তোর_প্রেমেতে_অন্ধ_হলাম পর্ব ১৭+১৮

#তোর_প্রেমেতে_অন্ধ_হলাম
#লেখিকাঃ Tamanna Islam
#পর্বঃ ১৭

সাগর চৌধুরী ঠিক থাকতে না পেরে সোফার ওপর ধপ করে বসে পরেন। আশ্চর্যের চরম সীমায় গিয়ে অর্নীলের দিকে তাকায় কপাল কুচকে। অর্নীলের মুখে মাত্রই কি শুনলো তা যেনো বিশ্বাসই করতে পারছে না।

সাগর;; অর্নীল বাবা দেখো…..

সাগর চৌধুরীর কিছু বলার আগেই অর্নীল এসে তার বাবার সামনে বসে। বেশ রাগান্বিত সুরেই বলে ওঠে….

অর্নীল;; বাবা জানো জন্ম দিলেই বাবা হওয়া যায় না। তুমি নিজেও বাবা হতে পারো নি, কোন দিন বাবার দায়িত্ব পালন করতে পারো নি৷ আর সবথেকে বড়ো কথা কি জানো! তুমি নিজেই আরেকটা মেয়ে কে পিতৃহারা করেছো।

সাগর;; অর্নীল তুমি আমার ছেলে। নিজেও এতো বড়ো একটা কোম্পানির ওনার। মেয়েরা তোমার পিছে লাইন লাগিয়ে থাকে। কিন্তু তুমি এতো শত মেয়েকে বাদ দিয়ে আর কোন মেয়ে পেলে না। শেষে কিনা, শেষে কিনা ওই রহমানের মেয়ে কেই।

অর্নীল তার বাবার কথায় তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে হাততালি দেয় কিছুটা।

অর্নীল;; বাহ বাবা, তুমি আজ সত্যি প্রমাণ করে দিলে যে তুমিই সেই মহান সাগর চৌধুরী। সত্যি তোমার মতো কেউ হতেই পারে না, তোমার মতো মন-মানসিকতার মানুষ হতেই পারে না। ইম্পসিবল। আজ তোমার পুরনো কাহিনী সামনে কি এলো তুমি তো পুরোই পল্টি খেয়ে গেলে। যেখানে নিজের ভূল স্বীকার করার কথা সেখানে তুমি আমাকে বলছো যে আমি কেনো সিয়াকে ভালোবাসলাম৷

সাগর;; ___________

অর্নীল;; বাবা একটা কথা বলবো! আমার না এখন তোমাকে বাবা বলে ডাকতে এক বিন্দু ইচ্ছেও করে না জানো। আর সত্যি বলতে আমার তোমাকে খুন করতেও এখন বাধবে না।

অর্নীলের কথায় সাগর চৌধুরী ফট করে মাথা তুলে তার দিকে তাকায়।

সাগর;; অর্নীল! ভুলে যেও না আমি তোমার বাবা।

অর্নীল;; ওহ র‍্যালি। তো শুনো আজ থেকে আমি তোমাকে আমার বাবা বলে জীবনেও পরিচয় দিবো না। তোমার কারণে, শুধুমাত্র তোমার কারণেই আজ আমার মা নেই। সব দোষ তোমার।
আর আজ তোমার জন্য আমার ভালোবাসা আমার কাছে থেকেও নেই। (চিল্লিয়ে)

সাগর;; অর্নী……..

অর্নীল;; শুনে রাখো আমি সিয়া কেই বিয়ে করে এই বাড়িতে আনবো। এই বাড়ির বউ করে আনবো। তাতে চাই তোমার মতামত থাকুক আর না ই থাকুক কিন্তু আমার জীবনে সিয়া তো থাকবেই। (প্রচন্ড রেগে)

এই বলেই অর্নীল দ্রুত সিড়ি বেয়ে ওপরে নিজের রুমে চলে যায়। আর এদিকে সাগর চৌধুরী চিন্তায় পাগল প্রায়। না, ছেলের মনে নিজেকে নিয়ে জন্মানো ঘৃণাকে নিয়ে না। অর্নীলের জীবন থেকে সিয়াকে কি করে সরানো যায় তা নিয়েই। তিনি গম্ভীর মুখে সোফার ওপরেই বসে ভাবতে লাগলেন।


আর ওদিকে সিয়া এখনো বাড়ি ফিরে নি দেখে দোলা যেনো চিন্তায় মরে মরে। বাড়িতে একে তো কারেন্ট নেই, তারওপর সিয়াও নেই। দোলা হলরুমে শুধু পায়চারিই করে যাচ্ছে। এরই মধ্যে হঠাৎ বাইরে দরজাতে কলিং বেলে চাপ পরে। দোলার মনে যেনো শান্তি ফিরে আসে। সে দ্রুত গিয়ে দরজা খুলে দেয়। দেখে সিয়া মাথার চুল থেকে শুরু করে পায়ের শেষ ভাগ পর্যন্ত পুরো গোছল করে এসেছে। চুল গুলো প্রচুর এলোমেলো হয়ে গায়ের সাথে লেপ্টে আছে। দোলা দরজা মেলে দাড়ালে সিয়া কিছু না বলেই মাথা নিচু করে সোজা ভেতরে এসে পরে।

শিউলি;; কিরে সিয়া! এভাবে ভিজলি কি করে? আরে দোলা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কি দেখছিস যা আগে টাওয়াল এনে আগে মেয়ে টাকে দে। ঠান্ডা-জ্বর আসবে তো।

দোলা;; হুমম হুমম।

দোলা গিয়ে সিয়াকে একটা টাওয়াল এনে দেয়। সিয়া আস্তে আস্তে করে নিজের মাথা মুছতে লাগে।

শিউলি;; হ্যাঁ রে, তুই কি কোন গাড়ি-ঘোড়া পাস নি৷ এই বৃষ্টিতে কেউ এভাবে ভিজে। এদিকে আয় দেখি মাথা মুছে দিচ্ছি আমি।

সিয়ার নানু গিয়ে তার মাথা মুছে দেয়। কিন্তু সিয়া যেনো নিজের মাঝে নেই। সে অবাক হয়ে এক দিকেই তাকিয়ে আছে। যেনো কারো কোন কথা তার কান অব্দিও পৌঁছাচ্ছেই না। দোলা সেটা খেয়াল করলো৷

দোলা;; সিয়া

সিয়া;;__________

দোলা;; সিয়া!

সিয়া;; হ হ্য হ্যাঁ বলো।

দোলা;; কি হয়েছে? সব ঠিক আছে তো?

সিয়া;; আব..হ্য হ্যাঁ সবই ঠিই আছে কি হবে। ঠিক আছে সব।

দোলা;; রুমে যা চেঞ্জ করে আয়। তারপর খেতে আয়।

সিয়া;; ক্ষিদে নেই আমার।

এই বলেই সিয়া টাওয়াল টা হাতে করে নিয়ে নিজের রুমে এসে পরে। দোলা তার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থাকে। সিয়া যতোই না বলুক কিছু না কিছু তো হয়েছেই। সিয়া রাতে আর নিজের রুম থেকে বের হয় না। দোলাও আর ডাকে না। তবে গভীর রাতে শুধু একবার সিয়ার রুমে গিয়ে দেখে এসেছে। গভীর ঘুম। বৃষ্টি তে ভিজেছে ঠান্ডা ঠান্ডা একটা ভাব তাই ঘুম টাও গভীর৷ দোলা চলে আসে।

পরেরদিন সকালে সিয়া ঘুম থেকে উঠেই কলেজে যাওয়ার জন্য দৌড়াদৌড়ি শুরু করে দেয়। সিয়া কলেজে চলে গেলে দোলা শিউলি কে মেডিসিন খাইয়ে দিয়ে নিজের রুমে রেস্ট নিতে পাঠিয়ে দেয়৷

হলরুমে দোলার আসতেই ল্যান্ডলাইনে ফোন আসে। দোলা গিয়ে ধরে ফেলে। তবে ওপর পাশে থাকা ব্যাক্তি টির কন্ঠ শুনতেই যেনো দোলা ভয় পেয়ে যায়। সে সাগর চৌধুরী ছাড়া আর কেউ না।

সাগর;; কেমন আছেন ভাবি?

দোলা;; ____________

সাগর;; অনেক দিন পর আপনার কথা মনে পরলো তো তাই ফোন না দিয়ে আর থাকতেই পারলাম না, কি করবো বলুন। এবার আসি সোজা সাপটা কথায়।

দোলা;; কেনো ফোন করেছেন আপনি? কি চাই? এখন সব শেষ হওয়ার পর আমাদের তো অন্তত বাঁচতে দিন।

সাগর;; হ্যাঁ হ্যাঁ বাঁচুন মন খুলে বাঁচুন। কেউ মানা করে নি। তবে হ্যাঁ তা নিজের মেয়ের দিকে খেয়াল রেখে। আপনার মেয়ের ওপর নজর দিন। আমি কিছুই লুকাতে চাই না। আর লুকায়িত নেই ও। আমার ছেলে অর্নীল আর আপনার মেয়ে সিয়া একে ওপরের প্রেমে নাক অব্দি ডুবে রয়েছে যা হয়তো আপনি নিজেও জানেন। কিন্তু আমি চাই না এমন হোক। সিয়া কে বলে দিবেন অর্নীলের থেকে দূরে দূরে থাকতে। এতে আপনার, আমার সবারই ভালো৷

এই বলেই সাগর চৌধুরী ঠাস করে ফোন কেটে দেয়। আর দোলা কিঞ্চিত চোখ কুচকে ফেলে৷ দোলা গিয়ে বসে পরে। সিয়া যে কাল রাতে চিন্তা মাখা মুখ করে বসে ছিলো অবশ্যই তাহলে কাল অর্নীলের সাথে সিয়ার কিছু একটা হয়েছে। এবার যেনো দোলার সন্দেহ টা আরো গাঢ় হয়ে গেলো। এভাবেই বেশ সময় চলে গেলো। শিউলি তার রুম থেকে বের হয়ে দেখে দোলা হলরুমেই চুপ চাপ বসে আছে। শিউলি গিয়ে দোলার পাশে বসে পরে।

শিউলি;; কিরে এভাবে বসে আছিস যে!

দোলা;; মা, সিয়ার বিয়ে দিয়ে দিলে কেমন হয়??

দোলার কথায় শিউলি অবাকই হয় বেশ। কেননা দোলা সবসময় বলতো যে আগে সিয়াকে দিয়ে পড়াশোনা শেষ করাবে তারপর তাকে বিয়ের পিড়িতে বসাবে। আর আজ কিনা দোলাই এই কথা বলছে।

শিউলি;; মানে, কিন্তু কেনো?

দোলা;; না এমনি, হুট করেই কথা টা মাথায় এসে বারি খেলো। হ্যাঁ মা এটাই ঠিক। আমি সিয়াকে বিয়ে দিয়ে দিবো। আজ থেকেই সব ব্যাবস্থা শুরু করে দিবো। আর হ্যাঁ সিয়াকে আগেই এইসব কিছুর ব্যাপারে কিচ্ছু বলবে না।

শিউলি;; সিয়া কি রাজি হবে?

দোলা;; আমি বুঝাবো ওকে, নিজের সবটুকু দিয়েই বুঝাবো। আর আমি জানি সিয়া বুঝবে। আর এখন কোন কিছুই সিয়ার অজানা নয়। ও কেনো বুঝবে না। আমিও তো চাইনি এমন কিছুর ডিসিশন হুট করেই নিতে কিন্ত এখন আমার আর কোন রাস্তা নেই। সিয়া কে যদি এখন একটা ভালো ঘরে বিয়ে দিতে পারি তাহলেই আমি চিন্তামুক্ত৷

শিউলি;; ঠিকআছে।

এই বলেই শিউলি উঠে চলে যায়। অন্যদিকে অর্নীল তার অফিসে চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে এক হাত দিয়ে কপালের পাশে চেপে ধরে রেখেছে। সকাল হতে ইতোমধ্যে ৬ কাপ কফি খেয়ে ফেলেছে সে তবুও যেনো আজগুবি সব ভাবনাগুলো মাথা থেকে যেতেই চাইছে না। অর্নীল উঠে গিয়ে কিছুটা দূরে গিয়ে দাঁড়ায়। তার কেবিন থেকে বাইরের ওই ব্যাস্ত শহর টা দেখা যায়। সেইদিকেই তাকিয়ে ছিলো সে তখনই কারো ডাকে পেছন ঘুড়ে তাকায়, দেখে ম্যানেজার এসেছে।

ম্যানেজার;; স্যার..

অর্নীল;; কিছু বলবেন?

ম্যানেজার;; জ্বি আসলে স্যার বড়স্যার আপনাকে ডেকেছেন।

অর্নীল;; কেনো?

ম্যানেজার;; জ্বি স্যার তা তো আমি জানি না।

অর্নীল;; আচ্ছা ঠিকআছে।

ম্যানেজার চলে যায়। তবে সাগর চৌধুরীর এই সময়ে ডাকার মানে কি! অর্নীল নিজের কেবিন থেকে বের হয়ে পরে।


সিয়ার কলেজ শেষ, আজ মাত্র ত্রিশ মিনিটের দুইটা ক্লাস হয়েছে। সিয়া নিজের ব্যাগ টা নিয়ে ক্লাস রুম থেকে বের হয়ে পরে। গেটের বাইরে এসে ফ্রেন্ড দের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলেই আসতো তবে কারো ডাকে থেমে যায়৷

সায়ন;; সিয়া!

সিয়া;; আরে আপনি এখানে? কি মনে করে?

সায়ন;; না মানে আসলে তোমার সাথে কিছু কথা ছিলো।

সিয়া;; আচ্ছা তাই, তো ডক্টর সাহেবের আমার সাথে কথা বলার এতোই তাড়া যে উনি নিজের সাথে স্টেথোস্কোপ টাও নিয়ে এসে পরেছে!

সায়ন নিজের দিকে খেয়াল করে দেখে যে আসলেই তার ঘাড়ের ওপর স্টেথোস্কোপ ঝুলছে। পেসেন্টের চেকাপ করে দ্রুত পায়ে বের হয়ে পরেছে। এটা যে ঘাড়ে রয়েছে তার দিকে কোন খেয়ালই ছিলো না। সায়ন হেসে দেয়৷ তারপর নিজের ওপর থেকে তা সরিয়ে দেয়।

সায়ন;; চলো একটা কফি শপে বসি।

সিয়া;; আচ্ছা চলুন।

সায়ন & সিয়া গিয়ে একটা কফি শপে বসে পরে।

সায়ন;; কি খাবে বলো?

সিয়া;; না না আমি কিছুই খাবো না। আপনি বলুন কি বলবেন।

সায়ন;; আব… আসলে সিয়া কথা টা মেইনলি আমার না।

সিয়া;; বুঝলাম না।

সায়ন;; আন্টি কেমন আছে?

সিয়া;; হ্যাঁ ভালোই।

সায়ন;; হুমমম। আন্টি তোমাকে কি কিছু বলেছে?

সিয়া;; কই, না তো।

সায়ন;; ওহহ আচ্ছা।

সিয়া;; কেনো কি হয়েছে?

সায়ন;; আন্টি যেহেতু এখনো তোমাকে কিছুই বলে নি তাহলে অপেক্ষা করি। আন্টি নিজেই তোমাকে বলবে।

সিয়া;; সিক্রেট নাকি?

সায়ন;; কিছুটা তেমনই৷

সিয়া;; হুমমম, আচ্ছা তো আমরা এখন উঠি।

সায়ন;; আচ্ছা।

এই বলেই তারা বাইরে বের হয়ে পরে৷ সিয়াকে সায়ন ড্রপ করে দিতে চাইছিলো কিন্তু সিয়া নিজে একাই এসে পরে। বাসায় এসেই দেখে দোলা বসে বসে সবজি কাটছে আর শিউলি টেবিল গুছাচ্ছে।

সিয়া;; মা

দোলা;; কিরে এসে পরেছিস। এতো জলদি যে?

সিয়া;; না আসলে ক্লাস তেমন একটা হয় নি তাই।

দোলা;; ওহহ আচ্ছা।

সিয়া;; আচ্ছা মা, আদিবা আপুর বাড়ি থেকে কি কেউ ফোন দিয়েছিলো?

দোলা;; না।

সিয়া;; ওহহ

দোলা;; কেনো?

সিয়া;; না এমনি, আমি রুমে গেলাম।

সিয়া নিজের রুমে চলে যাওয়ার ৫-১০ মিনিট পরেই দোলার ফোনে কল আসে। দোলা গিয়ে ধরে। আর এবার সত্যি সায়নের মা ফোন করেছেন।

রুমি (সায়নের মা);; আসসালামু আলাইকুম আপা।

দোলা;; ওয়ালাইকুম সালাম আপা। এত্তো দিন পর মনে পরলো। কেমন আছেন?

রুমি;; জ্বি আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি। আপনারা সবাই কেমন আছেন? আর সিয়া কেমন আছে?

দোলা;; জ্বি সবাই ভালো।

রুমি;; আসলে আপা আপনার সাথে একটা জরুরি বিষয়ে কথা বলার জন্য ফোন করা আজ।

দোলা;; জ্বি বলুন।

রুমি;; কথা টা হয়তো দেখা করে বললে বেশি ভালো হবে।

দোলা;; এমা তাহলে তো সেটা আরো ভালো কথা। আরে সবাই কে নিয়ে সোজা এখানে চলে আসুন।

রুমি;; জ্বি আমিও তাই ভাবছি। আপনি বললে বিকেলে আসবো!

দোলা;; জ্বি জ্বি অবশ্যই।

রুমি;; জ্বি আচ্ছা তাহলে এখন রাখি।

দোলা;; আচ্ছা।

দোলা ফোন কেটে দিতেই শিউলি বলে…..

শিউলি;; কিরে কার ফোন ছিলো?

দোলা;; রুমি আপা জাবেদের মা মানে আদিবার শাশুড়ীর ফোন ছিলো৷

শিউলি;; কেনো?

দোলা;; আজ বিকেলের দিকে আসতে চায়। জরুরি কথা আছে।

শিউলি;; জরুরি কথা!

শিউলি আর দোলা কিছুক্ষন চুপ করে একে ওপরের দিকে তাকিয়ে থাকে।

শিউলি;; দোলা, আমি যা ভাবছি তুইও কি….

দোলা;; হ্যাঁ, আমিও তাই ভাবছি।

সিয়া কে তারা কেউই কিছুই বলে। তাকে তার মতো করে থাকতে দেয়। এদিকে সিয়াকে বারবার ফোন করে যাচ্ছে অর্নীল তবে সিয়া ফোন শুধু কাট করে দিচ্ছে৷ কলেজ থেকে এসেছে যাবত নিজের রুমে। দোলা গিয়ে জোর করেই খাইয়ে দিয়েছে কিছু। আস্তে আস্তে বিকেল হয়। হলরুমে বেশ মানুষের আওয়াজ পেয়ে সিয়া কপাল কুচকে দরজার দিকে তাকায়। অর্ধেক সিড়ি বেয়ে নেমেই থেমে যায়। অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। কেননা হলরুমে সায়নের মা-বাবা-বোন আর আদিবা নিজেও বসে আছে। দোলা & শিউলি তাদের সাথে কথা বলছে। সবাই কথা বলছিলো তার মাঝেই আদিবার চোখ যায় সিয়ার দিকে। সিয়া সিড়ির ওপরে দাঁড়িয়ে আছে, আদিবা সবাইকে বলে উঠে সিয়ার কাছে চলে আসে। সিয়ার হাত ধরে নিয়ে তার রুমের দিকে যেতে লাগে। সিয়া কিছু বলবে কিন্তু তার আগেই আদিবা তাকে নিয়ে এসে পরে। রুমে এনে দরজা ঠাস করে লাগিয়ে দেয়। সিয়ার আর বুঝতে বাকি নেই যে কেনো সায়ন সকাল বেলা সিয়াকে ওই কথা গুলো বলছিলো আর কেনোই বা এখন সায়নের মা-বাবা এখানে এসেছে। সিয়া অবাক স্তব্ধ হয়ে বিছানাতে বসে পরে৷ আর আদিবা সিয়ার পাশে বসে দ্রুত বলে ওঠে…..

আদিবা;; সিয়া কি হচ্ছে এগুলো?

সিয়া;; কি আর হবে?

আদিবা;; তোর সম্পর্ক অর্নীল ভাইয়ার সাথে আছে তাহলে এগুলো কেনো? তুই জানিস সায়নের বাবা-মা তোর আর সায়বের বিয়ের কথা বলতে এসেছে এখানে। ওরা চায় যে তোর যেনো সায়নের সাথে বিয়ে হয় আর আমরা দুই বোনও একই সাথে থাকি। কিন্তু এটা তো হয় না। অর্নীল কে তুই ভালোবাসিস। ভালোবাসিস একজন কে আর বিয়ে করবি আরেকজন কে। এটা কি সিয়া, তুই কাউকে কিছু বলছিস না কেনো? আর জেঠিমা না তোদের সম্পর্কে সবই জানে তাহলে কেনো এখন সায়নের সাথে…..

সিয়া;; আদি, আমরা যা চাই তা সবসময় পাই না।

আদিবা;; তুই বুঝতে পারছিস অর্নীল ভাই জানলে কি করবে?

সিয়া;; আমি কিছুই লুকাতে চাই না। না অর্নীলের থেকে, না তোর থেকে আর না ই চাচ্চুর কাছ থেকে।

আদিবা;; মানে?

সিয়া;; তুই যখন বাসায় যাবি চাচ্চু কে বলে দিস যে উনি যার সাথে কাজ করে মানে সাগর চৌধুরী সে আর কেউ না তারই আপন ভাই রহমান শেখের খুনি।

আদিবা যেনো কয়েক হাজার ভোল্টের ঝটকা খেলো। চোখ গুলো আপনা আপনিই বড়ো হয়ে কপাল ভাজ হয়ে আসে।

আদিবা;; মানে কি, কি বলিস তুই?

সিয়া;; আর সাগর চৌধুরীই অর্নীলের বাবা। এখন তো বুঝতেই পারছিস। অর্নীলের বাবা আমার বাবার খুনি এটা জানার পরেও কি করে আমি…..

সিয়া হঠাৎ তার বুকের মাঝে হাত দিয়ে চেপে ধরে। জোরে জোরে দম নিচ্ছে। যেনো কেউ তার গলা চেপে ধরেছে। চোখ থেকে কয়েক ফোটা পানি গড়িয়ে পরে। চোখ বড়ো বড়ো হয়ে আসে। আদিবা তা খেয়াল করে দ্রুত পানি নিয়ে এসে সিয়াকে খাইয়ে দেয়। আর পিঠে হালকা ভাবে চাপড় দিতে থাকে। কয়েক মিনিট পর সিয়া স্বাভাবিক হয়ে আসে।

আদিবা;; আস্তে, তুই জানিসই যে নিজের ওপর জোর খাটিয়ে কিছু করলে এমন সমস্যা হয় তোর। প্রেসার নিতে পারিস না তবুও কেনো নিস!

সিয়া;; কি করবো বল। উপায় নেই। ভেবে দেখেছিস তুই। মা কে কি করে না করি। ভাববে আমি স্বার্থপর। তাই নিজেই মায়া ত্যাগ করে দিলাম।

আদিবা;; হ্যাঁ ওই হিসেব নিয়েই বসে থাকো তুমি। অর্নীল ভাই জানলে না জানি কি করে, এসে যখন তুলকালাম কান্দ বাধিয়ে দিবে তখব বুঝিস।

সিয়া;; ছাড় না এইসব কথা এখন।

দোলা;; সিয়া আদিবা, নিচে নেমে আয়।

আদিবা;; ওই যে জেঠিমা ডাকে, চল।

আদিবা সিয়া কে নিয়ে নিচে চলে আসে। আর সিয়ার আসতেই রুমি সিয়াকে ডাক দিয়ে আদর করে নিয়ে নিজের পাশে বসায়। সিয়াও মুখে মেকি হাসি ঝুলিয়ে রাখে ভদ্রতার খাতিরে।

এভাবেই বেশ সময় কথা বার্তা বলে সায়নের বাবা মা বোন চলে আসে। আর আদিবাও সিয়া কে অনেক বুঝিয়ে শুনিয়ে এসে পরে।

রাতে সিয়া ঘরের টুক টাক কাজ করছিলো তার মাঝেই ফোন আসে। সিয়া ভাবে অর্নীলের এই ভেবেই ফোন কেটে দিতে যাবে তখন খেয়াল করে দেখে আননোন বাম্বার। সিয়া রিসিভ করে।

সিয়া;; হ্যালো।

সায়ন;; হ্যালো সিয়া৷

সিয়া;; ওহ আপনি, জ্বি বলুন।

সায়ন;; এখন তো সবই বুঝে গেছো।

সিয়া;; জ্বি অনেক ভালো করেই বুঝেছি।

সায়ন;; আজ কাজের চাপের ফলে তোমার সাথে দেখা করতে পারি নি। মানে বিকেলে আসতে পারিনি। কাল দেখা করি??

সিয়া কিছুক্ষন ভেবে তারপর উত্তর দেয়।

সিয়া;; জ্বি আচ্ছা।


রাত বাজে ১ টা। তখন অর্নীল বাসায় আসে। সাগর চৌধুরীর চোখে পরে অর্নীল কে। তিনি পেছন থেকে অর্নীল কে বেশ কয়েকবার ডাক দিলেও সে না শোনার ভান করে এসে পরে। সিয়া কে আর কলও দেয় নি ভেবেছে একেবারে দেখাই করে নিবে।

আর আদিবা বাসায় গিয়ে পরে আরেক মহা চিন্তায়। সাগর চৌধুরী সিয়ার বাবা কে মেরেছে আর বিল্লাল অর্থাৎ তার বাবা-ই কিনা আবার এই সাগর চৌধুরীর সাথে কাজ করছে। তাহলে তো অবশ্যই বিল্লাল কিচ্ছু জানে না। কারণ যদি জানতো তাহলে জীবনেও কাজ করতো না তার সাথে। আদিবা ঘরের মাঝে পায়চারি করছে আর এগুলো ভাবছে। জাবেদ ওয়াসরুম থেকে বের হয়ে দেখে আদিবা নিজের ভাবনায় মগ্ন।

জাবেদ;; এতো কিসের ভাবনা-চিন্তা তোমার?

আদিবা;; না না এমনি।

জাবেদ;; না, কিছু তো হয়েছে। বলো

আদিবা;; আরে কিছু না।

জাবেদ;; সিওর?

আদিবা;; হ্যাঁ।

জাবেদ;; আচ্ছা।

আদিবা;; আচ্ছা জাবেদ, শুনো না।

জাবেদ;; হ্যাঁ বলো।

আদিবা;; সকালে আমাকে একটু বাবার বাসায় নামিয়ে দিবে যাবে!

জাবেদ;; আরে এটা কোন ব্যাপার, ধুর পাগলি। আচ্ছা আমি কাল অফিসে যাওয়ার আগেই বাবার বাসার সামনে নামিয়ে দিয়ে যাবো কেমন! এবার এই সব হাবিজাবি চিন্তা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে দিয়ে ঘুমাও তো ঘুমাও।

আদিবা;; হুমমম।

এক একজনের মাথায় এক এক রকমের বুদ্ধি ঘুর পাক খাচ্ছে। সবাই নিজের পরিস্থিতি থেকে বুঝতে পারছে যে আসলে ব্যাপার টা ঠিক কতোটা কঠিন। সাগর চৌধুরী ভাবছে কীভাবে সিয়াকে অর্নীলের মন থেকে মুছে ফেলা যায়। দোলা চিন্তায় আছে নিজের মেয়ে কে নিয়ে। এই ভেবে যে সাগর চৌধুরী সিয়ার আবার কোন ক্ষতি যেনো করে না বসে। আদিবা ভাবছে সব ঠিক করতে হবে সবার আগে তার বাবার সাথে এই ব্যাপারে কথা বলতে হবে। সায়ন ভাবছে সিয়ার সাথে বিয়ে করে ঘর-সংসার করার বুদ্ধি। কেননা সায়ন মনে মনে সিয়া কে বেশ পছন্দ করে ফেলেছে। সিয়া ভাবছে নিজের পরিবারের ওপর যেনো কোন আচড় না আসে। আল্লাহ যা করে ভালোর জন্যই করে। তো যাই হোক না কেনো সব যেনো ভালোই হয়। নিজে যেনো ভেঙে না পরে ঠিক থাকতে পারে। আর অর্নীল ভাবছে দুনিয়া উল্টে যাক তবুও সিয়া তার হয়ে থাক। কিচ্ছু লাগবে না শুধু সিয়া কে চাই। অতীতে কার সাথে কি হয়েছে কি না হয়েছে তা দেখার বিষয় অর্নীলের না, ব্যাস সিয়া হলেই হবে। এ যেনো এক ভুল-ভুলাইল্লা তে সবাই ফেসে গেছে।
#তোর_প্রেমেতে_অন্ধ_হলাম
#লেখিকাঃ Tamanna Islam
#পর্বঃ ১৮

কলেজে যাওয়ার মন নেই একদম সিয়ার। সবকিছু খুব বেশি বিরক্তিকর লাগছে, খুব বেশি। গতকাল রাতে জিদের বশে এসে ঘুমের দুইটা ট্যাবলেট খেয়ে শুয়ে পরেছিলো। কলেজে যাওয়ার ইচ্ছে আগে থেকেই ছিলো না এর জন্য ঘুম থেকেও ওঠে নি। বেলা বেশ গড়িয়ে ১০ঃ৩০ এর দিকে ঘুম ভেঙেছে তার। ফ্রেশ হয়ে এসে স্নিগ্ধ মুখে করিডরে খোলা বাতাসে বসে ছিলো। রোদের ঝলক এসে করিডরে পরেছে। সামনেই চা রাখা, থেকে থেকে তাতে চুমুক দিচ্ছে।

দোলা;; সিয়া, সিয়া

সিয়া;; আমি করিডরে।

দোলা;; আজ ক্লাস নেই তোর!

সিয়া;; তেমন একটা নেই আর ইচ্ছেও করছে না যেতে।

দোলা;; ওহ আচ্ছা থাক তাহলে।

সিয়া;; মা, ব্যাস্ত তুমি?

দোলা;; না।

সিয়া;; একটু আমার পাশে এসে বসবে!

দোলা;; এমা, কি হয়েছে তোর। খারাপ লাগছে?

সিয়া;; তেমন না একটু বসো।

দোলা;; আচ্ছা।

দোলা গিয়ে সিয়ার পাশে বসে পরে৷ দোলা খেয়াল করলো সিয়ার মুখ টা কেমন মলিন হয়ে আছে। এক দৃষ্টিতে আকাশ পানে তাকিয়ে আছে।

দোলা;; সিয়া, ঠিক আছিস তুই?

সিয়া;; মা, আমার বিয়ে ঠিক?

দোলা;; না মানে দেখ কেউ দেখতে আসলেই তো বিয়ে একদম ঠিক হয়ে গেলো না।

সিয়া;; আমি জানি মা। সায়নের সাথে বিয়ে তাই না!

দোলা;; এখনো ঠিক হয় নি। আচ্ছা যদি সায়নের সাথে তোর বিয়ে ঠিক করি তাহলে?

সিয়া;; যা ভালো মনে করো।

দোলা;; তুই কি রেগে আছিস আমার ওপর?

সিয়া;; না, একদম না। রাগ করার কোন মানেই হয় না। আমি বুঝি সব। তবে হয়তো কোথাও না কোথাও আমাকে “বেইমান” নামক উপাধি টা পেতে হবে এই আর কি।

দোলা তার মাথা অন্য পাশে ঘুড়িয়ে ফেলে। তখনই সিয়ার ফোনে ফোন আসে, সিয়া তাকিয়ে দেখে অর্নীল।

দোলা;; আমি যাই কিছু কাজ আছে। ভালো না লাগলে নিচে নেমে আসিস।

দোলা চলে যায়। সিয়া হাতে ফোন টা তুলে স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে আছে। ফোন পিক করবে কি করবে না ভাবছে। সিয়া ফোন টা পাশেই রেখে দেয়। ধরবে না। ধরলেই এত্তো গুলো প্রশ্ন একসাথে ছুড়ে মারবে অর্নীল। আর সেগুলো একটারও জবাব দেওয়ার সাহস-শক্তি বা ইচ্ছে কোনটাই নেই তার। তাই না ধরাটাই শ্রেয়। ফোন কানের কাছে বাজতে বাজতে এক সময় বিরক্তি ধরে গেলো সিয়ার। তাই সে ফোন কেটে দিয়ে বন্ধ করে রেখে দেয়।


অর্নীল তার অফিসে বসে বসে এতোক্ষন সিয়াকে ফোন দিচ্ছিলো আর অর্নীল সিওর ছিলো যে ফোন হয়তো ধরবে না সিয়া আর তাই হলো। ফোন কেটে দিয়ে অর্নীল তার সামানে থাকা সিয়ার ছবির একটা ছোট্ট ফ্রেমের দিকে তাকায়। অর্নীলের চোখ গুলো লাল হয়ে গেছে। সিয়ার ছবিটা হাতে নিয়ে বৃদ্ধা আঙুল দিয়ে হালকা ছুইয়ে দেয় তাতে। অর্নীল এখন হুট হাট করেই সিয়ার বাসায়ও চলে যেতে পারে না কেননা এখন ব্যাপার টা বেশ সিরিয়াস আর ব্যাপার টার সাথে বড়ো রাও জড়িয়ে আছে তো এখন এমন পাগলামি করলে কেমন দেখায় সব। তাই অর্নীল শান্ত রাখছে নিজেকে। আসলে অর্নীল নিজেও দেখছে যে সিয়া ঠিক কি কি করতে পারে।

আর ওদিকে আদিবাকে জাবেদ তার বাবার বাসায় নামিয়ে দিয়ে গেছে। আদিবা কে এই সময়ে বাসায় আসতে দেখে বিল্লাল বেশ অবাক হয়।

আদিবা;; বাবা।

বিল্লাল;; কিরে মা তুই এই সময়ে? আর জাবেদ কেনো এলো না? ঠিক আছে তো সব?

আদিবা;; না বাবা কিচ্ছু ঠিক নেই। সত্যি কিচ্ছু ঠিই নেই।

বিল্লাল;; কি বলিস?

আদিবা;; ভেতরে চলো।

বিল্লাল;; আরে কিন্তু….

আদিবা;; আহা, তুমি আগে ভেতরে চলো তো।

আদিবা বিল্লাল কে নিয়ে ভেতরে চলে গেলো। আদিবা নিজে আগে মাথা ঠান্ডা করে তারপর বিল্লাল কে বসিয়ে সবকিছু আস্তে ধীরে বলতে লাগে।

আদিবা;; বাবা দেখো, এখন আমি যাই বলবো সব মনোযোগ দিয়ে শুনবে আর প্লিজ হাইপার হবে না। কারণ অনেক বছর আগের কথা তো এখন কোন কিছু করেও লাভ নেই।

বিল্লাল;; আচ্ছা হয়েছে কি?

আদিবা;; তুমি আগে ওই সাগর চৌধুরীর সাথে সব ধরণের কাজ করা বন্ধ করে দাও।

বিল্লাল;; কিন্তু কেনো?

আদিবা;; কারণ তোমার বড়ো ভাই কে আর কেউ না ওই সাগর চৌধুরীই খুন করেছে।

বিল্লাল;; কি সব যা তা বলছিস আদিবা?

আদিবা;; এটা কোন যা তা বলছি না বাবা। বিশ্বাস না হলে তুমি জেঠিমার সাথে কথা বলে দেখতে পারো। এতোদিন, এত্তোগুলো বছর অব্দি সিয়ার মা সবকিছুই লুকিয়ে রেখেছিলো। আর আমার রিসেপশনের দিন জেঠিমা যখন হুট করেই চলে যায় তার একমাত্র কারণ ছিলো সাগর চৌধুরী। অবশ্যই নিজের সামনে নিজের স্বামীর খুনি কে দেখলে কেউই ঠিক থাকতে পারবে না। জেঠিমা ও পারে নি।

বিল্লাল হুট করেই বুকের বা পাশে তার কাপাকাপা হাত দিয়ে চেপে ধরে। চোখ থেকে চশমা টা খুলে বাম হাতে রেখেছিলো তা হাত থেকে নিচে পরে যায়। শ্বাস আটকে গিয়ে কথা বলাও বন্ধ হয়ে যায়। আদিবা এক দৌড়ে গিয়ে তার বাবাকে ধরে ফেলে। বাড়ির সবাই কে চিল্লিয়ে ডাক দিলে সবাই ছুটে আসে৷ তারপর অবস্থা বেশি খারাপ হয়ে গেলে বিল্লাল কে ইমারজেন্সি হস্পিটালে নিয়ে যাওয়া হয়। সায়নেরই হস্পিটালে নিয়ে যায়। সায়ন হয়তো তখন বাসায় ছিলো। আদিবা তখন সায়ন কে ফোন করে দ্রুত তার হস্পিটালে আসতে বলে৷ আর খবর শুনে সায়ন দ্রুত এসে পরে। আদিবা তো কেদে কেটে একাকার। তারপরেই দোলা কে ফোন করে। দোলা শিউলি কে বাসায় রেখে সিয়া কে নিয়ে দ্রুত বাড়ি থেকে বের হয়ে পরে। বেশ সময় পর দোলা & সিয়া গিয়ে দেখে আদিবা হস্পিটালের ভেতরে তার বাবার হাত ধরে বসে আছে। কাদছে। দোলা আর সিয়ার ভেতরে যেতেই সায়নের চোখে পরে।

দোলা;; সায়ন, বিল্লাল কেমন আছে?

সায়ন;; আন্টি আসলে অতিরিক্ত প্রেসার পরেছে। অর্থাৎ উনি হয়তো হুট করেই বেশ শকিং একটা কিছু শুনেছেন তাই ধকল টা সামলাতে না পেরে বুকে চাপ দিয়ে উঠেছে। তবে ভাগ্য ভালো যে ভাবি জলদি আমাকে ফোন করেছে। দেরি হয়ে গেলে স্ট্রোক করার চান্স ছিলো অনেক বেশি। তবে এখন সব নরমাল আছে।

দোলা;; যাক বাঁচলাম।

দোলা এই বলেই ভেতরে চলে গেলো। আদিবা বাইরে এসে পরে। সিয়া কে দেখে বাইরে দাঁড়িয়ে আছে। তবে সিয়ার আদিবা কে বেশি একটা সুবিধের মনে হলো না। আদিবা সায়ন আর সিয়ার দিকে এক নজর তাকিয়ে সেখান থেকে চলে আসে৷ আর দোলা ভেতরে গিয়ে বিল্লালের পাশে বসে পরে।

দোলা;; বিল্লাল ঠিক আছো? হঠাৎ কি হয়েছিলো তোমার?

বিল্লাল;; ভাবি তুমি আমার কাছ থেকে এত্তো বড়ো কথা টা কি করে লুকাতে পারলে? আমার কি এই ব্যাপার টা শোনার মতোও কোন অধিকার ছিলো না।

দোলা;; কি বলছো এইসব। আমি কিছুই বুঝতে পারছি না।

বিল্লাল;; ভাইকে সাগর মেরেছে।

দোলা কিছুটা হকচকিয়ে যায় বিল্লালের এমন কথায়। দোলা এখন এটাই ভাবছে যে বিল্লাল এই কথা কীভাবে জানতে পারলো।

বিল্লাল;; কি ভাবছো ভাবি আমি কি করে জানতে পারলাম। পেরেছি কোন এক না এক ভাবে। আর কতো, আর কতো লুকাবে। সত্য একদিন না একদিন তো সামনে আসারই ছিলো।

দোলা;; বিল্লাল!

বিল্লাল;; আমি জানি এত্তো পুরনো কেস কেউ ফাইল করবে না আর যেখানে সাগর চৌধুরীর মতো একজন সেখানে তো কথাই নেই। আমি আজকেই ওই লোকের সাথে সব কাজ বন্ধ করে দিবো।

দোলা;; এখন এইসব মাথা থেকে বাদ দিয়ে রেস্ট নাও। বেশি চিন্তা করো না এতে শরীর খারাপ তোমারই হবে। বাদ দাও। আমি চাই না আগের ইতিহাস পুনরায় ঘটুক।

এই বলেই দোলা বের হয়ে এসে পরে। আর ওদিকে সিয়া আদিবার কাছে যায়। গিয়ে দেখে আদিবা ফোনে কথা বলছে। সিয়াকে দেখে আদিবা ফোন রেখে দেয়।

সিয়া;; তুই চাচ্চু কে সব বলে দিয়েছিস তাই না?

আদিবা;; হ্যাঁ।

সিয়া;; যাক, একদিক দিয়ে ভালোই হয়েছে।

আদিবা;; অর্নীল ভাইয়ের সাথে তোর কথা হয়েছে?

সিয়া;; বেশ কয়েকদিন যাবত সবকিছুই বন্ধ।

আদিবা;; হুমম। বাসায় নানু হয়তো একা তুই জেঠিমা কে নিয়ে চলে যা। সায়ন আর আমি বাবাকে বাড়ি পৌঁছে দিবো।

সিয়া;; হুমম।

সিয়া আর দোলা প্রায় ঘন্টা খানিকের মতো হস্পিটালে থেকে তারপর এসে পরে। আদিবা সেইদিন আর তার শশুড় বাড়িতে যায় না। সেইদিন তার বাবার সাথে বাড়িতেই থেকে যায়।


এভাবেই সময় যাচ্ছে, দিন যাচ্ছে। একটা সময় সায়নের সাথেই সিয়ার বিয়ের কথা পাকাপুক্ত হয়ে যায়। সবাই বেশ খুশি। কেউ কেউ প্রকৃতি পক্ষেই খুশি আবার কেউ কেউ শুধু অভিনয় মাত্র। সায়নের পরিবার সত্যিই খুব ভালো। সায়ন নিজেও অনেক বেশি খুশি। তবে আদিবা বেশ নারাজ। সে সিয়াকে বুঝিয়েও কিচ্ছুই করতে পারছে না। আর সিয়া যে এইসব কিছু ইচ্ছে করে করছে তা কিন্তু মোটেও না। এক প্রকার বাধ্য হয়েই তাকে এই বিয়েতে মত দিতে হয়েছে।

সায়ন আর সিয়ার বিয়ে ঠিক হয়েছে। আজ থেকে শুরু করে ঠিক তিন দিন পর সিয়ার বিয়ে। সিয়া তার কলেজেও কাউকেই জানায় নি বিয়ের ব্যাপারে। একদিন সিয়া বাইরে গিয়েছিলো কিছু কাজে। সেখানে সে অর্নীল কে দেখে। আর দেখা মাত্রই তড়িঘড়ি করে সেই স্থান ত্যাগ করে। বাসায় এসে পরে সে। প্রায় ৭-৮ দিন পর অর্নীল কে দেখেছে সিয়া। রুমে ছুটে গিয়ে দরজা আটকে দিয়ে মুখ দুই হাত দিয়ে চেপে ধরে ঢুকরে কেদে ওঠে।


অর্নীল তার বাসায় গেলে সাগর চৌধুরী আজ সোজা অর্নীলের সামনে এসে দাঁড়িয়ে পরে। অর্নীল এড়িয়ে চলে যেতে ধরে কিন্তু সাগর চৌধুরী আটকিয়ে দেয়।

সাগর;; অর্নীল আজ তুমি আমার কথা না শুনে যেতে পারবেই না। খুব গুরুত্বপূর্ণ কথা আছে।

অর্নীল;; জলদি বলো।

সাগর;; তোমাকে দেশের বাইরে যেতে হবে।

অর্নীল;; মানে?

সাগর;; মানে কিছু কাজের জন্য দেশের বাইরে যেতে হবে তোমাকে। আর এছাড়াও তুমি অনেক দিন যাবত যেতে চাইছিলে আমিই যেতে দিচ্ছিলাম না। তার ওপর তোমার কাজের চাপ ছিলো বেশি। কিন্তু এখন তো সব নরমাল। তাই বলছি যে এখন তুমি চলে যাও।

অর্নীল;; হুম ভেবে বলবো।

সাগর;; ভেবে বলার আর কি আছে। চলে যাও।

অর্নীল আর কিছু না বলেই ঘরে চলে যায়। মাঝখানে একদিন চলে যায়। বিয়ের বাকি রইলো আর মাত্র দুইদিন। আর এদিকে যেনো সাগর চৌধুরী অর্নীল কে বাইরে পাঠানোর জন্য একেবারে উঠে পরে লেগেছে। অর্নীলের সন্দেহ হয়। কিন্তু এছাড়াও অর্নীলেরও অনেক দিন যাবত বাইরে যাওয়ার প্ল্যান ছিলো। পাসপোর্ট-ভিসা সবই রেডি, অর্নীলও ভেবে নিলো যে সে যাবে।


এখন রাত, অর্নীল বেডে উপুড় হয়ে শুয়ে আছে। ফোন ঘাটছিলো, ঘাটছিলো বলতে ফোনে সিয়ার ছবি দেখছিলো। কিছু সময় পর উঠে গিয়ে ছাদে চলে যায়। ভারি ভারি কদম ফেলে ছাদে যাচ্ছে। নীরবতার মাঝে শব্দ গুলো যেনো সুস্পষ্ট। ছাদে গিয়ে রেলিং ধরে দাঁড়ায়। শূন্য চোখে তাকিয়ে আছে। সামনে হাজার হাজার সুউচ্চ বিল্ডিং৷ রাতের আধারে নানাবিধ আলো ফুটে ওঠেছে সেগুলোতে। হঠাৎ অর্নীল সিগারেট জ্বালিয়ে নেয়। অন্ধকারে সাদা ধুয়া গুলো শূন্যে মিলিয়ে যাচ্ছে। কয়েক পাফ নিতেই সিগারেটের আগুন টা নিভিয়ে দিলো। কেন যেনো মনও সায় দিচ্ছে না খেতে। সিয়া যে তার সাথে এভাবে সব কিছু হুট করেই বন্ধ করে দিবে তা অর্নীল ভাবেই নি। শুধু নিজের বাবার খুনি কে তা জানতে পেরে কথা বন্ধ করে দিয়েছে নাকি এর পেছনে আরো অন্য কোন কারণ রয়েছে এটাই ভাবছে অর্নীল। না সিয়া তাকে সব ক্লিয়ারলি জানাচ্ছে আর না নিজে জানতে পারছে। কেননা সিয়া সব স্কোপ অফ করে দিয়েছে। অর্নীল ডিসাইড করে নিলো সে আর তার বাবার সাথে আর থাকবে না। কারণ এখানে থাকলে সে ধীরে ধীরে পাগল হয়ে যাবে। দূরে চলে যাবে এখান থেকে। কাল ১২ঃ৩০ টায় অর্নীলের সিঙ্গাপুর যাওয়ার ফ্লাইট আছে। অর্নীল ভেবে নিয়েছে কিছুদিন বাইরে থেকে আসবে তারপর বাকি সব হ্যান্ডেল করবে। ঘন্টা খানিকের মতো ছাদের ওপরে থেকে নিচে নেমে আসে। সারারাত জেগে ভোরের দিকে অর্নীলের চোখ লেগে আসে। অফিসে যাবে না। প্রায় সকাল এগারোটার দিকে ফোনের কর্কশ আওয়াজে অর্নীলের ঘুম ভেঙে যায়। চুল গুলো হাত দিয়ে ঠিক করতে করতে ফোন ধরে। নাম্বার না দেখেই রিসিভ করেছে। গভীর কন্ঠে বলে….

অর্নীল;; হ্যালো।

জাবেদ;; হে অর্নীল কেমন আছো?

অর্নীল;; ওহ জাবেদ, হ্যাঁ ভালো আছি। তুমি কেমন আছো?

জাবের;; আরে আমি কি এই সময়ে ভালো না থেকে থাকতে পারি বলো।

অর্নীল;; এতো খুশি ব্যাপার কি, বাবা-টাবা হবে নাকি?

জাবেদ;; আরে না। সায়ন মানে আমার ভাই আর কি ওর বিয়ে ঠিক।

অর্নীল;; ওহহ আচ্ছা যাক ভালোই হলো।

জাবেদ;; শুনো অর্নীল আগামীকাল বিয়ে বুঝলে৷ আর তোমাকে আসতে হবে মানে আসতেই হবে।

অর্নীল;; আব… জাবেদ আ”ম সো সরি বাট আমি সিঙ্গাপুর যাচ্ছি। আজ সাড়ে বারো টায় আমার ফ্লাইট।

জাবেদ;; কি বলো! আরে ক্যান্সেল করে দাও। কিছুদন পর যাও।

অর্নীল;; সরি ইয়ার, পারবো না। আমাকে যেতেই হবে। আর সমস্যা নেই সবাই তো আছেঅ, ইনজয় ম্যান৷

জাবেদ;; তার মানে আসনে না।

অর্নীল;; না আসতে পারলেও ফোন তো আছে। ভিডিও কল দিও দেখবো।

জাবেদ;; ধুর সেটা হয়।

অর্নীল;; আচ্ছা আমার কথা ছাড়ো তুমি বলো কেমন আছো আদিবা, তোমার বাবা-মা সবাই কেমন আছে?

জাবেদ;; হ্যাঁ সবাই অনেক ভালো।

অর্নীল;; আর সিয়া কেমন আছে?

জাবেদ;; আরে ও আবার ভালো থাকবে না। ওর ই তো দিন।

অর্নীল;; মানে?

জাবেদ;; আরে মানে সায়নের সাথে তো সিয়ার বিয়ে ঠিক হয়েছে। ওদের বিয়ে হচ্ছে।

জাবেদের কথায় অর্নীল যেনো আকাশ থেকে পরলো। তড়িঘড়ি করে বিছানা থেকে নেমে পরে। পুরো ব্ল্যাংক হয়ে গেছে সব কিছু। মাথা হ্যাং মেরে গেছে। অর্নীল কয়েক সেকেন্ড চোখ বন্ধ করে রেখে আবার খুলে। বিছানার সাইডে বসে হাত দিয়ে কপাল চেপে ধরে। চোখ-মুখ কেমন মূহুর্তেই লাল বর্ণ ধারণ করে ফেলেছে।

জাবেদ;; অর্নীল, অর্নীল! হ্যালো অর্নীল।

অর্নীল;; হ্য হ্যাঁ শুনছি বলো।

জাবেদ;; কি হয়েছে?

অর্নীল;; কিছু না। বিয়ে কবে?

জাবেদ;; বিয়ে আগামীকাল।

অর্নীল;; জাবেদ, সরি টু সে বাট এই বিয়ে হবে না, হতে পারে না।

জাবেদ;; মানে বুঝলাম না।

অর্নীল;; বুঝে যাবে।

এই বলেই অর্নীল ফোন কেটে দেয়। কিন্ত জাবেদের মাথায় কিছুই ঢুকে না। কোন রকমে ফ্রেশ হয়ে গায়ের ওপর জেকেট টা জড়াতে জড়াতে নিচে নেমে আসে। হলরুমে সাগর সার্ভেন্ট দের দিয়ে টেবিলে খাবার সাজাচ্ছিলো তখনই দেখে অর্নীল পারছে না শুধু দৌড় দিতে এতো দ্রুত হাটছে।

সাগর;; অর্নীল কোথায় যাচ্ছো? খেয়ে নাও কিছু।

অর্নীল;; ক্ষুদা আমার মরে গিয়েছে। And the flight is cancel, I”m not going to Singapore..

সাগর;; কিন্তু কেনো?

অর্নীল;; বিয়ে যে থামাতে হবে।

সাগর;; বিয়ে!

অর্নীল;; Don’t act like an innocent baba… তুমি সব জানো রাইট, আর সব জেনে বুঝেই আমাকে বাইরে পাঠাতে চাইছিলে। যেনো এদিকে সিয়ার বিয়ে হয়ে যায় আর আমি টেরও না পাই। সন্দেহ আগে থেকেই ছিলো আমার তোমার ওপরে। কিন্তু মুখ ফুটে কিছু বলি নি। এখন আমিও দেখবো যে সিয়ার বিয়ে অন্য জায়গায় কীভাবে হয়। গেট রেডি সিয়াকে নিজের ছেলের বউ হিসেবে দেখার জন্য।

এই বলেই অর্নীল বের হয়ে পরে। আসলে ঠিকই। নিজের কোন এক গার্ড কে দিয়ে সাগর চৌধুরী খোঁজ নেওয়ায়। আর পরে শুনতে পারে যে সিয়ার বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে ডক্টর সায়নের সাথে। আর অর্নীল যেনো ঝামেলা না করে তার জন্যই তাকে বাইরে পাঠাতে চেয়েছিলো। কিন্তু সব প্ল্যান জলে গেলো। অর্নীল সবকিছ জেনে গেছে। আর জাবেদ অর্নীল কে সব বলে দিয়েছে কেননা জাবেদ জানে না যে অর্নীল আর সিয়া একে ওপর কে অনেক ভালোবাসে। তা না হলে হয়তো জাবেদ সায়নের সাথে সিয়ার বিয়ের আলাপ উঠতেই দিতো না। জাবেদ অর্নীল কে বলেও দিয়েছে সব না জেনেই।
আর ওদিকে বিয়ের সব কেনাকাটা শেষ, সব আয়োজন করা শেষ। তবে সবাই ঠিক করেছে যে বিয়ে টা হবে ঘরোয়া ভাবেই। এটা দোলা চায় আর সাথে বাকিরাও। আর আদিবা তো সিয়ার থেকে ফুলে রয়েছে। সিয়া যেনো এক জলজ্যান্ত কাঠের পুতুল হয়ে গেছে। কিছু বলে না, হাসে না। শুধু ফ্যাকাশে মুখ করে তাকিয়ে থাকে। এই ব্যাপার টা আদিবা, দোলা সবাই খেয়াল করেছে কিন্তু করার যে এখন কিছুই নেই। সিয়া শুধু সবার আড়ালে নিজের চোখের পানি ফেলে। সে তো ভেবেই বসেছে যে তার বিয়ে ঠিক। কাল সকালে সূর্য ওঠার সাথে সাথে বিয়ের সানাই বেজে যাবে আর হয়তো তার কিছুক্ষন বাদেই হয়ে যাবে সিয়া অন্য কারো। আচ্ছা অর্নীল কি এইসব কিছু জানে? দিয়া মাঝে মাঝে এটাই ভাবে। এভাবে দেখতে দেখতেই বেলা গড়িয়ে আবার রাতের আধার নেমে আসে।





চলবে~~




চলবে~~

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here