তোলপাড়
ইসরাত জাহান তানজিলা
পর্ব-১০
_____________________
রুদ্র অনেকক্ষণ শূন্য মস্তিষ্ক নিয়ে তাকিয়ে থাকলো।মুখ থেকে আপন শক্তিতে বেরিয়ে আসলো, “কি অদ্ভুত!” মাত্র ঘটে যাওয়া ঘটনা’টা যতই ভাবে ততই রুদ্র হতজ্ঞান হয়ে যায় আর বিস্ময় ভাব’টা প্রগাঢ় হয়।একটা মেয়ে পাবলিক প্লেসে এভাবে দৌড় দিলো আবার ফ্লাইং কিসও ছুঁড়ে মারলো।এতসব কাণ্ডর পর অরূণী’কে স্বাভাবিক ভাবেই রুদ্রের বিরক্ত লাগার কথা। কিন্তু আজ হঠাৎ স্বাভাবিক নিয়মের বেড়াজাল থেকে বেরিয়ে রুদ্রের হাসি পাচ্ছে।একটু হেসে আবার গম্ভীর হয়ে গেল রুদ্র।এই মেয়ের উদ্ভট সব কাণ্ডকীর্তিক জন্য রুদ্রের লাঁছিত হতে হয়েছে, এমনকি টাকা’টা পর্যন্ত ফেরত দিলো না! হাসা একদম সমীচীন নয়। রুদ্র মনের ভিতর অমর্ষ ভাব আনার চেষ্টা করল।
চারদিকের মানুষ অরূণীর দিকে সরু চোখে তাকায়। এমন যুবতী একটা মেয়ের দৌড় দৃষ্টিকটু বটে। কিন্তু অরূণীর ভিতর সব সময় একটা উপেক্ষাপূ্র্ণ ভাব।কে কি মনে করল এই নিয়ে যেন অরূণীর ভাবার সময় নেই। মানুষ তাঁর জীবনের অর্ধেক আনন্দ নষ্ট করে কে কি মনে করবে এই ভেবে।অরূণী পিছনে ফিরে দেখে রুদ্র নেই।শ্বাস কষ্টের রোগীর মত হাঁপাতে লাগলো অরূণী। তাইতির বাসায় গিয়ে ধপ করে সোফায় বসে পড়ল।তাইতি অবাক গলায় বলল, “কিরে কি হয়েছে?”
অরূণী হাসতে হাসতে যেন সোফা থেকে ফ্লোরে লুটিয়ে পড়বে।হাসির বেগে অরূণীর গলার স্বর অস্পষ্ট।অরূণীর কথা বুঝতে না পেরে তাইতি বলল, “পাঁচ মিনিট মন-প্রাণ উজাড় করে হেসে নে। তারপর বলিস কি হয়েছে।”
অরূণীর হাসি থামতে পাঁচ মিনিটেরও বেশি সময় লাগলো।বলল, “রুদ্র’কে দিয়েছি।”
অরূণীর গলায় এখনো হাসি লেগে আছে। তাইতি বেশ অবাক হয়ে আগ্রহী গলায় বলল, “দিয়েছিস মানে?কি দিয়েছিস?”
– “চুমু।”
তাইতি চমকালো ভীষণ।এই অরূণীর একদমই বিশ্বাস নেই। যে কোনো মুহূর্তে যে কোনো কাণ্ডই বাঁধিয়ে ফেলতে পারে।বিস্মিত আর সন্দিহান গলা তাইতির। যেন মহা আশ্চর্যজনক কিছু শুনেছে।
– “মানে কি বলছিস তুই?”
– “এত অবাক হওয়ার কি আছে? ফ্লাইং কিস দিয়েছি। কখনো সুযোগ হলে সত্যি সত্যি দিয়ে বসবো। তারপর পরেরদিন পত্র-পত্রিকায় দেখবি ‘দিনে দুপুরে রুদ্র নামক এক যুবক’কে জোর করে চুমু।’
অরূণী আবার হাসতে হাসতে গলে পড়ছে যেন। তাইতির চোখ চড়কগাছ। দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে বলল, “রুদ্র আকন দেখেছে তুই ফ্লাইং কিস ছুঁড়েছিস?”
অরূণী আত্মপ্রসাদপূর্ণ গলায় বলল, “হ্যাঁ দেখেছে।আমায় বলে এই মেয়ে দৌড়াবে না, দাঁড়াও।”
এই টুকু বলে থেমে চতুর ভাব নিয়ে অরূণী আবার বলল, “আমি কি বোকা নাকি যে দাঁড়াবো?আমায় সামনে পেলেই কয়েক ঘা মেরে বসবে।আমি কি বুঝিনা?”
– “তুই তো চড়ের ভয়ে তাঁর সামনেই যেতে পারিস না।তোর প্রেম হবে কীভাবে?কি সব পাগলামি করছিস তুই অরূণী!ছেলে’টা তোকে বেহায়া ভাবে না?”
– “মাঝে মাঝে একটু বেহায়া হতে ভালো লাগে।”
এর ভিতর তাইতির ভাবি সুমি নাস্তার ট্রে নিয়ে আসলো।রুদ্র’কে নিয়ে আলোচনা আর দীর্ঘায়িত হলো না। সুমি নাস্তার ট্রে’টা অরূণীর সামনে রেখে মিষ্টি হাসলো। জিজ্ঞেস করল, “নীড়া,রাকা ওঁরা আসে নি?”
তাইতি বলল, “এসে পড়বে এক্ষুণি।”
ওঁদের আসতে ঘন্টা দেড়েক লাগলো।সুমি ওঁদের সব বুঝিয়ে দিলো কীভাবে সাজাতে হবে। সারাদিন খুব আনন্দ-ফুর্তি’কে কাটলো। অনুষ্ঠান শেষ হতে রাত হয়ে গেল বেশ।অরূণীর বাসায় যেতে যেতে এগারো’টা বাজে। সূর্য তখনো বাসায় ফিরেনি। সূর্য বাসায় থাকলে চেঁচিয়ে বাসা মাথায় তুলতো।অরূণীর শরীরে ক্লান্তি ভর করেছে। বিছানায় গা এলিয়ে আবার সেই সিম’টা অন করলো। রুদ্রের কাছে ফোন করলো। রুদ্র ফিজিক্সের জটিল জটিল কষে তখন ক্লান্ত। কিরণের দিকে তাকিয়ে মহা বিরক্তি নিয়ে বলল, “পিওর সাবজেক্ট নিয়ে অনার্স করতে গিয়ে জীবন’টা বেদনার হয়ে গেল রে।”
এর ভিতর ফোনের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে রুদ্র নিয়মানুসারে অবাক হয়ে যায়। রুদ্রর কথার প্রত্যুত্তরে কিরণ হালকা গলায় বলল, “আমার তো ভালোই লাগে।”
কিরণের কথা রুদ্রের কান অবধি পৌঁছালো না বোধ হয়। রুদ্রের অবাক দৃষ্টি ফোনের দিকে। রুদ্র ফোন রিসিভ করে ছাদের দিকে হাঁটতে লাগলো।অরূণী প্রথমেই বলল, “কেমন লেগেছে?”
রুদ্র কথার আগাগোড়া না বুঝে জিজ্ঞেস করলো, “কি কেমন লেগেছে?”
অরূণীর কণ্ঠে হাসি, “কিস।”
রুদ্র কয়েক মুহূর্তের জন্য থমকে গেল।অরূণীর এমন অকুণ্ঠিত ভাব, সংশয় কিংবা সংকোচহীনতা রুদ্র’কে ক্রমে ক্রমে যেন বিস্ময়ের গভীরে প্রবেশ করায়। রুদ্র কিছু বলার আগেই অরূণী আবার বলে ওঠল, “দূর থেকে দিয়েছে তো ভালো নাও লাগতে পারে।কাছ থেকে দিলে বুঝতেন।”
অরূণীর প্রতি’টা কথায় রুদ্র স্তম্ভিত হয়ে যায়।রুদ্র সংশয়াপন্ন হয়ে বলল, “তোমার মাথায় কি কোনো সমস্যা আছে?”
– “উঁহু কখনো সমস্যা ছিলো না। কিন্তু আপনায় দেখার পর সমস্যা হয়েছে।মহা সমস্যা।প্রেম গত সমস্যা।”
অরূণী একটু থেমে আবার বলল, “আপনার গার্লফ্রেন্ড আছে?নিশ্চয়ই আছে। সিরিয়াস প্রেম না থাকলে ব্রেক আপ করে দেন।ওসব ফস্টিনষ্টি ভালো না।কালকেই ব্রেকাপ করে দিবেন ঠিকাছে?”
রুদ্র বুঝতে পারছে না কী উত্তর দেওয়া উচিত। খুব কঠিন উত্তর খুঁজছে। পরক্ষণে কি যেন ভেবে ঠাণ্ডা মেজাজে বলল, “আচ্ছা যাও কালই ব্রেকাপ করে দিবো।আমার সাথে দেখা করো একবার।”
– “এসব বলে ভুলিয়েভালিয়ে দেখা করাবেন।আর দেখা হলেই চড় মারবেন। আমি কি বুঝি না?”
অরূণী একটু থেমে আবার বলল, “আমি তো শ্যামলা। চেহারা কুৎসিত।আপনার চেহারা তো আপেলের মত।এজন্যই তো প্রেম করতে চাচ্ছেন না।”
রুদ্র’কে কথা বলার কোনো সুযোগ না দিয়ে অরূণী অনার্গল ভাবে কথা বলেই যাচ্ছে। রুদ্র নির্বাক শ্রোতা মত অবাক হয়ে শুনে যাচ্ছে। শুধু ভাবছে কত অদ্ভুত রকমের মানুষ আছে দুনিয়ায়।অরূণী কিছুক্ষণ পর থামলে রুদ্র কথা বলার সুযোগ পেলো একটু।বলল, “এই মেয়ে শুনো, কালকে দেখা করো আমার সাথে। মারবো না তোমায়। আচ্ছা..আচ্ছা তোমার পরিচয়’টা বলো আমায়।”
অরূণী গাঢ় গলায় বলল, “শ্বশুড় বাড়ি চিনেন না,এটা কোনো কথা?হবু বউয়ের পরিচয় জানেন না। লজ্জার ব্যাপার।”
তারপর আবার বলল, “ আমি জানি আপনি মারবেন।সাপের মাথায় হাত দিয়ে কসম করলেও আমি বিশ্বাস করবো না যে আপনি আমায় মারবেন না।”
রুদ্রের গলা খুব হিমশীতল। বলল, “আমার সাথে দেখা না করলে প্রেম করবে কীভাবে বলো তো?দেখা না হলে কি প্রেম হবে?”
– “কেন ফোনে ফোনে প্রেম হবে।আপনি আমায় আই লাভ ইউ বলবেন, উম্মাহ বলবেন।তাহলেই তো প্রেম হয়ে যাবে।”
রুদ্রর হাসি পাচ্ছে উদ্ভট সব কথা শুনে। সাবলীল ভাবে অবান্তর সব কথা বলে যাচ্ছে।যে সব কথা শুনলে কেউই না হেসে পারবে না। রুদ্র হাসলো আস্তে।হাসির শব্দ ফোনের ওপাশ অবধি পৌঁছালো না। অরূণী আবার বলল, “আপনার টাকা দেই না বলে আমায় পকেটমার ভেবেন না।প্রেম করলেই টাকা ফেরত।”
রুদ্র বলে, “আমি মোবাইলের প্রেমে বিশ্বাসী নয়। আমার সামনে আসো।”
– “আমার চড় খাওয়ানোর পরিকল্পনা না? আর ওই লোক আপনায় মার-টার দিয়েছে?”
আমজাদ হোসেনের কথা মনে পড়তেই রুদ্রের মেজাজ চট করে খারাপ হয়ে গল। তিক্ত মেজাজে বলল, “থাপ্পড় দিয়ে গাল লাল করে দিবো।”
– “এই থাপ্পড়ের জন্যই তো আমি মোবাইলের প্রেমে বিশ্বাসী।”
অরূণী থামলো। কিছুক্ষণ পর খুব সিরিয়াস গলায় বলল, “বলেন না আপনার গার্লফ্রেন্ড আছে?”
এর ভিতর অরূণীর ফোন বন্ধ হয়ে গেল। সারাদিন চার্জ দেওয়া হয়নি ফোনে। ফোন বন্ধ হওয়ার সাথে সাথে কারেন্ট’টাও চলে গেলে।একেই বলে দুর্ভাগ্য। রুদ্র ফোন হাতে দাঁড়িয়ে রইল।কি এক অদ্ভুত প্রাণীর পাল্লায় পড়ে রুদ্রের জীবন ভয়ংকর রকমের অদ্ভুত হয়ে ওঠছে। পৃথিবী’তে অদ্ভুত শব্দ’টা যেন অরূণীর কারণেই সৃষ্টি হয়েছে। রুদ্র ঠিক করলো টাকার আর দরকার নেই।অরূণীর ফোন রিসিভ করবে না আর নম্বর ফোন নম্বর বদলে ফেলবে।যেই ভাবা সেই কাজ। পরেরদিন রুদ্র সিম কার্ড বদলে ফেলল। কিরণ যে বিরক্ত হলো তাতে। বলল, “ভাই বিশ্বাস কর মেয়ে’টা কে আমার এত ভালো লেগেছে। এমন মেয়ে ভালো না লেগে পারে। এই মেয়ের চঞ্চলতায় যে কোনো পুরুষ ঘায়েল হতে বাধ্য।আর তুই কি-না সিম কার্ড বদলে ফেললি?”
রুদ্র নির্লিপ্ত গলায় বলল, “মেয়েলি ব্যাপার-স্যাপারে আগ্রহ খুঁজে পাই না এখন আর।”
রুদ্র একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে উদাস ভঙ্গিতে বসে রইলো।কি এক স্মৃতিচারণায় ব্যস্ত হয়ে গেল। অতীতের স্মৃতি জানালায় কষ্ট গুলো কড়া নাড়ছে।
_____________
পরের দিন বিকাল বেলা অরূণীর টিচার আসে।দেখতে খাটো, চুল গুলো কোঁকড়ানো,চোখে মোটা ফ্রেমের চশমা। চেহারায় গাম্ভীর্য ভাব। চশমার কারণে গাম্ভীর্য ভাব’টা যেন আরো গাঢ় হয়েছে। মুখে মেধাবী মেধাবী একটা ছাপ আছে। অরূণী জড়সড় হয়ে বসে আছে তাঁর সামনে। সারা দুপুর গুগলে শিক্ষক তাড়ানোর উপায় খুঁজেছে। কিন্তু ব্যর্থ হলো। গুগল’টা যেন দিন দিন অরূণীর কাছে অকেজো হয়ে ওঠছে।অরূণীর চোখে-মুখের অবস্থা সঙ্গিন,মনে মনে তীব্র অনিচ্ছা। সাহেদ আহমেদ পাশে বসে আছে। মেধাবী মানুষ সহজেই সাহেদ আহমেদের প্রিয় হয়ে ওঠে। সাহেদ আহমেদ জিজ্ঞেস করল, “কি নাম তোমার?”
– “পিয়াস।”
সাহেদ আহমেদ কিছুক্ষণ খোশগল্প করলো। কিছুক্ষণ পর বলল, “আচ্ছা পড়া শুরু করো তুমি। আমি যাচ্ছি।”
সাহেদ আহমেদ চলে যাওয়ার পর পরই অরূণী ঠোঁট প্রশস্ত করে হেসে পিয়াসের দিকে তাকিয়ে অদ্ভুত এক ভঙ্গিতে বলল, “হায়! কোঁকড়া ভাইয়া।”
পিয়াস যেন অরূণীর কথা’টা বুঝলো না। ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে বলল, “কি?”
অরূণী হেসে বলল, “আপনার চুল গুলো খুব সুন্দর। আমার এক বান্ধবীরও এমন কোঁকড়া চুল।এমন চুল দেখলে আমার টানতে ইচ্ছে করে।আমি তো আমার সেই বান্ধবীর চুল টেনে ছিঁড়ে ফেলি মাঝে মাঝে।ম্যাগি নুডলস ডাকি ও’কে। আপনি তো আমার টিচার, আপনায় তো ওসব ডাকতে পারি না।”
অরূণীর আচরণে পিয়াস অবাক হলো। পিয়াস খুব চাপা স্বভাবের।মুখ দেখে বুঝার উপায় নেই যে অবাক হয়েছে।বলল, “আচ্ছা ওসব কথা রাখি। বই বের করো।”
অরূণী পদার্থ বিজ্ঞান দ্বিতীয় পত্র বই’টা বের করলো। অরূণী’কে একটা টপিক বুঝাতেই পুরো সময় পেরিয়ে গেল। তাও পড়া শেষে অরূণী বলল, “ভাইয়া কিছুই বুঝলাম না।”
পিয়াস তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকায়।বেশ বিরক্ত গলায় বলল, “বুঝো নি মানে?কি বুঝো নি?কোথায় বুঝো নি? এটা তো খুব সহজ পড়া।আমি কি তোমায় বুঝাতে পারছি না নাকি?”
অরূণী হতাশ গলায় বলল, “জানি না ভাইয়া।কোথায়ও কিছু বুঝতে পারছি না।”
পিয়াস আরো কিছুক্ষণ বুঝালো পড়া’টা। তাও বুঝতে পারলো না অরূণী।এমন গবেট ছাত্রী কারোই কাম্য নয়।পিয়াসের মতো মেধাবী ছাত্রের তো আরো বিতৃষ্ণা এমন স্টুডেন্টের প্রতি। পিয়াস যথারীতি হতাশ হয়ে যায়। অরূণী মনে মনে হাসছে।পড়া শেষে রুমে গিয়ে চাপিয়ে রাখা হাসি মুক্তি দেয়।যে ইচ্ছে করে পড়া বুঝেনা ,তাঁকে কীভাবে বুঝাবে পিয়াস?
দুই-তিন দিন ধরে রুদ্রের ফোন বন্ধ।অরূণীর মন জুড়ে উথাল পাতাল কষ্ট।আর এই দিকে পিয়াস কুলম্বের সূত্র আর ক্ষেত্রতত্ত্বের মতো পড়া তিন-চার দিন ধরে বুঝিয়ে যাচ্ছে। কিছুতেই কিছু বুঝতে পারছে না অরূণী। পিয়াসের চোখে-মুখে তীব্র বিরক্ত।অরূণী শুধু মেনিমুখো হয়ে বলে, “না বুঝলে কি করবো ভাইয়া?”
পিয়াস রাগ চাপিয়ে বলল, “কেন বুঝো না? আমি কি তোমায় বুঝাতে পারছি না?এটা আমার ফল্ট নাকি তোমার গোবরে ব্রেনের ফল্ট?”
অরূণীর সহজ স্বীকারোক্তি, “আমার ব্রেনের ফল্ট ভাইয়া।”
– “এত গুলো ক্লাস তুমি পেরিয়ে এসেছো কীভাবে এই মাথা নিয়ে?”
অরূণী কোনো উত্তর দেয় না। রুদ্রের ফোন বন্ধ এই চিন্তায় অরূণী অস্থির। সেখানে এসব কথা প্রচণ্ড তেতো মনে হচ্ছে। আরো চার-পাঁচ দিন ধরে এই পড়াই চলল। শেষে পিয়াস বিরক্ত হয়ে সূর্য’কে বলল বোধ হয়। একদিন সন্ধ্যায় সূর্য অরূণী’কে ডেকে বলল, “সমস্যা কি তোর?তুই না-কি পড়া বুঝিস না?”
অরূণী নিচু স্বরে বলল, “শিপন স্যারের পড়া বুঝি, নাহিদ স্যারের পড়া বুঝি।সবার পড়া বুঝি। কিন্তু পিয়াস ভাই অনেক ভালো করে পড়ানো সত্ত্বেও আমি বুঝি না পড়া।”
সূর্য গর্জে ওঠে, “ফাজলামি শুরু করেছিস তুই?টিচার বিদায় করার ফন্দি এঁটেছিস?”
সূর্যের এমন কর্কশ গলার রাগে অরূণীর চোখ বর্ষণমুখর হয়ে যায়।কপোল ছুঁয়ে দুই ফোঁটা অশ্রুজল গড়িয়ে গড়িয়ে পড়ল।
_______________
রুদ্রের সাথে কথা বলতে না পেরে অরূণী কেমন দিশেহারা হয়ে গেল। অরূণী সাহস সঞ্চয় করলো। তীব্র দু্ঃসাহস। কার্তিক কর্মকারের বাসায় যাবে। রুদ্র নামক এক শূন্যতায় ভুগছে অরূণী। রুদ্র চড়-থাপ্পড় যা দেওয়া দিক। তবুও যাবে রুদ্রের সামনে। সকাল বেলা কলেজের উদ্দেশ্যে বাসা থেকে হয়ে কলেজে না গিয়ে সোজা কার্তিক কর্মকারের বাসার। আশেপাশে তাকায় খুব সাবধানী চোখে। তারপর টুপ করে ওঠে পড়ে সিঁড়ি বেয়ে।অরূণীর পাঁজর কাঁপিয়ে ধ্বক ধ্বক করছে শুধু। শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থা। হাত-পা ঈষৎ কাঁপছে যেন। কাঁপা কাঁপা হাতে কলিং বেল বাজায়।ভিতর থেকে বলে, “দরজা খোলা।”
এত সব উত্তেজনায় অরূণী খেয়ালই করে নি যে দরজা খোলা। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকলো দরজার সামনে। ভিতরে ঢুকতে গিয়েও আবার পিছিয়ে যাচ্ছে। কয়েক মুহূর্ত পর সাহস করে ঢুকেই পড়ল।কিরণ রুমে। অরূণীর দিকে এক পলক তাকিয়ে গভীর রাতে দুঃস্বপ্ন দেখার ন্যায় হকচকিয়ে ওঠে। ঠিক দেখছে তো ও?নিজের চোখ’কে বিশ্বাস হচ্ছে না কিরণের। অরূণী আশেপাশে তাকিয়ে বলল, “রুদ্র আকন কোথায়?”
কিরণ বিস্ময়ে কথা বলতে পারছে না।এই মেয়েই কি রেস্টুরেন্টে বসে রুদ্রের কাছ থেকে টাকা ধার নিয়েছে? কেমন মেয়ে এটা?কি অদ্ভুত মেয়ে?রুমে ঢুকে পড়লো!এত সব বিম্ময়কর ভাবনা-চিন্তা কিরণের গলায় আস্ত হাত ঢুকিয়ে রেখেছে ফলস্বরুপ কিরণ কথা বলতে পারছে না যেন। শ্যেন দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল, “রুমে ঢুকে পড়লে?শরীরে কি কোনো ডর-ভয় নেই?আরে কি অদ্ভুত!কি বীভৎস।বের হও,বের হও।”
অরূণী সহজ গলায় বলল, “রুদ্র আকনের সাথে কথা বলে চলে যাবো।”
কিরণ প্রচণ্ড রেগে বলল, “রুদ্র বাসায় না।বের হও তুমি রুম থেকে।”
অরূণী পাল্টা মেজাজ দেখিয়ে বলল, “রাগ দেখাচ্ছেন কেন আপনি? রুদ্র আকনের ফোন নম্বর দেন।”
– “তুমি কি সেই মেয়ে যে রুদ্রের কাছ থেকে টাকা ধার নিয়েছো?তুমি আর একদিন এসেছিলা রুদ্রের ফোন নম্বরের জন্য।”
কিরণ একটু থেমে আবার বলল, “ সমস্যা কি তোমার? বের হও রুম থেকে।”
অরূণী জোর গলায় বলল, “ফোন নম্বর দেন। বের হয়ে যাবো।বেশি বাড়াবাড়ি করলে চেঁচাবো।”
অরূণী ওঁর স্কার্ফ থেকে একটা সেফটিপিন খুলে কিরণ কে দেখিয়ে বলল, “ফোন নম্বর দিবেন?না-কি পেট ফুটো করে দিবো?”
কিরণ বিস্ময়ে হতবাক! অরূণী আবার বলল, “চিৎকার করলে কি হবে বুঝতে পারছেন? আমি শুধু ফোন নম্বর’টা চেয়েছি। দিয়ে দিলেই তো হয়। ঝামেলা বাড়াচ্ছেন আপনি।”
সেফটিপিনের ভয় কিরণ পাচ্ছে না কিন্তু মেয়ে মানুষের সাথে ঝামেলা বড্ড বিপদজ্জনক ব্যাপার।তার ওপর চিৎকার চেঁচামেচির হুমকি দিচ্ছে। কিরণ ফোন নম্বর’টা দিয়ে দিলো।
(চলবে)