তোমায় ছোঁয়ার ইচ্ছে পর্ব -৩৬+৩৭ ও শেষ

#তোমায়_ছোঁয়ার_ইচ্ছে
#পর্ব_৩৬
#সুমাইয়া_মনি

সকালে নরমালি হাঁচি-কাশি হলেও। এখন রাদের সর্দি দ্বিগুণ ভেড়েছে। হালকা জ্বর জ্বর অনুভব হচ্ছে শরীরের ভেতরে। ইসানা গরম দুধ ও স্যুপ বানিয়ে নিয়ে এসেছে। তাকে খেতে দিয়ে মেডিসিনের বক্সে ঔষধ নাড়াচাড়া করছে। সেখান থেকে আপাতত সর্দির ঔষধ বের করে পাশে রাখল। স্যুপ খাওয়ার পর তাকে সেবন করতে বলবে। বাংলাদেশের তুলনায় আমেরিকায় শীতের প্রভাব তীব্র। ফ্লাইট সকালে হবার ফলে শীতল বাতাসের কারণে সর্দি হয়েছে। ইসানা রাদের নিকট এসে ঔষধের পাতা বিছানার ওপর রেখে বলল,
‘খাওয়া শেষে এটি খেয়ে নিবেন।’
‘আপনি কোথায় যাবেন?’
‘এশারের নামায পড়তে যাব।’
‘একেবারে নাপাও দিয়ে দিন। কারণ আমি আর কিছু খাব না। ঔষধ খেয়েই ঘুমবো।’
‘তাহলে স্যুপ আরেক বাটি খেতে হবে।’
রাদ কুর্নিশ করে তাকায়। ইসানা রাদের চাহনি ভ্রূক্ষেপ না করে রুম থেকে বেরিয়ে রান্নাঘরের দিকে এগোয়। এক বাটি গলা পর্যন্ত ভরপুর দিয়েছে। আরেক বাটি এমন হবে এটি তার বুঝতে বাকি থাকে না। খাওয়ার ইচ্ছে নেই বললেই চলে। মুখে তেতো ভাব অনুভব করছে। ইসানা আরেক বাটি নিয়ে ফিরে আসে। পাশের টেবিলে রেখে ঔষধের বাক্স বিছানার ওপর রেখে পাশের রুমে চলে যায় নামায কায়েম করতে। রাদ চামিচে উঠিয়ে খাওয়ার চেয়ে একেবারে টান দিয়ে খেয়ে ফেলে। পরের বাটিও এভাবেই শেষ করল। পরিশেষে দুধ খেয়ে ঔষধ খায়। গায়ে কম্বল জড়িয়ে বালিশে মাথা রেখে ঘুমানোর চেষ্টা করে। বেশকিছুক্ষণ পর ইসানা রুমে এসে দেখে রাদ নিদ্রায় বিভোর। ইসানা আহার সেরে ঘুমাতে আসল। ঘড়ির পানে তাকিয়ে দেখে এগারোটা ছুঁই ছুঁই। নজর সরিয়ে বিছানার ওপর ফেলে। রাদ বিছানায় ঘুমিয়েছে। সোফায় ঘুমাতে হবে তাকে। এটা ভেবে সে রাদের পাশের ফাঁকা স্থানে তাকায়। আর কিছু না ভেবেই রাদের অপর প্রান্তে এসে রাদের গায়ের একই কম্বল গায়ে টেনে বালিশে মাথা রাখল। ঘাড় ঘুরিয়ে রাদের ঘুমন্ত মুখশ্রীতে একবার দৃষ্টিপাত করল। খুব কাছ থেকে রাদের ঘুমন্ত মুখশ্রী দেখে অন্যরকম প্রশান্তি অনুভব হয় হৃদয়ে। আর্ট করা ভ্রু, মৃদু গোলাপি ঠোঁট জোড়া ও বন্ধ থাকা আঁখি ক্রমশে তার ছুঁয়ে দিতে ইচ্ছে করছে। পিটপিট করে নজর সরিয়ে পর পরই আবার তাকায়। সে ক’দিন আগে রাদের অবর্তমানে ফাঁকা স্থানে হাত বুলিয়েছিল। আজ সে-ই স্থান পরিপূর্ণ! তার হৃদয়ে দোলা দিয়ে উঠে। কম্বলে মুখ লুকিয়ে ম্লান হাসে। পরমুহূর্তে টেবিল লাইট অফ করে দেয়।
সকাল বেলায় ইসানার নাকে মিষ্টি একটা সুভাষ এসে বারবারই লাগছে। চোখ খুলতে গিয়েও সুভাষের তীব্র গন্ধে মেলতে পারছে না। সুভাষটি কিছুটা নেশালো। আচমকা তার খটকা লাগে মনে এটি অতি আপন কাছের কারো পারফিউমের সুভাষ। দ্রুত চোখ মেলে দেখে রাদের বাহুডোরে আবদ্ধ আছে সে। লজ্জায় শরীরের ভেতরে প্রচণ্ড গরম অনুভব করে। ঈষৎ দুলে ওঠে সর্বাঙ্গ। রাদের শরীর বেশ গরম। সে কলেজে পড়াকালীন বান্ধবীদের মুখে শুনেছে ছেলেদের শরীরের তাপমাত্রা মেয়েদের শরীরের চেয়ে বেশি গরম হয়ে থাকে। তাহলে কি রাদের শরীরের তাপমাত্রা এজন্যই গরম, নাকি জ্বরের প্রভাবের ফলে গরম হয়ে আছে? তড়িঘড়ি করে সরে যেতে নিলে রাদ ঘুম জড়িত কণ্ঠে বলল,
‘প্লিজ সানা আরেকটু থাকো। বেটার ফিল হচ্ছে।’
বলতে বলতে রাদ আরেকটু শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো।
ইসানা রাদকে সরাতে পারলো না। চুপটি করে সেভাবেই রাদের বাহুডোরে বন্দী হয়ে রইলো। মিনিট কয়েক পর রাদের ফোন বেজে উঠলো। পাতলা হয়ে এলো তার ঘুম। চোখ মেলে ইসানাকে নিজের আষ্টেপৃষ্ঠে জড়ানো দেখে মুচকি হাসে।
ইসানা রাদের ঠোঁটে মুচকি হাসি দেখে নজর সরিয়ে নেয়। সরে যেতে চাইলে রাদ ছাড়ে না। মৃদুভাবে কপালে চুমু এঁকে দেয়। কোমল স্বরে বলে,
‘তোমায় ছোঁয়ার ইচ্ছে আমার প্রথম দাপ পূর্ণ হলো সানা।’
ইসানা লজ্জায় সেভাবে থাকতে পারে না। হাত সরিয়ে বাহুডোর থেকে নিজেকে মুক্ত করে উঠে যায়। রাদ উঠে বসে ঠোঁটের হাসি চড়া করে ফোন হাতে তুলে নেয়। মুরাদের কল পেয়ে ব্যাক করলো।
‘বল?’
‘আসবি কখন?’
‘একটু পরেই আসছি।’
‘জলদি!’
‘হুম, রাখ।’ ফোন রেখে রাদ ফ্রেশ হতে যায়। আগের থেকে সে এখন সুস্থ অনুভব করছে। সর্দি-কাশি কমেছে। নাস্তা খাওয়ার সময়ে ইসানা লজ্জায় রাদের পানে তাকাচ্ছিল না। নজর সরিয়ে রেখে খাবার সার্ভ করে খেয়েছিল। রাদ রেডি হয়ে এসেছিল। খাওয়া শেষে চলে যাওয়ার সময় ফিরে এসে ইসানার কানের কাছে ঝুঁকে ফিসফিস করে বলে,
‘আজ সকালটা আমার জীবনের বেস্ট মুহূর্তের একটি অধ্যায় হিসাবে গন্য। ধন্যবাদ!’
বলে চলে যায় রাদ। রাদের কাছে আসা ইসানার হৃদয়ে তোলপাড় ঝড় তুলেছে। ওর স্পর্শ জাদুর মতো তার অস্তিত্বকে ছুঁয়ে দিয়েছে। লজ্জা ও অনুভূত তাকে ঘিরে রেখেছে। নড়াচড়া করতেই শরীর ভারী অনুভব হচ্ছে। এ অনুভূতি তার অজানা! ক্ষণে ক্ষণে যেন নতুন অনুভূতির অধ্যায় প্রকাশ পাচ্ছে সে।
.
‘মা চিতয় পিঠা কেন বানাচ্ছ? তুমি তো জানোই আমরা দু-ভাই বোন এই পিঠা পছন্দ করি না।’ শালিনী কপাট কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল।
তিনি বললেন,
‘এই পিঠা ইসানার পছন্দের। ওর জন্য বানাচ্ছি।’
‘নতুন বউয়ের জন্য পিঠা বানানো রেখে প্রাক্তন বউয়ের জন্য পিঠা বানাচ্ছ। এ তোমার কেমন বি’চা’র?’
‘কে বলেছে নতুন বউয়ের জন্য পিঠা বানাবো না। ওর জন্য তিন-চার রকমের পিঠা বানানো হবে। এই পিঠাটা বার্তি বানাচ্ছি শুধু মাত্র ইসানার জন্য।’
শালিনীর চোখ-মুখ রাগে ঘুচে এলো। বলল,
‘তোমার অহেতুক আদিখ্যেতা আমার ভালো লাগে না। ওর জন্য পিঠা বানানোর কোনো প্রয়োজন ছিল না। আসবে কি আসবে না সেটাও তো তুমি শিওর জানো না।’
‘আমার মন বলছে আসবে। ইসানার মন তোর মতো পাথর না। নিজের অহংকার বিসর্জন দে এবার। অনেক তো হলো।’
‘মা তুমি তো দেখছি ইসানার ভক্ত হয়ে গেছো?’ রাগী কণ্ঠে শুধালো।
তিনি আর কিছু বললেন না। এ মুহূর্তে নিজের মেয়ের সঙ্গে তর্কে না জড়ানোই শ্রেয় বলে মনে করেন। নয়তো লোক ভর্তি আত্মীয়দের সামনে সিনক্রিয়েট করে বসবে। বাকি বাজার করে ইভান বাড়ি ফিরে। তিনি শালিনীকে চিতয় পিঠা দিতে বলে ইভানকে। শালিনী মুখ ভার করে পিঠা নিয়ে ছোট ভাইয়ের নিকট এগিয়ে যায়। ইভান চিতয় পিঠা দেখে সরস নয়নে তাকায়৷ তারপর এক পিস হাতে তুলে খেতে আরম্ভ করে। শালিনী কিছুটা বিরক্ত হলো ইভানকে খেতে দেখে।
__
মিটিং শেষে রাদ নিজের কেবিনে এসে বসলো। পিছু পিছু মুরাদও এলো। নতুন কাপড়ের সেম্পল নিয়ে বেশকিছুক্ষণ কথা হয়। তারপর সে-সব রেখে নিজেদের বিষয়ে আলাপন জুড়ে।
‘হানিমুনে যাওয়াটা জরুরী রাদ।’
‘কয়েক মাস পরে গেলে ভালো হয়।’
‘নাহ! আম্মু-আব্বু নাতি-নাতনির জন্য পাগল করে ফেলছে।’
‘এতে হানিমুনে যাওয়ার কি দরকার। তুই তো বাড়িতেই ডাউনলোড দিতে পারিস।’ মুচকি হেসে বলল।
‘শা’লা ফাজলামো রাখ। সোহানাকে নিয়ে ঘুরতে যেতে চাই। তোদের ছাড়া একা যেতে ইচ্ছে করছে না।’
‘আগে সানাকে রাজি করাতে হবে।’
‘বাসায় গিয়ে বলিস।’
‘ওকে।’
‘আর শোন, তুইও আমার মতো ডাউনলোড দেওয়ার চেষ্টা করবি।’ মুরাদ এটি বলে হেসে ফেলে। রাদও হেসে দেয়।
.
আটটার দিকে রাদ বাড়ি ফিরে। ইসানা রাদের জন্য নিজ থেকেই কফি বানিয়ে টেবিলের ওপর রেখে ড্রইংরুমে চলে আসে। টাইসনও সেখানে ছিল। দু’জনে একত্রে বসে কার্টুন দেখছে। রাদ ফ্রেশ হয়ে তাদের সঙ্গে যোগ দেয়। ইসানার মনোযোগ ছিল টিভির ওপর। রাদ এক পলকে ইসানাকে দেখে তারপর টিভির পানে তাকিয়ে বলে,
‘শুনুন একটা কথা ছিল?’
‘কথাটা নিশ্চয় হানিমুনে যাওয়া নিয়ে?’ টিভির পানে তাকিয়ে পাল্টা প্রশ্ন করে ইসানা।
রাদের কপালে কিঞ্চিৎ ভাজ দেখা যায়। সে ইসানার পানে সবিস্ময় হয়ে তাকিয়ে বলল,
‘আপনি জানলেন কীভাবে?’
‘সোহানা জানিয়েছে মুরাদ ভাইয়া নাকি যাওয়ার জন্য ফোর্স করছে ওঁকে।’
‘ও! এখন আপনার মতামত কী?’
‘বাড়িতে থেকে প্রতিদিন নিরামিষ খাবার খেয়ে যদি বেড়াতে গিয়েও নিরামিষই খেতে হয়, তাহলে তো সেখানে গিয়ে লাভ নেই।’ রাদকে এক পলক দেখে নিয়ে কথাটি বলল। সপ্রশ্ন সূচক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে রাদ। ইসানার কথা আগামাথা বুঝে উঠতে পারছে না। এখানে নিরামিষ খাবারের আইটেম কোথা থেকে আসলো বুঝছে না। সে বলল,
‘বুঝিয়ে বলুন।’
‘বুঝে নিন।’ বলে ইসানা রুমে এলো। রাদ ফ্লোরের পানে চেয়ে কথাটা মিলনোর চেষ্টা করছে। ইসানা রুম থেকে উঁকি দিয়ে রাদকে ভাবুক দৃষ্টিতে দেখে একটা টেক্সট পাঠালো। লিখা ছিল,
‘আমাদের মধ্যকার সম্পর্ক ঠিক না হলে হানিমুনে গিয়ে লাভ নেই।’
টেক্সট দেখে রাদ এবার ইসানার কথার মানে বুঝতে পারে। ম্লান হাসে সে। ইসানা কথাটা ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে বলেছে। তাই তার বুঝতে অসুবিধা হয়েছে। রাদ তৎক্ষনাৎ রুমে আসে। ইসানা শুঁখনো কাপড়চোপড় ভাজ করে আলমারিতে রাখছিল। রাদ মৃদু শব্দের ব্যবহার করে গেট লাগায়। ইসানা পিছনে ঘুরে রাদকে গেট লাগাতে দেখে আ’ত’ঙ্কে চটজলদি আগের ন্যায় ঘুরে দাঁড়ায়। রাদ ইসানার পিঠের পানে চেয়ে শার্টের উপরের বোতাম খুলে এগিয়ে আসে। ইসানা থাইগ্লাসের আয়নার মাধ্যমে রাদকে এগিয়ে আসতে দেখে ভীত হয়ে যায়। বরাবর ওড়না ঠিকঠাক করতে থাকে। রাদ একদম ইসানার পিঠের কাছাকাছি এসে দাঁড়ায় ঈষৎ কেঁপে উঠে সরে দাঁড়ালো ইসানা। রাদ পুনরায় ইসানার পিঠের দিকে এগিয়ে কানের কাছে ঝুঁকে বলল,
‘আমরা চাইলে সম্পর্কের মধ্যকার দূরত্ব ঘুচিয়ে ফেলতে পারি, চলুন?’
ইসানা ঘুরতেই রাদের উ’ন্মু’ক্ত খো’লা বুকের পানে নজর পড়ে। দ্রুত নজর নিচু করে বলল,
‘বাঁ’ধা দেবো না।’
‘আপনার অনিচ্ছাকৃত ভাবে অধিকার ফলাবো না।’
‘একদিন অপেক্ষা করুন।’ স্বাভাবিক ভাবে বলল ইসানা।
‘হোয়াই?’
‘আমি নামায পড়ছি না চারদিন হলো?’
রাদ কপাল কুঞ্চন করে বলে,
‘কাল যে বললেন নামায পড়তে যাচ্ছেন এশারের।’
‘মিথ্যা বলেছি। যাতে আপনি সোফায় না ঘুমিয়ে বিছানায় ঘুমান এজন্য। দুঃখিত!’ কিছুটা অ’প’রা’ধী কণ্ঠে শুধালো। রাদ মুচকি হাসে। বলে,
‘নেক্সট টাইম সিক্রেট রাখবেন না। কাল আমি আপনার জন্য অপেক্ষা করব। আই হোপ আপনি আমাকে আমার পুরো অধিকার দিয়ে মন থেকে মেনে নিবেন।’
ইসানা হ্যাঁ! নাহ! কিছু বলছে না। সে নিরুত্তর। লজ্জায় তার শরীর যেন কাঁপছে। এত শীতের মধ্যেও সে ঘামছে। বুকে ক্রমাগত ধুকপুক শব্দ বেড়ে চলেছে। রাদ শার্টের বোতাম লাগিয়ে ফের বলল,
‘উত্তর দিতে হবে না। তৈরী থাকবেন।’ পুরো বাক্য শেষ করে রাদ রুম ত্যাগ করল। ইসানা ওড়নার দ্বারা ঘাড়ের ঘাম মুছে বিছানায় বসল। নিজেকে ধাতস্থ করার যথেষ্ট চেষ্টা করছে।
এমন নয় যে সে রাদকে ঘৃ’ণা করে। সে-ও পছন্দ করে। নেই তার ওপর কোনো প্রকার রাগ-ক্ষোভ। তবে কী রাদের মতো সে নিজেও তাকে ভালোবাসে?
.
.
.
#চলবে?

কার্টেসী ছাড়া কপি করা সম্পূর্ণ নিষেধ।#তোমায়_ছোঁয়ার_ইচ্ছে
#পর্ব_৩৭ ( অন্তিম পর্ব)
#সুমাইয়া_মনি

দূরদেশ থেকে ছেলে-মেয়ে বাড়ি ফিরলে যেমন মা-বাবা খুশিতে আত্মহারা হয়ে আদর-যত্ন করে। তেমনি আদর-যত্নে আপ্যায়নে কোনো ত্রুটি রাখেনি ইভানের মা সালেহা বানু। ইসানা ও রাদকে পেয়ে যেন নতুন মেয়ে জামাইকে পেয়ে বসেছে। নানানরকমের পিঠা ও চা-নাস্তার আয়োজন করছেন। সব খাবার-দাবার তাদের সামনে রেখে তিনি ইসানার পাশে বসলেন। মৃদু হেসে ইসানার মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,
‘তোমরা এসেছো অনেক খুশি হয়েছি আমি মা। তোমার মামা-মামী কেমন আছে?’
‘ভালো আছে। আপনার শরীর ভালো আছে মা?’
ইসানার মুখে মা ডাক শুনে তার চোখ ছলছল করে উঠলো। ইসানা আগের আলান বোলান রেখেছেন ঠিকিই। কিন্তু মায়ের অধিকার যে এখন আর নেই! তিনি কান্নারত চোখে বললেন,
‘তুমি আমায় ক্ষমা করে দিয়েছো তো মা?’
‘আপনি আমার গুরুজন। আপনার ভুলত্রুটি ধরে রাখা উচিত নয় মা। আমার আগের কিছুই মনে নেই।’
‘তুমি অনেক বড়ো মনের মানুষ ইসানা।’ আঁচল দ্বারা চোখের পানি মুছে বললেন।
ইসানা তাকে সান্ত্বনা দিলেন।
‘খাও মা। তুমিও খাও রাদ বাবা।’
ইসানা খাচ্ছে। রাদকেও খেতে বলে। তাদের খাওয়ার মাঝে শালিনী এসেছিল। ইসানা কথা বলতে চাইলে শালিনী ইগনোর করে। তার কিছুটা মনঃক্ষুণ্ন হয়। রাদ ফোনে কথা বলার জন্য বাহিরে গেলো ইসানাকে বলে। সালেহা বানু ভেতরে গেলেন। আজ ছেলের বিয়ে। সব দিকে তাকে সামলাতে হচ্ছে। বসার ফুরসতও নেই তার। ইসানা একা হয়ে পড়ে। পিঠার বাটি টেবিলে রেখে পুরো বাড়িতে একবার নজর বুলায়। সালেহা বানুর পাশের রুমটিতে একসময় সে থাকতো।
এপাশে ওপাশে ছোটাছুটি করে কতোই না কাজ করেছে। আজ সে এ বাড়ির অতিথি। ঐসব এখন স্মৃতি! ইসানা উঠে সেই রুমটিতে প্রবেশ করলেন। সে-ই রুমে তখন ইভান শার্টের হাতার বোতাম লাগাচ্ছিল। তাদের মধ্যে চোখাচোখি হয়। ইসানা চলে যেতে নিলে ইভান ডাকে,
‘ভেতরে এসো ইসানা।’
ভদ্রতা বজায় রেখে ইসানা ভেতরে আসলো। ইভান তাকে বিছানার ওপর বসতে বলে চুল আঁচড়াচ্ছে। আয়নার মাধ্যমে ইসানার পানে চেয়ে বলল,
‘আমার নতুন জীবনের জন্য দোয়া কোরো।’
‘অবশ্যই!’
‘আমাকে কোট পড়তে সাহায্য করবে?’
ইসানা ইভানের পানে চেয়ে ইতস্তত বোধ করে। ইভান সেটি বুঝে বলে,
‘থাক আমি একা পড়ে নিবো।’
‘সাহায্য করব সমস্যা নেই ‘
ইভান মৃদু হেসে কোটটি ইসানার হাতে দেয়। ইসানা কোট নিয়ে ইভানের পিছন দাঁড়ায়। সুন্দর ভাবে তাকে পড়াতে সাহায্য করে। অবাক করা বিষয় প্রাক্তন স্ত্রী তার প্রাক্তন স্বামীকে বিয়ের জন্য রেডি হতে সাহায্য করছেন। এতে ইসানার বিন্দুমাত্র আক্ষেপ নেই। তবে ইভানের মন ভেতরে ভেতরে ভেঙেচুরে যাচ্ছে। কিচ্ছুটি বুঝতে দিচ্ছে না তার প্রাক্তন স্ত্রী-কে। কষ্ট দমিয়ে উপর থেকে হাসছে। শুধু মেয়েরাই পারে না, ছেলেরাও নিখুঁত ভাবে অভিনয় করতে পারে।
তারা নিজেদের মধ্যে আরো কিছুক্ষণ কথা বলে।
ঘন্টাখানিক বাদে ইভানের চাচাতো, মামাতো ভাইরা মিতুকে নিয়ে হাজির হয় এবাড়িতে। খাওয়া দাওয়ার পূর্বে বিয়ে পড়ানো হয়। খুব সুন্দর ভাবে তাদের বিয়ে সম্পূর্ণ হয়। এর মাঝে রাদকে ইসানা একবারও দেখেনি। খাওয়া দাওয়ার সময়ে আসে। ইভান, মিতু এবং রাদ ইসানাকে একত্রে খেতে দেওয়া হয়। ইভান মিতুকে ইসানার সঙ্গে প্রাক্তন স্ত্রী হিসাবেই পরিচয় করিয়ে দেয়। মিতু স্বাভাবিক ভাবে বিষয়টি নেয়। পরিচয় হয় রাদের সঙ্গেও। গুরুগম্ভীর হয়ে ছিল রাদ। খাওয়ার সময়ে ইসানা কয়েক বার কথা বলেছিল। কিন্তু রাদ একটি প্রশ্নেরও জবাব দেয়নি। রাদের গম্ভীর মুখশ্রী দেখে ইসানা ভাবনায় মসগুল হয়। হঠাৎ রাদের এমন আচরণ বুঝে উঠতে সক্ষম নয় সে।
আসার সময় সব কিছু ঠিকঠাক ছিল। এখন এমন আচরণ বেমানান! তারা সন্ধ্যার পর বাড়ির উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়। সালেহা বানু তাদের থেকে যেতে বলেছিল। রাদ তার কথা আমলে নেয়নি। রওয়ানা হয় তাদের গন্তব্যে। গাড়িতে বসে ইসানা রাদের গম্ভীরতার কারণ জিজ্ঞেস করে বসে,
‘কী হয়েছে আপনার? আমার সঙ্গে এমন আরচণ করছেন কেন?’
রাদ এবারও চুপ থাকে। নেই তার মুখে কোনো উত্তর। শক্তভারী নজর তার সামনের পানে। ইসানা জবাব না পেয়ে চুপ থাকে। তার জানামতে এমন কোনো কাজ করেনি যাতে রাদ ক্ষোভিত হবে তার ওপর। সে জানালার পানে চেয়ে আজকে সকালের ঘটনাটি ভাবে। রাদকে আজ কোট পড়তে সহায়তা করেছিল। অবশ্য রাদ নিজে পড়তে পারে। তবুও ইসানার কাছে ছোট্ট আবদার রেখেছিল। ইসানা তার আবদার রেখেছে। এবং তাকেও শাড়ী পড়াতে সাহায্য করেছে। সে নিজেই শাড়ী পড়তে পারে। তারপরও রাদ ইচ্ছে করেই সাহায্যের হাত বাড়িয়েছে। দূরত্বহীন দু’জন কপোত-কপোতী কাছাকাছি ছিল। শাড়ী পড়ানো শেষে রাদ তাকে কাছে টেনে কপালে, গালে চুম্বন দিয়েছে। বলেছে,’ তোমায় ছোঁয়ার ইচ্ছে দ্বিতীয় দাপ পূর্ণ হলো।’ ইসানা দৃষ্টি নিচু রেখে রাদের ভালোবাসা অনুভব করেছে, শুনেছে। তার কাছে প্রিয় একটি মুহূর্ত ছিল সেটি। ভেবে সে লজ্জা অনুভব করে। আড়চোখে রাদকে দেখে। এখনো তার মুখশ্রী মলিন ও গম্ভীর!
নৈঃশব্দে বড়ো নিশ্বাস নিলো।
.
‘বিয়েটা অন্যভাবে হয়েছে আমাদের। এতে আপনার কোনো অসুবিধা হয়েছে?’ ইভান কথাটি বলে বিছানার এক প্রান্তে বসল। মিতু চোখ তুলে তাকালো। কোমলভাবে বলল,
‘হয় নি। আচ্ছা এভাবে বিয়ের আইডিয়া কে দিয়েছে আপনাকে?’
‘নিজের তৈরী। বর পক্ষের সঙ্গে বরও যায়। কিন্তু আমি এবার ভিন্নভাবে নির্মিত করেছি। আমার সব চাচাতো-মামাতো ভাইদের পাঠিয়ে আপনাকে আমাদের বাড়িতে এনেছি। তারপর বিয়ে হলো।’
‘ইউনিক ছিল।’
‘হ্যাঁ! নাতি-নাতনীদের বলতে পারবেন এক সময়ে।’ বলে মুচকি হাসলো ইভান। মিতুও হেসে ফেলে।
‘ইসানাকে দেখে কী আপনি রাগ করেছেন?’
‘তাকে দেখে না ছিল আমার মধ্যে রাগ, না ছিল ঈর্ষান্বিত বোধ। তবে আমি অবাক হয়েছি তাকে দেখে। সে আপনার বিয়েতে এসেছে।’
‘ও এমন একটি মেয়ে, যার মধ্যে এক বুক দুঃখ কষ্ট জর্জরিত থাকলেও বহিঃপ্রকাশ করবে না। সব কিছু সুন্দর ভাবে মানিয়ে নিতে পারে। আপনিও কিছুটা ওর মতো।’
‘এজন্য আপনি আমাকে বিয়ে করতে রাজি হয়েছেন?’
‘উঁহু! একজন মানুষের গুন আরেকজনের মধ্যে থাকা কমনীয়। এজন্য তাকেই যে আগের কেউ ভেবে বিয়ে করা বা রিলেশনে জড়ানো ঠিক, এটা লজিকহীন। মায়ের জন্যই আপনাকে বিয়ে করেছি। আর আপনার আচরণ, ব্যবহার কিছুটা ইসানার মতো। এজন্য আপনাকে আমার হুটহাট ভালো লেগেছে। আশা করি এমনই থাকবেন সব সময়ে।’
‘চেষ্টা করব। আপনাকে প্রথম দিনই আমার ভালো লেগেছে। আপনি আমার স্বামী হয়েছেন। এটা আমার ভাগ্য বলা যায়।’ দৃষ্টি নত রেখে বলল।
‘আমি৷ এতটাও ভালো নই।’
‘আগের কথা মুছে ফেলুন। এখন আপনি আমার কাছে সুপুরুষ!’
ইভান মৃদু হেসে উঠে ঢয়ার থেকে একটি স্বর্ণের চেইন বের করে এগিয়ে আসে।
‘আপনার মাথার কাপড়টা ফেলুন।’
মিতু এক পলক ইভানকে দেখে মাথার কাপড় ফেলে দেয়।
ইভান ঝুঁকে চেইনটি পড়িয়ে হাতে পাঁচ হাজার টাকা উপহার দেয়। মিতু চেইনটি দেখে অনেক খুশি হয়। মিনমিন স্বরে বলে,
‘আমি আপনাকে কিছু দিতে পারলাম না।’
‘কোথাও চলে যাচ্ছি না। কাছেই থাকবো। এক সময় দিয়েন। এটি ইসানা উপহার হিসেবে দিয়েছে আপনাকে। আর টাকা আমি দিয়েছি।’
মিতু বলল,
‘তাহলে দু’জনার উপর ঋনি হলাম।’
ইভান মুচকি হাসে। মিতুর হাসিও চওড়া হয়। ইভান মিতুর পানে কয়েক মিনিট চেয়ে থাকে। মিতুর মাঝে ইসানাকে খু্ঁজে নেয় এবং ইসানার ওপর থেকে মুভ অন করে নিবে। সে মিতুর হাত ধরে বলল,
‘আমাদের ইউনিক বিয়ের অনুষ্ঠানের কথা নাতি-নাতনীদের বলতে হবে। এজন্য প্লানিং করি চলুন।’
মিতু লজ্জায় মাথা নুইয়ে নেয়। ইভান শব্দ করে হেসে ফেলে। নতুন এক দম্পতির তৃতীয় ভালোবাসার পৃষ্ঠার সূচনা হলো!
__
‘সমস্যা কী?’
‘হলো কী?’
মুরাদ ও সোহানা দু’জন দু’জনকে প্রশ্ন করে রাগী দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। মুরাদ চোয়াল শক্ত করে বলল,
‘মেয়ে চাই আমার।’
‘তো আমি কী করব?’
‘সাহায্য করবে।’
‘পারব না।’
‘ফোর্স করতে হবে?’
‘বাপের বাড়ি যেতে হবে?’ চোখ রাঙিয়ে বলল।
‘আরেকটা বিয়ে করতে হবে?’
‘একজনকে খু’ন করতে হবে।’ চেঁচিয়ে বলল সোহানা।
‘বেবিই বি কাম ডাউন। দিও না গো লগ ডাউন।’ অভিনয় ভঙ্গিতে বলল মুরাদ।
সোহানা মুখ ভার করে সোফায় বসে আছে। মুরাদ মানানোর তোড়জোড় নিয়ে বলল,
‘কাল কী খাবে বলো? আমি তোমার জন্য সব কিনে আনবো। তবুও…..।’
‘আমার একটা কন্ডিশন আছে।’ রাগী কণ্ঠে বলল।
‘বলো বলো। আমি মানতে রাজি।’
সোহানা শাহাদাৎ আঙুল দেখিয়ে বলল,
‘আমার একটা ছেলে চাই।’
‘একটা না দশটা দেবো। আগে তোমায় ছুঁতে তো দেও… ‘ বলতে বলতে সোহানাকে কোলে তুলে নিলো মুরাদ। তাদের মানঅভিমানের পালা এড়িয়ে দ্বিতীয় ভালোবাসার পৃষ্ঠার সূচনা হলো।
_
সেই যে ল্যাপটপ নিয়ে বসেছে রাদ। রাখার নামগন্ধ নেই। ঘড়িতে এগারোটা বাজে। নুডলস, কফি সব বানিয়ে পাশে রেখেছে। কিচ্ছু খায়নি রাদ। তার না খাওয়াতে নিজেও খাচ্ছে না। ইসানা বিছানায় বসে রাদের মেজাজ খারাপের কারণ খুঁজছে। সে বিয়ে বাড়িতে কী এমন করেছে বুঝতে পারছে না। ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে যায়। সে নিজেকে আর আঁটকে রাখতে পারে না। ফোন রেখে বিছানা থেকে নেমে তার সামনে দাঁড়িয়ে কপাট কণ্ঠে বলল,
‘কোথায় সমস্যা হয়েছে? না ঠিকমতো কথা বলছেন, না খাচ্ছেন। আমার ভুলটা কোথায় হয়েছে বলুন?’
রাদ মনে মনে চাইছিল ইসানা নিজ থেকেই তাকে এ বিষয়ে প্রশ্ন করুক। তাই হয়েছে। সে ক্ষোভিত নজরে তাকে এক পলক দেখে ল্যাপটপ বন্ধ করে উঠে দাঁড়ায়। ইসানার কাছাকাছি এসে কোমড়ে হাত রেখে নিজের সঙ্গে মিশিয়ে ধরল। হঠাৎ রাদের আ’ক্র’ম’ণে ইসানা হতভম্ব হয়ে সবিস্ময় তাকায়। রাদ দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
‘আপনাকে ছোঁবার অধিকার যেমন আমার একার আছে, তেমনি আপনারও ছোঁয়ার অধিকার কেবল আমারই আছে। আমি ব্যতীত আপনি অন্যকাউকে ছুঁতে পারবেন না।’
এতক্ষণে ইসানার মাথা নাড়া দিয়ে উঠলো গন্ডগোলটা কোথায় হয়েছে। ইভানকে কোট পড়িয়ে দেওয়ার সময় ইসানা ইভানকে না চাইতেও ছুঁয়েছে। এটি রাদ দেখে ফেলেছে। এজন্য ক্রোধ নিয়ে বসে রয়েছে। ইসানা রাদের অধিকার ফলানোর বিষয়টি ভালো লাগে। সে মনে মনে খুশি হয়। স্বামীর রাগ ভাঙাতে সে স্বাভাবিক ভাবে নিজেও রাদকে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে। এতে রাদ কিছুটা অবাক হয়। ভ্রুতে কিঞ্চিৎ ভাজ পড়ে। ইসানা কোমলভাবে বলল,
‘স্বামীর রাগ ভাঙানো স্ত্রীর কর্তব্যের মধ্যে পড়ে শুনেছি। এটা নিশ্চয় আমারও করতে হবে। তো বলুন মাই লিটেল হাসবেন্ড, আমাকে কী করতে হবে এ মুহূর্তে? স্যরি বললে হবে?’
রাদ ভ্যাবাচেকা খেয়ে যায়। ইসানার এরূপের সঙ্গে আজ সে নতুনে পরিচিত হয়েছে। সে কী তাহলে তার রাগ বুঝতে পেরেছে? তবে কি তাদের সম্পর্ক স্বাভাবিক হতে চলেছে অন্য স্বামী-স্ত্রীদের মতো? রাদ বাঁকা হেসে এক ভ্রু উঁচু করে নরম স্বরে বলল,
‘রাগ ভাঙাতে হলে ছোঁয়ার ইচ্ছে তৃতীয় দাপ পূরণ করতে দিতে হবে। ডু ইউ এগ্রী?’
‘ইয়েস! কজ আই লাভ ইউ!’ বলে ইসানা মুচকি হাসে। রাদ ইসানার কপালে কপাল ঠেকিয়ে চোখ বন্ধ করে ফিসফিসে শুধায়,
‘লাভ ইউ টু..।’
পরিশেষে তাদের প্রথম ভালোবাসার অধ্যায়ের সূচনা হলো। তাদের মাঝের বনিবনা, মনমালিন্য, দুরত্বকে চিরকালের জন্য বিদায় জানালো।

সমাপ্ত।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here