# তোমার_নেশায় !
,
,
(২৪)
,
,
কঠিন হৃদয়ের মেয়ে তৃষ্ণা!
.
.
.
.
দিন পেরোয়, মাস পেরোয় দেখতে দেখতে যেন চার বছর পেরিয়ে গেল। সময় যে থেমে থাকেনা চলতে থাকে তার আপন গতিতে। সময়ের সাথে অনেক কিছুই বদলে যায় তেমনি অনেকখানি বদলে গেছে রুপশার জিবন। রুপশা রুপাঞ্জনের দেওয়া আঘাত পুরোপুরি সামলাতে না পারলেও বেশ খানিক টা উন্নত হয়েছে। যথেষ্ট টাকা থাকা সত্তেও রুপশা শুধুমাত্র বাচ্ছাদের সাথে সময় কাটানোর জন্য একটা কিন্ডারগার্ডেন এ জব নেয়। সারাদিন কাটে ওখানকার দুষ্টোমিষ্টি বাচ্ছাদের সাথে, আর সন্ধ্যা রাত কাটে তার নিজের পাজি ছেলে রুপকের সাথে! রুপকের এখন ৪ বছর চলছে সে ও তার মায়ের কিন্ডারগার্ডেনে পড়ে। কিন্তু দুষ্টমির দিক থেকে সবাইর সেরা। রুপশার সারাদিন কাটে ওর পিছনে খাবার নিয়ে দৌড়াতে দৌড়াতে। আহসান সাহেব সব দেখেন আর হাসেন। যাক অবশেষে মেয়েটা তার অতিত থেকে বেরিয়ে এসেছে। অন্যদিকে রুপাঞ্জন খান আর রুপাঞ্জন খান নেই, এখন সে পরিপুর্ন ফরেজগার রুপাঞ্জন। যে রুপাঞ্জন এর নেশা ছিল মেয়ে মানুষ আর টাকা সেই রুপাঞ্জন এখন অতিরিক্ত হিসেব মেনে চলে বিজনেস চালায়। এক টাকা ও সুদ গ্রহন বা দান করতে দেওয়া হয়না তার অফিসে। প্রয়োজন ছাড়া কোনো মেয়ের সাথে কথা বলা তো দুর চোখ তুলে তাকায় না পর্যন্ত। নামাজের সময় হলে যতই কাজ থাকুক না কেন আগে নামাজ আদায় করা শ্রেয় মনে করে রুপাঞ্জন। প্রত্যেক মুনাজাতে এটাই দোয়া করে, যেন আল্লাহ তার প্রিয়তমা স্ত্রীর সাথে খুব শিঘ্রিই তার দেখা করিয়ে দেন। যারা সর্বক্ষন রুপাঞ্জনের মৃতু্্য কামনা করতো তারা এখন রুপাঞ্জন কে ছাড়া কিছুই বুঝেনা।
কোনো স্টাফের সাথে রুপাঞ্জন উচ্চস্বর এ কথা বলেনা।
সিলেট……….
,
রুপশা খিচুড়ির প্লেট নিয়ে রুপকের পিছনে দৌড়াচ্ছে। কিন্তু রুপক একবার এদিকে লুকাচ্ছে তো একবার ওদিকে লুকাচ্ছে।
,
:– রুপক সোনা, খেয়ে নেয় না বাবু! মাম্মাম আর দৌড়াতে পারছিনা তো।
,
:– মাম্মাম আমি খাবোনা তো।
,
;– ওই দেখ বিড়াল টা কেমন আড়ি পেতে আছে তোর খাবার গুলা খেয়ে নিতে কিন্তু আমি তাকে বলে দিয়েছি এই খাবার শুধু রুপক সোনার।
,
:– মাম্মাম আমি খাবো তবে একটা কান্ডিশান আছে আমার।
,
:– উফফ সব কিছুতে তোর কান্ডিশান। আচ্ছা বল কি কান্ডিশান??
,
:– আমি বিকালে বান্টিদের সাথে খেলতে যাব। আর তুমি বকা দিতে পারবানা কিন্তু।
,
:– এই ছেলেকে নিয়ে আর পারিনা সারাক্ষন দুষ্টমি। পড়াশুনার দিকে একদম মন নেই।
,
:– আচ্ছা তাহলে আমি খাচ্ছিনা।
,
:– না না আচ্ছা ঠিক আছে। নে এবার হা কর।
,
:– ইয়ে কি মজা। থ্যেংক্স মাম্মাম।
,
:– ইউর মোস্ট ওয়েলকাম সোনা।
,
এই বলে ছেলের কপালে চুমু খায় রুপশা। তারপর ওকে কোলে বসিয়ে আদর করে খাওয়াতে থাকে। ছেলেটা কে যতবার দেখে ততবার না চাইতে ও লোকটার কথা মনে পড়ে যায়। রুপকের ফেইস এতো অদ্ভুত ভাবে কি করে মিলে ওনার সাথে। আজ যদি সব ঠিক থাকতো তাহলে হয়ত আমার রুপক ওর বাবাইয়ের ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত হতোনা। উনি তো জানেন ও না যে আমাদের একটা বাবু আছে। উনি যদি কখন ও জানতে পারেন তাহলে কেমন রিয়েক্ট করবেন, যদি রুপককে অধিকার খাটিয়ে নিয়ে যেতে চান। তখন কি হবে? আমি যে বাচবোনা আমার রুপক সোনা কে ছাড়া। না ও শুধু আমার ছেলে আর কার ও না। রুপকের কথায় রুপশার ঘোর কাটে,
,
:– মাম্মাম তোমার নাম কি??
,
:– হঠাৎ এই প্রশ্ন কেন বাবু?
,
:– বলোনা মাম্মাম।
,
:– রুপশা চৌধুরী।
,
:–তাহলে তুমি আমার রেজাল্ট কার্ডে রুপশা খান লিখে সাইন করলে কেন?
,
রুপশা যেন আকাশ থেকে পড়ে এই কথা শুনে।
,
:– মানে, আমি সত্যি এটা লিখেছি??
,
:– হুম তুমি এটাই লিখেছো। জানো টিচার আমায় এত্তোগুলা বকা দিয়েছে।
,
রুপশার কানে রুপকের কোনো কথা ডুকছেনা। সে অবাক হয়ে ভাবছে এতো বছর হয়ে গেল এখন ও কিভাবে ওই অভ্যাস টা থেকে যেতে পারে। আসলে রেজাল্ট কার্ডে সাইন করার সময় ওর রুপাঞ্জনের কথা মনে পড়েছিল। আজ যদি রুপাঞ্জন থাকতো তাহলে হয়ত রেজাল্ট কার্ডে ও সাইন করতো। তাই হয়ত অন্যমনস্ক হয়ে ও এটা লিখে ফেলেছে। রুপক আবার তার মাম্মাম কে ঝাকায়,
,
:– মাম্মাম শুনোনা তোমার নাম কি রুপশা খান ছিল??
আমার নাম টা অনেক ভালো লাগেছে।
,
রুপশা অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে ছেলের দিকে। কিন্তু রুপক কোনো উত্তর না পেয়ে বার বার একি প্রশ্ন করে যাচ্ছে। তখন দরজার পাশ আহসান সাহেব যাচ্ছিলেন। তিনিও রুপকের মুখে এমন প্রশ্ন শুনে অবাক হোন। না রুপশার অতিত কে আর সামনে আসতে দেওয়া যাবেনা। মেয়েটা অনেক কষ্টে ডিপ্রেশন কাটাতে পেরেছে। উনি তাড়াতাড়ি রুমে ডুকে রুপক কে কোলে তুলে নেন,
,
:– নানু ভাই চলো আমরা ঘোড়া খেলবো।
,
:– কি মজা, চলো চলো।
,
,
আহসান সাহেব রুপক কে নিয়ে বেরিয়ে যান। কিন্তু রুপশা একি ভাবে পাথর হয়ে বসে থাকে। বুক টা লাফাতে থাকে তার। সে জানতো এমন একটা প্রশ্নের সম্মুখীন তাকে একদিন হতেই হবে। সমাজ কে তো সে অনায়শেই বলে বেড়িয়েছে, যে রুপকের বাবাই মারা গেছে।
কিন্তু রুপক যখন বড় হয়ে জিজ্ঞাস করবে তার বাবাই কোথায়?
তখন আমি কি জবাব দেব ওকে? ছেলের চোখের দিকে তাকিয়ে কি করে এতো বড় মিথ্যা বলবো। আবার সত্যি টা জানানোর শক্তি নেই আমার মাঝে। কি করে বলবো আমি, যে ওর বাবাই শুধুমাত্র রিভেঞ্জ নিতে বিয়ে করেছিল আমায়। ওর জন্ম হওয়াটাও শুধুমাত্র একটা কয়েনসিডেন্স ছিল। ছেলেটা তো ভেঙে যাবে এটা শুনে। রুপশা ঘামতে থাকে। অতিতের কালো ছায়া হাজার চেষ্টা করলেও মানুষের পিছু ছাড়েনা।
রুপাঞ্জনের অফিস,,,,,
,
রুপাঞ্জন জোহরের নামাজ আদায় করে এসে নিজের কেবিনে বসে আছে। তখনিই ম্যেনেজার এসে বলল,
,
:– may I come in Sir???
,
:– ম্যনেজার আপনাকে কতবার বলেছি সবাইর আগে সালাম দিতে হয়। এটা সুন্নত।
,
:– সরি স্যার, আসসালাম ওয়ালাইকুম।
,
:– ওয়ালাইকুম আসসালাম ওয়া রাহমাতুল্লাহে ওয়া বারাকাতু। বলেন কি খবর?
,
:– স্যার, আজকে মিনহাজ গ্রুপ কম্পানির সাথে একটা মিটিং ছিল বলেছিলাম না।
,
:– হুম মিটিং কোথায় হবে?
,
:– সিলেটের, যাফলং। এই জায়গা টা ঠিক করা হয়েছে। বিকালের ফ্লাইট স্যার। রেডি থাকবেন।
,
:– হুম ওকে। এবার আপনি আসুন।
,
সিলেটের নাম শুনতেই নিজের অজান্তে রুপাঞ্জনের বুক কেপে উঠল। কেমন অস্থিরতা অনুভব করতে লাগল। হঠাৎ মনে পড়ে গেল চার বছর আগের সেই শিশুটির কথা যাকে সে রক্ত দিয়েছিল। আজ ও ছেলেটির মুখ ভুলতে পারেনি রুপাঞ্জন। কেন এতো মায়া ছেলেটির মুখে। এখন তো অনেক বছর কেটে গেছে বাবূটা বেশখানিক টা বড় হয়ে গেছে হয়ত। না বেশখানিক না একটু খানিক। এখন তো ভাগ্যচক্রে আবার সিলেট যাওয়া হচ্ছে। আবার যদি বাচ্ছাটার সাথে দেখা হতো। কি মিষ্টি দেখতে বাচ্ছাটা। অবশ্যই ওকে দেখলেও চিনব না আমি। আজ যদি আমার রুপশা থাকতো আমার সাথে। তাহলে হয়ত আমার ও এমনন একটা ফুটফুটে বাচ্ছা থাকতো। কিন্ত আমি জানি একদিন আমার তোমার সাথে দেখা হবেই রুপশা। আমার ভালোবাসার নেশা ঠিক তোমায় আমার কাছে টেনে আনবে। আমি যে আজ ও ডুবে আছি তোমার নেশায়!!
বিকাল এর আকাশ নীল হয়ে আঁছে। আকাশে উড়ে বেড়াচ্ছে কয়েকটা নাম না জানা পাখি। রুপশা দের বাগান বাড়ির ভিতরে ফুটবল খেলছে একদল শিশু। এদের মধ্যে পাজি রুপক ও আছে। আর ওর ছোট বন্ধুরা বান্টি, শিফু, জনি, টিনা।
হঠাৎ বান্টি ফুটবল টা জোরে কিক করে। আর বল টা উড়ে ওয়াল টপকে বাইরে চলে যায়। নিমিষেই বাচ্ছাদের মুখে হাসি উড়ে যায়।
:– এবার কি হবে?(শিফু)
,
:– বান্টি তুমি এতো জোরে কিক করলে কেন?(জনি)
,
:– আমি বুঝতে পারিনি বল টা বাইরে চলে যাবে।
,
:– এখন কে আনবে বল টা। বান্টি তুমি যাও। (টিনা)
,
:– না আমার খুব ভয়ে করে। মাম্মি বকা দিবে বাইরে গেলে।
,
:– ঠিক আছে তবে আমি যাবো!!!!!!!(রুপক)
,
:– তোর ভয় করবেনা রুপক?? গার্ড আংকেল তো বের হতে দিবেনা আমাদের।
,
:– চলো সবাই গিয়ে দেখি।(রুপক)
,
,
রুপক আর বাকি বাচ্ছারা গিয়ে দেখে গার্ড আংকেল তার কেবিনে ডুকে ফোনে কথা বলছে।
,
:– এটাই সুযোগ। আমি যাই তোমরা কিন্তু গার্ড আংকেল কে দেখে রেখো।
,
:– ওকে রুপক(সবাই)
,
,
রুপক পা টিপে টিপে ধীরে ধীরে এগিয়ে যায়। গেইট থেকে বের হয়ে দেখে বল টা ঠিক রোডের মাঝ বরাবর পড়ে আছে। রুপক দৌড় দিয়ে বল টা কে ধরতে যায়। তখনই একটা গাড়ি এসে সঝোরে ব্রেক কষে ওর সামনে। আরেকটু হলে সাংঘাতিক এক্সিডেন্ট হতো। তবুও রুপক ভয়ে পেয়ে পড়ে যায় আর পায়ে ব্যথা পায়। গাড়ির ড্রাইবার খুব ভয়ে পেয়ে যায়। গাড়ির পিছনের দরজা খুলে একজন বেরিয়ে এসে তাড়াতাড়ি রুপক কে কোলে তুলে নেয়। হ্যা, সে আর কেউ না সয়ং রুপকের বাবাই রুপাঞ্জন খান। রুপাঞ্জন তাকিয়ে দেখে বাচ্ছাটা ভয়ে সেন্সলেস হয়ে পড়েছে। তাই তাড়াতাড়ি গাড়িতে উঠে বসে ড্রাইবার কে হস্পিটাল নিয়ে যেতে বলে। বাচ্ছাটা কে কোলে নেওয়ার পর থেকে রুপাঞ্জনের কেমন যেন অস্থির লাগছে। আবার ওর মায়া ভরা মুখের দিকে তাকিয়ে ভালো লাগায় ভরে যাচ্ছে মন। হস্পিটাল পৌছাতেই রুপাঞ্জন রুপক কে কোলে নিয়ে দৌড়ে ভিতরে যায়। ডাক্তার দের ডাকতে শুরু করে। ডাক্তার রা রুপককে নিয়ে যায়। রুপাঞ্জনের তখনই খেয়াল হয় ও সেই চার বছর আগেকার একি হস্পিটাল এ চলে এসেছে। যেখানে ও প্রথম একটা বাবু কে কোলে নিয়েছিল। তখন ডাক্তার এসে জানালেন রুপকের সেন্স ফিরেছে।রুপাঞ্জন রুমের ভিতর গিয়ে দেখে বাবু টা শুয়ে আছে। পায়ে হাল্কা ব্যান্ডেজ করা হয়েছে। রুপাঞ্জন রুপকের মাথায় হাত দিয়ে বলে,
,
:– নাম কি তোমার বাবু?
,
:– রুপক চৌধুরী।
,
:– বাহ খুব সুন্দর নাম।
,
:– আংকেল আপনার নাম কি??
,
:– আমার গাড়ির সাথেই তোমার এক্সিডেন্ট হয়েছিল।
,
:– ওহহ, আপনার লাগেনি তো আংকেল??
,
:– আমার লাগবে কিভাবে আমি তো গাড়ির ভিতরে ছিলাম আর তুমি ভাইরে তাইতো তোমার লেগেছে। আচ্ছা তুমি রাস্তায় দৌড়াচ্ছিলে কেন?
,
:– বান্টি বল টা কে খুব জোরে কিক করে তারপর আমি বল টা আনতে বের হই তারপর…..
,
:– আচ্ছা বুঝছি। আর কখন ও এমন বের হবানা ঠিক আছে।
,
অন্যদিকে রুপশা কিচেনে রুপকের জন্য কেক বানাচ্ছিল। তখনই বান্টি হাপাতে হাপাতে এসে বলে,
,
:– ভালো আন্টি ভালো আন্টি, রুপক……..
,
:– কি হয়েছে রে বান্টি???
,
:– আন্টি রুপককে একটা সাদা গাড়ি এসে দাক্কা দেয়। রুপক পড়ে যায় তখন একটা আংকেল ওকে গাড়িতে করে নিয়ে চলে যায়।
,
রুপশার পায়ের তলা থেকে যেন মাটি সরে যায়। মুহুরতেই বুক টা ফাকা হয়ে যায়। সে আর কিছুই ভাবতে পারছেনা তার রুপক সোনা…..
রুপশা মাটিতে বসে কান্না শুরু করে দেয়। কোন লোক রুপক কে কোথায় নিয়ে গেছে। রুপক এখন কেমন আছে। এইসব ভাবতেই যেন কলিজা শুকিয়ে যাচ্ছে। তখনই তার ফোনে একটা কল আসে,
কাপা হাতে রিছিভ করতেই ওপাশ থেকে,
,
:– হ্যলো আমরা সিটি হস্পিটাল থেকে বলছি। আপনি কি রুপকের মা??
,
:- জি আমার ছেলে কোথায়? ওর কি হয়েছে?
,
:–ওর একটা ছোট এক্সিডেন্ট হয়েছে। আপনি তাড়াতারি চলে আসুন।
,
রুপশা হতদন্তের মতো ছুটতে থাকে হস্পিটালের দিকে সেখানে যে নতুন কিছু অপেক্ষা করে আছে তার জন্য! রুপাঞ্জনের এতোদিনের অপেক্ষা এবার হয়ত ফুরাবে।
,
,
,
আজ এইটুকু কেমন লাগল জানবেন। আর কালকের জন্য খুব খুব সরি!!
,
# ধন্যবাদ