তোমারই আছি আমি
পর্ব-২৬
Sara Mehjabin
তুরাগের হাতের দিকে তাকিয়ে চমকে উঠলাম। কনুই এর কাছে ভাঁজ করা হাতা থেকে কবজি পর্যন্ত লম্বা রক্তের রেখা। বোঝা যায় এটা অন্য কারো রক্ত। কারন রক্ত শুকিয়ে দাগ হয়ে গেছে।
আমি ভয়ার্ত দৃষ্টি নিয়ে ওর হাতের দিকে তাকিয়ে আছি। আমার দৃষ্টিভঙ্গি লক্ষ্য করে তুরাগ একটা জোর করা হাসি দিল, কি হলো,,খাও। প্লিজ। (খাবারের প্লেট আমার দিকে বাড়িয়ে)
আমি চিৎকার দিয়ে উঠলাম,,রক্ত,,,আপনার হাতে রক্ত কিসের?
“ওই তো হাঁটার সময় একটা ইটের মধ্যে পা আটকিয়ে পড়েছিলাম,,, ঐজন্য। হাতটা একটু কেটে গেছিল। বাইরে ছিলাম তাই ড্রেসিং নেওয়া হয় নি। শুকিয়ে গেছে।” তুরাগ কথাগুলো বলল কিন্তু অনেক থেমে থেমে। বোঝাই গেল সব মিথ্যা। সে মাথার ভেতর কথাগুলো তৈরি করে তারপর বলছে।
“মিথ্যা বলছেন। আপনি মিথ্যা বলছেন। আর সেইটা আপনার চোখেমুখে স্পষ্ট।”
“কেন,,,তোমার কি মনে হয়? কাউকে মার্ডার করে এসেছি? ? আচ্ছা আমি নাহয় মার্ডার করতেই পারি বাট মার্ডারের রক্ত হাতে নিয়ে ঘুরব? তুমি ভাবো আমি এতই বোকা?”
“যাই হোক আপনি এই মুহূর্তে এই বাসা থেকে চলে যান। আমি একটা মেয়ে একা বাসায়। এই মুহূর্তে আপনাকে এই বাসায় দেখা গেলে আপনার হয়তো কিছুই হবে না কিন্তু আমার অনেক সমস্যা হবে। সো প্লিজ গো। প্লিজ।”
“সারা তুমি কি আমাকে বিশ্বাস করছ না?”
“একদমই তাই। আমি আপনাকে বিশ্বাস করা দূরে থাক সন্দেহ করছি। আপনার চলাফেরা, কথা-বার্তা হুটহাট উদয় হওয়া সবকিছু খুবই রহস্যজনক লাগে আমার। আপনি কে? কেন বারবার আমার জীবনে ইন্টারফেয়ার করেন? কি উদ্দেশ্য আপনার?”
“হা হা উদ্দেশ্য অবশ্যই আছে। কিন্তু উদ্দেশ্যটা খারাপ না। আমার একমাত্র উদ্দেশ্য তোমাকে হেল্প করা। তুমি আমাকে বিশ্বাস করতে পারো। না, তুমি বাধ্য আমাকে বিশ্বাস করতে। কারণ এই মুহূর্তে আমার সাহায্য তোমার জন্য খুব দরকার। আমাকে বিশ্বাস না করলে যা তুমি হারাবে তার জন্য তার জন্য আফসোস করার মতোন অবস্থায়ো তুমি থাকবে না।”
তুরাগ স্থিরকন্ঠে কথা শেষ করে তার প্যান্টের পকেট থেকে আরেকটা ফোন বের করে। একটা ফোন অলরেডি ওর হাতে। কয়েকটা কল রেকর্ডস শোনায় আমাকে। কল রেকর্ডসগুলো শুনে আমি যেন নিঃশ্বাস নিতেই ভুলে গিয়েছি। এইগুলো কিভাবে সম্ভব!
তুরাগ: আজকে রাত যে তোমার জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ বুঝতেই পেরেছ। সঠিক সময়ে রেডি থেকো।
আমি: আপনি এতোকিছু কিজন্য করছেন?
তুরাগ হেসে বলল, তোমার জন্য।
বলেই আমার চুলগুলোতে আলতোভাবে হাত বুলিয়ে বেরিয়ে গেল।
ওরা সবাই সন্ধ্যার দিকে ফিরে আসল। স্টোররুমের আড়াল থেকে ওদের কথাগুলো শোনার চেষ্টা করছিলাম। আকাশভাইয়ার জন্য মনটা বড্ড ব্যাকুল হয়ে আছে।
ওরা সবাই চলে গেলে অদ্বিতী সুযোগমতো আসল আমার কাছে। আমার হাতটা ধরে ভরসা দেবার ভঙ্গিতে বলল, দাদার কিচ্ছু হবে না রে। আমার দাদা ভালো হয়ে যাবে দেখিস। একদম সুস্থ হয়ে যাবে। সাতদিন পর ব্যান্ডেজ খুলবে মাথার। অবশ্য মাথায় অনেক ব্যথা। পেইনকিলার ছাড়া খুব কষ্ট পাচ্ছিল। চিন্তা করিস না। দাদা অনেক স্ট্রং। ঠিক হয়ে যাবে। খেয়েছিস কিছু??চেহারা দেখে তো মনে হয় না খেয়েছিস।
বলেই অদ্বিতী রান্নাঘরের দিকে চলে গেল। একটা প্লেটে করে ভাত মাখিয়ে আমার মুখের সামনে ধরল,,আমি বারবার না খাওয়ার চেষ্টা করলাম। কিন্তু অদ্বিতী নাছোড়বান্দা। আমাকে সম্পূর্ণ প্লেট না খাইয়ে ছাড়ল না। খাওয়া শেষে পানি খাইয়ে আমাকে বিছানায় শুইয়ে দিল। বালিশসহ আমার মাথাটা কোলের ওপর রেখে ধীরে ধীরে চুলে হাত বুলিয়ে দিতে লাগল। মেয়েটা সত্যিই খুব ভালো! ওর ভাইয়ের প্রতি শ্রদ্ধা-ভালবাসার কোন তুলনা হয় না। ওর মতো বোন পাওয়া ভাগ্যের বিষয়।
আস্তে আস্তে আমার চোখজোড়া ঘুমে বন্ধ হয়ে গেল।
—————————————————————————–
রাত তিনটা। হাসপাতালের নির্জন করিডোর ধরে হেঁটে যাচ্ছে একটি মেয়ে। সমস্ত শরীর চাদরে মোড়ানো যার দরুন চেহারা দেখা যাচ্ছে না। সে হাঁটছে খুব ধীরে, সন্তর্পণে। চোখে সতর্কতার দৃষ্টি। বারবার সে তার চারপাশে দেখে দেখে এগোচ্ছে।
সিঁড়ির কাছে এসে কিছুক্ষণ থমকে রইল মেয়েটি। তারপর ধীরে ধীরে সিঁড়ির ধাপগুলো পেড়িয়ে উঠে গেল। দোতলার ১৬ নম্বর কেবিনের দরজা হালকাভাবে খুলে ভেতরে প্রবেশ করল।
এটাই আকাশের কেবিন। মাথায় ব্যান্ডেজ, সারা শরীরে চাদর জড়িয়ে নিশ্চিন্তে ঘুমাচ্ছে। ধীর নিঃশ্বাসের সঙ্গে ওঠানামা করছে বুক।
মেয়েটি চাদরের নিচের থেকে ধারালো ছুরিটা বের করে। জানালা গলানো চাদেঁর আলোয় চকচক করছে। সেই চকচকে ছুরির দিকে তাকিয়ে চকচক করে ওঠে মেয়েটির মুখ। চোখদুটোয় এসে বিরাজ করে রাজ্যের হিংস্রতা। শক্ত হাতে ছুরিটা উচু করে তুলে আকাশের বুক বরাবর গাঁথতে নেয় সেই মুহুর্তেই কেবিনের লাইট আচমকা জ্বলে উঠল।
“অ্যারেস্ট হার অফিসার” পেছনে তুরাগের কন্ঠ। পাশেই সারা।
মহিলা পুলিশেরা অদ্বিতীকে ঘিরে ধরে অতি দ্রুত। অদ্বিতীর হাতের থেকে ঠাস করে ছুরিটা পড়ে যায়। ভয়ার্ত দৃষ্টিতে তাকায় চারদিকে।।
তুরাগকে দেখে চিৎকার করে ওঠে, তুমি??
তুরাগ: হ্যা আমি। তোর সঙ্গে ছিলাম তোর সব অপকীর্তির রহস্যভেদ করার জন্য। ধীরে ধীরে তোর বিরুদ্ধে সব প্রমাণ জোগাড় করেছি। এবার আমার কাজ শেষ। অফিসার, ওকে অ্যারেস্ট করুন। এই মেয়েটা দীর্ঘদিন আকাশকে খুনের প্ল্যান করেছে। লোক দিয়ে আকাশকে অ্যাটাক করিয়ে ওনার মাথায় আঘাত করিয়েছে। এখন এসেছিল ওনাকে খুন করতে। শুধু তাই নয় মেয়েটি ড্রাগ ডিলিং এর সঙ্গে যুক্ত। ওর বয়ফ্রেন্ড এই হসপিটালের বার্ন ইউনিটে ভর্তি। আর বয়ফ্রেন্ডের চিকিৎসার টাকার জন্য ও দীর্ঘদিন ড্রাগসের ব্যবসা করছে।
“আমি কিচ্ছু করি নি। আমি কিছু জানি না। আমাকে ছেড়ে দিন। ও সারা আমার খুব ভয় করছে। আমাকে ছেড়ে দিতে বল্।” অদ্বিতী কেঁদে আর্তনাদ করে ওঠে।
অদ্বিতীকে দ্রুত সেখান থেকে থানায় নিয়ে যাওয়া হলো। ইতিমধ্যে হাসপাতালে ভীড় সৃষ্টি হয়েছে। সবাই জেনে গিয়েছে হসপিটালে ক্রাইম করার চেষ্টা চলছিল। আকাশদের বাড়িতেও খবর পৌঁছে গেছে।
সমস্ত পরিস্থিতি মিলিয়ে প্রচন্ড ভয় পেয়ে আছে সারা। ইশ্,,আরেকটু যদি দেরি হতো! তাহলে হয়তো ওর আকাশভাইয়াকে চিরদিনের জন্য-ই হারিয়ে ফেলত। সারা আকাশের মাথার কাছে বসে কপালে অসংখ্য চুমু দিল। হাতটা টেনে বুকের কাছে ধরে রাখল কিছুক্ষণ। তারপরে হাতেও চুমু খায়। ” আমার কি হতো আকশভাইয়া যদি তোমাকে হারিয়ে ফেলতাম। আমি আর যাব না তোমাকে রেখে। তুমি বকা দিলেও যাব না। সবসময় তোমার কাছে থেকে আগলে রাখব তোমায়। যেমন তুমি ছোটবেলায় আমাকে আগলে রেখেছ,,কখনো কোনো অভাব-ই বুঝতে দাও নি।”
আকাশের গালের পাশে চুমু খায়।
—————————————————————————–
অদ্বিতীকে থানায় নেওয়া হয়েছে। কিছুক্ষনের মধ্যে বাড়ির সকলেই হাজির হলো সেই জায়গায়। ইতিমধ্যে খবরটি হসপিটালের-ই কোন লোক দ্বারা মিডিয়াতে ভাইরাল হয়ে গেছে। লাইভ টেলিকাস্ট হচ্ছে। রাত জেগে ফেসবুক স্ক্রল করা সায়ানের অভ্যাস। হুট করেই খবরট নজরে পড়ল। আর একটি মুহূর্ত-ও দেরি না করে বাবা-মা’কে নিয়ে চলে আসে থানায়।
বাড়ির লোকজন জেনে যাওয়া, মিডিয়াতে ভাইরাল হওয়া, সবার সামনে ড্রাগ ডিলার প্লাস খুনী প্রমাণিত হওয়া সবকিছু মিলিয়ে ভয়ে-উত্তেজনায় অদ্বিতী অজ্ঞান হয়ে গেল।
: অদ্বিতীকে ছেড়ে দিন অফিসার। আসল অপরাধীকে ধরুন।
থানায় প্রবেশকারীকে দেখে চমকে ওঠে উপস্থিত সবাই। আকাশ। মাথায় কোন ব্যান্ডেজ নেই, শরীরেও আঘাতের কোনো চিহ্ন দেখা যাচ্ছে না। ওকে দেখে আবাকের চরম পর্যায়ে পৌঁছে গেছে প্রত্যেকে।
তুরাগ: তু-তু-মি ন-ন-না অ-সু-স্থ।
আকাশ মৃদু হাসল, না। তোর মতো দুয়েকটা কীটের আঘাত আমাকে অসুস্থ বানানোর ক্ষমতা রাখে না,,,নিবিড়।
চলবে