তোমারই আছি আমি
পর্ব-১৭
Sara Mehjabin
আকাশকে পাওয়া যাচ্ছে না ঠিক সেই মুহুর্তে মেধাদের বাসা থেকে ফোন।
মেধাদেরকে কি জবাব দেবে এখন সেই চিন্তায় খানবাড়ির সবাই অস্থির হয়ে পড়েছে। অবশেষে সাঈদ সাহেব ফোনটা তুললেন। সত্য যতই কঠিন হোক তার মুখোমুখি সবাইকেই দাঁড়াতে হয়।
– হ্যালো,,, আকাশ আছে? আকাশকে প্লিজ ফোনটা দিন না। খুব দরকার ওকে। প্লিজ।
ফোনের অপর পাশ থেকে অস্থিরভাবে কথাগুলো বললেন মেধার মা শিল্পী।
সাঈদ খান: কেন? কি দরকার ওকে?
শিল্পী: দেখেন না ভাইজান। মেয়ে আমার কি পাগলামি শুরু করেছে। বলছে নাকি এই বিয়ে করা ওর পক্ষে সম্ভব নয়। এই বিয়ে করলে আকাশ নাকি ওকে শেষ করে দেবে। বলেন তো ভাইজান এইসবের মানে কি? এতবছর দুইজনের সম্পর্ক–চোখের সামনে দেখেছি আকাশ কি না করেছে ওর জন্য। ওকে কতোটা ভালবাসে আকাশ। আর সে বলছে আকাশ ওকে ভালবাসে না। ওকে বিয়ে করতে চায় না। ওদের কোন সম্পর্ক নেই। বলেন তো এগুলো কথা,,,এখন আমরা কি করব? মেয়েটা পুরো পাগলের মতো আচরণ করছে। সামলানো যাচ্ছে না ওকে। আমার মনে হয় দুইজনের মধ্যে সামান্য ঝগড়া-ঝাটি রাগারাগি হয়েছে।তাই এই মেয়ে বিয়ে না করার জিদ ধরেছে,,, জানেন ই তো ছোট থেকে আদরে থেকে কেমন মাথা গরম টাইপের। রাগ উঠলে কোন হুশ থাকে না। যদি আকাশ আসলে ওকে সামলাতে পারত।
সাঈদ খান ফোনের অপর প্রান্তে প্রায় বাকরুদ্ধ হয়ে গেলেন। শুধু কোনমতে শিল্পীকে বললেন, ভাবি পরে ব্যাক করছি।
: ভাইজান ঐদিকে তো আরেক ঘটনা। মেধা নাকি বলছে আকাশকে বিয়ে করবে না।
: কিহ? এরা সবাই মিলে শুরু করলটা কি?
: ভাইজান একটা কথা বুঝতে পারছি না এইখানে আমরা তাদেরকে তো জোর করে বিয়ে করাচ্ছিলাম না। দুইজনে দুইজনকে পছন্দ করত। আমরাও তাই ফ্যামিলি থেকে বিয়েটা আগিয়েছি। এখন বিয়ের দিন এসে এই ধরনের সিনক্রিয়েট কেন করছে ওরা? ওরা কি বুঝতে পারছে না এটা শুধু ওদের লাইফের ডিসিশন নয় এটার সাথে আমাদের দুইটা ফ্যামিলির মান-সম্মান জড়িত আছে। তাহলে ওরা কেন এগুলো করল?
: জাস্ট সাট আপ। ওরা কেন এগুলো করল জানলে আমি এইখানে বসে থাকতাম না। আমার হয়েছে যত জ্বালা। একজন রাগ করে বাপের বাড়ি চলে যায়,,,একজন বিয়ের দিন নিঁখোজ হয়। আর আমার মুখটায় চুন-কালি দিয়ে মেকাপ করাবে। ইচ্ছা করছে বসে বসে নিজের মাথার চুল ছিঁড়ি।
: সেটা সম্ভব না ভাইজান। আপনার মাথায় চুল নেই।
: সাঈদ জাস্ট সাট ইওর মাউথ আপ।
: তাহলে মোট কথা হলো,,জামাই পালাইছে। আর কন্যা বলছে বিয়ে করব না। তাইলে আমি ঘরে গেলাম। মেকাপ টেকাপ যা আছে উঠায়া ফালাই। ধুর্ ভাবছিলাম বিয়ে হবো দুই তিনটা ছবিটবি তুলব। ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়েছি,,আজকে বাড়িতে বিয়ে। ধুততেরি কিছুই হলো না। যাই ঘরে গিয়া ঘুমাই গা।
বলতে বলতে হাই টেনে সাঈদ খানের বৌ নিজের রুমের দিকে রওনা হলেন।
সাইদ বিস্ফোরিত দৃষ্টিতে তার স্ত্রীর চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইলেন। একটু পরে আবার বেবিন খানের ফোন বেজে উঠলো।
বেবিন: সাঈদ ফোন ধরো তুমি। আমার শক্তি নেই ফোন ধরার।
সাঈদ: হ্যালো।
আকাশ: আরে চাচ্চু আব্বুর ফোন তুমি ধরেছ কেন? আব্বু কোথায়?
সাঈদ: তোর আব্বুকে কথা বলার অবস্থায় রেখেছিস তুই? ছিঃ আকাশ! তুই আমাদের বাড়ির একমাত্র ছেলে ,,,তোর কাছ থেকে এইরকম কিছু আশা করি নি। কিভাবে পারলি এটা করতে?? বাপের মান-সম্মানের কথাও ভাবলি না? এতগুলো মানুষের সামনে কি জবাব দেবে সে!
আকাশ: চাচ্চু ওয়েট ওয়েট। ফিল্মের সব ডায়লগ যদি একবারেই দিয়ে দাও তাহলে এরপরে কি বলবে? পরের জন্য কিছু জমা রাখো। কারণ আজকে বাড়িতে অনেক বড় ফিল্ম হবে। ফিল্মে তোমারো তো একটা রোল প্লে করতে হবে। সো সেটার জন্য ডায়লগ-ও লাগবে।
সাঈদ: আকাশ তুই কি বলছিস কিছু বুঝতে পারছি না। কোথায় তুই?
আকাশ: আমি বাসার খুব কাছাকাছি। মেধার সঙ্গে ফোনে হুট করে ঝগড়া লেগে গেছিল। রাগ করে বলছে সে আমাকে বিয়ে করবে না। আমি সত্যি টেনশনে পড়ে গেলাম যদি বিয়ে না করে! জানোই তো মেধা অবুঝ ধরনের। সো যত দ্রুত পেরেছি ওদের বাসায় চলে গেছি। বিয়ের মাত্র কিছুক্ষণ আগে স্বামী-স্ত্রীর দেখা করা ঠিক না তবুও গিয়েছি। গিয়ে দেখি যা ভেবেছিলাম পাগল মেয়ে সত্যি সত্যি তোমাদের ফোন করে বলেছে বিয়ে করবে না। বুঝো কেমন পাগল! একে নিয়ে থাকব কিভাবে সারাজীবন আমার এখনই টেনশন হচ্ছে। যাই হোক অবশেষে বৌয়ের মাথাটাথা ঠান্ডা করিয়ে আসলাম।
সাঈদ: সব-ই বুঝলাম বাবা কিন্তু আমাদেরকে তো একবার বলবি।
আকাশ: কিভাবে বলতাম? বললে তোমরা কেউ বুঝতা এই প্রবলেমটা? উল্টা বিয়ের আগে বর-বৌ দেখা করে না হেনতেন বলে আটকে দিতো। আর ঐদিকে মেধা রাগ করে সত্যি সত্যি বিয়ে না করত। তখন বুজতে মজা!
সাঈদ: যাওয়ার পরে ফোন তো করবি।
আকাশ: সকাল থেকে মেধার সঙ্গে অনেকক্ষণ কথা হয়েছে। চার্জ ছিল না ফোনে।
সাঈদ: যাক বাবা বিয়েটা হচ্ছে এটাই বড় কথা।
আকাশ: তো কি ভেবেছিলে? আমি সিনেমার নায়িকার মতো বিয়ের দিন পালিয়ে যাব কাগজে লিখে “এই বিয়ে করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। আমাকে তোমরা ক্ষমা করো। হা হা হা। আমি যখন বলেছি বিয়ে করব মানে আজকেই করব। আর সেটা অবশ্যই তোমাদের সবার সামনে করব। আমার বৌ সবার সামনে তার সম্মান নিয়ে এই বাড়ির চৌকাঠে পা রাখবে। বুঝতে পেরেছ কি বললাম,,, সো আব্বুকে এত টেনশন নিতে না করো। আমি আসছি।
অল্পক্ষণের মধ্য খানবাড়ির পরিস্থিতি স্বাভাবিক পর্যায়ে ফিরে আসল। উৎসব-অনুষ্ঠানের আয়োজন শুরু হলো আগের মতো। কিছুক্ষনের মধ্যে আকাশকে নিয়ে খানবাড়ি থেকে মেধাদের বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দিল সবাই।
—————————————————————————-
চোখ খুলতে নিয়েই তীব্র আলোর ঝলকানিতে চোখ বন্ধ করে ফেললাম। মাথাটা যন্ত্রনায় ছিঁড়ে যাচ্ছে। কেমন নেশা নেশা ভাব লাগছে সমস্ত শরীরে। মাথার ব্যথা কপাল থেকে চোখ পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়েছে। চোখ খুলে তাকাতে ভীষণ কষ্ট হলো তাও আস্তে আস্তে চোখ খুললাম। আর নিমেষেই আমার শরীরের সমস্ত দুর্বলতা ছাপিয়ে ভয় আর আশঙ্কা বাসা বাঁধতে লাগল। এটা কোন জায়গা? আমি কিভাবে এলাম?
কিচ্ছু চিন্তা করতে পারছি না। এখানে আসার আগে আমার সাথে কি হয়েছে তাও মনে নেই। মাথাটায় এত পরিমাণ যন্ত্রণা হচ্ছে যে কোনকিছু চিন্তা করার মতো চাট নেওয়ার ক্ষমতা আমার মস্তিষ্কের নেই। আমিও আর কিছু মনে করতে জোর করলাম না। ভাবতে ইচ্ছা করছে না কিছু। কেমন ঘোর ঘোর অবস্থায় চলে গিয়েছি। শুধু একটাই অনুভুতি কাজ করছে তীব্র যন্ত্রণা সাথে পিপাসা। প্রচুর পিপাসা লাগছে। খুব অস্ফুটস্বরে কয়েকবার উচ্চারণ করলাম,,, পানি পানি,,,
কথাটা বলামাত্র-ই কেউ একজন আমার মাথাটা ধীরে ধীরে উঠিয়ে বুকের ওপর রাখে। মুখের কাছে গ্লাসটা ধরে আস্তে আস্তে পানি খাইয়ে আবার শুইয়ে দেয়। চুলে বিলি কাটতে থাকে। আমি কোনকিছুই বুঝতে পারছি না শুধু বুঝতে পারছি ভীষণ চেনা এই ছোঁয়াটা। অল্পক্ষণের ছোঁয়াতেই চোখে রাজ্যের শান্তি নেমে এলো। শারিরীক যন্ত্রনাগুলো নিমেষে মিলিয়ে যেতে লাগল। আমি গভীর ঘুমে আবারও তলিয়ে গেলাম। এবং ঘুমিয়ে পড়ার মুহূর্তে টের পেলাম সে আমার মাথাটা বুকে টেনে নিয়ে কপালজুড়ে চুলজুড়ে অস্থিরভাবে ভালবাসার পরশ এঁকে যাচ্ছে। তৃষ্ণার্ত ক্লান্ত মানুষ পানি পাওয়ামাত্র যেভাবে পান করে ঠিক যেন তেমন,,, যেন কতবছর এমন তৃষ্ণা মেটায় নি। আজ সে তার সমস্ত জমানো তৃষ্ণা উসুল করেই ছাড়বে। তাকে বাধা দেবার শক্তি আমার নেই।
—————————————————————————-
: একি ,,,নতুন বৌয়ের মুখ ঢাকা কেন?
বিয়েবাড়িতে উপস্থিত বেশিরভাগ মানুষেরই এক-ই প্রশ্ন কারণ মেধার মুখ ঘোমটায় ঢাকা। গলা পর্যন্ত ঘোমটার কারণে মেধাকে দেখাই যাচ্ছে না।
শিল্পী: আরে মেধা,,মুখটা তোল্ মা। এরকম ঘোমটা দিয়ে বসে আছিস কেন? দাঁড়া,,,আমি সরিয়ে দেই ঘোমটা।
শিল্পী মেধার ঘোমটা তুলে দিতে গেলে মেধা হাতে ইশারা করে। মাথা নাড়িয়ে বোঝায় ঘোমটা না খুলতে।
মেধার এই আচরনের কোন অর্থ-ই তিনি খুঁজে পেলেন না। তবুও কিছু বললেন না মেধাকে। মেয়েকে ভীষণ ভয় করে তার। কখন কি কারণে মেজাজ বিগড়ে যাবে কে জানে! তারচেয়ে ভালো যা মন চায় করুক। বিয়েটা শান্তিমতো হয়ে যাক।
অন্যরাও মূলত মেধার রাগ ও জেদ বিষয়ে জানে বলেই মেধার মুখ দেখানো না নিয়ে কোন কথা বলার সাহস পেল না।
তবে অদ্ভুত একটা জিনিস লক্ষ্য করল সবাই যে বিয়ে পড়ানো শুরু হতেই মেধা কাঁপতে লাগল। যেন প্রচন্ড ভয় পাচ্ছে। ঘোমটার আড়াল থেকে মেধার ঘনঘন নিশ্বাসের আওয়াজ পাওয়া যেতে লাগল। অতিরিক্ত নার্ভাস অবস্থায় মানুষ যেরকমটা করে! কিন্তু এই বিষয়টাই আশ্চর্য লাগছে সবার। মেধার মতো মেয়ে বিয়ে বলে নার্ভাস ফিল করার প্রশ্ন-ই ওঠে না। আর এভাবে ভয়ে হাত-পা মেধার কখনো কাঁপে না। সবাই জানে মেধা ভয় পায় না, ভয় দেখায়। মেধাকে যখন কবুল বলতে বলা হলো কাঁপার পরিমাণ উত্তরোত্তর হারে বাড়তে শুরু করল তার।
“একি মেধা,,,কি হয়েছে তোর? ভয় পাচ্ছিস নাকি?”
“এইভাবে কাঁপছিস কেন? শরীর খারাপ লাগছে?”
আকাশ সবার দিকে একবার দৃষ্টি দিয়ে মেধার কোলে হাত রাখল। খুব শান্তকন্ঠে বলল, মেধা কবুল বলো। বলো। কিচ্ছু হবে না। আমি আছি তো।
আকাশ খুব নরম কন্ঠে কথাগুলো বললেও মেধা এমনভাবে কে়পে উঠলো যেন আকাশ হুমকি দিচ্ছে তাকে।
“ক-ক-বুল।”
বলেই প্রচন্ডরকম কাঁপতে কাঁপতে মেধা অজ্ঞান হয়ে গেল। আকাশ দ্রুত মেধাকে জড়িয়ে ধরল যাতে পড়ে না যায়। আর সঙ্গে সঙ্গেই মেধার মুখের ঘোমটা উন্মোচিত হয়ে গেল।
চলবে