তোমাতে আসক্ত আমি পর্ব -৪৩

#তোমাতে_আসক্ত_আমি
#ইরিন_নাজ
#পর্ব_৪৩

ঝিরিঝিরি বৃষ্টি হচ্ছে। তার মাঝেই আবরারের বুকে মুখ গু*জে বসে আছে আরশি। দীর্ঘ সময় কাঁ*দার কারণে ক্ষনে ক্ষনে কেঁ*পে উঠছে সে। আবরারের গভীর দৃষ্টি সেই ক*ম্প*নরত আরশির পানেই নিবদ্ধ। ইতোমধ্যেই তার টি-শার্ট এর এক পাশ আরশির চোখের পানিতে ভিজে গেছে। তবুও ন*ড়*চ*ড় নেই তার। সে চাচ্ছে আরশি নিজের বুকের মাঝে জমানো ক*ষ্ট গুলো আজ তার সাথে ভাগ করুক, মন ভরে কাঁ*দু*ক। এতে যদি মেয়েটার ক*ষ্ট একটু কমে। নিজের চোখের সামনে নিজের প্রাণের প্রিয় বাবার মৃ*ত্যু দেখার মতো বড় য*ন্ত্র*না আর কিছু আছে কি? আবরার আরশির জায়গায় নিজেকে কল্পনা করতে গিয়েও করতে পারলো না। প্রাপ্ত বয়স্ক হওয়া সত্ত্বেও অন্তর কেঁ*পে উঠলো তার। অথচ সেই ছোট্ট আরশি সেটা স*হ্য করেছে।

দীর্ঘ সময় চোখের জল ফেলার পর ধীরে ধীরে শান্ত হলো আরশি। এতো বছরের জমানো অব্যক্ত ব্য*থাগুলো ভরসা যোগ্য কারোর কাছে ব্যক্ত করতে পেরে ভীষণ শান্তি অনুভব করলো সে। ঝিরিঝিরি বৃষ্টি হচ্ছে টের পেতেই আবরারের কাছ থেকে সরে আসতে চাইলো সে। কিন্তু ছাড়লো না আবরার। সেভাবেই বুকের মাঝে পুরে রাখলো আরশি কে। আরশি কা*ন্না ভেজা কণ্ঠে বিড়বিড় করে বললো,

— ছাড়ুন এমপি সাহেব। বৃষ্টি হচ্ছে। আমাদের ভেতরে যাওয়া উচিত।

আবরার শান্ত কণ্ঠে বললো,

— এরপর কি হয়েছিল মিসেস অদ্ভুত চোখওয়ালি? আমি সব টা জানতে চাই। যখন বিশ্বাস করে এতটুকু বলেছো, তখন বাকিটাও তোমার মুখ থেকে শুনতে চাই। বলবে না আমায়?

সময় নিলো আরশি। তারপর ধীর আওয়াজে পুনরায় বলতে লাগলো,

— এরপর আর কি? আমার জীবনের সুখের অধ্যায়ের সমাপ্তি ঘটেছিলো সেদিন। এরপর পদে পদে বুঝতে পেরেছিলাম বাবা ছাড়া সন্তান কতটা অ*স*হায়। যখন আমার সেন্স ফেরে তখন নিজেকে হসপিটালে পাই। পাশে চাচিম্মু অর্থাৎ আমার বড় চাচার স্ত্রী বসেছিলেন। হা*উ*মা*উ করে কেঁ*দে আব্বুর কাছে যেতে চেয়েছিলাম। আব্বু কে দেখার জন্য পা*গ*লা*মি করছিলাম। তখন চাচিম্মু আমাকে শ*ক্ত করে জড়িয়ে ধরেন। জানান অতিরিক্ত র*ক্ত*ক্ষ*র*ণের কারণে আমি প্রায় পনেরো ঘন্টা অ*জ্ঞান ছিলাম। ততক্ষনে আমার বাবার জানাজা সম্পূর্ণ হয়ে গেছে, তাকে ক*ব*র ও দেয়া হয়েছে। ক*ষ্টে বুক টা ফে*টে যাচ্ছিলো তখন। শেষবারের মতো আব্বু কে না দেখতে পারার ক*ষ্ট, তার বুকে মাথা রেখে “ভালোবাসি আব্বু” বলতে না পারার ক*ষ্ট। হুট করে আম্মুর কথা মনে হলো। অ*স্থি*র কণ্ঠে চাচিম্মু কে আম্মুর কথা জিজ্ঞাসা করতেই চাচিম্মু জানালো আম্মু পাশের রুমে আছে। তার অবস্থা ও ভালো না। আব্বুর ম*র*দে*হ দেখার পর থেকে কেমন যেনো পা*গ*লের মতো আচরণ করছে। অসংখ্যবার জ্ঞান হা*রি*য়েছে। তাই তাকেও হসপিটালে ভর্তি করা হয়েছে। ক*ড়া ঘুমের ওষুধ দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে রাখা হয়েছে। আম্মুর অবস্থার কথা শুনে ছ*ট*ফ*ট করে উঠলাম আম্মু কে দেখার জন্য। চাচিম্মু ডাক্তারের কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে আসলেন। আমাকে নিয়ে গেলেন পাশের রুমে। আমার সবসময় গোছালো, পরিপাটি থাকা আম্মুর বে*হা*ল দশা দেখে বুক কেঁ*পে উঠলো আমার। এ*লো*মে*লো চুল, চোখের নিচে গাঢ় কালি, মলিন চেহারা। দুই হাতে মুখ চে*পে ডু*ক*রে কেঁ*দে উঠলাম আমি। পরম মমতাময়ী মায়ের মতো বুকে জড়িয়ে নিলেন চাচিম্মু। মাথায় হাত বুলিয়ে বুঝালেন আমাকে শ*ক্ত হতে হবে, আমার মায়ের জন্য হলেও শ*ক্ত হতে হবে। আমার মায়ের যে এখন আমি ছাড়া আর কেউ নেই। আম্মুর কথা ভেবে নিজেকে কিছুটা শান্ত করি। আম্মুর জ্ঞান ফেরা অব্দি ওখানেই আম্মুর হাত ধরে বসেছিলাম। ঘন্টা দুয়েক পর আম্মুর জ্ঞান ফেরে। কিন্তু আমার হাতের মাঝে নিজের হাত দেখে এক ঝ*ট*কা*য় হাত সরিয়ে নেয় আম্মু। ক্রো*ধ আর ঘৃ*ণা মিশ্রিত চোখে আমার দিকে তাকায়। চি*ৎ*কা*র করে বলে আমাকে তার সামনে থেকে চলে যেতে। আমি অবাক চোখে তাকিয়ে থাকি আম্মুর দিকে। ন*ড়*তে ও যেনো ভুলে গিয়েছিলাম তখন। আমি যাচ্ছি না দেখে আম্মু চি*ৎ*কার চেঁ*চা*মে*চি করতে থাকে। রুমে থাকা নার্স এমন অবস্থা দেখে আমাকে বলে রুম থেকে চলে যেতে। আম্মুর ব্রেনে চা*প পরে এমন কোনো কিছু করা যাবে না এখন। এতে ক্ষ*তি*ক*র কিছু হতে পারে। আম্মু তখন অ*স্বাভাবিক আচরণ করছিলো। বারবার চি*ৎ*কা*র করে বলছিলো আমাকে সামনে থেকে চলে যেতে। ধীর পায়ে রুম থেকে বেরিয়ে এসেছিলাম আমি। খুব করে কাঁ*দ*তে চাইছিলাম কিন্তু কেনো যেনো চোখে আর পানি আসলো না। এরপর দুইদিন হসপিটালে থাকতে হলো। দুইদিন পর নিজেদের বাড়িতে ফিরে আসলাম। সাথে আসলো বড় চাচা আর তার পরিবার। আশ্চর্যের বিষয় কি জানেন? আব্বুর মৃ*ত্যু*র খবর শোনার পর আমাদের কোনো আত্মীয় আমাদের বাড়িতে আসে নি। হয়তো আমাদের দায়িত্ব না নেয়া লাগে এই ভ*য়ে। হাসি পাচ্ছিলো তখন। আব্বু থাকতে তারা কি মিষ্টি ব্যবহার ই না করতো! আর আব্বু যাওয়ার পর কেউ শান্তনা টুকু দিতে আসে নি। তবে এটা ভেবে শান্তি লাগছিলো যে সবাই ছেড়ে গেলেও আমার বড় আব্বু মানে আমার বড় চাচা আমাদের ছেড়ে যান নি। কিন্তু উনি যে ভ*য়ং*কর পরিকল্পনা করে আমাদের সাথে ছিলেন তা তখনও বুঝা তো দূর, মাথাতেও আসে নি। দেখতে দেখতে আব্বু যাওয়ার দুই সপ্তাহ পার হলো। চাচিম্মু ছায়ার মতো আমার সাথে সাথে ছিলেন। এর মাঝে যতবার ই আম্মুর সামনে গিয়েছি আম্মু দূর দূর করে তা*ড়ি*য়ে দিয়েছে। আম্মুর চোখে আমি তার স্বামীর মৃ*ত্যু*র জন্য দো*ষী হয়ে গিয়েছিলাম। চাচা চাচিম্মু সাথে ছিলো দেখে ধীরে ধীরে নিজেকে সামলে নিচ্ছিলাম। আব্বু চলে গেলেও দ্বিতীয় বাবা অর্থাৎ আমার বড় চাচার হাত আমার মাথার উপর আছে ভেবে ভরসা পাচ্ছিলাম। কিন্তু সেই বিশ্বাস, ভরসা যে এক নিমিষেই ভে*ঙে চু*র*মা*র হয়ে যাবে তা কে জানতো!

থামলো আরশি। লম্বা একটা শ্বাস টে*নে আবার বলা শুরু করলো,

— আব্বুর যাওয়ার তৃতীয় সপ্তাহ চলছে তখন। হুট করে একদিন সন্ধ্যায় চাচা এসে রু*ক্ষ কণ্ঠে বললেন আম্মু কে নিয়ে বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে। অবাক হলাম আমি। বিস্ময়ে চোখের পাতা ফেলতে পারছিলাম না। মনে হচ্ছিলো যা দেখছি ভুল দেখছি, যা শুনছি ভুল শুনছি। বিশ্বাস হচ্ছিলো না এটা সেই চাচা যে এতদিন আমাদের সাথে এতো সুন্দর ব্যবহার করেছে। কিন্তু চাচা পুনরায় একই কথা বলায় অবাক কণ্ঠে চাচা কে জিজ্ঞাসা করলাম এসব উনি কি বলছেন। চাচা বা*জে একটা গা*লি দিয়ে বললেন বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে। সেদিন কি হলো কি জানি নিজের মাঝে একটা জে*দ অনুভব করলাম। তে*জে*র সাথে বললাম আমার আব্বুর বাসা ছেড়ে আমি কোথাও যাবো না। আর এই বাসা তো আমাদের। উনি যেনো এই বাড়ি থেকে চলে যায়। আমার কথায় খি*ক*খি*ক করে হেসে উঠলেন চাচা। কিছু পেপার্স আমার সামনে ফেলে বললেন এখন থেকে এই বাড়ি আর আব্বুর ব্যাংক এ যা ব্যালেন্স আছে সবকিছুর মালিক উনি। চমকে উঠলাম আমি। দ্রুত পেপার্স হাতে নিয়ে দেখলাম। তেমন কিছু না বুঝলেও এটা বুঝলাম আমাদের সব কিছু আমার চাচা নিজের নামে করে নিয়েছেন। পায়ের তলা থেকে যেনো মাটি সরে গিয়েছিলো এসব দেখার পর। চাচা মানুষটাকে অচেনা লাগছিলো। আমি জে*দ ধরে বসে রইলাম আমার বাসা থেকে আমি কিছুতেই যাবো না। চাচিম্মু আর নাতাশা আপু ও অনেক বুঝানোর চেষ্টা করলো চাচা কে। কিন্তু চাচা মানবার মানুষ নন। উনাদের ও অ*কথ্য ভাষায় গা*লি*গা*লা*জ করলেন, চাচিম্মুর গায়ে হাত পর্যন্ত তু*লে*ছিলেন। তারপর… তারপর আর কি আম্মু আর আমাকে বাড়ি থেকে বের করে দিলেন। চাচা এতো বড় বে*ই*মা*নি করবেন ধারণার বাহিরে ছিলো। এইসব কিছুর মাঝে আম্মু একদম নীরব ছিলো। শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলো আমাদের বাড়িটার দিকে। আম্মুর মুখের দিকে তাকিয়ে খুব ক*ষ্ট হচ্ছিলো কিন্তু কাঁ*দ*তে পারছিলাম না। বুঝতে পেরেছিলাম আমাকে এবার অনেক বেশি শ*ক্ত হতে হবে। কারণ এই সুন্দর পৃথিবী আমার জন্য আর সুন্দর নেই বরং ক*ঠি*ন থেকে ক*ঠি*ন হতে চলেছে। অ*ন্ধ*কা*র হয়ে গেছে তখন। আম্মু কে বাসার সামনে রেখে আমি পাশের দোকানে গিয়ে মুনের বাবা কে ফোন করলাম। মুন আমার বেস্টু ছোটবেলা থেকে। একই স্কুলে পড়াশোনা করেছি আমরা। মুনের বাবা কে সব টা জানানোর পর উনি কিছু সময়ের মধ্যেই আমাদের বাড়ির সামনে আসেন। আমাদের নিজেদের বাড়িতে নিয়ে যান। মুন আর মুনের বাবার এতে কোনো স*ম*স্যা না থাকলেও মুনের আম্মুর মুখ দেখে বুঝতে পেরেছিলাম উনার আমাদের আসা টা মোটেও পছন্দ হয় নি। আর পছন্দ না হওয়াটাই স্বাভাবিক। যেখানে আত্মীয়রা পর্যন্ত মুখ ফিরিয়ে নিলো সেখানে উনি তো বাইরের মানুষ। কিন্তু ওই রাত টা ওখানে কা*টা*নো ছাড়া আর কোনো উপায় ও ছিলো। মুনের বাবা সব টা জানার পর আমাকে পুলিশের হেল্প নিতে বললেন। কিন্তু আইনের উপর থেকে আমার ভরসা একেবারেই উঠে গিয়েছিলো। কারণ আব্বুর মৃত্যু নিয়ে তারা কোনো তদন্ত ই করে নি। যেখানে আমার কাছে স্পষ্ট মনে হয়েছিল আমাদের ইচ্ছা করে হ*ত্যা*র চেষ্টা করা হয়েছিল সেখানে তারা কোনো প্রকার তদন্ত ছাড়াই সেটাকে এ*ক্সি*ডে*ন্ট বলে চালিয়ে দিয়েছে। শুধু এখানেই শেষ নয়, তারা সেই ট্রাক ড্রাইভার কেও খোঁজার চেষ্টা করে নি। তাই পুলিশের কাছে সাহায্য চাওয়া মানে সময় ন*ষ্ট বলে মনে হলো আমার। ওইদিন রাত টা মুনদের বাড়িতেই কা*টা*লাম। সকালে আম্মু কে ওদের বাড়িতে রেখে মুনের বাবার সাথে বেরিয়ে পড়লাম। খুঁজে একটা দুই রুমের ঘর ভাড়া নিলাম। নিম্নমানের এলাকা হওয়ায় ভাড়া খুব বেশি ছিলো না। তবে আমার কাছে বেশিই ছিলো। বাড়িওয়ালি যখন অ্যাডভান্স চাইলো মুখ টা শু*কি*য়ে গেলো আমার। আমার কাছে তখন এক টাকাও নেই। কিন্তু বেশিক্ষন চি*ন্তা করতে হলো না। মুনের বাবা অ্যাডভান্স সহ দুই মাসের ভাড়া দিয়ে দিলেন। মাথায় হাত রেখে বললেন যতক্ষণ না আমার কোনো ব্যবস্থা হচ্ছে উনি সাহায্য করবেন। এর জন্য আমি সারাজীবন উনার কাছে কৃতজ্ঞ থাকবো। এরপর আম্মু কে নিয়ে নতুন বাড়িতে উঠলাম। কাজের খোঁজ করতে লাগলাম। আমাকে দেখে মায়া হলো প্রতিবেশী আন্টির। উনি খোঁজ করে কিছু টিউশন পাইয়ে দিলেন। খুব বেশি বেতন ছিলো না তবে চলার মতো। নাতাশা আপুর সাথে যোগাযোগ করে আমার সার্টিফিকেট গুলো নিয়ে একটা সরকারি কলেজে ভর্তি হলাম। দেখলেন ভাগ্য কাকে, কখন, কোথায় নিয়ে যায়? কোথায় আমার পড়ার কথা ছিলো বেস্ট কলেজে, সেই আমি ভর্তি হলাম একটা সরকারি কলেজে। অবশ্য এতে আমার রেজাল্ট এর কোনো ক্ষ*তি হয়নি। কারণ পড়াশোনা নিজের কাছে। আমি যেখানেই পড়ি না কেনো, ভালোমতো পড়াশোনা করলে আমাকে ভালো ফলাফল করা থেকে ঠে*কা*বে কে?

চলবে,

(আস্সালামুআলাইকুম। লেখার মাঝে কোনো ভু*ল থাকলে ক্ষ*মা করবেন। কেমন লেগেছে আজকের পর্ব জানাবেন অবশ্যই আর ভু*ল-ত্রু*টি ক্ষ’মা’র দৃষ্টিতে দেখবেন। ধন্যবাদ।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here