জীবনেও তোমার কাছ থেকে কিচ্ছু লুকাবো না। প্রমিজ।’
মিথি ঠোঁট উল্টে বসলো। নাক টেনে বললো,
‘ তাহলে বল ছেলেটা কে?’
নেহা মুচকি হেসে বলে,
‘ কাল তোর সাথে পরিচয় করিয়ে দিব। এখনি কিছু না বলি?’
মিথি বিরক্তিতে মুখ থেকে ‘ চ ‘ শব্দের মত আওয়াজ করে বললো,
‘ এখন আবার কালকের জন্য অপেক্ষা করতে হবে। আজ বললে কি হয়?’
‘ প্লীজজজ, আজকের রাতটায় তো!’
মিথি তপ্ত শ্বাস ছেড়ে বললো,
‘ আচ্ছা ঠিক আছে, মেনে নিলাম তোর কথা। শুধুমাত্র এত কষ্ট করে আমাদের বাসায় এসে এই মিষ্টি গানটা উপহার দিয়েছিস বলে তোকে মাফ করে দিয়েছি। নয়তো জীবনেও মাফ পেতি না। বাই দ্যা ওয়ে, কার সাথে এলি বলতো?’
‘ ভাইয়া দিয়ে গিয়েছে। বলেছিলাম বাসায় আসার জন্য। কিন্তু অফিস করে এসে অনেক টায়ার্ড হয়ে গিয়েছিল তাই আমাকে নামিয়ে দিয়েই আবার বাসায় চলে গিয়েছে।’
‘ তো উনি জানতে চায় নি হঠাৎ এই সময় তুই এখানে কেন আসতে চেয়েছিস?’
‘ জিগ্যেস করেছিল। উল্টাপাল্টা বলে ম্যানেজ করে নিয়েছি।’
‘ ভালোই হয়েছে। আজ তাহলে রাতে আমার সাথে থাকবি। তারপর কাল আমাকে তোর বয়ফ্রেন্ডের সাথে পরিচয় করিয়ে দিবি। বুঝেছিস?’
নেহা বাধ্য মেয়ের মত মাথা নাড়িয়ে বললো,
‘ জ্বি ম্যাডাম, সব বুঝেছি।’
.
.
রাতের খাবার শেষে সবাই যার যার রুমে শুয়ে পড়লো। মিথি আর নেহাও শুয়ে পড়েছে। কিন্তু ঘুম আসছে না কারো চোখেই। দুইজনেই চুপচাপ মাথার উপর ফ্যানটার দিকে তাকিয়ে আছে। নেহা কিছু একটা ভাবছে। সে ঘুরে মিথির দিকে তাকালো। ডিম লাইটের নীল আলোতে মিথিকেও নীল নীল লাগছে। নেহা মাথার নিচে একহাত রেখে মাথাটা কিছুটা উচুঁ করে মিথির দিকে ঘুরে শুলো। তারপর উদ্বেগ নিয়ে বললো,
‘ আচ্ছা মিথি, আমাকে একটা কথা বলবি?’
মিথি তার দিকে ঘুরে তাকালো। প্রশ্ন করলো,
‘ কি কথা?’
নেহা বললো,
‘ তুই একবার একটা ছেলেকে দেখে সিফাত সিফাত বলে পাগল হয়ে উঠেছিলি। পরে আঙ্কেল অনেক কষ্ট করে তোকে থামিয়ে ছিলেন। আচ্ছা কে ঐ সিফাত? তোর কি হয় বলতো?’
মিথির মুখটা বিষণ্ণতায় ছেয়ে গেল। ছোট্ট একটা ঢোক গিলে সে বললো,
‘ আমার বেস্ট ফ্রেন্ড।’
নেহা অনেকটা অবাক হলো। বললো,
‘ তুই তো ওর ব্যাপারে আমাকে আগে কিছু বলিসনি?’
‘ ইচ্ছে হয়নি। ও আমার কাছে নেই। কোথায় আছে তাও জানি না। আমার সাথে কোনো প্রকার যোগাযোগও নেই। তবে জানিস তো ওকে আমি এখনো অনেক মিস করি। ভীষণ মিস করি।’
কথা গুলো বলে থামে মিথি। নেহার দিকে আবারও ঘুরে তাকায়। বলে,
‘ তুই আসার আগে আমার জীবনে ঐ সব ছিল। বড্ড ভালোবাসতো আমাকে জানিস। সবসময় আগলে রাখতে। কিন্তু হঠাৎ একদিন সব কিছু এলোমেলো হয়ে যায়। ও আলদা হয়ে যায় আমার থেকে। আমাকে ছেড়ে অনেক দূরে চলে যায়। যেই দূরত্বটা এতটাই বিশাল ছিল যে আমি এখনো সেটা গুজাতে পারিনি।’
নেহা ক্ষীণ সুরে বলে,
‘ কি হয়েছিল? কেনো সিফাত তোকে ছেড়ে চলে গিয়েছিল?’
মিথি চোখ বুজে নিঃশ্বাস নেয়। পুরনো স্মৃতিগুলো তাজা হয়ে উঠে মস্তিষ্কের প্রতিটি রন্ধ্রে রন্ধ্রে। চোখ মেলে তাকিয়ে মিথি বলতে আরম্ভ করে। তাদের বন্ধুত্ব শুরুর গল্প, তাদের আনন্দের মুহূর্তগুলো, তাদের সুখ দুঃখ গুলো, সব শেষে তাদের আলাদা হওয়া সব বলে মিথি। দম ফেলে সে। গলাটা ধরে এসেছে তার। বুকটা পুরনো ব্যাথায় আবারও চিন চিন করে উঠে। নেহা জড়িয়ে ধরে মিথিকে। সরব গলায় বলে,
‘ আমি সিফাতকে খুঁজে এনে দেবো। তুই একদম মন খারাপ করিস না। সিফাত ঠিক ফিরে আসবে। আর ঠিক তোকে ক্ষমা করে দিবে।’
মিথি হাসে। নেহার মাথায় হাত রেখে বলে,
‘ তোর কথাই যেনো সত্যি হয় নেহু।’
চলবে…
(আসসালামু আলাইকুম। আজকের পর্বটা হয়তো একটু বেশিই অগোছালো। আসলে হয়েছে কি, আমি যেই ফোনে গল্প লিখি সেই ফোনটা তে কি যেনো সমস্যা হয়েছে, কোনোমতেই অন হচ্ছে না। এইদিকে ঐ ফোন ছাড়া আমি টাইপ ও করতে পারি না। ভেবেছিলাম আজকে ঠিক হয়ে যাবে তাই কালকে গল্প দেয়নি। কিন্তু আফসোস, হলো না ঠিক। এখন বাধ্য হয়ে খুব কষ্ট করে আমাকে আমার নতুন ফোনে টাইপিং করতে হয়েছে। আসলে এক ফোনে টাইপিং করতে করতে অভ্যাস হয়ে যাওয়ার পর আবার নতুন ফোনে টাইপিং করতে কষ্ট হয়ে যায়। সব ফোনের কিবোর্ড তো আর এক না। যায় হোক দোয়া করবেন আমার আগের ফোনটা যেনো ঠিক হয়ে যায়। আমি ঐ ফোনটা ছাড়া টাইপিং করে শান্তি পাই না🥺😭)
চলবে..