তোমার প্রণয় নগরে
উর্মি প্রেমা (সাজিয়ানা মুনীর)
পর্ব- ৫
(কার্টেসী ছাড়া কপি নিষেধ )
আজ রিদ্ধির হলুদ। ভোর থেকে বাড়িতে তোড়জোড় শুরু ।রিদ্ধি সায়রার নানা বাড়ির লোকজন আরো তিনদিন আগে চলে এসেছে। দুই ভাইয়ের একমাত্র বোন রিদ্ধি। রিদ্ধির নিজের কোন বোন নেই।সেই কমতিটাও সায়রাই পূরণ করছে। সবকিছু একা হাতে সামলাতে হচ্ছে সায়রার।ডালা থেকে কুলা ,ছেলেদের বাড়িতে পাঠানো তত্ত্ব সাজসজ্জা থেকে শুরু করে স্টেজে কনের সামনে রাখা খাবার গুলো তাকে সাজাতে হচ্ছে।তার উপর বোনেদের আবদার তো আছেই! কোন শাড়ির সাথে কোন কানের দুল পরবে? চুল কি খোলা রাখবে নাকি খোপা বাঁধবে? লাল সাদা শাড়ির সাথে কোন ফুল মানাবে! হাজারো আবদার।কাজের ফাঁকেফাঁকে সায়রা এদিকটাও দেখছে।রিদ্ধিদের বাড়ি শহুরে পরিবেশ থেকে খানিক দূরে।এখানকার পরিবেশ অনেকটা উপশহরের ন্যায়! যাকে বলে গ্রাম শহরের মাঝামাঝি! বাড়ীর সামনে বিরাট পুকুরপাড় ,পুকুরপাড়ের পাশে খোলা বিস্তৃত বিশাল মাঠ।সেখানে রিদ্ধির বিয়ের অনুষ্ঠানের যত আয়োজন । বিশাল আয়োজন! বিশাল আয়োজন হবে নাই বা কেন? চেয়ারম্যানের একমাত্র কন্যার বিয়ে বলে কথা! সাড়া গ্রাম জুড়ে হৈ হৈ রৈরৈ আমেজ ।
এসব তত্ত্ব সাজসজ্জা দেখে বাড়ির সবাই সায়রার প্রশংসায় পঞ্চমুখ! ছোট মামীর সায়রাকে বড্ড মনে ধরেছে।এক সময় তো আফসোসের স্বরে বলেই ফেলল,”ইশ মোস্তাফিজ যদি সায়রার ছোট না হয়ে বড় হতো ,সায়রাকে মোস্তাফিজের বউ করে আনতাম! আফসোস! ”
মামি এহেন আফসোসে সারা ঘর জুড়ে হাসির রোল পড়ল।সবাই সায়রার এতো এতো প্রশংসা করছে, অথচ তার নিজের মা, সিন্থিয়া বেগম ফোনে প্রশংসা বাক্যে শুধু এতোটুকু বললেন,”যতটা অকর্মা তোকে ভেবেছি ততটা অকর্মাও তুই না ”
তা শুনে অভিমানে ঠোঁট ফুলালো সায়রা ,মা তার প্রশংসা করলো নাকি খোঁচা মারল?
.
হলুদ ছোঁয়া পর্ব শেষ হয়েছে সেই অনেকক্ষণ।এখন নাচ গান চলবে।ডি.জে এসেছে সারারাত গান বাজবে।ঐদিকে সায়ন সহ তার কিছু বন্ধুরা আসছে।সায়নের বন্ধুদের জন্য রিদ্ধির বড় ভাই রেদোয়ান, আলাদা স্পেশাল খাবারদাবারের আয়োজন করেছে। অধীর আগ্রহ নিয়ে সায়নের অপেক্ষা করছে রিদ্ধি।হাতে সায়নের নামে মেহেদি লাগিয়েছে ,তার পছন্দমত হলুদ কনে সেজেছে।তাকে দেখাতে হবে না? রিদ্ধিকে দেখে কি বলবে সায়ন? তা ভেবে লজ্জায় লাল নীল হচ্ছে রিদ্ধি। সায়রাও কম নয় ,সুযোগের ঠিক ব্যবহার করছে।এটা ওটা বলে আরো লজ্জায় ফেলছে রিদ্ধিকে !
খানিক বাদে পাখির দলবল “বর এসেছে ,বর এসেছে ” হৈ চৈ করে ঘরে ঢুকল।সায়রা আরমিন যেন এই অপেক্ষাতে- ই ছিল ,তারাও তাদের দলবল নিয়ে হুড়হুড় করে নিচে নামল!
.
আরসাল বিরক্তি ভারী মুখ করে দাঁড়িয়ে।সায়নের মুখে ইয়া বড় , বিশ্বজয়ের হাসি।সায়নের এই হাসি দেখে আরসালের আরো বেশি মেজাজ খারাপ হচ্ছে! রাত পোহালে কাল সকালে এদের বিয়ে,আদিখ্যেতা দেখিয়ে এই নিশিরাতে এখানে আসতে হবে কেন? বউ বিয়ে করে তার বাড়িই যাবে , অন্য কোথাও তো নয়! এক রাতের জন্য কি সহ্য হচ্ছেনা ? এই নিশিরাতে এখানে আসতে হবে কেন? যত সব আদিখ্যেতা! আসার পক্ষে একদম মত ছিল না আরসালের,সায়নের পীড়াপীড়িতে আসতে হয়েছে।সায়ন আরসালের কাঁধে হাত রেখে আহ্লাদী স্বরে বলে উঠে,
–“রাগ করছিস কেনো দোস্ত! দু,এক ঘন্টার ব্যাপার- ই তো! ”
আরসাল উত্তর দিলো না।ক্ষিপ্ত নয়নে সায়নের দিকে তাকাল।এমন সময় হৈচৈ আওয়াজ কানে বাজল। চোখ ফিরিয়ে সামনে তাকাতে। একদল মেয়ে দেখতে পেলো ,অকস্মাৎ,আরসালের দৃষ্টি আটকাল কারো উপর।কপালে ভেসে থাকা বিরক্তির ছাপ গুলো মুহূর্তে- মিলিয়ে গেল।গা জুড়ে এক স্নিগ্ধ হাওয়া বয়ে গেল।বুকটা ঠকঠক কাঁপছে।সামনে শুভ্রতায় মোড়ানো শুভ্রপরী দাঁড়িয়ে! তার সারা অঙ্গ যেন বসন্তে নয়া ফুলের মত দুলছে।লতানো খোলা চুল গুলা হাওয়ায় হেলে দুলে উড়ছে ।রক্ত রাঙা লাল ঠোঁট জোড়ায় প্রমত্ত হাসি।পড়নে লাল সাদা লেহেঙ্গা! যেন কোন ঘন বর্ষনে স্নিগ্ধ গোলাপ! সাদা স্কার্ট টা দু হাতে উঁচু করে তার দিকেই যেন পা বাড়িয়েছে ।কয়েক সেকেন্ডের জন্য আরসাল থেমে গেল।পুরোপুরি নিস্তেজ নিমিষ দাঁড়িয়ে রইল।আশেপাশের চারিদিক যেন থমকে গেছে।শুধু সামনে থাকা স্নিগ্ধ গোলাপটা তার দিকে বেড়ে আসছে।তিরতির করে আরসালের বুক কাঁপছে ,বুকের কোথাও তীব্র এক যন্ত্রণা! অপ্রকাশিত অজানা!
দলবল নিয়ে সায়নের দিকে আসছে সায়রা। আরসালকে নিজের দিকে গভীর নয়নে অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে দেখে,ভয় পেয়ে যায় ।মনে পড়ে যায় আরসালের বলা সেই দিনের কথা “তোর সাথে কথা বলা তো দূর ,তোর চেহারাও দেখতে চাইনা! ”
সায়রা তাড়াতাড়ি ওড়নার কোণ টেনে দ্রুত হাতে মুখ ঢেকে ফেলল।বিষয়টা আরসালের চোখে বাঁধল ,বিরক্তি সহিত আবারো কপাল কুঁচকে নিলো ।যেন ব্যাপারটা তার বিন্দুমাত্র পছন্দ হয় নি।
সায়নের পথ আটকে ধরেছে সায়রা আরমিন।সাথে দলবল তো আছে- ই।তাদের আবদার একটাই,
–“আগে আমাদের লেনদেন মিটাও , তারপর বউয়ের সাথে দেখা করতে দিবো ”
সায়রার এহেন কথায় সায়ন ঠোঁট উল্টে বলে,
–“আজ কিসের লেনদেন! বিয়ে তো কাল ,কাল সব লেনদেন মিটিয়ে দেব । একবার বউটার সাথে দেখা করতে দে! ”
সায়রা নাকচ করল।সায়ন ইমোশনাল ব্লাকমেইল শুরু করল ,
–“তুই না আমার বোন সায়রা? ভাইয়ের সাথেও এমনটা করতে পারবি ? ”
সায়রার সোজাসাপ্টা জবাব ,
–“পারবো কি? অলরেডি করছি! এই দুই দিন তুমি আমার ভাই না ,দুলাভাই! আর আমি তোমার আদরের শালিকা ।আমাদের একটা শালিকাগত অধিকার আছে না?
আগে আমাদের পাওনা মিটাও, তবেই বউয়ের সাথে দেখা করতে দিবো! ”
সায়নের কোন কথায় সায়রারা শুনল না।নিজেদের পাওনা নিয়েই রাস্তা ছাড়ল।চকচকে হাজার টাকার বান্ডিল ধরিয়ে দিয়েছে সায়ন ।তা দেখে কনে বাড়ির সবার হৈ চৈ শুরু! ভেতরে ঢুকার সময় তুর্জয় থামল।তা দেখে আরায়ালও ভ্রু কুঁচকে দাঁড়িয়ে রইল।তুর্জয় সায়রার মুখোমুখি হয়ে হাস্যউজ্জ্বল মুখ তুলে বলল,
–“তোমাকে ভীষণ সুন্দর লাগছে সায়রা,স্বপ্নে দেখা শুভ্রপরীদের মত! ”
সায়রার ভ্রুদ্বয় কুঁচকে এলো ,তুর্জয়ের দৃষ্টি অনুসরণ করে পেছনে ফিরল। দেখল, তুর্জয়ের দৃষ্টি সায়রার দিকে না! তার পিছনে দাঁড়িয়ে থাকা লাজুকলতা আরমিনের দিকে। আরমিনও লজ্জায় লাল হচ্ছে।চোখে মুখে লজ্জার রক্তিম আভা ছেয়ে।সায়রা ফিক করে হেসে দিলো ,তুর্জয়ের কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিস করে বলল,
–“কাহি পে নিগাহে কাহি পে নিশানা? বাহ তুর্জয় ভাই বাহ! ”
তুর্জয় মাথা নুয়ে হেসে ফেলল ,সেই সাথে সায়রাও! তাদের এতো বেশি কাছাকাছি ,হাসাহাসি! কেউ একজনের চোখে বাঁধল ।খুব করে বাঁধল। ভীষণ রাগ হচ্ছে তার।অগ্নিচোখে দুজনকে অপলক দেখে যাচ্ছে।চোখ দিয়ে যদি কাউকে ভস্ম করা যেত? তবে এতোক্ষণে নিশ্চিত এই দুজন ভস্ম হয়ে ,হাওয়ায় মিলিয়ে যেত।
.
সশব্দে ডি.জের গান বাজছে। ছোট বড় সবাই ড্যান্স ফ্লোরে যে যার যার মত নাচছে।সায়রা দূরে দাঁড়িয়ে দেখছিল ,রিদ্ধির পীড়াপীড়িতে তাকেও যেতে হলো।একপ্রকার জোর করে রিদ্ধি সায়রা কে ড্যান্স ফ্লোরে নিয়ে গেল ।তুর্জয়,সায়ন রিদ্ধি সায়রা পাখি পিয়াস একত্রে- ই নাচছিল।মাঝেমাঝে তুর্জয় সায়রা হাসাহাসিও করছে।দূর থেকে আরসাল সবটা দেখছে।কোনকিছু তার দৃষ্টির অগোচর হচ্ছে না। হৈ হুল্লর আরসালের পছন্দ না।তার উপর রিদ্ধির ইঁচড়েপাকা চাচাতো বোনদের গিলে খাওয়া নজর তো আছেই ।পশ্চিমা দেশের আধুনিকা আজকালকের বাচ্চাদের একটু বেশি আধুনিক বানিয়ে দিয়েছে ।বাচ্চা মেয়েদের এডাল্ট চাহনির ধাঁচে গা ঘিনঘিন করে উঠে ।
আরসাল ড্যান্স ফ্লোর থেকে খানিক দূরে বসেছিল।এখান থেকে ড্যান্স ফ্লোর স্পষ্ট! সায়রাকে দেখা যাচ্ছে। যা আরসালের মেজাজ খারাপ করছে।একের পর এক সিগারেট খাচ্ছে।অন্ধকারে বিষাক্ত ধোঁয়া গুলো হাওয়ায় মিলছে শুধু। বারবার প্রশ্ন জাগছে ,তুর্জয়র সাথে সায়রার কি এমন গভীর সম্পর্ক! কেন এতো হাসাহাসি? তুর্জয়ের সাথে সায়রা কেন হাসবে? কেন ঘুরবে? হোক সায়রা তার অপছন্দ, না মানা হবু বউ! সায়রা অন্য কোন ছেলের সাথে হাসবে কেন? ঘুরবে কেন? অন্য কারো সাথে হাসতে পারবে না।ঘুরতে পারবে না সায়রা।আর তুর্জয়ের সাথে তো একদমই না! তার প্রিয় ,অপ্রিয় ,মানা ,না মানা যা আছে! তা শুধু তারই থাকবে।কেউকে সেই জিনিসের দিকে চোখ তুলে তাকাতে দেবে না।কাউকে না!
এমন সময় সামনে থেকে দুই মহিলার কথোপকথন কানে এলো আরসালের।প্রথম মহিলা সায়রাকে দেখিয়ে বলছে,
–“ঐ সাদা লেহেঙ্গা পরা মাইয়াডা ,সিন্থিয়ার বড় মাইয়া সায়রা না! ”
–“হ ,বড় হইয়া গেছে , দেখতে হুনতেও কি সুন্দর হইছে।একদম পরী গো লাহান ।”
–“হ ঠিক! সায়নের লগের পোলাডা কেডা? সায়রার বয়ফেরেন্ড নিহি! ”
–“মনে হয়, আজকাল যা জমানা! কিন্তু যাই ক পোলাডা কিন্তু সুন্দর ।দুইজনরে হেভি মানাইছে! ”
এই কথোপকথন আরসালের মনের জ্বলন্ত আগুনে ঘি ঢালার জন্য যথেষ্ট ছিল।চেয়ার ছেড়ে তড়াক করে উঠে দাঁড়ায় আরসাল।ভীষণ ক্ষিপ্ত সে।চোয়াল শক্ত ।রাগে দাঁত কটকট করছে।বড় বড় পা ফেলে ড্যান্স ফ্লোরে সায়রার দিকে এগিয়ে যায়।ড্যান্স ফ্লোর তখন কৃত্রিম আবছা আলোয় অন্ধকার ।খপ করে কেউ সায়রার হাত চেপে ধরে, সায়রা কেঁপে উঠে।ঘাড় ফিরে পেছন তাকাতে কারো শক্ত বুকে ধাক্কা খায়।মাথা উঁচু করতেই ভয়ে কেঁপে উঠে।আঁতকে দূরে সরে যেতে নিলে শেষ রক্ষা হলো না।সামনে থাকা ব্যক্তি আরো শক্ত করে তার হাত চেপে ধরে ।টেনে হিঁচড়ে ভিড় থেকে বের করে শুনশান আউট হাউসের দিকে নিয়ে যেতে লাগে।সায়রার হাজার আকুতি মিনতিতে আরসালের হৃদয় বিন্দুমাত্র গললো না!
তোমার প্রণয় নগরে
উর্মি প্রেমা (সাজিয়ানা মুনীর)
পর্ব- ৬
(কার্টেসী ছাড়া কপি নিষেধ )
–“হাত ছাড়ুন আরসাল ভাই, আমার লাগছে! ”
সায়রার কান্না ভেজা আকুতি। ক্ষিপ্ত আরসালের কান অবধি পৌঁছাল না। গরুর মত টেনে হিঁচড়ে নিয়ে যাচ্ছে সায়রাকে। তার কান্নাকাটি আকুতি মিনতিতে বিন্দুমাত্র ভ্রুক্ষেপ নেই আরসালের। রাগে ফোঁসফোঁস করছে। সায়রাকে আউট হাউসে এনে বেশ শব্দ করে দরজা বন্ধ করল। কিছু বুঝে উঠার আগে, হুট করে সায়রাকে দেয়ালের সাথে ঠেসে ধরে গাল চেপে ধরল। তার রাগান্বিত উত্তাপিত নিশ্বাস সায়রার মুখের উপর পড়ছে। ভয়ে আত্মা বের হবার উপক্রম। অশ্রুসিক্ত চোখজোড়ায় ভীতিকর চাহনি । শুকনো ঢোক গিলল সায়রা। মুখ খুলে কিছু বলতে যাবে তার পূর্বেই আরসাল হুংকার দিয়ে উঠে । সজোরে ঝাঁকুনি নিয়ে ঝাঁঝাল গলায় আওড়ায় ,
–“তুর্জয়ের সাথে তোর কিসের সম্পর্ক? এত হাসাহাসি, চোখাচোখি কেন? বাইকের পেছনে বসে ঘুরে বেড়ানো? কি ভাবছিস এসব কারো চোখে পড়ে না? সবাই অন্ধ!”
আরসালের এমন আচরণ কথাবার্তায় সায়রা হতবাক। সেই সাথে বিস্ময়ের চরম পর্যায়! হতভম্ব স্বর টেনে ধীর আওয়াজে বলল,
–“এসব কি বলছেন আরসাল ভাই! আমি আর তুর্জয় ভাই….”
আরসাল এক রামধমকে চুপ করিয়ে দিলো সায়রাকে। কথা কেটে ভারী স্বরে বলল,
–“একদম ন্যাকা সাজার চেষ্টা করবি না সায়রা। তোকে আমার ভালো করে চেনা। আমার জীবন নষ্ট করে তোর শখ মিটেনি? এবার কি তুর্জয়ের জীবনটা নষ্ট করতে চাস? সব ছেলেরা তোর আশেপাশে ঘুরঘুর করুক এটাই তুই চাস? তাই না?
তাহলে, সরি টু স্যে তোর চরিত্রে সমস্যা আছে! ”
সায়রা থমকে গেল। আরসালের প্রত্যেক আরোপ, প্রত্যেক অপমান সায়রা মাথা পেতে মেনে নিলেও এবারের আরোপে সে চুপ থাকতে পারল না। গা ঝারা নিয়ে উঠল সে। রাগে জেদ অপমানে শরীর ঘিনঘিন করছে। আরসাল তাকে এতটা নিচু ভাবে! এতটা? যে ‘চরিত্রহিনার’ ট্যাগ লাগিয়ে দিলো! মুহূর্তে সায়রা রেগে অগ্নিমূর্তির রূপ ধারণ করে। আরসালের শার্টের কলার চেপে কাছে টেনে আনে। রাগান্বিত চিৎকার দিয়ে বলে,
–“নিজেকে কি ভাবেন? আমাকে আপনার মানুষ মনে হয়না? আপনার সব অপমান আরোপ মেনে নিচ্ছি বলে আমি দুর্বল, চরিত্রহীনা? আমার চরিত্র দোষ আছে! আমি মানছি চারবছর আগে আমি যা করেছি তা অন্যায় , চরম অন্যায়! যার কোন ক্ষমা নেই। বয়স কম ছিল, অবুঝ ছিলাম। যা হয়েছে না বুঝে ছেলেমানুষির বসে করে ফেলেছি। জোরজবরদস্তি মানে এতটা গম্ভীর সেই সময় তা আমার ছোট মস্তিষ্কে খেলেনি। আমার কাছে জোরজবরদস্তি শব্দটা মারামারি করার মত সহজ শব্দ ছিল। নতুন জামাটা ছিঁড়ে যাওয়ায় আপনার উপর প্রচন্ড রাগ হয়েছিল। ভেবেছিলাম আমাকে ভয় দেখানোর জন্য ইচ্ছে করে ঐসব কারসাজি করেছেন। তাই বড় বাবার কাছে নালিশ করেছিলাম। কিন্তু আমার বলা দু বাক্যে আপনার সাথে এত বড় অন্যায় হবে, তা আমার জানা ছিল না। বুঝে উঠতে পারিনি কতটা গভীর শব্দ আমি বলে ফেলেছি। যার জন্য আমি অনুতপ্ত! ভীষণ অনুতপ্ত। চারবছর অনুতাপের দহনে খনেখনে দগ্ধ হয়েছি, এখনো হচ্ছি। আপনার সব অপমান আরোপ শাস্তি মাথা পেতে মেনে নিতে রাজি ! কিন্তু চরিত্রহীনার আরোপ কোনদিন মেনে নিবো না, মানবো না।”
এতটুকু বলে সায়রা চুপ হয়ে যায়। অস্পষ্ট অপ্রকাশিত মান অভিমানে গলা ধরে আসছে। ভিতর থেকে সব ভেঙে চুরে কান্না আসছে। এত জঘন্য আরোপ কেউ কোনদিন তার উপর লাগায়নি। বুক চিঁড়ে হুহু কান্নারা বেরিয়ে আসতে চাইছে ।পা জোড়া অবশ হয়ে ভেঙে আসছে। থপ করে নিচে বসে পড়ল সায়রা। হাত দিয়ে মুখ চেপে, হুহু শব্দ তুলে কান্না করে দিলো। কান্নার বেগ ধীরেধীরে বাড়ছে। আরসাল ঠাই দাঁড়িয়ে আছে। চোখেমুখে বিস্ময়ের ছাপ। সে এতটা বলতে চায়নি, কিন্তু রাগের মাথায় কি থেকে কি বলে ফেলেছে! বুঝতে পারেনি।
মুখ সংযত রাখতে পারেনি আরসাল। বুকের ভেতরটা অস্থির লাগছে। ভীষণ অস্থির। সায়রার কান্না যেন তার বুকে যেয়ে বিঁধছে। সহ্য হচ্ছেনা সায়রার চোখের পানি। অদ্ভুত এক তিক্ত অনুভূতি। এই অনুভূতির অর্থ কি? আরসালের জানা নেই। একদমই জানা নেই। মাথা যন্ত্রণা করছে খুব। আর কিছুক্ষণ এখানে থাকলে নিশ্চিত বড় কোনো অঘটন ঘটিয়ে ফেলবে সে।দ্রুত পায়ে দরজার দিকে এগিয়ে যায়। সায়রাকে একা ফেলে হনহন করে আউট হাউস থেকে বেরিয়ে আসে। খানিক দূরে খোলা আকাশের নিচে দাঁড়িয়ে বড় বড় শ্বাস ফেলছে । গা ঘামছে। এত নার্ভাস কেন সে? সায়রাকে কাঁদতে দেখে তার বুক কেন কাঁপছে? এ কেমন অনুভূতি!
অনেকটা সময় নিয়ে নিজেকে শান্ত করল আরসাল। কিন্তু পুরোপুরি শান্ত হতে পারছেনা। বাড়ি ফিরে শাওয়ার নিতে হবে, তবেই যেন এই অস্থিরতা কমবে। দু’কদম গাড়ির দিকে বাড়াতে আচমকা লোডশেডিং হয়। মুহূর্তে চারিদিক ঘুটঘুটে অন্ধকারে তলিয়ে যায়। আরসাল কয়েক মুহূর্তের জন্য থামে । মিনিট দু’একের ব্যবধানে আলো ফিরে আসে। হয়তো জেনারেটর ছেড়েছে। গাড়িতে চড়ে সায়নকে ইনফর্ম করার জন্য মোবাইল হাতে নিতে, আরসালের দৃষ্টি আটকায় বাহিরে আউট হাউজের দিকে। সারা বাড়ি আলোয় ঝলঝল করলেও, আউট হাউজ এখনো অন্ধকাতে ডুবে। মুহূর্তে মনে পড়ে যায় সায়রার ফোবিয়ার ব্যাপারটা। “ওহ শিট” অকস্মাৎ আওয়াজ করে, তড়িঘড়ি করে গাড়ি থেকে নেমে পড়ে আরসাল। ছুটে যায় আউট হাউজের দিকে। মোবাইলের আলো জ্বেলে ভেতরে প্রবেশ করতেই, থমকে যায়। পা অচল হয়ে আসে।
মাটিতে পড়ে বড়বড় শ্বাস নিচ্ছে সায়রা। থেমে থেমে নিশ্বাস ফেলছে ,বুকে হাত চেপে ধীর স্বরে বলছে,
–“বাঁচাও, কেউ আমাকে বাঁচাও! ওই অন্ধকার দৈত্য আমাকে মেরে ফেলবে।”
আরসাল এক মুহূর্ত দেরী না করে সায়রার কাছে ছুটে যায়। সায়রাকে দ্রুত কোলে তুলে নিয়ে, বার কয়েকবার ডাকে। সায়রা সাড়া দিচ্ছেনা। ঘন ঘন শ্বাস ফেলছে । নিশ্বাস থেমে থেমে যাচ্ছে। চোখ মুখ রক্ত লাল হয়ে আছে। ভাষাহীন আঁখিদ্বয় ধীরে ধীরে বন্ধ হয়ে আসছে। শরীর ঠাণ্ডা নিস্তেজ! বুজে থাকা আঁখিকোণ বেয়ে পানি ঝরছে। অজানা এক ভয় আরসালের বুক চেপে বসল। মাথা কেমন জানো শূন্য শূন্য লাগছে। আরসাল আবারো ডাকল,
–“সায়রা, এই সায়রা! চোখ খোল! সায়রা”
সায়রার জ্ঞান নেই, অচেতন। নিস্তেজ নিথর হয়ে আরসালের বুকে ল্যাপ্টে।আরসাল ভয়ে জমে গেছে। প্রিয় কাউকে হারানোর ভয়! খুব করে অনুভব করছে। দ্রুত মোবাইল হাতে নিয়ে সায়নকে ফোন করল।
.
আরসালের আর বাড়ি ফেরা হলো না। সায়রার রুমের সামনে সোফায় বসে নির্ঘুম রাত কাটাল। এক মিনিটের জন্যও চোখের পাতা এক করেনি। সায়রার জ্ঞান ফেরার অপেক্ষায় আছে। রাতে অসুস্থতার খরব পেয়ে সিন্থিয়া বেগম, মাহির আহমেদ ছুটে এসেছে। সেই রাত থেকে ভিতরেই আছেন। আরসাল হাঁটুতে ভর দিয়ে মাথা চেপে বসে আছে। চোখ লাগবে লাগবে ভাব, এমন সময়ই ভেতর থেকে পাখি ছুটে আসে। বার্তা দিয়ে যায়,
–“সায়রুপুর জ্ঞান ফিরেছে।”
আরসালের জানে যেন জান ফিরল। চোখেমুখে আনন্দের উজ্জ্বল দ্যুতি। ফোঁস করে গলায় আটকে থাকা নিশ্বাস বেরিয়ে এলো। দ্রুত পায়ে রুমে ঢুকল। আরসালকে ঢুকতে দেখে রুমের অন্যসবাই বেরিয়ে গেল। সায়রা খাটের মাথায় গা এলিয়ে আধশোয়া হয়ে বসে। ভোরের উজ্জ্বল আলো মলিন মুখখানায় পড়ছে। বন্ধ চোখ জোড়া ফ্যাকাসে। উষ্কখুষ্ক চুলগুলো কপাল ছেয়ে আছে। শুষ্ক ঠোঁটদ্বয় তিরতির কাঁপছে! দেখে ভীষণ মায়া হলো আরসালের। নিজের উপর চাপা এক জেদ হলো। কেন হলো, জানা নেই!
চেয়ার টেনে সায়রার মুখোমুখি বসল আরসাল। চেয়ার টানার খড়খড় শব্দে সায়রা সামান্য ছিটকে উঠল। চোখ মেলে নিমিষ দৃষ্টিতে আরসালের দিকে তাকাল। উঠে বসতে নিলে আরসাল থামিয়ে দেয়। স্পষ্ট স্বরে বলে,
–“রেস্ট নে! আমি পরে আসছি।”
আরসালের অত্যন্ত স্বাভাবিক আচরণ দেখে সায়রা চমকাল। ভীষণ চমকাল। কিন্তু চেহারায় তা ফুটিয়ে তুলল না। না সূচক মাথা নাড়িয়ে আরসালকে থামিয়ে ধীর স্বরে বলল,
–“আমি ঠিক আছি, আরসাল ভাই! আপনি বসুন।”
দুজন মুখোমুখি। কেউ কারো সাথে কথা বলছে না। নীরবতা ভেঙে সায়রা কাঁচুমাচু স্বরে বলল,
–“আপনাকে কিছু বলার ছিল আরসাল ভাই।”
আরসাল মাথা তুলে সায়রার দিকে তাকাল। সায়রা চোখ নামিয়ে গলা ঝেরে বলতে শুরু করল,
–“চারবছর আগে আমি আপনার জীবনের যা ক্ষতি করেছি তার সম্পূর্ণ পূরণ করা সম্ভব নয় তা আমি জানি। কিন্তু আমি আমার দিক থেকে যথাসাধ্য চেষ্টা করব।
চরিত্রহীন আরোপ ঠিক কতটা জঘন্য তা আমি কাল অনেকটা উপলভ্য করতে পেরেছি। ঐযে কথায় আছে না? আমরা ততক্ষণ অন্যের ব্যথা অনুভব করিনা যতক্ষণ না তা নিজের সাথে ঘটে! আপনার বলা দু বাক্যে আমার এই হাল!
এক ঘর লোকের সামনে আমার দেওয়া এতো বড় আরোপে আপনার উপর ঠিক কতটা ম্যান্টালি প্রে্সার পড়েছে তা আমি সামান্য হলেও আন্দাজ করতে পারছি, আরসাল ভাই!”
এতোটুকু বলে সায়রা থামল। মাথা উঠিয়ে একবার আরসালকে দেখে নিলো। আরসালের শান্ত চাহনি। দুজন চোখাচোখি হতে সায়রা আবারো চোখ নামিয়ে নিলো। নির্ভীক স্বরে বলল,
–“অতীতে যা এলোমেলো হয়েছে, তা গোছানো সম্ভব না। কিন্তু ভবিষ্যৎ! অবশ্যই গোছানো সম্ভব।
চিন্তা করবেন না, আজকের পর আর কেউ আপনার উপর ওই জঘন্য আরোপ লাগাবে না।”
সায়রার কথায় আরসালের ভ্রু কুঁচকে এলো। দৃষ্টি তীক্ষ্ণ হলো, বুঝার চেষ্টা করল। সায়রার মনে ঠিক কি চলছে। কিন্তু ব্যর্থ, এমন সময় তার ভাবনাচ্ছেদ হলো। দরজার কড়া নড়েছে। কেউ এসেছে। সায়রা দরজার দিকে তাকিয়ে অভয় নিশ্বাস ফেলল। যেন সে জানে কে এসেছে। আরসাল কুঞ্চিত ভ্রুদ্বয় নিয়েই দরজায় তাকাল।
চলবে……