তোমারই আছি আমি
পর্ব-১৫
Sara mehjabin
সারা ,ফারিহা , আজমী ভার্সিটিতে ঢুকেই আশ্চর্য হয়ে গেল। পুরো ক্যাম্পাস জমকালো ভাবে সাজানো; এমনভাবে সাজানো যেন আজকে কারো এখানে বিয়ে হবে। ছেলেময়েরা ছোটাছুটি করে বিভিন্ন কাজ করছে। দেখে মনে হয় আজকে ভার্সিটিতে বিশেষ কিছু হবে; কোন অনুষ্ঠান হয়তোবা।
আজমী: ঐ আজকে মনে হয় কিছু আছে রে। আগে জানলে একটু ফিটিং হইয়া আসতাম। ধুর ছাতার গিবন।
ফারিহা: আহ চুপ। বুঝতে দে বিষয়টা। হ্যা রে সারা কি হতে পারে বল্ তো।
সারা: কি জানি।
আজমী: দোস্তগণ অবস্থা সুবিধার বুঝি না। তোমাদের যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে দৌড় দিতে হবে। এবারের সংগ্রাম আমাদের দৌড় দেওয়ার সংগ্রাম। লেট’স গোওও।
ফারিহা: আজাইরাটার কি হইলো? ও দৌড়ায় ক্যান?
আজমী( দৌড়াতে দৌড়াতে): আরে আমি দৌড়াই ক্যান না জিগ্যেস করে নিজেরাও দৌড় দেন আফারা। ভালো কইরা তাকায়া দ্যাখ এইখানে যারা আছে সব ঐ মেধার গ্যাং এর পোলাপান। এরা কোনকিছু বিচার করে না। যারে সামনে পায় তার কপালেই শনি নামায়া ছাড়ে। তারমধ্যে আমাদের সঙ্গে অলরেডি ঝামেলা হইছে অনেক। সো জান বাঁচাইতে চাইলে দৌড় দে। বাই এনি চান্স ওদের কারো চোখে পড়লে আমাদের তিনজনের জামাই বিধবা হয়ে যাবে।
ফারিহা: এ চুপ। ওই সারা আমারও মনে হয় আজকে এই মেধাদের গ্যাংএর কোন পার্টি ফার্টি আছে সো আমাদের থাকার কোন দরকার নাই। চল্, চলে যাই।
সারা: হুম..এখানে থাকা লাগবে না। আয় ক্লাসে যাই।
তিনজনে কোরিডর ধরে হেঁটে যাচ্ছে। মেধাদের গ্যাং এর কথা শুনার পর থেকেই অদ্ভুত কারণে সারা বিষয়টা নিয়ে ভাবছে। মেধাদের গ্যাং মানে আকাশ-ও থাকবে। কি কারণে এইরকম বিয়েবাড়ি স্টাইলে ক্যাম্পাস সাজিয়েছে। তাহলে সারা মনে মনে যেটা ভাবছে সেটাই কি? এরকম হলে সারা’র পক্ষে এক সেকেন্ড-ও স্থির থাকা সম্ভব হবে না।
ক্লাসে যাওয়ার পথে হুট করে একটা মেয়ে সারাদের তিনজনের সামনে এসে দাঁড়াল। সেই মেয়েটা যে সেই প্রথম দিন সারাদের মেধা সম্পর্কে বলেছিল। মেয়েটি মিশুক,, খুব ভালো মেয়ে। সারাদের সঙ্গে ভালোই সম্পর্ক তৈরি হয়েছে কয়েকদিনে।
জাইন: আরে তিন বান্দরনী,,,কতদিন তো তোদের খবর-ই নাই। কৈ গেছিলি?
আজমী: আসলে সারা একটু অসুস্থ ছিল আপু। আমরা আবার একজন কোথাও না গেলে তিনজন যাই না। এজন্য কেউই আসি নাই।
জাইন: ওমা সারা অসুস্থ ছিলি তুই? আমাকে একটাবার ফোন-ও করলি না? আমি তোদের নিয়ে অনেক টেনশন করেছি।
সারা: স্যরি আপু। তোমাকে ফোন করতে ইচ্ছা করেছিল। কিন্তু মনে করেছিলাম তুমি ডিস্টার্ব হবে।
জাইন: তুমি অনেক ভালো বুঝেছ সোনামনি। এখন তিনজনে চলো। আজকে একটা গ্রান্ড পার্টি আছে। অন্নেক ইনজয় হবে।
সারা: না আপু আমরা ঐদিকে যাবো না। ঐসব তো ঐ মেধাদের গ্রুপের।
জাইন: আরে ধুর্ মেধাদের হতে যাবে কেন? আজকে ঐখানে সবাই যেতে পারবে। আর কাউকে কিছুই বলা হবে না। তোরা চল্ তো।
জাইন ওদের কে টানতে টানতে জোরাজুরি করে নিয়ে এল। পার্টির এ্যরেন্জমেন্ট দেখে ওরা সবাই হতবাক। মনে হচ্ছে সত্যি কারো বিয়ে।
আজমী: ঐ সারা,, এইটা ভার্সিটি না কমিউনিটি সেন্টার? এত সাজগোজ আয়োজন কিছুই তো বুঝতেছি না। কারো বিয়ে হবো নাকি এইখানে?
জাইন: বিয়ে না বিয়ের মতোই।
আজমী: সেইটা আবার কি?
জাইন: তোরা জানিস না আজকে কি? পুরা দুনিয়া জানে আর তোরা তিন বলদ কৈ থাকস?
সারা: কেন? আজকে কি?
জাইন: তোরা খবর জানিস না? আমাদের ভি.পি আছে না মাকসুদুল সাদাত আকাশ তার সাথে মেধার বিয়ে। এই কয়দিন পরেই। ওদের গ্রুপের সবাই ওদের বিয়ের সেলিব্রশনের জন্য পার্টি দিছে আজকে, এইজন্যই এত কিছু। দ্যাখ কপাল কি,,আকাশ ভাইয়া কত ভালো একটা ছেলে,, সবার কত হেল্প করে,, কত ব্রিলিয়ান্ট স্টুডেন্ট,,, একবছর পর এ্যব্রোডে স্কলারশিপ নিয়ে চলে যাবে আর এই মেধা কোন মেয়ে হলো? ফুল ডাইনী বুড়ি একটা! ওর চেয়ে কত ভালো মেয়েরা আকাশভাইয়ার জন্য পাগল ছিল! আর আকাশভাইয়া শেষে এইটারে বিয়ে করবে। আমার চিন্তা করলে নিজের চুল ছিড়তে মন চায়। এই মেধার কপাল কি সোনা দিয়ে বাঁধানো!
একটু পরেই আকাশ মেধা দুজনেই এলো। সবাই মেতে উঠলো ওদেরকে নিয়ে। আকাশ মেধাকে একহাতে কোমর জড়িয়ে কাছে টেনে দাঁড়িয়েছে। দুজনেই সুন্দর দেখতে। তাই খুব মানিয়েছে দুজনকে। সত্যিই মনে হচ্ছে ওরা একে অপরের জন্য তৈরি। মেধাকে ঠিক পরীর মতো লাগছে। সারা মেধাকে খুটিয়ে খুটিয়ে দেখতে গিয়ে অনেকগুলো ধাক্কা খেল। মেধা কত নিঁখুত! মেধার মতো পারফেক্ট হাইট, পারফেক্ট ফিগার, ড্রেসিং সেন্স, ধবধবে ফর্সা গায়ের রং- সারা তার ধারেকাছেও না। মেধার সঙ্গে ওর কোন তুলনাই চলে না। ও যদি মেধার মতো হতো তাহলে হয়তো এই লোকটা ওর-থাকত। ইশ্ ওরকম সুন্দর কেন হলাম না? তাহলে হয়তো আকাশভাইয়া আমাকে ভুলে যেত না। তাকে ছাড়া যে আমার দমটা আটকে আসে।
আজমী: ফারি,, ওই ফারি সারারে দ্যাখ। কেমন কাঁপতেছে। ভয় করতেছে আমার,, যদি রিঅ্যাক্ট করে ফেলে?
ফারিহা আজমীর দিকে আশস্তপূর্ন দৃষ্টি দিয়ে সারার হাত চেপে ধরল। খুব শক্তভাবে। সারা কেঁপে ওঠে ওর দিকে তাকায়।
ফারিহা বলে, সারা শান্ত হ। একদম শান্ত। কোন রিঅ্যাকশন করবি না। ঐ লোকটা কেউ না। কেউ না তোর। তার লাইফে যা খুশি হোক তুই সেটা নিয়ে ভাববি না।
ফারিহার প্রতিউত্তরে সারা চুপ রইল। পুরো অনুষ্ঠানে তার মধ্যে কোন রিঅ্যাকশন দেখা গেল না।
প্রায় শেষ পর্যায়ে এসে একটা ছেলে হুট করে বলল, আমরা দেখতে পাচ্ছি আমাদের মধ্যে বসে আছেন একজন বিশিষ্ট গায়িকা। যার সুন্দর কন্ঠস্বর আমরা নবীনবরণে শুনেছিলাম। সারা মেহজাবিন ফার্স্ট ইয়ার খুব সুন্দর গান গায়। সারা আপু প্লিজ আজকে আকাশভাইয়া ও মেধাআপুর নতুন জীবনের শুভেচ্ছা হিসেবে তুমি তাদের ডেডিকেট করে একটা গান শোনাও আমাদের প্লিজ।
সারা যেতে চাইছিল না কিন্তু আশেপাশ থেকে খুব চাপ আসছে। তারচেয়েও বড় কথা ফারিহা বলল “যা। খুব ভালো গাইবি। লোকটাকে বুঝিয়ে দে তাকে নিয়ে তোর কিছু যায় আসে না। ও হ্যা, ওদের নতুন জীবনের শুভেচ্ছা দিতে ভুলিস না।”
সারা উঠে গান গাইতে গেল। শুরুতেই হাসিমুখে ওদেরকে খুব সুন্দরভাবে শুভেচ্ছা জানাল। আড়চোখে তাকিয়ে দেখল ওর স্বাভাবিক রিঅ্যাকশন দেখে আকাশ রাগে থমথম করছে। মাথার চুল টেনে হাত মুষ্টি করে রাগ কন্ট্রোলের তীব্র চেষ্টা চালাচ্ছে কিন্তু পারছে না। সারা যখন বলল সে মনে মনে সবসময় চাইবে ওরা দুজন যেন একসঙ্গে ওদের দুজনের জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত ওদের দুজনের সংস্পর্শে ভালবাসাময় জীবন কাটাতে পারে সেই মুহূর্তে আকাশ রক্তবর্ণ লাল চোখ করে সারার দিকে তাকাল। যেন পারলে সারাকে চোখ দিয়েই গিলে খায়। সারা সেসব পাত্তা না দিয়ে গান শুরু করল। সারা হাসিমুখে গাইছে আর এদিকে আকাশের নিঃশ্বাসের গতিবেগ ওঠানামা করছে। বিস্ফোরিত চোখে সে তাকিয়ে দেখছে সারাকে। সারাকে চিনতেই পারছে না। এই মেয়ে যে কোনো মেয়ে আকাশের সঙ্গে কথা বললে কেঁদেকেটে জ্বর উঠিয়ে ফেলত,,,আকাশের সঙ্গে কথা বলত না, নিজের খাওয়া-দাওয়া বাদ দিয়ে দরজা বন্ধ করে বসে থাকত–তার সেই জিদ সামলাতে আকাশকে কি না করতে হয়েছে। সারা’র অবস্থা দেখে শেষ পর্যন্ত আকাশ মেয়েদের সাথে কথাই বন্ধ করল। তার সামনে আকাশ অন্য একটা মেয়েকে বিয়ে করবে দুইদিন পরে অথচ সারা–কত সহজ স্বাভাবিক।আকাশ তো এটা দেখতে চায় নি। সে চেয়ছিল তাকে অন্যকারো সঙ্গে দেখে সারা রিঅ্যাক্ট করুক। তাকে হারানোর যন্ত্রনায় কষ্ট পাক। যতটা কষ্ট সে আকাশকে দিয়েছিল আকাশ মিথ্যা করে হলেও সারাকে সেই কষ্ট ফেরত দিতে চায়। অথচ সারা’র মধ্যে কোন ভাবলেশ নেই। তাহলে কি সারার মনে এখন ওর কোন জায়গা নেই? জায়গাটা কি শূন্য হয়ে গেছে? নাকি নতুন কেউ সেই জায়গার মালিক।
এদিকে যন্ত্রনায় সারা’র কন্ঠ বুজে আসছে। আর এক শব্দ গান গাইতে ইচ্ছে নেই তার। হাসিমুখ দিয়ে সেটা যথাসম্ভব লুকিয়ে রাখার চেষ্টা করছে। কিন্তু গানের প্রথম অংশ গেয়ে সারা আর পারল না। কান্নায় বুজে আসা কন্ঠ থেকে গানের আর একটা শব্দ-ও বের করতে পারল না সে। সেই মুহুর্তে গান শুরু হয় সারার গাওয়া লাইনের পরের থেকে। তবে পুরুষকন্ঠ। সবাই অবাক হয়ে দেখছে লোকটাকে। এ কে? একে তো আগে কখনো দেখে নি। মনেও হয় না ভার্সীটির কেউ।
ছেলেটাকে দেখে আকাশের হৃৎপিন্ডে ধাক্কা লাগল। মেধা অবাকভাবে ডাকল, ভাই…। আর সারা কোন কথাই বলতে পারল না। তুরাগ সারাকে নিয়ে দাঁড়াল ঠিক সেই ভঙ্গিতে যে ভঙ্গিতে আকাশ আর মেধা এতক্ষণ দাঁড়িয়েছে। একহাতে সারার কাধ জড়িয়ে সারাকে সাথে নিয়ে গান শেষ করল। চারদিকে হাততালির বন্যা বয়ে যায়। আর আকাশ হিংস্র বাঘের দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে থাকে সারা ও তুরাগের দিকে।
অবশেষে এলো আকাশের সাথে মেধার কেক কাটার পালা। অনুষ্ঠানের মূল আকর্ষণ।
“আকাশ বেবি হোয়াট আর ইউ ডুয়িং? আর ইউ গোন ক্রেজি?” মেধা বারবার চিৎকার করছে।
কিন্তু সেসব দিকে হুশ নেই আকাশের। সে ছুরি দিয়ে কেকটা একেবারে নষ্ট করে পা দিয়ে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিল। সামনে যা পেল সব আছাড়ে ভাঙচুর করল। চেয়ারগুলো পা দিয়ে ফেলে দিল।
মেধা আকাশকে থামাতে গেলে আকাশ এক ধাক্কায় ফেলে দেয়। “ইউ ইডিয়ট গার্ল,,জাস্ট গো টু হেল।”
সারা তুরাগকে বলল, আপনি চলুন। কথা আছে।
তুরাগ বলল, চলো।
সন্ধ্যাবেলা। সারা টিউশন পড়িয়ে বাসায় ফিরছে। যদিও তেমন রাত নয় তবুও ঘন আঁধার নেমেছে ছোট্ট গলিটায়। গলির ভেতরে কিছুই দেখা যায় না। মোবাইলের ফ্লাশ অন করে কোনমতে সামনে হাঁটছিল সারা এমন সময়েই কেউ তার মুখ চেপে তাকে দেয়ালের সাথে লাগিয়ে দেয়।
চলবে
(