#তোমায়_ছোঁয়ার_ইচ্ছে
#পর্ব_১৮
#সুমাইয়া মনি
টানা আধা ঘণ্টা পর মিটিং শেষ হয়। গ্রিন কোম্পানির অফিসের ভেতর থেকে বের হবার সময় ইভান রাদকে পিছন থেকে ডেকে নিকটে এগিয়ে আসে। তিনি খুব সৌজন্যসূচক ভাবে জিজ্ঞেস করে,
‘ফ্যাভোর চাই!’
‘বলুন মি.ইভান।’
‘আপনার পি.এ ইসানাকে আমেরিকা শহর ঘুরে দেখাতে চাই।’
‘অবশ্যই! যেতে পারেন। যদি সে যেতে চাই তো!’
‘মিস.ইসানা আপনি যাবেন আমার সঙ্গে?’ কথাটা বলতে বলতে ইসানার পানে তাকাল ইভান। বাকিরাও তাকিয়ে আছে। রাদ মনে মনে চাইছে ইসানা যেন না বলে দেয়। সে এক প্রকার বাধ্য হয়েই যেতে দেওয়ার কথাটি বলেছে। রাদের এই একই চাওয়া ইমরানও চাইছে। ইসানা জোরপূর্বক ঠোঁটে হাসি ফুটিয়ে বলল,
‘মাথায় পেইন হচ্ছে আজ যেতে চাইছি না।’
‘কোনো সমস্যা নেই। কাল সকালে বের হবো।’
ইসানা চোখের পলক ফেলে মাথা হালকা দুলিয়ে হ্যাঁ সম্মতি জানায়। ইভান প্রচুর খুশি হয়।
‘ওকে সি ইউ টুমোরো।’ বাক্য উচ্চারণ করতে করতে চলে যায়। ইসানা সবাইকে উপেক্ষা করে আগেভাগে হেঁটে গাড়িতে উঠে বসে। রাদ, ইমরান স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে। তবে বিপদের আভাস পুরোপুরি ভাবে কাটেনি। লিসা ইসানার পাশাপাশি না বসে রাদের পাশে এসে বসে। তার মনে কিঞ্চিৎ রাগ এসে ভর করেছে। সে ইসানাকে নিয়ে ঈর্ষা অনুভব করছে। সিনিয়র অপারেটর হয়েও তার থেকে ইসানাকে সবাই প্রায়োরিটি বেশি দিচ্ছে। ভেতরে ভেতরে ক্ষোভ জাগ্রত হচ্ছে ইসানার ওপর। মুরাদ ইসানার পাশে বসেছে। রাদের ফেইস দেখে সে খুব মজা পাচ্ছে। অনিচ্ছুক কাজ তাকে করতে হচ্ছে মানবতার খাতিরে। অন্যসব বিষয় আলাদা হলেও, ইসানার বিষয় রাদ একটু বেশিই সেনসিটিভ। প্রেয়সী বলে কথা! তার গুরুত্ব সবার থেকে কয়েক গুন বেশি।
হোটেলে ফিরে ইসানা বিছানার নিচে বসে পড়ে। আস্তেধীরে কার্পেটের উপর জড়োসড়ো হয়ে শুয়ে রয়। চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে করছে তার। কিন্তু পরিস্থিতি তাকে বাঁধা সৃষ্টি করছে। এক সময় যে স্বামী তাকে রিজেক্ট করেছিল, এখন সে তাকে কয়েক গুন বেশি মূল্যায়ন করছে। আঁখিযুগল বন্ধ করে নেয় সে। ভীষণ কষ্ট হচ্ছে তার। যেটা ভাষায় প্রকাশ করা বড্ড দায়!
মিনিট পাঁচেক পর রাদ ইসানার দরজায় নক করল। ইসানা শোয়া থেকে উঠে নিজেকে স্বাভাবিক করে দরজা খুলে দেয়। দরজা খুলে দেওয়ার পর পরই রাদ ইসানার দিকে মেডিসিনের পাতা এগিয়ে দিয়ে বলে,
‘খেয়ে ঔষধ নিন, পেইন সেরে যাবে।’
ইসানা হাতে নিয়ে বিনাবাক্যে দরজা বন্ধ করে দিলো। সে তখন মাথা ব্যথার বিষয় মিথ্যা কথা বলেছিল। কারণ ইসানা যেতে চাইনি তার প্রাক্তন স্বামীর সঙ্গে বেড়াতে। কিন্তু তবুও সে ফেঁসে গেছে। কাল তাকে না চাইলেও যেতে হবে।
এদিকে ইসানার নিরবতা রাদকে ভেতরে ভেতরে পীড়া দিচ্ছে। রুমের দিকে এগোতেই মুরাদ দরজার সামনে দাঁড়িয়ে হেলান দিয়ে বাক্য টেনে উচ্চারণ করল ‘কী?’
রাদ কপাল কুঁচকে তাকিয়ে বলল,
‘তোর কী সমস্যা? সেদিন আইডিয়া দিলি কীভাবে তাকে পটাবো। আর আজকাল দেখছি তুই সাহায্যের বদলে আমাকে ইর্রিটেট করছিস।’
‘তোর ব্যবহারে আমি ইর্রিটেট।’
‘হোয়াই?’
‘জীবনেও প্রেম না করার নতিজা এটা।’
‘তুই নিজেও তো করিস নি। সিঙ্গেল থেকেছিস। এখন আমাকে জ্ঞান দিচ্ছিস।’
‘তবুও তো আমারটা হলো।’
‘আমারটিও হবে।’
মুরাদ কানের মধ্যে কেনি আঙুল ঢুকিয়ে বিড়বিড় করে বলল,
‘স্বপ্নে!’
‘বাস্তবে হবে।’
‘দেখা যাক। চ্যালেঞ্জ এক্সেন্টেড!’
‘আমি কোনো চ্যালেঞ্জ দিচ্ছি না।’
‘দিতে হবে। আপসে না হলে জোর করে নিবি।’
রাদ বিরক্ত হয়ে বিড়বিড় করে ‘ফালতু’ উচ্চারণ করে চলে গেল।
মুরাদ শুনে ফেলে চেঁচিয়ে বলে,
‘তুই ফালতু।’
রাদ ওর এক পায়ের জুতো ছুঁড়ে দেয় মুরাদের নিকট। মুরাদ জুতোটি ক্যাচ ধরে ফেলে। রাদ তৎক্ষনাৎ দরজা বন্ধ করে ফেলে। মুরাদ ছুঁড়ে দেওয়ার সুযোগ পায় না। রাগে নাকের পাটা ফুলিয়ে অগ্রসর হয় ভেতরের দিকে।
__
সকাল দশটায় ইভান হোটেলের সামনে গাড়ি নিয়ে উপস্থিত হয় ইসানাকে পীক করতে। ইসানা এক মিনিট পর বের হয় ভেতর থেকে। গাড়িতে বসার মুহূর্ত পর্যন্ত রাদ ওপর থেকে ওঁকে দেখে। ভেতরে এক রাশ ক্ষোভ চাপিয়ে রেখেছে। মুরাদ পাশাপাশি দাঁড়িয়ে নিচে উঁকি দিয়ে ইভানের গাড়ি দেখে আড়মোড়া ভেঙে ব্যাঙ্গ করে বলল,
‘আজকের দিনটা কত সুন্দর, কি বলিস রাদ?’ কাঁধে হালকা চাপড় দিয়ে বলল।
রাদ ক্রোধ নিয়ে টেরা ভাবে তাকায় মুরাদের পানে। সেটি দেখে সে পুনরায় বলে,
‘তুই তো কিছু করতে পারছিস না। অথচ দু’দিনের মানুষটি তাকে নিয়ে… ‘ লাস্টের অংশটুকু শিস বাজিয়ে শেষ করল।
‘তুই আমার বন্ধু না, একটা শত্রু!’ দাঁতে দাঁত চেপে বলল রাদ।
মুরাদ হেসে রাদের সঙ্গে হ্যান্ডশেক করে বলল,
‘কংগ্রাচুলেশনস, বুঝতে পেরেছিস।’
‘শা*লা..’বলে মারতে উদ্যত হতেই মুরাদ এক ছুটে পালায়। রাদ নিচের দিকে ঝুঁকে দেখে গাড়িটি আর নেই। হতাশাজনক সরু নিশ্বাস ফেলে সে৷
হনলুলু এরিয়ার গ্রিন হাউস নামের এক রেস্টুরেন্টে ইসানাকে নিয়ে আসে ইভান। সেটি সমুদ্রের কাছাকাছি অবস্থিত। ইভান ইসানার সঙ্গে বন্ধুত্বসুলভ আচরণ করে। আপনি থেকে তুমি বলে সম্বোধন করছে। অবশ্য ইভান ইসানার চেয়ে বড়ো ছিল। উনত্রিশে পা রেখেছে। এখনো পর্যন্ত সিঙ্গেল। তার গার্লফ্রেন্ড ছিল না। বর্তমানেও নেই। ইভান নিজেকে যতোই ভিন্ন ভাবে উপস্থাপন করুক না কেন, ইসানার মনের দাগ সে কিছুতেই মুছতে পারবে না।
‘আপনি কখনো রিলেশন করেছেন?’ ইসানা অকপটে জিজ্ঞেস করে বসে ইভানকে।
‘নাহ!’
‘গুড লুকিং হওয়া শর্তেও রিলেশন করেন নি। কারণ কি ছিল?’
‘আমার জীবনের একটাই লক্ষ্য ছিল বড়ো কিছু হবার। চার বছর আগে পড়াশোনা কমপ্লিট করে আমি বিদেশে চলে আসি। গ্রিন কোম্পানিতে অপারেশন হিসাবে জব পাই। আমার কাজের দক্ষতা দেখে দু বছরের মাথায় কোম্পানির ম্যানেজার হয়ে যাই।’
‘আপনি দেশে যাচ্ছেন না কেন?’
‘বাবা-মায়ের ওপর অভিমান জমে আছে।’
‘কিসের অভিমান?’
‘সে-সব না হয় আরেকদিন বলব। তোমার বিষয় কিছু বলো?’
‘আমি ডিভোর্সি!’ দ্বিধাবোধ ফেলে বলল ইসানা।
ইভান কিছুটা চমকালো। শিওর হবার জন্য আবার জিজ্ঞেস করল,
‘সত্যি?’
‘হুম।’
‘ছেলেমেয়ে আছে তোমার?’
‘নাহ! আপনি কি আগে বিয়ে করেছিলেন?’
‘একদম না। আমাকে দেখে কি তাই মনে হয়?’
‘নাহ! এমনি প্রশ্ন করলাম।’
‘ওহ!’
‘ভুলে যাওয়া রোগ কল্যাণময়, কিন্তু অতিদ্রুত ভুলে যাওয়া রোগ ভীষণ কষ্টকর!’
‘মানে?’
‘অনেকের ক্ষেত্রে এটা হয়, এজন্য বললাম।’
‘তোমার গুছিয়ে কথা বলার অভ্যাস আছে।’
‘মোটামুটি!’
‘আই লাইক ইট!’ হেসে বলল ইভান।
তারা আরো কিছুক্ষণ কথা বলে সময় অতিবাহিত করে। কেঁটে যায় ঘন্টাখানেক সময়। দূর থেকে ইমরান তাদের দুরবিন দিয়ে দেখছে। এখানে আসা অব্দি তাদের ফলো করেছে। এখনো করছে। কিছুক্ষণের জন্য নজর সরিয়ে একা একা বিড়বিড় করে বলে,
‘আমার সঙ্গে আসতে বললে কত বাহানা জোগাড় করে। আর তার সঙ্গে কি সহজে চলে এলো।’ এক রাশ দুঃখ প্রকাশ করে দুরবিনে নজর দিয়ে পুনরায় দেখতে লাগলো।
সন্ধ্যার পাখিরা নিজেদের নিড়ে ফিরছে। অবশ্য এখানে তেমন পাখপাখালির দেখা মিলে না। খুব কমই নজরে আসে। সূর্য ডিমের কুসুমের ন্যায় ধারন করেছে। একটু আগে ইসানা হোটেলে ফিরেছে। করিডোর থেকে রাদ, মুরাদ দু’জনে তাকে দেখেছে। রাদের মনে মনে রাগ হলেও সে মুরাদের সামনে প্রকাশ করে না। এমনিতেই মুরাদ তাকে নিয়ে ব্যাঙ্গ করে। প্রকাশ করলে আরো মজা নিবে ভেবে চুপ আছে।
‘আগে ছিল ইমরান এখন ইভান। তার জীবনে একজন না একজন আছেই। রাদ তুই তাকে ভালোবাসিস সেটা প্রকাশ কর নয়তো সে যে কারো হয়ে যেতে পারে।’
‘কীভাবে করব? আমার মস্তিষ্ক ফাঁকা।’
‘রাতে তাকে নিয়ে ঘুরতে বের হতে পারিস।’
‘যাবে বলে মনে হচ্ছে না।’
‘সে তোর পি.এ। বললেই যাবে দেখিস।’
রাদ নিরুত্তর থেকে ভাবে কীভাবে ইসানাকে বলা যায়। বললে কী যেতে রাজি হবে?
.
.
.
#চলবে?
কার্টেসী ছাড়া কপি করা সম্পূর্ণ নিষেধ।#তোমায়_ছোঁয়ার_ইচ্ছে
#পর্ব_১৯
#সুমাইয়া_মনি
স্বচ্ছ ল্যাম্পপোস্টের আলোয় পায়ে পা মিলিয়ে হাঁটতে দু’জন তরুণ-তরুণী। আকাশের নির্মল চাঁদটি এক ফালি মেঘের আড়ালে মুখ লুকাচ্ছে বার বার। আজ সারাদিন মেঘলা আবহাওয়া ছিল। যার দরুণ শীতের রেশ একটু বেশিই ছিল অন্যদিনের তুলনায়। রাদের দেওয়া জ্যাকেটের পকেটে দু হাত পুরে ইসানা নীরব হয়ে হাঁটছে। ইসানা তার দেওয়া জ্যাকেটটি পড়েছে, এটা দেখে রাদ মনে মনে খুশি হয়। পাশাপাশি হাঁটছে রাদ। একটু আগেই তারা বাহিরে হাঁটতে বের হয়েছে। মুরাদের জোরাজোরিতে রাদকে দ্বিধাবোধ ফেলে ইসানাকে বাহিরে বের হওয়ার বার্তাটি জানায়। প্রথম বলাতেই ইসানা রাজি হয়ে যায়। আর এখন তারা সরু পথ পাড়ি দিচ্ছে এক সঙ্গে। ফুটপাত ধরে আরো অনেক মানুষকেই হাঁটতে দেখা যাচ্ছে। কেউ বা আবার এক প্রান্তে দাঁড়িয়ে বাক্যবিনিময় ব্যস্ত।
রাদ কথা বলার টপিক খুঁজে পাচ্ছে না। শেষমেশ সরস স্বরে জিজ্ঞেস করে,
‘আপনি কী খেতে পছন্দ করেন?’
ইসানা রাদের প্রশ্ন শুনে তেমন আগ্রহ দেখায় না। কোমল স্বরে বলল,
‘আহামরি তেমন কিছু পছন্দ নয় আমার। তবে বাদাম খুব প্রিয়।’
‘ওহ!’ বলে থেমে যায় রাদ।
ইসানা রাদকে পছন্দের খাবার সম্পর্কে জিজ্ঞেস করে না। কেননা সে রেহানা আনসারীর কাছ থেকে জানতে পেরেছে তার পছন্দের খাবার কী কী? ইসানার নীরবতায় রাদ ফের বলে,
‘আপনার প্রিয় রং?’
‘কালো।’
‘আমারটি কি জিজ্ঞেস করবেন না?’
‘নীল, সাদা।’
‘কী করে জানলেন?’ কিছুটা অবাক হয়ে জানতে চাইলো।
‘আন্টি বলেছে।’
‘তাহলে নিশ্চয় প্রিয় খাবারের সম্পর্কেও জানেন?’
‘হুম।’
‘মামনি এটাও বলেছে?’
‘হ্যাঁ! তিনি আমাকে যাওয়ার সময় একটি ডায়েরী দিয়েছিল। সেটির মধ্যে আপনার পছন্দ, অপছন্দের তালিকা রয়েছে।’
রাদ কপাল কুঁচকে বলে,
‘আমি ভয়…’
‘টিকটিকি, ব্যাঙ ভয় পান আপনি।’ অবশিষ্ট কথাটি ইসানা পূরণ করে।
রাদ কিঞ্চিৎ রাগ নিয়ে চোখ বন্ধ করে মুখ ঘুরিয়ে নেয়। কিছুটা বিব্রতবোধ করছে সে। সুপ্ত অভিমান হয় তার মামনির ওপর। রাদ টপিক বদলাতে স্বাভাবিক ভাবে বলল,
‘আপনি আমাকে তুমি করে বলছেন না কেন?’
‘এখনো পর্যন্ত তুমি করে কাউকেই সম্বোধন করিনি। চাইছিও না!’
‘এনি রিজন?’
‘সিক্রেট!’
রাদ সামান্য হতাশ হলো। বলল,
‘অতীতকে ভুলে গিয়ে ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবা উচিত!’
‘আপনাকে কে বলল আমি অতীত নিয়ে পড়ে আছি?’ ইসানার অকপটে প্রশ্ন শুনে রাদ অপ্রস্তুত হয়। বলে,
‘অনুমান করলাম।’
‘কিছু অতীত না চাইতেও সামনে এসে উপস্থিত হয়।’
‘যেমন?’
ইসানা উত্তর না দিয়ে দ্রুত হাঁটতে আরম্ভ করে। রাদ থেমে যায়। দাঁড়িয়ে দেখছে ইসানার কোথায় যাচ্ছে। সামনের খালি বেঞ্চে বসে। রাদ রাস্তার ওপর প্রান্তের শপটিতে যেতে আরম্ভ করে। সে মূলত বাদাম ক্রয়ের জন্য এসেছে। এই রাস্তায় মানুষজন তেমন নেই। ইসানা একা বেঞ্চটিতে বসে রয়েছে। হঠাৎ এখানকার এক যুবক ইসানার থেকে এক হাত দূরে বসে পড়লো। তার উপস্থিতিতে তেমন প্রতিক্রিয়া দেখাল না ইসানা। স্বাভাবিক ভাবে বিষয়টি নিয়েছে। যুবকটি দেখতে অতিরিক্ত ফর্সা, বেশ লম্বা – চওড়া। হাতে ছিল ব্লু রঙের আইফোন। সম্ভবত বড়লোক ঘরের ছেলে। মিনিট কয়েক সময় অতিবাহিত হবার পর যুবকটি ইংরেজিতে ইসানার উদ্দেশ্যে বলল,
‘আর ইউ এ প্রস্টিটিউট?’
রাগে অগ্নিশর্মা হয়ে তাকায় যুবকটির দিকে ইসানা। দাঁতে দাঁত চেপে সর্বশক্তি দিয়ে সজোরে যুবকটির নাকে ঘু’ষি ছুঁড়লো। আকস্মিক ঘটনায় যুবকটি ব্যথায় কুঁকড়ে উঠে চোখমুখ বন্ধ করে নাকে হাত রাখল। সেকেন্ড কয়েক পর নাকের কাছে তরল কিছু অনুভব করল। হাত সামনের দিকে তাক করতেই রক্ত দেখে চমকে উঠে। ইসানার পানে চেয়ে দেখে রাগে ফোঁস ফোঁস করছে। যুবকটি দ্রুত গতিতে দৌঁড়ে জায়গা প্রস্থান করল। ইসানার শরীরে যেন কেউ আগুন ধরিয়ে দিয়েছে। নাকমুখ গরম হয়ে গেছে ক্রোধের কারণে। রাদ পিছন থেকে পুরো ঘটনাটি দেখে থতমত খেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। পরক্ষণে ইসানার সাহসীকতা দেখে নজর সরিয়ে ফিক করে হেসে ফেলে। তারপর স্বাভাবিক ভাবে এগিয়ে এসে বাদাম এগিয়ে দেয় ইসানার নিকট। হাত অনুসরণ করে ইসানা চোখ তুলে রাদের আদলে তাকায়। একটু আগের ঘটনা ভুলে নিজেকে স্বাভাবিক করে বাদাম হাতে নেয়। রাদ পাশে বসতে নিলেই ইসানা বলে উঠে,
‘হোটেলে যাব।’
রাদ না বসে দাঁড়িয়ে বলে ‘চলুন’। তারা অগ্রসর হয় হোটেলের উদ্দেশ্যে।
_
‘মুরাদ রাদ কি ইসানা আপুকে পছন্দ করে বা ভালোবাসে?’ গম্ভীর কণ্ঠে শুধালো লিসা।
‘দু’টোই!’ ভ্রু উঁচু করে জবাব দিলো মুরাদ।
লিসা রেগেমেগে বলল,
‘আমার অনুমান সঠিক! ঐ ছোটলোক ঘরের মেয়েটিকে রাদ পছন্দ করে।।’
‘মুখের ভাষা সংযত করো লিসা।’ কিঞ্চিৎ রাগ নিয়ে বলল।
‘একদম না! আমার রাদকে আমারাই কাছ থেকে কেঁড়ে নিবে আমি চুপ থাকব না।’ চেঁচিয়ে বলল।
‘তোমার রাদকে সে কেঁড়ে নিচ্ছে না। বরঞ্চ রাদ তাকে ভালোবেসে আপন করে নিতে চায়।’
‘রাদের রুচি এত নিচে কীভাবে নেমেছে। একটা মিডেলক্লাস মেয়েকে…। আমি মানতে পারছি না।’
‘বাস্তবতা মেনে নিতে হবেই।’
‘সোহানার বিষয়টি না হয় মানা যায়। কিন্তু ইসানা, সে তো ডিভোর্সি এবং বয়সেও বড়।’
‘ভালোবাসা কেবল রূপ-যৌবন দেখেই হয় না লিসা।’
‘তুমি আমাকে যেটা বোঝাতে চাইছো আমি সেটা বুঝতে পারছি। কিন্তু আমি তাকে রাদের জীবনে কিছুতেই মেনে নিবো না।’
‘যে সারাজীবন থাকবে সে যদি মেনে নেয় তাহলে তুমি কোন খ্যাতের মু’লা!’ কিছুটা ব্যাঙ্গ করে বলল মুরাদ।
লিসা আরো ক্ষেপে যায়। আঙুল তুলে বলে,
‘রাদকে তুমি উসকেছো। আমি আন্টিকে সব বলব সব!’ বলে লিসা যাওয়ার ধরলে মুরাদ কাঠিন্য স্বরে ডেকে থামায়। লিসা থেমে যায়। কিন্তু ঘুরে তাকায় না।
.
ইভান হোয়াটসঅ্যাপে বড়ো বোন শালিনীকে কল দিয়েছে। এতদিন পর ছোট ভাইয়ের ফোন পেয়ে খুশিতে রিসিভ করে ‘কেমন আছিস’ জিজ্ঞেস করে।
‘ভালো। বাবা-মা কেমন আছে?’
‘ভালো আছে। কতদিন পর কল দিলি। অভিমান সরেছে আমাদের ওপর থেকে?’
‘হ্যাঁ! বাদবাকি গুলোও শীঘ্রই সরে যাবে। একটা গুড নিউজ আছে।’
‘তার আগে বল তুই আসবি কবে?’
‘যদি আমার ইচ্ছেটা পূরণ হয় তবেই আসবো খুব দ্রুত!’
‘ইচ্ছে কী? আর গুড নিউজ কি সেটা বল।’
‘দু’টোই এক।’
‘বলে ফেল।’
‘আমি বিয়ে করব। একটি মেয়েকে ভীষণ পছন্দ হয়েছে।’
‘আমেরিকান মেয়ে। একদম চলবে না। বাবা-মা ক্ষেপে যাবেন।’
‘নাহ! মেয়ে বাংলাদেশি।’
‘নাম?’
‘ইসানা ইবনাত।’
নাম শুনে শালিনী বিড়বিড় করে বলে ভাবতে থাকে। ইভান অপরপ্রান্তে বলছে,
‘রাদ কোম্পানির পি.এ পোস্টে কাজ করছে। আমাদের কোম্পানির সঙ্গে ডিল করার জন্য আমেরিকায় এসেছে। প্রথম দেখায় পছন্দ হয় ওঁকে।’
শালিনী কপাল কুঁচকে বলল,
‘কই ছবি দে তো ওর।’
‘দেখো পাঠাচ্ছি। আজকে দু’জনে মিলে অনেক ঘুরাঘুরি করেছি। তখন কিছু সেলফি তুলেছিলাম। অবশ্য ও তুলতে চাইছিল না। আমি ফোর্স করায় তুলেছে।’ কথা বলতে বলতে তাদের কিছু ছবি গ্যালারি থেকে হোয়াটসঅ্যাপে পাঠায়।
ইভানের সঙ্গে ইসানার একত্রিত ছবি দেখে চোখ চড়কগাছ শালিনীর। বিস্মিত হয়ে বলল,
‘এটা তো তোর প্রাক্তন স্ত্রী ইসানা!’
শুনেই ইভানের ঠোঁটের হাসিটুকু মিলিয়ে যায়। বুকের মাঝে মোচড় দিয়ে উঠে। উৎকণ্ঠে বলল,
‘কী? তুমি শিওর আপু?’
‘হ্যাঁ! শিওর। এটাই ইসানা। যাকে রেখে তুই পালিয়েছিলি।’
‘এটা হতেই পারে না। কিছুতেই না!’ উত্তেজিত হয়ে চেঁচিয়ে বলল ইভান। মনে পড়ে ইসানার বলা সেই কথাটি। যার কেন্দ্রবিন্দু ছিল সে নিজে!
_
সকালে..
প্রচন্ড জোর বেগে গাড়ি চালাচ্ছে ইভান। চেহারায় ফুটে আসে তীব্র রাগ! রাগের চোটে তিরতির করে ঠোঁট কাপছে। শালিনীর মুখে ইসানার বিষয়ে সব শুনে ক্রোধে সারারাত সিগারেট ও মদের নেশার ঘোরে ছিল। নির্ঘুম কাটিয়ে দিয়েছে রাতটি। সে কিছুতেই ইসানাকে প্রাক্তন স্ত্রী হিসাবে মেনে নিতে পারছে না। বিয়ের পর ইসানার নাম তো দূর চেহারা দেখার আগ্রহ জাগেনি তার মধ্যে। ভোরবেলায় চলে এসেছিল এয়ারপোর্টে।
সেখানের পরই যাত্রা শুরু হয় তার নতুন জীবনের। ভুলে গিয়েছিল তার অতীত। ডিভোর্স পেপারে তার সাইন দিয়েই পাঠিয়েছিল। ইসানার নাম সহ বাকি সব শালিনী যুক্ত করে দেয়। তার মধ্যে এখন একটিই ক্ষোভ কাজ করছে মাত্রাতিরিক্ত কেন ইসানা তাকে বলেনি সে-ই তার প্রাক্তন স্ত্রী!
মিনিট কয়েক পর গাড়ি হোটেলের সামনে এসে দাঁড়ায়। পার্ক না করেই ছুটে আসে হোটেলের ভেতরে। ইভানের অনুমান অনুযায়ী এখন ব্রেকফাস্ট করার সময়। তাই সে ক্যান্টিনে আসে। হনহনিয়ে আসতে দেখে অনেকেই তার দিকে উৎসুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। সেখানেই তাদের সকলকে নাস্তা করতে দেখতে পায়। ইভানের নজর ইসানার ওপর পড়তেই ক্রোধ যেন দ্বিগুণ বেড়ে যায়। দ্রুত বেগে এগিয়ে এসে বাহু ধরে তুলেই কষিয়ে চড় দিলো ইসানার গালে।
সকলে ইভানের এমন আচরণে দাঁড়িয়ে যায়। হতভম্ব তারা! জটিল প্রশ্ন সবার মনে। আসেপাশের লোকজনও তাদের পানে তাকিয়ে রয়েছে। হঠাৎ এরূপ ঘটনা আশাহত! রাদের কপালে তীব্র থেকে তীব্র রাগ এসে ভর করে। বিনাকারণে ইভানের এমন সিনক্রিয়েট অস্বাভাবিক! ইসানা ঘাড় কাত করে দৃষ্টি নত করে সেভাবেই দাঁড়িয়ে রয়। ইভান উগ্রভাবে চেঁচিয়ে জিজ্ঞেস করে,
‘কেন বলোনি তুমি আমার প্রাক্তন স্ত্রী! কেন?’
এতক্ষণে তাদের প্রশ্নের জবাব মিলে। তবে থাপ্পড় দেওয়ার বিষয়টিতে বিরক্ত হয় ইভানের ওপর।
‘কথা বলছো না কেন?’ আরো জোরে চোঁচালো ইভান।
ইসানা টলমল অশ্রুসিক্ত চোখে ইভানের পানে চেয়ে তাচ্ছিল্য হাসে। বলে,
‘কী বলতাম? আমি আপনার প্রাক্তন স্ত্রী। যাকে রেখে পালিয়েছিলেন। চিনতে পেরেছেন আমাকে? এসব বলতাম আপনাকে?’ এতটুকু বলে গাল বেয়ে নোনাজল গুলো মুছে নেয়। ফের বলে,
‘কাল বিয়ের ব্যাপারে জিজ্ঞেস করার পর আপনি অস্বীকার করেন। তারপর আর কীভাবে বলব আমি আপনার প্রাক্তন ছিলাম! না বলার কারণে আমার ওপর অনেক ক্ষোভ জমেছে আপনার। একবার ভাবুন তো আমার কতটা ক্ষোভ জমেছে এটা জেনে আপনি আমাকে রেখে পালিয়েছেন। অস্বীকার করেছেন পবিত্র কালেমা পড়ে বিয়ে করা স্ত্রীকে! প্রথম দিন আপনাকে দেখে, আপনার নাম শুনে বুঝেছি আপনি আমার প্রাক্তন…। নিজেকে শক্ত রেখেছি। মানিয়ে চলার চেষ্টা করেছি। আমার ভাগ্যটা দেখুন। যে আমাকে প্রথমে অস্বীকার করেছে। সে এক দেখাতেই আমাকে পছন্দ করে ফেলেছে।’ ইসানা থেমে উল্টোহাতে দু’চোখের পানি মুছে ফেলে। ইভান তখনো রাগান্বিত হয়ে তাকিয়ে আছে ইসানার ওপর। ইসানা স্বাভাবিক হয়ে বলে,
‘যে তার পূরানো অতীতকে অস্বীকার করে, সে-ই মহামূল্যবান ব্যক্তির ওপর আমার কোনো ক্ষোভ নেই। আমি তাকে ক্ষমা করে দিয়েছি বহু আগেই। মাফ করবেন সত্যিটা লুকানোর জন্য।’ দু’হাত জোর করে বলে ইসানা ক্যান্টিন ত্যাগ করে।
মিনিট কয়েক পিনপতন নীরবতা ঘিরে ধরে তাদেরকে।
আচমকা লিসা ইভানের নিকট এগিয়ে এসে সজোরে গালে একটি চ’ড় নিক্ষেপ করে। ইভান গালে হাত রেখে ক্রোধ চোখে লিসার পানে তাকায়। লিসা তেজি কণ্ঠে আঙুল তুলে বলে,
‘এটা আপনি ডিজার্ভ করেন, ইসানা আপু না! ভদ্র সমাজে এখনো আপনার মতো কিছু অমানুষ রয়েছে। ওপর দিক থেকে তাদের একদম চেনা যায় না।’ লিসাও বাহিরের দিকে অগ্রসর হয়। ইভানের নিশ্বাস তীব্র হয়ে আসে রাগের বশে।
লিসার যাওয়ার পানে ক্ষোভিত চোখে তাকিয়ে আছে।
রাদ এক কদম ইভানের সামনে রেখে মুরাদের পানে চেয়ে ক্রোধান্বিত কণ্ঠে শুধালো,
‘ওনাকে জানিয়ে দে! ইসানার ধারেকাছেও যেন আসতে না দেখি। এবার ছেড়ে দিলেও, পরের বার শেষ রক্ষে হবে না। গ্রিন কোম্পানির সব ডিল ক্যান্সেল!’
.
.
.
.
#চলবে?
কার্টেসী ছাড়া কপি করা সম্পূর্ণ নিষেধ।