#তোমারই_আছি_আমি
পর্ব-১৪
#SaraMehjabin
সারা ঘুম ভেঙ্গে যা দেখল তা দেখার জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিল না। তার পরনে লাল টুকটুকে লেহেঙ্গা,, সাথে হাতভর্তি চূড়ি, গহনা-গাটি। যা দেখছে তা স্বপ্ন না সত্যি বোঝার জন্য সারা নিজের গায়ে চিমটি কাটল,,,একবার দুইবার না অনেকবার। অবশেষে বুঝল এটা সত্যি। তবু নিশ্চিত হতে বিছানা ছেড়ে আয়নার সামনে দাঁড়ায়। আয়নায় নিজের অবয়ব দেখে সারা স্তব্ধ। তাকে কেউ খুব মিষ্টি করে লাল টুকটুকে একটা বউ সাজিয়ে দিয়েছে। লাল লেহেঙ্গা,, চুল বাঁধা,, হাতভর্তি ঝনঝনানি চূড়ি,,,চোখে কাজল,,, আরেকটা জিনিস দেখে সারা একদম ‘হা’ হয়ে গেল। এত সাজুগুজু করানোর পর সেই ব্যক্তি (সারা জানে না কে সে,,,মানুষ ভূত না অন্যকিছু) কপালের ডানপাশে গোল্লা করে একটা কালো টিপ আঁকিয়েছে। যেন সারা একটা ছোট্ট বাচ্চা। কারো নজর লেগে যেতে পারে তাই নজরদোষ কাটাচ্ছে টিপ দিয়ে।
কপালে ফোটা আঁকা জায়গাটা সারা স্পর্শ করল। খুব সুন্দর করে সাজিয়ে দেওয়ার পর এরকম শুধু একজনেই করত। তার কথা ভাবতেই মুহুর্তেই সারার হৃৎস্পন্দন বেড়ে গেল। হৃৎস্পন্দনের গতির আঘাত বুকে ব্যথা হচ্ছে।
একসময় বাথরুমের ছিটকিনির ‘খট’ খোলার শব্দে সারার ঘোর ভাঙল। সারা’র ঘরের বাথরুম থেকে তুরাগ বেরিয়ে এলো। চোখেমুখে পানি। মুখ নিচের দিকে রেখে চুলগুলো সামনে-পিছনে-ডানে-বামে ঝাড়ানোর ফলে পানি ছিটকে পড়ল সারার মুখে।
পানির ছিটা লাগায় সারার চোখ গেল তুরাগের দিকে। তুরাগ তার রুমে! তার বাথরুমে! তার মানে কি এই লোকটাই…. এইসব!! আর ভাবতে পারল না সারা।
“আরেকটা,,,এই গালে,,, আরে ঐ গালে দিয়েছ,,এই গালে দাও,,ঘাড়ের নিচে দেওয়া হয় নি,,ঐখানে একটা দাও।”
সারা তুরাগের চুলগুলো একত্রে টেনে ধরে তুরাগকে বাথরুমের দরজার সাথে লাগিয়ে ধুমাধুম কিল-ঘুষি-থাপ্পড় গিফ্ট করেছে। আর তুরাগ সারাকে ইন্সট্রাকশন দিচ্ছে কোথায় কোথায় মারে নি। রাগে সারার গা জ্বলে উঠছে। এতো বড় নোংরা একটা কাজ করেও লোকটার ভেতর কোনো লজ্জা নেই! আবার বলে এইদিকে মারো ঐদিকে মারো,,,ইহ্ শখ কত,,,তার কথামতো মারতে হবে! ভাব দেখে মনে হয় সারা চুম্মা দিচ্ছে তাকে। ছিঃ ছিঃ সারার মনে চাইছে মেরে ফেলে লোকটাকে। শুধু খুনের মামলায় ফেঁসে যাওয়ার ভয়ে পারছে না।
: অসভ্য ইতর নোংরা জঘন্য বদমাইশ বাদুড়ের পাছা,,, একটা মেয়ের রুমে ঢুকে সে ঘুমিয়ে আছে আর এই সুযোগে আপনি এত বড় নোংরা কাজটা করলেন? আপনার লজ্জা করল না?
: বিশ্বাস করো আমি বেশি বড় নোংরা কাজ করিনি। যেটা করেছি সেটা বাধ্য হয়ে করেছি। আমার প্রচুর চাপ ছিল। সায়ানকে বললাম তোদের বাথরুমটা কোথায়। তো ও আমাকে বেসিনের পাশের কমন বাথরুমে নিয়ে গেল বাট ঐটার ট্যাপ নষ্ট। এছাড়া বাথরুম আছে আর দুইটা। একটা তোমার মা-বাবার রুমে আরেকটা তোমার রুমে। তোমার মা আবার ঐ বাথরুম কাউকে ইউস করতে দেন না। সো বাধ্য হয়ে আসলাম তোমারটায়। বিলিভ মি আমি বড় কিছু করি নাই। জাস্ট ছোট্ট বাথরুমটা করেছি। কিন্তু তুমি এইটার কারনে মার দিবে জানলে বড় ছোট সব টাইপের করে তোমার বাথরুম ভরিয়ে ফেলতাম। যাতে ইউ কান বিট মি অল ডে।
সারা: সাট আপ। আপনার কোন কথা বিশ্বাস করি না। আপনি যে খুবই জঘন্য লোক সেইটা প্রথমদিনেই বুঝেছিলাম। বাট আপনি যে এই পরিমাণ নিচ কল্পনাও করি নি।
তুরাগ: ও মাই খাট ওয়াও! তুমি আমাকে নিয়ে এতো ভাবনা-চিন্তা করো?
সারা রেগে তুরাগের বুক বরাবর বিশাল একটা খামচি বসাল। এতো জোরে খামচি দিয়েছে যে কোন মানুষ ব্যথায় কেঁদে ফেলবে আর সেইখানে এই তুরাগ খামচি খাওয়ার পর প্রথমে নিজের মোবাইলটা বের করল তারপর একটা ধুমধারাক্কা গান ছেড়ে দিয়ে সারার সামনে নাচা শুরু করল।
সারা: এই সমস্যাটা কি আপনার? আপনি কি পাবনা(পাবনার লোকেরা রাগিয়েন না। মজা করে বলা হয়েছে) থেকে পালিয়ে আসছেন কোনোভাবে?
তুরাগ: ঐখান থেকে পালিয়ে আসি নি বাট এখন খুশির ঠেলায় ঐখানেই যেতে হবে। থ্যাংক ইউ ভাবনাকুমারী,,থ্যাংক ইউ। তুমি বুকের ওপর যে দাগ বসিয়েছ আজীবনেও এইটা উঠবে না। চিরকালের জন্য তুমি আমার বুকে এই দাগটা হয়ে রয়ে গেলে। তাছাড়া তুমি কি চিন্তা করে দেখেছ মার দিতে গিয়ে তুমি কতবার আমাকে টাচ করলে। আমার শরীরের কত জায়গায় তোমার ছোঁয়া থাকল। থ্যাংকস এ লট ফর দিস প্রিসিয়াস গিফ্ট।
সারা: ভাইয়া,,,এই ভাইয়া,,,কোথা থেকে এসব মানসিক রোগী ধরে আনিস? সামনে থেকে সরা। এই আজীব জন্ত আমি আর নিতে পারছি না।
সারা’র চিৎকার-চেচামেচিতে সায়ান চলে আসে।
সায়ান: কি রে বোনু,,এরকম সেজেছিস কেন?
সারা কি বলবে খুঁজে পেল না। ইতস্তত করে উত্তর দিল, কিছু না,,এমনি।
সায়ান: আচ্ছা শোন্ ,,,আম্মু বাসায় নাই। তুরাগের জন্য চা বানিয়ে দিয়ে যা।
সারা: ঐ বদের বাচ্চার জন্য আমি চা কেন, বিষ বানাতে প্রস্তত।
সায়ান: বোনু কি বলছিস বিড়বিড় করে? জোরে বল্ কিচ্ছু শুনি না।
সারা: তোমার শোনা লাগবে না। তুমি তোমার মহান বন্ধু নিয়ে সোফার রুমে যাও। আমি চা-নাশতা নিয়ে আসছি।
রান্নাঘর থেকে ড্রয়িংরুমের দূরত্ব বেশি না। চা-নাশতা বানাতে বানাতে সারা ওদের অনেক কথাই শুনল। সারার বাবা তুরাগকে একেবারে খুটিয়ে খুটিয়ে ওর সম্পূর্ণ বৃত্তান্ত শুনছেন। এতদিন কোথায় ছিল, বিদেশে কি নিয়ে পড়াশোনা করেছে, বাবা কি করে বাসা কোথায় কয় ভাইবোন ভবিষ্যতে কি করার ইচ্ছা বিয়েশাদি নিয়ে কি ভাবছে কেমন মেয়ে পছন্দ ইত্যাদি ইত্যাদি। ব্যপারগুলো সারার মোটেও স্বাভাবিক লাগছে না। ভাইয়া কোন বন্ধুকে বাসায় আনে না। তুরাগকে আনল। বন্ধুকে যে পরিস্থিতিই হোক বোনের রুমে সায়ান ঢোকাবে না তাও যে সময় সারা ঘুমিয়ে আছে। ওরা কি অন্যকিছু ভাবছে সায়ানকে নিয়ে? যদিও এখানে সন্দেহ করার মতো কিছুই হয় নি তবুও সারার কেমন যেন সন্দেহ হলো। ওরা কি জানে না সারাকে নিয়ে অন্যকিছু ভাবার পরিনতি কি হতে পারে!
সারা চা দেওয়ার সময় তুরাগের নজর গেল ওর ডানহাতের অনামিকার দিকে। সে হুট করেই সারা’র হাত টেনে নিজের কাছে নিল। ঘটনার আকাস্মিকতায় সারাসহ সবাই অবাক। তুরাগের সেদিকে খেয়াল নেই। সে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখছে সারার আঙ্গুলের আংটিটা। হীরের আংটি। জ্বলজ্বল করছে।
: এই আংটি তুমি কোথায় পেয়েছ? সত্যি উত্তর দাও।
: কি আশ্চর্য! কোন আংটি
এবার সারাও খেয়াল করল তার ডানহাতের অনামিকায় আংটি।
সায়ান: ও মাই গড। এটা তো রিয়েল ডায়মন্ড। এতো দামি আংটি তুই কোথায় পেলি?
সারা বুঝতেই পারছে না হচ্ছে কি এসব। ঘুম থেকে উঠেই অদ্ভুত সাজগোজ। তারপর হাতে আংটি। গুলিয়ে যাচ্ছে সব।
সারা: আজমী দিয়েছে।
সায়ান: ওহ
তুরাগ: স্যরি সারা। আমি এভাবে রিয়্যাক্ট করলাম। আমার বড় বোনের এনগেজমেন্ট রিংটাও সেইম টাইপ ডিজাইন ছিল। আজকে এনগেজমেন্ট কাল থেকে আংটি পাওয়া যাচ্ছে না। বাধ্য হয়ে পুরানো একটা আংটি দিয়ে অনুষ্ঠান হলো।
সারা: আশ্চর্য তো! পৃথিবীতে এক ডিজাইনের একটাই আংটি থাকে? ভাইয়া তোর এই বন্ধু আসলেও মানসিক রোগী।
সারা রেগে নিজের রুমে চলে গেল। অথচ ভেতরে ভেতরে আশ্চর্যের চরম পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। এইসব ঘটনার মানে কি?
—————————————————————————–
মেহেন্দী সন্ধ্যা। নিজের রুমের জিনিসপত্র নির্বিশেষে যা কিছু আছে সব ভাঙচুর করছে মেধা। মাঝে মাঝে জোরে চিৎকার করছে সাথে ফোস ফোস করে নিঃশ্বাস ফেলছে। দেখে মনে হচ্ছে বিশাল একটা অজগর সাপ ফনা তুলে দাঁড়ানো।
মেধার এই রাগের কার তার মেহেন্দি অনুষ্ঠানে খানবাড়ির চৌদ্থগুষ্টি মেহেদী পড়েছে সে নিজে বাদে। কারণ অদ্বিতী মাইশা ওরা যে ডিজাইনারকে এনেছিল মেধা ভাব ধরে বলেছে সে ওদের সাথে মেহেদী পড়বে না। তার জন্য আলাদা ডিজাইনার লাগবে। যে শুধু তাকেই মেহেদী পড়াবে। সেই হিসেবে একজন ডিজাইনার বুকিং ছিল মেধার। মেহেদী অনুষ্ঠানের ঠিক পনেরো মিনিট আগে সে ফোন করে বলল আসবে না।
তার বিয়ের অনুষ্ঠানে অন্যরা আনন্দ করল,নাচগান করল আর মেধা-সে দাঁড়িয়ে রইল এককোনায়। আশ্চর্য মেধার একটা বিয়ের অনুষ্ঠান-ও ঠিকভাবে হচ্ছে না। অদ্বিতী একটু পর পর মেধাকে পিন্চ করছিল। মাইশাও আজকে অদ্বিতীর সাপোর্ট করেছে। রাগে মেধার ইচ্ছা করছিল ওদের চুল ছিঁড়ে দিতে। একবার বিয়ে হয়ে যাক,,,বুঝবে মেধা কি জিনিস!
পুরো অনুষ্ঠানে আকাশকে একবারো দেখা গেল না।
—————————————————————————-
বেশ কয়েকদিন ভার্সিটি যাওয়া হয় না। এভাবে তো আর চলে না। পড়াশোনা করতে হবে। তাছাড়া ঐ ঘটনা(সি.সি ফুটেজ) অনেকদিন হয়ে গেছে। এখন বোধহয় কারো তেমন মনেও নেই।
সারা তাই বাসার কাজ শেষ করে ভার্সিটির জন্য রেডি হয়ে নিল।
আজমী, ফারিহা আর সারা তিনজন একসাথে ভার্সিটিতে আসল। এসেই দেখল পুরো ভার্সিটি কেমন সাজ সাজ রব। গেট থেকে শুরু করে প্রত্যেকটা জায়গা বেশ সুন্দরভাবে সাজানো। ছেলেমেয়েরা অন্যান্য দিনের তুলনায় সাজগোজ; সবাই নানান দিকে ছোটাছুটি করছে।
আজমী: ঐ আজকে মনে হয় কিছু আছে। ধুর্ আগে জানলে একটু ফিটিং হয়ে আসতাম। ধুরছাতার গীবন।
ফারিহা: আহ চুপ। বুঝতে দে বিশয়টা। হ্যা রে সারা হইতাছে কি রে?
সারা: কি জানি।
চলবে