তোলপাড়
ইসরাত জাহান তানজিলা
পর্ব-২২
___________
জ্বরে অরূণীর হুঁশ নেই। রুদ্র ফোন রেখে বারান্দা থেকে রুমে এসে খাটের উপর বসে রইলো কিছুক্ষণ। অস্থিরতা কাজ করছে।কিরণ ঘুমাচ্ছে। রুদ্র আবার বারান্দায় যায়। চেয়ারে বসে সিগারেট ধরায়।লাবন্যের কথা মনে পড়ছে আজ ভীষণ।লাবন্যের কথা মনে পড়াতে এত অস্থির লাগছে না-কি অরূণীর কথা গুলো মনে তোলপাড়ের সৃষ্টি করছে? রুদ্র বুঝতে পারছে না ঠিক। চেয়ারে স্থির ভঙ্গিতে বসে চোখ বুঁজে ভাবছে আজ হঠাৎ কেন এমন হচ্ছে?যে ক্ষত শুকিয়ে দাগের সৃষ্টি হয়েছে সে ক্ষত নতুন করে জেগে ওঠছে কেন? সিগারেটের উচ্ছিষ্ট অংশ’টা মেঝেতে ফেলে আবার একটা সিগারেট ধরায় রুদ্র। নানান চিন্তা-ভাবনার ভিতর দিয়ে অন্য রকম একটা রাত কাটে রুদ্রের।কিছুটা যন্ত্রনা, কিছুটা নির্ঘুমতা।লাবন্যের সাথে সম্পর্কের ইতি ঘটার পর রাত গুলো কেমন বদলে গিয়েছিল রুদ্রের।বার বার ঘুম ভেঙ্গে যেত, কখনো বা ঘুম হতো না। হাজার রকমের যন্ত্রনাময় স্মৃতি রুদ্রকে এলোমেলো করে দিতো। সময়ের সাথে সাথে সব ঠিক হয়েও গিয়েছে। আজ আবার সব নড়বড়ে হয়ে গেল।
সকাল বেলা কিরণকে ঘুম থেকে ডেকে তুলে রুদ্র।এভাবে ডেকে তোলার কারণে কিরণ ঘাবড়ে যায়। ত্রাসিত হয়ে চোখ খুলে।কিরণ বিহ্বল হয়ে বলে, “কি?কী হয়েছে?”
রুদ্র হালকা হেসে বলল, “তেমন কিছু হয় নি।একটা গান শুনা।”
কোনো অঘটন হয় নি ভেবে কিরণ স্বস্তি পেলেও এভাবে ডেকে তোলার কারণে ক্ষুব্ধ হয়ে বলে, “তুই এভাবে ডেকে তুললি কেন আমারে? আর গান বলবো মানে? ইয়ার্কি মারিস?”
– “তুই তো ভালো গান করিস।ইয়ার্কি করলাম কোথায়?”
– “আমার গানের সুরকে তুই কুত্তার ঘেউ ঘেউ এর সাথে তুলনা করছিস। আমি কি ভুলে গেছি?”
রুদ্র কিরণের প্রশংসা করে বলল, “তুই তো খুব ভালো গান করিস।ওসব তো ইয়ার্কি করে বলেছি।গান বল দোস্ত।”
কিরণ সন্দিগ্ধ হয়ে তাকায়। রুদ্রের আচরণ বেখাপ্পা লাগছে। সন্দিহান হয়ে বলল, “হয়েছি কী তোর বল তো?”
রুদ্র টেবিলের উপর রাখা গিটার’টা কিরণের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, “গান শুরু কর। রোমান্টিক গান।এমন রোমান্টিক গান করবি যাতে আমার মন,প্রাণ,দেহে রোমান্টিকতা উপচে উপচে পড়ে।”
কিরণ চোখ বড় করে তাকিয়ে রইল। কিরণ কিছু বলতে গেলে রুদ্র খ্যাক করে ওঠে বলে, “কথা বাড়াবি না।গান বল।”
সকাল বেলা সুমধুর ঘুম ভাঙ্গিয়ে এমত কাণ্ড যথারীতি নির্যাতনের শামিল। মেজাজ চড়ে যাচ্ছে কিরণের। রুদ্র আবার গানের জন্য তাড়া দেয়।কিরণ বিরক্ত গলায় গিটারের টুংটাং শব্দের সাথে গান ধরে।গান শুরু করতেই সঞ্জিতা কর্মকার দরজার কাছ থেকে রুদ্রের নাম ধরে হাঁকে। গান আর শোনা হয় না। কিরণ স্বস্তি পায়।আবার শুয়ে পড়ে। সঞ্জিতা কর্মকারের হঠাৎ আগমনের কারণ ভাবতে ভাবতে দরজার কাছে যায় রুদ্র। রুদ্র’কে দেখেই সঞ্জিতা কর্মকার একটু হেসে পরক্ষণে গম্ভীর হয়ে বলল, “মাস হয়েছে পাঁচ-সাত দিন হয়ে গেছে।ভাড়া কোথায়?”
রুদ্র একটু লজ্জায় পড়ে। দুই দিন আগে কার্তিক কর্মকার বলেছিলো ভাড়ার কথা কিন্তু রুদ্রের মনে ছিলো। রুদ্র ভাড়া দিয়ে বিদায় করে সঞ্জিতা কর্মকারকে। কিরণ রওয়ানা দিচ্ছে যেন কোথায়। রুদ্র কিরণের দিকে তাকিয়ে বলে, “কোথায় যাচ্ছিস তুই?গানের কি হলো?”
কিরণ ব্যস্ত গলায় বলল, “রাখ তোর গান। পাঁচ মিনিটের মধ্যে যেতে বলেছে অফিস থেকে।অথচ গাড়ি দিয়ে সেখানে গেলেও বিশ মিনিট লাগবে।”
– “অফিস?কীসের অফিস?”
– “ওহে সুবোধ বালক হেড অফিস।গার্লফ্রেন্ডের অর্ডার বুঝলা এবার?”
রুদ্র বিমূঢ় হয়ে তাকিয়ে থাকে।কিরণ বের হওয়ার কিছুক্ষণ পর রুদ্রও বের হয় বাসা থেকে। অরূণী কে নিয়ে চিন্তা অস্থিমজ্জায় গেঁথে যাচ্ছে। অরূণীর রাতের বলা কথা গুলো টেপ রেকর্ডের মতো কানে বাজতে লাগলো। অদ্ভুত এক টান অনুভব হয় অরূণীর জন্য। রুদ্র ভালোবাসি,অরূণীর এই কথাটায় কি ছিলো রুদ্র জানে না। মনে হচ্ছে প্রগাঢ় কোনো নেশা ছিলো।যা চুম্বকের মত টানছে রুদ্র কে।অরূণীর জ্বর আসার কারণ গুলো ভেবে মনে মনে হাসছে রুদ্র।এত’টা পাগলামি একটা মানুষ কীভাবে করে?জ্বর আসার ব্যাপার’টা আসলেই অদ্ভুত। রুদ্রের ইচ্ছে হচ্ছে অরূণী’কে একবার ফোন দিয়ে খোঁজ নিতে।পরক্ষণে কি ভেবে যেন দিলো না।
________________
বিকালের দিকে অরূণীর জ্বর কিছু’টা কমে।রাতে রুদ্র’কে বলা কথা গুলো ভেবে অরূণী লজ্জা পাচ্ছে এখন। রুদ্র দেখা করতে বলল কেন? রুদ্র কে জড়িয়ে ধরার অনুভূতির কথা অরূণীর ভুলতে পারছে না।অরূণী শিউরে উঠছে বার বার। সর্বাঙ্গে কেঁপে উঠছে।অরূণী নিজ থেকে ফোন দিলো।বলল, “দেখা করবেন না?”
রুদ্র হাসে।বলে, “তুমি সুস্থ হয়েছো?আনারস নিয়ে দেখতে আসবো? দুনিয়াতে এত খাবার থাকতে আনারসের কথা কেন বলেছো?”
রুদ্র শব্দ করে হাসে কথাটা বলে।অরূণী অভিমানী হয়ে ওঠে, “একবার ফোন দিয়ে জিজ্ঞেসও করেন নি সুস্থ হয়েছি কি-না?জ্বর তো আপনার জন্যই আসে।”
অরূণী একটু থেমে আবার বলল, “হ্যাঁ আমার আনারস ই ভালো লাগে।”
– “ভেবেছিলাম ফোন দিবো। তারপর আর দেওয়া হয় নি।”
রুদ্রের আচরণের এত পরিবর্তন।অরূণীর মনে বিস্ময় ঢেউ খেলে। কিন্তু প্রকাশ করলো না। বলল, “আপনার ফোন দেওয়া উচিত ছিলো।যেহেতু এসবের জন্য আপনি দায়ী।”
– “আমি দায়ী? তুমি যেসব কাজ করো তাতে তোমায় থাপ্পড় দেওয়া উচিত!আলসেমি করে দেওয়া হয় না।”
রুদ্র এই বলে থেমে আবার জিজ্ঞেস করে, “জ্বর কমেছে তোমার?”
– “কমেছে একটু।দেখা করবেন না?”
– “এরকম আজব জ্বর তোমার ছাড়া আর বোধ হয় কারো হয় নি।”
– “এরকম ভালো তো কেউ বাসে নি।”
– “এত ভালোবাসা আসে কোত্থেকে তোমার? ইঁচড়ে পাকা মেয়ে।”
অরূণী হাসে।বলে, “আপনার কথা গুলো মিষ্টি লাগছে আজ খুব।”
কিছুক্ষণ পর আবার বলল, “দেখা করবেন না?কতবার জিজ্ঞেস করেছি, উত্তর দিচ্ছেন না।”
– “করবো দেখা।জড়িয়ো ধরো না আবার।”
অরূণী লজ্জা পেলো কিঞ্চিৎ। রুদ্র আবার বলল, “যে রেস্টুরেন্টে প্রথম দেখা হয়েছে সেই রেস্টুরেন্টে এসো। তুমি চাইলে আনারসও খাওয়াবো।”
অরূণীর খুশিতে আত্মহারা। বাঁধ ভাঙ্গা আনন্দ নিয়ে বলে, “আসছি, আসছি। আপনিও আসেন। তাড়াতাড়ি আসবেন কিন্তু।”
রুদ্র কে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে অরূণী ফোন রেখে দেয়। রুদ্র দেখা করতে বলেছে এই আনন্দে পুলকিত হচ্ছে ক্রমশ। নিজেকে ধমকায়, বেশি আনন্দিত হওয়া যাবে না তাহলে আবার জ্বর আসবে।অরূণী কোনো রকম চুল গুলো বেঁধে বাসা থেকে বের হওয়ার সময় সেলিনা আহমেদের সামনে পড়ে।সেলিনা আহমেদের কঠিন গলা, “জ্বর নিয়ে কোথায় যাস তুই?এক পা ও বের হবি না।”
অরূণীর তর সইছে না।কখন বাসা থেকে বের হবে,কখন রেস্টুরেন্টে যাবে।অস্থির গলায় বলে, “আম্মা তাইতির কাছ থেকে নোট আনতে যাবো। জরুরি ব্যাপার বুঝলে?”
অরূণী বাসা থেকে বের হয়।সেই রেস্টুরেন্টে যায়। রুদ্র কেন দেখা করতে বললো?অরূণী দশ মিনিট ধরে বসে আছে রুদ্রের দেখা মিলছে না।অস্থির ভঙ্গিতে অপেক্ষা করতে লাগলো। রুদ্রের কাছে ফোন দেয়। ফোন তুলছে না। হঠাৎ অরূণীর মনে হলো রুদ্র কী ও’কে বোকা বানালো?শোধ নিলো?এমনটাই হয়ত।অরূণীর সমস্ত রঙিন কল্পনা-ঝল্পনা বিবর্ণ হয়ে গেল। অরূণীর ধারণা মিথ্যে করে দিয়ে মিনিট সাতেক পর রুদ্র আসলো।অরূণীর বুকের ভিতর তোলপাড় শুরু হয়ে গেল।জ্বরের মাত্রাটা বাড়তে লাগলো যেন। লজ্জাও পাচ্ছে। অরূণী’কে দেখে হালকা হাসে রুদ্র। অরূণীর যে টেবিলে বসেছে সেদিকে এগিয়ে যেতে লাগলো। রুদ্রের আচরণ আর রুদ্র’কে সম্পূর্ণ আলাদা মনে হতে লাগলো অরূণীর।অরূণী ভেবেছিল রুদ্র ওঁর মুখোমুখি চেয়ারে বসবে। কিন্তু অরূণীর এই ধারণাও মিথ্যে করে দিয়ে রুদ্র অরূণীর পাশের চেয়ারে বসলো।অরূণীর হৃদস্পন্দন বাড়তে লাগলো অসম্ভব ভাবে।অরূণী মুখ অন্যদিকে ঘুরিয়ে ফেলল। রুদ্র বলল, “কী হলো ওইদিকে তাকিয়ে আছো কেন?আমার দিকে তাকাও।”
অরূণী তাকায় না। রুদ্র বলল, “কী খাবে অর্ডার করো।আনারস খাবে?”
বলেই হেসে ফেলল রুদ্র।অরূণীও রুদ্রের দিকে তাকিয়ে লজ্জামাখা একটা হাসি দিলো।জ্বরের কারণে ফ্যাকাশে হয়ে গেছে অরূণীর মুখ’টা।চোখ দুটোও ক্লান্ত। রুদ্র ওয়েটারকে ডেকে খাবার অর্ডার করে।অরূণী মাথা নিচু করে বিড়বিড় করে বলল, “আপনার সামনে লজ্জা করছে আমার আজ।”
রুদ্র অরূণীর দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলে, “রাস্তা ঘাটে জড়িয়ে ধরতে লজ্জা করে না?কল্পনাতে ওষ্ঠ ছুঁতে লজ্জা করে না? রুদ্র ভালোবাসি এসব বলতে লজ্জা করে না?”
রুদ্রের কথা গুলো অরূণীর শিরায়-উপশিরায় শিহরণ জাগাচ্ছে। রুদ্রের এত ভালো ব্যবহার অস্বাভাবিক লাগছে অরূণীর কাছে। অরূণী কোনো উত্তর দিতে পারলো না উত্তেজনায়।ওয়েটার খাবার দিয়ে গেল অরূণীর খেয়াল নেই সেদিকে। রুদ্র বলল, “লজ্জা অনেক পেয়েছো আর পেতে হবে না।খাওয়া শুরু করো। আনারসও খাওয়াবো।”
অরূণী খাবার নাড়াচাড়া করছে রুদ্র। অরূণীর বা হাত’টা টেবিলের ওপর। রুদ্র আলতো করে অরূণীর হাতের উপর হাত রাখলো।উন্মনা হয়ে থাকার কারণে অরূণী হকচকিয়ে ওঠে তাকালো। রুদ্র অরূণীর হাত’টা শক্ত করে চেপে ধরে স্বাভাবিক গলায় বলল, “খাচ্ছো না কেন?”
(চলবে)